প্রেমে পরা বারণ পর্ব-২৯+৩০

0
128

#প্রেমে_পরা_বারণ
#Nosrat_Monisha
পর্ব-২৯

জোহরা মঞ্জিল মাহেরকে দেখে অসন্তুষ্ট হয় জাফর সিদ্দিকী। কিন্তু তার করার মতোও কিছু নেই। কারণ অর্কর যুক্তির কাছে হেরে গেছেন তিনি। অর্কর একটাই কথা নির্জনার নিরাপত্তা। রুহানকে কোন ভাবেই বিশ্বাস করা যায় না। হ্যাঁ এই সম্ভাবনাকেও ফেলে দিতে পারছেন না তিনি, বিয়ে হয়ে গেছে বলে নির্জনাকে ভুলে যাবে তেমন ছেলে যে রুহান না তা জাফর সিদ্দিকী খুব ভালো জানেন। তবে মাহেরকে নিয়ে তার আপত্তি ছিলো৷ যার উত্তরে অর্ক বলে,
–সবকিছু জানার পরও যদি রুহানকে তুমি এ বাড়িতে এলাউ করো, তবে মাহের কি দোষ করেছে? আর তুমি জানো না আরশি কেমন? ও নিজের হাসবেন্ড ছেড়ে অন্য কারও কথা ভাববে না।

এই হয়েছে এক ঝামেলা। জাফর সিদ্দিকীর দুই ছেলেই বিয়ে করে বেশি সেয়ানা হয়ে গেছে। তার কোন কথাই শুনছে না। সকালে অর্ণবকে ফোনে ফিরে আসার জন্য বলতেই সে জানায়, সময় হলে আসবে। কোথায় বাবার ভালো-মন্দ খোঁজ নিবে তা-না উল্টো বাবাকে প্রশ্ন করে, ‘বাবা,তুমি কি এসবে জড়িত?’
জাফর সিদ্দিকীর কৌশলে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলেও মনে মনে ক্ষোভে ফেটে পরেছেন।
বর্তমানে তিনি সারা ঘরে পায়চারি করছেন আর বিড়বিড় করে বলছেন,
– নিজের বাবাকে প্রশ্ন করে কত বড় সাহস। আরে ক্ষমতার লড়াইয়ে টিকে থাকতে গেলে এরকম দু চারজনকে মারতে হয়। আজ যদি আমি সবকিছুর ব্যবস্থা না করতাম তুই রাজনীতি করতে পারতি?

ডিএনএ টেস্টের ফলাফল এসেছে। হাসিমুখে যে ছেলেটা ‘আসছি’ বলে বের হয়ে গিয়েছিলো সে আজ কঙ্কাল হয়ে বাড়ি ফিরেছে। কঙ্কালের গোসল হয় না তবুও নিজের একমাত্র ছেলেকে কাফন পরিয়ে দাফন করে দিয়েছেন ফরিদ রহমান।
বাড়ির প্রতিটি মানুষ বিলাপ করছে। এর মধ্যে প্রীতি একেবারেই শান্ত। কোন কথা নেই কান্না নেই। যে ভাইয়ের জন্য এতো কিছু করেছে, সেই ভাইয়ের মৃত্যুর খবরে সে অনুভূতি শূন্য হয়ে গেছে।
কবর শেষে প্রীতির পাশে এসে বসে অর্ণব তার কাঁধে হাত রেখে বলে,
–একটু কাঁদো নাহলে অসুস্থ হয়ে যাবে।
অর্ণবের হাতটা সরিয়ে প্রীতি চোখমুখ শক্ত করে বলে,
–আপনি বাড়ি ফিরে যান।
–আর তুমি?
–আপনি ভাবলেন কি করে আমার ভাইয়ের খুনি যেখানে বাস সে বাড়িতে আমি ফিরে যাব?
–প্রথমত কোন কিছু প্রমাণ হয়নি আর দ্বিতীয়ত ওই বাড়িতেই তোমাকে ফিরে যেতে হবে। কারণ মানো বা না মানো বিয়েটা হয়ে গেছে আর ওটাই তোমার শ্বশুর বাড়ি।
তাচ্ছিল্যের সাথে প্রীতি বলে,
–জোর জবরদস্তির বিয়ের আবার শশুর বাড়ি হুহ।
নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করে অর্ণব।কারন সে জানে ভাইয়ের শোকে প্রীতি এখন যা খুশি তাই বলবে।
–দেখো এ নিয়ে আমি তোমার সাথে তর্ক করবো না।তোমাকে একটা কথা বলে রাখছি কোন কিছু প্রমাণ যদি হয় তাহলে বাবার শাস্তির ব্যবস্থা আমি নিজে করবো।
–আপনার বাবা পাক্কা রাজনীতিবিদ। এসব কোন কিছুর প্রমাণ কি সে রেখেছে?
–বেশ তাহলে আমি তদন্ত করব।
একটা অট্ট হাসি দিয়ে প্রীতি বলে,
–হা হা হা! তাহলেই হয়েছে, শেয়াল মুরগি চোর ধরবে। মি.অর্ণব আমি ক্লাস নাইন টেনের কোন বাচ্চা মেয়ে নই যে যা বোঝাবেন সে তাই বুঝবো। নিজের বাবার বিরুদ্ধে আপনি তদন্ত করবেন, সেটা আবার সুষ্ঠু । এসব ভন্ডামি আপনার ওই রাজনৈতিক রেলিতে যেয়ে বলবেন সবাই খুশিতে হাততালি দিবে, পরের দিন ফেসবুকে আপনি স্টার হয়ে যাবেন।কিন্তু আমার সামনে এসব ফালতু কথা বলবেন না।
অর্ণব প্রীতির হাত ধরে বলে,
–আমাকে একটু সময় দাও তোমার সব সন্দেহ দূর করে দিবো।
হাত সরিয়ে প্রীতি অর্ণবের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
–একমাস।
–বুঝতে পারলাম না।
–আপনাকে একমাস সময় দিলাম যদি এরমধ্যে নিজেকে প্রমাণ না করতে পারেন তবে আপনার আর আমার রাস্তা আলাদা হয়ে যাবে।
অর্ণবের কাছে এই মুহূর্তে প্রীতির সব শর্ত মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তাই সে অতি দ্রুত তদন্তের জন্য প্রথমে ফোন দিল নিজের পরিচিত সবচেয়ে বিশ্বস্ত মাধ্যমেের কাছে। তাদের বললো, যে ভাবে হোক সম্পূর্ণ ঘটনা তদন্ত করে সাত দিনের মধ্যে তাকে রিপোর্ট দিতে।


–মি. মাহের তোমার কথায় রাজি হল?
নির্জনার প্রশ্ন মুচকি হেসে অর্ক বলে,
–রাজি না হয়ে উপায় আছে? বেচারা আমার বোনটাকে ভালোবাসে। আর পুরুষের ভালোবাসার শক্তি ভীষণ ভয়ঙ্কর হয়।
অর্কর উত্তর শুনে নির্জনা বলে,
–তাই বুঝে তুমি আমাকে ডিভোর্স দিতে চেয়েছিলে?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অর্ক বলে,
–মেয়ে মানুষের টন্ট করার স্বভাব জীবনে যাবে না,কাল থেকে নাহলেও হাজার বার মাফ চেয়েছি। এখন তো মনে হচ্ছে বাকি জীবন এই একটা ভুলের জন্য মাফ চেয়ে যেতে হবে ।
নির্জনা এ বিষয়ে কিছু না বলে কথা ঘুরিয়ে বলে,
–তুমি কিন্তু এখনো আমাকে বললে না প্ল্যানটা কি। কিভাবে রুহানকে জব্দ করবে।
অর্ক মুচকি হেসে বলে,
–বলিনি কারণ কোন প্ল্যান নেই, যেটা আছে সেটা কেবলমাত্র একটা সম্ভাবনা।
–মানে?
একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে অর্ক নির্জনাকে হাত ধরে বিছানায় বসালো।
–রুহান একটা সাইকোপ্যাথ। ক্রিমিনালদের হ্যান্ডেল করা শাস্তি দেওয়া সহজ কিন্তু সাইকোপ্যাথের ক্ষেত্রে সেটা প্রায় অসম্ভব। এটা একটা অতলগহ্বরে মাটি খুঁজে বেড়ানোর মতো। আমি রুহানের সাথে দীর্ঘদিন অস্ট্রলিয়ার মেন্টালের এসাইলাম এ ছিলাম। ওকে যতটুকু চিনেছি তাতে এটুকু বুঝতে পারছি, আরশির প্রতি ওর কোন ইন্টারেস্ট নেই। সে আরশিকে ইউজ করতে চাইছে আমার আর তোমার উপর মেন্টাল টর্চার করার জন্য। আমাদের লাইফে আরশির যদি কোন ইম্পর্টেন্স না থাকে তাহলে রুহান আরশিকে মুক্তি দিয়ে দেবে। সেই জন্য ওরা যখন বাসায় আসবে তুমি এমন প্রিটেনড করবে যে আরশিকে তুমি পছন্দ করো না। শুধু তাই না রুহান আরশির উপর কোন প্রকার কোন ভায়োলেন্স করলে তুমি জাস্ট ইগনোর করবে। আর সব সময় এটা বোঝাবে আরশি না থাকার কারণে তুমি আমার সাথে ভালো আছো ।
নির্জনাক খানিকটা চিন্তিত হয়ে বলে,
–কিন্তু এতে কি কাজ হবে? মানে রুহান কি তাহলে আরশিকে ছেড়ে দেবে?
–i don’t know আমি শুধু প্রেডিক্ট করতে পারি, আশা করতে পারি।তবে রুহানের ছাড়তে চাওয়ার চেয়ে আরশির মুক্ত হতে চাওয়াটা বেশি ইম্পরট্যান্ট । আরশি যদি নিজে মুক্ত না চায় তাহলে খুব বড় সমস্যা হবে। সেজন্য আমি মাহেরকে নিয়ে এসেছি যদি আরশিকে একবার নিজের ভালোবাসাটা বোঝাতে পারে তাহলে আর সে নিশ্চয়ই ফিরে আসবে ।
অর্ণবের একথা শুনে চুপ হয়ে গেল নির্জনা।
যা দেখে সে নির্জনাকে প্রশ্ন করে,
– কি হলো কিছু বলছো না যে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নির্জনা বলে,
– স্বামী কি সেটা তুমি বুঝবেন না। মেয়েরা যে কোন কিছুর মূল্যে তার স্বামীর সংসার করতে চায়।শুধু তাই না আমাদের মেয়েদের কাছে কবুল বলার পর স্বামী সবকিছু হয়ে যায়। তখন বিয়ের আগের সম্পর্ক প্রেম-ভালোবাসা সব কিছু মূল্যহীন হয়ে যায়।
মেয়েদের জীবনে বিয়ের আগের প্রেম ভালোবাসা হলো ভেসে আসা মেঘ যা এক সময় চলে যায়।
–যেমন তোমার জীবন থেকে বিহান চলে গেছে?
–আমি সেভাবে বলতে চাইনি।
–আমি জানি তুমি সেভাবে বলতে চাও নি। তুমি কি বলতে চাইছো সেটাও আমি বুঝতে পারছি। তাইতো আমি বলছি যে , আমার কাছে কোন প্ল্যান নেই শুধু একটা সম্ভাবনা আছে।
তখনই দরজায় করাঘাত হয় বাইরে থেকে একটি মেইডের গলার আওয়াজ ভেসে আসে,
–আরশি ম্যাম আর নতুন স্যার চলে এসেছে। বড় স্যার আপনাদের নিচে ডাকছেন।

–তুমি বাবাকে গিয়ে বল আমরা আসছি।
অর্কর গলার আওয়াজ শুনে মেইডটা চলে যায়।
নির্জনা ব্যতিব্যস্ত হয়ে নিচে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলে অর্ক তাকে টান দিয়ে বিছানায় ফেলে দেয়।
–একি কি করছো? তোমার বাবা ডাকছে আরশিরা চলে এসেছে।
–একটু আগে কি বললাম? ওদের গুরুত্ব দিতে হবে না।
–তাহলে কি আমরা যাবো না?
–যাবো, তবে একটু রোমান্সের পর।


গোসল শেষে বের হয়ে অর্ককে চোখ রাঙাচ্ছে নির্জনা। এর মধ্যে আরো একবার মেইড এসে ডেকে গিয়েছে। নির্জনার গলার নিচটা সম্পূর্ণ লালচে হয়ে গেছে এগুলো নিয়েই সে রেগে আছে। দাগগুলো দেখিয়ে অর্ককে বলছে,
–তুমি এগুলো ইচ্ছে করে করেছ তাই না? এখন আমি সবার সামনে কি করে যাবো। আর এই ভেজা চুল দেখে সবাই কি ভাববে আমি এই অবেলায় কেন গোসল করেছি।
–হেয়ার ড্রাইয়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে নাও।
–ঐ যন্ত্রটা ইউজ করলে আমার চুল পড়ে যায়।
–তাহলে আর কি এভাবেই চলো আর দাগের কথা বলছো এক মিনিট
বলে অর্ক নিজের পিঠটা নির্জনাকে দেখিয়ে বলে,
–এগুলো কি?
নির্জনার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে যায় কারণ অর্কর সারা পিঠ জুড়ে শুধু তার নখের আঁচড়ের দাগ।


রুহান রাগে কটমট করছে আর অস্থির হয়ে পায়চারি করছে । জোহরা মঞ্জিল এসেছে প্রায় দেড় ঘন্টা কিন্তু এখনো নির্জনা নিচে নামে নি। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না, কেন দোতলা থেকে নিচে নামতে নির্জনার এতো সময় লাগছে।

–চলবে?

#প্রেমে_পরা_বারণ
#Nosrat_Monisha
পর্ব-৩০

নির্জনার ভেজা চুল, গরমে হাই-নেক ব্লাউজ, বারংবার কিছু একটা আড়াল করার চেষ্টা, যেন তার নিচে আসতে দেরি হওয়ার কারণটা রুহানকে চিৎকার করে বলছে।
রুহানের কাছে নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। তার সবকিছু ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে হলেও এই মুহূর্তে চুপ করে থাকা ছাড়া কোন উপায় নেই। কারণ সকালে আরশির কপালের কাটা দাগ দেখে তার বাবা তাকে শাসিয়েছে,
–কি ভেবেছো আমি কিছু বুঝি না জাফর সিদ্দিকীর মেয়েকে তুমি কেন বিয়ে করেছো? শুধুমাত্র মানসম্মানের কথা ভেবে বিয়েটা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু তারমানে এই না, বউয়ের উপর অত্যাচার করবে এটা মেনে নেবো না। একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো,ঐ বাড়িতে গিয়ে তুমি যদি কোন বাড়াবাড়ি করো তবে আমি নিজে তোমাকে শিকলে বন্দী করবো। এবার আর(নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে) কারও চোখের পানিতে আমি গলবো না।

খানিকটা বাবার ভয়েই চুপ আছে রুহান। তবে সে এটা ভেবে অবাক হচ্ছে আরশির মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে জাফর সিদ্দিকী যতটা না অস্থির হয়েছিলো তার চেয়ে বেশি শান্ত অর্ক-নির্জনা। যেন আরশির তাদের কাছে সম্পূর্ণ অদৃশ্য।
–তোমাদের এতো দেরি হলো কেন? আরশিরা কতক্ষণ থেকে অপেক্ষা করছে।
অর্ক একটু বিরক্তিকর স্বরে বলে,
–অপেক্ষা করার কি আছে? ওরা নিজের ঘরে গিয়ে রেস্ট করতো, আমরা পরে দেখা করে নিতাম। শুধু শুধু অবেলায় বিরক্ত করলে।
রুহানের পাশাপাশি জাফর সিদ্দিকীও ছেলে-ছেলের বউয়ের কথায় বেশ অবাক হয়। কোন প্রকার কুশলাদি বিনিময় ছাড়া অর্ক যে এরকম কথা বলতে পারে সেটা তার ভাবনার বাইরে । তবে মেয়ের মন খারাপ হবে এই ভেবে তিনি আর কথা বাড়ায় না। শুধু নির্জনার দিকে তাকিয়ে বলেন,
–ওদের একটু নিজের ঘরে দিয়ে এসো।
নির্জন একটা দম নিয়ে জাফর সিদ্দিকীর দিকে তাকিয়ে বলে,
–বাড়িতে এতো মেইড থাকতে আমি কেন ঘর দেখাতে যাব? তাছাড়া আরশিতো আর এই বাড়িতে নতুন না যে নিজের ঘর চিনে যেতে পারবে না।
জাফর সিদ্দিকী নির্জনাকে কিছু বলবে তার আগেই আরশি নিজের বাবাকে থামিয়ে বলে,
–বাবা প্লিজ এবার থামো। আমার ক্লান্ত লাগছে, আমি রুমে যাচ্ছি আমার লাগেজটা কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিও। আর আপনি(রুহানকে উদ্দেশ্য করে) আমার সাথে আসুন।
একপ্রকার বাধ্য হয়ে রুহান আরশির পিছনে যায়।
ঘরে পৌঁছে রুহান আরশিকে বিদ্রুপের সাথে বলে,
–কি ব্যাপার তোমার ভাই-ভাবিতো তোমাকে কেয়ারই করলো না। তোমার এ বাড়িতে আসায় তারা এতো বিরক্ত হয়েছে যে তোমার মাথার ব্যান্ডেজও দেখলো না।
আরশির নির্জনা-অর্কর ব্যবহারে খারাপ লাগলেও মনে মনে ভাবে এক হিসেবে ভালোই হয়েছে। তাছাড়া তার কথা চিন্তা করতে গিয়ে অর্ক-নির্জনা নিজেরদের জীবন নষ্ট করবে সেজন্য তো আর সে রুহানকে বিয়ে করে নি। তাই রুহানের কথায় কোন প্রতিক্রিয়া না করে শান্তস্বরে জবাব দেয়,
–ভালোই তো হয়েছে। তারা যত তাড়াতাড়ি নিজেদের জীবন থেকে আমাকে মুছে ফেলতে পারবে তত তাড়াতাড়ি ভালো থাকতে পারবে ।
–মানে তোমার রাগ হচ্ছে না ওদের উপর?
–কিসের রাগ? তাছাড়া আপনি ভুলে যাচ্ছেন মি.খন্দকার আমার দুই ভাই যাতে ভালো থাকে সেইজন্য আমি আপনাকে বিয়ে করেছিলাম।
এভাবে নিজের বাজি পাল্টে যেতে দেখে রুহানের মোটেও ভালো লাগছে না। সে ফোন বের করে প্রধানমন্ত্রীর পিএকে ফোন করে নির্জনার বাবার এক্সিডেন্টের ব্যাপারটা জানার জন্য। কিন্তু পিএ বলে নির্জনার বাবা আর ভাই মারা যাওয়াটা নেহাতই একটা দুর্ঘটনা ছিল। ট্রাক ড্রাইভার মাতাল অবস্থায় থাকার জন্য গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে ।


ঘরের ফিরে জিনিসপত্র ভাংচুর করছে অর্ক। নির্জনা তাকে থামানোর চেষ্টা করছে।
–অর্ক শান্ত হও।
–কিভাবে শান্ত হবো বলো? অমানুষটা আমার বোনের গায়ে হাত তুলেছে। ওকে আমি খুন করে ফেলবো।
–অর্ক বোঝার চেষ্টা করো আমাদের আর আরশির ঘরের মাঝখানে শুধু একটা ঘর, তুমি যদি এমন করো রুহান সব বুঝে যাবে। তখন আরশির ফিরে আসার সব রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে।
নির্জনার কথা শুনে অর্ক কিছুটা শান্ত হয়। এরপর একটা নিঃশ্বাস নিয়ে নির্জনাকে বলে,
–আমি যদি ঠিক হই তবে রুহান এখন পাগলা কুত্তার মতো হয়ে গেছে। সে তোমাকে আমার পাগল না-হওয়ার কথার সাথে সাথে, আরও কি কি বলে তোমাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করবে তা আমি জানি না৷
নির্জনা অর্কর হাতে হাত রেখে বলে,
– তুমি চিন্তা করো না, রুহান খন্দকার যত বড় ফাঁদই পাতুক না কেন আমি ঠিক তা কেটে বের হয়ে আসবো। ভরসা করো।
–তোমার উপর আমার ভরসা হান্ড্রেড পার্সেন্ট কিন্তু রুহানের উপর এক পার্সেন্টও না। আমি যাতে একা হয়ে যাই, ভাইয়ার সাহায্য না নিতে পারি সেইজন্য সাত বছর পর প্রীতির ভাইয়ের লাশ খুঁজে বের করে ফেলেছে। তোমাকে আমাকে আলাদা করার জন্য যে সে কোন সত্য বের করবে সেটা আমি নিজেও জানিনা । যত সহজে বলছি সব ঠিক হয়ে যাবে ব্যাপারটা তত সহজ নয়, কারণ আমাদের লড়াইটা রুহান খন্দকারের বিরুদ্ধে। সোজা বাংলায় বলতে গেলে আমরা আগুন নিয়ে খেলছি।

নির্জনা অর্ককে ভরসা দেয়,
–আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।


জহুরা মঞ্জিলের খাবার টেবিলে আজ অদ্ভুত নিরবতা। সাধারণত অর্ক-আরশি এক টেবিলে বসলে এমনটা হয় না। তবে এই নীরবতার মধ্যেও রুহানের চোখ নির্জনা আর অর্কর উপর নিবদ্ধ হয়ে আছে, কপোত-কপোতীর মতো তাদের প্রেম যেন উথলে পরছে। এর মধ্যে অর্ক টেবিলের নিচে দিয়ে নির্জনার পায়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে যা নিশ্চিত রুহানের চোখে পরেছে। সে এক রাগে চোখ বন্ধ করে হাতের গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেলে ফুঁসতে ফুঁসতে খাবার ছেড়ে চলে যায়।
কেউ তাকে আটকানোর চেষ্টা করে না।
রুমে এসে আরশি দেখে রুহান পাগলের মতো জিনিসপত্র ভাংচুর করছে। আরশি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাতে মোবাইলটা নিয়ে রুহানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–আপনার ভাংচুর শেষ হলে আমাকে ফোন দিবেন আমি বাগানে গেলাম।


নির্জনা টেবিল গুছিয়ে রুমে যাবে তখনই রুহান তার হাত ধরে আরশির রুমে নিয়ে যায়।
–ছাড়ুন আমাকে। কি হচ্ছেটা কি? ছাড়ুন বলছি।
রুহান নির্জনাকে ছেড়ে তাকে অনুরোধ করে বলে,
–প্লিজ, সুইটহার্ট আমাকে জাস্ট পাঁচ মিনিট সময় দাও তোমাকে কিছু বলার আছে।
–ছিহ!আমার আপনাকে দেখলেই জাস্ট ঘেন্না হচ্ছে। আমাকে বের হতে দিন নাহলে চিৎকার করবো।
–সুইটহার্ট।
–আর একবার ওই নামে আমাকে ডাকলে আপনার জিভ আমি টেনে ছিড়ে ফেলবো। নির্লজ্জ বেহায়া মানুষ একটা । লজ্জা করো না ঘরে বউ রেখে আরেকজনকে এসব নামে ডাকছেন।
এরপর নির্জনা রুহানকে ঠেলে বের হয়ে দরজার কাছাকাছি পৌঁছতেই রুহান বলে উঠে,
–অর্ক কখনোই পাগল ছিল না। সে শুধু পাগল হওয়ার অভিনয় করে গেছে। তোমার সো কলড হাসবেন্ড তোমাকে ঠকিয়েছ।
নির্জনার পা দুটো থেমে যায় সে অবাক হয়। কিন্তু সেটা রুহানের কথার জন্য না অর্কর দূরদর্শী চিন্তার জন্য। কারণ রুহান যে এমন করবে সেটাতো অর্ক তাকে একটু আগেই বলছিলো। নিজের স্বামীর বুদ্ধির উপর নির্জনার বেশ গর্ববোধ হয়।
সে পিছনে ফিরে ভ্রুকুঁচকে বলে,
–তো?
বিস্মিত হয়ে রুহান বলে,
–তো? তোমার রাগ হচ্ছে না? তোমার হাজব্যান্ড তোমাকে ঠকিয়েছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নির্জনা ঠোঁটের কোণে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলে,
–মি. খন্দকার আমার হাসবেন্ড আমাকে ঠকিয়েছে, তাতে আপনারা তো মাথা ব্যথা কেন হচ্ছে আমি সেটাই বুঝতে পারছি না।
নির্জনার কথায় রুহান হতভম্ব হয়ে যায় যে সে টেরই পায় না কখন নির্জনা সেখান থেকে চলে গেছে। তার হুঁশ ফিরে অর্কর কন্ঠে,
–তু-তু-তু- আহারে বেচারা। কি হলো নির্জনা তোমার কথা বিশ্বাস করলো না।
সাথে সাথে অর্ক মুখ বরাবর ঘুসি দিয়ে রুহান বলে,
–বল তুই আমার নির্জনাকে কি করেছিস? ও কেন আমার কথা বিশ্বাস করলো না?
আজ অর্ক মনস্থির করেছে রুহানের সাথে হাতে নয় মগজ দিয়ে লড়বে। তাইতো নির্জনাকে ইশারায় সেখান থেকে চলে যেতে বলেছে। নিজের ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা রক্ত মুছে বাঁকা হেসে বলে,
–প্রথমত নির্জনা তোমার না আমার। আর দ্বিতীয়ত আমার বউয়ের সাথে আমি কি করেছি সেটা তোমাকে বলবো এমন গাধা আমি না। বাট তুমি যেহেতু এতো আগ্রহী তাই একটা ক্লু দেই। যা করলে অবেলায় গোসল করতে হয়, হাই নেক পরতে হয় আমি নির্জনার সাথে তাই করেছি।
সাথে সাথে রুহান অর্ককে আরেকটা ঘুসি দিয়ে বলে,
–How dare you touch her?
নিজেকে সামলে অর্ক বলে,
–আরে বাবা নিজের বউকে টাচ করতে কি সাহস লাগে নাকি? ভালোবাসা থাকলেই হয়।
রুহানের ফর্সা কপালে নীল শিরাটা ক্রোধে ফুলে উঠেছে।
–তুমি কি ভুলে গেছো তোমার বোন আমার জিম্মায়,। তুমি ভাবতেও পারবে না তার সাথে আমি ঠিক কি কি করতে পারি?
–তাই না-কি? তা করো না তোমাকে বাঁধা কে দিয়েছে?
–Don’t you love your sister?
–Of course I love her but not more than my happiness. আর এই কয়েক দিনে আমি এটা বুঝে গেছি আমার একমাত্র সুখ নির্জনা।

হস্ত যুগল মুষ্টিবদ্ধ করে রুহান বলে,
–তোমার ভাই-বোন সুখী না থাকলে তুমি ভালো থাকবে?
–অবশ্যই না । কিন্তু আমার ভাই-বোন অসুখী থাকবে কেন?তারা তো যা চেয়েছে তাই পেয়েছে।
অর্কর কথা শুনে ভ্রু কুচকায় রুহান। যা দেখে অর্ক বলে,
–ওহ বুঝতে পারলে না তো। লেট মি ক্লিয়ার দিস। ভাইয়া প্রীতিকে পছন্দ করত, তুমি ভাইয়ার সাথে প্রীতির বিয়ে দিয়েছো। আজ না হয় কাল প্রীতি ভাইয়াকে মেনেই নেবে। সো ভাইয়া হ্যাপি। আর রইলো বাকি আরশি ওর কোন প্রেমটেম ছিলো না। টিনএইজ থেকে তার একটাই লক্ষ্য কোন হট হ্যান্ডসাম ছেলেকে বিয়ে করা। তোমাকে একটা সিক্রেট বলি, ছয়মাস আগেও আরশির বাকেট লিস্টে কি ছিল জানো? রুহান খন্দকারের মতো হ্যান্ডসাম কাউকে বিয়ে করা।
তুমি জানো, বাবা যত ভালো ভালো ছেলে এনেছে সবাইকে আরশি রিজেক্ট করে দিয়েছে শুধুমাত্র ওরা হ্যান্ডসাম না বলে। আর যেসব ছেলে হ্যান্ডসাম তারা আমার বোনের মত আটার বস্তাকে বিয়ে করতে রাজি হতো না, তাই এতো দিন ওর বিয়ে হয় নি। তুমি ওকে বিয়ে করে সেই প্রবলেম সলভ করে দিয়েছে।
আরও একটা বোনাস বলছি, আমার বাবার সবসময়ের ইচ্ছে ছিলো কোন বড় বিজনেস ফ্যামিলিতে আত্মীয়তা করা। আর তুমি সেই ইচ্ছেটাও পূর্ণ করে দিয়েছো কারণ খন্দকারদের চেয়ে বড় বিজনেস ফ্যামিলি বাংলাদেশে কে আছে বলো?
সো আল্টিমেটলি, তুমি আমার পরিবারকে আনহ্যাপি করতে গিয়ে সুপার হ্যাপি করে দিয়েছো।

নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না রুহান। এতো বড়ো ভুল সে কিভাবে করেছে? রাগে অর্কর শার্টের কলার চেপে ধরে চিৎকার করে বলে,
–তুই মিথ্যা বলছিস।

–বিশ্বাস না করলে কি আর করা। তবে তুমি কথাগুলো যাচাই করে দেখতে পারো। আরশির ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে একটা মেরুন কালার ডায়েরি আছে। সেটাতেই আরশি নিজের বাকেট লিস্ট লিখে রেখেছিলো আই থিংক সো । কিন্তু যাই বলো ব্রো, আমার পুরো পরিবার তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ শুধু তোমার জন্যই আমরা তিন ভাই-বোনই নিজের মনের মতো জীবনসঙ্গী পেয়ে গেলাম।

–নাআআ!এটা কিছুতেই হতে পারে না।
রুহানের চিৎকারের বিপরীতে অর্ক নিজের কলার থেকে রুহানের হাতটা সরিয়ে তার পরাজিত চেহারর দিকে তাকিয়ে একটা শয়তানি হাসি দিয়ে বলে,
– কিন্তু এটাই হয়েছে। আচ্ছা, এখন দ্যা গ্রেট রুহান খন্দকার কি করবে? লেট মি গেস,
ক্লাবে কিংবা বারে গিয়ে একটা বড়ো মদের বোতল কিনে সেটা খেয়ে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বাপ্পারাজের মতো গান গাইবে,
‘তোমরা সবাই থাকো সুখে, আগুন জ্বলুক আমার বুকে
মনটাকে বলি তুমি কেঁদো না প্রেমের নাম বেদনা”
গানটা সুর করে গেয়ে সেই সুরে শিষ বাজাতে বাজাতে অর্ক সেখান থেকে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়।

–চলবে?