#প্রেম_প্রেম_পায়
#স্বর্ণালী_সন্ধ্যা
পর্ব চব্বিশ
২৪.
‘বাহ আপনি তো খুব সুন্দর নাটক করেন!’
রাফিয়া পাশে তাকিয়ে দেখলো সামির তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। রাফিয়া সামিরের দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে ভাব নিয়ে বলল,
‘তা একটু পারি।’
সামির একই দৃষ্টি নিয়ে বলল,
‘তা তো দেখলাম। আমার বোন কে কতো সুন্দর সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যা বলে দিলেন’
রাফিয়া এবার সামিরের দিকে তাকিয়ে তেজ নিয়ে কণ্ঠ নিচু রেখে বলল,
‘আপনার বোন হচ্ছে নি’ব্বি টাইপ।আমার ভাইকে দেখে লাড্ডু ফুটছে তার মনে।আপনি আপনার বোনকে তার থেকে ১৮/১৯ বছরের বড় ছেলের সাথে প্রেম করতে দিবেন? আজব পাবলিক!’
বলে সে অন্যদিকে চলে গেল। সামির হা হয়ে গেল। মেয়েটা তাকে এভাবে ভাব দেখালো। দেখে নিবে সে!
আলাপ আলোচনার একপর্যায়ে ফারদিন আহমেদ বললেন,
‘এবার আংটি পড়ানো যাক মেয়েকে?’
আসিফ ইসলাম বিনয়ী ভাবে বললেন,
‘জি জি।’
ফারদিন আহমেদ তার স্ত্রী কে বললেন,
‘তুমি পড়িয়ে দাও আংটি।’
আখি বেগম এগিয়ে এলেন অপরাজিতার দিকে। অপরাজিতা মাথা নিচু করে বসে আছে। তার কেন যেন খুব লজ্জা লাগছে। বিয়ের বষয়ে সব মেয়েরাই এভাবে লজ্জা পায় নাকি!
আখি বেগম অপরাজিতার বাম হাতের শাহাদাত আঙ্গুলে আংটি টা পড়িয়ে দিলেন। অপরাজিতা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো হাতের দিকে। আখি বেগম অপরাজিতার মনোভাব বুঝে তার কাছে গিয়ে আস্তে করে বলল,
‘অনামিকা আঙ্গুল আমার ছেলের জন্য ছেড়ে দিলাম’
ফায়াদ পাশ থেকে মায়ের কথা শুনে নিশব্দে হেসে দিল। অপরাজিতা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল।আখি বেগম মুচকি হেসে অপরাজিতা কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
‘আমার মেয়ে হওয়ার জন্য প্রস্তুত তো?’
অপরাজিতা আবেগে আপ্লুত হয়ে মাথা ঝাকিয়ে হ্যা বলল।
রামিসা বেগমের চোখে পানি চলে এলো এই মুহূর্ত দেখে।তার মেয়েটা ভালো ঘরে যাচ্ছে তাহলে। মায়ের মতো শাশুড়ী পাবে। চলে যাবে তাকে ছেড়ে। চোখ টলমল করে উঠলো তার। বোনের অবস্থা বুঝতে পেরে আমিনা কাধে হাত রেখে তাকে শান্তনা দিলেন।
আংটি পড়ানো শেষ হতে ফারদিন আহমেদ বললেন,
‘বাকি কথা আমরা বড়রা সারছি। ছোটদের এখানে কাজ নেই। তোমরা নাহয় ছাদে বা কোথাও গিয়ে আড্ডা দাও! কি বলেন আসিফ ভাই?’
আসিফ ইসলাম সম্মতি দিয়ে বললেন,
‘হ্যা এখানে থেকে ভালো লাগবে না তোমাদের। তোমরা ছাদে যাও। ছাদে বসার জায়গা আছে।আলোও আছে’
বড়দের কথা শুনে অপরাজিতা, ফায়াদ, ফারাজ, নীতি, সামির, রাফিয়া, সামিয়া,আবির,রিজু সবাই ছাদের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।সিড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে রাফিয়া সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ছোটদের ছাদে যেতে বলছে। আমরা না হয় যাচ্ছি কিন্তু ফায়াদ ভাই আর ফারাজ ভাই কোনদিক দিয়ে ছোট?’
তার কথা শুনে জোরে হেসে দিল নীতি আর অপরাজিতা। অপরাজিতা বলল,
‘তারা বড় বাচ্চা বুঝেছো রাফিয়া?’
নীতি হাসতে হাসতে বলল,
‘সিরিয়াসলি?’
রিজু বলল,
‘কুছ ভি?’
সামির বলল,
‘এই মেয়েগুলোর একটা টপিক পেলেই হইসে!’
অপরাজিতা সামিরকে দৌড়ানি দিতে গেলে ফায়াদ অপরাজিতার হাত ধরে ফেলল।শাসনের সুরে বলল,
‘শাড়ি পড়ে দৌড়াদৌড়ি করো কেন? ব্যথা পাবে তো।’
ফায়াদ এর কথা শুনে সবাই সমস্বরে বলে উঠলো,
‘ওওওওও ব্যথা পাবে তো!’
অপরাজিতা সবার রিয়েকশনে খানিক লজ্জা পেল। এত লজ্জা পাচ্ছে কেন সে?ফায়াদ ভ্রু কুচকে তাকালো তাদের দিকে।অপরাজিতা মিনমিন করে বলল,
‘আমার অভ্যাস আছে।’
ফায়াদ বাকিদের পাত্তা না দিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
‘থাকুক। দৌড়াবে না।’
বাকিটা সিড়ি সে হাত ধরেই উঠলো। হাত ছাড়লো না অপরাজিতার। অপরাজিতা হাতের দিকে তাকিয়েই সিড়ি বেয়ে উঠছে। ভালো লাগছে তার। ভীষণ ভালো লাগছে।
বাকিরা মিটমিট করে হাসছে তাদের দেখে।
‘ভাই একটা কথা ছিল।’
ফারদিন আহমেদ এর কথা শুনে আসিফ ইসলাম বললেন,
‘জি বলেন ভাই।’
রামিসা বেগম উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কি বলবে তা শুনার জন্য।
ফারদিন আহমেদ গলা ঝেড়ে বললেন,
‘আমি আর আমার স্ত্রী চাইছিলাম তাদের কবুল পড়িয়ে রাখতে।আপনি কি বলেন?’
আসিফ ইসলাম তা শুনে একটু ভেবে বললেন,
‘আমি আমার মেয়েকে এতো তাড়াতাড়ি বিদায় দিতে চাই না। আপনাকে তো বলেছিলাম ভার্সিটিতে চান্স পেলে তারপর ধুমধামে বিয়ে দিব আমার মেয়েকে আমি।’
আখি বেগম তা শুনে বলল,
‘ না না ভাই। অপরাজিতাকে আমরা এখনি নিয়ে যাবো না। শুধু আকদ টা করিয়ে রাখতে চাইছি।’
আসিফ ইসলাম ভাবনায় পড়ে গেলেন।রামিসা বেগম স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে সে কি বলবে তা শুনার জন্য।হঠাৎ এতো তাড়াতাড়ি করার কি আছে বুঝলেন না তিনি।
ফারদিন আহমেদ গলা খাকারি দিয়ে বললেন,
‘আসলে হয়েছে কি! ছেলে মেয়ে দুজনেই বড় হয়েছে।যেহেতু আংটি বদল হয়েছে তার মানে তারা একে অপরের সাথে কথা বলবে দেখা করবে। আমার স্ত্রী চাচ্ছিল সম্পর্ক টা হালাল হোক। তারা একে অপরের সাথে কথা বললে তা যেন হালাল থাকে। তাই এই চিন্তা করলো সে।’
আখি বেগম এবার বললেন,
‘আপনারা যখন মেয়ে উঠিয়ে দেবেন তখন ধুমধামেই নিয়ে যাবো। সে বিষয়ে চিন্তা করবেন না।’
অনেক কথাবার্তা হলো তাদের এ বিষয়ে।
ছাদে পৌছিয়ে ফায়াদ আর অপরাজিতাকে প্রাইভেসি দেওয়ার জন্য ফারাজ বাকিদের নিয়ে ছাদের অন্য সাইডে চলে গিয়েছে।
অন্য সাইডে গিয়ে দাড়াতেই সামিয়া ফারাজকে জিজ্ঞেস করলো,
‘আপনি আপু আর দুলাভাইকে ওখানে রেখে আসলেন কেন?’
ফারাজ বলল,
‘তাদের কথা আছে তাই’
সামিয়া এবার ন্যাকামি করে বলল,
‘কি কথা? আমিও শুনবো।’
সামিয়ার কথা শুনে রাফিয়া বিরবির করে বলল,
‘বল’দ’
সামির এসে সামিয়ার মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
‘বেশি কথা বললে নিচে পাঠায় দিব।চুপচাপ থাক!’
ফারাজ বাধা দিয়ে বলল,
‘আহা বাদ দাও ব্রো! বাচ্চা মানুষ। ‘
ফারাজের প্রতিবাদ দেখে সামিয়া যেন আবেগে আপ্লূত হয়ে গেল। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। ফারাজ অবশ্য খেয়াল করলো না। সে আশে পাশে তাকিয়ে দেখলো নীতি রেলিং এর কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। ফারাজ গিয়ে তার কাছে দাড়ালো। তা দেখে সামিয়ার ছোট মনে যেন কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এই বয়সের মেয়েগুলো এমনি। সবকিছুতে বেশি বেশি একদম!
ফারাজ গিয়ে নীতির পিছনে পকেটে হাত দিয়ে দাড়িয়ে
গলা খাকারি দিয়ে তার উপস্থিতি জানান দিল।নীতি পিছে তাকিয়ে ফারাজকে দেখে মুচকি হাসলো।ফারাজও পালটা হেসে নীতির পাশে দাড়ালো। দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘কেমন লাগছে?’
নীতি রেলিং এ ভর দিয়ে দাড়িয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘অনেক ভালো।বাতাসটা অনেক ভালো লাগছে।’
‘বাংলাদেশ কেমন লাগছে?’
নীতি এবার মাথা বাকিয়ে ফারাজের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলল,
‘ বাংলাদেশ কেমন লাগছে তা বলতে পারছি না তবে আপনার পরিবারটা অনেক সুন্দর। এতো ভালোবাসা পেলে যেকোনো জায়গাই ভালো লাগবে।’
তারপর একটু থেমে বলল,
‘থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ আমাকে সেখানে একা ফেলে না আসার জন্য।থ্যাংক ইউ আমাকে এতো সুন্দর মুহুর্ত গুলো দেওয়ার জন্য।’
নীতির ঠোঁটে হাসি কিন্তু চোখ গুলো টলমল করছে।মেয়েটা অল্পতেই গলে যায়। ফারাজ সে মুখখানার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘My pleasure dear’
সামিয়া তাদের দুজনকে কথা বলতে দেখে এতোক্ষন জললেও এখন সে দুঃখ পাচ্ছে৷ ছোট বয়সের আবেগ তারই বা কি দোষ।রাফিয়া তা দেখে ভেঙচি কেটে বলল,
‘এতোটুকু বয়সে এতো আবেগ আসে কিভাবে?তাও এতো বড় লোকের প্রতি!ঢং!’
রিজু রাফিয়া হাল্কা ধমকের সুরে বলল,
‘এরকম করছিস কেন? বাচ্চা মানুষ। বুঝাতে হবে ওদের। বয়সটাই এমন।যা সম্ভব না তা ওদের টানে বেশি।’
বলে সে গেলো সামিয়ার কাছে৷ মেয়েটা একা একা দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। রিজু গিয়ে বলল,
‘হেই আমি রিজু’
সামিয়া একবার তাকিয়ে আবার অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
‘হ্যালো ভাইয়া’
রিজু দেখলো সামিয়া ফারাজ এবং নীতির দিকে তাকিয়ে আছে। সে তাই এবার সোজা জিজ্ঞেস করলো,
‘তুমি ফারাজ ভাইকে পছন্দ করো?’
সামিয়া চমকে তাকালো।রিজু হেসে বলল,
‘ভয় পাবে না। আমি কিছু বলবো না কাউকে।’
সামিয়া লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গি করে বলল,
‘হুম’
রিজু ফাজলামো করে বলল,
‘এতো বড় কাউকে? ফারাজ ভাই তোমার থেকে ১৮/১৯ বছরের বড়।ভাবতে পারছো!তোমার বিয়ের বয়স হতে হতে তার চুল দাড়ি পাকা শুরু করে দিবে।’
সামিয়া অবাক হয়ে বলল,
‘কেনো, উনি তো অনেক সুন্দর। ‘
‘এখন সুন্দর। পরে আর থাকবে না। তখন তো সবাই বলবে সামিয়ার জামাই বুড়ো।’
সামিয়া ভাবনায় পরে গেল। রিজু বুঝলো কাজ হয়েছে তার কথায়। ফারাজের সৌন্দর্য দেখে সামিয়া আকর্ষিত হয়েছিল।সবই বয়সের দোষ।রিজু চোখের ইশারায় রাফিয়া কে বুঝালো,
‘দেখেছিয়া বুঝে গিয়েছে।’
রাফিয়া মিটমিট হাসছে।
————
ফায়াদ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অপরাজিতার দিকে। যার কারনে অপরাজিতা তাকাতেও পারছে না। অন্যদিকে তাকাচ্ছে বারবার। এক পর্যায়ে অপরাজিতা বিরক্ত নিয়ে ফায়াদের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?’
চোখে চোখ পড়তে আবারো চোখ সরিয়ে ফেলল সে।লজ্জা লাগছে অপরাজিতার খুব অথচ সে ভাবতো তার লজ্জা নেই। তা দেখে ফায়াদ বাকা হাসলো।বলল,
‘মেয়ে দেখতে এসেছি তো।’
অপরাজিতা মাথা নিচু করেই শাড়ির আচল প্যাচাতে প্যাচাতে মিন মিন বলল,
‘তাই বলে এভাবে তাকিয়ে থাকবেন। আমি তো আপনাকে দেখতে পারছি না। আমার লজ্জা করে!’
ফায়াদ অধর কোণে হাসি রেখেই অপরাজিতা হাত থেকে আচল ছুটিয়ে তা ছেড়ে দিয়ে বলল,
‘তাকাও দেখি পারলে।’
ফায়াদের কথায় কি যেন একটা ছিল। অপরাজিতা ভাবলো তাকে কি চ্যালেঞ্জ করলো! এখন তো সে তাকাবেই!
মাথা তুলে তাকালো ফায়াদের দিকে। চোখে চোখ পড়ে গেল৷ ভিতরটা কেপে উঠলো। লজ্জাকে এবার আর চোখ সরাতে দিল না সে। ফায়াদ তা দেখে দুষ্ট হাসলো। অপরাজিতার চোখের দিকে তাকিয়ে এক কদম বাড়ালো সে। অপরাজিতা খানিকটা নড়ে উঠলো। আরো এক কদম বাড়াতেই অপরাজিতা এক কদম পিছাতে চাইলো। কিন্তু পারলো না। ফায়াদ তার কোমরে হাত দিয়ে তাকে এক কদম পিছানোর পরিবর্তে এক কদম নিজের দিকে নিয়ে এসে দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেলল।
অপরাজিতা খিচে চোখ বন্ধ করে ফেলল।ফায়াদের বুকে হাত দিয়ে নিজেকে ব্যালেন্স করলো।ফায়াদ এক হাতে অপরাজিতার কোমর ধরে আরেক হাত দিয়ে অপরাজিতা চুল গুলো গুছিয়ে দিয়ে গালে হাত বুলিয়ে বলল,
‘চোখ খুলো।’
অপরাজিতা চোখ বন্ধ করে না বোধক মাথা নাড়ালো।ফায়াদ রসিকতা করে বলল,
‘আমাকে দেখবে না?’
অপরাজিতা এবার ফায়াদের বুকে মাথা গুজে দিল। মুখ লুকিয়ে বলল,
‘এমন করেন কেন? লজ্জা পাচ্ছি তো’
ফায়াদ এবার শব্দ করে হেসে দিল।শব্দ করে হেসে অপরাজিতাকে জড়িয়ে ধরলো। অপরাজিতা সে হাসির শব্দ শুনে ফায়াদের বুকে চিমটি কাটলো। ফায়াদ অপরাজিতার হাত ধরে বলল,
‘চিমটি কাটো কেন?’
অপরাজিতা বলল,
‘আমার ইচ্ছা।’
ফায়াদ অপরাজিতাকে বুক থেকে সরিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো৷ অপরাজিতা এই দৃষ্টি দেখে বলল,
‘কি?’
ফায়াদ অপরাজিতার গালে হাত বুলিয়ে সম্মোহনী কণ্ঠে বলল,
‘ইচ্ছে তো আমারো অনেক কিছু করছে।’
অপরাজিতা ঢোক গিলে বলল,
‘কি ইচ্ছে?’
ফায়াদ টান দিয়ে অপরাজিতাকে আবারো নিজের কাছে নিয়ে এলো। অপরাজিতা কেপে উঠলো। ফায়াদ অপরাজিতার মুখের দিকে ঝুকে গেল।তার দৃষ্টি অপরাজিতার সেই রাঙানো ঠোঁটের দিকে। ফায়াদ আরেকটু কাছে ঝুকতেই অপরাজিতা চোখ বন্ধ করে ফেলল। কিছুক্ষন পর অপরাজিতা অনুভব করলো তার ডান গালে এক উষ্ণ ঠোঁটের ছোয়া। শিহরিত হলো সে। ফায়াদ অপরাজিতার কানের কাছে কাধে মাথা রেখে বলল,
‘কিছু ইচ্ছে আপাতত বাকি থাকুক।সময় মতো পূরণ করে নিব।’
বলে সে অপরাজিতাকে ছেড়ে দূরে গিয়ে দাড়ালো। অপরাজিতা আস্তে করে চোখ খুলে দেখলো ফায়াদ রেলিং এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়ে আছে হাসি হাসি মুখ করে। তা দেখে অপরাজিতার মুখেও হাসি ফুটলো। ফায়াদ অপরাজিতাকে পাশে এসে দাড়াতে বলল।অপরাজিতা গিয়ে ফায়াদের পাশে দাড়ালো। ফায়াদের কাধে মাথা রাখলো।কিছু মুহুর্ত কেটে গেল।নিরবতা ভেঙে অপরাজিতা বলল,
‘আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন না আমার প্রতি আপনার চাহনি কেমন?’
ফায়াদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।অপরাজিতা ফায়াদের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘মারা ত্নক চাহনী। ডুবে যাই সে চাহনী তে আমি। সেই দৃষ্টি দেখলে হৃদয় স্পন্দন বেড়ে যায়। আমি–‘
ফায়াদ অপরাজিতার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করিয়ে দিল।শান্ত কণ্ঠে সুধালো,
‘বেসামাল হচ্ছি আমি। তোমার অনুভূতি প্রকাশ বেসামাল করে দেয় আমাকে। তুমি সফল। পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি তোমার জন্য।তোমাকে নিয়ে কল্পনা করতে ভালো লাগে ৷ না দেখলে অস্থির অস্থির লাগে।যখন তখন দেখতে মন চায়।আমারো তখন তোমার মতো করে প্রেম প্রেম পায়।’
একটু থেমে সেই চোখে চেয়ে বলল,
‘তোমার ভালোবাসা জিতে গিয়েছে। ভালোবাসি অপরাজিতা। ভালোবাসি তোমাকে।’
(চলবে)
#প্রেম_প্রেম_পায়
#স্বর্ণালী_সন্ধ্যা
পর্ব পঁচিশ
২৫.
‘তোমার ভালোবাসা জিতে গিয়েছে। ভালোবাসি অপরাজিতা। ভালোবাসি তোমাকে।’
অপরাজিতা থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো।তার মনে হচ্ছে সে ভুল কিছু শুনে ফেলেছে।সে কি আদও সঠিক শুনেছে কি না তা নিয়ে তার সন্দেহ হচ্ছে। ফায়াদ এখনো তাকিয়ে আছে অপরাজিতার দিকে। অপরাজিতার মনোভাব এখন তার চেহারা দেখে বুঝতে পারছে না সে।
অপরাজিতা কি বলবে তার তো মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে মনে হচ্ছে।তার লাগছে যেনো সে সব কিছু একসাথে পেয়ে গিয়েছে হঠাৎ যার কারনে অনুভূতিরা সব একসাথে দলা পাকাচ্ছে।
সে কিছু বলার চেষ্টা করলো কিন্তু তার কথা আটকে যাচ্ছে।সে কথা গুছাতে পারছে না।অনুভূতিরা আটকে যাচ্ছে। সুখ সুখ লাগছে আবার সেই সুখে কান্নাও পাচ্ছে তার। সে বলতে চেষ্টা করলো,
‘আ আপনি আ আমাকে আপনি–‘
থেমে গেল অপরাজিতা সে বলতে পারছে না। অস্থির লাগছে তার। এতো খুশি সে রাখবে কোথায়? তার ডাক্তার সাহেব তাকে ভালোবাসে বলেছে। তার ভালোবাসা সফল! ডাক্তার সাহেব তাকে ভালোবাসে। তার ভালোবাসা পরিপূর্ণভাবে দুপাক্ষিক। এসব ভেবে ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছে সে।
অপরাজিতাকে এমন অস্থির হতে দেখে ফায়াদ তার হাতের মুঠোয় অপরাজিতার হাত নিয়ে বলল,
‘রিল্যাক্স রিল্যাক্স! Take a deep breath!’
অপরাজিতা ফায়াদের কথা শুনলো।লম্বা করে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো। কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছে যে কোনো সময় কেদে দিবে। ফায়াদ কিছু বলতে যাবে তখনি সামির এসে বলল,
‘ভাইয়া! আমাদের নিচে যেতে বলেছে।’
ফায়াদ সেদিকে তাকিয়ে বলল,
‘আসছি’
অপরাজিতা নিজেকে সামাল দিল। ফায়াদ ইশারায় জিজ্ঞেস করলো,
‘ঠিক আছো?’
অপরাজিতা মাথা নাড়িয়ে বলল ঠিক আছে।
তারা সবাই নিচে নামলো। নিচে গিয়ে বসতেই আসিফ ইসলাম এবং ফারদিন আহমেদ জানালেন সবাইকে যে আগামী শুক্রবার জুম্মা নামাজের পর তাদের আকদ হবে ঘরোয়াভাবে। পরবর্তী তে অনুষ্ঠান করে মেয়ে তুলে দেওয়া হবে।
খবর শুনে উপস্থিত সবাই খুশি হলো।ছোট আবির তো লাফাচ্ছে আপুর বিয়ে বিয়ে করে। সবার মুখেই হাসি।
হঠাৎই অপরাজিতা এর মাঝে ভ্যা করে কেঁদে দিল। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল সে। ভীষণ ভাবে কান্না করছে।
কান্না দেখে সকলে অস্থির হয়ে উঠলো। রামিসা বেগম তো মেয়ের কাছে এসে মেয়েকে শান্তনা দিচ্ছেন।সবার ধারনা বিয়ে হয়ে যাবে তাড়াতাড়ি এজন্য সে কাদছে। কিন্তু সে কেনো কাদছে তা একমাত্র ফায়াদ জানে।ফায়াদের মন চাচ্ছে মেয়েটাকে বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলতে। উফ মেয়েটাকে কান্না করতে সে নিষেধ করেছিল।অপরাজিতার কান্না তার সহ্য হচ্ছেনা।
রামিসা বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘আরে পাগলী মেয়ে আমার কান্না করছিস কেন?এখনি পাঠিয়ে দিচ্ছি না।’
আসিফ ইসলাম মেয়েকে বললেন,
‘আম্মাজান তুমি খুশি না?’
অপরাজিতা ফোপাঁতে ফোপাঁতে বলল,
‘তুমি যা করবে তাতেই খুশি আমি।’
বলে সে আড়চোখে ফায়াদের দিকে তাকাল।ফায়াদ তাকে ইশারায় কাদতে মানা করলো।অপরাজিতা মাথা হেলিয়ে বুঝালো সে ঠিক আছে। ফায়াদ চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করলো যে সে আছে অপরাজিতার সাথে।
অপরাজিতার কান্না থামলো ধীরে ধীরে।রিজু বলল,
‘ভাইয়া আর অপরাজিতা পাশাপাশি আসো একটু।ছবি তুলি কয়েকটা।’
রামিসা বেগম তখন বললেন,
‘হ্যা তোমরা ছবি তুলো।ততক্ষণ না হয় ভাই আপা আপনারা আসুন খাবার খেয়ে নেন।বাচ্চারা সবাই একসাথে খাবে নে।’
বড়রা সবাই ডাইনিংএ গিয়ে বসলো।
ফায়াদ অপরাজিতা পাশাপাশি বসলো। রিজু ছবি তুলবে তাদের। ছবি তুলার মধ্যেই ফায়াদ সবার আড়ালে অপরাজিতার হাত মুঠোবন্দি করলো।ফায়াদ জানে তবুও আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,
‘কেদেছো কেন?’
অপরাজিতা মাথা টা নিচু করে বলল,
‘আমি আসলে অনুভূতি সামলাতে পারছিলাম না। সব একসাথে কান্না হয়ে গিয়েছে।’
‘উফ কথা পরে বলো তোমরা। ফোনের দিকে তাকাও’
রিজু বলল।
তারপর সকলে মিলে বেশ অনেকগুলো ছবি তুলল।ছবি তুলার পর্ব শেষ হতে তাদেরও ডাক পড়লো ডাইনিং এ।
খাবার খেতে বসে রিজু পড়লো বিপাকে। খেতে বসার শুরু থেকেই সে খেয়াল করছে সামিয়া নামের মেয়েটি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।এ আবার কেমন জালা।এভাবে তো খাওয়া যায় না। রিজু তার পাশে বসা রাফিয়াকে খোচা মেরে নীচু স্বরে বলল,
‘এইহ! এই পিচ্চি মাইয়া আবার আমার দিকে তাকায় আছে কেন?’
রাফিয়া ভালোভাবে দেখলো সামিয়াকে। তারপর মাথা নিচু করে হেসে দিল।রাফিয়াকে হাসতে দেখে ভ্রু কুচকালো রিজু।রাফিয়া রিজুকে একইভাবে নীচু স্বরে বলল,
‘আরো বুঝা যাহ! দেখ গিয়ে এই মেয়ে তোর উপর বা’শ খেয়েছে।সামলা এবার ঠ্যালা।আমি হেল্প করবো না এবার।’
বলে সে খাওয়ায় মনোযোগ দিল। রিজু সামিয়ার দিকে তাকিয়ে ফাকা ঢোক গিলল।সে এইসব বাচ্চার ঝামেলায় জড়াতে চায় না।কোন দুঃখে গিয়েছিল এরে বোঝাতে। এরই মাঝে রিজু দেখলো সামিয়া তার দিকে তাকিয়ে লজ্জা মাখা হাসি দিয়েছে।তা দেখে রিজু সাথে সাথে খাবারের দিকে মনোযোগ দিয়ে বলল,
‘আল্লাহ বাচাও!’
বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হলো ফায়াদের। বাসায় প্রবেশ করেই ছেলেগুলো সব রুমে না গিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিল আগে। নীতি, রাফিয়া রুমে গিয়েছে ফ্রেশ হতে। ফায়াদ কিছুক্ষণ বসে তারপর তার বাবা আর ভাইদের ঠেলেঠুলে পাঠালো ফ্রেশ হতে। সকলে ফ্রেশ হয়ে আবার সোফার রুমে বসলো।ফারদিন আহমেদ বসেই বললেন,
‘শেষ পর্যন্ত বিয়ে করছো তাহলে?’
ফায়াদ মুচকি হাসলো। ফারাজ বলল,
‘করবেনা আবার! তোমার ছেলে প্রেমে একেবারে হাবুডুবু খেয়ে ডুবে গিয়েছে। খেয়াল রাখা,চোখে চোখে কথা আরো কতো কি যে দেখলাম’
রাফিয়া বলল,
‘আরে ভাই তুমি এতো রোমান্টিক কিভাবে হলে বলো তো!কোনো মেয়ের সাথে কখনো ফ্লার্টও তো করতে দেখলাম না।’
নীতি তাদের কথাবার্তা শুনে অবাকই হচ্ছে। এদের সাথে যত থাকে তত অবাক হয়। এরা এমনভাবে কথা বলে যেন সবাই সবার বন্ধু। কতো সুন্দর বন্ডিং তাদের।মাশাআল্লাহ।
আখি বেগম সবার জন্য চা নিয়ে এসেছে। রিজু সবার আগে এক কাপ চা নিয়ে বলল,
‘এটার এখন খুব দরকার ছিল ফুপ্পি।থ্যাংক ইউ!’
ফায়াদ আর ফারাজ একসাথে বলে উঠলো,
‘চা খাবো না মা।’
আখি বেগম দুজনের দিকেই তাকালেন একবার একবার করে। তারপর হেসে দিয়ে বললেন,
‘জানি জানি। এনেছি কফি। আর নীতি চা খাও তো?’
নীতি বলল,
‘হ্যা হ্যা।’
আখি বেগম আর রাফিয়ার আম্মুও বসলো চা নিয়ে। সকলে ফায়াদের বিয়ে নিয়ে কথা বলছে। ঘরোয়া ভাবে আকদ হলেও কিছু আয়োজন তো করা লাগবেই। সে বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে।
অপরাজিতা শাড়ি টাড়ি খুলে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। তখন আবির এসে বলল,
‘আপু৷ তুমি কি চলে যাবা?’
অপরাজিতা ভাইকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
‘এখন না। তোকে আরো বকা বাকি আছে আমার!’
আবির অভিযোগ করে বলল,
‘বকবে কেন?’
অপরাজিতা গাল গুলো টেনে দিয়ে বলল,
‘চলে গেলে তো আর কেউ বকবে না। তাই সব বকা একসাথে দিয়ে যাবো। ভালো হবে না?’
আবির গাল ফোলাল। অপরাজিতা হেসে দিল। তার ডাক পড়েছে। বসার রুমে গিয়ে দেখলো। মা, খালামণি সব কিছু গুছিয়ে রাখছে। আসিফ ইসলাম সোফায় বসে আছেন। ডাকলেন,
‘এদিকে আসো আম্মা।’
অপরাজিতা গিয়ে বাবার পাশে বসলো।আসিফ ইসলাম মেয়ে বললেন,
‘তুমি আমার উপর রাগ করো নি তো?’
অপরাজিতা বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বাবার বুকে মাথা রেখে বলল,
‘মোটেও না বাবা। আমি তোমার উপর একটুও রাগ নেই।’
আসিফ ইসলাম আবার জিজ্ঞেস করলেন,
‘তুমি খুশি তো আম্মা?’
অপরাজিতা সে কথার জবাব না দিয়ে বাবাকে বলল,
‘ বাবা কখনো বলা হয় নি তবে জানো তো আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।’
মেয়ের কথা শুনে আসিফ ইসলাম হেসে দিলেন। তার চোখের কোণে পানি চলে আসলো।তবে তিনি তা প্রকাশ করলেন না। বললেন,
‘আমিও ভালোবাসি আম্মা’
আবির এসে গাল ফুলিয়ে বলল,
‘আমাকে বাসো না?’
আসিফ ইসলাম কিছু বলার আগে অপরাজিতা বলল,
‘না বাসে না’
আবির গাল ফুলিয়ে বাবার দিকে তাকালো। তা দেখে আসিফ ইসলাম হেসে বললেন,
‘বাসি তো আব্বা। আপনাকে ভালোবাসবো না তো কাকে বাসবো?’
অপরাজিতা আবিরকে ভেঙচি কেটে বলল,
‘আমাকে বেশি বাসে।’
রামিসা বেগম ছেলেমেয়েদের কাণ্ড দেখে কাজ করছেন আর মুচকি হাসছেন।আমিনা বেগম বোনকে বলল,
‘তোমার মেয়েটা বড় হয়ে গিয়েছে আপা’
রামিসা বেগম একপলক মেয়ের দিকে তাকালেন। তার মুচকি হাসলেন। মনে মনে বললেন,
‘হুম বড় হয়ে গিয়েছে। কাউকে মনের মাঝে যতন করে ভালোবাসতেও জানে আমার মেয়ে এখন।সুখে থাকুক সে ‘
শুতে শুতে বেশ রাত হয়ে গেল।ফায়াদরা অনেকটা সময় গল্প করে তারপর শুতে গেল। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ক্লান্তিরা সব সয়ে গেল।প্রশান্তি বয়ে গেল। দেহের শান্তির সাথে মনের শান্তিও বিরাজ করছে।চোখ বন্ধ করলেই সেই মায়াময়ী ফুল ভেসে আসে চোখের সামনে।এ যে কি অনুভূতি তা কেবল যে ভালোবাসে সে জানে।
বেশ কিছুটা সময় পর ফায়াদ গিটারের সুর শুনলো। রাতের সাথে গিটারের সুর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তা বুঝতে পারলো ফায়াদ।তার রুম থেকে আবছা আবছা শুনা যাচ্ছে। এই সুর কোথা থেকে আসছে তা বুঝলো ফায়াদ। দিনের বেলা সকলের সাথে হাসি খুশি থাকলেও রাতে কার সাথে অভিনয় করবে? রাতের আধারে অভিনয় করা যায় না। নিজের সাথে অভিনয় করতে করতে রাতে সে অভিনয়ের বাধ ভেঙে যায়।
সবাই হয়তো শুনলো সে গিটারের সুর। কিন্তু কারো কিছু করার নেই। যার বেদনা, সেটা শুধুই তার। বাকিরা যতই বলুক আমি বুঝি কিন্তু কেউ কারো বেদনা বুঝে না।
ফায়াদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করলো।চোখের পাতায় তার ভালোবাসা ভাসছে। কিন্তু কানে কারো ভালোবাসা হারিয়ে যাওয়ার করুন সুর আসছে। কিছু লাইন আবছা ভাবে ভেসে আসলো কানে,
‘তুমি আমায় ডাকলা না গো, তুমি রইলা দূরে
তোমার হইয়া অবাক জোছনা ডাকলো অচিন সুরে…’
(চলবে)