প্রেমে পরা বারণ পর্ব-০৬

0
39

#প্রেমে_পরা_বারণ
পর্ব -৬
#Nosrat_Monisha

–নারী মানে মায়া, নারীদেহ মানে মোহ।
চোখ বন্ধ করে কথাগুলো মনে মনে বারংবার আওড়াতে লাগলো অর্ক।
এদিকে কোন পুরুষের এতো কাছাকাছি আজ প্রথম এসেছে নির্জনা। তাই নারী ভিতরের নারীসত্তাকে অনুভব করতে পেরে তার শরীর-মন শিহরিত হয়ে উঠে এবং একরাশ লজ্জা তার উপর ভর করে।
সে সন্তর্পণে অর্কর উপর থেকে উঠে ওয়াশরূমে গিয়ে আবার ঝর্ণা চালু করে দিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
–সমস্যা কি আমার? আর কিছুক্ষণ আগ এটা কি ছিলো?
অন্যদিকে অর্ক এখনো নির্জনার চুলের ঘ্রাণ অনুভব করতে পারছে। সে মনে মনে বলে,
–একে যত দ্রুত সম্ভব এ বাড়ি থেকে বের করতে হবে নইলে আমি বিপদে পরে যাবো।


–মি.খন্দকার এতদিন নিরুদ্দেশ হওয়ার কারণ কি?
এয়ারপোর্টে সব সাংবাদিদের এড়িয়ে সামনে চলে গেলেও এক মহিলা সাংবাদিকের করা এই প্রশ্নে রুহান কালো সানগ্লাসটা খুলে ভ্রুকুঞ্চন করে তার দিকে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিরুত্তাপ কন্ঠে বলে,
–থিংক বিফোর ইউ টক মিস। আপনি কে? যে আপনাকে আমি কোন কিছু এক্সপ্লেইন করবো। আর আমি নিরুদ্দেশ সেটা আপনি কোথায় শুনেছেন?আমার বাবা কি পুলিশে আমার মিসিং কমপ্লেইন্ট রিপোর্ট লিখিয়েছে?

রুহানের দৃষ্টি আর গলারস্বরে মহিলা সাংবাদিকের গলা শুকিয়ে আসে। সবাই ঠিক বলে রুহান খন্দকারের ভাবই আলাদা। অন্যান্য বিজনেসম্যানরা যেখানে সাংবাদিকদের হাতে রাখার চেষ্টা করে। কারণ গারা ভয় পায় সাংবাদিকরা যদি তাদের বিরুদ্ধে উল্টাপাল্টা কিছু লিখে বা কোন নিউজ প্রচার করে দেয় তাহলে তাদের রিপুটেশন খারাপ হয়ে যাবে । আর সেখানে এই রুহান খন্দকার সাংবাদিকদের গ্রাহ্যই করে না বরং পারসোনাল প্রশ্ন শুনলে ক্ষেপে যায়।
নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে,
–সরি স্যার। একচুয়েলি অনেকদিন কোথাও আপনার কোন আপডেট ছিলো না এমনকি আপনার ফেসবুক -ইন্সটাগ্রামেও না। তাই।
–সো? আমি আমার সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট আপডেট করব কি করবো না সেটা আমার পার্সোনাল ম্যাটার। তা নিয়ে আপনাদের এত মাথাব্যথা কেন? জার্নালিজম মানেই কি আরেকজনের পারসোনাল স্পেইসে ঢুকে পরা না-কি? যতসব গার্বেজ!
বলে রুহান হনহন করে গাড়িতে উঠে বসে।
রুহান কালো রোলস রয়েসে বসতেই ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দেয়। রুহান বুঝতে পারে তার মাথাটা ঝিম ধরে আসছে এছাড়াও তার ড্রাইভার মাস্ক পরিহিত অবস্থায় আছে। সে কিছু একটা আন্দাজ করে বলে,
–স্টপ দ্যা কার।
কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। রুহান ইতিমধ্যে বেঁহশ। রুহানের ড্রাইভার সাথে সাথে তমিজউদদীন খন্দকারকে কল দিয়ে বলে,
–স্যার কাজ হয়ে গেছে।
–গুড, ওকে সরাসরি বাসায় নিয়ে এসো। খেয়াল রাখবে যাতে কোনমতেই জ্ঞান না ফিরে।
তিনি ফোন রেখে তার পি.এ কে বলেন,
–সব ব্যবস্থা করা হয়েছে কি-না আরও একবার গিয়ে চেক করে এসো।
পি.এ সাথে সাথে “ইয়েস স্যার” বলে সেখান থেকে চলে যায়।
মাইমুনা খন্দকার নিজের স্বামীর দিকে নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,
–তাহলে শেষমেষ নিজের ছেলেকে শেকলে বন্দী করবে বলেই সিদ্ধান্ত নিলে?
চোখ-মুখ শক্ত করে তমিজ উদ্দিন বলেন,
–এছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই। নিজের ছেলেকে সঠিক পথে আনার একটা শেষ চেষ্টা আমাকে করতেই হবে।
–তাই বলে সুস্থ ছেলেকে শেকলে বন্দি করে রাখবে? একটা সত্যি কথা বলতো, তুমি কি ওই মন্ত্রীকে ভয় পাচ্ছো?
–একদমই না। ওরকম মন্ত্রী চাইলেও আমার কিচ্ছু করতে পারবে না। আমি ভয় পাচ্ছি বিবেককে, আল্লাহর কাছে পরকালের জবাবদিহিতাকে। আমি তমিজউদদীন খন্দকার জীবনে কোন অন্যায় করিনি, অন্যায়কে প্রশ্রয়ও দেই নি। সেখানে পুত্র প্রেমে অন্ধ হয়ে এতোদিন তার সকল অন্যায়কে মেনে নিয়েছি। ভেবেছিলাম একদিন শুধরে যাবে কিন্তু না সে দিন দিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাই বাবা হিসেবে এবার আমাকে কঠোর হতেই হবে।
–একটা বাইরের মেয়ের জন্য নিজের ছেলেকে এভাবে কষ্ট দেওয়া কি অন্যায় না?
–ভুলে যেওনা রুহানের মা ঐ মেয়েটাও কারো না কারো সন্তান।
স্বামীর এই কথার প্রেক্ষিতে মাইমুনা কোন পাল্টা যুক্তি দিলো না। কেননা গত পাঁচ দিন হলো তিনি জানতে পেরেছেন তার স্বামী রুহানকে দেশে এনে শিকল বন্দী করে চিকিৎসা করাবেন। তখন থেকে তিনি এর বিরোধিতা করছেন স্বামীকে আটকানোর চেষ্টা করছেন কিন্তু কোন লাভ হয়নি। তমিজউদদীন খন্দকারতো নিজের জেদে অনড় হয়ে আছেন, যে এবার হয় ছেলে সুস্থ হবে, না-হয় তিনি নিজে হাতে ছেলেকে তার কৃতকর্মের শাস্তি দিবেন।


রুহানের দুই মিনিটের সাক্ষাৎকার মুহূর্তেই ইন্টারনেট ভাইরাল হয়ে গেছে। হ্যাশট্যাগ গার্বেজ এখন সবার নিউজফিডে। সকাল থেকে কম করে হলেও পঞ্চাশবার আরশি আর ডা. প্রীতি ভিডিওটা দেখেছে। এরা দুজন রুহান খন্দকারের ডাই হার্ট ফ্যান।
এখনও তারা বাগানে বসে সেই ভিডিওটাই দেখছে আর বিশ্লেষণ করছে।
–ওহ! ব্ল্যাক শার্টে রুহানকে আজ কি হ্যান্ডসাম লাগছে।
আরশির কথার প্রেক্ষিতে ডা. প্রীতি বলে,
– রুহানকে সবসময়ই হ্যান্ডসাম লাগে, এ আর নতুন কি?
–তা যা বলেছো। রুহানকে যেমন দেখতে তেমন এটিটিউড। যাকে বলে একদম খাপেখাপ। তবে আজকে রুহান এয়ারপোর্টে যা করলো একদম রকিং। সব সাংবাদিকদের মুখে তালা।
তখনই সেখানে অর্ক আসে।

–তোমরা এখানে?আর আমি তোমাদের সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি।
তারা দুজনে একসাথে প্রশ্ন করে,
–কেন?
–নতুন একটা প্ল্যান মাথায় এসেছে।
অর্ককে মাঝপথে থামিয়ে ডা. প্রীতি বলে,
–আমি নাই।
আরশিও তাল মেলায়,
–এবার আমিও নাই।

–আরে একবার প্ল্যানটা তো শুনো।
আরশি অর্ককে পাত্তা না দিয়ে বলে,
–কোন কিছুই শুনার নাই তোমার এসব প্ল্যানের জন্য আমরা আবার বকা খাবো।
প্রীতি আরশিকে সমর্থন করে বলে,
–এক্সাকটলি তাছাড়া মেয়েটাতো আর তোমাদের কোন ক্ষতি করছে না। কতো এফোর্ট দিচ্ছে তোমার সাথে বন্ধুত্ব করতে কিন্তু তুমি?

–আমার প্রয়োজন নেই টাকার লোভে পাগল বিয়ে করো এমন কারও সাথে বন্ধুত্বের। তোমাদের কারও হেল্প লাগবে না যা করার আমি নিজেই করবো।
বলে সেখান থেকে চলে যায়।


পড়ন্ত বিকেলে নির্জনা ছাদে ঘুরাঘুরি করে। এ বাড়িতে আসার পর থেকে এটাই তার রুটিন। বাগানের চেয়ে ছাদের খোলা আকাশ তার ভালো লাগে।
আজকে নির্জনার মন খারাপ। সে দেখছে কিভাবে আরশি আর ডা.প্রীতি রুহান খন্দকারের ভিডিও দেখছে আর তার প্রশংসা করছে। নির্জনার ইচ্ছা করছিল চিৎকার করে বলতে,
–তোমরা যার এত প্রশংসা করছো সে আসলে ভেতর থেকে একটা অমানুষ, সাইকোপ্যাথ। বন্ধ করো এর ভিডিও দেখা।
কিন্তু সে নিরুপায়। খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে সে ছাদের দরজা খোলে। আর দরজা খুলতেই আগে থেকে ভেতরে লুকিয়ে থাকা অর্ক ভুতের মুখোশ পরে তার সামনে এসে “ভাও” করে চেঁচিয়ে উঠে। অন্য সময় হলে নির্জনা নিজেকে সামলে নিত কিন্তু আজ অন্যমনস্ক হওয়ায় আর মন খারাপ থাকায় সে আর নিজের মন-মস্তিষ্ককে সামলাতে পারেনি। তাই অর্ক এভাবে সামনে আসতেই সে প্রচন্ড চমকে গিয়ে একটু পেছাতেই পা পিছলে সিড়ি দিয়ে নিচে পড়ে যায়।
ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটেছে অর্ক কিছুই করতে পারে না। সে ভেবেছিল অন্যান্য বারের মতো নির্জনা এবারও হাসিমুখে তাকে বলবে,
–আমি কিন্তু একটুও ভয় পাইনি, আপনার আরও নতুন কোন দুষ্টু বুদ্ধি বের করতে হবে, দস্যি ছেলে।


শুক্রবার থাকায় আজ অর্ণব কোথাও বের হয় নি। অনেকদিন পরে ভালো রান্না পেয়ে সে একটু বেশি খেয়ে ফেলেছে । মা মারা যাওয়ার পর এত যত্ন করে অর্ণবদের বাড়িতে কেউ রান্না করে নি। নির্জনা আসায় বাড়িটা কেমন যেন আগের মতো যেন সাজানো গুছানো হয়ে যাচ্ছে । অর্ণবের মনে হচ্ছে, দিন দিন
জোহুরা মঞ্জিলে নির্জনা তার মায়ের জায়গা দখল করে ফেলছে। তার বাবা আগের মতো নিশ্চিতে ঘুমায়, তার ছোট ভাই-বোন দুটি সারাদিন বিচ্ছুর মতো দুষ্টুমি করে বেড়ায়, তাকে দেখে আর ভয় পেয়ে নিজেদের গুটিয়ে নেয় না। বাড়িতে এখন সে শান্তি অনুভব করতে পারে। তবে একটা প্রশ্ন তাকে এখনও তাড়া করে বেড়াচ্ছে নির্জনার মতো এতো ভালো একটা মেয়ে কেন অর্ককে বিয়ে করলো? টাকার লোভে কাউকে বিয়ে করার মতো মেয়ে তো তাকে মনে হয় না।
এসব ভাবতে ভাবতে সে আনমনে হাঁটতে গিয়ে কোন কিছুসাথে হোঁচট খায়। নিজেকে সামলে সেদিকে ফিরে তাকতেই দেখে নির্জনা মেঝেতে পরে আছে তার মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। আর ঠিক উপরে সিঁড়িতে অর্ক পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। অর্ণব অর্ককে শেষ এমন অবস্থায় দেখেছিলো পনের বছর আগে যখন সে স্মরণ করতে পেরেছিলো তার মা আর দাদী তাকে বাঁচাতে গিয়ে মারা গেছে। কিন্তু এখন এসব ভাবার সময় নেই তাই সে চিৎকার করে ডা.প্রীতি বলে ডাক দেয়। প্রীতি তার মায়ের সাথে ভিডিও কলে কথা বলছিলো। অর্ণবের চিৎকারে সে দৌড়ে বের হয়ে আসে। শুধু সে না বাড়িতে থাকা বাকি সবাই সেখানে উপস্থিত হয়। অর্কও নিজের হুঁশ ফিরে পায় সে তাড়াতাড়ি করে নিচে নামে। প্রীতি এসে নির্জনার অবস্থা দেখে সাথে সাথে তাকে চেক করে বলে,
–অনেক ব্লিডিং হচ্ছে। হেমারেজ কি-না বলা যাচ্ছে না। এক্ষুনি হাসপাতালে নিতে হবে জলদি তুলুন।
অর্ণব নির্জনাকে কোলে তুলে নেয়।
– ড্রাইভার ছুটিতে। আমি গাড়ি বের করছি।
বলে জাফর সিদ্দিকী তাদের আগে বের হয়ে যায়।
তারা তিনজন নির্জনাকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্য রওনা হয়।
পিছনে অর্ক আর আরশি রয়ে যায়। অর্ককে দেখে আরশি বুঝতে পারে সে প্রচন্ড মানসিক ধাক্কা পেয়েছে। তাই সে অর্কর কাছে গিয়ে বলে,
–তুমি ঠিক আছো।
অর্ক তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে,
–এই জন্য আমি ঐ ঘর থেকে বের হতে চাই নি। আমার ছায়াও অশুভ। যে আমার কাছে আসবে সেই কষ্ট পাবে ।
–এমন কিছুই না। এটা একটা এক্সিডেন্ট।
বলে আরশি অর্ককে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তার হাত ধরে। কিন্তু অর্ক তার হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,
–হ্যাঁ এটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট যেটা আমি ইচ্ছে করে করেছি। আমার থেকে দূরে থাকো নাহলে তুমিও মরে যাবে।
এরপর সে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।

––চলবে?