প্রেমজাল পর্ব-০২

0
1674

#প্রেমজাল
পর্ব ০২
জান্নাতুল মাওয়া মাহিমুন

-“লেটস ট্রাই সামথিং নিউ সুইটহার্ট! আর ইউ রেডি টু গেট পানিসমেন্ট ফোর বিটরে মি? (Let’s try something new, sweetheart! Are you ready to get punishment to betray me)”

একটু আগে সাওয়ার নেওয়ার সত্যেও ইতিমধ্যে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মনে মনে সাহস জুগিয়ে কিছু না শোনার ভান ধরলাম। একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে পাশ কাটাতেই আয়ান পিছনে থেকে খপ করে হাত ধরলে ফেললো। আমি ২/৩ বার হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করলাম। যতই ছাড়াতে চাই ততই যেনো আকড়ে ধরে। বাধ্য হয়ে মৌনতা কাটিয়ে শান্ত গলায় বললাম,

-“ছাড়ুন”

-“হাতটুকু ধরার অধিকার আমার আছে এজ এ লিগ্যাল হাসবেন্ট (As a legal husband) অপপ্স এগ্রিমেন্ট হাসবেন্ট” ভরাট কন্ঠে বললো আয়ান।

আমি আরেকবার হাত ছাড়াতে চেষ্টা করাতেই আয়ান হ্যাচকা টান দিয়ে তার সাথে মিশিয়ে নিলো। হঠাৎ এমন হওয়ায় উনার খুব কাছাকাছি চলে গেলাম। আমাদের মাঝে মাত্র চার ইঞ্চি দূরত্ব। রীতিমতো আমার হাত-কাপাকাপি শুরু হয়ে গেছে। নিশ্বাস যেনো ক্রমশ প্রগাঢ় হচ্ছে। হার্টবিট খুব দ্রুত বেগে চলচ্ছে। এর আগে কোনো উনার এতো কাছাকাছি আসেনি। এমনকি কারোর এতো সংস্পর্শে যাওয়া হয়নি। আমি আলতো ভাবে উনার বুকে হাত রেখে সরাতে চাইলাম। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ থাকলে নিঃসন্দেহে সেন্সলেস হবো। মরার একটু তো সরলোই না, আরো যেনো কোমড় চেপে কাছে টেনে নিলো। কপালের চুল বেয়ে পানি গলা পর্যন্ত ভিজে চুপ চুপ।

আয়ান কপালের অবাধ্য ভিজে থাকা চুল গুলো কানে পিছনে গুজে দিলো। এখন যেনো উনার উষ্ণতা আমাকে গ্রাস করছে। উনার গরম নিশ্বাস আমার মুখে আছড়ে পরছে। আমি আর সহ্য না করতে পেরে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। উনার উত্তপ্ত হাওয়ায় আমার কাধ ছেয়ে যাচ্ছে। উনি আমার কানের কাছে নিজের মুখ এনে তার থুতনি আমার কাধে রাখলো।

-“ইগনোর!! সেটাও আমাকে? কেনো রে? আমি কি তোর অই লাফাঙ্গা আশিক এর থেকে দেখতে খারাপ? যে আমার দিকে ফিরেও তাকাস না।….. (একটু থেমে) কে জানি এসেছিলো? কি জানি নাম অই ছেলেটার? অহ হ্যা আকাশ। দেখে আসিস কালকে কেমন। হয়তো সরকারি কোনো জেনারেল হাসপাতালের বেডে আধমরা পরে আছে কি না কে জানে?” বলে আমাকে ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাড়ালো।

আয়ানের বলা কথাটা কানের দুয়ারে কড়া নারতেই সারা শরীর যেনো শিউরে ওঠলো। আমি অবাক চাহনিতে উনার দিকে তাকালাম। এই বজ্জাত ব্যাটা নিশ্চিত সাইকো। কে না কে দেখতে এসেছে বলে হাসপাতালের বেড পর্যন্ত ঘটনা গড়াবে।

আচমকা উনি আমার মুখ ফুক মারলেন। সাথে সাথে উনার মুখ ও নাকের গরম হাওয়া আমার মুখমন্ডলে বিচরণ করতে লাগলো। উনার এমন বিব্রতকর কান্ডে চক্ষু আমার চড়কগাছ। অস্থিরতা চরম মাত্রায় উপছে পরছে। আয়ান আমার এই অবস্থা দেখে ঠোঁট চেপে ভিলেনি হাসি দিলেন। শার্টের প্রথম দুইটা বোতাম খুলতে খুলতে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। আমার চোখ যেনো অটোমেটিক মার্বেলের আকার ধারণ করতে উপক্রম। আমার শরীর যেনো ক্রমশ অবশ হয়ে যাচ্ছে। পাথরের ন্যায় দাড়িয়ে আছি। মানুষটার চোখ-মুখে রম্যতার ছাপ। সে আমার কাছে এসে ঝুকতেই দ্রুত কয়েক ধাপ পিছিয়ে গেলাম। উনি এগিয়ে আসছেন আর আমি পিছনে যাচ্ছি। পিছিয়ে যেতে যেতে এক পর্যায় দরজার সাথে মিইয়ে গেলাম। হাত কচলিয়ে যাচ্ছি আনমনে। উনি আরো আমার সামনে এসে দাড়ালো। অস্বস্তিতে উশখুস করে সরে যেতে চেষ্টা করতেই উনি উনার বলিষ্ঠ দুই হাত খানা দরজার দুইপাশে ভর দিয়ে রাখলেন। উনার শীতল তুখর চোখ আমার চোখেতে আবদ্ধ। খুব আস্তে আস্তে হৃদ স্পন্দন রেসপন্স করছে। হয়তো অক্সিজেনের ঘাটতি হচ্ছে চারদিকের থমকা কার্বন-ডাই-অক্সাইডের প্রভাবে। উনাকে দেখলে হৃদয় কোণে এমন অজানা অনুভূতি সায় দেয় কেনো? কেনো পারি না তাকে প্রত্যাখ্যান করতে? কেনো অজানা মায়ার টান আমাকে আটকে রাখছে? তাহলে আমি কি উনার প্রতি অনুভূতি প্রবণ হয়ে পরলাম?

আয়ান আমার ভাবনার সুতো কেটে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,

-“জানেমান!! আমার জিনিসকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টার অপরাধে তোমার হবু বরের এক পা তো কবরে রেখে এসেছি। এখন তোমার সাথে কেমন ট্রিট করবো? দেবী চৌধুরানীর ডাকাত দলের মতো হিংস্র টাইপ নাকি…

আমি উনাকে থামিয়ে মাথা নিচু করে মিহি গলায় বললাম,

-“সরুন! আমার সামনে থেকে নাহলে কিন্তু…

এবার আয়ান আমার কথায় ব্যাঘাত ঘটালো। উনি তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বললো,

-“কেনো আমাকে দিয়ে হয় না? আদ্র কে লাগবে নাকি? ডাকবো আদ্রকে? তুই ডাক আদ্রকে”

ইতিমধ্যে উনার চোখ আগ্নেয়গিরি লাভার মতো টগবগ করছে। এই বুঝি আমাকে তার চোখ দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করবে।

আয়ান ডোন্ট কেয়ার ভাব দিয়ে হুংকার করে উঠলেন।

-“না সরলে কি করতে পারিস কর”

উনার তীক্ষ্ণ জোরালো কণ্ঠে আমার কানের পর্দা ফেটে যাবে মনে হচ্ছে।

আমি কটাক্ষ করে আনমনে হাত কচলাতে কচলাতে।বিড়বিড়িয়ে বললাম,

-“ব্যাটা পুরাই আস্ত বজ্জাত। তিল থেকে তাল হলেই খালি আদ্র ভাইকে টানে”

উনি আমার কথা শুনতে বা বলতে পারলো কি না কে জানে। আমাকে অবাক করে উনার দুই হাতে আমার দুই হাত আকড়ে ধরলো। আমি বোকা বনে উনার দিকে ফ্যাল ফ্যাল কতক্ষণ চেয়ে রইলাম।

-“ইটস টাইম টু ডু সামথিং ইন্টারেস্টিং, সুইটহার্ট ( It’s time to do something interesting, Sweetheart) ওয়ানা স্ট্রাট?” বলে চোখ টিপ মারলো।

আয়ানের কথা শুনে রীতিমতো আমার কান দিয়ে ধোয়া ছুটছে। নিশ্চিত গালেও রক্তিম আভা ফুটে ওঠেছে। আগের থেকে যেনো দ্বিগুণ কাপাকাপি বাড়তে লাগলো। কলিজার পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। উনি একপ্রকার টেনে বিছানায় বসালেন। এখনো উনার হাতে আমার হাত আবদ্ধ। উনি একচেয়ালি কি করতে চাইছেন? আমার সাথে কি হতে চলেছে? আমার গবেট মার্কা মাথায় কিছুই যে ঢুকছে না। আমি উনার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকালাম। আমি থমথমে গলায় কিছুটা অবাক চাহনি নিয়ে বললাম,

-“আপনার ইনটেশন কি? আপনি এখানে বসছেন কেনো?”

আয়ান আমার কথা শুনে হো হো করে হেসে দিলো। মনে হচ্ছে আমার কথায় বেশ মজা পেলে। আমি ভ্রু কুচকে বিরক্তি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম।

-“বাহ রে! বিয়ে করলাম আর বাসর করবো না”

আমি দাঁড়িয়ে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিলাম। খুব দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস ওঠা নামা করছে। আমি নিজেকে স্বাভাবিক করতে করতে বললাম,

-” আ…আ..আপনার মা..মাথা টাথা ঠিক নেই”

পিছন থেকে আয়ান হাত টান দিয়ে বিছানায় ফেলে দিলেন। এমন আচরণ করবে ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। এখন তো মনে আজকেই ইন্না নিল্লাহ না হয়ে যাই। এই বুঝি প্রাণ পাখি উড়াল মারলো। উনি আমার মুখের অপর উবু হতেই আমার ছটফটানি বেড়ে গেলো। আমি চাতক পাখির মতো এদিক ওদিক ফাক ফোকড় খুজতে লাগলাম। সুযোগ পেলেই ফুড়ুথ করে উড়ে যাবো।

-“অনেক শখ না এই চেহারা সবাইকে দেখানো? তাই তো মনের ভেতর কোনো ভয়-ডর নেই। ঢেং ঢেং করে বসা হয়েছিলো না? আজ সারা রাত আমি তোকে দেখবো” ভাবলেশহীন ভাবে বললো আয়ান।

আমার সারা শরীর কাটা দিয়ে উঠলো। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল শিহরণ বয়ে গেলো৷ মনের মাঝে এক নাম না জানা অনুভূতি রাশিগুলো উথাল-পাতাল হয়ে গেলো। আনমনে বিছানার চাদর আকড়ে ধরলাম।

-“আই সওয়ার ( I swear), আরেকবার ঠোঁট কামড়াতে দেখলে তোর খবর আছে। এমন দাপাদাপি না করে চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে থাকবি। জাস্ট কন্টাক মাই আই অনলি”

আয়ানের এমন রামধমক টাইপ হুমকি শুনে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলাম। মনে মনে দোয়া-দুরূদ পরলাম। আস্তে আস্তে কখন যে ঘুমপরী তার রাজ্যে নিয়ে গেলো কে জানে!

___________________

কাচের জানালা ভেদ করে সূর্যি মামার আলোক রশ্মি উঁকি ঝুঁকি মারছে। নব্য প্রভাতের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। চারপাশে স্নিগ্ধ হাওয়া বইছে। ঘুমের রেশ কাটিয়ে উঠতেই বুঝতে পারলাম কেবল মাত্র সকাল হলো। ঘুম থেকে আড়মোড়া দিয়ে উঠতে অনুভব করলাম কেও তার বাহু দিয়ে কোমর জরিয়ে আছে। পাশে তাকাতেই নিশ্চুপে তপ্ত শ্বাস নিলাম। হুমায়ুন আহমেদ ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসে সেই কথাটি মনে পরে গেলো। আসলেই হয়তো বিয়ের পর নতুন একজন যুবকের প্রান্ত ধারে এক বিছানায় ঘুমানোর মতো অস্বস্তিকর জিনিস আর দুটো নেই। আস্তে আস্তে হাতের বাধন ছাড়িয়ে নিলাম। আমি চাই না আবারো অতীতের বিষাক্ত ঘটনা পুনরাবৃত্তি হোক। আর তো মাত্র কয়েকটা মাস। যে যার নিজের রাস্তায় পাড়ি দিবে। কিংবা কয়েকদিন বাদেই লাল টুকটুকে বেনারসি পরে বউ সেজে রিয়া আ……..

চলবে…..