#প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা
#আফসানা_মিমি
| চৌদ্দ তম পর্ব |
কথিত আছে, “ভাঙা কলস বাজে বেশি।” আজাদ সাহেবের বেলায় তেমন।
প্রেম নীড়ে আজ জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আদরের ছোট ছেলের জন্মদিন বলে কথা! সকাল সকাল লোকজনের আসা যাওয়া হচ্ছে প্রেম নীড়ে। পুরো বাড়ি সাজানো হচ্ছে কাঁচা ফুল সহ বিভিন্ন অর্কিড ফুল দিয়ে। প্রেম নীড় যেন আজ ফুলের বাগান হয়ে উঠেছে। আজাদ সাহেব সকাল থেকে এক স্থানে চেয়ারে বসা। বসে বসে চয়ের পর চা পান করে যাচ্ছেন আর সকলকে নির্দেশনা দিচ্ছেন। আজাদ সাহেবের কন্ঠস্বর আজ অট্ট শোনা যাচ্ছে। নিজে কোন কাজ করছে না কিন্তু সকলকে খাটাচ্ছেন। বাদ রাখেননি প্রিয়তমা স্ত্রীকেও। চায়ের পর চা নিয়ে আসার হুকুম দিচ্ছেন পরপর। এজন্য আয়েশা আজাদ আজ চরম ক্ষিপ্ত। ক্ষিপ্ত হওয়ার’ই কথা! সকাল থেকে আয়েশা আজাদ রান্না ঘরে। সকালের চা নাস্তা পর্যন্ত করতে সময় পায়নি এর মধ্যে চা-খোর স্বামীর পর পর হুকুম। আয়েশা আজাদ আরো একটা কারণে ক্ষেপে আছে। আর সেটা হচ্ছে প্রিয় অদুরের পুত্রবধূকে নিয়ে। সাত সকালে আয়েশা আজাদকে পটিয়ে চলে গিয়েছে পার্লারে। আয়েশা আজাদ দ্যা ইমোশনাল শাশুড়ি মা বউমার কাঁদো কাঁদো চেহারা দেখে অনুমতি দেয়। কিন্তু পরমুহূর্তে আয়েশা আজাদ ভরকে যায় কেননা আয়েশা আজাদের ভোলা ভালা পুত্রবধূ নিখুঁত অভিনয় করে শাশুড়িকে সালাম করে চলে যায়। তখন থেকেই এক হাতে সব সামলে নিচ্ছেন। আয়েশা আজাদ ফাহিমাকে ব্যঙ্গ করে বকছেন,
” মাগো মা! ও আমার মা জননী। আজকে না তোমার ছেলের জন্মদিন! আজ আমাকে সকলের সিমনে সুন্দর না দেখালে তুমি পড়শিদের সামনে মুখ দেখাবে কি করে। আমি যাই! ইয়েহ আমি যাই! কত সুন্দর করে আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে চলে গেলো। পড়ে রইলাম আমি।”
ফাহিমাকে বকার মধ্যেই আজাদ সাহেবের ফের হুকুম আসে এক কাপ চা পাঠানোর জন্য। সংবাদটা নিয়ে আসে আজকের কাজ করা লোকজনের মধ্যে একজন। আয়েশা আজাদ এবার তেতে গেলেন। চিনির স্থানে দ্বিগুণ পরিমাণ লবন মিশিয়ে চা তৈরি করে দিলেন। কাজের লোকটির হাতে চায়ের কাপ, হা করে আয়েশা আজাদকে দেখছে লোকটি।
” যদি মহাজনকে বলে দাও আমার কুকাজের কথা, তাহলে টাকা কেঁটে রেখে দিবো। মনে থাকবে তো!”
কাজের লোকটা আয়েশা আজাদের হুমকি শুনে ভয় পায়। হুড়মুড় করে চলে যায় মালিককে চা দিতে।
আয়েশা আজাদ আদরের ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে মিষ্টান্ন তৈরী করছেন। পায়েস,সেমাই, মিষ্টি, দই সকল কিছু তৈরি করেছেন এক হাতে।
এখন রান্না করবেন মোরগ পোলাও। মুরগির মধ্যে লেবু, টেস্টি লবন মিশিয়ে ঢেকে দিলেন আয়েশা আজাদ। এর মধ্যেই আজাদ সাহেবের চিৎকার শোনা যায়। আয়েশা আজাদ হাতের কাজ ফেলে বের হয়ে আসেন রান্না ঘর থেকে।
” আমাকে এত কষ্ট দিয়ে তুমি কি শান্তি পাও ললিতা? আমি আরামে থাকলেই কি তোমার বুকে আগুন জ্বলে?”
বেসিনে ওয়াক ওয়াক করে সকাল থেকে এই পর্যন্ত পেটে পরা চা পানীয় বের করলেন। মুখ মুছে অসহায় হয়ে বললেন জল্লাদ বউকে।
” আগুন জ্বলে কি! তোমার আরাম দেখলে মনে হয় কেউ আমার বুকে পেট্রল ঢেলে দিয়েছে।”
” সেটা তো তোমাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। এখন বলো কি কাজ করতে হবে?”
আয়েশা আজাদ কথা বাড়ালেন না। স্বামী যে পরাজয় বরণ করেছেন তাতেই অনেক।
———-
সকাল সকালে প্রেম নীড়ের সকলে কাজে লেগে থাকলেও ঘুমিয়ে আছে নবাব নাদিফ। রান্নাঘর থেকে সুগন্ধি বের হচ্ছে খাবারের। চোখ বন্ধ করা অবস্থায় নাদিফ লম্বা শ্বাস নেয়। মুখে ফুটে উঠে মৃদু হাসি। নাদিফ এবার চোখ খুলল। সকাল সকাল পোলাওয়ের সুগন্ধি’ই জানান দিচ্ছে আজ নাদিফের জন্মদিন। ছোট বেলা থেকেই নাদিফের মা এই দিনে মোরগ পোলাও করেন। নাদিফকে সকালে খাবার টেবিলে বসিয়ে আয়েশা আজাদ নিজ হাতে খাইয়ে দেন। নাদিফের মন আজ খুবই খুশি। পছন্দ করা মানুষ যে নাদিফের আশেপাশে। নাদিফ আজ মন ভরে দেখবে অপরুপকে।
রান্না ঘরে খুব মনোযোগ সহকারে শসা,টমেটো কেঁটে স্পেশাল সালাদ তৈরি করছে রুপ আর কিছুক্ষণ পর পর পোলাও নেড়ে ঢেকে দিচ্ছে। আয়েশা আজাদ রুপের আগমনে আনন্দিত হোন। রুপকে বলে বলে মোরগ পোলাও রান্না করতে দেন। রুপও মায়ের সমেত আন্টির কথায় খুশি হয়।
সালাদ তৈরি করতে করতে রুপের মনে পড়ে প্রথম দিন আজাদ সাহেবের সাথে দেখা হওয়ায় কথা।
” আমার ছেলে অনেক হট কি বলি গরম তাই তো শসা খায়।”
আজাদ সাহেবের কথা মনে করে রুপ হাসে। রপ মনে মনে বলে, সত্যি আঙ্কেল আপনার ছেলে খুব গরম! এজন্যই আজ শুধু শসা’ই খাওয়াবো। যেন মাথা ঠান্ডা হয়।
রুপের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে কানের কাছে কারো ফিসফিস কথার আওয়াজে,
” হাসছো কেন অপরুপ! আমার কথা চিন্তা করে? তুমি কি খেয়াল করেছো! তোমার হাসিতে গালে গর্ত হয়ে আসে! যাকে বলে টুল পড়া হাসি! উফ পাগল করা হাসি।”
রুপ কেঁপে উঠে কথার আওয়াজে। তাড়াহুড়ো করে নড়তে গেলে আবদ্ধ হয় নাদিফের সুঠাম বক্ষঃস্থলে। রুপ নাদিফের বক্ষঃস্থল বরাবর। নাদিফ এক প্রকার রূপকে দুই হাতের বন্ধনীতে আবদ্ধ করে রেখেছে। রুপের পিছনে আগুনের উত্তাপ,চুলা।
” তুমি রান্না করছো?”
রুপের দৃষ্টি জমিনে। নাদিফ রুপের একদম কাছাকাছি। পিছনের চুলার আঁচে রুপের পিঠ যেন উত্তাপে জ্বলে যাচ্ছে। রুপ নাদিফের কথার প্রত্যুওরে মাথা উপর নিচ করে তা দেখে নাদিফ মুচকি হাসে।
” তুভি জানো কি! আজকের একটা রীতি আছে। যেই রীতি তোমার পালন করতে হবে?”
” সরে দাঁড়ান।”
” আমাকে উপহার দিবে না?”
” আমার কাছে আপনাকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই।”
রুপের কথায় নাদিফ রুপের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে,
” আছে তো! আমার ভালোবাসায় ডুব দেয়া।”
কারোর আগমনের আভাস পেয়ে নাদিফ রুপের কাছ থেকে দূরে সরে যায়। ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করে ঢকঢক গলায় ঢালে।
” রুপ! পোলাও রান্না শেষ হয়েছে রে?”
” জ্বি আন্টি।”
আয়েশা আজাদ রান্নাঘরে এসে ছেলেকে দেখতে পেয়ে অবাক হোন পরমুহূর্তে পানি পান করতে দেখে কিছু মনে করেন না।
” আজ পোলাও রুপ রান্না করেছে?”
নাদিফ যে এতক্ষণ রুপের কাছাকাছি ছিলো সেটা যেন স্বপ্ন। নাদিফ না জানান ভান করে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে কথাগুলো। আয়েশা আজাদ ছেলের কথায় মুচকি হাসেন। রুপের কাছে গিয়ে রুপের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
” আজ তোর পছন্দের মোরগ পোলাও আমার ছোট মেয়েটা করেছে। দেখিস না কি সুন্দর সুগন্ধি বের হয়েছে! দেখবি খেতেও মজাদার হবে।”
নাদিফ রুপের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসে। আজ নাদিফ রুপের লজ্জা আরো বাড়াবে বলে মনে মনে ছক কশে।
” খাবার খাবো মা! টেবিলে খাবার দাও।”
রুপের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি হেসে নাদিফ চলে যায়। রুপ পড়ে মহা ফ্যাসাদে। এই নাদিফ যে কোন একটা কাণ্ড আজ ঘটাবে তার আভাস রুপ পাচ্ছে।
খাবার টেবিল যেন আজ মিষ্টান্নময়। হরেক রকমের মিষ্টান্ন দিয়ে ভরপুর। সাথে রয়েছে নাদিফের মোরগ পোলাও। খাবার টেবিলে আজাদ সাহেব, আয়েশা আজাদ, রাইসা, রুপও রয়েছে। নাবিল ফাহিমাকে নিয়ে পার্লারে। আজাদ সাহেব পর পর পাঁচটা মিষ্টি সাবার করেছেন আয়েশা আজাদের অগোচরে। আজকের দিনের একটা কঠোর নিয়ম রয়েছে। নাদিফের আহারের পূর্বে কেউ আহার করতে পারবে না। পানীয় দ্রব্য পান করে থাকতে হবে। কিন্তু আজাদ সাহেব আজ মহা খুশি। পাঁচটা মিষ্টি সাবার করে পেট ভরে টমেটো হয়ে আছে আর তা আজাদ সাহেবের প্রাণ প্রিয় স্ত্রী জানেন না।
রাইসা আজাদ সাহেবের পাশে বসেছে। আজাদ সাহেবের সকল কিছু ফোনে রেকর্ড করে রেখেছে আয়েশা আজাদের কথায়।
” আঙ্কেল! বিলাই মিষ্টি খায়।”
ফোনের দিকে তাকিয়ে রাইসা আজাদ সাহেবকে বলে। আজাদ সাহেব সত্যি সত্যি বিড়াল ভেবে বসলেন। খাবারের টেবিলের উপর নিচ পর্যবেক্ষণ করে বিড়াল না পেয়ে রাইসার দিকে প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকান। রাইসা দাঁত কেলিয়ে আজাদ সাহেবের দিকে ফোন তাক করে যেখানে স্পষ্ট আজাদ সাহেবের টুপটুপ করে মিষ্টি গেলা দেখাচ্ছে। আজাদ সাহেবের মুখ একটুখানি হয়ে যায়। রাইসার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,
” কি চাই?”
” ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে। রুপ সহ।”
আজাদ সাহেব কিছু একটা ভেবে প্রত্যুওরে বলেন,
” ছেলে বউ সন্তান সব যাবো। চলবে?”
রাইসা আজাদ সাহেবের কথায় খুশিতে গদগদ ভাব। আজাদ সাহেবকে আচ্ছা বলে দেয়।
এদিকে নাদিফ চুপচাপ বসে আছে। আয়েশা আজাদ এটা সেটা খাবার প্লেটে তুলে দিচ্ছেন ছেলেকে। কিন্তু ছেলে তাঁর মুখে কস্টিপ এঁটে বসে আছেন।
” কি হয়েছে আমার বাবাটার? খাবার কি আজ মন মতো হয়নি?”
নাদিফ মায়ের কথা শুনে কোণা চোখে রুপের দিকে তাকায় যেখানে রুপ আপাতত ব্যস্ত টেবিলের নিচের নাদিফের হাতের মুঠোয় বন্দি নিজের হাত ছুটাতে। রুপ অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নাদিফের দিকে। নাদিফ রুপের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলে,
” প্রতি বছর যেই হাতে মোরগ পোলাও রান্না হয় সেই হাত দিয়ে আমাকে খাইয়ে দিতে হয়। আমি ভাবছি এ বছর কি হবে!”
নাদিফের কথা শেষ হতেই আজাদ সাহেব বলে উঠে,
” এই বছর’ও একই হবে। যেই হাতে প্রতি বছর মোরগ পোলাও রান্না হয় সেই হাতে’ই আমার ছেলের মুখে অন্ন উঠবে।”
আজাদ সাহেবের কথা শেষ হতেই রুপ ভীষম খায়। এ কেমন কঠিন বার্তা রুপের কর্ণধারে আসলো তা ভেবেই রুপের কান্না চলে আসে। এদিকে আয়েশা আজাদ মনে মনে খুশিতে আটখানা। আয়েশা আজাদ’ই তো ছেলেকে সুযোগ করে দিলেন। আয়েশা আজাদও স্বামীর কথায় তাল মিলালেন,
” হ্যাঁ হ্যাঁ! পূর্বের রীতি তো পালন করতেই হবে। রুপ মা! তোমার কোন আপত্তি আছে নাদিফকে খাইয়ে দিতে?”
রুপের যেন আজ মৃত্যুর দিন। সকলের সামনে নাদিফকে খাইয়ে দেয়ার চেয়ে মরে যাওয়া’ই ভালো রুপের জন্য। নাদিফের হাতের মুঠোয় এখনও রুপের হাত। নাদিফ রুপের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,
” কি অপরুপ! তৈরি তো?”
নাদিফের কথা শেষ হতেই রাইসা বলে,
” আমি তৈরি আজকের দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দি করতে।”
রুপ রাইসার কথা শনে কটমট চোখে তাকায়। তা দেখে রাইসা বিড়বিড় করে বলে,
” পাগলি ক্ষেপেছে।”
রুপ অবস্থা নাজেহাল। আয়েশা আজাদ নাদিফের খাবারের পাত্রে খাবার পরিবেশন করলেন। রুপ পারছে না দৌঁড়ে চলে যেতে। নাদিফ হা করে বসে আছে রুপের হাতে খাবে বলে। পর মুহূর্তে নাদিফের মুখে দুষ্টু হাসির রেখা বিদ্যমান হয়ে আসে। নাদিফ স্বর একটু টেনে বলল,
” কই গো! খাইয়ে দাও?”
চলবে……….