প্রেমে পরা বারণ পর্ব-০৫

0
44

#প্রেমে_পরা_বারণ
পর্ব -৫
#Nosrat_Monisha

–আমার মা জোহরা সিদ্দিকী এবং আমার স্ত্রী আসরা সিদ্দিকীর মৃত্যুর জন্য অর্ক দায়ি।
জাফর সিদ্দিকীর কথায় নির্জনা ভ্রুকুটি করলেও সে কিঞ্চিতমাত্র বিচলিত হয়ে পরে নি। জীবনে এতো কিছু দেখেছে আর সহ্য করেছে যে এখন সব জটিল খোলাসাই তার কাছে সাধারণ মনে হয়। তবুও সে বলে,
–আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না স্যার।
জাফর সিদ্দিকী একটু থেমে আবার বলেন,
– তোমাকে সবট খুলে বলছি তাহলেই বুঝতে পারবে।
আমার মা জহুরা সিদ্দিকী আসরাকে পছন্দ করে এ বাড়িতে বউ করে নিয়ে আসে। পর দুই বছর গ্যাপে আমার তিন সন্তান জন্ম নিলো। আসরা তার সবটুকু দিয়ে এই সংসার সাজিয়েছিলো। রাজনীতির উঠতি ক্যারিয়ারের চাপে ওকে সময় দিতে না পারলেও আমাদের সংসারের ভালবাসার কমতি ছিলো না। আসরাদের গ্রামের রীতি ছিলো আম-কাঁঠালের সময় মেয়ে আর মেয়ের জামাইকে দাওয়াত করে খাওয়াতে হয়। আমি প্রথম দু-তিন বছর গেলেও পরে আর যেতে পারি নি। সেই বছর একইভাবে দাওয়াত এলে সিদ্ধান্ত হলো আমার মা আর আসরা তিন বাচ্চাসহ যাবে। কিন্তু অর্ণব আর আরশি ছিলো আমার ভক্ত তাই ওরা যেতে রাজি হলো না। তবে অর্ক বরাবরই মা ন্যাওটা থাকায় সে সাথে গেলো। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে এর দুই দিন পর আমার পার্টি অফিসে ফোন এলো আসরাদের গ্রাম থেকে। জলদি সেখানে যেতে কারণ আসরা আর আমার মায়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে।
আমি সব ছেড়ে বাচ্চাদুটোকে নিয়ে রওনা হই। গ্রামটা শহর থেকে দূরে আর রাস্তার অবস্থা খারাপ থাকায় পৌঁছাতে সন্ধ্যা নামে। আমি আর বাচ্চা দুটো যখন সেখানে পৌঁছালাম দেখি তিনটা লাশ পর পর বারান্দায় সাজানো। একটা আমার মায়ের একটা, আমার শ্বশুরের আর আরেকটা অর্ণবের মায়ের। আমার মাথা নষ্ট হয়ে যায়। আমার শ্যালক আর শ্বাশুড়ি মারফত জানতে পারি রাতে তাদের বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। ডাকাতির এক পর্যায়ে অর্ক ভয় পেয়ে চিৎকার শুরু করায় ডাকাতদল তাকে চুপ করাতে গুলি করে কিন্তু আমার মা আর আসরা অর্ককে বাঁচাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় । অর্ক চোখের সামনে মা আর দাদীর হত্যা দেখে আরও বেশি চিৎকার শুরু করলে তারা অর্ককে আঘাত করে এতে সে জ্ঞান হারায় অন্যদিকে আমার শ্বশুর নিজের মেয়ে আর নাতির এমন করুন অবস্থা দেখে প্রতিবাদ করতে গেলে তাকেও গুলি করে হত্যা করে ডাকাত দল। আমি তাদের কোন কথা বিশ্বাস করি নি। আমার মনে হতে লাগলো আমার শ্যালক আর শ্বাশুড়িই এর জন্য দায়ী। অর্কের সাথে দেখা করতে চাইলাম কিন্তু তারা জানালো অর্ক হাসপাতালে ভর্তি এখনো জ্ঞান ফিরে নি। মা-বউয়ের লাশ আর অজ্ঞান ছেলেকে নিয়ে সোদিনই ঢাকা ফিরে এলাম। শত চিকিৎসার পরও অর্কের জ্ঞান ফিরে আসে নি। ডাক্তার জানায় মাথায় আঘাত আর রক্তক্ষরণের জন্য সে কোমায় চলে গেছে। অর্ণব আর আরশিকে নিয়ে আমার নতুন সংগ্রাম শুরু হলো। যেহেতু শ্বশুর বাড়ির সবার উপর আমার সন্দেহ ছিলো তাই আমি কাউকে আমার বাড়িতে এলাও করি নি। দিনরাত ভেবেছি একবার অর্কর জ্ঞান ফিরে এলেই সবার পর্দা ফাঁস হবে।
আমার অপেক্ষার অবসান ঘটে । ছয় মাস পর অর্ক কোমা থেকে বের হয়ে আসে। কিন্তু ডাক্তার জানায় সে শকে আছে তার স্মৃতি ফিরতে সময় লাগবে। কিছুদিন পর অর্ক আমাদের সবাইকে মোটামুটি চিনতে পারে। যদি ধীরে ধীরে সেদিনের কিছু কিছু কথা মনে করে। কিন্তু তার মস্তিষ্কে সমস্ত স্মৃতি আবছায়া হয়ে থাকে। তবে এই আবছায়ার মধ্যেও সে একটা কথা স্পষ্ট মনে করতে পারে যে তার মা আর দাদী তাকে বাঁচাতে গিয়ে গুলি খয়েছে। আমি বুঝতে পারি নিজে শ্বাশুড়ি আর শ্যালককে ভুল বুঝেছি। তাদের কাছে মাফ চাই, আমার এখানে আসতে বলি কিন্তু তারা আসে না। খানিকটা অভিমান করেই বলে,
যে বাড়িতে মেয়ে নেই সেখানে গিয়ে কি লাভ তবে বাচ্চাদের জন্য চিরকালই নানির বাড়ির দরজা খোলা।
এটুকু বলে জাফর সিদ্দিকী থেমে যায়। তাকে থেমে থাকতে দেখে নির্জনা প্রশ্ন করে,
–এরপর কি হলো? অর্করই বা এমন অবস্থা কি করে হলো?

– অর্ণব আর আরশি অর্ককে তাদের মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী ভাবতে থাকে। অর্ক তাদের কাছে যেতে চাইতো তাদের সাথে খেলতে চাইতো কিন্তু ওরা দুজন তার সাথে বাজে ব্যবহার করতো, মায়ের খুনি বলে তাড়িয়ে দিত।
একজন কিশোর, অন্যজন শিশু। আমি অথৈই সাগরে পড়ে গেলাম। কাউকে বুঝাতে পারছিলাম না যে যা হয়েছে তাতে অর্কের কোন দোষ নেই। আমার হাসি-খুশি ছেলে-মেয়েরা হাসতে ভুলে যায়। তারা অর্ক থেকে দূরে থাকতে শুরু করে। এরই মধ্যে টক্সিক কিছু আত্মীয়-স্বজন আর প্রতিবেশী অর্ণবকে অর্কর বিরুদ্ধে আরো বেশি ক্ষেপিয়ে দেয়, যার ফলে অর্ণব তাকে আমার আড়ালে মারধর করা শুরু করে। এসব কিছুর কারণে অর্কও ভাবতে থাকে সে নিজেই তার মা আর দাদিকে খুন করেছে। ভালো হওয়ার বদলে আমার ছেলেটা দিন দিন খারাপ হতে থাকে। একসময় বুঝতে পারি সে মানসিক রুগি হয়ে গেছে। দেশে চিকিৎসকরা কোন সলিউশন দিতে না পারায় বাধ্য হয়ে আমি তাকে চিকিৎসার জন্য বাইরে পাঠাই। তিন বছর পর সেখানকার ডাক্তাররা জানায় তার ভালো হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই, কেননা তার ব্রেইন এগারো বছর বয়সে আটকে গেছে । তাই বাধ্য হয়ে তাকে দেশে নিয়ে আসি। ততদিনে অর্ণব আর আরশি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। তারা অর্কের সাথে মিশতে চেয়েছে কিন্তু অর্কই তাদে সাথে কোন কথাই বলতো না, বরং তাদের মারতে যেতো। এর মাঝে একদিন অর্কের পাগলামি অনেক বেশি বেড়ে যায় ফলে তাকে শিকল দিয়ে আটকে রাখা হয়। দশ বছর আমার ছেলেটা শিকলে বন্দি ছিল।
এবার নির্জনা প্রশ্ন করে,
–এই দশ বছরে আপনারা উনার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন নি?
–করেছি কিন্তু কোন ডাক্তারই দুদিনের বেশি এ বাড়িতে টিকতে পারতো না। আমিতো কবেই হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। তখনই আমাদের জীবনে ফেরেস্তা হয়ে আসে ডা.প্রীতি। বছর খানেক আগে আমার এক পরিচিত ডাক্তার অর্কের চিকিৎসার জন্য তাঁর প্রিয় ছাত্রী ডা.প্রীতির নাম সাজেস্ট করে। আমিও ডা.প্রীতিকে নিয়ে আসি। সম্পূর্ণ ভালো না হলেও আমার ছেলে শেকলের জীবন থেকে মুক্তি পায়। সবার সাথে কথা বলতে শুরু করে। আরশির সাথে তো তার এখন বেশ ভালো সম্পর্ক। (একটু দ্বিধা নিয়ে) আমি জানি এ বিয়েটা দিয়ে আমি তোমার জীবন নষ্ট করেেছি কিন্তু তবুও একটা অনুরোধ ছিল।
–বলুন।
–আমি জানি ডাক্তাররা বলেছে যে, অর্ক আর ভালো হবে না। কিন্তু ডা. প্রীতির আসার পর থেকে আমি মিরাকেলে বিশ্বাস করা শুরু করেছি। আমার বিশ্বাস সে একদিন ভালো হয়ে যাবে।
তাই আমার ছেলেটার সাথে খারাপ ব্যবহার করো না। সে যদি কোন ভুল বা দুষ্টামি করে তবে একটু মানিয়ে নিও। যদি পারো তার সাথে বন্ধুত্ব করে নিও।
–হুম।
জাফর সিদ্দিকী আবার বলে,
–নির্জনা
–জ্বি বলুন
–আমি বাবা তাই একজন মায়ের মতো নিজের সন্তানের সাথে মিশতে পারি না, তাদের সুখ-দুঃখ ভাগ করতে পারি না, কিন্তু এর মানে এই না যে আমি তাদের ভালবাসি না। আসলে আমি ভালবাসাটা প্রকাশ করতে পারি না। আমি জানি,বুঝতে পারি, আমার তিন সন্তানের কেউই ভালো নেই। কিন্তু তাদের সাথে এই নিয়ে কথা বলার সাহস হয় না। কেননা এর জন্য কোথাও না কোথাও আমিই দায়ী। তাদের মা মারা যাওয়ার পর আমি তাদের যথেষ্ট সময় দিতে পারি নি। কাজের লোকের হাতে তাদের সব ছেড়ে দিয়েছি। আজ দেখো আমার ক্যারিয়ারে আমি একজন সফল রাজনীতিবিদ হলেও পিতা হিসেবে আমি ব্যর্থ।

অর্কের অতীত সম্পর্কে জানিয়েছেন সেটা ঠিক আছে কিন্তু নির্জনা বুঝতে পারছে না জাফর সিদ্দিকী তাকে কেন এসব কথা বলছে। সে কোন প্রশ্ন করার আগে তিনি নিজেই বলেন,
–আমার এই বাড়িতে অর্থ-বিত্তের কমতি না থাকলেও মায়া-মমতা-স্নেহের বড়োই অভাব। যদি পারো বাড়িটাকে আপন করে নিও বাড়ির সদস্যদের ভালোবেসো।
জাফর সিদ্দিকীকে এই মুহূর্তে নির্জনার কাছে আর নির্দয় স্বার্থলোভী মন্ত্রী মনে হচ্ছে না বরং এক অসহায় পিতা বলে মনে হচ্ছে। যিনি কি-না তার সামনে নিজের সন্তানদের সুখের আর্জি করছেন। অন্য সময় হলে নির্জনা মুখের উপর না করে দিতে কিন্তু আজ জাফর সিদ্দিকী উপর তার দয়া হলো কারণ আজকে নির্জনা তাঁর মধ্যে নিজের বাবাকে দেখতে পাচ্ছে। তার বাবাও একদিন রুহান খন্দকারের কাছে এইভাবে নিজের মেয়ের সুখ-শান্তির ভিক্ষা চেয়েছিলেন কিন্তু তার বদলে শুধু মৃত্যু পেয়েছেন। তাই সে নিজের বাবার মতো আরেক বাবাকে আশাহত হতে দিলো না। নির্জনা সে জাফর সিদ্দিকীকে আস্বস্ত করলো,
–স্যার আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। আমার বন্ধুত্বে যদি আপনার ছেলে ভালো হয়ে উঠে তাহলে তার সাথে আমি বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করব। আর বাকি রইলো এ বাড়িকে আপন করার কথা সেটা আপনার আমাকে বলে দিতে হবে না। কারণ মেয়েরা নিজের স্বামীর বাড়িকে আপন করার ক্ষমতা নিয়েই জন্মায়।


আরশি আর অর্ক দৌড়া-দৌড়ি করে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে পরে। তখন মেইড দরজায় এসে বাইরে থেকেই জানিয়ে যায় খাবার দেওয়া হয়েছে। অর্ণব সবার জন্য অপেক্ষা করছে।
আরশি হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
–আমি যেতে পারবো না। এই বান্দরটার জন্য দৌড়ে – দৌড়ে আমি কহিল হয়ে গেছি।
অর্কও একইভাবে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
–আমারও একই অবস্থা। মানে কি বলবো একটা মোটা মানুষ যে এভাবে দৌড়াতে পারে তা আমার জানা ছিলো না।

বলা বাহুল্য, আদুরে মেয়ে হাওয়ায় আরশি ছোট থেকেই একটু গোলগাল। তবে তার কোন হরমেনাল কিংবা অন্য কোন স্বাস্থগত সমস্যা নেই। সে খেতে ভালবাসে তাই খেয়েদেয়েই মোটা। কিন্তু ঐ যে কথায় বলে, কানাকে কানা বলো না। তেমনই আরশিকে কেউ মোটা বললে সে বেজায় ক্ষেপে যায়। এবারও তাই হলো।

সে এলোপাতাড়ি অর্ককে কতগুলো কিল-থাপ্পড় দিতে থাকে আর বলে,
–ইতর, শয়তান কই আমি মোটা?
অর্ক তাকে থামানোর চেষ্টা করে বলে,
–আমার ভুল হইছে বইন এইবারের মতো মাফ কইরা দেও।
–না আগে বলো আমি মোটা না।
–ওরে আগে মাইর থামাও পরে বলছি।
আরশি কিল-ঘুষি থামালে অর্ক নিজের দুই হাত দিয়ে আরশির ফোলা আর ঢলঢল গালগুলো চেপে ধরে তার দিকে তাকিয়ে বলে,
–বোন আমার তুমি মোটা না, তুমি আলুর বস্তা।
–কি?
বলে আরশি আবার অর্ককে মারতে যাবে কিন্তু ডা.প্রীতি তাদের ঝগড়া থামিয়ে দিয়ে বলে,
–জলদি চলো। খাবার টেবিলে দেরি করে গেলে তোমার হিটলার ভাই আমাদের আস্ত রাখবে না৷
আরশি এবার ডা.প্রীতির দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলে,
–আমার ভাইয়াকে একদম হিটলার বলবে না প্রীতি।
–তো কি বলবো জল্লাদ?
–প্রীতি ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। আমার এতো সুন্দর হ্যান্ডসাম ভাইকে তুমি জল্লাদ কেন বলছো? তুমি জানো আমার ভাইয়ের ফেসবুকে কতো মেয়ে ফলোয়ার আছে? সবাই তার এক লুকে ঘায়েল হয়ে যায়।
ডা.প্রীতি মুখ মুটকে বলে,
–রাজনীতির কাজ বাদ দিয়ে কেউ যদি জিম যায় আর চাপদাড়ি রেখে স্টাইল করে বেড়ায় তবে মেয়েরা তো পাগল হবেই।
–ও হ্যালো আমার ভাই স্টাইল করে বেড়ায় না। ভাইয়ার ফেইসটাই এমন যে, যা পরে তাতেই স্টাইলিশ লাগে। ইউ নো জন্মগত হ্যান্ডসাম।
প্রীতি মুখ বাঁকিয়ে বলে,
–আসছে জন্মগত হ্যান্ডসাম!! এখন চলো আর দেরি করলে তোমার ঐ জন্মগত হ্যান্ডসাম ভাই এখানে চলে আসবে। তখন খাবার খাওয়ার বদলে খোটা আর জ্ঞান খেতে হবে।
তিনজনই খাবারের জন্য যায়।


সিদ্দিক বাড়ির খাবার টেবিলে কেউ বাড়তি কোন কথা বলে না। যা দু একটা কথা সেগুলো অর্ণব জিজ্ঞেস করে বাকিরা উত্তর দেয়। জাফর সিদ্দিকী আর নির্জনাও খাবার খেতে আসে।
খাবারের মাঝখানে অর্ণব নির্জনাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–যেহেতু তুমি আমার ছোট ভাইয়ের বউ তাই আমি তোমাকে তুমি বলেই ডাকছি। কি নাম তোমার?
নির্জনা স্বভাবিকভাবে বলে,
–নির্জনা।
–নির্জনা সুন্দর নাম। এ বাড়িতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?
–জ্বি-না স্যার।
নির্জনার মুখে স্যার শুনে অর্ণব খাওয়া বন্ধ করে দেয়। এরপর নিজের চোখ-মুখ শক্ত করে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
–তোমার বাড়ি কোথায়? তুমি কে, কি কিংবা কেন তুমি অর্ককে বিয়ে করেছ? সে সবকিছু আমি জানি না আর জানতে চাইও না। তবে বিয়েটা যখন হয়েছে তখন তুমি এবাড়ির বউ এটাই সত্য তাই আমার ছোট ভাইয়ের বউ হিসেবে তুমি আমাকে স্যার নয় ভাইয়া বলে ডাকবে । আশা করি আমার কথা বুঝতে পেরেছ?

জাফর সিদ্দিকর সাথে কিংবা অন্য মানুষজনের সাথে যেভাবে নির্জনার তর্ক করে সেটা সে অর্ণবের সাথে সেভাবে করতে পারলো না। তার যুক্তি আর ব্যক্তিত্বের কাছে নির্জনা হার মেনে নিয়ে বলে,
–জ্বি ভাইয়া।
– গুড। নির্জনা এ বাড়িতে শাড়ি পরার কোন বাধ্যবাধকতা নেই তুমি যে পোশাকে অভ্যস্ত কিংবা যে পোশাক পরে তুমি শান্তি পাও সেই পোশাকই পরবে, তবে সেটা অবশ্যই শালীন হতে হবে। আর একটা কথা তোমার কোন কেউ অসুবিধা হলে কিংবা কোন কিছুর প্রয়োজন হলে অবশ্যই বলবে। বাকি এটা তোমার হাজবেন্ডের বাড়ি মানে তোমার নিজের বাড়ি । সো বি কমফোর্টেবল, অলরাইট?
বেশ গাম্ভীর্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের হলেও অর্ণবের কথাগুলো শুনে নির্জনার ভালো লাগে। সে মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় ।


নির্জনা জহুরা মঞ্জিলে মানিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। বিয়ের পরদিন থেকে রান্নাঘর সহ বাড়ির দেখাশোনার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। কিন্তু তার সকল কাজেই বাগড়া দেয় অর্ক। প্রতিদিন নিত্যনতুন ফন্দি আঁটে নির্জনাকে ভয় দেখানোর আর বিপদে ফেলার যাতে সে বাড়ি থেকে চলে যায়। বিয়ের পরদিন থেকে অর্ক এমন সব কর্মকাণ্ড করেছে যেগুলো সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। সে এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে কেন এ বাড়িতে ডাক্তাররা দুদিন না যেতেই পালিয়ে যেতো।
অর্ক কখনো মাঝরাতে অন্ধকারে অদ্ভুত পোশাক পরে তাকে ভুতের ভয় দেখায়, আবার কখনো চুলে চুইংগাম আটকে দেয়, রান্না ঘরে নেংটি ইঁদুর ছেড়ে দেওয়া থেকে শুরু করে টিকটিকি ধরে পর্যন্ত নির্জনার গায়ে ফেলে দিয়েছে। কারও মাথায় যে এতো দস্যিপনা বুদ্ধি থাকে পারে তা নির্জনার ভাবনার বাইরে ছিলো এতোদিন। অর্ক এসব কর্মকাণ্ডে নির্জনা ভয় না পেলেও ডা. প্রীতি আর আরশি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তাদের মতে অর্কর এসব বুদ্ধিতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না বরং অর্কর বদলে তারা দুইজন জাফর সিদ্দিকী আর অর্ণবের কাছে প্রতিনিয়ত বকা খাচ্ছে । কিন্তু এত কিছুর পরেও নির্জনা অর্কর সাথে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
আজকে অর্ক বাগান থেকে একটা কুনোব্যাঙ ধরে এনেছে ওয়াশরুমের ভিতরে ছেড়ে দিয়েছে নির্জনাকে ভয় দেখাতে।
নির্জনা ঘরে এসে দেখে অর্ক ভিডিও গেম খেলছে। সে মনে মনে বলে,
–আজ সকাল থেকে দস্যিটা চুপ আছে। না জানি আবার কি প্ল্যান করছে?
সে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।।
নির্জনা ভেতরে যেতেই অর্ক গেম ছেড়ে মজা দেখার জন্য বিছানার উপর আয়েশ করে বসে থাকে ।
কিন্তু অনেকক্ষণ নির্জনার কোন সাড়াশব্দ না-পেয়ে একটু আশাহত হয়।
অন্যদিকে অতিরিক্ত গরম পরায় নির্জনা গোসল শেষে ভাবে আজ বাথটবে একটু গা ডুবাবে কিন্তু বাথটবে পানি দিতেই সেই কুনো ব্যাঙটা লাফ দিয়ে তার গায়ের উপর উঠে যায়। হঠাৎ ব্যাঙ দেখে নির্জনা একটু চমকালেও মোটেও ভয় পায় না বরং তার ভীষণ রাগ হয়। একে তো এই গরমে আজকে সে অনেক কিছু নিজে হাতে রান্না করেছে, তার উপর রুমে আসার সময় নিউজে দেখেছে রুহান খন্দকার দেশে ফিরছে, সব মিলিয়ে আজ তার মেজাজ চরম খারাপ। কোথায় ভাবলো একটু শান্তিতে গোসল করবে কিন্তু তার দস্যি স্বামী সেই উপায়ও রাখে নি।
–আজ ওর একদিন কি আমার একদিন।
এই বলে ব্যাঙটাকে বাঁহাতে ধরে ওয়াশরুমের দরজা খুলে দুপদাপ করে অর্কের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এরপর ব্যাঙটা উঁচু করে ধরে রাগান্বিত স্বরে বলে,
–এটা কি?
অর্ক বুঝতে পারে না, এই মেয়ে কোন ধাতুতে তৈরি যে, তার কোন পরিকল্পনাই কাজে লাগছে না। কতকিছু করছে কিন্তু মেয়েটা তো কোন কিছুতেই ভয় পায় না।
তবে তার উত্তরের অপেক্ষা না করেই নির্জনা ব্যাঙটা ঘরে ছুড়ে ফেলে তুড়ি বাজিয়ে অর্কর দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলে,
–লিসেন মিস্টার অর্ক সিদ্দিকী এই দিকে আমার দিকে তাকান। এসব ছোটখাটো পোকামাকড় কেন? আপনি আমাকে ভয় দেখানোর জন্য যদি রাসেল ভাইপারও নিয়ে আসেন তবু লাভ নেই। এক আল্লাহ ছাড়া এই নির্জনা কাউকে ভয় পায় না।

বিয়ের রাতে ঘটে যাওয়া তিলের ঘটনার পর অর্ক নির্জনার দিকে তাকায় না সে যতই দুষ্টুমি করুক না কেন নির্জনার সামনে এলে সে সবসময় মাথা নিচু করে কিংবা অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। অর্ককে মাথা নিচু করে থাকতে দেখে নির্জনা সেখান থেকে চলে যেতে পা বাড়ায় কিন্তু তার ভেজা শরীর থেকে চুইয়ে মেঝেতে পরে থাকা পানিতে অসাবধানতা বশত পা পিছলে সে সরাসরি অর্কর উপর পরে যায়।
এতে করে নির্জনার ভেজা চুলগুলো অর্কর মুখের উপর এসে পরে। অর্ক এবার নির্জনাকে খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করে। নির্জনার যে সৌন্দর্য গত কয়েকদিন যাবত সে এড়িয়ে যেতে চাইছে সেই সৌন্দর্য আজ সরাসরি তার উপরে এসে পরেছে। নির্জনার কাজল ছাড়া আয়ত চোখ, অতিরিক্ত রাগে ফুলানো নাক আর সুন্দর মুখশ্রীতে ভেজা গোলাপি ঠোঁট সবকিছু যেন অর্ককে নিজের দিকে টানছে।

–চলবে?