#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকা: আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৫২ ( অর্ধাংশ)
সফেদ পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে প্রহরকে আসতে দেখে দ্রুতধাবী হয়ে গেলেন রফিক আজম। লুঙ্গি মুঠোয় আগলে নিয়ে তরান্বিত পায়ে খোলা গেটের সমীরেখা পেরিয়ে প্রবেশ করলেন স্মরণিকা নিবাসে। ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড ভীত তিনি। সমুখের দিক হতে আসা প্রহরের ভরসা নেই। সত্যিই যদি কোলে তুলে নেয়,মান সম্মান নীলচে অন্তরিক্ষে পাখি হয়ে উড়বে কিংবা শুভ্র,স্বচ্ছ,মেঘামালাদের ন্যায় জলীয়বাষ্প রূপে পুঞ্জীভূত হয়ে ভাসমান হয়ে রবে দূরবর্তী ওই আকাশে। মূলত হাতে-ছোঁয়ার বাহিরে চলে যাবে সম্মান নামক অমূল্য, অতীব প্রিয় রতনখানি। হাস্যকর পাত্র হয়ে যাবেন তিনি সবার সম্মুখে। আর এ ছেলের সম্মানের প্রতি কোনো মায়া নেই, দুনিয়া পরোয়া করে চলে না, গ্রামের মানুষের চোখের তারায় উনি যে শ্রদ্ধার প্রাচীর নির্মাণ করেছেন সেটার একেকটা ইট খসাতে পারলেই যেন গভীর প্রশান্তি মিলে তার। কেন যে ভয়কাতুরে হয়ে পড়লেন আর বলতে গেলেন এসে নিয়ে যেতে! তার চেয়ে চিত্তের অস্থিরতা দূরে ঠেলে আগে ঢুকে গেলেই ল্যাটা চুকে যেত। শুনতে হতো না এসব আজগুবি কথাবার্তা।
আব্বার মতিগতি কিছুই বুঝতে পারছে না নিশাত। এই বলল, প্রহর আসলে যাবে, এখন আবার নিজেই পা চালাল অন্দরমহলের দিকে। প্রহরকে সম্মুখে এসে থামতে দেখে আব্বার পাশাপাশি সে সহ বাকি সবাই থমকে গেল। রোকেয়া ও পিংকির মায়ের মুখে আনন্দের ঝলমলে হাসি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। আব্বার সর্বদা গাম্ভীর্যের শামিয়ানা পরিহিতা চেহারাটার অভিব্যক্তি দেখতে চেয়েও দেখতে পারল না নিশাত পেছনে থাকার দরুন। দেখল, হৃদয়ে নরম স্থানে ধারা–লো ছু–রি বসানো শ্যামপুরুষের চেহারাটা। এই মুখ সে যতবার,যত পল দেখে হৃৎপিণ্ডে ছু–রি গাঁথে যেন কেউ, কেমন চিনচিন করে ওঠে অকস্মাৎ। শ্বাস-প্রশ্বাস ভারী হয়ে যায়, কখনো নিয়ন্ত্রণ হারায় তো কখনো আবার ধীরে ধীরে চলে। মাদল বাজা বন্ধ হয় না একটাবারের জন্যও। হৃদয় তন্ত্রী বাজতে থাকতে অবাধে, পুরো উদ্যমে। চিত্ত জুড়ে চলে শিহরণের তোলপাড়। বিয়ে হয়ে গেল,অনুভূতিদের ঠিকানা হলো, ভয় কমল তবুও সাহসী হয়ে উঠতে পারল না সে। প্রহর ভাইয়ের সামনে সে যেন তোতা পাখি আর না হলে বোবা এক নিরীহ প্রাণী। যার অন্তর্দেশে হাজারো শব্দের আনাগোনা থাকে,মুখে থাকে না কোনো বর্ণ। একদমই নিজেকে কাবু করতে পারে না সে, অথচ শত শত বার চায় যথেষ্ট স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় প্রহর ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে চমকে দিতে তাকে৷ নিশাত জানে এটা অসম্ভব এক কল্পকাহিনি। যা কল্পনায়ও সম্ভব নয়,বাস্তবে কি হবে? ভালোবাসার পুরুষের সামনে প্রতিটি নারী ভিতর থেকে অল্পস্বল্প হলেও অস্থির থাকে। এই যে এখন সে আব্বার কাঁধের উপর থেকে চো-রা চোখে একটু একটু করে দেখছে প্রহরকে,চাইলে কি আর সবার মতো সোজাসাপ্টা তাকানো যায় না মানুষটার দিকে? না,ও চাইলেও পারবে না। ওর চোখের মুগ্ধতা অনায়সে বন্দীত্ব বরণ করবে প্রহরের চোখের কারাগারে। আজ আসার আগে যত্ন করে গতবার প্রহরের দিয়ে যাওয়া চিঠিটার জবাবে একটা চিঠি লিখে এনেছে কাঁপা কাঁপা হাতে। চিঠিখানা লেখনীর সময়টুকুতে বুকটাও ধড়ফড় করছিল খুব। এই চিঠি পড়ার পর প্রহর ভাই নিশ্চিত সঠিকভাবে নেবে না কোনো কিছু। ত্যাড়া লোকটা না জানি কত পচানি দেয় তাকে! নিশ্চয়ই একগাদা লাজের বাণে জর্জরিত করবে,নতুবা অপমানের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তিরস্কারের সুরে বলবে,’ ছি!ছি! নিশু, এত অসভ্য হয়েছিস তুই! কোথায় গেল তোর লাজলজ্জা? তুই লিখতে পারলি এসব?’
কল্পনার রাজ্যেই বাসিন্দা হয়ে অপমানে কিংবা লাজে জড়ীভূত হয়ে যায় নিশাত। এই চিঠি আদৌ দেবে কি-না ফের ভাবনার জগতে নিমজ্জিত হলো। কয়েক লহমা বাদে সেখানে থেকে বেরিয়ে দেখে প্রহর ভাই আব্বাকে জড়িয়ে ধরেছেন। চক্ষুতে ভাসমান দৃশ্য ভুল সংজ্ঞায়িত করে পুনশ্চঃ তাকায় সে। সত্য, দেখা দৃশ্যপট একেবারেই সত্য।
রফিক আজম অপ্রতিভ হয়ে পড়লেন প্রহর আকস্মিক তাঁকে জড়িয়ে ধরায়। গলায় কাশি উঠে গেল৷ প্রহরের সিগারেটের ছোঁয়ায় পোড়া ঠোঁটের কোণে ক্রুর হাসি ফোটে উঠে। কেমন ভর্ৎসনার সুরে বলে ওঠে উনার কানে ফিসফিস করে,’ অহংকার হারিয়ে, অসহায় এক ব্যক্তি হয়ে অবশেষে পদলি ফেললেন স্মরণিকা নিবাসে। ওয়েলকাম টু ইউর ডটারস ফাদার ইন লজ হাউস। আই লাভ ইউ, শ্বশুরজান। ‘
শেষের বাক্যে ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন রফিক আজম। কীসব কথাবার্তা ছেলেটার! ‘ অপমান করে ভালোবাসা মারানো হইতেছে’ মনের ঘরে চুপিসারে এটা বলতে ভোলেন নি তিনি। প্রহর উনাকে ছেড়ে দিতেই প্রত্যয় এসে জাপটে ধরলেন উনাকে। এক দু কদম পেছালেন বোধহয় আকস্মিক আক্র-মণে৷ নিশাত ততক্ষণে আব্বার পাশ থেকে সরে গিয়ে একপাশে দাঁড়ায়। শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে যেন কোনো মিল-মিলান্তির কার্য সম্পন্ন হচ্ছে, এমন মনে হলো তার। প্রত্যয় মামাকে জড়িয়ে ধরে নির্ভেজাল গলায় বলল,’ আই লাভ ইউ মামা। ‘
কণ্ঠটা, বাক্যটা আবেগ ধরিয়ে দিলেন রফিক আজমের পাষণ্ড হৃদয়ে। অল্পস্বল্প আবেগি হলেন সে। পাথুরে অন্তরটা কেঁপে কেঁপে উঠল আপনের সংস্পর্শে। এই ছেলেগুলোকে অনাদরে অবজ্ঞা করেছেন কতকাল, অথচ তিলার্ধ ক্রোধ নেই ছেলে দুটোর চেহারায়,গলায়। উল্টো কত ভালোবাসা! এতকাল যা ভাবেন নি ক্রোধের বশীভূত হয়ে,প্রহরের ভেঙে দেওয়া অহংকারে অসহায়ত্ব বরণ করে তিনি যেন ফিরে পাচ্ছেন ধীরভাবে নরম মনটা। অনুতপ্ত হলেন ভীষণ নানার বাড়ির আদর-সোহাগ থেকে প্রহর, প্রত্যয়,শিমুলকে বঞ্চিত করায়। তবে পুরোপুরি নয়, বছর বছর ধরে লালন করা অহংকার কি এত সহজে দূর হয়? কিন্তু স্বয়ং তিনিই স্বীকারোক্তি করেন সামান্য হলেও হিংসা নামক যে পর্দা ঢেকে রেখেছিল কোমল চিত্তকে, মন্থরগতিতে সরতে আরম্ভ করেছে তা।
উজ্জ্বল সাহেব মালা নিয়ে এসে কোনো বিড়ম্বনা, আড়ষ্টতা ছাড়াই পরিয়ে দিলেন রফিক আজমের গলায়। অষ্ট প্রহর ঠোঁটে হাসি লেগে থাকেন উনার। হিংসা জঘন্য একটা শব্দ। এই শব্দ যাকে বশ করেছে একবার,তাকে পৃথিবীতে নিকৃষ্ট মানুষের পাশাপাশি অসহায় বানিয়ে ছাড়ে। মানুষের হৃদয় হয় তুলোর ন্যায় নরম। এ হৃদয় অন্যের যন্ত্রণায় বা ভালোবাসায় কাতর হয় না, এমনটা হতেই পারে না। কিন্তু হিংসা সে হৃদয়টার ওপরে খুবই সন্তর্পণে আস্তেধীরে চাঁদোয়া ফেলে দেয়, ক্রোধ, অহংকারের চাদর। ঢেকে দেয় নরম মনটাকে। অতঃপর ভালোমন্দ বুঝে না মানবজাতি, সে কেবল খুঁজতে চায় নিজের সুখ। কিন্তু বোকা মানব এটা বুঝে না, হিংসায় সুখ নহে, মিলে শুধুই দুঃখ, ধ্বংস। এজন্য উজ্জ্বল সাহেব নিজের সত্তায় এটাকে কখনোই বসতি গড়তে দেয় নি। বন্ধুর প্রতিও অভিযোগ নেই তাঁর। সবসময় চেয়েছেন সবকিছু ঠিক হয়ে যাক। অভিমান ছিল কিঞ্চিৎ, কিন্তু অতি যতনে পুষে রাখা ভালোবাসার কাছে তা নেহাতই তুচ্ছ। পরিপূর্ণ চোখে তাকিয়ে বললেন,
‘ আসলি তবে আমার বাড়িতে। ভেতরে চল। ‘
রফিক আজম কী বলবে ভেবে পাচ্ছেন না। ক্ষীণ সময় ব্যয় করে একটু আধটু ইতস্তত করে বললেন,
‘ কেমন আছিস?’
‘ আলহামদুলিল্লাহ। ভিতরে গিয়ে কথা হবে,চল। ভাবি চলেন।’
রোকেয়াকেও উদ্দেশ্য করে বললেন উজ্জ্বল সাহেব। সবাই ভিতরে চলে গেলে নিশাতও পিছু পিছু পা ফেলে কচ্ছপের গতিতে। হাতে টান পড়ে ওর তৎক্ষনাৎ। চমকায় না,হকচকায় না। ওই একটু বেহায়া হৃদয় সমুদ্রের তীরে বেসামাল লহরির আছড়ে পড়ে, ভিজিয়ে দিয়ে যায় হৃদয় ভূমিটা। ফিরে তাকায় পাশে।
প্রহর পাশ থেকে সামনে এসে দাঁড়ায়। গভীর দৃষ্টিজোড়া সংকুচিত করে দেখতে থাকে নিশাতকে। গুটিয়ে যেতে চায় নিশাত এহেন চাউনিতে৷ কী দেখছে অমন করে প্রহর ভাই! জিজ্ঞেস করবে কি! ভাবতে ভাবতে প্রশ্নটা করে ফেলে,
‘ কী হয়েছে? কী দেখছেন?’
প্রহর নজর স্থির করে। নড়চড় হয় না চাহনি। প্রমত্ত চোখে চেয়ে থাকে নিশাতের হালকা রঞ্জিত বদনে। কোনোরকম কপটতা না করে সিধেসাধা জবাব দিল,
‘ তোকে দেখছি। ‘
‘ কেন?’
‘ তোকে দেখব না? মাস খানেক পর পর দেখি তোকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হবে না? এবার বিশাল পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি তোর মাঝে। ‘
নিশাত ব্যাকুল হয়ে পড়ে। আগ্রহী কণ্ঠে জানতে চায়,
‘ কেমন পরিবর্তন?’
প্রহর হাত ছেড়ে আরো এগিয়ে আসে। নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস মিলিত হওয়ার তোড়জোড় চলছে। নিশাতের চোখের আয়নায় তীব্র জানার ইচ্ছে প্রকাশিত। অপরদিকে সেতারের ঝংকার চলছে অভ্যন্তরীণে প্রহরের বলিষ্ঠ দেহ খুব কাছে অনুভব করায়। প্রহর হাত তুলে ওর মাথার ওপর থেকে ঘোমটা সরিয়ে দেয়। প্রশ্ন করে,
‘ ঘোমটা দিয়ে, লাল জামা পরে একেবারে বউ রূপে হাজির হয়েছিস,রেখে দিই? ইচ্ছে করছে, মামুজানের টাকা বাঁচিয়ে দিই, শুধু বলব ফুলের টাকা দিয়ে দিতে,আমার রুমটা সাজানোর জন্য, তাতেই চলবে। ‘
নিশাত দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। এরকম কথার সামনে টিকে থাকতে পারবে না ও। প্রহর ভাই, ওকে আজগুবি, ত্যাড়া কথা বলবে না,তা হতেই পারে না। কথা ঘুরাতে পূর্বের প্রশ্ন তোলে,
‘ কী পরিবর্তন বললেন না তো। ‘
লজ্জাহীন, নির্লিপ্ত কণ্ঠের জবাব আসে কর্ণকুহরে,
‘ বিয়ের ফুল ফোটেছে তোর। সুন্দর হয়ে গেছিস আরো বেশি। মোটাও হয়েছিস একটু। আলতামাখা হাতে রক্তজবা লাগছে তোকে। তোর টকটকে লাল রঙে মাখোমাখো ঠোঁট দুটি আমার বুকের উচাটন বাড়িয়ে দিচ্ছে। তর সইছে না,বুঝলি? চুমু এখন একটা খেতেই হবে। ‘
বলেই টুপ করে আলতো করে ছুঁয়ে দিল প্রহর নিশাতের নিটোল ওষ্ঠযুগল। নজর না সরিয়ে প্রবল এক নেশা ছড়িয়ে দিয়ে বলল,’ দেখ তো, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক লাগল কি-না। কেউ দেখলে বুঝে যাবে তোকে চুমু খেয়েছি। লেগে থাকলে মুছে দে। ‘
নিশাতের তনুমনে উষ্ণতা। চঞ্চলমতি মনটা ছটফট করছে আদুরে স্পর্শে। হৃদযন্ত্রটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে বড্ড অভদ্রভাবে লাফালাফি করছে। কম্পরত হাতে ওড়নার কোণা তুলে নিয়ে গেল প্রহরের অধরের একেবারে সন্নিকটে। ঈষৎ লেগেছে লাল রঙ৷ লিপস্টিকের ওপরে লিপগ্লস দিয়েছিল ও,যার কারণবশত ভেজা ভেজা ছিল ওষ্ঠাধর। সহজে লেগে গেল প্রহরের ঠোঁটে। মুছতে গেল প্রহর ওড়না হাত থেকে ছাড়িয়ে দেয়। উন্মুখ চেয়ে থেকে বলে,
‘ তোর আঙুল দিয়ে মুছে দে সুইটহার্ট। ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে তো ছুবি না, আঙ্গুলই ছুঁয়ে দে জান। ‘
#চলবে~
#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকা: আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৫২( সম্পূর্ণ)
নিশাতের বুকের ভেতরে অদমনীয় অনুভূতির চাবুকাঘাত বেড়ে গেল। দেদারসে ছুটতে আরম্ভ করল হৃদস্পন্দন। আঙ্গুল সরিয়ে আনতে চাইল মৃদু দুর্বল মন। সম্ভব হলো না। হাত বাধা শক্ত হাতের বাঁধনে। প্রহর ঠোঁটের কাছে হাতটা নিয়ে পলকহীন অনিমিখ চেয়ে আছে চাতকের ন্যায়। নিশাত ভাবনঘরে অঢেল ভাবনা ভেবে অবশেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, মুছে দেবে সে প্রহরের ঈষৎ লাল রঙে ছেয়ে থাকা ঠোঁট দুটো। অপরিমেয় সাহস নিয়ে অনুভূতিদের সায় দিয়ে তাকাল সে প্রহরের ঠোঁট জোড়ায়। ছুঁয়ে দিল আলতো করে। শিরশির করে উঠল সমস্ত দেহ। তৎক্ষনাৎ তরতর করে বেড়ে গেল র-ক্ত উচ্ছ্বাস। গায়ের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম ভেসে উঠল কপালে। ডান বাহুতে শক্ত হাতের স্পর্শে ঘাবড়াল আরো বেশি।
প্রহর বাহু কিঞ্চিৎ চাপ দিয়ে ধরে তাকে আরো গভীরভাবে টেনে নিল নিজের দেহের কাছাকাছি। সামান্য দুর্বল চাহনির লজ্জালু দৃষ্টিতে চোখ জোড়া ডুবিয়ে বলল গম্ভীর গলায়,
‘ দেরি হচ্ছে, জলদি মুছে দে। নয়তো আমি এভাবেই চলে যাব ভেতরে। সবার সামনে কিন্তু তোকেই লজ্জায় পড়তে হবে। ‘
নিশাত তক্ষুনি তড়িঘড়ি করে লাজুকলতাকে নেতিয়ে দিয়ে মুছে দিতে লাগল আঙ্গুলের ঘষায় ঠোঁটে লেগে থাকা লিপস্টিক। কিন্তু মোছার বদলে আরো ছড়ে যেতে লাগল। অদ্ভুত সুন্দর দেখাল প্রহরকে। হাসি পেয়ে গেল তার। সেই মিটমিটে হাসিকে চাপিয়ে রেখে গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলল সমুখের পুরুষের বুকের ওপর। অস্ফুট মধুর ধ্বনিতে বলল,
‘ ওড়না দিয়েই মুছতে হবে। আঙ্গুলে মুছতে গেলে ছড়ে যায়।’
প্রহর ভুরু দুটিকে কুঁচকে তাকাল। নিশাতের ওড়নার অর্ধাংশ হাতে নিয়ে তাচ্ছিল্যের কণ্ঠে বলল, ‘ দ্যাখ, তোর ওড়না কত নিষ্ঠুর। এমন জর্জেটের নিষ্ঠুর ওড়না দিয়ে আমি আমার ঠোঁট মুছতে দেব,তোকে? ভাবলি কী করে! আমার ঠোঁট রক্তাক্ত করে চুমু না খাওয়ার ধান্ধা। ঠোঁট কে-টে গেলে তো বলবি, প্রহর ভাই আপনার ঠোঁট কা-টা, ঠোঁটে চুমু খেতে পারব না। এসব একদম চলবে না নিশু। তোর সব কুচক্রী কাজ আমার জানা আছে। ‘
নিশাত তাজ্জব বনে গেল। সে কেন এমন চাইবে! জর্জেটের ওড়না দিয়ে ঠোঁট মুছলে রক্তা-ক্ত হয়ে যাবে, তারপর সে ঠোঁটে চুমু খাবে না, এত গভীর কর্মকাণ্ডের কথা সে ঘুণাক্ষরেও ভাবে নি। অথচ সামনের মানুষটা সবসময় সব বিষয়ে সন্দেহ করে, সাধারণ বিষয়টাকে অসাধারণের পর্যায়ে নিয়ে যায়, ইচ্ছেমতো কাণ্ড নিজে সাজিয়ে ফেলে, যেটার ছিটেফোঁটাও থাকে না ওর মনে। রাজনীতি করে করে এ হাল হয়েছে বলেই ধরে নিল সে। নতুবা এমন প্যাঁচাল কই থেকে শিখবে! মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,
‘ আমার ব্যাগে মনে হয় টিস্যু আছে, দাঁড়ান দেখি। ‘
‘ আমি দাঁড়িয়েই আছি, তুই দ্যাখ। ‘
‘ আচ্ছা। ‘
সাথে আনা সাইড ব্যাগ খুলল নিশাত। প্রহর সেটায় কী মনে করে চোখ রাখল। চোখে বিঁধল খামে মোড়ানো চিঠি। নিশাত টিস্যু নিয়ে ঝট করে ব্যাগের চেইন লাগিয়ে মুখোমুখি হলো প্রহরের। হাত বাড়িয়ে মুছে দিতে লাগল ওষ্ঠজোড়া। কানের পিঠে টের পেল তপ্ত ছোঁয়া। প্রহর চুলগুলো গুঁজে দিচ্ছে কানের পিঠে। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করে,
‘ তোর ব্যাগে চিঠি কেন? কে দিয়েছে? ‘
নিশাত স্তম্ভিত। অভ্যন্তরে কম্পন। অস্থিরতা ফোটে ওঠতে শুরু করে ক্রমশ চেহারায়। সে কী করে বলবে এই চিঠি আপনার গতবার ঢাকা যাওয়ার সময় দিয়ে যাওয়া চিঠির জবাব! বললে নিশ্চয়ই এখন নিয়ে পড়ে ফেলবে লোকটা। তারপর! তারপর একটা কথাও ছেড়ে বলবে না ওকে মানুষটা। সত্য লুকাতে একটা মিথ্যা বলল,
‘ এটা! এটা আমাকে আমার এক ফ্রেন্ড দিছে। ‘
‘ বাহ! ইন্টারনেটের যুগে এসে তোর ফ্রেন্ড চিঠিও দেয়? কোন ফ্রেন্ড, কেমন ফ্রেন্ড? ছেলে না মেয়ে? বাড়ি কই? আমাদের গ্রামের না-কি অন্য গ্রামের?’
একের পর এক ক্রমাগত প্রশ্নের জোয়ারে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে নিশাত। ঠিকঠাক মিথ্যা সাজাতেও পারল না মেয়েটা। বলল,
‘ শহরের ফ্রেন্ড, মেয়ে ফ্রেন্ড। ‘
প্রহর আরো বেশি সংশয়িত দৃষ্টিতে চাইল।
‘ শহরের ফ্রেন্ড? ঢাকার? কিন্তু তোর ঢাকাতে ফ্রেন্ড কই থেকে আসবে?’
নিশাত চট করে আরেকটা মিথ্যা বলল,
‘ ফেসবুক..ফেসবুকে পরিচয়। সে কিছু গিফটের সাথে চিঠিটা পাঠাল। ‘
‘ দেখি কী লিখেছে চিঠিতে। দে, আমায় দে। ‘
নিশাত বৃষ্টিকালীন আকাশে বিদ্যুৎ চমকানোর মতোই চমকাল। আরেকটা মিথ্যে কিছু বলার আগে ব্যাগ টেনে নিয়ে চিঠির খামটা নিয়ে নেয় হাতে প্রহর। প্রশ্ন করে,
‘ পড়েছিস এটা? কী লেখা এতে?’
‘ আমার সর্ব-নাশ। ‘
মুখ ফস্কে কথাটা বেরিয়ে গেল নিশাতের। সটকে সরে গেল সে প্রহরের শরীরের কাছ থেকে। প্রহর রাগ রাগ চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ কী বললি?’
‘ কিছু না। পড়ি নি এখনো। ‘
‘ আচ্ছা, আমিই তোর বান্ধবীর দেওয়া চিঠিটা পড়ি তাহলে। দেখি,আমার বেক্কল বউকে কী লিখল। ‘
নিশাত মনে মনে এক নাগাড়ে আওড়াল, ‘ সর্ব-নাশ, সর্ব-নাশ,সর্ব-নাশ। ‘ হ্যাঁ, নিজের সর্বনা-শই তো লিখেছে সে। তবে এই সর্বনা-শে কোনো ক্ষ-তি নেই। আছে হৃদয়ের আত্মসমর্পণ। যা কোনোদিনও মুখে বলতে পারত না সে, শ্বাস-প্রশ্বাস সঙ্গ ছেড়ে দিলেও। সেই আত্মসমর্পণের ছোট্ট একটি গল্প লিখেছে চিঠিতে। কিন্তু সে চায় নি চিঠিটা এখনই পড়ুক, প্রহর। কিন্তু বাঁচার উপায়ও নেই। মুখোমুখি আর থাকতে পারবে না সে। ভিতরে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলে প্রহর ধ-মকে উঠল,
‘ কোথায় যাচ্ছিস? দাঁড়া, তোর চিঠি পড়া হলে ফেরত নিয়ে যাস। ‘
‘ ফেরত দিতে হবে না। ‘
গাঁইগুঁই করে বলল নিশাত।
‘ কেন? অবশ্যই ফেরত নিবি। আমি কি লুটপা–টকারী? এমন ভাব করছিস যেন তোর চিঠি লুটপাট করে ছিনিয়ে নিছি? পড়েই দিয়ে দেব। প্রহর এজায ছিনিয়ে কিছু নেই না। ‘
নিশাত বিড়বিড় করল,’ এক্ষুনি তো নিলেন। আমার ব্যাগ থেকে আপনি চিঠিটা ছিনিয়ে নিলেন। ‘
বিড়বিড় অব্দিই সীমাবদ্ধ থাকল ওর উচ্চারিত একেকটা বর্ণ,শব্দগগুচ্ছ। সরাসরি বলার সাহস আর কই! দেখা যাবে, ঠাস ঠাস থা–প্পড় পড়েছে গালে। অতঃপর গালটাই ব্যথা হয়ে যাবে। তার চেয়ে ভালো জড় পদার্থের ন্যায় স্থির দাঁড়িয়ে থাকা। তবুও ভিতরে ভিতরে তীব্র অস্থিরতা বেড়েই চলল। আড়চোখে দেখতে লাগল প্রহরকে। চিঠির ভাঁজ খুলে তাতে চোখ বুলাচ্ছে সে। থেকে থেকে সরল চাহনি কেমন কাঠিন্যতায় পরিণত হয়ে গেল। ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারছে না ও মানুষটার অভিব্যক্তি। এক পর্যায়ে চিঠিটা ভাঁজ করে সেটা সাথে নিয়ে চলে গেল প্রহর ঘরের দিকে। ফিরে তাকাল না পর্যন্ত ওর পানে।
নিশাত বিস্ময়াহত হলো। থম মে-রে গেল কয়েক পলের জন্য। কান্না পেয়ে গেল তার ভীষণ। চোখের কোল ভরে উঠল নোনতা জলে। চিঠি পড়ে কি প্রহর ভাই ওকে খারাপ মেয়ে ভেবেছে? ভিতরের এক সত্তা বলল, নিশ্চই ভেবেছে,লিখেছিসই এমন কথা। মেয়ে মানুষ এসব কেন লিখলি? অনুভূতি আটকে চুপ করে থাকবি। এসব বেহায়া কথা কেন লিখবি? আরেকটা সত্তা তার বিরোধিতা করে যেন বলল, ‘ ভুল করিস নি। এমপি সাহেব এমনটাই চেয়েছিলেন। ‘ নিশাত কারো কথা শুনল না। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার জানিয়ে বলে, ‘ কেন ওইসব লিখলি,নিশু? বাজে মেয়ে ভাবছে উনি তোকে। নাহলে ওইভাবে পাথরের মতো কঠিন মুখ করে চলে গেলেন কেন?’
এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে গাল বেয়ে চিবুক ছুঁয়ে গলা স্পর্শ করল। হাতের উল্টোপিঠে মুছে ফেলল জল। প্রহরকে নিজের দিকে আসতে দেখে অবাক হয়। লম্বা লম্বা পদক্ষেপে এসে ওর হাত ধরে বুকে টেনে নেয় প্রহর। পিঠে হাত রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে স্তিমিতভাবে জানতে চাইল,
‘ কাঁদছিস কেন জান?’
নিশাতের কিশোরী সত্তা ফুপিয়ে উঠল। প্রশ্ন করল,
‘ আপনি আমাকে বাজে মেয়ে ভাবছেন,তাই না?’
‘ আমার তিলবতী বাজে মেয়ে হবে কেন? সে বোকাসোকা একটা মেয়ে। তার মনে ক্যাচাল থাকলেই না বাজে কিছু করবে। সে নির্বোধ। আমি শুধু ভাবছি, নির্বোধ মেয়েটা এই চিঠি লিখল কীভাবে! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না একদম, সেজন্য ঘরে গিয়ে আবার পড়ব ভাবছিলাম। সত্যি তুই লিখেছিস,এটা?’
নিশাত বুক থেকে মাথা তুলে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝায়। প্রহর বাতাসের মতো করে ফিসফিস করে বলল,
‘ জামাই পাগল হচ্ছিস তাহলে ধীরে ধীরে। তবে ধৈর্য্যের পরীক্ষা আরো বাড়িয়ে দিলি। তোর এই লিখিত আত্মসমর্পণ আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে দিতে চাইছে। ভাবছি চিঠিটা বাঁধাই করে দেয়ালে সাজিয়ে রাখব। চিন্তা করিস না, আমাদের রুমে কাউকে ঢুকতে দেব না। আর আমাদের বাচ্চাকাচ্চা যখন পড়তে শিখে যাবে, লুকিয়ে ফেলব। ‘
নিশাত নিশ্চুপ হয়ে রইল। এই লোকের সাথে সে পারবে না। সব কথা উল্টাপাল্টা। কপট রা**গ দেখিয়ে বলে,
‘ না, রুমেও রাখতে পারবেন না৷ দেখে ফেললে সবাই কী ভাববে?’
‘ হু,এমন চিঠি লিখেছিস কাউকে দেখিয়ে খুশিটাও জাহির করতে পারব না। ‘
.
.
খাওয়া শেষে সোফায় বসলেন রফিক আজম সবার সাথে। বাড়ির সবাই উপস্থিত এখানে। মূলত বিয়ের অনুষ্ঠানের পাকাপোক্ত তারিখের জন্য প্রচন্ডের আগ্রহ নিয়ে একত্রিত সকলে। সৌরভও চলে এসেছে। রফিক আজম ঘাড় বাঁকিয়ে এক পলক আলতার দিকে তাকালেন। বোনের জন্য অদ্ভুত মায়া কাজ করছেন তাঁর। অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছেন ধীরে ধীরে। ‘ কায়া দেখলে মায়া বাড়ে’ কথাটা যেন চিরন্তন সত্য। বোনকে দূরে রেখেছিলেন সবসময়, চেহারাটুকু দেখতে চাইতেন না। অথচ এই বোন বিনা অভিমানে, কোনো ঘৃ-ণা ছাড়া বরণ করে নিলেন তাকে বাড়িতে। খাওয়ার সময় আলতা নিজ হাতে ভাইকে দিচ্ছিল সব। এক ফাঁকে এটাও বলেছে, ‘ আমি আপনার পছন্দের পিঠা বানিয়েছি, ভাই। যাওয়ার সময় দিয়ে দেব। ‘ বোনের প্রতি স্নেহ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ভেতরে ভেতরে।
মোশতাক সাহেব গুরুগম্ভীর স্বরে বললেন,’ অনুষ্ঠানের ডেট টা ঠিক করে ফেলুন তাহলে। আর দেরি করে লাভ নেই। ‘
উজ্জ্বল সাহেবও বড়ো ভাইয়ের সাথে তাল মিলালেন,’ দশ দিন পর হলে কেমন হয়,রফিক?’
প্রহর নেই এখানে। নিশাত ও শিমুল একে অপরের হাত চেপে ধরে অদূরে দাঁড়িয়ে আছে। শিমুল ওর কানে কানে বলল,’ আমার বিয়ের কথা বলছে না কেন, মামা? দুজনেরটা একসাথে ঠিক করলে ভালো হতো। দুই বান্ধবী একদিনে বউ সাজতাম রে। ‘
‘ সত্যি করে বল, আমার ভাইয়ের জন্য তুই পা-গল না-কি বউ সাজার জন্য? ‘
শিমুল স্পষ্ট স্বরে বলল,’ দুটোর জন্যই। মামা কি সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিছু জানিস?’
‘ আব্বার মনের কথা জানিনা রে। তবে বাড়িতে এতগুলো দিন সৌরভ ভাই ভালোই আন্দোলন করেছে। চেষ্টা করেছে আব্বাকে রাজি করাতে। সকালে সাহস করে আম্মা জিজ্ঞেস করেছিল, কিছুই বলে নি। ‘
শিমুল দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে সৌরভের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। জলভরা,অসহায় দৃষ্টি। সৌরভের মুখোমুখি থাকায় সেটা সৌরভ সহজেই দেখতে পায়। আব্বার পাশাপাশি বসে আছে সে। নির্ভয় স্বরে আব্বার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
‘ আমারটার কথা বলছেন না কেন,আব্বা? একসাথে দুইটার কথাই সেড়ে ফেলুন। ‘
রফিক আজম ছেলের দিকে চোখ পাকিয়ে চাইলেন। একেবারেই নিচু গলায় বললেন সৌরভকে,
‘ বোন জামাইটার মতো বেহায়া হইছো। ধৈর্য্য ধরো,বলমু। ‘
সৌরভ মৃদু হেসে সামনে তাকায়। এতগুলো দিন প্রহরের কথামতো কাজ করেছে সে। বলতে গেলে প্রহর আব্বাকে রাজি করানোর বিভিন্ন টেকনিক শিখিয়ে দিয়েছে তাকে। এই যেমন একদিন প্রহরের কথামতো সে আব্বাকে বলল,’ শিমুলকে বিয়ে করিয়ে আনলে আপনারই লাভ, আব্বা। শিমুলকে ওর ভাইরা অনেক ভালোবাসে। প্রহর নিশুরে একটা ধম-ক দেওয়ার আগেও বা আপনেরে কিছু কওয়ার আগে চিন্তা করব তার বোন আপনের বাড়িতে আছে বউ হয়ে। এতে বোনের ওপরে বাজে প্রভাব পড়বে। সেটা হিসেব করে আপনাকে আর কিছু বলবে না। ব্যাপারটা এমন হয়ে যাবে, এক হাতে দাও আরেক হাতে নাও। মানে সব সমান সমান। ‘
এরকম অনেক কথাই আব্বাকে বলে ইনিয়েবিনিয়ে এই বিয়েটার প্রতি রাজি করানোর চেষ্টা করেছে সে। রফিক আজম প্রহরকে ভয় পান। ছেলেটা না আবার বোনের জন্য ব্ল্যাক**মেইল করে বসেন উনাকে। তার চেয়ে ভালো ভালোই প্রস্তাব দিয়ে ভাগ্নিকে বাড়ির বউ করে নেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন আলতা ও উজ্জ্বল সাহেবকে উদ্দেশ্য করে,
‘ সৌরভ শিমুলকে পছন্দ করে। আমি চাইছিলাম, একসাথে এটারও কথা পাকা করে ফেলতে। যদি তোমরা রাজি হও তাহলেই। ‘
ঊষা এহেন কথা শুনে শিমুলের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। চোখে রাঙাল সে,
‘ এই কাণ্ড কবে ঘটিয়েছিস?’
‘ হয়ে গেছে বছরখানেক আপু। ‘
‘ তলে তলে সবগুলো প্রেম করেছিস।’
শিমুল মুখ একটু বাঁকা করে বলল,
‘ তুমিও তো করেছ ভাবি। ‘
‘ আমি কই করলাম! তোর লাফাঙ্গা ভাই অন্য মেয়েদের পেছনে পড়ে থাকত। প্রেম তো করছি বিয়ের পর। ‘
‘ আমার ভাইকে লাফাঙ্গা বললে তুমি?’
‘ হ্যাঁ, কোনো মেয়ের সাথে প্রেম না করতে পারলে জেদ ধরে থাকত জোর করে হলেও প্রেম করার। তো এসব ছেলেদের লাফাঙ্গাই বলে। ভাগ্যিস সঠিক সময়ে আমার জন্য ভালোবাসার ফুল ফুটেছিল। ‘
ঊষার কথা শুনে নিশাত ও শিমুল দুজনেই হাসতে লাগল আওয়াজবিহীন।
মোশতাক সাহেব নিষেধ করতে চাইলেন সৌরভের সাথে বিয়েটায়। কিন্তু ভাই ও ভাইয়ের বউয়ের জন্য পারলেন না। এ পরিবারের সাথে সম্পর্ক দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যাচ্ছেন উনি। সর্বক্ষণ বোনের কথা মনে পড়ে যায়, চোখে ভেসে ওঠে বোনের নিথর দেহের ওপরে ধবধবে সাদা চাদর দেওয়া মুহূর্তখানা। হাহাকার করে উঠল তাঁর অন্তর্দেশ নিমিষেই। রবিন আসে নি। সহ্যও করতে পারতেন না দেখলে। উজ্জ্বল সাহেব ও আলতা খুশিমনে সৌরভ ও শিমুলের ব্যাপারটায় সম্মতি দিয়ে দিলেন। তবে একসাথে অনুষ্ঠান হবে না। প্রহর ও প্রত্যয়েরটা হবে আপাতত৷ আর শিমুল কলেজে ভর্তি হবার পর বিয়ের তারিখ ঠিক করা হবে।
প্রহর মোবাইল চাপতে চাপতে এলো। বুয়ার নিয়ে আসা মিষ্টির প্লেট থেকে একটা মিষ্টি নিয়ে মুখে ঢোকাল। তৎপরে বলল,
‘ সব ঠিকঠাক। কিন্তু একটা কথা বাকি রয়ে গেল, শ্বশুরজান। ‘
উজ্জ্বল সাহেব কপাল কুঁচকে ছেলেকে প্রশ্ন করলেন,’ কী কথা,প্রহর?’
‘ যৌতুকের কথা। ‘
সাবলীল গলায় বলল প্রহর। তার কথা শুনে সকলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। নিশাত অবিশ্বাস্য চক্ষে তাকিয়ে রইল। রফিক আজম বললেন,
‘ কী চাও যৌতুকে?’
প্রহর ঘরের চতুর্দিকে চেয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,
‘ ফার্নিচার টার্নিচার সবই আছে। আমি ভিন্ন কিছু চাই, গভীর কিছু চাই,সুন্দর একটা স্মৃতি চাই। ‘
আলতা সরল কণ্ঠে বলল,’ স্পষ্ট করে বল প্রহর। ‘
প্রহর মোবাইলটা টি-টেবিলের ওপর রেখে রফিক আজমের সামনে এসে দাঁড়ায়। বলে,
‘ আমার ছোট একটা চাওয়া,মামুজান। আশা করি পূরণ করবেন। আমি চাই, আপনি আমাকে, প্রত্যয়কে, শিমুলকে একটাবার জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। মামার স্নেহের পরশ পাওয়ার ইচ্ছেটা আমাদের ভিতর অপূর্ণ হয়ে রয়ে গেছে। ‘
রফিক আজম বিলম্ব না করে বসা থেকে উঠে জড়িয়ে ধরলেন প্রহরকে। অহংকারের বরফটা গলে গেল বোধহয়। প্রত্যয়কে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। শিমুলের মাথায় হাত রাখতেই চোখে পানি চলে এলো উনার। লুকিয়ে ফেললেন খুবই সন্তর্পণে। তবে প্রহরের চক্ষু এড়ালো না। সে সবার অগোচরে নিশাতের হাত ধরে বলে,
‘ দ্যাখ,তোর বাপকে কাঁদিয়ে ছেড়েছি। ‘
নিশাত মনে মনে বলল,’ আপনি বেয়াদব হলেও ভালো মানুষ।’
_____________________
দিনটা শুক্রবার। বাল্যবিবাহ সম্পর্কে এক সমাবেশে অতিথি হিসেবে ডাকা হয়েছে কয়েকজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদকে। প্রহরের পাশাপাশি বিপক্ষ দল থেকে নেমন্তন্নে সমীরণও এসেছে। দুজন বসেছে পাশাপাশি। তাকে ডাকা হলো বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। সমীরণ বক্তৃতা দেওয়ার এক পর্যায়ে রহস্যময় হাসি হেসে বলে,
‘ আজ আমরা বাল্যবিবাহ রোধে এত উপদেশমূলক কথা বলছি। কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন, আপনারা কি জানেন আমাদের সদ্য হওয়া এমপি সাহেব প্রহর এজায বাল্যবিবাহ করেছেন? এমপিই যদি এমন করেন আমরা এসব মিছে বক্তৃতা দিয়ে কী লাভ? আমি চাই প্রহর এজায নিজে এ ব্যাপারে আমাদের কিছু বলুক। ‘
প্রহরের হাত মুঠো হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। রা-গে শক্ত হয়ে এলো চোয়াল।
#চলবে!
#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকা: আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব____৫৩
অনুষ্ঠানে মোটামুটি শোরগোল বেঁধে যায় সমীরণের মুখ থেকে নিঃসৃত কথার দরুন। সদ্য এমপি প্রহর এজাযের লুকায়িত বিবাহ নিয়ে কানাঘুঁষা, কলরবের মেলা শুরু হয়ে গেল ক্ষণিকের মাঝেই। বিরোধী দলের একজন তো দাঁড়িয়ে বলেই ফেললেন,” নিজে গোপনে বাল্যবিবাহ করে এখানে এসেছে বাল্যবিবাহ রোধ করতে। যে এমপি হয়ে নিষিদ্ধ কাজ করে তার এমপি হবার কোনো যোগ্যতা নেই। এমন এমপি আমরা চাই না। ”
লোকটার সাথে আরো ক’জন তাল মিলাতে লেগে পড়ল। এতকাল পর মোক্ষম সুযোগ মিলেছে মোশতাক সাহেব ও তার পরিবারকে জব্দ করার। সুবর্ণ সুযোগটুকু সমীরণ ও তার দলবল যেন হাত ছাড়া করতেই চাইছে না। মুহূর্তেই খানিক সময় আগের শান্তশিষ্ট, সুন্দর পরিবেশ পাল্টে হট্টগোল বেঁধে গেল প্রায়। বাল্যবিবাহ রোধের মতো ভালো এক সমাবেশে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ছড়িয়েছিটিয়ে পড়ল।
ঘাড় ঘুরিয়ে ঠোঁটের কোণে সুপ্ত হাসি এঁকে প্রহরের দিকে তাকায় সমীরণ। আগুনের ঘি ঢালার মতো কাজটা করে সে বলল,” আপনি কি এ ব্যাপারে কিছু বলতে চান এমপি সাহেব?”
প্রহর একমনে নিচের দিকে চেয়ে আছে। তার ভাবভঙ্গি বুঝার বা দেখার উপায় নেই। সে কি তবে লজ্জায় মাথা নিচু করে নিয়েছে? হবারই ছিল এটা। অন্তর্দেশে অনাবিল শান্তি বয়ে গেল তার। পরক্ষণেই সংকুচিত হয়ে আসে দৃষ্টি জোড়া।
প্রহর চেয়ার ছেড়ে ওঠে আসে। পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে সমুখে এসে দাঁড়ায় তার। চোখে চোখ রাখে। রোষকষায়িত দৃষ্টি। সমীরণ চমকায় না,একদম অবিচল সে। পলিটিক্স করতে গেলে প্রতিক্ষণে যেখানে জান নেই নেই হাল,সেখানে এই রক্তিম চাহনির পরোয়া সে করে না। গাঢ় চাউনি সেও নিবদ্ধ করে। ক্রোধানলে দগ্ধ চাহনিতেই চলছে করা-ঘাত। প্রহর স্মিত হাসে। ফিসফিস করে তার উদ্দেশ্যে বলে,
” যুদ্ধে যাওয়ার আগে রাজা বা রাজকুমার তলো-য়ার চালানোর শিক্ষা নিয়েই যায়, কিছু না জেনে বোকার মতো প্রাণের বিসর্জন দিতে যায় না। তেমন আপনারও লড়াই করার আগে শক্তপোক্ত তথ্য সংগ্রহ করে লড়াইয়ে নামা উচিত সমীরণ সাহেব। আপনার জন্য মডেলিং ব্যাপারটাই ঠিক আছে, এমপি আসনে আপনার মতো নির্বোধ মানুষকে শোভা পায় না। সেজন্য আসনটাও আপনার হয় নি। ব্যাড লাক, ভাই সাহেব। ”
সমীরণের চোখ র””ক্তবর্ণে ছেয়ে গেল। ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নির্নিমেষ। প্রহর গাল বাঁকিয়ে হাসল। ভ্রু নাচিয়ে এগিয়ে গেল মাইকের দিকে। সবার হৈ চৈ থামিয়ে দিয়ে ভারিক্কি স্বরে বলতে লাগল,
” আমার বউ ১৮ এর নিচে নয়। চাইলে তার বার্থ সার্টিফিকেট চেক করতে পারেন আপনারা। পারিবারিকভাবে হুট করে বিয়েটা হয়ে যাওয়ায় কাউকে বলা হয় নি। লাভ ম্যারেজ হওয়ায় বিষয়টা দ্রুতই ঘটে যায়। দুইদিন পরই আমার বিয়ের অনুষ্ঠান, আপনারা তখুনি জানতে পারতেন। তবে সমীরণ সাহেব যখন বিষয়টা খোলাসা করেই দিলেন, বেশ ভালো করেছেন। আপনারা আগেভাগেই জেনে গেলেন। ধন্যবাদ সমীরণ সাহেব। আমার তো বিয়ের কথা বলতে শরমই লাগছিল, আপনি আমার হয়ে বলে দিয়ে বড়ো উপকার করলেন। থ্যাংকস এ্যা লট। ”
সমীরণের দিকে চেয়ে হাসিমুখে ধন্যবাদ দিল প্রহর। লোকজন প্রায় হাসিমুখে করতালি দিতে লাগলেন। রাগে ফুঁসতে লাগল সমীরণ। প্রহর তাকে পার করে যাওয়ার সময়টায় পুনর্বার চাপা গলায় বলল,
” সত্যিই বিয়ে করেছি বলতে লজ্জা লাগছিল। এতদিনে তুই আমার জন্য ভালো কিছু করলি, কলিজা শান্তি করে দিলি। অনুষ্ঠান শেষে ট্রিট দেব তোকে এই খুশিতে। ”
সমীরণ দাঁতে দাঁত চেপে সবটা সহ্য করল। এখুনি নিজের ভুল স্বীকার না করলে সবাই তাকে চেপে ধরবে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বাঁধিয়ে অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য নষ্ট করতে চেয়েছিল বলে।
মাইক হাতে নিয়ে বলল,” সরি,আমার বোধহয় জানতে ভুল হয়ে গিয়েছিল। কোনো প্রকার দ্বন্দ্ব আনতে চাই নি এখানে। শুধু যা শুনেছিলাম সেটা ভুল মনে হওয়াই সমাজের চোখে সত্যটা খোলাসা করতে চেয়েছিলাম। ”
অনুষ্ঠান শেষে প্রহর গাড়ির কাছে সমীরণকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটুখানিও অবাক হলো না। দীর্ঘ শ্বাস টেনে নিয়ে কেমন নিশ্চিত সুরে বলল,
” আমি জানতাম, ট্রিটের জন্য তুই যাবি না। আমি কিন্তু ট্রিট হিসেবে হুইস্কি খাওয়াব না, চা খাওয়াব। ”
সমীরণ ক্রোধমিশ্রিত স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে,
” আসল কথায় আয়। তোর বউয়ের বয়স ১৮? মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে প্রহর এজায?”
বলেই বিশ্রী-ভাবে হো হো শব্দ করে হাসতে লাগল। প্রহর বলতে কৃপণতা করল না,
” ভীষণ কুৎসিত তোর হাসিটা। এভাবে জীবনেও বউয়ের সামনে হাসিস না। এক রাত্রিযাপন করা মেয়েগুলো অর্থ লোভে সহ্য করে গেলেও, জনম জনম পাশে থাকা বউটা এরকম হাসি শুনলেই পরের দিন পালিয়ে যাবে নিশ্চিত। তুই আমার খারাপ চাইতে পারিস,আমি পারি না। তাই তোর একটা খারাপ দিক ধরিয়ে দিলাম যেন তোর বউটা পালিয়ে না যায়। ”
সমীরণের মেজাজ গরম পানির ন্যায় টগবগ করে ফুটতে শুরু করল। বলল,
” কাম টু দ্যা পয়েন্ট প্রহর এজায। ”
” রিলেক্স, রিলেক্স। চায়ের আড্ডায় বলব সব। যতই হোক আমি আমার শত্রু**দেরও ভীষণ ভালোবাসি,তাদের সাথে ঠান্ডা মাথায় কথা বললে ভালো আলাপসালাপ হয়। আর মাথা ঠান্ডা রাখতে হলে অবশ্যই চা খাওয়া দরকার। শত্রুর সাথে বি–ষ না খেতে পারলেও,এক কাপ চা খেতেই পারি। ”
সমীরণ কাটাকাটা গলায় মর্জি দেয়,” ঠিক আছে। ”
সে প্রহরের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে চাইছে। একবার সাধারণ জনগণের মনে নেতার প্রতি ক্ষোভ চলে এলে নেতাকে আসন ছাড়তে বাধ্য করার জন্য তারাই যথেষ্ট। তনুজার জন্য বাবার স্নেহে আসন হারিয়েছে সে। নির্বাচনে লড়াই করার আগেই কাপুরুষের মতো পেছন হটতে হয়েছে সাপোর্ট,পাওয়ার কম থাকার জন্যে। কিন্তু একদিন না একদিন এই আসনে বসবেই সে। ভালোবাসা অন্যের হয়েছে, আসন অন্যের হয়েছে। সব কিছু নিজের করবে ও। ঊষা জীবন দিতে বললে সে নির্দ্বিধায় দিয়ে দেবে,কিন্তু বেঁচে থাকতে দু দণ্ড শান্তিতে থাকতে দেবে না প্রহর ও প্রত্যয়কে। এই পৃথিবীতে তার জন্য সব মিছে হয়ে গেলেও ঊষা সত্য। তার প্রতিটি হৃদস্পন্দন ঊষাকে দিন-রাত কাছে চায়,নিজের করে চায়,বুকের খুব কাছাকাছি চায়- এ সবকিছু সত্য, নির্মম সত্য। প্রহরের গাড়িতে ওঠে না সে৷ নিজের গাড়ি করে আসে।
সাঁঝের বেলা পেরিয়ে শর্বরের ছোঁয়া ধরণীতলে। টং দোকানের এক কোণে ঝুলছে টিমটিমে হলদেটে আলোকচ্ছটা ছড়ানো বাতি। দোকানির বারো বছর বয়সী ছেলেটা চা দিয়ে গেল ফটাফট। এমপি সাহেব তার ছোট দোকানে চা খেতে এসেছে বলে ছেলেকে তিনি এটা-সেটা দিতে বলছেন চায়ের সাথে খাওয়ার জন্য। প্রহর নিষেধ করে দিল কিছু দিতে। ছেলেটা দোকানের টোল টা বের করে দিল ওদের বসার জন্য। সমীরণ হাতের ঘড়ির দিকে দৃষ্টি ফেলে বলল,
” আমার শ্যুট আছে একটু পর, একটু আর্লি আড্ডা শেষ করলে ভালো হয়। ”
প্রহর চায়ে চুমুক দিল। চিবুকে তর্জনী রেখে চাপদাড়িতে খরখরে হওয়া গালে বুড়ো আঙ্গুল ঘষে ঠান্ডা মগজে তিরস্কার করল,
” শ্যুট না-কি ডেট? রুমডেট?”
সমীরণের রাগ ধরে গেল। প্রহর তাকে রাগে বদ উম্মাদ করতে চাইছে এটা ধরতে পারল সে অনায়সে। মেজাজ শান্ত রেখে থম ধরা গলায় জবাব দিল,
” রুমডেট ছেড়ে দিয়েছি। কারণ আমার সব ইচ্ছে, চাওয়া, অনুভূতি এক নারী কেড়ে নিয়েছে। এখন সর্বস্বান্ত আমি। অন্য নারীর দিকে তাকানোর মতো দৃষ্টিটাও সে ছিনিয়ে নিয়েছে তার ভালোবাসায় বিভোর করে। ”
প্রহর এ যাত্রায় অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকায়। বিনা বিস্ময়ে সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করে,
” প্রেমে পড়েছিস?”
সমীরণও সোজা পথটাই বেছে নেয়। কাষ্ঠ হাসিতে উত্তর দেয়,
” হ্যাঁ, তোর চাচাতো বোনের। ”
প্রহর মিছে হা-হুতাশ করে,
” উফ! তুই তো প্রেমের উষ্ণতায় পুড়ে যাবি। ”
” পুড়ছি অলরেডি। ”
” তোর প্রেম পিপাসা কোনোদিনও মিটবে না। ”
” জানি। ”
” তবুও ভালোবাসবি?”
” কী করব! মনকে ধরে রাখতে পারি না। তোর রাগ লাগছে না তোর বোনকে ভালোবাসি শুনে? ”
প্রহর চা রেখে সিগারেট ধরালো। এক টান দিয়ে ফুঁ দিয়ে বি**ষাক্ত ধোঁয়া মিশিয়ে দিল প্রকৃতিতে। শীতল স্বরে বলল,
” হাইপার হবো কেন? ঊষাকে নিয়ে আমার চিন্তা নেই। কারণ তুই ওকে ভালোবাসিস। আর যারা ভালোবাসে তারা তার ভালোবাসার মানুষের ক্ষতি হতে দেয় না, উল্টো নিরাপদ, অদৃশ্য বলয়ে রাখে মানুষটাকে সবসময়। ”
প্রহর পুনরায় বলল,
” তোর জীবনের মধুর অধ্যায়ের সাথে, ভয়ংকর কষ্টের অধ্যায় শুরু হয়ে গেল ভেবে পৈশা-চিক আনন্দ হচ্ছে।”
” মৃন্ময়ীকে কোথায় রেখেছিস?”
” আছে কোনো এক প্রান্তে। পৃথিবীতে কি জায়গার অভাব আছে?”
” তুই আর তনুজা মিলে ভাবছিস আমায় ধ্বং-স করে ফেলবি? ”
” তোকে আমরা কেন কষ্ট করে ধ্বংস করতে যাব? আমাদের আরো অনেক কাজ আছে। আমার এখনো বাচ্চার বাপ হওয়া বাকি। ধ্বংস তুই নিজের কারণেই নিজে হচ্ছিস। আমার বউয়ের গল্পটা বলি এবার।
ছোটবেলায়, তখন ওর বয়সটা পাঁচ হবে। গ্রামে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া দেখে তার শুরু হলো আবদার,সেও স্কুলে পড়বে। মেয়ে ভালো করে অ,আ শিখল না,অথচ স্কুলে পড়বে বলে আবদার। আমি সুযোগ পেয়ে থাপ্প**ড় টাপ্পড় দিলাম, মামি মা–রল কোনো লাভ হলো না। শেষমেশ জন্ম নিবন্ধন পরিবর্তন করা হলো। এক বছর বাড়িয়ে দেওয়া হলো। ক্লাস ওয়ানে দুই বছর রাখা হলো। সেদিন বউটা জেদ করেছিল বলে বার্থ সার্টিফিকেটে আজ বয়সটা ১৮। নয়তো রেজিস্ট্রি করতে পারতাম না। আমার বউকে বিয়ে করতে গেলি, কিন্তু সার্টিফিকেটের বয়সটার খোঁজই নিলি না। জীবনে চলতে গেলে শুধু খু—ন করলে হয় না, ভালো পয়েন্টগুলোও জেনে রাখতে হয়। তোর সাথে চায়ের ডেটটা স্মরণীয় থাকবে। আর হ্যাঁ দুদিন পর আমার আবার বিয়ে, বেঁচে থাকলে খুব শীগ্রই তোকে মামা ডাক শোনাব। ”
চায়ের টাকা মিটিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল প্রহর। সমীরণ রোষের তোড়ে দোকানের টোলটা লাথি মে-রে ফেলে দিল। সবকিছুর একটা বিহিত সে করবেই। এই বিহিতে কেবল ঊষাকেই সেফ রাখতে হবে তার। ঊষার কিছু হলে এই পৃথিবীতে নিঃশ্বাস ফেলতে সে নিজেই ভুলে যাবে।
_____________________
বিয়ে নিয়ে শুরু হয়ে গেল দুই পরিবারে ভাগাভাগি। নিশাত ও প্রহরের নয়, প্রত্যয় ও ঊষার বিয়ে নিয়ে। কথা হলো, ঊষা ও প্রত্যয় একই বাড়ি থাকায় প্রত্যয় বরযাত্রী হয়ে যাবে কোথায়। তখন বড়োদের আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো ঊষাকে মজুমদার বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে নিশাতের কাছে। প্রত্যয় ও প্রহর দুজনেই বরযাত্রী হয়ে সেখানে যাবে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে বেঁকে বসল প্রত্যয়। সে কিছুতেই বউকে আলাদা কোথাও দেবে না। এক বাড়িতে বরযাত্রী হলে কি সমস্যা! শিমুল চোখমুখ কুঁচকে বলে,
” কেমনে কী ছোটো ভাইয়া? আমরা প্রহর ভাইয়ের বরযাত্রী হয়ে মামুর বাড়িতে যাব না-কি এখানে তোমার বরযাত্রী সেজে বসে থাকব? এমন হলে একদিনে বিয়ে দুটো রাখার কি দরকার ছিল? বরং তোমার অনুষ্ঠানটা ক্যান্সেল করে দিলেই হয়। দরকার নেই তোমার অনুষ্ঠানের। ”
প্রত্যয় দিশেহারা হয়ে বলে,
” তাহলে বিয়ের দিন সকালে ওই বাড়ি চলে যাবে ঊষা। ”
শিমুল চাপাস্বরে শুধায় তখুনি,
” তুমি এত বউ পাগল কবে হলে ভাইয়া? দুইটা দিনের ব্যাপার। তারপর বউকে নিয়েই আসবে। কেউ খেয়ে ফেলবে না তোমার বউকে। ”
” হলুদ টলুদের কী দরকার? বিয়ের দিন গিয়ে লাল বেনারসি পরে চলে আসবে,ব্যাস। ”
” হতে পারে তোমাদের কাছে ব্যাস,কিন্তু আমাদের কাছে না। আর আমি আমার দুই ভাবিকে সব সাজে দেখব, সব অনুষ্ঠান করব। এত বউ বউ করিয়ো না। প্রহর ভাই তো করে না। ”
শেষমেশ পরাজিত হয়ে ঊষাকে মজুমদার বাড়ি যেতে দেয় প্রত্যয়। কিন্তু এখানে আরেক ঘটনা ঘটে গেল। আলতা,শিমুলও চলে গেল মজুমদার বাড়ি কনেপক্ষ হতে। প্রহর, প্রত্যয়,মোশতাক সাহেব,উজ্জ্বল সাহেবই কেবল বরযাত্রী হিসেবে স্মরণিকা নিবাসে রয়ে গেলেন। আজ নিশাত ও ঊষার মেহেদি, হলুদ রাত্রি দুটোই একসাথে। শিমুল নিশাতের ঘরে সবুজ রঙের লেহেঙ্গা ও ফুল রেখে যায়। ঊষাকে সাজিয়ে পার্লারের মেয়েগুলো নিশাতকে সাজাবে। সে গোলাপি একটা লেহেঙ্গা পরে সৌরভের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। সবে সোনালি রঙের পাঞ্জাবিটা পরে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখছে সৌরভ। তার পেছনে একটা মেয়েলি প্রতিবিম্ব আয়নায় ভেসে ওঠতেই ঝটপট চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। শিমুল অবাক হয়ে যায়।
” চোখ বন্ধ করলেন কেন?”
” তোর দিকে একটু গভীরভাবে তাকাতে ইচ্ছে করছে। আর গভীরভাবে তাকালে আমি অঘটন ঘটিয়ে ফেলব। ”
শিমুল সবিস্ময়ে আবারো প্রশ্ন করল,
” কেমন অঘটন? এগুলো কেমন আবোলতাবোল কথা? চোখ খুলুন। ”
জোর গলায় বলল শিমুল। তার অন্যদিকে খেয়াল নেই। সে সৌরভকে সাজ দেখাতে এসেছে। এসেছে প্রিয়তমের থেকে প্রশংসা কুড়িয়ে নিতে। সৌরভ তার দিকে ফিরে চোখ খুলল। কোমর ধরে কাছে টেনে নিল এক ঝটকায়। টুপ করে খুবই আলতোভাবে ওষ্ঠাধরে ওষ্ঠ ছুঁয়ে অপরিমেয় গাঢ় স্বরে বলল,
” ঘটিয়ে ফেললাম অঘটন। ”
শিমুলের দমে টান পড়ল। স্নায়ু টান টান। বুক ধড়ফড় করতে শুরু করে। এগুলো সহজে হজম করতে পারে না সে। প্রেমে পড়ার আগে এসব তো ভাবে নি। বিড়বিড় করে বলল,
” এত চুমুটুমু খাবেন না, শরম লাগে। ”
সৌরভ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে বুকের মাঝে। কোমল শরীরটায় ব্যথা শুরু হয়ে যায় পুরুষালি শক্ত ছোঁয়ায়। মানুষটা কি ওকে জড়িয়ে ধরে নিঃশেষ করে দেবে আজ?
__________________
প্রত্যয় মইটা নিশাতের বারান্দা বরাবর রেখে বলল,
” ভাই, ওঠে যাও। তারপর আমি উঠব, নিশুর ঘর দিয়ে ঊষার কাছে যাব। ”
” মই দিয়ে কেন যাব? আমি ওর বর, দরজা দিয়ে সসম্মানে যাব আমি। ”
প্রহরের কথায় প্রত্যয় জবাব দিল,
” কিন্তু আমাদের দাওয়াত দেয় নি ভাই। শিমুল, মা দেখলে বলবে বউয়ের পেছনে ছুটে এসেছি। ”
” কথা কোনদিক থেকে ভুল? আর আমার শ্বশুর বাড়িতে দাওয়াত লাগবে না আমার। ব্যাগ দে। ”
প্রহরের পিছু পিছু প্রত্যয়ও বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। কেউ ওদের খেয়াল করল না। বাড়ির আনাচে-কানাচে অতিথিদের সমাগম। একমাত্র মেয়ের বিয়ের জন্য রফিক আজম ও মোশতাক সাহেব অনেক বড়োসড়ো আয়োজন করেছেন। গ্রামের কোনো ঘরই বাদ রাখেন নি নিমন্ত্রণ করার। কারো নজর ওদের দিকে না এলেও একেবারে সামনে পড়ল সৌরভের। সে সহাস্যে বলল,
” আপনাদের হলুদ অনুষ্ঠানের আয়োজন এখানে করা হয় নি। ”
প্রহর দ্বিধাহীনভাবে স্বীকার করল,
” আমরা আমাদের বউদের দেখতে এসেছি। ”
” কিন্তু আপনাদের বউদের আগামীকাল নিতে আসার কথা। ”
” আগামীকাল নিয়ে যাব,এখন দেখতে এসেছি। ”
” কিন্তু অনুমতি নেই। ”
প্রহর উগ্র চোখে দেখল। বলল,
” তোরটা কাছে আছে বলে, আমাদের সাথে ভাব নিচ্ছিস? আর একটা শব্দ বললে শিমুলকে সাথে নিয়ে চলে যাব। তখন মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকিস। ”
সৌরভ রাস্তা ছেড়ে দিল। প্রহরের প্রশ্ন এলো কানে,
” আমার বউয়ের ঘরে মানুষ আছে?”
” না। শুধু তোর বউ আছে। তার বেশি ঘুমানোর অভ্যাস। গতকাল থেকে ঠিকঠাক ঘুমাতে পারে নি বলে মাথা ব্যথা। তাই ভিড় জমাচ্ছে না কেউ। ”
কিছুটা রুষ্ট মুখে বলল সৌরভ। প্রহর ফের প্রশ্ন করল,
” ও কি মাথা ব্যথার ঔষধ নিয়েছে?”
” নিয়েছে। ”
প্রত্যয় ও সৌরভকে রেখে নিশাতের রুমে ঢুকে ফটাফট দরজা আটকে দেয় প্রহর। নিশাত মাত্র বারান্দায় গিয়েছিল। হুট করে আওয়াজ পেয়ে ঘরে এসে প্রহরকে দেখে ফরফর করে উচ্চারণ করে,” আপনি?”
” চমকাচ্ছিস কেন? এদিকে আয়। ”
নিশাত এগিয়ে আসতেই প্রহর ব্যাগ বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
” এখানে শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট আছে। ব্লাউজ আর পেটিকোট পরে আয় ওয়াশরুম থেকে। তোকে শাড়ি পরিয়ে দিয়ে চলে যেতে হবে জলদি। ”
বলে প্রহর চেয়ার টেনে বসল। নিশাতের অবস্থা বেগতিক হয়ে পড়ল। মানুষটা তাকে শাড়ি পরাবে, মানে! বিয়ের আগের দিন লজ্জায় ম–রেটরে গেলে সে? শুকনো ঢোক গিলে বলল,
” লেহেঙ্গা পরতে বলেছে ফুপু আম্মা। শাড়ি কেন? ”
” লেহেঙ্গাটা আমিই কিনেছিলাম। কিন্তু আমার মতামত পরিবর্তন হয়েছে এখন। আমি চাই তুই শাড়ি পর এবং সেটা আমার হাতে। ”
” আমি পরতে পারি শাড়ি। ”
প্রহর কড়া চোখে তাকাল। ধমকে উঠল,
” তোকে জিজ্ঞেস করেছি আমি? ”
” না। ”
ধম–কের তোপের মুখে পড়ে সুড়সুড় করে নিশাত ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। ব্লাউজ ও পেটিকোট পরে হলুদ সিল্কের শাড়িটা গায়ে পেচিয়ে বের হয় কোনোরকম ভণিতা না করে। তবে বুকটা প্রচন্ড ঢিপঢিপ করছে তার। মাথা নত করে রাখে। শরীর শিরশির করছে।
প্রহর এগিয়ে এসে শাড়ি টেনে ধরতেই বুকের ভেতর উদ্বেল ঢেউ শুরু হয়ে যায়। একবার মাথা তুলে তাকায়। আটক পড়ে যায় নেশাড়ু চোখের চাহনিতে। পাগলা ষাঁড়ের মতোন ছুটতে আরম্ভ করে হৃদস্পন্দন। সমস্ত দেহে চলতে থাকল কম্পনের খেলা। হাত-পাও কেমন নড়চড় করছে।
প্রহর শাড়ির আঁচল বুকে ছড়িয়ে দিয়ে নিশাতের জন্য সর্ব–নাশ বয়ে আনা কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
” ছটফট করছিস কেন সুইটহার্ট? ”
নিশাতের ভিতরকার অস্থিরতা আরো তীব্র হয়ে যায়। প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে সে,
” আপনি শাড়ি পরাতে পারেন?”
” তোর মতোন অকর্মণ্য আমি? ”
সবসময় উল্টোপাল্টা কথা। নিশাত আর জবাব দেয় না। প্রহর ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে। পেটের কাছে কুচিগুলো ধরে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ে। সেই নিঃশ্বাসের অঘোষিত ছোঁয়ায় শ্বাস-প্রশ্বাস প্রায় থমকে যাওয়ার উপক্রম নিশাতের।
উন্মুক্ত পেটের দিকে পল-অনুপল চেয়ে থেকে প্রহর কুঁচিগুলো গুজে দিল। তৎপরে পেটে ঠোঁটজোড়া ছুঁয়ে দেয় গভীরভাবে। নিজেকে বহু কষ্টে দমিয়ে বলে,
” অস্থির হোস না জান। শুধু শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছি, আজ অন্য কিচ্ছু করব না,প্রমিজ। ”
#চলবে!