প্রেমময়ী তুমি পর্ব-৩০+৩১

0
549

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_৩০
#নিশাত_জাহান_নিশি

“সোহানী দেখো। তুমি তো জানো আজ-ই আমার বিয়েটা ভেঙেছে। আর আজই আমার মা-বাবা জোর করে তোমার সাথে আমার বিয়েটা দিয়ে দিলো! নেহাত মা-বাবার কথা কখনো ফেলতে পারিনা বলে বাধ্য হয়েই বিয়েটা করা। তবে এই মুহূর্তে আমি বিয়েটাকে মন থেকে মেনে নিতে পারছিনা! আমি চাইছি তুমি কয়েকমাসের জন্য খালামনির কাছে থাকো! যখন আমার মন শান্ত হবে পরিস্থিতি অনুকূলে আসবে তখন আমি নিজে গিয়ে তোমাকে ঐ বাড়ি থেকে নিয়ে আসব। মন থেকেও তোমাকে হয়তো মেনে নিতে পারব!”

সদ্য বিয়ে করা বরের মুখ থেকে এই হৃদয়বিদারক কথাগুলো শুনে অজান্তেই সোহানীর চোখের কোণে জল জমে এলো! বুকটা অদ্ভুত যন্ত্রণায় ভারী হয়ে এলো। হাত-পা কাঁপতে লাগল। ঘোমটার নিচ থেকে পূর্ণ দৃষ্টিতে এক পলক নীড়ের দিকে তাকালো। নিজের মনে অভিসন্ধি কষিয়ে বলল,,

“সিরিয়াসলি নীড় ভাইয়া? আমাকে মন থেকে মানার জন্য আপনার এতোটাই সময়ের প্রয়োজন যে আপনি এখন আমাকে জোর করে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে চাইছেন? বিয়ের মতো এতো খুশির একটা দিনে এই করুন প্রস্তাবটা আমার কাছে রাখতে পারলেন? বুকটা একটুও কেঁপে উঠল না আপনার? এতোটাই নিষ্ঠুর, নির্মম, পাষাণ আপনার মন? তবে কি আপনার সাথে আমার প্রণয়ের আরও অনেক দেরি নীড় ভাইয়া? আদৌ এই ক্ষুদ্র জীবনে আমাদের প্রণয় হবে তো?”

অভিমানে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো সোহানী। নাক টেনে দুঃখ সংবরণ করল। কিছুতেই তার মনোক্ষুণ্ণতা বুঝাতে দিলো না। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার মিথ্যে হাসির আশ্রয় নিলো! মাথা থেকে এক ঝটকায় ঘোমটাটা সরিয়ে নিলো। নীড়ের দিকে সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। জোরপূর্বক হেসে বলল,,

“আপনার শর্তে আমার কোনো আপত্তি নেই নীড় ভাইয়া! আপনার কথার উপরে আমার আর কোনো কথা থাকতে-ই পারেনা! আপনি হয়তো ঠিক-ই বলেছেন নীড় ভাইয়া, একটা সম্পর্ক হুট করেই মেনে নেওয়া যায় না। তার জন্য অনেকটা সময়ের প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে আপনি যতো সময় চান আমি দিতে রাজি!”

অজান্তেই নীড় শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সোহানীর দিকে! অপলক সোহানীর দিকে তাকিয়ে থেকে তার কথায় অভয় দিয়ে বলল,,

“হ্যাঁ। আর কিছুদিন পরেই তো তোমার ফাইনাল এক্সাম শুরু! ঐদিকে তোমার ফাইনাল ইয়ারটাও কমপ্লিট হয়ে যাবে আর এইদিকে আমিও নিজেকে যতোটুকু সম্ভব গুছিয়ে নিতে পারব। খালামনির কাছে থাকলে তোমার পড়াশোনাটাও ভালো হবে। ভালো একটা রেজাল্ট হবে। পাশ আউট হওয়ার পর তুমি চাইলে মাস্টার্সও কমপ্লিট করতে পারো আবার চাইলে চাকরী বাকরীর জন্যও ট্রাই করতে পারো। সববিষয়ে আমাকে পাশে পাবে! তোমার পড়ালেখার খরচ চালানো থেকে শুরু করে তোমার ভরণপোষণের খরচও আমি নিজেই বহন করব। কারণ এখন থেকে তুমি আমার দায়িত্ব! সেইদিক থেকে আমি আমার দায়িত্ব শতভাগ পালন করব। আর তোমার কাজ হবে শুধুমাত্র ক্যারিয়ারে ফোকাস করা। ভালো একটা রেজাল্ট করা।”

হাসিমুখে সোহানী মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালেও মনে মনে তার তুষের আগুন জ্বলছে! বাস্তব চিন্তা-ধারা থেকে নীড় কথাগুলো শতভাগ সঠিক বললেও সোহানীর মন তা কোনোমতেই মানতে চাইছে না। নীড়ের কাছাকাছি থাকতে চাইছে! সারাক্ষণ নীড়কে চোখে চোখে হারাতে চাইছে। অন্যসব হাজবেন্ড-ওয়াইফরা যেভাবে পরস্পর মিলেমিশে থাকে, তাদের মধ্যে যেরকম ভালোবাসা থাকে, দু’জন একই ছাদের তলায় থাকে, একে অপরের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়, যখনই ইচ্ছে হয় বরকে এক নজর দেখতে পারে, দিন শেষে বরের বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে সোহানীও ঠিক সেই রকম হাজবেন্ড-ওয়াইফের সম্পর্ক-ই চাইছে। একদম দূরে দূরে থাকতে চাইছে না।

সোহানীর সম্মতি পেয়ে নীড় তড়িৎ বেগে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। ভ্যাপসা গরমের ঝাঁজে নীড় পাঞ্জাবির প্রথম বাটনটা খুলে কয়েকদফা তপ্ত শ্বাস ছাড়ল। সোহানীর দিকে একবার গরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ক্ষীণ গলায় বলল,,

“এই বিষয়ে আমি মায়ের সাথে কথা বলব। তোমাকে নতুন করে কিছু বলতে হবেনা। তুমি শুধু রুলস অনুযায়ী চলবে আর নিজের খেয়াল রাখবে। বাকি সব আমি বুঝে নিব। আর হ্যাঁ, তোমার সুবিধা-অসুবিধা সব আমার কাছে জানাবে। ভালো-খারাপ সবকিছু। কোনোকিছু আমার থেকে আড়াল করার প্রয়োজন নেই ওকে?”

সোহানী আবারও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। কিছু একটা ভেবে সে তড়িঘড়ি করে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। কাপড়ের আঁচলটা হাতে নিয়ে আকস্মিকভাবেই নীড়ের মুখোমুখি দাঁড়ালো! নীড়ের ঘাড়ের দিকে তৎপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ঘাড় বেয়ে অকাতরে ঘাম ঝড়ছে নীড়ের! ব্যস্ত হয়ে সোহানী নীড়ের ঘাড়ের দিকে খানিক উঁকি দিলো। নীড় ভ্রু কুঁচকে সোহানীর দিকে তাকালো। নির্বোধ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী হলো?”

সোহানী নিরুত্তর! নিজের কাজে ব্যস্ত সে। প্রবল ভালোবাসা এবং যত্নে আবিষ্ট হয়ে সে একটু একটু করে নীড়ের ঘাড়ের ঘামগুলো মুছে দিলো। নীড় না চাইতেও আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে সোহানীর দিকে তাকালো! সোহানীর কোমল হাতের পরশ পেতেই উত্তেজনায় নীড় খানিক নড়েচড়ে উঠল! মেয়েদের নরম হাতের স্পর্শ যে এতোখানি লোমহর্ষক হয় তা আগে কখনো টের পায়নি নীড়! প্রথমবারের মতো এই বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন হলো তার। দ্বিধায় জর্জরিত নীড়৷ সোহানীর প্রতিটি উত্তপ্ত শ্বাস তার মনে শ্রাবণ হাওয়ার বেগে ছোটোছুটি করছিল! দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার। তাৎক্ষণিক সোহানীর সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো নীড়৷ পাঞ্জাবির কলারটা ঠিক করে মাথা চুলকে রুম থেকে প্রস্থান নিলো। সোহানী আহত দৃষ্টিতে নীড়ের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। বিষন্ন মনে বলল,,

“আপনি এতো নিষ্ঠুর কেন নীড় ভাইয়া? আমার ভালোবাসার একটুখানি স্পর্শেও কী আপনার মনে একটুখানি প্রেম/ভালোবাসার দাগ কাটেনি?”

,
,

গভীর রাত। নিস্তব্ধ ধরা। চাঁদের আলোয় পুলকিত চারিপাশ। যতদূর দৃষ্টি যাচ্ছে ততদূরই কেবল জোছনার মাখামাখি দেখা যাচ্ছে। গোটা ধরণী যেনো মায়াপুরীতে পরিণত হয়েছে। কোথাও কোনো কোলাহলের শব্দ নেই। না আছে প্রকৃতির একছটা গুঞ্জন, না আছে জনমানবের কোনো কলরব। তবে ক্ষণে ক্ষণে দমকা হাওয়া এসে সমস্ত নীরবতার তাল কেটে দিচ্ছে! শো শো আওয়াজে আশপাশটাকে এক মোহময় তরঙ্গে মাতিয়ে তুলছে। শরীরটাকে মনোমুগ্ধকর শীতল বাতাসে ভাসিয়ে দিচ্ছে। দেহ এবং মনকে প্রফুল্ল করে তুলছে। আকাশের মধ্যিখানে জ্বলজ্বল করে ওঠা মায়াবী চাঁদটা থেকে কিছুতেই যেনো দৃষ্টি সরাতে পারছেনা নূর! তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে মাহিন। ক্লান্তি দূর করতে সে অকাতরে সিগারেট ফুঁকছে! নূরকেও সাধছে সিগারেট খেতে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো নূর আজ কিছুতেই সিগারেটে হাত দিচ্ছে না! ভেতর থেকে কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। খুবই বিমূর্ষ দেখাচ্ছে তাকে। মাহিন বিষয়টাতে খুব অবাক হলো। কৌতূহলী গলায় নূরের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“এই কী হয়েছে নে তোর? এভাবে মুখ ফুলিয়ে রেখেছিস কেন?”

নূর আবারও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে মায়াবী চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল। ভাবুক হয়ে ভরাট গলায় বলল,,

“আই থিংক, রোজকে আমার সরি বলা উচিৎ!”

মাহিন ভ্রু কুঁচকে নূরের দিকে তাকালো। সচকিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“আশ্চর্য! তুই কেন রোজকে সরি বলতে যাবি হ্যাঁ? অন্যায় তো রোজ তোর সাথে করেছিল।”

“রোজ আমার সাথে কোনো অন্যায় করেনি মাহিন! রোজ তখন যা করেছিল একদম ঠিক করেছিল। সে একজন প্রকৃত মনের মানুষ ছিল বলেই এতো বড়ো মহান একটা কাজ সেদিন করতে পেরেছিল! জানিস? আমরা ছেলে-মেয়েরা না? বড্ড স্বার্থপর! আমরা সবসময় নিজের ভালো থাকাটাকে প্রাধান্য দিই! কখনো মা-বাবার দিকটা ভেবে তাদের ভালো থাকাটাকে প্রাধ্যান্য দিই না। কখনো এটা ভাবী না যে, তারা আমাদের সেই ছোটোবেলা থেকে কতো কষ্টে, যত্নে, ভালোবাসায়, কতো ত্যাগ তিতিক্ষার পর আমাদের লালন পালন করল, নিজের শখ-আহ্লাদ সব বিসর্জন দিয়ে আমাদের মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলল, আমাদের ভালোর জন্য নিজেদের ভালো থাকাকে ত্যাগ করল, আমাদের সুখের জন্য নিজেদের সুখ জিনিসটা কী তা ভুলতে বসল! তাদেরও তো আমাদের কাছ থেকে কিছু চাওয়ার বা পাওয়ার থাকতে পারে। আমাদের ঘিরে অনেক আশা-ভরসা থাকতে পারে। কিন্তু না, আমরা তা মানতে নারাজ! আমরা কেবল নিজেদের দিকটাই ভাবতে ইচ্ছুক। তুই ঐ অনু মেয়েটাকে দিয়েই দেখ না! কীভাবে সে নিজের ভালো থাকাটাকে, নিজের সুখে থাকাটাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তার পরিবারকে কষ্ট দিলো? গোটা সমাজের কাছে পরিবারের মানসম্মান নষ্ট করল, সাথে আমার ভাইয়া এবং আমার পরিবারকেও কষ্ট দিলো! জানিস? এই ঘটনাটা থেকে আমি রিয়েলাইজ করতে পেরেছি, সেদিন রোজ যা করেছিল একদম ঠিক করেছিল! সঠিক সিদ্ধান্তটাই সে নিয়েছিল। হয়তো এর বিপরীতে আমি এবং রোজ সাময়িক কষ্ট পেয়েছি বা এখনো পাচ্ছি তবে আস্তে ধীরে সেই আঘাতের জায়গাটাও মুছে যাবে! আমরা একদিন সব মানিয়ে নিতে শিখে যাব। তবে এখানেও ভাগ্য বলে একটা কথা আছে! উপর ওয়ালা সৃষ্টির শুরু থেকেই আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে রেখেছেন। আমার ভাগ্যে রোজ ছিল না! তাই আমি তাকে পাইনি। তদ্রুপ নীড় ভাইয়ার ভাগ্যেও অনু মেয়েটি ছিল না। সোহানী ভাবি ছিল। তাই তো অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই তাদের বিয়েটা আজ হয়ে গেল।”

নূরের কাঁধে হাত রাখল মাহিন। নূরের সাথে একমত পোষণ করে বলল,,

“তুই খারাপ কিছু বলিস নি নূর। আসলেই আমরা ছেলে-মেয়েরা খুব স্বার্থপর। সবসময় নিজের দিকটাই ভাবী। মা-বাবার দিকটা কখনো ভাবী না।”

“উঁহু। তোর ক্ষেত্রে কখনো এই কথাটা যায়না মাহিন! তুই ছোটোবেলা থেকেই অনেককিছু সেক্রিফাইজ করে আসছিস! চৌদ্দ বছর বয়স থেকে আমাদের ছেড়ে মা-বাবাকে ছেড়ে দূরদেশে গিয়ে সেলিনা আন্টির কাছে থাকছিস! সেদিন এক কথায় মা-বাবার কথা মেনে নিয়েছিলি তুই। তাদের সিদ্ধান্তের উপর একটা কথাও বলিস নি। কোথায় তুই স্বার্থপর হলি বল?”

মাহিন শুকনো হাসল। নূরের চোখের দিকে তাকিয়ে ধীর গলায় বলল,,

“তবে আমি আর সেক্রিফাইজ করতে রাজি নই নূর! এবার থেকে আমি আমার মা-বাবার কাছে, আমার ভাইদের কাছে থাকতে চাই। আমার আপন মানুষদের সাথে থাকতে চাই। এবার আমিও স্বার্থপর হতে চাই নূর!”

তাৎক্ষণিক মাহিনকে জড়িয়ে ধরল নূর। স্থির গলায় বলল,,

“তোকে আর কোথাও যেতে হবেনা মাহিন। মা-বাবা তোকে আর কোথাও যেতে দিবেনা! এবার থেকে তুই আমাদের সাথেই থাকবি। ডিসিশান নেওয়া হয়ে গেছে অলরেডি।”

মাহিন মৃদু হাসল। খুশিতে নূরকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরল। প্রফুল্ল গলায় বলল,,

“আমি জানতাম, মা-বাবা এবার আমাকে আর কোথাও যেতে দিবেনা। তোকে বুঝাতে পারবনা নূর, আমি ঠিক কতোটা হ্যাপি হয়েছি।”

দুইভাই মিলে গলাগলি করে নিজেদের মধ্যকার সব সুখ-দুঃখ বন্টন করে মধ্যরাত প্রায় তিনটার দিকে নিজেদের রুমে গেল। আয়মন বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে আছে। সাদমান রাত বারোটার পরে জরুরী কাজে তার বাড়ি ফিরে গেছে। আয়মনকে ঠেলতে ঠেলতে দুইভাই বিছানার এক কর্ণারে নিয়ে গেল! আয়মনকে নিয়ে অনেক হাসি-ঠাট্টাও করল। কোনোদিকেই হুশ নেই আয়মনের। সে তো ব্যস্ত ঘুমপরীদের সাথে ডেটিংয়ে! শুধু আয়মন কেন? এতো গুরুত্বপূর্ণ ডেটিংয়ে থাকলে কী দিন-দুনিয়ার খবর থাকে কারো? কিছুক্ষণ ঠাট্টা-মশকরা করার পর নূর এবং নীড় আয়মনের পাশে শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল।

নীড় এবং সোহানী একই বিছানায় দুই পাশ ফিরে শুয়ে আছে! রাগে বুদ হয়ে সোহানী বিছানার উপর থেকে বাহারী এবং তাজা ফুলের পাপড়িগুলো ঝেড়ে তাদের ঘুমানোর ব্যবস্থা করেছে। নীড় চোখ বুজে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লেও সোহানী এখনো অবধি চোখ লাগাতে পারেনি। চোখের জল ছেড়ে সে অকাতরে কাঁদছে। পিছু ফিরে বার বার নীড়ের পেছন পানে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে! একটিবার নীড়কে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছে প্রকাশ করছে! মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছে করছে সত্যিই সোহানী নীড়কে মন থেকে খুব ভালোবাসে! তবে অলক্ষুণে পরিস্থিতির চাপে পড়ে কিছুই মুখ ফুটে পারছেনা সে। সোহানীর সবথেকে খারাপ লাগার জায়গা হলো কাল সকালের দিকেই তারা কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাবে! সাবরিনা আবরার এবং হাবিব আবরারের সাথে এই বিষয় নিয়ে কথা বলা হয়ে গেছে! প্রথম দিকে তারা রাজি হতে না চাইলেও পরে সোহানীর পরীক্ষার কথা ভেবে তারা রাজি হয়ে গিয়েছে। নীড় যেভাবে বিষয়টা তাদেরকে বুঝিয়েছে তারাও বিষয়টাকে ঠিক সেভাবেই বুঝে নিয়েছে। পরে একযোগ হয়ে সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সোহানীর ফাইনাল পরীক্ষার পর ধুমধাম করে অনুষ্ঠান করে সোহানীকে এই বাড়িতে উঠিয়ে আনবে! সোহানীর এখন কুমিল্লা যাওয়া নিয়ে সোহানীর মা-বাবা খারাপ কিছু খুঁজে না পেলেও সাবরিনা আবরার বিষয়টাকে খারাপ দৃষ্টিতে-ই দেখেছেন! তবে কাউকেই এই ব্যাপারে কিছু আঁচ করতে দেননি। বিষয়টা ভিতরে ভিতরে রেখেছেন। নীড়ের সাথে পরে এই বিষয়ে খোলামেলা কথা বলবেন বলে মনে মনে ভেবে রেখেছেন।

চাঁদ, জায়মা, নাদিয়া, সাদিয়া এবং রুহি নিজেদের রুমে নাক টেনে ঘুমুচ্ছে। মধ্যরাত দুটো পর্যন্ত তারা নিজেদের রুমে বসে নাচ, গান করেছে! সোহানীর বিয়ে হয়ে যাওয়ার খুশিতে তারা যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে বসেছে! চাঁদ অনেকবার চেষ্টা করেছে সোহানী এবং নীড়ের বাসরঘরে হানা দিতে! তবে জায়মা চাঁদের সেই চেষ্টাকে বার বার দমিয়ে দিয়েছে! জোর করে আটকে রেখেছে চাঁদকে। কারণ, জায়মা কিছুটা হলেও আঁচ করতে পেরেছে নীড় এবং সোহানীর মধ্যে সম্পর্ক ভালো নয়! নীড় কোনো কারণে এখনো সোহানীকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি।

_____________________________________

ঘড়িতে সকাল দশটা চলমান। বাড়ির লোকজন এতক্ষণে ঘুম ভেঙে উঠেছে মাত্র! কাল সারাদিনের ধকলে সবার শরীরের অবস্থা বেহাল। তাই আজ বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে গতকালের সমস্ত ক্লান্তি, অনিদ্রা এবং ধকল কাটিয়ে উঠেছে সবাই। তবে সোহানী এবং নীড় এখনো ঘুম ভেঙে উঠতে পারেনি! ঘুমের ঘোরে দুজন দুজনের গাঁয়ের সাথে মিশে আছে! নীড়ের ডান হাত সোহানীর কোমর জড়িয়ে আছে! সারারাত নির্ঘুম থাকার দরুন সোহানীর ঘুমের রেশটা নীড়ের তুলনায় একটু বেশি। তাই সে তার শরীরে নীড়ের হাতের স্পর্শ টের পাচ্ছেনা। নীড় বেশ আরাম করে নড়েচড়ে ঘুমুচ্ছে। ধীরে ধীরে সোহানীর শরীরের সাথে একাত্নভাবে মিশে যাচ্ছে! সোহানীর প্রতিটি শ্বাস-নিশ্বাসের শব্দ তার কানে প্রখরভাবে বেজে উঠছে। কিছুক্ষণ পর পর তার কান দুটো খাড়া হয়ে উঠছে। তবে ঘুমের তাল কেটে সে কিছুতেই ওঠতে পারছেনা। একটু পর যখন নীড় ঘুম ভেঙে ওঠে দেখবে সোহানী তার শরীরের সাথে এতোটা মিশে রয়েছে তখন তার প্রতিক্রিয়া ঠিক কীরূপ হবে তা ভেবেই হয়রান আমি!

চাঁদ ফ্রেশ হয়ে মাত্র ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলো। টাওয়াল দ্বারা মুখ মুছতে মুছতে ধীর পায়ে হেঁটে বেলকনিতে দাঁড়ালো। সকালের তেজী রোদের ঝলকানিতে চোখ মেলে সে পূর্ণ দৃষ্টিতে এখানে ওখানে তাকাতে পারছিল না। রোদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে সে পিটপিটে দৃষ্টিতে বাড়ির আঙ্গিনায় চোখ বুলালো। অমনি চোখগুলো তার চকচক করে উঠল! ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক প্রফুল্ল হাসির রেখা। বুকটা তার দুড়ুদুড়ু করে কাঁপতে আরম্ভ করল। উত্তেজনায় হাত-পা নড়েচড়ে উঠল! আর এক মুহূর্ত ব্যয় করল না চাঁদ। টাওয়ালটা মাটিতে ছুড়ে ফেলে এক দৌঁড়ে রুম থেকে প্রস্থান নিলো। কম্পিত শরীর নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা মেইন গেইটের কাছে চলে এলো। গেইটের পাশ ঘেঁষে অসহায় অবস্থায় বসে আছে ছোট্ট একটি গলুমলু সুন্দর দেখতে বিড়ালছানা! চোখে আনন্দ অশ্রু নিয়ে চাঁদ ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল। বিড়ালছানাটির মুখোমুখি বসে হাঁপাতে লাগল। ছোট্ট ছানাটি চাঁদকে দেখামাত্রই ফ্যাল ফ্যাল চাহনিতে চাঁদের দিকে তাকালো৷ ছোট ছোট থাবা বাড়িয়ে ম্যাও বলে ডাকতে লাগল। চাঁদ কান্না মুখেও হাসি ফুটিয়ে তুলল! আবেগঘন হয়ে বিড়ালছানাটির দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,,

“এই? তুই কী পুচি?”

বিড়ালছানাটি আবারও ম্যাও করে ডেকে উঠল! চাঁদের বাড়িয়ে রাখা হাতটির দিকে মগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। নির্ভয়ে ঠায় চাঁদের মুখোমুখি বসে রইল। চাঁদ আবেগি হয়ে উঠল। ঝট করে বিড়াল ছানাটিকে কোলে তুলে নিলো। ছানাটিও চাঁদের বুকের সাথে একাত্নভাবে মিশে রইল! মনে হচ্ছে যেনো তার মতো দুঃখী বিড়ালছানা পৃথিবীতে আর দুটো নেই! চাঁদ কাঁদতে কাঁদতে বিড়ালছানাটিকে আদর করতে লাগল। কান্নাজড়িত গলায় বলল,,

“তোকে দেখে আমার পুচির খালি জায়গাটা পূরণ হয়ে গেল! জানিনা তুই কোথা থেকে এসেছিস। কে তোকে এখানে নিয়ে এসেছে। তবে আমি তোকে আর কোথাও যেতে দিব না। জোর করে হলেও আমার কাছে রেখে দিব।”

চাঁদ অবিরত হেচকি তুলে কাঁদতে লাগল। গেইটের অপর প্রান্ত থেকে নূর বুকের উপর দু’হাত বেঁধে চাঁদের প্রতিটি আদরমাখা কথা খুব মনযোগ দিয়ে শ্রবণ করতে লাগল! অজান্তেই মিটিমিটি হেসে উঠল সে। চাঁদের খুশিতে সেও বেশ খুশি হলো। নূর তার দেওয়া কথা রেখেছে! চাঁদের জন্য আবারও নতুন একটা পুচি এনে দিয়েছে। চাঁদ আজ কুমিল্লা ফিরে যাবে বলে কোথাও না কোথাও নূরের মনে একটা খারাপ লাগা কাজ করছে! তাই যাওয়ার সময় চাঁদকে তার তরফ থেকে ছোট্ট একটি উপহার দিলো৷ যা হয়তো চাঁদ কখনো ভাবতে পারেনি! সকাল সকাল বাড়ি থেকে বের হয়ে নূর চাঁদের জন্য বিড়ালছানার খুঁজে লেগে পড়ল। তার পরিচিত একটি এনিমেল স্টোর থেকে ফুটফুটে এই বিড়ালছানাটি নিয়ে এলো। বেলকনিতে চাঁদকে এক ঝলক দেখামাত্রই সে ছানাটিকে গেইটের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে নিজে গেইটের বাইরে লুকিয়ে পড়ল! চাঁদ যেনো নূরকে দেখতে না পারে তাই! নূর চায়না চাঁদ এই বিষয়ে জানুক! নূরের সামান্যতম দুর্বলতার জায়গাটা চাঁদ বুঝুক!

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নূর। বুক থেকে হাতজোড়া নামিয়ে নিলো। মুখ থেকে মাস্কটা খুলে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। অমনি তার বাঁ হাতে একটা টান পড়ল! কৌতূহলী হয়ে নূর পিছু ঘুরে দাঁড়ালো। সঙ্গে সঙ্গেই তার চোখজোড়া চড়কগাছে পরিণত হলো। চাঁদ পেছন থেকে নূরের হাতটা কষে ধরেছে! ছলছল দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। নূর তাৎক্ষণিক ভড়কে উঠল। তাড়াহুড়ো করে চাঁদের হাতটা এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলো। ইতস্তত গলায় বলল,,

“তুতুতুমি?”

একহাত দিয়ে চোখের জল মুছল চাঁদ। অন্যহাত দিয়ে শান্ত বিড়ালছানাটিকে বুকের সাথে আঁকড়ে ধরল। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কেন? ভয় পেয়েছেন আপনি?”

ঘাবড়ে ওঠে নূর শার্টের কলারটা ঠিক করল। শক্ত গলায় বলল,,

“না৷ ভয় পাব কেন?”

“তাহলে এভাবে ছটফট করছেন কেন?”

“কোথায় ছটফট করলাম?”

“আপনার চোখ-মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।”

নূর প্রসঙ্গ পাল্টে নিলো। মিছে ধমকের স্বরে বলল,,

“তুমি আমার হাত ধরেছিলে কেন হ্যাঁ? একবার বারণ করেছিলাম না হুটহাট আমার হাত না ধরতে?”

চাঁদ অবুঝ দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। ভরাট গলায় বলল,,

“আজ তো আমি চলেই যাব নূর ভাইয়া! আজ আমার সাথে একটু ভালো ব্যবহার করলে কী হয়?”

নূরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি জোড়া অবিলম্বেই সংকুচিত হয়ে এলো। দৃষ্টি ঘুরিয়ে সে অন্য পাশ ফিরে গেল। শুকনো ঢোক গিলে অস্বস্তিকর গলায় বলল,,

“আজ না গেলে হয় না?”

চাঁদ মাথা নুইয়ে নিলো। ব্যথীত গলায় বলল,,

“না! আজ আমার যেতেই হবে। আর কবে আপনার সাথে দেখা হবে জানিনা! তবে আপনি ভালো থাকবেন কেমন? আর চেষ্টা করবেন রোজ আপুকে খুব শীঘ্রই ভুলে যেতে! মন দিয়ে পড়াশোনা করতে। খালামনি এবং আঙ্কেলের কথা শুনে চলতে। নীড় ভাইয়া এবং মাহিন ভাইয়ার খেয়াল রাখতে।”

নূর বিশৃঙ্খল শ্বাস ছাড়ল। ভাবশূণ্য গলায় বলল,,

“ঠিক আছে যাও। তুমিও ভালো থেকো! না বুঝেই তোমাকে অনেক হার্ট করেছি আমি। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।”

বুকে একরকম চিনচিনে ব্যথা নিয়ে নূর জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। বাড়ির ভেতর না ঢুকেই সে উল্টো পথে হাঁটা ধরল! কিছুতেই এই মুহূর্তে সে চাঁদের মুখোমুখি হতে পারছে না! চোখদুটো জলে ভরে উঠছে। কী যেনো একটা হারিয়ে যাওয়ার ব্যথা উপলব্ধি করছে। কেন এই ব্যথাটা অনুভব হচ্ছে তা একরত্তিও বুঝতে পারছে না নূর! শুধু বুঝতে পারছে এই অনুভূতিটা হওয়া উচিৎ নয়! একেবারেই উচিৎ নয়। কিছু কিছু অনুভূতি অল্পতেই সামলে নিতে হয়। নয়তো অনুভূতিকে ছোটো করা হয়! চাঁদ অস্থির দৃষ্টিতে নূরের যাওয়ার পথে তাকালো। কম্পিত গলায় বলল,,

“নূর ভাইয়া আমি জানি আপনিই বিড়ালছানাটিকে এনে দিয়েছেন! আমি আপনার চোখ দেখেই সব বুঝে গেছি নূর ভাইয়া! নিজেকে এভাবে আড়াল করে কোনো লাভ নেই। আপনার এই বিশাল বড়ো উপহারটিকে আমি আজীবন আগলে রাখব নূর ভাইয়া। খুব যত্নে আগলে রাখব।”

#চলবে…?

[রি-চেইক করা হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_৩১
#নিশাত_জাহান_নিশি

“নূর ভাইয়া আমি জানি আপনিই বিড়ালছানাটিকে এনে দিয়েছেন! আমি আপনার চোখ দেখেই সব বুঝে গেছি নূর ভাইয়া! নিজেকে এভাবে আড়াল করার কোনো মানে নেই। আপনার এই বিশাল বড়ো উপহারটিকে আমি আজীবন আগলে রাখব নূর ভাইয়া। খুব যত্নে আগলে রাখব।”

পিছু ফিরে তাকালো না নূর! দ্রুত পায়ে হেঁটে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। এই মুহূর্তে যেনো এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারলেই তার জানটা বাঁচে! বেঁচে থাকার একটুখানি দিশা খুঁজে পায়। পাগলের মতো ছুটতে লাগল নূর। দিক-বিদিক ভুলে! কোথায় গেলে সে একটু মানসিক শান্তির খোঁজ পাবে তারই নেশায় ঘুরছে! তবে চাইলেই কি শান্তির খোঁজ পাওয়া যায়? শান্তি খুঁজে পাওয়া কি এতোই সহজ? ভেতরটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। যন্ত্রণায় একপ্রকার ছটফট করছে। চাঁদকে ঘিরে এই নিদারুন যন্ত্রণার মূল কারণ নূর খুঁজে পাচ্ছে না! আদতে কী এই যন্ত্রণাটা হওয়া উচিৎ? নাকি চাঁদকে নিয়ে এতোটা না ভাবা উচিৎ? নিজের বিবেকের কাছে এই কঠিন প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর না খুঁজে পেয়ে নূর তার হাঁটার গতি আরও বাড়িয়ে দিলো! পাগলের মতো দৌঁড়াতে লাগল। নূরের ছায়া মিলিয়ে যেতেই চাঁদ রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল। নূরের যাওয়ার পথ থেকে চঞ্চল দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। বিড়ালছানাটিকে বুকের সাথে মিশিয়ে দীর্ঘ একটি শ্বাস ছাড়ল। ভরাট গলায় বলল,,

“তোর আসল মালিক তো আমাদের ছেড়ে চলে গেল রে পুচি! এবার তার সাথে আমাদের আর কবে দেখা হবে বল তো? আদোও আর দেখা হবে তো?”

পুচি নিশ্চুপ। কেবল ছোটো ছোটো থাবায় চাঁদের গলায় একের পর এক আঁচড় বসাচ্ছে! জিভ চেটে কিছু একটা ইশারা করছে। অসহায় দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকাচ্ছে। পুচির দেওয়া আঁচড়ে চাঁদ কেঁপে কেঁপে উঠছে। যদিও পুচির আঁচড়ের ব্যথা অতোটা গাঢ় নয় তবে একটুখানি ব্যথা তো লাগছে-ই। ব্যথায় হাঁসফাঁস করে উঠল চাঁদ। তড়িৎ বেগে পুচির থাবায় হাত রাখল। অধৈর্য্য গলায় বলল,,

“উফফ দিচ্ছি তো খাবার। এর জন্য আমাকে এতো মা’রা লাগে হ্যাঁ? প্রথমদিনই আমাকে আ’হত করছিস। একদম মালিকের মতো জোচ্চোর হয়েছিস!”

ক্ষুধার্ত পুচিকে বুকে ধরে চাঁদ দ্রুত পায়ে হেঁটে বাড়ির ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করল। এক্ষণি পুচির খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। নয়তো কখন আবার আঁচড়ের বদলে কামড় বসিয়ে দেয় বলা যায়না! ব্যাকুল হয়ে চাঁদ রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই অমনি নাদিয়া, সাদিয়া এবং রুহি বেশ উত্তেজিত হয়ে দৌঁড়ে এলো চাঁদের কাছে। চাঁদের কোলে নতুন পুচিটিকে দেখামাত্রই তারা বেশ আশ্চর্যিত হয়ে মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল! কৌতূহলী গলায় সমস্বরে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“আপু? কোথায় পেলে এই ছানাটিকে?”

চাঁদ ম্লান হাসল৷ ক্ষুধায় ক্লান্ত হয়ে থাকা পুচির গলায় শুড়শুড়ি দিয়ে বলল,,

“নূর ভাইয়া এনেছে। এ হলো আমার আরেকটা পুচি। আমার আরেকটা জান!”

কাউকে আর কথা বাড়ানোর সুযোগ দিলো না চাঁদ। এমনকি কারো মুখের দিকেও তাকালো না! সবাইকে উপেক্ষা করে দ্রুত পায়ে হেঁটে রান্নাঘরে প্রবেশ করল। সাবরিনা আবরার একা হাতে সবার জন্য সকালের নাশতা তৈরি করছেন। দুটো গ্যাসেই রয়েছে বিফ বিরিয়ানি এবং ব্ল্যাক কফি! গোটা রান্নাঘর বিরিয়ানির লোভনীয় সু-ঘ্রাণে আচ্ছন্ন হয়ে আছে! সেই ঘ্রাণে কাবু হয়ে যে কারো-ই জিভে অটোমেটিকলি জল চলে আসবে। চাঁদও কিন্তু তার ব্যতিক্রম নয়! ঘ্রাণে একপ্রকার আকৃষ্ট হয়ে চাঁদ নাক টানতে টানতে সাবরিনা আবরারের পাশে দাঁড়ালো। চোখ বুজে লোভাতুর গলায় বলল,,

“উমমম খালামনি। জিভে জল চলে এলো তো। কখন এই অমৃতটা আমার পেটে পড়বে বলো তো?”

বিরিয়ানির বড়ো পাতিলটা মৃদু আঁচে রেখে সাবরিনা আবরার হাসি মুখে চাঁদের দিকে তাকালেন। কাপড়ের আঁচল দ্বারা কপালে লেগে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো মুছলেন। ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলার পূর্বেই উনার চোখে গেল চাঁদের বুকে মিশে থাকা পুচির দিকে। তাৎক্ষণিক উনার চোখ দুটো খুশিতে চকচক করে উঠল! আনন্দে আপ্লুত হয়ে উনি পুচির দিকে তাকিয়ে চাঁদের উদ্দেশ্য প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“এই চাঁদ? কোথা থেকে পেলি একে?”

চাঁদ স্মিত হাসল। আনন্দঘন গলায় বলল,,

“তোমার ছোটো ছেলে এনে দিয়েছে খালামনি! একদম পুচির মতো দেখতে না?”

“হ্যাঁ তো! একদম পুচির মতো দেখতে। গোল গোল চোখ। মায়াভরা চাহনি।”

“এজন্যই তো এর নাম রেখেছি পুচি। ভালো হয়েছে না নামটা?”

সাবরিনা আবরার আহ্লাদি হয়ে উঠলেন। চাঁদের কোল থেকে পুচিকে তুলে নিলেন। বুকে চেপে ধরে পুচিকে ইচ্ছেমতো আদর করতে লাগলেন। চাঁদ ব্যস্ত হয়ে পড়ল পুচির জন্য খাবারের সন্ধান করতে। অমনি তার সূক্ষ্ম দৃষ্টি পড়ল রান্নাঘরের সেল্ফে। ছোট্টো একটি স্টিলের বাটিতে বিফের কিছু অংশ অবশিষ্ট আছে। খুশিতে আটখানা হয়ে চাঁদ সেই অবশিষ্ট বিফের অংশগুলো পুচিকে খেতে দিলো। খাবার পেয়ে পুচি আকুপাকু করে উঠল। হাতে গোনা কয়েক মিনিটের মধ্যেই চেটেপুটে সম্পূর্ণ খাবারটা সাবার করে ফেলল! স্বাদে জিভ চাটতে লাগল। পুচির খাবার দেখে চাঁদেরও এবার ক্ষুধামন্দা বেড়ে গেল! পেটে হাত রেখে চাঁদ কাচুমাচু মুখে সাবরিনা আবরারের মুখোমুখি দাঁড়ালো। আহ্লাদি গলায় বলল,,

“এবার আমার খাবারটা দাও না খালামনি। ক্ষুধায় তো পেট চোঁ-চোঁ করছে। দাও না একটু বিরিয়ানি আমাকে, দাও না।”

সাবরিনা আবরার ফিক করে হেসে দিলেন! আদুরে হয়ে চাঁদের গাল টেনে দিলেন। মিঠা গলায় বললেন,,

“বিরিয়ানি দেখে অমনি খুব ক্ষিদে পেয়ে গেল না? মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে খালামনিকে এখন বস করা হচ্ছে হ্যাঁ?”

“না খালামনি। সত্যি বলছি, আমার খুখুখুব ক্ষিদে পেয়েছে।”

“আচ্ছা বুঝেছি। আগে সোহানীকে ঘুম থেকে উঠতে দে। এরপর না হয় আমি সবার জন্য খাবার টেবিলে বিরিয়ানিটা বেড়ে দিব।”

চাঁদ বিস্মিত হলো। কোমরে হাত গুজে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী বললে খালামনি? আপু এখনো ঘুমুচ্ছে?”

সাবরিনা আবরার কুচুটে হাসলেন! রসাত্মক গলায় বললেন,,

“বুঝিস না? নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে। এখন তো চোখে একটু ঘুম বেশিই থাকবে !”

চাঁদ বাঁকা হাসল! মাথাটা দুলিয়ে বলল,,

“ওহ্ আচ্ছা৷ তাহলে এই ব্যাপার? এজন্যই আমার আপু এতো বেলা করে ঘুমুচ্ছে?”

সাবরিনা আবরারকে প্রত্যত্তুর করার সুযোগ দিলো না চাঁদ। পরক্ষণে এক ভ্রু উচিঁয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গলায় বলল,,

“এক কাজ করলে হয় না খালামনি? আপুকে গিয়ে আমি একটু ডেকে দিই?”

“ধ্যাত না! ঘুমুচ্ছে ঘুমুক। তোর যেহেতু এতোই ক্ষিদে পেয়েছে তাহলে এক কাজ করি তোকে না হয় আমি একটু করে বিরিয়ানি বেড়ে দিই। পরে সোহানী উঠলে সবার সাথে না হয় আরও একবার খেয়ে নিবি!”

চাঁদ দাঁত কেলিয়ে হাসল। খুশিতে আপ্লুত হয়ে উঠল। ব্যতিব্যস্ত গলায় বলল,,

“দাও দাও খালামনি এখনি দাও। জিভে জল চলে এলো আমার। উফফফ আর সহ্য করা যাচ্ছেনা!”

সাবরিনা আবরার হাসতে হাসতে চাঁদের জন্য ছোটো একটি প্লেটে একটুখানি বিরিয়ানি বেড়ে দিলেন। বিরিয়ানির লোভে লোভাতুর হয়ে চাঁদ দিশা খুঁজে না পেয়ে রান্নাঘরের সেল্ফের উপরে চড়ে বসল। আরামচে বিরিয়ানি গিলতে লাগল! আর ফাঁকে ফাঁকে সাবরিনা আবরারের রান্নার হাতের হাজারটা প্রশংসা করতে লাগল। চোখ বুজে হাত নাচিয়ে তৃপ্তি প্রকাশ করতে লাগল। চাঁদের কার্যকলাপ দেখে সাবরিনা আবরার মিটিমিটি হাসতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর পর চাঁদের মাথায় গাড্ডা মারতে লাগলেন। ছোট্টো পুচিও চাঁদের পাশে বসে গরুর মাংসের হাড্ডি চিবুচ্ছে! চাঁদ মাংস খাচ্ছে আর পুচিকে একটু করে মাংসের হাড্ডি দিচ্ছে।

,
,

বেলা বাড়ার সাথে সাথে সূর্যের তাপ গোটা বাড়ির ছাদের আস্তরণ ভেদ করে প্রতিটি রুমে রুমে আগুনের ফুলকির ন্যায় ছড়িয়ে পড়ল! পুরো বিল্ডিংটাই লাভার রূপ ধারণ করল। ভ্যাপসা গরমের ঝাঁজে তৎক্ষণাৎ নীড়ের আরামদায়ক ঘুমটাও ভেঙে গেল! পাঞ্জাবির কলারটা ঝেড়ে নীড় একরাশ বিরক্তি প্রকাশ করে সোহানীর কোমর থেকে হাতটা সরিয়ে নিলো। পিটপিটে চোখে আশেপাশে তাকালো। অমনি সোহানীর গরম শ্বাস-প্রশ্বাসের ভাপ তার চোখে-মুখে ঠিকরে পড়ল! থতমত খেয়ে উঠল নীড়! পূর্ণদৃষ্টি মেলে পাশে তাকালো। অমনি তার চক্ষুজোড়া কপালে ওঠে গেল! সোহানীর গায়ের সাথে আঠার ন্যায় লেগে আছে নীড়। দুজনের মধ্যে একরত্তিও ফাঁকফোকর নেই। বাতাস চলাচলের সামান্যতম জায়গাটুকুও অবশিষ্ট নেই। এমনকি সোহানীর শাড়ির আঁচলের সাথে তার ঘড়ির ফিতেটাও শক্তভাবে লেগে আছে! কোমরের অংশ থেকে একটুখানি কাপড় সরে আছে। ধবধবে সাদা পেটটা নীড়ের দু’চোখে স্পষ্ট! অমনি নীড় শুকনো ঢোক গিলল! শঙ্কিত দৃষ্টিতে সোহানীর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকালো। বড়ো সড়ো কোনো কেলাঙ্কারি বেঁধে যাওয়ার পূর্বেই নীড় আস্তে করে সোহানীর পাশ থেকে সরে এলো! ছটফটিয়ে শোয়া থেকে ওঠে বসল। বাঁ হাত দ্বারা আচ্ছেমতো কপাল চাপড়ালো! বিড়বিড় করে বলল,,

“ডেম ইট! এসব কী দেখলাম আমি? হ্যাংলার মতো একটা মেয়ের গোপন অঙ্গ দেখলাম? ওহ্ গড এখন তো আমার নিজেরই খুব রিপেন্ড হচ্ছে!”

কপাল থেকে হাত সরিয়ে নিলো নীড়৷ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সোহানীর কাপড়ের আঁচল থেকে তার ঘড়ির ফিতেটা ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তবে প্রতিবার তাকে ব্যর্থ হতে হলো। কারণ, হালকা টানে কাপড়ের আঁচল থেকে ফিতেটা ছাড়ানো সম্ভব হচ্ছেনা। এরজন্য জোরে একটা হেঁচকা টান দিতেই হবে। যা হয়তো এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। কারণ, এই টানের সাথে হয়তো সোহানী ঘুম ভেঙে ওঠে যাবে নয়তো শাড়ির আঁচল খুলে নীড়ের হাতে চলে আসবে! মন্থর গতিতে অনেকক্ষণ যাবত চেষ্টা করার পরও আশানুরূপ কোনো ফল না পেয়ে নীড় এই পর্যায়ে এসে ভীষণ অধৈর্য্য হয়ে উঠল। বিরক্তির শেষ পর্যায়ে পৌঁছাতেই দাঁতে দাঁতে চাপে ঘড়িটায় দিলো এক হেঁচকা টান! অমনি সোহানীর কাপড়ের আঁচলটা খুলে নীড়ের হাতে চলে এলো! ঘড়িটাও কাপড়ের আঁচল থেকে খুলে এলো। সঙ্গে সঙ্গেই সোহানী ধড়ফড়িয়ে ঘুম ভেঙে উঠল! থতমত খেয়ে সোজা বসে পড়ল। নীড় আর এক মুহূর্ত এই জায়গায় বসল না! নিজের প্রেসটিজ রক্ষা করতে তড়িৎ বেগে বিছানা ত্যাগ করে সোজা দাঁড়িয়ে পড়ল। সোহানীর চোখ থেকেও ঘুম উবে গেল। আতঙ্কগ্রস্ত দৃষ্টিতে নীড়ের দিকে তাকালো। কম্পিত গলায় বলল,,

“কীকীকী হয়েছিল?”

নীড় শুকনো ঢোক গিলল! সোহানীর শরীর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে পিছু ফিরে দাঁড়ালো৷ রাশভারি গলায় বলল,,

“এতো কুয়েশ্চন না করে আগে কাপড়ের আঁচলটা ঠিক করো!”

সোহানীর নজর পড়ল এবার তার বুকের দিকে। অমনি চোখজোড়া তার চড়কগাছ হয়ে উঠল। তাড়াহুড়ো করে বুকের আঁচলটা টেনে ঠিক করে নিলো। নীড়ের দিকে তাকানোর আর একবিন্দুও সাহস পেল না সে। লজ্জায় রাঙা হয়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। মাথা নুইয়ে ক্ষীণ গলায় নীড়কে বলল,,

“সরি নীড় ভাইয়া। আমি আসলে খেয়াল করিনি শাড়িটা কখন সরে গেল!”

নীড় গলা ঝাড়লো৷ বিষয়টাকে প্রশ্রয় না দিয়ে বেশ গম্ভীর গলায় বলল,,

“হয়েছে হয়েছে। শাড়িটা পাল্টে এবার ফ্রেশ হয়ে নাও।”

কোনো রকমভাবে এই লজ্জাষ্কর পরিস্থিতি এড়িয়ে এলো নীড়! মানে মানে করে রুম থেকে কেটে পড়ল। দরজার বাইরে এসে বুকে হাত রেখে সুদীর্ঘ এক স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। মনে মনে আওড়ে করে বলল,,

“ওহ্ গড। এই যাত্রায় বেঁচে গেছি! সোহানী কিছু আঁচ করতে পারেনি। এর আগের ঘটনাগুলো যদি কোনোভাবে সোহানী আঁচ করতে পারত তখন আমায় ঠিক কী ভাবত? নিশ্চয়ই ভাবত আমি ইচ্ছে করে তার গাঁয়ের সাথে ঘেঁষেছিলাম! শাড়ির আঁচলে আমার ঘড়ির অংশটা জোরপূর্বক লাগিয়েছিলাম! এহ্! যা নয় তা ভাবত।”

সোহানী বেকুব দৃষ্টিতে নীড়ের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। ধ্যান ভাঙতেই সে নাক-মুখ কুঁচকে নিলো। সন্দিহান গলায় বলল,,

“যাহ্ বাবা! এখানে হলোটা কী? সত্যিই কী আমার গাঁ থেকে শাড়ির আঁচলটা আপনা-আপনি খুলে গিয়েছিল? আমি তো এর আগেও অনেকবার শাড়ি পড়ে ঘুমিয়েছিলাম। কই কখনও তো ঘুম থেকে ওঠে দেখিনি এভাবে আমার শাড়ির আঁচলটা গাঁ থেকে খুলে পড়ে আছে!”

,

,

ঘড়িতে কাটায় কাটায় বিকেল পাঁচটা চলমান। আনমনা হয়ে বাসের সিটে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে চাঁদ। পুচিকেও তার বুকের সাথে একাত্নভাবে মিশিয়ে রেখেছে। পুচিও আরাম পেয়ে নাক টেনে ঘুমুচ্ছে। তার পাশের সিটেই বসে আছে জায়মা। কানে এয়ার ফোন লাগিয়ে গানের নেশায় সে বুদ হয়ে আছে। চাঁদের পরিবারের সবাই এই বাসে করে কুমিল্লা ফিরছে! প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে তারা। একটু পরেই হয়তো কুমিল্লা বাসস্ট্যান্ড পৌঁছে যাবে। বিশাল একঘেয়েমি দূর করতে চাঁদ চলন্ত গাড়ির জানালায় মাথা ঠেকিয়ে বসল। মনটা তার ভীষণ খারাপ। ভীষণ বলতে ভীষণ খারাপ। যা ভাষায় ব্যক্ত করার মতো নয়। ভেতরটাও কেমন যেনো ছটফট করছে তার। সাবরিনা আবরার, হাবিব আবরার, নূর, নীড়, মাহিন সবাইকে খুব মিস করছে সে। তাদের ছেড়ে আসতে একটুও ইচ্ছে করছিল না তার! প্রায় অনেকদিন তো থাকা হলো ঐ বাড়িতে। সেই হিসেবে খারাপ লাগাটা কাজ করা নিতান্তই স্বাভাবিক। সাবরিনা আবরারের কথা মনে করে খুব কান্নাও আসছে তার! আসার সময় নূরের সাথে দেখা হয়নি চাঁদের। সেই যে সকালে নূরের সাথে একবার দেখা হয়েছিল তারপর থেকে নূরের ছায়াটিও পর্যন্ত বাড়িতে দেখা যায়নি! ফোনেও পাওয়া যাচ্ছিল না তাকে! সাদমানের সাথেও দেখা হয়নি তার। কারণ সাদমান জানতই না চাঁদ আজ কুমিল্লায় ফিরবে! জানলে হয়তো একবার না একবার সাদমানের সাথে দেখা হতোই হতো। এই দুটো মানুষের সাথে দেখা না করেই চাঁদকে বিষন্ন মনে কুমিল্লা ফিরতে হলো।

ফেরার সময় আরও একটা মারাত্নক খারাপ কাজ করে এসেছে চাঁদ! ঐ নেশাখোর ছেলেটার উপর থেকে আরোপকৃত কেইস তুলে এসেছে! পুলিশ এবং নেশাখোরের বড়ো ভাইয়ের চাপে পড়ে মূলত বাড়ির সবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে চাঁদকে এই অনৈতিক কাজটা করতে হয়েছে। বড়ো বড়ো মানুষের সাথে হাত ঐ নেশাখোরের পরিবারের। উপর মহলেও বেশ জানা শোনা আছে তাদের। তাই নিজ হাতে চাঁদ কারো বিপদ ডেকে আনতে চায়নি! সবাইকে বিপদমুক্ত করে এসেছে। “ক্ষমতা যার, শাসন তার।” সেক্ষেত্রে ক্ষমতাহীন মানুষদের টিকে থাকাটা দিনের আকাশে চাঁদ দেখার মতো অকল্পনীয়।

সোহানী ভেতরে ভেতরে নীড়ের যাতনায় অবিরত জ্বলছে, পুড়ছে, দ্বগ্ধ হচ্ছে! ভেতরের যাতনাটা সে বাইরে কাউকে প্রকাশ করে বলতে পারছেনা। ফেরার পথে কেবল সাবরিনা আবরারকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছে! তার ভেতরের একমাত্র আকুতিই ছিল যেনো নীড়কে ছেড়ে না আসা। তবে নীড় সোহানীর সেই আকুতিভরা কান্নার কারণ একরত্তিও বুঝেনি! হয়তো চেষ্টাও করেনি। কঠোর মনে সোহানীকে বিদায় দিয়েছে সে। গোটা চার থেকে পাঁচমাস সোহানী কীভাবে নীড়কে ছাড়া কাটাবে তা ভেবেই যেনো তার কান্নার মাত্রা আরও দ্বিগুন বৃদ্ধি পাচ্ছে!

______________________________________

সময়ের তালে গাঁ ভাসিয়ে কেটে গেলো গোটা ছয়মাস! প্রায় দেড়মাস হলো সোহানীর ফোর্থ ইয়ার ফাইনাল এক্সাম শেষ হয়েছে। শর্তানুযায়ী এই কয়েকদিনের মধ্যেই সোহানীকে ঘরে তোলার কথা ছিল নীড়ের! এই সময়টার জন্যই যেনো সোহানী এতগুলো মাস ধরে চাতক পাখির মতো ছটফটিয়ে অপেক্ষা করছিল। নিয়ম করে ক্যালেন্ডারের পাতায় পাতায় কেটে যাওয়া প্রতিটা দিনের হিসাব রাখছিল! যার সাক্ষী ছিল একমাত্র চাঁদ। নীড়কে ঘিরে সোহানীর যতো পাগলামির আছে এসবকিছুর সাক্ষী ছিল একমাত্র চাঁদ। সুযোগ পেলে চাঁদও সোহানীকে বর পাগলী মেয়ে বলে ক্ষেপাতো! আরও নানানভাবে সোহানীকে রাগাতো। এই নিয়ে শুরু হয়ে যেতো দুবোনের মধ্যে নানাধরনের খুনশুটি, রাগ-অভিমান!

চাঁদের সেকেন্ড ইয়ার এক্সাম শুরু হলো মাত্র। আরও বাকি রয়েছে চার চারটে পরীক্ষা। পরীক্ষার চাপে পড়ে নূরের কথা প্রায় ভুলে বসেছে চাঁদ! ঢাকা থেকে ফেরার পর থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত নূরের সাথে কোনোরূপ যোগাযোগ হয়নি চাঁদের! না নূর কখনো চেষ্টা করেছিল চাঁদের সাথে একটু আধটু যোগাযোগ করার! প্রথম কয়েকদিন নূরের কথা খুব নিয়ম করে চাঁদের মনে পড়লেও এখন আর তেমন মনে পড়েনা! নূরকে পুরোপুরি ভুলে বসেছে সে! সারাক্ষণ শুধু পুচিকে নিয়ে মেতে থাকাই যেনো তার একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে! ছোট্টো পুচিটি এখন আর ছোট্ট নেই। ছয়মাসে অনেক বড়ো হয়ে গেছে সে। চাঁদের যত্নে, আদরে, ভালোবাসায় পুচি দিন দিন আরও সুন্দুরী রমণী হয়ে উঠছে! আগের চেয়ে আরও নাদুস নুদুস হয়ে উঠছে। গাঁয়ের জেল্লা যেনো দিন কী দিন বাড়ছে। পাড়ার সব ছেলে বিড়ালরা এখন আদা জল খেয়ে পুচির পেছনে পড়ে থাকে। পুচিকে দেখলেই জিভ বের করে রাখে! পুচির সৌন্দর্যে একপ্রকার ফিদা তারা! হাঁসফাঁস করে পুচিকে একবার কাছে পেতে! পুচিও কিন্তু কম ভাবওয়ালী নয়! কিছুতেই সে কারো কাছে ধরা দিবেনা! কারো প্রেমের প্রস্তাবেও রাজি হবেনা। সবসময় নিজের ভাব বজায় রাখবে। হ্যান্ডসাম বিড়ালদের কাছেও নিজের সৌন্দর্য রক্ষা করে চলবে!

বিকেল পাঁচটা বাজতেই চাঁদ, জায়মা এবং তাশফিয়া পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে এলো। তাশফিয়া হলো চাঁদ এবং জায়মার নিউ ফ্রেন্ড। প্রায় তিনমাস হলো তাশফিয়ার সাথে চাঁদ এবং জায়মার বন্ধুত্বের। এখন তারা তিনজনই বেস্ট ফ্রেন্ড। একজন আরেকজনকে ছাড়া বাঁচবে না এরম একটা অবস্থা! পরীক্ষা ভালো হওয়ার কারণে চাঁদ অনেক হাসি-খুশি থাকলেও জায়মা এবং তাশফিয়া মনম’রা হয়ে আছে! কারণ, তাদের দুজনের পরীক্ষাই খুব বাজে হয়েছে! চাঁদ বিভিন্নভাবে তাদের শান্তনা দিচ্ছে। তাদের মন ভালো করার জন্য বাড়ি যেতে যেতে তাদের দুজনকে আইসক্রীম খাওয়াবেও বলেছে! আইসক্রীম খাওয়ার কথা শুনে তারা দুজনই পরীক্ষায় ফেল করার টেনশন ভুলে গেল! দুজনই লোভের বশবর্তী হয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। চাঁদ বাঁকা হাসল। তাদের মন ভালো করার ঔষধ চাঁদের খুব ভালোভাবেই জানা আছে।

পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে চাঁদের বাড়ি পায়ে হেঁটে যেতে প্রায় পনেরো মিনিটের রাস্তা। তাশফিয়ার বাড়ি চাঁদ এবং জায়মার বাড়ি থেকে আরও পনেরো মিনিট দূরে। চাঁদের বাড়ি পর্যন্ত তাশফিয়া পায়ে হেঁটে গেলেও বাকি রাস্তাটুকু তার রিকশা করে যেতে হয়। কথা বলতে বলতে চাঁদের বাড়িটুকু পায়ে হেঁটে যেতে তার কোনো সমস্যা হয়না। বরং ভালো হয়। হাসি-ঠাট্টায় সময় কেটে যায়। চাঁদ এবং জায়মার সাথে কিছুক্ষণ সময় বেশি কাটানো যায়। জায়মা এবং তাশফিয়াকে রাস্তার অপর পাশে রেখে চাঁদ দৌঁড়ে গেল রাস্তার বিপরীতে। তিনজনের জন্য তিনটে কোণ আইসক্রীম কিনতে। পরীক্ষার ফাইলটা ডান হাতে রেখে চাঁদ দোকানের বাইরে রাখা ডিপ ফ্রিজটির সামনে দাঁড়ালো। চোখ বুলিয়ে ফ্রিজের ভেতরের সবকটা আইসক্রীম দেখে নিলো। কিছুক্ষণ ভাবনা-চিন্তার পর চাঁদ বাঁ হাতের তর্জনী আঙুল দ্বারা ভ্যানিলা ফ্লেভারের তিনটে কোণ আইসক্রীমের দিকে ইশারা করল। উচ্ছুক গলায় দোকানীকে বলল,,

“মামা। ভ্যানিলা ফ্লেভারের তিনটা কোণ আইসক্রীম দেন তো।”

দোকানী মিষ্টি হাসলেন! চাঁদের কথামতো ফ্রিজ খুলে চাঁদকে তিনটি কোণ আইসক্রীম দিলেন। হাসিমুখে আইসক্রীম তিনটি হাতে নিয়ে চাঁদ পার্সের চেইনটা খুলল। দুটো একশ টাকার নোট বের করে দোকানীর মুখের সামনে ধরল। সৌহার্দপূর্ণ গলায় বলল,,

“এই নিন মামা টাকাটা।”

দোকানী জিভ কাটল! দু’হাত নাড়িয়ে বলল,,

“আরেহ্ না আপু টাকা লাগবেনা! আপনাকে আমি আইসক্রীম তিনটি এমনি এমনিই দিলাম।”

চাঁদ ভ্রু কুঁচকালো। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“মানে? এমনি এমনি দিলেন মানে?”

“মানে আপু আজ আমার দোকানের সমস্ত কাস্টমারদের আমি ফ্রিতে আইসক্রীম খাওয়াচ্ছি। এখন এই লিস্টে আপনিও আছেন!”

চাঁদ তাজ্জব দৃষ্টিতে দোকানীর দিকে তাকালো। জিজ্ঞাসু গলায় বলল,,

“সিরিয়াসলি? এই যুগে এমন দোকানীও আছে? যে ফ্রিতে কাস্টমারকে আইসক্রীম খাওয়ায়?”

দোকানী মাথা চুলকালো। রহস্যাত্নক হেসে বলল,,

“হয়তো আছে আপু! এই মিশনটা আমি আপনাকে দিয়েই স্টার্ট করলাম। আপনিই হলেন আমার ফ্রি ভুক্ত ফার্স্ট কাস্টমার।”

চাঁদ আর কথা বাড়ালো না। টাকাটা পার্সে ঢুকিয়ে নিলো। ভাবশূণ্য গলায় বলল,,

“যাই হোক। থ্যাংকস ভাইয়া।”

চাঁদ প্রস্থান নিলো। পিছু ঘুরে দাঁড়াতেই হঠাৎ তার সামনে হাওয়াই মিঠাই পড়ল! সেদিনের সেই লোকটা। যে লোকটা পনেরো টাকার কমে হাওয়াই মিঠাই দিচ্ছিল না চাঁদকে। অনেকক্ষণ ঘ্যাচ ঘ্যাচ করার পরও দেয়নি। উল্টে চাঁদকে দুই এক লাইন কথা শুনিয়ে দিয়েছে। লোকটাকে দেখামাত্রই চাঁদের আগের তেজ ফিরে এলো। চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“এই এই আপনি আমার সামনে কী করছেন হুম? ঐদিন না বলেছিলাম আপনি আর কখনো ভুলেও আমার সামনে পড়বেন না?”

লোকটি দাঁত বের করে হাসল! তিনটা হাওয়াই মিঠাই চাঁদের মুখের সামনে ধরল। ভদ্র গলায় বলল,

“এই নেন আফা। এই তিনোডা হাওয়াই মিডাই আম্নের। আজকে আর কোনো টাকা লাগবনা। ফিরিতে দিলাম। নিয়া নেন সব।”

চাঁদ টাস্কি খেলো। ভ্রু যুগল খড়তড়ভাবে কুঁচকে লোকটির দিকে তাকালো। কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“সিরিয়াসলি? আপনি ফ্রি তে আমাকে এই হাওয়াই মিঠাইগুলো দিবেন?”

“হ্যাঁ আফা। ফিরিতেই দিমু। নিয়া নেন সব। যতো ইচ্ছা নিয়া নেন।”

“কিন্তু ফ্রিতে কেন? ঐদিন তো একটা টাকাও কমে রাখছিলেন না। আজ আবার ফ্রিতে কেন?”

“আর কইয়েন না আফা। আইজ আমার মাইয়ার জন্মদিন। তাই হগলরে ফিরিতে খাওয়াইতাছি।”

চাঁদ তাজ্জব বনে গেল! একটু পর পর তার সাথে কী হচ্ছে এসব? সবাই কেন চাঁদকে আজ ফ্রিতেই সবকিছু দিচ্ছে? কী রহস্য লুকিয়ে আছে এর পিছনে? লোকটার জোরাজুরিতে চাঁদ বাধ্য হয়ে হাওয়াই মিঠাই তিনটে হাতে নিলো। লোকটির ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল যেনো হাওয়াই মিঠাই তিনটে কোনো রকমে হাতে তুলে দিলেই লোকটি বাঁচে। নির্বোধ ভঙ্গিতে চাঁদ রাস্তা পাড় হলো। জায়মা এবং তাশফিয়ার মুখোমুখি দাঁড়ালো। হঠকারি গলায় বলল,,

“আচ্ছা আজ আমার সাথে এসব কী হচ্ছে বল তো? সবাই কেন আজ আমাকে ফ্রিতেই সব দিচ্ছে?”

চাঁদের কথায় কোনো হেলদুল হলো না তাদের। চোখের সামনে ফেভারিট আইসক্রীম এবং হাওয়াই মিঠাই দেখে লোভ সংবরণ হচ্ছিলনা তাদের! টপাটপ করে তারা চাঁদের হাত থেকে তাদের কোণ আইস্ক্রীম এবং হাওয়াই মিঠাই দুটো কেড়ে নিলো। দুজনই আইসক্রিম মুখে দিয়ে সমস্বরে বলল,,

“আরে রাখ তোর সন্দেহ টন্দেহ! আগে আমরা খেয়ে নিই। আইসক্রিমগুলো গলে যাচ্ছে।”

চাঁদ হতাশ শ্বাস ছাড়ল। মনে মনে অনেক জল্পনা-কল্পনা করতে লাগল। চিন্তিত হয়ে জায়মা এবং তাশফিয়ার পেছনে হাঁটা ধরল। চাঁদ আইসক্রিমটা খুলে একটা মাত্র বাইট বসালো আইসক্রিমটায়। অমনি নিঃশব্দে একটি মাইক্রো এসে তার পাশাপাশি দাঁড়ালো। কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই চাঁদের হাত থেকে হেচকা টানে আইসক্রিমটা কেড়ে নিলো! মুহূর্তের মধ্যেই জানালার কাঁচ লাগিয়ে গাড়ির মালিক ফুল স্পিডে গাড়িটা ছেড়ে দিলো! চাঁদ চিৎকার করে উঠল। গাড়িটার পিছু পিছু দৌঁড়াতে লাগল। শখের আইসক্রিম কেড়ে নেওয়ার দুঃখে কান্নাকাটি করে বলল,,

“এই কে আপনি? আইসক্রিমটা কেড়ে নিলেন কেন হ্যাঁ? এক্ষণি আমার আইসক্রিমটা ফেরত দিয়ে যান বলছি! এএএএ আমার আইসক্রিম!”

গাড়ির মালিক বাঁকা হাসল! জবরদস্ত ভাব নিয়ে গাড়ির হ্যান্ডেলে হাত লাগল। আইসক্রিমে চাঁদের বাইটের জায়গাটায় কুটুস করে একটা বাইট বসালো! চোখ থেকে কালো সানগ্লাসটা এক ইঞ্চি নিচে নামালো। ভ্রু যুগল উঁচিয়ে মারাত্নক সুন্দর চাহনিতে লুকিং গ্লাসের দিকে তাকালো। এ্যাশ রঙের শার্টের কলারটা ঝেড়ে ব্যস্ত চাহনিতে জানালার কাঁচ খুলে প্রাণপনে দৌঁড়াতে থাকা চাঁদের দিকে তাকালো। আইসক্রিমটা গিলে খেয়ে রহসাত্মক গলায় বলল,,

“এবার তুমি আমাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যাবে চাঁদ! নতুন করে আবারও আমার মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করবে। আমাকে পেয়ে তুমি উদ্ভ্রান্ত হয়ে যাবে। আমার মায়ায় তুমি এতোটাই মারাত্মকভাবে জড়িয়ে পড়বে যে আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করতে তোমার বুকটা লক্ষ্যাধিকবার কেঁপে উঠবে!”

#চলবে…?