প্রেমের উষ্ণ ধোঁয়াতে পর্ব-৪৯+৫০

0
1208

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকা: আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব_____৪৯

রজনীতে হওয়া বর্ষণের জলবিন্দুতে ধুয়েমুছে চাকচিক্য রূপ লাভ করল গাছের ধূলিধূসর পাতা,পথঘাট, সবকিছু। বাতাবরণ জুড়ে নির্মল পবন। গ্রীষ্মের প্রবল তাপদাহে বৃষ্টি যেন এক মুঠো সুখ হয়ে আত্মসমর্পণ করে অমর্ত্যলোকের কাছে। তার সেই আত্মসমর্পণে বিজয় উল্লাসে ছেয়ে যায় প্রকৃতি, ঝলমলে হয়ে ওঠে সবকিছু। প্রত্যুষে খিলখিল করে হাসছে যেন আশপাশ। প্রহর ভাইয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে উপবনের দোলনায় এসে বসল নিশাত। উপবন বলার কারণ হলো, দোলনার কাছে আসতে ক্ষুদ্র বন পেরিয়ে আসতে হয় তার। ফুপি সূর্যমুখীর বীজ ফেলেছিলেন এদিকটায়। সেগুলোর চারা গজিয়ে গাছ লম্বাটে হয়েছে খুব। ঘন ঘন গাছের ভিড়ে কেউ লুকিয়ে থাকলেও খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে। দোলনার কাছ পর্যন্ত আসার জন্য দুইধারে সূর্যমুখীর বাগানের মাঝে দিয়ে সরু রাস্তা করে দেওয়া। সেটা দিয়ে এসে দোলনায় বসল নিশাত। পেছনে আবার নানানবিধ লতা গাছ দোলনাটাকে আঁকড়ে ধরে আছে। প্রহর ভাই স্নানে গিয়েছে, সেই সুযোগে রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসল সে নিচে। তারপর একটু বাড়ির চারিধার ঘুরে দেখার জন্য আকুপাকু করা মনকে সায় দিয়ে চলে এলো এখানে। একবার ভেবেছিল, শিমুলের কাছে যাবে। কিন্তু এখনো ঘুমোচ্ছে মেয়েটা কাজের বুয়া থেকে জানতে পারল। কি এমন ঘুম মেয়েটার!
নিশাত হতবাক। যেই মেয়ে ভোরে ওঠার স্বভাব বহন করত, সে কি-না এত বেলা করে ঘুমে নিমগ্ন! রাতে কি ঘুমোয় নি? কী করে সারারাত জেগে? আজকাল শিমুল ও সৌরভ ভাইয়ের ওপর গাঢ় সন্দেহের বাসা বেঁধেছে ওর মন ভূমিতে। ভাইয়াও শিমুলের প্রতি যথেষ্ট আগ্রহী, আর শিমুলটাও আগের মতো কলটল দেয় না তাকে, মেয়েটাকে হারিকেন দিয়ে খুঁজতে হয় এখন। আজ প্রহর ভাই যাওয়ার পর ভালো করে জেঁকে ধরবে তাকে।

নিশাত পায়ের কাছে সৌন্দর্য বিলীনে মত্ত একটা লালচে রঙা বুনোফুল দেখে ঝুঁকে তুলে নেয় হাতে। গভীর চোখে তাকায় ফুলটার দিকে। প্রহর ভাইকে বিয়ের পর কখনো কিছু দেয় নি সে,সবাই না-কি প্রেমিক, স্বামীকে কত কি দেয়! আচ্ছা, ফুলটা দেবে কি? ফুলটা দিলে প্রহর ভাই আবার হাসবে না তো? যা লোক! সবসময় ওকে অ–পমান করেই তৃপ্তি পায় ওই অভদ্র পুরুষ। তাই ভাবল,ফুলটা ফেলে দিবে। তক্ষুনি কানে বাজল তীক্ষ্ণ সুরের প্রশ্ন,

” এত গভীর মনোযোগ দিয়ে কী দেখছিস ফুলটায়? আমাকে তো কখনো এত মনোযোগ দিয়ে দেখিস নি। দেখবি দূরের কথা,ফিরেও তো তাকাস না আমার দিকে। মনে হয় তাকালে তোর শরীর জ্বলে যাবে,এমন ভাব করিস। ”

অপ্রতিভ, হতচকিত হয়ে যায় নিশাত। দৃষ্টি তুলে ভুলে যায় প্রতুত্তর করতে। ধবধবে শ্বেত পাঞ্জাবি পরিহিত, হালকা ভেজা চুলের পুরুষকে দেখে ডঙ্কা বেজে উঠল তার হৃদপিণ্ডে। চোখে এসে হানা দিল অপরিসীম মুগ্ধতা। এই পুরুষের প্রতি ওর এই মুগ্ধতার রেশ কাটবে না কখনো। বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে,কোনোভাবেই কিশোরী হৃদয় মানতে চায় না কোনো বাধা। উল্টো সমর্পিত হতে চায় এই পুরুষের কাছে। কিন্তু বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারে না সে,সরাসরি একদমই তাকাতে পারে না প্রহর ভাইয়ের দিকে। সরাসরি তাকাতে গেলে লজ্জা গ্রাস করে নেয়, বুকের গহীন সমুদ্রের তরঙ্গের ন্যায় উথাল-পাতাল করে, ভয় হয় শা–ণিত দৃষ্টির কাছে ধরে পড়ে যাওয়ার। তাই চো–রাচোখে দেখে সর্বদা।

প্রহর দোলনায় এসে বসল ওর পাশে। নিশাত না তাকিয়ে কি মনে করে যেন কম্পনরত হাতে ফুলটা বাড়িয়ে দেয় তার দিকে। প্রহর সেটা হাতে তুলে নিয়ে কেমন কাঠ গলায় বলল,

” এদিকে তাকা। ”

আদেশ ছিল নাকি ধ**মক নিশাত বুঝল না। মাথা নত করে ফিরে তাকাল। প্রহর ওর চিবুকে আলতো করে ছুঁয়ে মুখটা উপরে তুলে গালভর্তি চন্দ্রাকৃতির হাসি নিয়ে বলল,

” এটা দিয়ে আমি কী করব রে? কানে দিব? তুই চাইছিস মেয়েদের মতো ফুলটা আমি কানে দিই? জানতাম তুই আমার বেইজ্জতি চাইবি। প্রমাণ করে দিলি তুই কার মেয়ে। ছিহ! নিজের স্বামীর এত অবমাননা করছিস! তোকে আবার শা**স্তি দেওয়া জরুরি। ”

অশান্ত, প্রেমহীন, কাঠখোট্টা কণ্ঠ শুনে নিশাত ভড়কাল। মনে পড়ে গেল প্রহরের রাক্ষ**সের মতো কাণ্ডখানা। দ্রুত গতিতে ঘাড় পেছনে এলিয়ে অল্প সরে বসল সে। শ্বাসরুদ্ধভাবে বলল,” এমনিই দিয়েছি। আমার ভুল হয়েছে প্রহর ভাই, আপনি কানে দেবেন কেন? ”

প্রহরের কপালে কুঞ্চিত রেখা পড়ল। হঠাৎ করে চাপা ক্রোধে গর্জে উঠল সে,” স্বামীকে ভাই বলছিস কেন, গাধী? তোকে কি এখন শিখিয়ে-পড়িয়ে দিতে হবে আমি তোর স্বামী? স+ ব সংযুক্ত আ( া-কার) স্বা, ম ঈ( ী-কার) মী= স্বামী। নে বানান করে বলে দিলাম, মুখস্থ কর। ”

নিশাতের মুখ ভোঁতা হয়ে গেল। বার কয়েক উচ্চারণ করতে চাইল, ‘ ত্যাড়া লোক, ত্যাড়া লোক। ‘ এই এক মানুষ সর্বদাই সবকিছুতে ত্যাড়া। কোনোদিন যদি সিধেসাধা কোনো কথা বলে থাকে,তাহলে সেটা বোধহয় সজ্ঞানে বলে নি কিংবা ভুলে বলে ফেলেছে। ত্যাড়ামি বাস করছে তার শিরা-উপশিরায়, প্রতিটি রক্তকণিকায়, রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। পেটানো,একহারা, মেদহীন শরীরটাই ত্যাড়ামিতে ভরপুর। সবসময় শুধু ব**র্বরোচিত অত্যাচার চালায় ওর ওপর। ভীত স্বরে মিনমিন করে বলে,
” বানান পারি আমি। ভুল হবে না আর,প্রহর ভাই। ”
বলেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল নিশাত নিজের বেকুব কাজে। মুখে ডাকটা চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে যেন। সে কী করবে? মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে। এতে তার কী দো–ষ!

প্রহরের চক্ষুদ্বয় রক্তিম চাহনি নিক্ষেপ করল নিশাতের দিক। অতি সত্বর হাত বাড়িয়ে ঝট করে বুকে টেনে আনল মেয়েটার কোমল দেহটা নিজের বক্ষস্থলে। পিঠে হাতের চাপ ফেলে আগ্নেয়গিরির মতো ঝাঁজালো রূপ ধারণ করে বলল,
” আবারো ডেকেছিস। তোর মুখে ভাই শুনলে নিজেকে এখন অসহায় লাগে, বর বর ফিলিং উধাও হয়ে যায়। নিশু রে নিশু, আমি তোর বর। ”

নিশাত অপরা**ধী এবং আতঙ্কিত গলায় বলে ওঠে,” ছোট বেলায় ভাই না ডাকলে বলতেন বেয়া**দব, মা**রতেনও। তখন থেকে অভ্যাস হয়ে গেছে, প্রহর ভাই। আর এমন হবে না। ”

প্রহর ঈষৎ ঝুঁকে কপাল নিয়ে ঠেকাল নিশাতের কপালে। নাকে নাক ছুঁয়ে ভারী নিঃশ্বাস ফেলল ওর চেহারায়। বুকে উদ্বেল ঢেউ তুলে দিয়ে প্রমত্ত চোখে চেয়ে ডাকে,
” তিলবতী, ও তিলবতী!”
নিশাত কোনো মন্ত্রে বশীভূত হওয়ার মতো করে সাড়া দেয়,” হু।”
” তোকে বিয়ে করে আমার শুধু আদর নিয়েই জ্বালা না,সবদিক থেকেই জ্বালা। তুই আমায় ভাই ডাকিস, আদরও করিস না, ভালোবাসিও বলিস না আবার আমাকে ভালো করে দেখিসও না। আমার মতো সুদর্শন বরটাকে তুই অবহেলা করিস কীভাবে? ”

হৃদয় তন্ত্রী বেজে ওঠে নিশাতের। সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে যায় এক প্রবল প্রেমময় নেশা তার মাঝে। উত্তর দেয় প্রহরকে কলকল মধুর স্বরে,

” আপনাকে আমি দেখি,গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখি। ”
” কই,তোকে আমার দিকে তাকাতে দেখি না!”
” সরাসরি দেখি না তো,লুকিয়ে দেখি,আপনার নজর লুকিয়ে। ”
” তাহলে আমি ঠিকি বলেছিলাম, তুই একটা চু***রনি। ”

ভ্রম ও বশ দুটোই ছুটে প্রচন্ড বেগে উড়ে গেল কোথাও। কান,চোখ, দৃষ্টি সব সজাগ হলো নিশাতের জাদুকরী কণ্ঠে হঠাৎ তিতা কথা শুনে। সে ভুলেই গেছিল,এটা শ্রদ্ধেয়, ত্যাড়া রাজ্যের রাজা প্রহর ভাই।

প্রহর ওর হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়। বলে,” যেতে হবে, বিকেলে মিটিং আছে। চল,ঘরে চল। ”

আড়ষ্টভাবে ওঠে দাঁড়ায় নিশাত। প্রহরকে সত্য বলে দিয়েছে সে,লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার সত্যটুকু। এখন সুযোগ পেলেই মজা নিবে এটা নিয়ে। আবার কানে আসে,

” আমি এ মাসে আর আসব না গ্রামে। সামনের মাসে আসব। ”

নিশাতের মনটা বিষাদে ভরে গেল। বিচ্ছেদ শব্দটুকু এখন আর যে সয় না তার। অভিমান হয়, অযাচিত অভিমান। জানে, দূরত্ব প্রহর ভাই ইচ্ছে করে সৃষ্ট করে না,তবুও অপরিমেয় অভিমানে দ্বিগুণ তপ্ত হয়ে ওঠে হৃদয়ের উষ্ণ ভূমি। নিজের লাজলজ্জা অতলান্তিকে ডুবিয়ে পেছন থেকে জাপটে ধরে বলিষ্ঠ দেহটা। অশ্রুভেজা গলায় বলে,
” ভালোবাসি, প্রহর ভাই। ”
প্রহর বুকে জড়িয়ে থাকা হাত দুটো ধরে হাতের মালকিনকে সামনে নিয়ে এসে বুকে মিশিয়ে নেয়। অসহিষ্ণু গলায় বলে ওঠে,

” আমার তিলবতী কাঁদছে। এই তিলবতী, কাঁদছিস কেন তুই? চলে যাচ্ছি বলে? আবার আসব তো সামনের মাসে। ”
নিশাত জানে না কেন তার এত কান্না পাচ্ছে। শুধু মনে হচ্ছে এই বিচ্ছেদ তাকে দুঃখের ছোঁয়ায় জর্জরিত করছে। এই বিচ্ছেদ এক বুক কষ্ট উপহার দিচ্ছে তাকে।
বুকে মুখ গুঁজে থেকে অস্পষ্টভাবে বলে,” জলদি চলে আসবেন। ”
” তোর বর রাজনীতি করে, কোনো যুদ্ধে যাচ্ছে না। সব তচনচ হয়ে গেলেও তোকে আমি ছাড়ছি না,সুইটহার্ট। কত যুদ্ধ করলাম শ্বশুরজানের সাথে তোকে পাওয়ার জন্য, সব বৃথায় দেওয়ার মতো গর্দভ আমি নই। ”

বলেই প্রহর ওষ্ঠ চেপে ধরল নিশাতের চুলের ভাঁজে। শান্ত হয়ে গেল মেয়েটা।
_________________________

রফিক আজম পুকুর পাড়ে বেতের মোড়া পেতে বসে আছেন। সৌরভ সেদিকে যাওয়ার জন্য পায়চারি করছে বারংবার। ছেলের অস্থিরতা চোখে বিঁধল উনার। কাছে ডাকলেন,

” এদিকে আয়, সৌরভ। কিছু কইবি?”

সৌরভের অভ্যন্তরে তুফান চলছে। ভয়রা হানা দিচ্ছে। আব্বার প্রতিক্রিয়া কেমনতরো হবে সেটা ভেবে ভেবে তাপহীন, শীতল দিনেই দরদর করে ঘামছে সে। সবটাই লক্ষ্য করলেন রফিক আজম। গুরুগম্ভীর কণ্ঠখানা নাড়লেন,

” কী হইছে বাপ? কোনো সমস্যা? ”

সৌরভ দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেরে,শিমুলের চেহারাটা কল্পনা করে নিস্তরঙ্গ গলায় বলে ফেলল,

” নিশাতের ব্যাপারে কথা বলতে গেলে স্মরণিকা নিবাসে, আমার বিয়ের প্রস্তাবটাও রাখবেন, আব্বা। শিমুলরে ভালোবাসি। ”

#চলবে~
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকা: আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব____৫০

আক্কেলগুড়ুম হয়ে নিষ্পলক ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন রফিক আজম। থমথমে পরিবেশ। সকালের কোমল প্রকৃতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তেজস্বী রোদ উঁকি দিয়ে তাপ ছড়িয়ে দিল সর্বত্র। গন্ধবহ নেই চারিধারে, গাছের পাতার অব্দি কোনো নড়চড় নেই। রফিক আজমের স্তম্ভিত হওয়ার সাথে সাথে সব যেন নীরব ভূমিকা পালন করছে। একমাত্র থামল না সময় এবং মুখোমুখি থাকা দুটি মানবের শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া। সৌরভ অপরিসীম নির্ভয় চাহনি মেলে রেখে আব্বার প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায়। পুকুরের অপর পাড়ে উত্তর দিক দিয়ে এক ঝাঁক হাঁস লাইন ধরে নেমে পড়ল টলটলে জলের মধ্যে বেশ আরাম করে। শব্দ হলো ভীষণ, ভাঙল পিনপতন নীরবতার কঠিন কাঁচ। রাগান্বিত মেঘের মতো গর্জে উঠল গম্ভীর একখানা কণ্ঠস্বর,
” কি আবোলতাবোল বকতেছিস? ইয়ার্কি মা–রিস আমার লগে?”
সৌরভ ভুবন কাঁপানো স্বর হেলায় ডুবিয়ে দিল। সবিনয়ে বলল,” আপনের সাথে মজা করমু কেন? যা বলেছি সত্য বলেছি। শিমুল বয়সে ছোট কিন্তু মেয়ে ভালো। তাছাড়া আমার বিয়ের বয়স হয়েছে, আজ না হয় কাল বিয়ে করাবেন। শিমুলকে করালে মন্দ কি?”

সৌরভের কথা শুনে দৈবক্রমে রা–গে চোয়াল,হাত- পা কাঁপতে লাগল রফিক আজমের। ছেলের বেহায়াপনা, স্পর্ধা দেখে শিরা-ধমনীতে প্রবাহিত রক্ত ছলকে ছলকে উঠছে, মস্তিষ্কে দপদপ করে জ্বলছে আ–গুনের লেলিহান শিখা। মোড়া ছেড়ে মোটা,ভারিক্কি হাতের থাপ্প–ড় বসালেন ছেলের বাম গালে।

গালটা ব্যথার তোড়ে চিনচিন করে উঠল সৌরভের। চোয়াল, মুখ শক্ত হয়ে গেল অকস্মাৎ চেপে ধরা ক্রোধে।
হাত মুঠো করে শান্ত থাকল সে। তাকাল না পর্যন্ত আব্বার দিকে। আজ সে সকল প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে,মানসিকভাবে কঠোর বাঁধনে বেঁধে এসেছে নিজেকে। আজ হারবে না, প্রথম ভালোবাসার মতো পরিস্থিতির নিষ্ঠুরতার ভিড়ে হারিয়ে যেতে দেবে না দ্বিতীয় ভালোবাসাকে। পিংকি ছিল আবেগী ও স্বার্থপর একটা মেয়ে। ভালোবাসা নামক অনুভূতি ছিল তার কাছে তুচ্ছ। সে অভ্যস্ত ছিল রঙিন প্রেমে। প্রেম আর ভালোবাসা যে এক নহে। পিংকির মনে ক্ষণিকের অনুভূতিতে প্রেম জন্মালেও, মৃ–ত্যু অব্দি পাশে থাকতে হবে, প্রেমে থাকা মানুষটাকে ছাড়া নিজের তৈরি করা জগতটা শূন্য শূন্য লাগবে এমনতরো ভালোবাসা জন্মায় নি। সে কেবলই প্রেম করেছিল, ক্ষণিকের প্রেম, ভালোবাসে নি। তাই তো বিয়েতে অসম্মতি জানিয়ে প্রথমে কাঁদলেও, সময়ের স্রোতে নতুন আবেগে ভেসে যায়,ভুলে যায় তার প্রেমে পিপাসিত থাকা সৌরভ নামের প্রেমিক পুরুষকে। শিমুল সেই পিপাসা মেটায়, নতুন করে ভালোবাসার পথ দেখায়,দীর্ঘ প্রেমের নেমন্তন্ন জানায়। যেই প্রেমের উষ্ণ ধোঁয়ায় বারংবার হারিয়েও নিজের বুকের ভেতর শ্রাবনের বৃষ্টির সমাপ্তিতে ধরণীতে শীতল, শান্তির যে বাতাস বহে সেই অনলের পরশ খুঁজে পায়। আহা! এই প্রেম সে কেন আর ত্যাগ করবে? কেন দেবে বিসর্জন? জীবনে শান্তি সেও যে চায়। শিমুলকে ছাড়া নির্জীব দেহের মানব হয়ে বাঁচতে হবে তাকে। যে দেহে প্রাণ থাকবে তবে মনের হবে মৃ–ত্যু। মনের ম–রণ হলে দেহে প্রাণ থাকলেও তা যে প্রাণহীন।

রফিক আজম তপ্ত মগজে সতর্ক করলেন তাকে,” এমন বেহুদা কথা কইবা না আর। আজকের মতো বেহায়ামি যেন আর না দেখি। মুখে লাগাম দাও। বে**য়াদব পালি নাই আমি।”
” বেহুদা কথা বলি নি আমি আব্বা। সত্যিই আমি চাই আপনি শিমুলরে ছেলের বউ করে আনেন। নিশুকে ওই বাড়িতে দিচ্ছেন। এখনো আর কীসের জেদ চেপে রেখেছেন? নিজের জেদ আমাদের ওপর ফলাবেন না। পিংকির বেলায় আমি কিছু বলি নি, কিন্তু শিমুলকে আমার চাই। অহংকার, জেদ এবার ছাড়ুন। প্রহর বেয়া–দব হলেও সবসময় সঠিক কথা বলে, আপনি শুধু নিজের জেদকেই ভালোবাসেন। ”

সৌরভের গালে পুনরায় ভারিক্কি হাতের চড় পড়ল। রফিক আজমের গলা এবার নিচু রইল না আর। বজ্রপাতের ন্যায় পরিবেশ কাঁপিয়ে বললেন,
” বেয়াদব। তোকে আমি ত্যাজ্য করমু। বেয়া-দব হইছস ওই বেয়াদবটার মতোন। মাথা খারাপ করে দিছে ওই বেয়াদবটা তোদের সবার। ”

স্বামীর উঁচু, ক্রোধান্বিত গলা শুনে রোকেয়া অন্দরমহল থেকে তরান্বিত পায়ে ছুটে এলেন পুকুর পাড়ে। সাথে ছোট ফুপু,পিংকির মা সকলে। পিংকি গতকাল রাতে এসেছিল। গর্ভবতী হওয়ায় দৌর্বল্যজনিত কারণে কিছুটা অসুস্থ ও। বাড়ির সবার সাথে সেও ছুটে এলো। সকলের শ্রবণেন্দ্রিয় হয় সৌরভের উত্তর,
” দিন,ত্যাজ্য করে দিন আব্বা। যেই বাপের ছেলে-মেয়ের সুখের প্রতি ঈর্ষা, যে বাপ কেবল নিজের জেদে অটল থাকে,তাঁর সন্তান ত্যাজ্য করে দিয়ে নিঃসন্তান হয়ে থাকাই উচিত। ”

রোকেয়াসহ সকলে প্রায় স্তম্ভিত,নির্বাক। গলা চেপে কণ্ঠ রোধ করেছে যেন কেউ। সৌরভের মোটা গলায় রাগ নেই, জেদ নেই, আছে একরাশ অভিমান। অভিমানের ফাঁদে পা দিয়ে সেও বাবাকে সম্মান, সমীহ করতে ভুল বসল। জিতিয়ে দিল অদৃশ্য এক কুচক্রী শক্তিকে। রবিনের ভরাট কণ্ঠে নড়েচড়ে ওঠে সবাই, ” এসব কী বলছিস, সৌরভ? মাথাটা গেছে তোর? কী রকমভাবে কথা বলছিস তোর আব্বার সাথে? এই শিক্ষা দিয়ে বড়ো করা হয়েছে তোকে?”

সৌরভ ছোট কাকার দিকে তাকিয়ে অসহায় ভরপুর কণ্ঠে বলে উঠল,” আব্বা, আমায় অসহায় করে দিছে কাকা। উনি শুধু নিজেকেই বুঝেন,আমাদের অনুভূতি, খুশি বুঝেন না। আমি উনার বাধ্য হতে চাই না,শুধু চাই খুশিমনে উনি আমাদের কথা ভাবুক। শিমুলকে ভালোবাসি আমি,বিয়ে করতে চাই। তাতে অন্যায় কী? বিনা অনুমতিতে বিয়ে করে নিয়ে আসব এমন ছেলে নই আমি। আমার একটাই চাওয়া, আব্বা আমার জন্য শিমুলের হাত চাইবে, সকল মর্যাদা দিয়ে ঘরে তুলবে মেয়েটাকে। এই চাওয়া ভুল?”

রবিন অবাক হয়। সৌরভ শিমুলকে ভালোবাসে! প্রহর ও নিশাতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এখনো ঝামেলা- ঝঞ্ঝাট চলছে, বড়ো ভাই সৌরভের ব্যাপারটা সহজে মানবেন বলে মনে হয় না। ভাইয়ের পানে এক পল চাইল সে। সমাধান সে জানে না। কী বলবে তাও ঠাহর করতে ব্যর্থ হচ্ছে। রফিক আজম দাঁড়ালেন না আর। চলে গেলেন হনহন করে। স্বামীর মুখের দিকে এবং যাওয়ার পথে চেয়ে ছেলেকে কাতরস্বরে বললেন রোকেয়া ,” সৌরভ তোর আব্বা কষ্ট পাইছে। বাপ যেমনই হোক, তাই বলে তোর কোনো অধিকার নাই এভাবে কথা কওয়ার৷ ”

সৌরভও নিশ্চুপ থেকে স্থান ত্যাগ করে বের হয়ে যায় গেট দিয়ে। বাপ-ছেলে নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেছে। অতিরিক্ত রাগ কিংবা অভিমানে সম্পূর্ণ নিঃশব্দতা পালন করে দুজনেই। পিংকি শিমুলের জন্য পাগ**লাটে আচরণে মত্ত হওয়া সৌরভকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। সে আচ করেছিল দুজনের মাঝে কিছু একটা আছে। সেজন্য নিজেকে উপরে রাখতে একদিন ফোনে শিমুলকে তার ও সৌরভের একদা থাকা প্রেমের সবকিছু বলে দেয় চালাকি করে। এতে সে শিমুলকে হেয় করতে চেয়েছিল,বুঝাতে চেয়েছিল তার ছেড়ে যাওয়া এক ব্যর্থ প্রেমিক পুরুষকে ভালোবাসে শিমুল, যাকে সে ছ্যাঁকা নামক শব্দে জর্জরিত করে গিয়েছিল। বরাবরই ছোটো বয়স থেকে কাজিনমহলে সবথেকে হিং–সুটে মেয়েটা সে। নিশাতের অত্যধিক রূপ, বাড়িতে তার আদরের দুলালি হওয়া কভু সহ্য হতো না তার। ছলা কৌশলে অনেকবারই কষ্ট দিয়েছে, স্কুলে হেনস্তা করেছে নিশাতকে। শিমুলের প্রতিও হিং–সা আছে তার। ছোটো থেকে শিমুলের প্রিয় বান্ধবী সে হতে চেয়েছিল। কিন্তু শিমুল সবসময় ‘ নিশাত,নিশাত’ করে মুখে ফেনা তুলত। মনে হতো নিশাত ছাড়া ওর দুনিয়া চলবে না। সেই থেকে শিমুল চোখের বি**ষ হয়ে যায়। সেই বি**ষ থেকেই পূর্ব প্রেমের, মিছে আবেগের কথা বলে কত যাতনা না দিল শিমুলকে! এতে ও তৃপ্তি পেয়েছে,ভীষণ তৃপ্তি। বড়ো জেঠা বিয়েতে না মানলে খুব ভালো হবে।

রফিক আজম ঘরে আসতেই তাঁর ফোন বেজে ওঠে। তিনি এখনো বাটন ফোনগুলো ব্যবহার করেন। এটা ব্যবহারেই স্বস্তি পান তিনি। ছোটো স্ক্রিনে ” বেয়াদব ” শব্দটা পড়তেই বুঝলেন কার কল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কল রিসিভ করলেন।

” আসসালামু আলাইকুম শ্বশুরজান। কেমন আছেন?”
” কী জন্য কল দিছ? সেটা কও। এত ভণিতা করবা না। ”
প্রহর গাড়ির সিটে পিঠ এলিয়ে হাস্যমুখে বলে,
” কোনো উদ্দেশ্য নেই আজ। ভাবলাম আমার শ্বশুরজানের খবর নিই। ”
” ফাইজলামি করার সময় নাই আমার,ফোন রাখো। ”
” আপনি সবসময় আমায় এমন ভাবেন কেন? ঢাকা চলে যাচ্ছি, সরাসরি এসে দেখা করে যেতে পারি নি। ভাবলাম, কল দিয়ে বলি। আর তো বিয়ের অনুষ্ঠানের সময় আসব। অথচ মনে হচ্ছে আপনার মেজাজ একটু বেশিই গরম। ”
” তুমি এবং তোমার পরিবার আমার পরিবারটা শেষ করে দিছ। আমার বাচ্চা মেয়েটারে নিজের ভাগে নিছ, এখন ছেলেটাও আবোলতাবোল বকতেছে। তোমার পরিবারের সাথে আমি আর কোনো সম্পর্ক চাই না। দূরে রাখবা তোমার বোন রে। তোমার ফুপুরে আসতে দিই নাই এই বাড়িতে,তোমার বোন রে আসতে দিমু? ”
প্রহর না বুঝার ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল, ” কী হয়েছে শ্বশুরজান?”
রসাত্মক কণ্ঠে চৈত্রের কাঠফাটা রোদ্দুরের ন্যায় জ্বলে উঠলেন রফিক আজম দ্বিগুণ তেজে।
” মনে হইতেছে তুমি সব জানো। আমার ছেলেরে তুমিই মনে হয় ফুসলাইছ। সে নইলে তোমার বোনকে বিয়ে করব বলতেছে ক্যান?”
” আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, এটা তো খুশির খবর। আমাদের আত্মীয়তা বাড়বে তবে। আপনার মেয়েকে বিয়ে করার আগে অনেক মিষ্টি পাঠিয়েছিলাম, জিন জিন রব তুলে সব ফেলে দিলেন। এবার মিষ্টি নিয়ে আপনার আমাদের বাড়িতে যাওয়ার পালা। না-কি একেবারে নাতি-নাতনি হলে মিষ্টি নিয়ে যাবেন? এরকম ভুলেও ভাববেন না, নাতি-নাতনি হতে অনেক দেরি। এত অপেক্ষা করতে পারব না, শ্বশুরের কেনা মিষ্টি খাওয়ার জন্য আর অপেক্ষা করতে পারব না। আমি চাই না লোকে বলুক, এমপি প্রহর এজাযের শ্বশুর কিপ্টার কিপ্টা, মহাকিপ্টা। ”

রফিজ আজমের মনে হলো কল ধরে তিনি মহাঅন্যায় করে ফেলেছেন। এই ছেলে দিনকে দিন আরো অ**সভ্য হচ্ছে। মুখে কিছু উচ্চারণ করলেন,” বেশরম,নির্লজ্জ।”
প্রহরের আনন্দিত ও নির্লিপ্ত জবাব,
” ধন্যবাদ এবং আপনার আরেকটা হারের জন্য অভিনন্দন মামুজান। মানুষ যা অপছন্দ করে তা-ই কপালে জুটে বেশি। আপনার জন্য আপনার মেয়েটাকে অপছন্দ করতাম, এখন দেখেন তারে ছাড়া নিজেকে পাগল পাগল লাগে। সবই কিসমতের খেল।”
আলোক গতিতে হাত চালিয়ে কল কেটে ফ্যানের নিচে বসলেন রফিক আজম। মাথার তালু দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে যেন, অদৃশ্য তপ্ত ধোঁয়া। বিড়বিড় করলেন,” বেয়া-দব,বেয়া-দব, এই বেয়াদব ছেলের জন্য এমন হচ্ছে সব। ছেলে-মেয়ে দুটোকেই শেষ করে দিল এই ছেলে, একটাও হলো না আমার মতো। এই ছেলের ছেলে-মেয়ে এমন করলে টের পাবে আমার যন্ত্রণা। ”
পুনশ্চঃ ভুল শুধরে বললেন,” না, এই ছেলের মতো ত্যাড়া, অসভ্য, বেয়াদব কখনোই না হোক আমার নাতি-নাতনি। ”

নিশাত শিমুলকে প্রশ্নের সমুখে দাঁড় করিয়ে রাখল। একের পর এক প্রশ্ন করছে সন্দিগ্ধ গলায়। প্রশ্নগুলো এমন, ‘রাতে দেরিতে ঘুমাস? ভাইয়া আজকাল তোর কথা অনেক বলে। তোর ফোন বিজি পাওয়া যায় ক্যান রে? তুই কি কারো সাথে প্রেম করছিস?’ প্রশ্ন করার ফাঁকে ফাঁকে কোমরে শাড়ির আঁচলও গুঁজে ফেলেছে ও। শিমুল থতমত খেয়ে, করুণ চেহারা বানিয়ে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। নিশাতের হাত ধরে বলল,” তুই থাম ভাবি, বলছি আমি সব।”
” সত্যি বলবি সব। ”
” সত্যই বলব। আজ না হয় কাল তুই জানতেই পারতিস। আমি সৌরভ ভাইয়ের সাথে প্রেম করি। ভালোবাসি তাঁকে। ”
নিশাতের হৃৎস্পন্দনের গতি বৃদ্ধি পেল। জোরেশোরে প্রশ্ন করল,” কবে? কবে থেকে?”
” বেশিদিন হয় নি। কিন্তু আমি উনাকে আগে থেকেই পছন্দ করতাম। তোর ভাইটা অনেক শক্ত ছাঁচে গড়া। পটাতে কলিজার পানি পর্যন্ত শুকিয়ে গিয়েছিল। অথচ আমার ভাই কত ভালো! তোকে তুই ভালোবাসার আগেই ভালোবেসে ফেলল। কত শাড়ি,চকলেট আনত তোর জন্য। চিঠিও দিত তোকে। আর তোর ভাই একটা নিরামিষ আর খবিশ। ”
নিশাত হতবাক হয়ে যায়, ভ্যাবলা ভাঁড়ের মতো প্রশ্ন করে, ” ওইসব প্রহর ভাই দিত?”
” হ্যাঁ, ভাইয়া আনত তোর জন্য। আমার কি ঠ্যাকা পড়েছে তোকে যত্ন করে চকলেট খাওয়ানোর জন্য? যাকে তুমি ভয় পেতে,সে তোমায় তোমারই অজান্তে বয়স, দ্বন্দ্ব, সব ভুলে উম্মাদের মতো ভালোবাসত এবং বাসে। তোর ভাইকে পারলে বলিস নিরামিষ থেকে আমিষ হতে। মামার কাছে বিয়ের কথা বলতে বলেছিলাম। আজ সকালে বলার কথা।কি জানি বলতে পারল কিনা!”
নিশাতের নিস্তরঙ্গ গলায় আকস্মিক তরঙ্গ খেলে গেল। ভয়মাখা স্বরে বলে উঠল,” ভাইয়াকে বিয়ের কথা বলতে বলেছিস মানে? নিশ্চিত এতক্ষণে বাড়িতে আগুন জ্বলছে। ”
শিমুলও ভয়ার্ত গলায় আওড়াল, ” মামা কি বেশি রেগে যাবেন?”
” অনেক। আব্বাকে প্রহর ভাই ছাড়া কেউই তোদের বিয়েতে রাজি করাতে পারবে বলে মনে হয় না। প্রহর ভাইকে বল তোদের কথা। আমার ভাইটা যথেষ্ট ধৈর্য্যশীল মানুষ, কিন্তু কষ্ট পেলে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। কী থেকে কী বলে ফেলে আবার!”
” প্রহর ভাইকে বললে ভাইয়া আমাকে মে””রে হাড্ডি গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলবে। তাছাড়া আমি বিয়ের কথা বলব কী করে বড়ো ভাইকে! ছিঃ!ছিঃ! তুই বরং ভাইয়াকে বলিস মামাকে রাজি করাতে। তুই বললে ভাইয়া সব করতে রাজি।”
” তাহলে আমায় ধমকায়,মা–রে,শাসন করে কে?”
শিমুল গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দুষ্ট হেসে বলল,” এগুলোর নাম ভালোবাসা। সব মানুষ নরম, শান্ত স্বভাবের হতে পারে না। ভাইয়া ঘাড়ত্যাড়া, অশান্ত, বেপরোয়া স্বভাবের। এটা তোর জানা। তার থেকে নরমসরম ভালোবাসা আশা করা বৃথা, তার ভালোবাসাও তারই স্বভাবের মতোই। ”

নিশাতের মনে পড়ল যাওয়ার আগে লোকটা তাকে একটা চিঠি দিয়ে গেছে। চিঠিটা কখন লিখল কে জানে! সবার অলক্ষ্যে-অগোচরে পড়তে হবে। পড়ার জন্য তরও সইছে না তার। প্রহরের কথা মনে আসায় ধৈর্য্য মন সমুদ্রের লহরীতে ভেসে যাচ্ছে, অস্থির হয়ে উঠছে মন ক্রমে ক্রমে। শিমুলকে নিচে যাবে বলে তার ঘর ছেড়ে প্রহরের শূন্য ঘরটায় এসে টেবিলের ওপর থেকে সফেদ কাগজটা হাতে তুলে নেয়। এখানেই রেখে গিয়েছিল শিমুলের ঘরে যাওয়ার আগে, তখন পড়ার সময় হয় নি। মন তখন প্রহর ভাইয়ের বিদায়ে বিষণ্ণতার অতল গহব্বরে হারিয়ে গিয়েছিল। চিঠি খুলেই লজ্জায় নত হয়ে গেল হলুদাভ বদন,

” শাড়িতে তোকে গৃহিণী লাগছিল। আরেকটা জিনিসও লাগছিল, সেটা হলো’ হট’। এখন নিশ্চয়ই বলবি আমি অসভ্য? হ্যাঁ, এমনই আমি। মুখে যা আসে তা যদি বলতে না পারি তাহলে কী করব এই বাক স্বাধীনতা দিয়ে? শুধুমাত্র তোর খাতিরে,তোর লজ্জার খাতিরে মুখে বলতে পারব না বলে হাতে কম সময় নিয়েই চিঠিটা লিখে যেতে বাধ্য হলাম। কী করব? অনুভূতি চেপে রাখতে পারছিলাম না। আজ ছেড়ে দিলেও এসব আমি একদিন সরাসরি বলবই। মুখে লাগাম টানতে পারব না। আমি হররোজ কত স্বপ্ন দেখতাম তুই বউ বউ রূপে এসে আমার ঘুম ভাঙাবি, স্বপ্ন আজ বাস্তব হয়ে গেল। তোকে নিয়ে আমার আরো অনেক স্বপ্ন আছে। মধ্য রাত্রে ঘুম ভাঙলে তোকে দেখার জন্য হৃদয় হাহাকার করে আমার। জড়িয়ে ধরে বুকে মিশিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। এই হাহাকার নিঃশেষ যেন জলদি হয়ে যায় বেশি বেশি দুআ করিস নিশু। তোকে আর কীভাবে বুঝাব আমি কী চাই? বিখ্যাত ডায়ালগ ছাড়ব যে, ‘মন তো ছিনিয়ে নিয়েছি, ওইটা দিবি কি-না বল?’ ওটা কি বুঝতে পারছিস,তো? নিশ্চয়ই বুঝতেছিস। তুই এখন মনে মনে নিশ্চয়ই সেই চিরচেনা ডায়ালগটা মনে করে ফেলেছিস, তুই আমার দেহ পাবি শ–য়তান, মন পাবি না। যদি মনে মনেও আমায় শয়–তান বলিস পা-প হবে তোর,কারণ আমি তোর বর। আর তোর মন দেহ দুটোই তোর বরের মানে আমার। আর বুঝাতে পারব না,শেখাতে পারব না। এটাই শেষ শিক্ষা তোর জন্য।

ইতি,
গর্দভ নিশুকে ভালোবাসা শেখাতে গিয়ে ক্লান্ত হওয়া প্রহর এজায।

চিঠি পড়ে দমফাটা হাসি পেল নিশাতের। শব্দ করে হাসতে গিয়েও থেমে গেল। ভাঁজ করে শাড়ির আঁচলের নিচে লুকিয়ে চলে আসল নিচে। বাড়িতে যেতে হবে এবার। এই চিঠির জবাব সে অবশ্যই লিখবে, দেবেও প্রহর ভাইকে। মনে মনে একবার বলল, প্রহর ভাইয়ের সকল কষ্ট দূর হয়ে যাক।
_________________

প্রত্যয় বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। ডাকার ইচ্ছে নিভে গেল ঊষার। আজ তার জরুরি ক্লাস টেস্ট আছে। যেতেই হবে। গোসল সেড়ে তৈরি হয়ে নিয়েছে ও। যাওয়ার আগে প্রত্যয়ের শিয়রে বসে হাত চালাল ওর ছোটো ছোটো চুলের মাঝে। প্রত্যয় খপ করে হাতটা ধরে ফেলল। চোখ মেলল না। হাতটা টেনে নিয়ে ছোঁয়াল ওষ্ঠে। বুকে জড়িয়ে প্রশ্ন করল,
” কোথায় যাচ্ছিস? ”
” জরুরি ক্লাস আছে। ”
” তুই ডাক্তারনি হতে হতে আমায় যে প্রেমাসুখে রোগী বানিয়ে দিচ্ছিস সে খবর আছে তোর?”
ঊষা স্মিত হাসল। মৃদু ঝুঁকে প্রত্যয়ের কানের কাছে মুখ রেখে জবাব দিল,
” এই প্রেমবিরহের রোগ শরীরের জন্য ভালো। সইয়ে ফেলো।”
” তুই যখন বলছিস,সারাজীবন সইব আমি, ভোরের পাখি। সাবধানে থাকিস, গাড়ি নিয়ে যাইস। ভাইয়ার সাথে আমারও মিটিংয়ে যেতে হবে। আসার সময় নিয়ে আসব তোকে। ”
” ঠিক আছে। ”
ঊষা নিত্যদিনের মতোই রিকশায় চড়ে আসে মেডিক্যাল কলেজে। গেটের কাছে আসতেই বড়োসড়ো চমক পেল। সমীরণ গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবল,রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দ্রুত ঢুকে পড়বে গেটের ভেতর,কিন্তু সেই সুযোগটুকুও পেল না। বিদ্যুতের গতিতে তার সম্মুখে এসে হাজির হয় সমীরণ। বিধস্ত দেখাচ্ছে তাকে। কেমন করুণ মুখে অনুরোধ করে বসে,” কথা আছে। বেশিক্ষণ সময় নেব না। সারারাত ঘুমাতে পারি নি কথাটুকু বলার জন্য। ”

ঊষা বিব্রত পরিস্থিতিতে পড়ে গেল। আশেপাশে লোক ওদেরকেই দেখছে। সমীরণ নামি-দামি মডেল হওয়ায় সবার তীক্ষ্ণ নজর এদিকেই আসছে বার বার। সে বিগলিত হেসে বলল,” আমার খুব জরুরি ক্লাস টেস্ট আছে, এখন আপনার সাথে কথা বলার একটুও সময় নেই। ”
” সমস্যা নেই, আমি অপেক্ষা করব। সেই ভোর থেকেই অপেক্ষা করছি। দুপুর পর্যন্ত করতে হলে সমস্যা নেই। ”
” কি আপনি সকাল থেকে অপেক্ষা করছেন! কিন্তু কেন?”
সমীরণের কথায় ভেজাল খুঁজে পাচ্ছে না ঊষা। ক্লান্ত বিকেলে শ্রান্ত হয়ে হেঁটে বেড়ানো পথিকের মতোই লাগছে চেহারাখানা। উজ্জ্বল ফর্সা চেহারায় বেদনার ছাপ স্পষ্টত। ঊষার হাসি পেল না, চিন্তা জাগল, এমন খারাপ মানুষেরও বেদনা হয়? পরে মনে পড়ল রক্তে মাংসে গড়া মানুষ কি রোবট যে বেদনা হবে না? কিয়ৎক্ষণ ভেবে বলল,
” ঠিক আছে, আপনি অপেক্ষা করতে পারলে করুন। পরে কথা হবে। ”

ক্লাসে গিয়ে চিন্তামুক্ত হতে পারল না ঊষা। বার বার সমীরণের কথা ভাবাচ্ছিল তাকে। সব ঠিক হয়েও যেন হয় নি। প্রত্যয়কে পাওয়ার পরও ভয় তার পিছু ছাড়ছে না। পাওয়ার পর বরং হারিয়ে ফেলার ভয় তাড়া করছে বেশি। সমীরণ আবার কী বলতে চাইছে আচ করতে পারছে ও। সমীরণ সত্যিকারে ভালোবাসলেও এখন তা গ্রহণ করার উপায় নেই। এখন এসব অহেতুক ঝামেলা ব্যতীত কিছুই নই। ও শুধুই সবার জীবনে একটা জটিল ঝামেলা হয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। ঊষা মনেপ্রাণে চায়, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব মিটে যাক। সমীরণ দ্বারা আর ক্ষতিগ্রস্ত না হোক প্রত্যয় আর প্রহর। একবার কি বলবে সে সমীরণকে সকল দ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে নতুন করে সব আরম্ভ করতে?

সময়ের কাটায় যখন বারোটার ঘর ছুঁই ছুঁই ঊষা বেরিয়ে এসে হোঁচট খায়। চোখের তারায় দেখতে পায় ঘামে জবজবে হওয়া শরীরে সমীরণ সত্যিই তার জন্য অপেক্ষারত। সকালে দেখা তাগড়া শরীরটা রোদের তেজের হল্কায় ফুলের পাপড়ির ন্যায় মুষড়ে পড়েছে। তাকে দেখে অসহিষ্ণু গলায় বলে, ” এবার চলো, কোনো কফিশপে বসে কথা বলি। ”
” আপনি যান নি?”
সমীরণ স্তিমিতনেত্রে তাকায় ওর দিকে। কাষ্ঠ হেসে বলে,
” যাবার কথা তো ছিল না। বলেছিলাম, অপেক্ষা করব। তোমার জন্য এখন অপেক্ষা করতে কোনো কষ্ট হয় না আমার। চলো। ”
ঊষা ভরসা করতে পারছে না তাকে। পাথরের মতো কঠিন মুখ করে বলল,” আপনি যান,আমি রিকশায় আসছি। ”
সমীরণ গাড়ি লক করে চাবি নিয়ে নিল। কাউকে কল করে আসতে বলল গাড়ির কাছে। তৎপরে ঊষার দিক তাকিয়ে বলল,” তাহলে আমিও রিকশায় যাব, তুমি রিকশায় যাবে আর আমি গাড়িতে! ভালো লাগবে না আমার। ”
এত ভালোমানুষি ভালো লাগছে না ঊষার। তর্কে যেতে চায় না বলে তাল মিলিয়ে বলে, ” ঠিক আছে, তবে এক রিকশায় চড়তে পারব না আপনার সাথে। অন্য রিকশায় আসুন। ”
সমীরণ মাথা দুলিয়ে নির্দ্বিধায় মেনে নেয়,” ওকে। ”

রুফটপ একটা রেস্টুরেন্টে এসেছে ওরা। ঊষা এসেই একটা কফি অর্ডার দিল। সাধল না পর্যন্ত সমীরণকে। সমীরণ ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে ঊষার গুমোট চেহারা দেখে নিয়ে নিজের জন্য অর্ডার দিল একটা। কিছু রমণী তাকে দেখে অটোগ্রাফ, ছবি তোলার জন্য ছুটে এসেছে। বিরক্ত হলো বেশ ঊষা। প্রত্যয় ওকে নিতে আসবে বলেছিল। সমীরণের সাথে কথা শেষ করে ঝটপট বের হতে হবে এখান থেকে। তীক্ষ্ণ ফলার মতো কথাগুলো ছুঁড়ে মা””রল,

” আপনি আমায় ভালোবাসেন,এটা বলতে আসছেন। রাইট? কিন্তু আপনি যা চাইছেন সম্ভব নয় সমীরণ। আমি বিবাহিত। এখন আপনি যতই নিজেকে অনুশোচনায় দগ্ধ করুন বা আমায় আগের মতো না চেয়ে ভালোবেসে চান তাতেও লাভ নেই। আমি অন্য কারো অর্ধাঙ্গিনী। ”

সমীরণ দীর্ঘ শ্বাস টেনে নিল নিজের মাঝে। সমুখে বসে ওর দিকে ধারালো দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত করা মেয়েটাকে দেখতে লাগল উন্মুখ হয়ে। কেন অসময়ে এলো প্রেম তার মনের ঘরে? নাকি মনের অলিগলিতেই ঘুরঘুর করত? কিন্তু বুঝতে পারে নি সে। মনের ব্যাপার না হলে সে যেভাবেই হোক ছিনিয়ে নিত ঊষাকে। কিন্তু ঊষা এখন তার কাছে নাজুক একটা মেয়ে। পারবে না যন্ত্রণা দিতে। এই মেয়ের কাছে সহস্র বার নত হতে রাজি সে। ঘাত-প্রতিঘাতে না মেতে সহজ গলায় বলল,
” তোমাকে ডেকেছি এক পলক দেখার জন্য। কিছু অন্যায়ের ক্ষমা চাওয়ার জন্য, শাস্তি পাওয়ার জন্য। একটা সময় তোমাকে কতটা জঘন্যভাবে চেয়েছি মনে পড়লেই ইচ্ছে করে নিজেকে শেষ করে দিই। সেই জঘন্য চাহিদার জন্য তুমি যা শা–স্তি দেবে আমি মাথা পেতে নেব,ঊষা। ”

ঊষা কফিতে চুমুক দিয়ে কাপটা টেবিলে রেখে দিল। সমীরণের চোখে চাইল গাঢ় দৃষ্টিতে। চেষ্টা করল মুখের কথায় বিশ্বাসী না হয়ে, চোখ পড়ে সত্যতা যাচাই করার। ভালোবাসার দৃষ্টি ও চেনে। খুব ভালো করেই চেনে। হ্যাঁ, শানিত চোখজোড়ায় ভালোবাসার ছন্দ মিশে আছে, আকুতি দিয়ে যেন ডাকছে ওকে। সেটাকে সে পরম যত্নে অবজ্ঞা করে বলল,
” আপনার চোখে নিজের জন্য ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছি, আপনি আমাকে না পেয়ে প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে বিষা–ক্ত যন্ত্রণায় ছটফট করবেন,এর থেকে বড়ো শা–স্তি আর কী হতে পারে? এটাই আপনার জন্য শা-স্তি। বিষাদময় তিক্ত এক শাস্তি, ম–রণ পর্যন্ত তিলে তিলে ধ্বংস করবে আপনাকে। ”
সমীরণ রাগল না, চোখে বরং ফোটে উঠল যন্ত্রণা। বাস্তবতার রুক্ষ মূর্তিকে অবহেলিত করে সে কল্পনার জগতকে অঙ্কিত করে ঊষাকে স্মিত হাসিতে বলল,
” তুমি এ জনমে আমার না হও, পরের জনমে আমার হবে। তবুও এ জনমেই আমি প্রার্থনা করব,কোনো মিরাক্কেল হয়ে যাক, তুমি আমার হয়ে যাও,ঊষা। ”
” পরের জনম বলতে কিছু নেই। আপনার বুদ্ধি ভ্রষ্ট হয়েছে।”
” জানি, তবুও চাইছি। হবে না জেনেও চাইছি। চাইতে কেউ বাধা দিতে পারে না। তোমারও সাধ্য নেই আমার চাওয়ায় বাধা দিতে,তোমায় ভালোবাসতে। ”
ঊষা এবার নড়েচড়ে বসল। বলল,
” আপনার কাছে আমার একটাই অনুরোধ আপনি প্রহর ভাই ও প্রত্যয়ের পিছু ছেড়ে দিন। দ্বন্দ্ব ভুলে যান। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থাকবে,তাই বলে প্লিজ তাদের ক্ষতি করার কথা ভুলে যান। নিজে তো ভালোবাসেন,এখন একটু বুঝেন ভালোবাসার মানুষের কিছু হলে কেমন অনুভব হয়? প্লিজ উনাদের ক্ষতি করবেন না আর। ”

বলে ঊষা কফির বিল দিয়ে ঝটপট উঠে দাঁড়াল। সমীরণের দিকে তাকাল না,বেরিয়ে গেল সে। শীতল চোখ দুটি খুব করে চাইছিল সে একটা বার ফিরে দেখুক। সমীরণ নিজ মনে বলে,
” ভালোবাসা সবসময় নিঃস্বার্থ হতে শেখায় না। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা ভিন্ন ঊষা। আমার ভালোবাসায় পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও আমি পরোয়া করব না, শুধু তুমি হলেই চলবে। ত্যাগ করে ভালোবাসায় পরাজিত হওয়াতে বিশ্বাসী আমি নই। জোরও করব না। তুমি নিষিদ্ধ হলেও প্রতি মুহূর্তে তোমাকেই চাইব। ”

রেস্টুরেন্টের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল প্রত্যয়। ঊষাকে দেখে ফিচেল হেসে গাড়িতে উঠে বসল। দরজা মেলে দিয়ে বলল,” সাক্ষাৎ কেমন ছিল তোদের?”
ঊষা আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকায়। প্রত্যয় কি ভুল কিছু বুঝল?

( ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)