#প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা
#আফসানা_মিমি
|আঠারো তম পর্ব |
” তোমরা দেখো গো আসিয়া,
আব্বা-আম্মায় আমায় কাইজ্জা করে
ধমকিয়া ধমকিয়া।”
সোফার ঘরে ফাহিমা ছাড়া সকলেই উপস্থিত। আলোচনা হচ্ছে ঘুরতে যাওয়া নিয়ে। ফাহিমাকে শাস্তি স্বরূপ আজ সারাদিন রান্নাঘরে থাকার জন্য বলা হয়েছে। সেই সকালের কান্ডের পর থেকে ফাহিমা রান্নাঘরে। কিছুক্ষণ পরপর উঁচু আওয়াজে সকলের উদ্দেশ্যে ক্ষমা চাইছে আর বিলাপ সুরে গান গাইছে।
ফাহিমার বিলাপ আপাতত কেউ শুনছে না।
আজাদ সাহেব কানে তুলো গুঁজে খাতায় লিস্ট করছেন। আয়েশা আজাদ পাশে বসে ফোনে জায়গা খুঁজে চলছেন। রাইসা আয়েশা আজাদের পাশে বসে আপাতত শীতে কাঁপছে। আজকের কাদায় গোসল করে যেন রাইসার একশত তিন ডিগ্রি জ্বর এসে গিয়েছে এজন্য শপের মালিকের কাছ থেকে ছুটি নিয়েছে।
নাদিফ সোফায় বসে আড়চোখে রুপকে দেখেছে। রুপ মাত্র গোসল সেরে এসেছে। মাথার লম্বা কেশব ভালোভাবে মুছতেও সময় পায়নি। মাথায় কোনরকম ঘোমটা টেনে চলে আসে। নাদিফ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অপরুপকে দেখছে। ভেজা চুল থেকে টপটপ করে পানি ঝড়ছে। মাথায় লম্বাটে ঘোমটা দেয়া, চোখে চশমা। ঘোমটা হয়তো ভেজা চুল ডেকে রাখার জন্য দিয়েছে রুপ কিন্তু এই বেশেও নাদিফের কাছে পৃথিবীর সেরা অপরুপ মনে হচ্ছে। রুপ চশমার আড়ালে নাদিফের চাহনি লক্ষ্য করছে। কিছুক্ষণ পর পর নাদিফের মুচকি হাসি চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে না রুপের। রুপ নিজেকে সংযত করে নাদিফের নজর থেকে আড়ালে চলে যায়। অন্যদিকে ফিরে মুচকি হাসে।
রুপ জরুরি তলবে নিচে এসেছে। আজাদ সাহেব ডেকেছেন কিন্তু এখন উনার কোন সাড়া শব্দ নেই।
” বাবা-মা, চলে যাবো কি? তোমাদের ড্রামা কি আরো বাকী আছে?”
নাদিফের কথায় সকলে নড়েচড়ে বসেছে। ইতিমধ্যে আজাদ সাহেব কান থেকে তুলা বের করে দাঁত কেলিয়ে হাসছেন। আজাদ সাহেবের হাসির রহস্য উদঘাটন করতে পারছে না কেউ। অবশেষে আয়েশা আজাদ স্বামীর উদ্দেশ্যে বলেন,
” কি হয়েছে তোমার? আরো কাদায় শরীর মাখাতে ইচ্ছে করছে? ইচ্ছে হলে চলো। কাদায় এবার শরীর না মাখিয়ে, কাদা পেটের ভেতর ঢুকিয়ে দিবো।”
আয়েশা আজাদেরকথা শুনে আজাদ সাহেবের ভাবগতির কোন পরিবর্তন হলো না। উল্টো দাঁত কেলিয়ে বললেন,
” ভাবছি চব্বিশ নাম্বার হানিমুনটা সেড়ে ফেলি এই সুযোগে। চলো কক্সবাজার যাই সকলে।”
আজাদ সাহেবের কথা শুনে নাদিফ খুক খুক করে কাশি দিতে শুরু করে। রুপ নাদিফের অবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে যায়। তাড়াহুড়ো করে দৌঁড়ে খাবারের টেবিল থেকে গ্লাসভর্তি পানি নিয়ে আসে নাদিফের জন্য। নাদিফের মাথার পেছনে হাত দিয়ে নিজে পান করিয়ে দেয় পানি। এদিকে নাদিফ পানি পান করা অবস্থায় রুপকে দেখছে। রুপ নাদিফের জন্য এতটা চিন্তিত ছিল যে দৌঁড়ে আসার জন্য রুপের মাথা থেকে ওড়না পড়ে গিয়েছে তার খেয়াল নেই রুপের। যার ফলে রুপের ভিজে থাকা মাথার চুল ললাটের উপর এসে পড়ে।
নাদিফের নিঃশ্বাস যেন ভারী হয়ে আসছে রুপকে এতটা কাছে দেখে। নিজেকে সংযত করে রুপের উদ্দেশ্যে বলে,
” এদিকে আমি নিজের প্রেয়সীকে ভালোবাসা বুঝাতে অক্ষম ঐদিকে আমার বাবা-মা হানিমুন করতে এখনও প্রস্তুত এই বয়সে। কবে বুঝবে তুমি অপরুপ! আমারও তো ইচ্ছে হয় বিয়ের পর হানি,,,,,,
রুপ পরের লাইন আর শুনতে ইচ্ছুক না। এজন্য নাদিফের ঠোঁটে হাত দিয়ে বসলো যেন লাগামহীন নাদিফ আর কিছু বলতে না পারে।
রূপের এমন কাজে নাদিফ হাসে এবং রুপকে লজ্জায় ফেলার জন্য আরেকটা কাজ করে বসে। রুপের হাতে নিজের অধর ছুঁয়ে দেয় সকলের অগোচরে। রুপকে আরো লজ্জায় ফেলে দেয়। রুপ লজ্জা পেয়েছে, ভীষণ লজ্জা। কিন্তু তবুও রুপ অটল নাদিফের ঠোঁট থেকে নিজের হাত সরালো না। সরালে নয়তো দেখা যাবে সকলের সামনে লাগামহীন, নির্লজ্জ নাদিফ বাকি কথা বলে বসেছে, এই ভয়ে।
এদিকে ফাহিমা রান্না ঘর থেকে বাহিরে কাশির শব্দ শুনে দৌঁড়ে আসে। নাদিফের ঠোঁটের উপর রুপের হাত খানা দেখে ফাহিমা নিজের মস্তিষ্কে নিজ বানানো ভাবনা বসায়। ফাহিমা ভাবে নাদিফের হয়তো কিছু হয়েছে। তাই বিচলিত হয়ে দৌঁড়ে সকলের সামনে এসে বলে,
” ইয়া আল্লাহ! ছোট ভাইয়ের তো বমি হবে মনে হচ্ছে! বমি তো হয় শুধু একটা কারণেই, পেট খারাপ হলে বা পেটে গ্যাস হলে। ভাইয়ার কি পেট খারাপ হয়েছে? এই রুপ তুমি ভাইয়ার মুখের সামনে থেকে হাত সরাবে না। নয়তো দেখা যাবে ছোট ভাইয়া এখানেই ওয়াক ওয়াক করে ভাসিয়ে দিচ্ছে।”
ফাহিমার কথা শুনে সকলে ফাহিমার দিকে রক্তিম চোখে তাকায়। এতে ফাহিমা ভয় পেয়ে যায়। সকলের উদ্দেশ্যে মিনমিন করে বলে,
“এবার আমি কোন কাজের কথা বলিনি। যা সত্যি তাই বলেছি। তবুও সকলে রেগে আছে কেন আমার উপর?”
আজাদ সাহেব এবার এগিয়ে আসলেন বোকা পুত্রবধূর দিকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
” মা রে! আমার ঘরে গিয়ে দেখ, বুকশেল্ফের দ্বিতীয় তাকে হরলিক্সেরর বয়াম রাখা আছে। সেখান থেকে তিন চামচ হরলিক্স একসাথে মুখে পুড়বি তারপর সেটা পানি দিয়ে গিলে খাবি। তাহলে তোর মাথায় একটু বুদ্ধি সুদ্ধি হবে। যা মা! এখানে যদি আর এক মিনিট থাকিস! তাহলে তোর ক’ল্লা কাঁ’টা যাবে।”
আল্লাহ জানে ফাহিমা কি বুঝেছে। শশুরের কথা শুনে হাসি মুখে চলে গেল উপরে।
এদিকে রুপ সেই কখন নাদিফের ঠোঁটের উপর থেকে নিজের হাত গুটিয়ে নিয়েছে। ফাহিমার কথায় বেশ লজ্জা পেয়েছে রুপ এমনকি নাদিফের করা কাজেও বেশ লজ্জা পেয়েছে রুপ।
সকালে যখন ফাহিমাকে দিকে তাকাতে ব্যস্ত ঠিক তখন নাদিফ আরেকটা কাজ করে বসে। সকলের অগোচরে রুপের হাতের পিঠের অংশ চুমু খেয়ে বসে। এত রুপ আরো লজ্জা পায়। ছিটকে দূরে সরে যায় অনেকটা। নাদিফের দিকে কিছুক্ষণ রাগী চোখে তাকিয়ে আয়েশা আজাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় আড়চোখে দুষ্টু নাদিফের দিকে নজর রেখেই।
পরিবেশ থমথমে। কারোর মনের মধ্যে এখন ঘন্টা বাজছে, তো কারোর মনের মধ্যে সংশয়,আবার কারো মনে দুষ্টু বুদ্ধি। আজাদ সাহেব সকলকে স্বাভাবিক করার জন্য খানিকটা কেশে বলতে শুরু করলেন,
” আমি কখনো কথা দিয়ে কথার খেলাফ করিনি। আজও তাই। রাইসাকে বলেছিলাম ঘুরতে নিয়ে যাবো পরিবারের সকলের সাথে সুতরাং আমি আমার কথা রাখছি। আমরা আগামীকাল সারাদিন ঘুরবো, অনেক আনন্দ করবো, আগামীকাল শুধু পারিবারিক সময়; অফিস-আদালত, পড়াশোনা, ঘোরাঘুরি সব কিছু বাদ। বুঝেছ তোমরা দুজন?”
আজিদ সাহেব রুপ নাদিফের দিকে তাকিয়ে কথা বলছিলেন। যখন নাদিফ রুপকে চোখে চোখে জ্বালাতন করে যাচ্ছিলো। আয়েশা আজাদের পাশে এসে রুপের সাথে দুষ্টু মিষ্টি কথা বলছিলো। রুপ এবং নাদিফের কথাগুলো এমন ছিল,
” তুমি এত সুন্দর কেন অপরুপ?”
” আপনার নজর নিচে রাখুন। নজর লাগবে আমার উপর।”
” আমি তো আমার অপরুপের উপর নজর দিতে প্রস্তুত। যেন অন্য কেউ নজর দিতে না পারে।”
” আপনার চোখ নষ্ট হয়ে যাবে, অন্ধ হয়ে যাবেন অতি শীঘ্রই। তারপর চৌমাথায় বসে থালা নিয়ে ভিক্ষা করবেন।”
নাদিফ তখন হেসে উঠে। নাদিফের হাসি দেখে রুপও হেসে ওঠে। এর মাঝে আজাদ সাহেবের কথা দুইজনের কর্ণধারের পৌঁছায় না। এতক্ষণ আজাদ সাহেবের বলা কথা একটাও এই দুইজন মানব-মানবী কানে পৌঁছেনি। রুপ অসহায় চোখের দিকে তাকিয়ে আজাদ সাহেবের দিকে। রুপ বিড়বিড় করে বলছে,
” নিজেতো কেস খাবে খাবে, আমাকেও সাথে খাওয়াবে। বজ্জাত লোক একটা।”
রুপের অবস্থা দেখেন নাদিফ মুচকি হাসে। বাবার উদ্দেশ্যে বলে,
” পরিবারকে সময় দেয়ার জন্য নাদিফ সব সময় হাজির থাকবে। চিন্তা করো না গতকাল তোমার আগে আমি রেডি থাকবো। শুধু বলে দাও কোথায় যাবে।”
” আসলামপুর যাবো। তোর দাদার বাড়ি, চলবে?”
আজাদ সাহেবের কথা শোনে নাদিফ কিছু একটা ভেবে নিলো তারপর রুপের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি হেসে বলল,
” তোমার বাসার শিক্ষিকাকে বলে দাও, এক সপ্তাহের জন্য যেন কোচিং থেকে ছুটি নেয়। কারণ দাদা বাড়ি গেলে এক সপ্তাহ আগে ফিরবো না আমরা। এখন আমার প্রস্তাব যদি তোমাদের ভালো থাকা লাগে তাহলে ভেবে দেখতে পারো।”
নাদিফ রূপের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিয়ে চলে যায়।
আজাদ সাহেব ছেলের কথায় ভীষণ খুশি। অনেকদিন হয় গ্রামে যাওয়া হয় না। আসলামপুরে আজাদ সাহেবের আপন কেউ বেঁচে নেই। শুধুমাত্র চাচাতো ভাই সন্তান স্ত্রী রয়েছে সেখানে। আসলামপুরের বাড়িতে দুইজন মানব মানবি থাকে দেখাশোনা করার জন্য।
ফাহিমা সকলের সামনে আসে মন খারাপ করে। ফাহিমা আড় পেতে সকলের কথা শুনেছে এতক্ষণ।
” মানছি আমি ভুল করেছি। তাই বলে আমাকে রেখে দাদা বাড়ি যাবেন বাবা?”
আজাদ সাহেবের খুব মায়া হলো ফাহিমার উপর। ফাহিমাকে হাতের ইশারায় কাছে ডেকে অনে।
” ব্যাগ গুছিয়ে নাও মা। তুমি সহ আমরা সবাই যাবো আসলাম পুরে। সুন্দর করে সাজবে কিন্তু মা! আমি আমার এই মাকে যেন সকলের আগে তৈরি দেখি।”
ফাহিমা বাবার কথায় খুব খুশি হয়। আয়েশা আজাদের দিকে তাকাতে আয়েশা আজাদও সায় জানায়।
——–
ঘরে এসে রাইসা টাকা গুনে যাচ্ছে । বিছানার উপর এক হাজার টাকার তিন চারটে নোট বিছিয়ে রাখে। রাইসার কান্ড দেখে রুপ প্রশ্ন করে,
” কি ব্যাপার রাইসা? টাকা এভাবে বিছিয়ে রেখেছো কেন? তোমার কি টাকা বেশি হয়েছে! বেশি হলে আমাকে দিয়ে দাও। এই মাসে আমি খুব অভাবে আছি।”
প্রতুত্তরে রাইসা বলে,
” গত মাসে দুইটা জামা কিনেছিলাম। এই মাসে ফোন। ভাবছি হাতে যেই টাকা আছে সেই টাকা দিয়ে আরো দুইটা জামা কিনবো। এক সপ্তাহের জন্য বেড়াতে যাচ্ছি। ভালো জামা না থাকলে কিভাবে হবে!”
রাইসার প্রফুল্লতা দেখে রুপ মলিন হাসে। রুপের এত ইচ্ছে নেই সাজগোজের, বিলাসিতা জীবন যাপনের। রুপের যা আছে তা নিয়েই রুপ সন্তুষ্ট। রুপ কিছু না বলে বাহিরে চলে আসে। প্রেম নীড়ের বাগানের পাশে দু’তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাগানের দিকে দৃষ্টিপাত করে,
” অপরূপ একটা কথা রাখবে?”
রুপ বাহিরের দিকে তাকিয়েছিল এতক্ষণ। নাদিফের কথা শুনে ভয় পেয়ে যায়। পিছনে ফিরে তাকায়।
“কি কথা?”
” এভাবে’ই মাথায় ঘোমটা দিয়ে রাখবে সবসময় আমার সামনে। তোমাকে দারুন লাগে। ইচ্ছা করে সর্বক্ষণ সামনে বসিয়ে তোমাকে দেখি।”
চলবে…….