প্রেমে পরা বারণ পর্ব-০২

0
47

#প্রেমে_পরা_বারণ
পর্ব -২
#Nosrat_Monisha

নির্জনার সামনে অসহায় মুখমণ্ডলে একগুচছ লাল গোলাপ হাতে এক হাঁটু গেড়ে বসে আছে এক যুবক।

–আজকে যদি তুমি আমাকে বিয়ে করতে রাজি না হও অবুঝ বালিকা তবে আমি কচু গাছে ফাঁসি দিবো।
নির্জনা খিলখিল করে হেসে ফুল গুলো হাতে নিয়ে বলে,
–তুমি সারাজীবন বসে থাকলেও তোমাকে আমি বিয়ে করবো না বিহান সরোয়ার ।
নির্জনার কথা শুনে সটান করে দাঁড়িয়ে বিহান বলে,
–কেন?কেন? বিয়ে করবে না কেন?
–বিয়ের জন্য ভালবাসা জরুরি। আর আমি তোমাকে ভালবাসি না।
নির্জনার কথা শুনে বিহান জোরে চিৎকার করে উঠে ,
–খালামণিইইই!!!
পাপিয়া আক্তার ফিল্টারের পানি দিচ্ছিলো। বিহানের চিৎকারে চমকে তার হাত থেকে পানির বোতল পড়ে যায়। তিনি দৌড়ে বসার ঘরে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বলে,
–কি হয়েছে? এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন?

বিহান মুখভার করে বলে,
–দেখো না তোমার মেয়ে আবার আমাকে রিজেক্ট করে দিয়েছে বলে কিনা আমাকে ভালোবাসে না।

পাপিয়া আক্তার একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বিহানের কান টেনে ধরে বলে,
–বেশ করেছে। তোর মতো বাঁদরের কাছে মেয়ে বিয়ে দিলে আমি আর শান্তিতে থাকতে পারবো না।
–আআআ..খালামনির ছাড়ো লাগছেতো ।
নির্জনা দু হাতে তালি দিয়ে বলে,
–না আম্মু একদম ছাড়বেনা। ঠিক হয়েছে যখন-তখন যেখানে-সেখানে ফুল নিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পরে। তুমি জানো সেদিন কাঠফাটা রোদের মধ্যে আমার ভার্সিটিতে চলে এসেছিলো। সবার সামনে কতটা এম্বারেস্ট হতে হয়েছে আমাকে জানো?

–খালি আমার মেয়েটাকে জ্বালানো তাই না। আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।
বলে পাপিয়া আক্তার জোরে বিহানকে কান মলা দেয়।

–কি করছো কে খালামনি, লাগছে তো। তাছাড়া আমি এখন আর ছোট নেই আমার তো একটা মান সম্মান আছে না-কি?

–তাই বুঝি আর আমার মেয়েটার মান-সম্মান নেই? তোর পাগলামির কারণে সব জায়গায় মেয়েটাকে আমার লজ্জায় পরতে হয়।
এই বলে পাপিয়া আক্তার বিহানের কান ছেড়ে দেয়।
বিহান হাত দিয়ে কান ঘষতে ঘষতে বলে,
–তো আমি কি করবো? গত চার বছরে আমি কমপক্ষে চার’শ বার ওকে প্রপোজ করছি। প্রতিবারই আমাকে রিজেক্ট করে দেয়। আমার এফোর্ট দেখে খালু পর্যন্ত আমাদের বিয়েতে মত দিয়ে দিয়েছে কিন্তু তোমার মেয়ের মন গলছে না। তুমি জানো, আমার সব বন্ধুদের বিয়ে হয়ে বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গেছে। সত্যি বলছি খালামণি সিঙ্গেল থাকতে আর ভালো লাগেনা।

–ঠিক আছে ঠিক আছে বুঝতে পেরেছি তোর কষ্ট। এখন বস আমি আমি ভাতের মাড়টা ফেলে তারপর আসছি।
বলে পাপিয়া আক্তার রান্নাঘরে চলে যায়।
–আম্মু দাঁড়াও আমিও যাব।
বলে নির্জনা তার পিছু যেতে চাইলে বিহান খপ করে তার ডান হাত ধরে ফেলে,
–কি করছো কি বিহান হাত ছাড়ো।
–ছেড়ে দেবো তার আগে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।কেন আমাকে বারবার ফিরিয়ে দিচ্ছো?

–আমি কিছু জানি না, আমার হাতটা ছাড়ো।
বিহান নির্জনাকে হালকা টান দিয়ে তার কাছাকাছি নিয়ে আসে। এরপর তার চোখে চোখ রেখে বলে,
–আজ তোমাকে বলতেই হবে মানুষ হিসেবে কি আমি এতটাই অযোগ্য যে আমাকে ভালবাসা যায় না? বিয়ে করা যায় না।
(নির্জনাকে ছেড়ে দেয়) অবশ্য তুমি তোমার জায়গা থেকে ঠিকই আছো। তোমার মতো সুন্দরী মেধাবী মেয়ে আমার মতো ভবঘুরে সামান্য প্রাইভেট কোম্পানির চাকুরীজীবী ছেলেকে কেন ভালবাসবে? কি দিতে পারবো তোমাকে আমি? আমার আসলেই কোন যোগ্যতা নেই।
–না বিহান তুমি আমাকে ভুল বুঝছো। আমি কখনোই তোমাকে অযোগ্য ভাবি নি।
ভারাক্রান্ত স্বরে বিহান বলে,
–তবে কেন আমাকে ভালবাসোনা? কিসের এতো দ্বিধা?
– এটা দ্বিধা না বিহান ভয়।
–কিসের ভয়?
নির্জনা অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করে,
– রুহান খন্দকার
–কে রুহান খন্দকার?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নির্জনা বলতে শুরু করে,
–আমি আজ অব্দি কাউকে বলি নি। কিন্তু আজ যদি না বলি তবে তুমি আমাকে ভুল বুঝবে। তাছাড়া প্রতিবার তোমাকে এভাবে ফিরিয়ে দিতে দিতে আমিও ক্লান্ত।
–আমি শুনছি।
– গত বছর ভার্সিটি থেকে আমরা আর.কে ইন্ডাস্ট্রিতে গেছিলাম ফইনাল প্রজেক্ট আর এসাইনমেন্টের জন্য। সেখানেই আমার উপর রুহান খন্দকার নামে ঐ শকুনটার কুনজর পরে। আর তখন থেকেই দিনের পর দিন সে আমার উপর ভালোবাসার নামে মেন্টাল টর্চার করে যাচ্ছে।
–এক মিনিট এক মিনিট আর.কে. ইন্ডাস্ট্রিজ মানে ঐ মেডিসিন ব্রান্ড যেটা লায়ন গ্রুপের। আর রুহান খন্দকার মানে তার মালিক বাংলাদেশের ইউথ আইকন দ্য রুহান খন্দকার?
মাথা নাড়িয়ে নিরবে সম্মতি জানায় নির্জনা।
অস্থির হয়ে বিহান বলে,
–কিন্তু সে তোমার পিছনে কেন পড়ে আছে?হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক তার কি মেয়ের অভাব পড়েছে নাকি?
–একই প্রশ্ন আমিও তাকে করেছিলাম। সে উত্তর দিয়েছিল, যে মুহূর্তে, আমি তাকে না করে দিয়েছে সেই মুহূর্ত থেকে নাকি আমি তার নেশায় পরিণত হয়েছি। তাই যতদিন পর্যন্ত আমাকে নিজের করে না নিবে, ততদিন আমার পিছু ছাড়বে না। আমাকে ভালবাসে তাই জোর করে উঠিয়ে নিয়ে বিয়ে করা, বন্দি করে রাখা এসব করবে কিন্তু আমাকে অন্য কারও হতেও দিবে না। যদি আমি ভুল করে অন্য কাউকে ভালবাসি তবে তার মৃত্যু অনিবার্য। প্রথমে ভেবেছিলাম বড়লোক মানুষ আমি না করেছে তাই ইগোতে লেগেছে। কিছুদিন গেলে এমনি ঠিক হয়ে যাবে। শত শত মেয়েদের ভিড়ে আমাকে ভুলে যাবে। কিন্তু না বিগত দিনগুলোতে সে আমার সব ধারণা বদলে দিয়েছে। ভুলে যাওয়ার তো দূরের কথা দিন তার পাগলামি আরও বেড়ে গেছে। এখনতো সে আব্বু-আম্মু এমনকি নীড়কেও(নির্জনার ছোটভাই) প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে।
–মগের মুল্লুক নাকি? যা ইচ্ছে তাই করবে?
–এমনটাই বলতে পারো। তুমি জানো ফাইনাল এক্সামের পর আমি তোমার প্রপোজাল এক্সেপ্ট করে বিয়ের কথা ভাবছিলাম। কিন্তু সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। বড্ড ভালবাসি তোমায় তাই আমি চাইনা আমার জন্য তোমার কোন ক্ষতি হোক।
কথাগুলো বলে নির্জনে হুহু করে কেঁদে ওঠে।
বিহান তাকে আস্তে করে বুকে টেনে নেয়। নির্জনার জন্য বিহানের খুব কষ্ট হচ্ছে। মেয়েটা হাসিখুশি মুখের আড়ালে কতযন্রণা লুকিয়ে রেখেছে। সে নির্জনাকে বুক থেকে উঠিয়ে বলে,
–পাগলি একটা এত ভালোবাসো আর বলতে পারছিলে না? রুহান খন্দকারকে নিয়ে টেনশনতো। ঠিক আছে, আজই এমন ব্যবস্থা করবো যে রুহান খন্দকার কেন পৃথিবীর কেউ আর তোমাকে আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না।
নাক টেনে টেনে নির্জনা জিজ্ঞেস করে,
–কি করবে তুমি?
–আমরা আজই বিয়ে করবো।
–কিন্তু
–কোন কিন্তু না। রুহান খন্দকারকে ভয় পেলে সে আরও পেয়ে বসবে। এখন সাহসী হতে হবে। তুমি যদি একবার আমাকে বিয়ে করে ফেলো তাহলে পৃথিবীর কোন শক্তি আর আমাদের আলাদা করতে পারবে না।
–কিন্তু তার জন্য তো আমার মেয়েকে রাজি হতে হবে। বলো নির্জনা তুমি কি এই বাঁদরটাকে বিয়ে করবে?
পাপিয়া আক্তারের আওয়াজে তারা দুজন দুজনের থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়।
–আম্মু। ওভাবে বলো না বাদর হলেও কিউট আছে।
পাপিয়া আক্তার খুশিতে নির্জনাকে বুকে টেনে নেয়।
–বোকা কোথাকার এত কিছু হয়ে গেল আর তুমি আমাকে জানাওনি। তুমি কি ভুলে গেছো তোমার বাবা মিনিস্টার এর ড্রাইভার। আর তিনি তোমার বাবাকে কতটা স্নেহ করে ভালবাসে। তোমার ভার্সিটিতে ভর্তির সময় তিনি আমাদের কতো হেল্প করেছে মনে নেই। মানছি রুহান খন্দকারের আমরা কিছু করতে পারবো না কিন্তু মন্ত্রী জাফর সিদ্দিকীতো করতে পারবে। কিচ্ছু ভেবোনা সব ঠিক হয়ে যাবে।

নির্জনা মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে থাকে।
কিন্তু বিহান পাপিয়া আক্তারের কথা সম্পূর্ণ সহমতে না জানিয়ে বলে,
–খালামণির মন্ত্রী হলেও কেউ শুধু শুধু লায়ন গ্রুপের বিরুদ্ধে যাবে না। আর তাছাড়া আমরা রুহান খন্দকারকে কেন সুযোগ দিব? তুমি আর খালু রাজি থাকলে আমরা আজকেই বিয়েটা করে ফেলবো।
–কিন্তু আপা দুলাভাই কি তাদের একমাত্র ছেলের এভাবে বিয়ে দিতে রাজি হবে?
–আম্মু আব্বুর টেনশন তুমি করো না তো আমি তাদের সামলে নিবো। প্রয়োজনের পরে বড় করে অনুষ্ঠান করা যাবে। তুমি শুধু খালুকে ফোন দিয়ে বলো নীড়কে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসতে। আমি সব ব্যবস্থা করেছি।
বলে বিহান বের হয়ে যাবে তখনই দরজার সামনে থেকে ফিরে এসে পাপিয়া আক্তারের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
–খালামণির ওই বক্সটা দাও তো যেটা তোমাকে রাখতে দিয়েছিলাম।
–আনছি
বলে তিনি রুমে চলে যায়।
–কিসের বক্স বিহান?
নির্জনার প্রশ্ন বিহান মুচকে হেসে বলে,
–অপেক্ষা কর অবুঝ বালিকা। অপেক্ষার ফল সুমিষ্ট হয়।

একটু পর পাপিয়া আক্তার একটা বাক্স এনে বিহানের হাতে দিলে সে বক্সটা খুলে একটা ছোট চেইন আর লকেট বের করে নির্জনার গলায় পরিয়ে দিয়ে বলে,
–আজ থেকে তুমি আমার হলে। আমি তোমার জীবনে থাকি বা না থাকি আমি এই লকেটটা তোমাকে আমার কথা মনে করিয়ে দেবে।
এরপর বিহান বের হয়ে যায়।
পাপিয়া আক্তার নিজের স্বামীকে ফোন দিয়ে সব কথা জানায়। আর নওশাদ ছুটি নিয়ে নীড়ের কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

ঘন্টাখানেক পরে কলিংবেলের শব্দে পাপিয়া আক্তার দরজা খুলে বিহানকে দেখে চিৎকার করে ওঠে।
–বিহান!! এ কি হলো তোর?
তার চিৎকারের নির্জনা দৌড়ে বাইরে বের হয়ে দেখে কয়েকজন বন্দুকধারী তাদের ঘরে। এর মধ্যে একজন পাপিয়া আক্তারের দিকে বন্দুক তাক করে আছে। আর অন্য দিকের রক্তাক্ত প্রায় জ্ঞানহীন অবস্থায় বিহানকে দুজন ধরে রেখছে।তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে ভীষণ নির্মম ভাবে তাকে পেটানো হয়েছে।
এসবের মাঝখানে রুহান সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। নির্জনার হাত পা ভয়ের জমে গেছে। নিজের চোখের সামনে প্রিয় মানুষদের এত কষ্ট দেখেও সে কথা বলতে পারছে না।
নির্জনাকে দেখে রুহান বাঁকা হেসে তার দিকে এগিয়ে যায়।
–এই তো আমার সুইটহার্ট এসে গেছে। কি বলেছিলাম না অন্য কাউকে ভালবাসলে তার মৃত্যু অনিবার্য।
বলেই সে বিহানের দিকে বন্দুক তাক করে। সাথে সাথে নির্জনা রুহানের পায়ে পরে যায়। ঠুকরে কেঁদে উঠে বলে,
–দয়া করে বিহানকে ছেড়ে দিন। আপনি যা বলবেন আমি তাই শুনবো। আপনি যদি বলেন আপনাকে বিয়ে করতে তাও করব আপনি যদি বলেন বিয়ে ছাড়া থাকতে হবে তাও থাকবে তবুও আমার বিহানকে আর আমার পরিবারকে ছেড়ে দিন।

রুহান নির্জনাকে তুলে দাঁড় করিয়ে শয়তানি হাসি হেসে বলে,
–সরি সুইটহার্ট তুমি অনেক দেরি করে ফেলেছ। তাছাড়া তোমাকে জোর করা হলে তো অনেক আগেই করতে পারতাম কিন্তু আমি তোমাকে সম্পূর্ণ নিজের করে পেতে চাই। তোমার হৃদয়- মন-মস্তিষ্ক (রিভালবার দিয়ে নির্জনাকে স্পর্শ করে)সুন্দর এই শরীর সবকিছুতে শুধু রুহানের অধিকার থাকবে। কিন্তু (বিহানের দিকে রিভালবার তাক করে) এ বেঁচে থাকতে তা হবে না। কারণ তুমি তাকে ভালোবাসো।
–আমি ওকে ভালোবাসি না বিশ্বাস করো না আমি ওকে ভালোবাসি না।
বলে নির্জনা কাঁদতে থাকে।
বিহান বহু কষ্টে মুখ খুলে অস্পষ্ট স্বরে বলে,
–আমাকে মেরে ফেললেও নির্জনা আর কখনোই তোকে ভালোবাসবে না। ও শুধু আমাকে ভালবাসে।
নির্জনা দৌড়ে বিহানের কাছে গিয়ে বলে,
–একদম চুপ কোন কথা বলবে না তুমি। আমি তো উনাকে বুঝাচ্ছি।
বিহান নিজের রক্তাক্ত হাত দিয়ে নির্জনার কলেজ স্পর্শ করে বলে,
–ভালোবাসি তোমায় অবুঝ বালিকা।
এতে নির্জনা আরও জোরে কেঁদে দেয়। সে আবার দৌড়ে রুহানের কাছে এসে হাতজোড় করে বলতে থাকে,
–আপনি বিশ্বাস করুন আমি ওকে ভালোবাসি না।
–তাই বুঝি? ভালো না বাসলে তো এর মৃত্যুতে তোমার কিছু যায় আসবে না তাই না
বলে রোহান বিহানের বুকে একটা গুলি চালিয়ে দেয়। পাপিয়া আক্তার আর নির্জনা একসাথে চিৎকার করে ওঠে। একজন দৌড়ে বিহানের কাছে যেতে চাইলে রুহান তার হাত ধরে বাধা দিয়ে বলে,
–ওটা মরে গেছে সুইটহার্ট তাই কাছে গিয়ে কোন লাভ নেই। (সাথে থাকা গার্ডদের ইশারা করে) এটাকে বস্তা বন্দি করে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দে আর বাসাটা ভালো করে পরিষ্কার করে দে।
(নির্জনার দিকে তাকিয়ে) এই ঘটনার তিল পরিমাণ যদি কেউ জানে তাহলে তোমার পরিবারের কেউ বাঁচবে না । আসছি সুইটহার্ট খুব শিগ্রই দেখা হচ্ছে।

এরপর রুহান বের হয়ে যায়।
পাপিয়া চৌধুরী আর নির্জনা কান্নায় ভেঙে পড়ে। নওশাদ আর নীড় এসে তাদেরকে অবস্থা দেখতে পায়। নওশাদ পাপিয়ার কাছ থেকে সবকিছু জেনে দিকের জাফর সিদ্দিকীর কাছে কমপ্লেন করে। জাফর সিদ্দিকী পুলিশকে ঘটনার তদন্তের কথা বলে। প্রমাণ না থাকায় কোন লাভ হয় না। কিন্তু ইন্টারনেটে খবরটা প্রচার হয়ে যায়।
এতে রুহান ঘায়েল তা বাঘের মত ক্ষেপে যায়। নানাভাবে নির্জনাকে আর তার পরিবারকে হয়রানি করে। ফলে শহরে নির্জনার খুব বদনামি হয়।
বাধ্য হয়ে নওশাদ পরিবার নিয়ে অন্য শহরে চলে যায়। সেখানে সব চলছিল কিন্তু হঠাৎ আবার একদিন নির্জনার কাছে রুহানের ফোন আসে ঘটনা ক্রমে নওশাদ তা রিসিভ করে আর তাকে উল্টাপাল্টা কিছু কথা শোনায়।
ফলশ্রুতিতে কিছুদিন পর নওশাদ নীড় নিয়ে স্কুল থেকে ফেরার পথে তাদের রিক্সাকে একটা ট্রাক চাপা দেয়। মুমূর্ষ অবস্থায় দুজনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।কিন্তু সেখানকার ডাক্তার চিকিৎসা করতে অসম্মতি জানায়। তাই নির্জনা আর পাপিয়া আক্তার বাধ্য হয়ে তাদের আবার ঢাকায় নিয়ে আসে। ডাক্তার আপ্রাণ চেষ্টা করে তাদের বাঁচানোর জন্য। কিন্তু লাভ হয় না। পাঁচদিনের মাথায় নীড় আর পনের দিনের মাথায় নওশাদ মারা যায়।

নীড় আর নওশাদের মৃত্যুর পর জাফর সিদ্দিকী রুহানের ব্যাপারটা শক্তভাবে তদন্তের নির্দেশ দেন। এতে রুহানের বাবা একটু ভয় পেয়ে যায়। নিচের একমাত্র ছেলেকে বাঁচাতে তাকে রাতারাতি অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দেয়।

অসহায় অবস্থায় পাপিয়া আক্তার নির্জনাকে নিয়ে তাদের গ্রামের বাড়িতে থাকা শুরু করে। কিন্তু এতদিন তাদের সকল জমি-জায়গা ভোগ করা চাচারা বিষয়টি হজম করতে পারে না। ফলশ্রুতিতে তারা নির্জন আর পাপিয়ার নামে নানা রকম কথা ওঠাতে শুরু করে। অন্যদিকে মাস কয়েক পরে পুনরায় নির্জনার ফোনে রুহানের ফোন কল আসা শুরু হয়। একদিকে চাচাদের অত্যাচার, অন্যদিকে রুহানের অত্যাচার বাধ্য হয়ে পাপিয়া আক্তার আর নির্জনা জাফর সিদ্দিকীর শরণাপণ্য হয়।

কিন্তু জাফর সিদ্দিকী এবার এক অদ্ভুত কথা বলে। তিনি বলেন,
–খন্দকাররা প্রভাবশালী ব্যক্তি । তাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীও সহজে যায় না সেখানে আমি তো সামান্য মন্ত্রী। তাছাড়া রুহানের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ নেই। তবে নির্জনা মা যদি আমার পরিবারের সদস্য হত তবে আমি তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারতাম। পার্সোনালি সিকিউরিটি দিতে পারতাম।
এরপর তিনি ইনিয়ে-বিনিয়ে তার মানসিকভাবে অসুস্থ ছেলের সাথে নির্জনার বিয়ের কথা বলে। পাপিয়া আক্তার রাজি না হলেও নির্জনা এক কথায় রাজি হয়ে যায়। কিন্তু তার শর্ত থাকে যেকোনো মূল্যে জাফর সিদ্দিকী তার মাকে রোহানের হাত থেকে বাঁচাবে।

অতীতের এইসব কথা ভাবতে ভাবতে গাড়িতেই নির্জনার তন্দ্রা চলে আসে।
হঠাৎ সে দেখতে পায়, বিহান তার দিকে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর নির্জনা সেই হাত ধরা মাত্রই বিহান ছইয়ের মতো উবে যায়। নির্জনা খেয়াল করে তার হাত রক্তে রঞ্জিত হয়ে যাচ্ছে এবং সাথে সাথে চারিদিকটা অন্ধকার হয়ে গেছে । আর সেই অন্ধকারের মধ্যে সে দেখতে পায় তার ছোট ভাইটা রক্তাক্ত অবস্থায় স্কুল ইউনিফর্মে তার দিকে দৌড়ে আসছে আর চিৎকার করছে ‘আপু আমাকে বাঁচাও ‘
নির্জনা তার দিকে এগিয়ে যাবে তখনই তার বাবা নওশাদ রহমান আর্তচিৎকার কানে ভেসে আসে। সেদিকে তাকাতেই নওশাদ রহমান বলে উঠে,
–আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
শত চেষ্টা করেও নিজের বাবা আর ভাইকে বাঁচানোর জন্য নিজের জায়গা থেকে চুল পরিমান নড়তে পারছে না নির্জনা। তাদের দুজনের আর্তনাদে নিঃশ্বাস বন্ধের উপক্রম হচ্ছে। বহু কষ্টে চোখ মেলে তাকায় নির্জনা। হৃদপিন্ডটা এখনো উঠানামা করছে। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে চারদিকে তাকিয়ে দেখে সে এখনো গাড়িতে। তার পাশে জাফর সিদ্দিকী সিটে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছে।
খানিকবাদে গাড়ি থামতেই জাফর সিদ্দিকীর ঘুম ভেঙে যায়। তিনি ড্রাইভারকে কারণ জিজ্ঞেস করতেই ড্রাইভার জানায় টায়ার পাংচার হয়ে গেছে।
তাই বাধ্য হয়ে নির্জনা আর জাফর সিদ্দিকী নেমে দাঁড়ায়।
নির্জনার চোখে মুখে অস্থিরতা দেখে জাফর সিদ্দিকী তাকে জিজ্ঞেস করেন,
–তুমি ঠিক আছো।
নির্জনা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বলে,
–জ্বি আমি ঠিক আছি। আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল।
–বলো।
–আম্মুকে একা রেখে এলাম যদি রুহান খন্দকার বা আমার চাচারা আম্মুর কোন ক্ষতি করে?
–চিন্তা করো না তোমার আম্মুর পেছনে গার্ড রেখেছি। ওরা ছদ্মবেশে চব্বিশ ঘন্টা তোমার মাকে পাহারা দেবে।
–ধন্যবাদ স্যার।
–প্রথমত ধন্যবাদ দেওয়ার মতো আমি কিছু করিনি এটা আমার কর্তব্য। আর দ্বিতীয়ত, এখনো স্যার বলবে? এ দেশের ছেলের বউরা শ্বশুরকে বাবা বলে ডাকে।
নির্জনা মুচকি হেসে বলে,
–আমি আপনার ছেলের বউ এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য আমি আপনার ড্রাইভারেরই মেয়ে। তাই আপনাকে বাবা বলে নিজের অবস্থানটা ভুলতে চাই না।
–আহা এখানে অবস্থানের কথা আসছে কেন? তুমি আমার পুত্রবধূ এরচেয়ে বড় অবস্থান আর কি হতে পারে?
–যথার্থ বলেছেন স্যার। কিন্তু একটা কথা বলুন তো, আজ যদি আপনার ছেলে সুস্থ থাকতো তাহলে কি তার সাথে আমাকে বিয়ে দিতেন? আমি জানি ডাক্তার বলেছে, আপনার ছেলে কখনো সুস্থ হবে না কিন্তু উনি যদি কখনো সুস্থ হন তবে কি একটা ড্রাইভার এর মেয়েকে নিজের স্ত্রী হিসেবে মেনে নিবেন?

নির্জনার প্রশ্নের কোন উত্তর পারল না জাফর সিদ্দিকী। মেয়ে হিসেবে যতই ভালো হোক না কেন আজ অর্ক সুস্থ থাকলে কোনদিনও তিনি নির্জনার সাথে তার বিয়েটা দিত না। কেননা সমাজ স্ট্যাটাস বলে একটা কথা আছে। যেগুলো চিৎকার করে জাফর সিদ্দিকীর মস্তিষ্কে জানান দিচ্ছে, নির্জনার মতো নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে তার পরিবারের বউ হতে পারে না।

জাফর সিদ্দিকীর মৌনতার পরিপ্রেক্ষিতে নির্জনা বলে,
–স্যার আপনার নিরবতাই আমাকে উত্তর দিয়ে দিয়েছে। বাবা মারা যাওয়ার পর আমি একটা কথা বুঝেছি এ জগতে কোন কিছুই ফ্রী না। সব কিছুর বিনিময় হয়। যেমন আপনার সাথে আমার হয়েছে আমাদের মা-মেয়ের নিরাপত্তার বিনিময়ে আপনার অসুস্থ ছেলের সারাজীবনের দায়িত্ব আমার। আর আমি এটাও জানি কখনও আপনার ছেলে সুস্থ হলে আমাকে আপনাদের বাড়ি ছাড়তে হবে।
জাফর সিদ্দিকী জোরালো গলায় বলে,
–এমন কিছুই হবে না। তুমি যেমন এখন আমার পুত্রবধূ তেমন অর্ক ভালো হয়ে গেলেও থাকবে।

–স্যার এই কথাটা এতো জোরালো গলায় বলবেন না। কারণ আপনার ছেলে সুস্থ হলে সেই অধিকার আর আপনার কাছে থাকবে না।

টায়ার বদলানোর পর ড্রাইভার তাদের গাড়িতে ডাকে। ধীর পায়ে নির্জনা গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।
জাফর সিদ্দিকী ভাবতেও পারছে না একটা বাচ্চা মেয়ে তাকে এইভাবে আয়না দেখিয়ে দিবে। নিজের বিবেকের কাছে আজ তিনি প্রশ্নবিদ্ধ। সত্যি তো, যে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার নিয়ে তিনি রাজনীতিতে নেমেছিলেন আজ যখন একটা অসহায় মেয়ে তার কাছে সাহায্য চাইলো তখন তিনি কি করলেন?নিজের স্বার্থে মেয়েটাকে ব্যবহার করলেন। নিজের অসুস্থ ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে মেয়েটার জীবন নষ্ট করে দিলেন। আজ জাফর সিদ্দিকীর বিবেক তাকে প্রচন্ড ধিক্কার দিচ্ছে।


বরের গাড়ি।
অর্কে নিজের রাগ কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
সে রাগে গম গম করে বলতে থাকে,
–একটা মেয়ে কতটা লোভী হলে পাগলকে বিয়ে করতে রাজি হয়?
অর্ককে সমর্থন করে আরশি বলে,
–আই এ্যাগরি। মেয়েটা লোভী। আমি তো ভেবেই পাইনা নওশাদ আঙ্কেলের মত একটা ভালো মানুষের মেয়ে এতোটা লোভী হতে পারে।
তখন ডাক্তার প্রীতি তাদের দুজনার কথায় অসম্মতি জানায়,
–এভাবে বলো না এমনওতো হতে পারে মেয়েটা কোন কারণে এই বিয়েটা করতে বাধ্য হয়েছে।

অর্ক বাঁকা হেসে বলে,
–টাকার চেয়ে বড় কারণ আর কিছুই হতে পারে না ডা. প্রীতি। খোঁজ নিয়ে দেখো, মেয়েটা হয়তো আমার বাবার সাথে মোটা টাকার বিনিময়ে কোন কন্ট্রাক্ট সাইন করেছে। কিংবা কোথাও আমার নামে থাকা প্রোপার্টির ব্যাপারে জানতে পেরেছে তাই বাবাকে এভাবে পটিয়েছে।

প্রীতি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
–হতেও পারে। আমি তো এজন্য বললাম যে মেয়েটাকে দেখে খুব ইনোসেন্ট মনে হয়েছে। কি সুন্দর মায়াবী মুখটা।
–ছলনা সবসময় সুন্দর হয় ডা. প্রীতি।
আরশি এবারও ভাইয়ের সমর্থন করে বলে,
–একদম। তারমানে তুমি স্বীকার করছো মেয়েটা সুন্দর
এবার অর্ক চুপ হয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পর
আরশি আবার বলে,
–কি ভাবলে মেয়েটাকে কিভাবে শিক্ষা দেবে?
–জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ। ওই মেয়ে বাড়িতে ঢুকা থেকে এমন টর্চার করব না যে দুদিনের মাথায় লেজ গুটিয়ে পালাবে। সব প্ল্যান করা আছে।
খুশি হয়ে আরশি বলে,
–প্লিজ তোমার প্লানে আমাকেও এড করে নাও। আই এম সো এক্সাইটেড।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রীতি তাদের দুজনকে সাবধান করে বলে,
– যা করার ভেবেচিন্তে করবে। দেখা গেলো তোমাদের ধারণা সম্পূর্ণ ভুল আর মেয়েটা সম্পর্কে আমি যা ভাবছি তাই সঠিক। তখন কিন্তু নিজেদের ক্ষমা করতে পারবে না।

কিন্তু প্রীতির কথায় অর্ক কিংবা আরশি কোন পাত্তাই দিল না। বরং তারা উৎসাহের সাথে নির্জনাকে অপদস্ত করার পরিকল্পনা করতে লাগলো।

–চলবে?