প্রেমহিল্লোল পর্ব-০১

0
35

#প্রেমহিল্লোল||০১||
#তাসনীম_তামান্না

ভাবির বিলেতি বড় ভাইয়ের সাথে বিয়ের কথা চলছে। সন্ধ্যায় ইউনিভার্সিটির অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ইংরেজি ডিপারমেন্টের এক্সাম শেষ করে ক্লান্ত হয়ে বাসায় এসে এমন কথা শুনে কুয়াশা কেমন অভিব্যাক্তি প্রকাশ করা উচিৎ সেটা ভুলে গেলো। রুমে উপস্থিত সকলের দিকে নির্জীব নিস্প্রভ হয়ে তাকিয়ে রইলো। সকলের উৎকণ্ঠা, খুশি দেখে ওর ভীষণ কান্না পাচ্ছে। তাকে তাড়ানোর এতো তাড়া? তার আবার অসভ্য, নিষ্ঠুর, বর্বর লোকের সাথে!

হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠলো প্রথম দিনের দেখা সক্ষতের কথা। মেঘ আর তুতুলের প্রেমের বিয়ে দুই পরিবারকে তাও অনুষ্ঠানিকভাবে পাত্রী দেখার সাথে এনঙ্গেজমেন্ট ও বিয়ের তারিখ ঠিক করতে গিয়েছিল সকলে মিলে। কুয়াশা আর মেঘা সাথে বড় ভাই কুশানের দুইটা ছোট ছোট জমজ ছেলে কুশ এবং শান। বড়দের কথার মাঝে না থেকে বাড়ি ও তার আশপাশে ঘুরছিলো আর ছবি তুলছিলো।

কুয়াশার ফটোগ্রাফির ভীষণ ঝোঁক সেটা নিজের নয় ফুল, প্রকৃতি ইত্যাদি। তেমনি গার্ডেনে ফুলের ছবি তোলায় মত্ত ছিল। মেঘা, কুশ, শান যার যার মতো মজা করায় ব্যস্ত। ছবি তুলতে গিয়ে নতুন নতুন ফুলের সাথে দেখা হচ্ছে তাদের নামটাও ও জানে না এমনই একটা ফুল দুইটা রঙের পাশাপাশি ল্যাভেন্ডার আর ইয়োলো কালারের ও খুশি সহজসরল মনে সেটা ছুঁতে গেলে পিছন থেকে রাশভারী কণ্ঠে আত্মনার্দ করে উঠলো। কুয়াশা এমনিতেই ভীতু প্রকৃতির মেয়ে তাই আচমকা চিৎকারে ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠলো। পিছনে ফিরে এক সুদর্শন যুবককে দেখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। যুবকটি ধমকে বলল
–“ইডিয়েট, ফুলে হাত দিচ্ছো কেনো?”

অপরিচিত ছেলে ‘ইডিয়েট’ আর তুমি করে বলায় ওর ভীষণ রাগ হলো। কিন্তু ভয়ে প্রকাশ করতে পারলো না। ওকে চুপ থাকতে দেখে আবারও বলল
–“এন্সার করছ না কেনো?”

ও তুঁতলিয়ে বলল “দে-দেখ-ছিলাম ফু-ফুলটা আর ক-কিছু না।”

–“দেখছিলে কেনো?”

দেখছিলো কেনো? এই প্রশ্নের উত্তর নেই। মনে মনে ভয়টা আরো বাড়ছে। ওকে চুপ থাকতে দেখে ধমকে বলল
–“কী সমস্যা কথা বলতে পারো না? এক কথা কত বার জিজ্ঞাসা করা লাগে?”

ও এবার ভয়ে কেঁদে উঠলো। সামনের ছেলেটা আর কিছু না বলে চুপচাপ তাকিয়ে রইল। সান্ত্বনা বা কান্না থামার কথা কিছু বলছে না শুধু তাকিয়ে দেখছে। কুয়াশাকে কাঁদতে দেখে শান দৌড়ে এসে ওর পা জাপ্টে ধরে ভিতু ভিতু চোখে তাকিয়ে বলল
–“পিপি তুমার কী হইয়িছে? কাঁদো কিনু? এই লুকতা তুমাকে বুকা দিসে?”

যুবকটা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে টেনে তার কাছে টেনে নিয়েতে চাইলে শান শক্ত হয়ে কুয়াশাকে জাপ্টে ধরে চিৎকার করে বলল “ও পিপি ছিলে ধরা আমাকে নিয়ে গিলো।”

যুবকটা শব্দ করে হেঁসে উঠে বলল “আচ্ছা আসো তোমাকে আর তোমার পিপিকে বস্তায় ভরে নিয়ে যায়”

ওর কথা শুনে শান ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলো। ফোন রিসিভ করে মেঘ বাইরে এসেছিল। শানের কান্নার আওয়াজে ওখানে গিয়ে দেখলো। তুষার শানকে কোলে নিয়েছে আর শান ও কুয়াশা কাঁদছে। মেঘ গিয়ে বলল “কী হয়েছে?”

–“চুচু আমাকে ছিলে ধরা ধরে নিয়ে গেলো। আমাকে বাঁচাও।

মেঘও হেসে ফেললো বলল “তুষার, বাচ্চা দুটোকে তো কাঁদিয়ে ছাড়লে।”

–“দুইটা বাচ্চা কই পাইলা? এই বিচ্চুটা একটাই বাচ্চা।”

মেঘ হেসে কুয়াশার চোখের পানি মুছে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল “এই যে আরেকটা। আমাদের বাসায় মোট চারটা বাচ্চা, এখানে দুইটা প্রেজেন্ট আছে, আর দুইটা আশেপাশেই আছে।”

তুষার কুয়াশার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। মেঘ বলল “তুমি এতোক্ষণ কই ছিলা?”

–“একটু কাজ পড়ে গিয়েছিলো।”

মেঘ শানকে কোলে নিয়ে বলল “আচ্ছা ভিতরে চলো। কুশু চল।”

মেঘ হাঁটতে লাগলো। কুয়াশা একপল তুষারকে দেখে চোখ নামিয়ে নিলো। এতোক্ষণের আলাপে ওর বোঝা হয়েছে এটা ভাবির ভাই তুষার আগেই নাম শুনেছে। তুষার স্বল্প স্বরে বলল “তুমি বাচ্চা? তোমাকে এতোদিন বিয়ে দিলে বাচ্চা কাচ্চা হয়ে যেতো!”

কুয়াশা বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে দ্রুত ভাইয়ের পাশে হাঁটতে লাগলো। তুষার মুখ টিপে নিজেও ওদের সাথে গেলো।

তারপর পুরা অনুষ্ঠানে দুজনের মধ্যে চোখাচোখি হলেও কথা হয় নি। কুয়াশা দূরে দূরে থেকেছে। এরপরেও বিভিন্ন ভাবে দরকারে অদরকারে ওরা সামনা-সামনি চোখাচোখি হয়েছে। কেউ কথা বলেছি। মেঘের হলুদের দিন হইহুলরে মেতেছিল। সেদিন স্ট্রেজে কাপল ডান্স করেছিলো ঈশানের সাথে ঈশান ওর বন্ধু না বেস্টফ্রেন্ড বলা যায় ক্লাসমেট পাশাপাশি বড় ভাবির ভাই।

সেই ডান্স করায় তুষার রেগে গিয়েছিল। ওর রুমে দরকারে এসেছিল পিছনে পিছনে তুষার এসে দরজা লক করে দিলো। লকের শব্দে পিছনে ফিরে ওকে দেখে কুয়াশার মনে আবারও ভয়ে সৃষ্টি হলো তুতলিয়ে বলল “ক-কি কিছু বলবেন, ভাইয়া?”

তুষার ভয়ানক রেগে গেলো ওকে দেওয়ালে চেপে ধরে বলল “তোর ভাই কে? এতোগুলো ভাই নিয়ে তোর হয় না? ছেলেদের সাথে এতো ঘেষাঘেসি কেনো তোর? ছেলে দেখলেই গায়ে ঢলে পড়তে হয়?”

তুষারের এমন অহেতুক রাগের কারণ খুঁজে পেলো না। তার ওপরে তুইতোকারি করে কথা বলছে কুয়াশার মোটেও পছন্দ হলো না। তার ওপরে রুমের দরজা লক বাড়ি ভরতি মেহমান কেউ যদি দেখে দুইজন অবিবাহিত ছেলে-মেয়ে বন্ধ দরজা রুমে কী করছে এটা নিয়ে বাজে কথা রটে যেতে পারে। মেয়েদের নামে কলঙ্কটা বেশি লাগে। কুয়াশার চোখের সামনে মা-বাবা, ভাইয়ের মুখ ভেসে উঠলো। তাদের সম্মানের কথা ভেবে আজ পর্যন্ত একটা প্রেম করে নি। ছেলেদের থেকে যথেষ্ট যথা সম্ভব দূরত্ব বজায় রাখে। শুধু তার দুইটা স্কুল ছেলে ফ্রেন্ডের সাথে ক্লোজ কখনো কেউ খারাপ বলতে পারবে না আর এই লোকটা অবলীলায় তার নামে তার সামনে বদনাম করে যাচ্ছে। কুয়াশার দু’চার কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু করলো না ভাইয়ের শশুড়বাড়ি লোকজনের সাথে এমন করলে তারা বিয়ে ভেঙে দিলে তার ভীষণ কষ্ট হবে। তার জন্য তার ভাই কষ্ট পাবে এটা কিছুতেই হতে পারে না। ও ধাক্কা দিয়ে তুষারকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল “আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আপনি প্লিজ বাইরে যান। কেউ বন্ধ রুমে দু’জনকে দেখলে খারাপ ভাববে।”

তুষার ওর চোয়াল চেপে ধরে বলল
–“ঢ্যাংঢ্যাং করে যখন নাচো তখন কেউ খারাপ বলে না? শুনে রাখ ছেলেদের থেকে দূরে দূরে থাকবি। নাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে।”

কুয়াশা আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না ওর হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল “আমি যা ইচ্ছে করবো। আপনার কী সমস্যা? আমার ব্যাপারে আপনি এতো নাক গলাচ্ছেন কেনো? আপনার আমাকে হুকুম, অধিকার দেখানোর কোনো রাইট নাই।”

–“হ্যাঁ, নেই। সময় কথা বলবে।”

তুষার চলে গেলো। কুয়াশা আর কোনো অনুষ্ঠানে মন মতো মজা করতে পারলো না। নিজেকে তুষারের থেকে লুকিয়ে রেখেছিলো। ওর লোকটাকে ভীষণ বিরক্ত লাগে। এতো রাগ, এতো জেদ, ইগো, এটিটিউড ওর ভালো লাগে না।

কুয়াশা ওসব ভাবতে ভাবতে দাঁতে দাঁত চেপে চিৎকার করে বলল “আমি কোনো কাউকে বিয়ে করবো না। ঐ তুষারকে তো আগেই না, মরে গেলেও না, জীবনেও না। কখনোই না।”

ওর কথায় সকলের মধ্যে আনন্দ, উৎশ্বাস নিমিষেই থেমে গেলো। সকলে থমথমে মুখে তাকিয়ে রইল ওর দিকে।

চলবে ইনশাআল্লাহ