#প্রেমজাল
পর্ব ১৯
জান্নাতুল মাওয়া মাহিমুন
ফুরফুরে স্নিগ্ধ হাওয়ার সকালের পরিবেশ হয়ে উঠেছে মোহনীয়। ছনের ঘরের বেড়া চিড়ে মৃদু আলোড়নে আড়মুড়িয়ে চোখ খুললাম আমি। আমি উঠে বসতে চেষ্টা করতেই পেটের উপর ভারী কিছু উদ্ভাবন করলাম। খানিকের জন্য হিতাহিত জ্ঞান যেনো হারিয়ে ফেললাম। রীতিমতো আমি চোখে সরিষা ফুল দেখছি। আদৌ কি এটা বাস্তব? এক সুঠামদেহী যুবক আমার কাপড়ের আচল ভেদ করে মুখ কিছুটা কাত করে উবু হয়ে ঘুমে বিভোর।
আয়ানের অবস্থান এভাবে খুটিয়ে খুটিয়ে পপর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে এখন আমার নিজেরেই কেমন অস্বস্তি লাগছে। উনার প্রতিটি নিশ্বাস হাওয়া আমার পেটের অপর বিচরণ করছে। খানিকটা লজ্জাও লাগছে। উনি আমার সাথে এভাবে ঘুমিয়েছেন? ভাবতেই নাক কান দিয়ে ধোয়া ছুটতে লাগলো। ইশ!! কি এক বিব্রতকর অবস্থা। আচ্ছা উনাকে কি ডেকে তোলা দরকার? না না!! উনি ঘুমে কুপোকাত থাকলেও উনার জেগে যাওয়ার আগে সরাতে হবে। আল্লাহ ওয়াস্তে এভাবেই এই ব্যাটার লাগামহীন কথা ড্রাম ভর্তি। পরে আমাকে আগের ঠেং বগের ঠেং শুনাতে পিছ পা হবে না, হুহ। কিন্তু যেই অবস্থা আছে সরাতেই আমার অবস্থা টাইট।
খানিকবার আয়ানের মাথা, আয়ানের কাধ, আয়ানের বাহু চেপে ঠেলে সরাতে চেয়েও প্রতিবারই ফলাফল শূন্য হলো।
আকস্মিক ভাবে উনি নড়ে-চড়ে উঠতেই আমি সাত পাঁচ না ভেবেই তাড়াহুড়ো করে সটা্ন শুয়ে ঘুমের মিথ্যা ভান ধরতে লাগলাম। পেটের উপর ভারী ভারী ভাবটা ক্রমাগত বিলীন হতে লাগলো। মানে উনি উঠে গেসে। কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করলাম। পরক্ষণে উন্মুক পেটে ছোয়া পেতেই শিউরে উঠলাম। সারা শরীর কাটা দিয়ে উঠছে। আমি চোখ থাকা অবস্থাই দাতে দাত চেপে সহ্যের বৃথা চেষ্টা করতে লাগলাম। উনার আনাগোনা চিহ্ন না পেতেই পিট পিট করে চোখ খুললাম। সারা ঘর একবার চোখ বুলালাম। না আয়ান এখানে নেই। ঘরের দরজা হালকা খোলা। হয়তো সে বাইরে গেছে। আমি নিজের পেটের দিকে আকিয়ে আলতো ভাবে প্রশান্তির হাসি হাসলাম। পেটের খোলা অংশ কাপড় দ্বারা আবদ্ধ। আমি গুটি গুটি পায়ে বিছানা থেকে নেমে গেলাম। বিছানা থেকে নেমে চাদর টান টান করে নিলাম। কিছুটা বিব্রতও হলাম। বিছানায় একটাই বালিশ। তাই হতো উনি আমার সাথে অইভাবে ঘুমিয়ে ছিলেন। যদি আরেকটু উপরে মুখ করে ঘুমাতেন!! ছিঃ ভাবতেই লজ্জায় কুকড়ে গেলাম। নিশ্বাস অতি দ্রুত বেগে ওঠা-নামা করতে লাগলো। হায়!! কি লজ্জা!
_____________________________
অচেনা একটা লোক রকিং চেয়ারে বসে মদ্যপান করতে ব্যস্ত। ইতিমধ্যে তাকে মদের নেশা গ্রাস করে মাতাল অবস্থায় নিমজ্জিত করেছে। তাও যেনো তার মদের তৃষ্ণা মিটছে না। বোতল থেকে গ্লাসে মদ ঢেলে এর দিকে পৈশাচিক একটা হাসি দিলো।
দূর থেকে এসব দেখে রাগে ফুসফুস করছে মিসেস আহনাফ। রেগে তার মুখমন্ডল লালচে বর্ণ ধারণ করছে। না চাইতেও চোয়াল শক্ত করে মিসেস আহনাফ বলে উঠলেন,
-“ তোমার কি সকাল বেলা এসব ছাইপাশ না গিললে হচ্ছে না? এতো কীসের মদের নেশা?”
মিস্টার আহনাফ তার নেশাগ্রস্ত চোখ দিয়ে একবার মিসেস আহনাফের দিকে তাকালেন। তার কথাকে উপেক্ষা করে মদের ভেতর ২-৩টা আইস কিউব ঢেলে দিয়ে আরাম করে এক পায়ের উপর আরেক পা তুলে এক দৃষ্টিতে মদের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে রইলেন। উনি নেশাগ্রস্ত গলা নিয়ে বাঁকা হেসে বলতে লাগলেন,
-“ এটা যে শুধু মদের নেশা নয়। প্রতিশোধের নেশাও বটে”
শেষের কথাটা মিস্টার আহনাফ চোয়াল খানিকটা শক্ত করে বললেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে মিসেস আহনাফ তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বললো,
-“ যেভাবে মদের মধ্যে বরফের খন্ড ডুবে গিয়ে অস্তিস্ত্ব হারিয়ে ফেলেছে, একদিন তুমিও তোমার প্রতিশোধের নেশায় ডুবে গিয়ে সব হারিয়ে ফেলবে, আহনাফ”
মিসেস আহনাফের কথায় মিস্টার আহনাফ তার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়। মূহুর্তের মধ্যে তার চোখে হিংস্রতার ছাপ ফুটে উঠেছে। মিস্টার আহনাফ তার সর্বশক্তি দিয়ে হাতে থাকা মদের গ্লাসটা সামনে থাকা কাচের টেবিলের দিকে ছুড়ে মারলো। সাথে খন্ড-বিখন্ড হয়ে গেলো কাচের টেবিলের সাথে মদের গ্লাসটাও।
মিসেস আহনাফ কিছুটা ভয় পেলেও আবারো তাচ্ছিল্য হাসি টেনে বললো,
-“ হাহা হা!! দেখো আহনাফ! চেয়ে দেখো কাচের টুকরো গুলোর দিকে। ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো নিমিষে। তুমিও একদিন এভাবেই……”
মিসেস আহনাফ তার ব্যক্ত কথা পরিপূর্ণ না করতেই মিস্টার আহনাফ তেড়ে এসে তার চুলের মুঠি শক্তভাবে চেপে ধরলো। ইতিমধ্যে চুলের টানে মিসেস আহনাফের চোখে পানিও এসে গেছে। মিস্টার আহনাফ দাত কিড়মিড়ে বললো,
-“ বড্ড বেরে গেছিস না তুই? মুখে দেখছি খই ফুটে। আজকে তোর একদিন কি আমার একদিন” বলে টানতে টানতে মিস্টার আহনাফ তার স্ত্রীকে ঘরে নিয়ে ছুড়ে ফেলে। মিসেস আহনাফ হুমড়ি খেয়ে পরে তার কপালের অনেকাংশ খাটের কিনারার ঘর্ষণে কেটে যায়। ইতিমধ্যে চামড়া ছিলে রক্ত কণা জমা হয়। তাতেও যেনো মিস্টার আহনাফ কিংবা মিসেস আহনাফে কারোরেই কোনো ধরনের ভ্রুক্ষেপ হলো না।
মিসেস আহনাফ অশ্রু নয়নসিক্ত দৃষ্টিতে তাচ্ছিল্যতার সাথে মোলায়েল জর্জরিত কন্ঠে বললো,
-“ কি আর করবে? আবারো মারবে? শরীরের দাগ শুকিয়ে গেলেও মনের দাগ কখনোই কিন্তু শুকায় না, আহনাফ। আমার নিয়তিতে লেখা এমন চরম কষ্টের জন্য যে আমি নিজেই দায়ী। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সেদিনই করেছিলাম”
মিসেস আহনাফের কথায় মিস্টার আহনাফ হুংকার দিয়ে হাসতে লাগে। তার হাসির বজ্রপাতে সারা ঘর আলোড়ন ফেলে দেয়। মিস্টার পৈশাচিক হাসি হাসতে হাসতে তার কোমড় থেকে চামড়ার বেল্ট খুলে নিসেস আহনাফের দিকে এগিয়ে যায়। আবারো সারা ঘর জুড়ে যায় শব্দের আলোড়নে। তবে সেটা হাসির জন্য নয়। ব্যথায় আর্তনাদের, সহ্য না করতে পারার চিৎকার আর শরীরের অপর বেল্টের কড়াঘাতের। মিস্টার আহনাফ মদের নেশায় মাতাল হয়ে বেধারাম মারতে থাকে মিসেস আহনাফকে। মিস্টার আহনাফ মরতে মারতে এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে গেলে ছেড়ে দেয় মিসেস আহনাফ কে। ক্লান্ত শরীরে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পরে মিস্টার আহনাফ।
প্রত্যেকটা বেল্টের আঘাতের জায়গায় রক্তিম বর্ণ ধারণ করলেও এতোক্ষ্অণে তা নীলচে বর্ণ ধারন করছে। সবই যে তার কপাল। অতীতের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ যে এসব ভোগ করতে হচ্ছে মিসেস আহনাফ। সে তার ব্যথিত শরীর নিয়ে আস্তে আস্তে খুরিয়ে খুরিয়ে ওয়াশরুমে গেলো অযু করতে। নামাজ পড়ে মহান আল্লাহ তায়লার কাছে ক্ষমা চাইবে। যাওয়ার আগে মিসেস আহনাফ তার হিংস্র স্বামীর দিকে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে তাচ্ছিল্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।
মিসেস আহনাফ তার স্বামী এমন ধংসলীলা আর সহ্য করতে পারছেননা। কি করবেন তিনি? কি করে আটকাবেন তিনি? তার হাত-পা যে অদৃশ্য শিকল দ্বারা আবদ্ধ। পরিস্থিতে অপারক হয়ে পড়েছেন তিনি। জানামাজ এ বসে পড়ে এখন তার একমাত্র ভরসা আল্লাহ। একমাত্র মহান আল্লাহ ই পারে তার স্বামীকে হেদায়ত দান করে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে। তার স্বামী যে সম্পত্তির লোভ-লালসার পাশাপাশি প্রতিশোধ নিতে অন্ধ হয়ে গেছে।। মিসেস আহনাফ কাদতে কাদতে বেকুল হয়ে পরে। শুধু দোয়া করতে থাকে একজনের শাস্তি আরেকজন যাতে না পায়। সে ছোট্ট মেয়েটা যেনো মানুষরূপী জানোয়ার থেকে বেচে যায়। মিসেস আহনাফ কেদে কেটেও কোনো কুল কিনারা খুজে পেলো না। একসময় কাদতে কাদতেই অজ্ঞান হয়ে ঢোলে পরে জায়নামাজে।
#চলবে… ~ ইনশাল্লাহ…