#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকা: আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৫৪
‘ তোর জন্য লেহেঙ্গা তুই নিজেই নিলি। রাতে আবার মতামত পাল্টে শাড়ি পরলি কেন?’
নিশাত সবে মুখ ধুয়ে টেবিলে এসে খেতে বসেছে। স্বইচ্ছায় এসেছে বললে ভুল হবে,রোকেয়া টেনে বসিয়ে দিয়ে গেছেন তাকে। গোলাকার দেখতে একখানা প্লেটে খিচুড়ি ও গরুর মাংসের ঝোলও দিয়ে গেলেন খাওয়ার জন্য। খিচুড়ি থেকে
গরম ভাপা ধোঁয়া ওড়ছে শূণ্যে। নিশাত ঘুমে আবিষ্ট অস্পষ্ট চোখে সেদিকে চেয়ে জবাবে মিথ্যা বলল আড়ষ্ট কণ্ঠে,
‘ হুট করেই মনটা পরিবর্তন হয়ে গেল। মনে হলো শাড়ি পরলে সুন্দর লাগবে বেশি। লেহেঙ্গাতে বাচ্চা বাচ্চা লাগছিল আমায়। ‘
শিমুল দমল না। বিশ্বাস করল না তার কথায়। চেয়ারের ওপর দু পা তুলে বসল। অবিশ্বাসের সুরে বলল,
‘ তোর জবাবে রসকষ নেই রে নিশু। পানসে পানসে। একদম মিথ্যা বললে যেমন হয়। ‘
নিশাত লালচে মেহেদিতে রাঙানো ডান হাতটা আর খিচুড়িতে বাড়ায় না। খাবার ঘরের দেয়াল ঘড়িটার দিকে কিছু পল চেয়ে রয়। সাড়ে সাতটা বাজছে। বিয়ে বাড়ি হবার কারণে ঘুমটুম বিদায় জানিয়ে দিয়েছে দিনের একেবারে প্রাতঃকালে। গায়ে হলুদ ও মেহেদি অনুষ্ঠান দুটো একত্রে হওয়ায় বেশ দেরি করেই সমাপ্ত হয়েছে। প্রায় রাতের শেষভাগে। নিশাত হলুদের শাড়িটা আর না পাল্টে ঘুমে ঢলে পড়ে বিছানায় সকল সাজসজ্জা নিয়েই। বাথরুমে পর্যন্ত ঘুমিয়ে যাওয়া মেয়েটা আজ বিয়ের জন্য নির্ঘুম রাত পার করতে হচ্ছে, সাথে অপেক্ষাও সইছে না। বুকের ভেতর মধুর একটা অনুভূতি ঘাপটি মে-রে বসে আছে। কখন সেই ঘাড়ত্যাড়া মানুষটাকে বর সাজে দেখবে সেই অনুভূতিটুকু। ভবিষ্যতের দৃশ্য কল্পনা করে করে ঘুম আর চোখে আসে না। ঘুমন্তপরী মুহূর্তেই হয়ে উঠল স্বপ্নপরী। এখন তার চিন্তা হলো শিমুলকে কীভাবে বলবে তার ভাই শাড়ি পরিয়ে দিয়ে গেছে? শত হোক আপন বড়ো ভাই তার। ভাইয়ের করা এই লজ্জাজনক ব্যাপারখানা বোনকে বলা কি উচিত হবে? উঁহু, অনেক লজ্জা-শরমের কথা এসব। নিশাত বলবে না। সবসময়কার মতো মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘ মিথ্যা বলি নি। মিথ্যা কেন বলব?’
মুখ ঘুরিয়ে খিচুড়িতে চামচ নাড়াতে লাগল শিমুল। অভিমানী গলায় বলল,
‘ ভেবে রেখেছিলাম আমার বিয়ে হলে এ টু জেট রোমান্স হতে শুরু করে তোকে সব বলব। কারণ তুই-ই আমার একমাত্র বান্ধবী। আমার খুব শখ ছিল বান্ধবীকে সব শেয়ার করার। এখন দেখি যাকে আমি আমার লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে গোপন কথা শেয়ার করব ভাবছিলাম, সে আমাকে স্রেফ গায়ে হলুদের শাড়িটা বর দিয়ে গেছে সেটাই বলতে চায় না। আই হেট ইউ নিশু। ‘
নিশাত চমকিত চোখে তাকাল,’ তোকে কে বলল উনি দিয়ে গেছে? ‘
শিমুল ফোঁস ফোঁস করে বলল,’ শুধু দিয়ে গেছে? শাড়িটা পর্যন্ত পরিয়ে দিয়ে গেল ভাইয়া তোকে। সবার চোখে ছানি পড়ে থাকলেও, আমার চোখে পড়ে নি। আমি দেখেছি ভাইয়াকে তোর ঘরে ঢুকতে,তারপরই তোর গায়ে শাড়ি। তাহলে বুঝার আর কি বাকি থাকে? তোর অনেক বুঝ হয়ে গেছে না? তুই আমার থেকে কথা লুকিয়ে ফেললি। ‘
‘ ভুল বুঝতেছিস তুই। আসলে তোর ভাই হয়, বড়ো ভাইয়ের রোমান্সের কথা শুনতে তোর লজ্জা লাগবে না?’
নিশাতের কথায় চোখ বড়ো বড়ো করে মুখে হাত দিল শিমুল। চমকানোর অভিনয় করে বলল,
‘ ওহ-হো, চালা হয়ে গেল ভাইয়ার গাধী রানি, তিলবতী। কিন্তু আমার যে রোমান্সের কথা শুনতে ভালো লাগে? আমি না হয় ভাইয়াকে আমার দুলাভাই ধরে নেব,আর তুই আমার প্রাণের বান্ধবী ও মামাতো বোন। তাহলে শুনতে লজ্জা লাগবে না। ‘
নিশাত ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া গলায় বলল,’ তুইও নির্লজ্জ হয়ে গেছিস। ‘
ভেংচি কাটল শিমুল,’ হলে হয়েছি। ভাবি হয়ে জল
ঢেলে দিলি বান্ধবী ও তার বরের বাসর রাতের রোমান্স শোনার তীব্র ইচ্ছেটায়। তোর মতো বান্ধবী শত্রু–রও না হোক। ‘
শিমুলের এ কথায় প্রচন্ড হাসি পেয়ে গেল নিশাতের। শিমুল সেই হাসি দেখে নিজেও তৃপ্তিদায়ক হাসি হাসে। নিশাতের নরম,চিকন হাত দুটি করপুটে আগলে ধরে বলে,
‘ ভাইয়া তোকে অনেক চায় নিশু। আমরা বয়সে এক হলেও তোর জ্ঞান-বুদ্ধি,উপলব্ধি আমাদের থেকে কম সেটা সবাই জানি। বড্ড সহজ-সরল তুই। একদম ভোরে ঝরে পড়া স্নিগ্ধ শিউলির মতো। বয়স বাড়তে থাকলেও, দৈহিকভাবে তুই বাড়লেও মন থেকে ছোটই ছিলি, অবুঝ ছিলি। তাই ভাইয়া হয়তো তোকে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পিছিয়ে যেত বার বার। সারাক্ষণ বলত তুই বেক্কল। ভাইয়া নিজ মুখে কখনো তোকে ভালোবাসি না বললেও তোর প্রতি ভাইয়ার কাজ,আচরণ সব আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিত তোকে কতটা চায়। ভাইয়া মানুষটা একটু জটিল, ত্যাড়া কিন্তু তোকে ভীষণ ভালোবাসে। তুইও আমার ভাইকে খুব ভালোবাসিস নিশু। অনেক বেশি ভালোবাসা দিস। আগলে রাখিস। ‘
নিশাত একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল শিমুলের পানে। কি সুন্দর করে গুছিয়ে কথাগুলো বলল শিমুল! আসলেই সে বেক্কল। শিমুলের মতোন অত সুন্দর করে কথা বলতে পারে না, ভাইয়ের জন্য ভালোবাসা চাইতে পারে না, মহা মুশকিল সময়টাইও ভাইয়ের পাশে তেমন দাঁড়াতে পারি নি। ভাইয়া পিংকিকে ভালোবেসে ধোঁকা খাওয়ার পর টের পেল সে যদি নির্বোধ, বোকা না হতো তাহলে শুরুতেই বুঝে যেত। কষ্ট পেতে দিত না ভাইকে, টেনেহিঁচড়ে পিংকির মুখোশ খুলে দিয়ে বলত, ‘মেয়েটা শুধু নিজের স্বার্থ বুঝে ভাইয়া, ভালো টালো এই মেয়ে বাসতে জানে না। ‘
যদি বুঝদার হতো তবে শিমুলের হৃদয়ের কুঠুরিতে বছর ধরে লালন করা ভালোবাসার সন্ধান পেয়ে যেত। ভাইকে তখন বলত,’ তুমি শিমুলকে ভালোবাসো ভাইয়া, তোমার সামনে সকল সুখ বিছিয়ে দিতে পারবে মেয়েটা। জানো তো, যারা ভালোবাসে তারা মুঠোভর্তি সুখ উপহার দেয়,দুঃখ নয়। ‘ কিন্তু সে বুঝে নি,বলতে পারে নি, উপলব্ধি করে নি চোখের সম্মুখে হররোজ ফুলের মতো ভালোবাসা সাজিয়ে রেখে ইশারায় বলা প্রহরের কথাগুলো। কত কি কথায়, ইশারায় লোকটা সর্বদা বলে বেড়াত, ‘ ভালোবাসা সাজিয়ে রেখেছি, যতপারিস কুড়িয়ে আঁজলায় ভরে নে। ‘ এসব কিছুই ও বুঝে নি, কিচ্ছু না। তবে নিশাত এখন বুঝতে শিখেছে, সরলতার চাদর মনের ওপর থেকে ফেলে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। শিশু যেমন নড়বড়ে গুটি গুটি পায়ে হাঁটা শিখে যায়,তেমনি করে নিশাতও শিখছে সবকিছু কীভাবে বুঝে নেওয়া যায়,বাস্তবতা কেমন করে চিনতে হয় আর হৃদয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করা মানুষটাকে কীভাবে কীভাবে রঙিন ভালোবাসায় রাঙানো যায়।
ওদের কথাবার্তার মাঝে পিংকি এসে হাজির হলো। প্রথমে চেয়ারে বসে এক গ্লাস পানি পান করে একটা সূক্ষ্ম নিঃশ্বাস ছেড়ে ঘুরে বসল নিশাতের দিক। বলল,
‘ তোর সাথে আমার কথা আছে। ‘
নিশাতের বাম সাইডে বসা শিমুল কপালে ভাঁজ ফেলে, সন্দেহযুক্ত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে মা–রে তার দিকে,
‘ কী কথা? নিশু শুনবে না তোর কোনো কথা। ‘
পিংকি ক্ষেপাটে ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
‘ এটা ওর আর আমার ব্যাপার। কথাগুলো ওর শোনা উচিত। ‘
‘ কী কথা আমায় বল?’
এবারও তেজী গলায় বলল শিমুল। পিংকিও একই সুরে উত্তর দিল,
‘ তোর শোনার সময় হয় নি,এসব কেবল বিবাহিত মেয়েদের কথা। তোর বিয়ে হলে তখন তুই শুনিস,এখন কি তোর বিয়ে হচ্ছে? ‘
পিংকির ভর্ৎসনা বুঝতে অতিরিক্ত প্রয়াস করতে হলো না শিমুলের। সে যে সৌরভ ও তার বিয়েটা এখন হচ্ছে না বলে তিরস্কার করল, কথাটা ও বুঝল ঠিক ঠিক। প্রদীপের লেলিহান শিখার ন্যায় তেজীয়ান হয়ে বলল,
‘ ওই দ্যাখ,তোর ভ্যাবলা বর খুঁজছে তোকে। যা,যা। নিশাতকে তোর বিবাহ পরামর্শ দিতে হইব না। ভ্যাবলা বরের কাছে যা। ‘
পিংকি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে হাতে একটা আপেল নিয়ে সত্যিই সন্ধানী দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে কারিম। সরাসরি চোখ চোখ পড়ে যাওয়ায় ডাকলও তাকে। সে বিরক্তি মাখা বদনে শিমুলের দিকে তাকিয়ে চলে গেল ধীরে ধীরে। যাওয়ার আগে এটাও বলে গেল,’ পরে কথা বলব নিশুর সাথে। ‘
শিমুল অলক্ষ্যে-অগোচরে তাচ্ছিল্যের স্বরে তারই কথাটার নকল করল খুবই বিচ্ছিরিভাবে। নিশাতকে হু–মকি দিল,
‘ ওই কুটনির সাথে তুই কথা বললে,আমার তোর সাথে এক সপ্তাহ কথা বন্ধ থাকব কইয়া দিলাম। ‘
নিশাতের সেদিকে মনোযোগ নেই। তার সম্পূর্ণ ধ্যান কারিমের পিংকির বাহু জড়িয়ে ধরে উপরে নিয়ে যাওয়ার ওপর। শিমুল সেটা আচ করতে পেরে জিজ্ঞেস করে,
‘ ওদের অমন খুঁটিয়ে কী দেখছিস?’
নিশাত ন্যাতানো স্বরে বলে, ‘ যারা অন্যের সাথে খারাপ করে,তারা কিন্তু বিনিময়ে খারাপ পায় না। পিংকিকে দিয়েই দ্যাখ, সৌরভ ভাইয়াকে ঠকিয়েও যত্নশীল, প্রচন্ড ভালোবাসে এমন একটা মানুষ পেয়ে গেল জীবনে। ‘
‘ তুই কি ওর খারাপ কামনা করছিস?’
‘ মোটেও না। আম্মা বলেছে, একজন খারাপ করলে,তার খারাপ চাইতে নেই। শুধু মাঝে মাঝে পিংকির প্রতি ঘৃ*ণা চলে আসে। আমার ভাইকে কেন ঠকাতে হলো?’
‘ তোর ভাইকে আমি পাব বলে। সে না ঠকালে তোর ভাই আমার কথা ভাবত না, আমায় ভালোবাসত না। আমার ভালোবাসা পাবে বলেই হয়তো মিথ্যা ভালোবাসার জাল থেকে বেরিয়ে এলো সে। ‘
‘ হ্যাঁ। উত্তম কিছু পাবে বলেই ভাইয়ার এতটুকু দুঃখ সহ্য করতে হয়েছে। ধন্যবাদ শিমুল,আমার ভাইয়ার জীবনে আসার জন্য। তার দুঃখগুলো ধুয়েমুছে দেওয়ার জন্য। ‘
‘ হয়েছে, এত ধনেপাতা দিতে হবে না ওকে। ওদের বাড়িতে ধনেপাতা আছে অনেক। ‘
ভারি, মোটা কণ্ঠ শুনে নিশাত ঘাড় বাঁকিয়ে সৌরভকে দেখে মুচকি হাসল। শিমুল চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘ আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে দেখে,হিং-সে হচ্ছে আপনের?’
‘ হিংসে আর তোকে? পিচ্চি মেয়েদের প্রতি আমি কি নিয়ে হিং-সে করব! নিশু আয় তোকে খাইয়ে দিই। মেহেদি রাঙা সুন্দর হাত দুটো গুটিয়ে রাখ আজ। ‘
বলেই প্লেট টেনে নেয় সৌরভ। রাত থেকে মনটা আনচান করছে তার। বোনের জন্য মায়া লাগছে ভীষণ। সারাক্ষণ চোখের সামনে থাকা আদুরে বোনটার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। গ্রামে থাকলেও প্রতিদিন না হয় একবার করে দেখে আসত স্মরণিকা নিবাসে গিয়ে কিন্তু প্রহর এমপি হওয়ায় গ্রামে পড়ে থাকতে পারবে না। রোজ বহু কাজ থাকে তার,মিটিং থাকে। নিশাতকে সঙ্গে করে ঢাকার বাড়িতেই নিয়ে যাবে বিয়ের দু-একদিন পর।
নিশাত মুখে লোকমা পুরে নিয়ে ইশারায় কিছু একটা বলল ভাইকে। সৌরভ গাল ফুলিয়ে রাখা শিমুলের দিকে এক লোকমা বাড়িয়ে দিয়ে কড়া গলায় আদেশ করল,
‘ হা কর। ‘
শিমুলের তখন চট করে বুকটা কেমন জানি করতে শুরু করল। তোলপাড় শুরু হলো সেথায়। সৌরভের হাতে কীভাবে খাবে সে? অনিষিদ্ধ এক লজ্জা শুকনো পাতার ন্যায় পতপত করে উড়ে এসে মনের ঘরে বসতি স্থাপন করে ফেলল তৎক্ষনাৎ। তবুও সৌরভের চোখ রাঙানিতে পুরে নিল খাবারটা মুখে। গলায় আটকে গেল সম্পূর্ণ খাবার। চোখে জমে গেল নোনতা জল। সৌরভ প্লেট রেখে এগিয়ে এসে পানির গ্লাস তুলে দিল হাতে। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করল,
‘ গলা জ্বলছে? আমি কি ঠিকভাবে খাওয়াতে পারি নি? তোর কি কষ্ট হচ্ছে? ‘
সৌরভের উদ্বিগ্নতায় শিমুল আস্তে করে জবাব দিল,
‘ হু,ঠিক আছি। আপনে নিশুরে খাওয়ান।’
নিশাত বিমুগ্ধ নয়নে ভাই ও শিমুলের ভালোবাসার সুন্দর একটি দৃশ্য অবলোকন করে ফেলল। সৌরভের ফোনটা বেজে ওঠলে সে মোবাইল বের করে তার হাতে দিয়ে বলে,
‘ নে,তোর বর ফোন করেছে। এজন্য এসেছিলাম, এসে বলতেই ভুলে গেলাম। কথা বল। ‘
নিশাত মোবাইলটা নিয়ে খাবার ঘর থেকে বেরিয়ে ছোট ফুপুর ঘরে এলো। এই ঘরটায় নীরবতার খেলা চলছে,বাকিসব ঘর গিজগিজ করছে অতিথিতে। সে হ্যালো বলবার আগে অপরপাশের পুরুষালী স্বরটা অসহিষ্ণু গলায় বলল,
‘ আমার ঘুম হয় না আর তুই নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছিস?’
নিশাত জানতে চাইল,’ আপনার ঘুম হয় না কেন?’
‘ সারারাত ঘুমাতে পারি নি আমি। বার বার মনে হয়েছে তুই বউ সেজে আমার পাশে বসে আছিস, আর আমি তোকে আদর না করে ঘুমিয়ে যাচ্ছি। এটা তোর প্রতি চরম অন্যায় না? তাই ঘুমটা আর হলো না তোর কথা ভেবে। ‘
নিশাত এ কথার পৃষ্ঠে কিছু বলার সাহস পেল না। একটা বর্ণও উচ্চারণ করতে পারল না। কলটা কে–টে দিল চট করে। এসব কথার পিঠে কথা হয় না-কি? এসব কথা কেবলই পারে একটা কাজ করতে এবং তা হলো, হৃৎপিণ্ডের গতি নিয়ন্ত্রণহারা করে দিতে।
_________________________
বিয়ের অনুষ্ঠানে নিশাতের নিজের জন্য মন খারাপ হলো। প্রহরকে সাদা পাঞ্জাবির ওপর লাল শেরওয়ানি ও মাথায় পাগড়ি পরিহিত দেখে রূপকথার রাজকুমার মনে হচ্ছিল নিশাতের। আর নিজেকে লাগছিল রাজকুমারের পাশে কাঠকুড়ানি। এমনটা ভাবনার হেতু হলো, প্রহরকে সত্যিই তার থেকে বেশি সুন্দর লাগছিল। সকলে প্রশংসা করছিল খুব। স্কুলে একসাথে পড়া কিছু মেয়ে কানে কানে ফিসফিস করে বলেছে,’ নিশু তোর কি ভাগ্য রে! এত সুন্দর বর, তা-ও কিনা এমপি প্রহর এজায! কপাল তোর। সামান্য একজন হয়ে উনাকে পেয়ে গেলি শুধুমাত্র মামাতো বোন হওয়ায়। ‘
কথাগুলো শুনে প্রহরকে নিয়ে বেশ হিংসা হচ্ছিল ওর। সে শুনেছে পুরুষ লোককে বিয়ের দিন বেক্কল বেক্কল লাগে, কিন্তু এই লোকটাকেই কেন এত সুন্দর দেখাচ্ছে! কেন! এই কেন-র জবাব কোথাও পেল না সে। বিদায়ের সময়টায় পিংকি কাছে এসে কিছু শলাপরামর্শ দিল ওকে। নিশাতের মনে হলো মেয়েটা উলটো ভ-য় ঢুকিয়ে দিয়েছে ওর মনে। সাথে কিসব ঔষধও দিয়ে দিল! এসব হবে জানে কিন্তু সে এই অনুভূতি, একান্ত মুহূর্তগুলোকে ভয় ভয় হিসেবে নেয় নি কখনো। হয়তো পরিপূর্ণভাবে জানত না বলে ভয়টাও মনে প্রবেশের সুযোগ পায় নি। ঔষধগুলো কাঁপা কাঁপা হাতে সে হাতের ছোট্ট পার্সটায় ঢুকিয়ে রাখল। কম্পনরত কণ্ঠে প্রশ্ন করল পিংকিকে,
‘ এসব কেন খেতে হবে?’
পিংকি বিরক্ত মুখে বলল,
‘ শরীর ব্যথা করলে খাবি। শরীর কাল সকালে ব্যথা করব এটা একেবারে শিউর। আমার বেলায় কেউ পরামর্শ দিল না, কত কষ্ট পাইছি জানিস? পরের দিন সকালেই ডাক্তার আনল কারিম। বেক্কলটা অনেক ভয় পাইছিল আমার কান্না দেখে। তোর কত ভাগ্য, আমি তোরে পরামর্শ দিতেছি, কষ্ট হইব একটু আধটু,এই আরকি!’
নিশাতের গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ। মিনমিনে স্বরে বলে,
‘ কষ্ট কেন হবে? ‘
পিংকি পুনশ্চঃ কানে কানে উত্তর দিল,
‘ সকাল হলেই টের পাবি। আমি যে ঔষধ দিলাম খেয়ে নিস,ভয় পাস না। ‘
নিশাতের শরীর জমে প্রায় বরফে পরিণত হবার জোগাড়। বিদেয় তিথিতেও মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইল। পাশের মানুষটাকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল না আর। তার মনে এখন ভয় আর ভয়। ভয়ের স্তূপ জমে গেছে মন জমিনে।
রফিক আজম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। প্রহর উনার হাত ধরে ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলল,
‘ চিন্তা করবেন না। জোর করে আপনার কাছ থেকে আপনার মেয়েকে নিয়েছি মামুজান, হেলাফেলা করব না। আগলে রাখব। ‘
চেহারায় কোনো পরিবর্তন নেই রফিক আজমের। তিনি প্রহরের হাতের ওপর হাত রেখে বলেন,’ ও একটু বোকা। ছোটো মানুষ তো। দেখে রাইখো। ‘
এই প্রথম এতটা নরম সুরে প্রহরের সাথে কথা বললেন তিনি। লগ্নটা বিষাদের ও বিদায়ের হলেও সবার মুখে অমৃতের সন্ধান পাওয়ার মতো খুশির হাসি প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠল। প্রহর লাল লেহেঙ্গা পরিহিত নিশাতকে দেখে নিয়ে রফিক আজমকে একটুখানি নিম্নস্বরেই বলল,
‘ আপনার মেয়ে যে একটু না,একটু বেশিই বোকা, এটা আমি জানি শ্বশুরজান। তবুও আপনার এই বোকা মেয়েটা আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, আমার প্রাণ। ‘
.
.
.
শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরটাতেও নিশাত থরথর করে ঘামছে। বারংবার কানে মাদলের ন্যায় ঝংকার তুলে বাজছে পিংকির বলা একেকটা শব্দগুচ্ছ। গাড়িতেও ঘামছিল সে। প্রহর কতকতবার জিজ্ঞেস করেছিল শরীর খারাপ কি-না, অথচ নিশ্চুপ ছিল ও। বিয়ে নামক শব্দটা ওর নিকট যতটা মধুর ছিল, মনে জড়ো হওয়া ভয়টা সব কর্পূরের ন্যায় উবে দিল। ভেসে গেল মনের সৃষ্ট হওয়া বন্যার জলে। বয়সটা কম বলেই কি গভীর মুহূর্তগুলোর ব্যাখায় এতটা বিচলিত, ভয়ে জর্জরিত হয়ে পড়ছে সে? না-কি পিংকির কথাগুলো নিয়ে বেশি ভাবছে বলে? বিছানার চারপাশের ফুলগুলোর সুবাস গায়ে আরও তীব্রভাবে কা-টা হয়ে বিঁধছে যেন। উঁহু! আর নার্ভাস হবে না সে। ভাববে না। মনে মনে সাহস দিতে লাগল নিজেকে।
প্রহর ঘরে এসে মাথার পাগড়িটা রাখল সোফার ওপর। ব্লেজার খুলে ছুঁড়ে ফেলল সোফার এক কোণে। নিশাতের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল কতক্ষণ। সন্দিগ্ধ গলায় শুধাল,
‘ তুই এখনো ঘামছিস? ব্যাপার কি নিশু? কী হয়েছে তোর?’
প্রহরকে বিছানায় নিজের অল্পস্বল্প কাছে বসতে দেখে একটুখানি সরে এলো নিশাত। বিপাকে পড়ে গেল বড্ড। কী করে বলবে মনের অস্থির ভাবনাগুলো? মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। শ্বাসরুদ্ধকর হালে বলল,
‘ কিছু হয় নি। ‘
প্রহর শুনল না। মাথা থেকে লেহেঙ্গার দোপাট্টা খুলে মেঝেতে ফেলে দিল। খোপার ক্লিপগুলো খুলে দিতে দিতে বলে,
‘ তুই এসব পরেছিস,এ কারণে শরীর খারাপ লাগছে হয়তো। খুলে আয়। ‘
‘ না,না,ঠিক আছি। ‘
ব্যকুল হয়ে বলল নিশাত। প্রহর হাত ধরে টেনে নিজের মুখোমুখি বসাল। শান্ত,পলকহীন চোখে মেলে রাখল ওর দিকে। তবে সেই চাহনি আর বেশিক্ষণ শান্ত রইল না। নিমিষেই হয়ে গেল অধৈর্য্য, অশান্ত। ওই চোখজোড়ায় বইছে জোরালো তুফান, আছে এক প্রবল নেশা, আছে অধিকারবোধ আদায় করে নেওয়ার তোরজোর। নিশাতের আর সাধ্য হলো না চেয়ে থাকার। আকুলিবিকুলি করতে আরম্ভ করল বেহায়া মনটা। বাড়ল র-ক্তে উচ্ছ্বাস। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকল প্রেমের উষ্ণতায় উন্মাদ হবার গাঢ় এক নে**শা। অধর যুগলের নিকটস্থে কীর্তিনাশা বৈশাখের ন্যায় ধেয়ে আসা ঠোঁট দুটোকে বাঁধা দিতে পারল না আর। মিলে গেল একে-অপরের ওষ্ঠদ্বয়।
প্রহরের হাতটাও শুরু করল অস্থিরতা। সেই অস্থিরতার আধিপত্য নিশাতের কোমড়ে। হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো চুপসে যেতে থাকে মেয়েটা। মিশে যেতে থাকে পুরুষালি শক্তপোক্ত বক্ষে। আঁকড়ে ধরে প্রহরের গলা।
প্রহর ঠোঁট দুটি ছেড়ে দেয়। বদ্ধ চোখের রক্তাভ চেহারার মেয়েটাকে উন্মুখ চেয়ে থেকে প্রশ্ন করে,
‘ তুই কি নার্ভাস ফিল করছিস?’
নিশাত লজ্জায় চোখ-মুখ খিঁচে ফেলে। কিছু বলে না। নিশ্চুপ,নির্বাক। নীরবতাকে সম্মতি ভেবে প্রহর আরো কাছে টেনে নেয় ওকে। কিন্তু নিশাত হঠাৎ করেই বলে ওঠে,
‘ ওয়াশরুমে যাব। ‘
প্রহর কোমড় ছেড়ে দিয়ে বলে,
‘ যা, আমি অপেক্ষা করছি। ‘
বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে নিশাত। তিন মিনিট,পাঁচ মিনিট, দশমিনিট কেটে যায় তবুও বের হবার নামধাম নেই। প্রহর ওয়াশরুমের দরজায় বারি দেয় বার কয়েক। হাঁক ছাড়ে,
‘ নিশাত,তুই কি ওয়াশরুমে ঘুমিয়ে পড়েছিস?’
বিনিময়ে জবাব আসে না। প্রহর ধৈর্য্য হারিয়ে পুনরায় ডাকে,
‘ নিশু, বের হ। নইলে আমি কিন্তু দরজা ভাঙব। কি করছিস তুই এতক্ষণ ওয়াশরুমে?’
এবারও অসহনীয় নীরবতা চারিধারে।
‘ নিশু রে,তুই ঘুমানোর আর সময় পেলি না? এই রাতটার জন্য সেকেন্ড সেকেন্ড হিসাব করেছি। তুই পারলি আমার সাথে এমন করতে? চিঠিতে লিখেছিলি, মন ও দেহ দুটোই আপনার। এই আমাকে দেওয়া তোর? ফুলশয্যার রাতে এসে পারলি আমায় ধোঁ-কা দিতে?’
#চলবে!
#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকা_ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৫৫
কিছু উদ্দাম অনুভূতি থাকে যেগুলোর সাথে পরিচয় হতে প্রয়োজন হয় উপযুক্ত বয়স, পরিপক্ব মন ও সঠিক সময়ের। কিশোরী বয়স ও যৌবনের মাঝামাঝি ঝুলন্ত বালক-বালিকারা অজ্ঞাত থাকে অনেক গভীরতম বিষয়বস্তু সম্পর্কে। সে সকল বিষয়ে পুরোপুরি জ্ঞান না থাকায় ভয়ের একটা প্রদীপ দপদপ করে জ্বলতে থাকে বুকের গহীনে। বিয়ে নামক শব্দটার সাথে নিশাতের পরিচয় ছিল, পরিচয় হয়েছিল ভালোবাসার সাথেও,অল্পস্বল্প আদরে আবেগে মনের নন্দনকাননে উড়ে বেড়াত হাজারো চঞ্চল প্রজাপতি। কিন্তু শারীরিক কিছু ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে জ্ঞাত ছিল না সে। ছিল বললেও ভুল হবে না,কিন্তু কখনো ভালোবাসায় ক্ষ–তিকারক দিক ভেবে দেখে নি। তার কাছে আদর অতি তুলতুলে একটা শব্দ। এটার যে কঠিন কিছু দিক আছে তার কিশোরী মন ভেবে দেখে নি। হুট করে পিংকির ওইসব বলায় সে রোদের উত্তাপে মুষড়ে পড়া ফুলের মতোই মুষড়ে পড়েছে। অজানা শংকায় ও আতংকে সমস্ত শরীরে কাঁপুনি দলবেঁধে রাজত্ব করছে। চোখ বার বার জলের ভারে মুদিত হয়ে আসছে। কর্ণকুহরে আসছে প্রহরের কণ্ঠ। কিন্তু নিজেকে সামলে উঠতে পারছে না সে। প্রহরের মুখোমুখি হতে এবং তাকে অন্তর্দেশের ভয়টা বলতেও লজ্জা পাচ্ছে বেশ। অত অত ডাকে আর সাড়া না দিয়ে পারল না শেষমেশ। বৃদ্ধ বয়সে দেহের সমগ্র শক্তি, সামর্থ্য হারিয়ে ঠকঠক করে কম্পনরত বৃদ্ধা মহিলার মতোই কাঁপতে কাঁপতে দরজায় হাত রাখল ও। মেলে মাথা বের করে তাকিয়ে রইল। চাহনি নিথর, ভয়মিশ্রিত।
প্রহর ওয়াশরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। অর্ধ শরীর বের করে প্রাণহীন চোখে নিশাতকে তাকিয়ে দেখতে বুকের ভেতরটা মুচড়ে মুচড়ে উঠল তার। পরাধীন পাখির ন্যায় ছটফট করতে লাগল বক্ষস্থল। অসহনীয় ব্যথা শুরু হলো সেথায়। এমন একটা রাতে নিশাতের এই বিধস্ত হাল কল্পনায়ও আনার দুঃসাহস করে নি সে। এই বোকা মেয়েটাকে ধ-মক,শাসনের ওপরে রাখলেও কখনো অন্য কোনো কষ্ট দ্বারা যন্ত্রণা পেতে দেয় নি। উৎকণ্ঠিত না হয়ে দরজা ঠেলে সবটা উন্মুক্ত করল। টেনে দুর্বল, নরম শরীরটা বুকের মাঝে খুব আলতোভাবে চেপে ধরে ভীষণ শীতল স্বরে প্রশ্ন করল,” কী হয়েছে নিশু? কাঁপছিস কেন এভাবে?”
নিশাত বলিষ্ঠ কোমরে হাত পেঁচিয়ে ধরে প্রশস্ত বুকে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে উঠল। চমকে গেল প্রহর। বিমূঢ় হয়ে রইল কয়েক পল। তার ভেতরটায় তার তিলবতীর আকস্মিক কান্নায় ঝড় শুরু হলেও বাহ্যিক দিক থেকে একেবারে
চিরকাল বয়ে যাওয়া নদীর মতো শান্ত থাকল। আজ রাগ দেখাল না,ধম*কাল না,শাসাল না। উলটো শরীরটা আরেকটু নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে মায়াময় গলায় জানতে চাইল,” কাঁদছিস কেন? তোর কি শরীর খারাপ লাগছে? হু?”
নিশাত লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে বারংবার। তবুও তার মনে হলো প্রহরের সাথে মনের কথাগুলো খুলে বলা উচিত। কিন্তু জড়তা-সংকোচে, শরমে পারছে না ও। শুধু কান্না থামিয়ে বলে,” আমার পার্সে…পার্সে পিংকি কিছু ঔষধ দিয়েছে। ”
কথাগুলো পুরোপুরি স্পষ্ট বলতে পারে না ও। প্রহর বুঝে নেয়। জড়িয়ে ধরে এনে ফুলটুল সব বিছানার ওপর থেকে সরিয়ে বসায় ওকে। কোলের কাছে হাঁটু ভেঙে বসে জিজ্ঞেস করে ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে,
” পানি খাবি?”
ঘাড় নাড়ায় নিশাত। খাবে সে, প্রচন্ড তৃষ্ণা পেয়েছে। গলা শুকিয়ে কাঠ এবং বুকের ভেতরটা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে। প্রয়োজন পানি ও স্বস্তি। সবথেকে ভালো হতো বিয়ে নিয়ে হুট করে সৃষ্ট হওয়া ভয়গুলো কারো কাছে প্রকাশ করে নির্ভার হতে পারলে। কিন্তু এই মুহূর্তে সবথেকে আপন ও কাছের মানুষটা হলো তার স্বামী। তবুও পারছে না ও পুরোপুরি মানুষটার কাছে খোলা বই হতে। হতে পারে সবটাই তার চিরায়িত স্বভাবের জন্য ও বয়সের দোষ বলে। ওর শরীরের হাল দেখে প্রহর নিজেই তার মুখের সামনে গ্লাস ধরে পানি খাইয়ে দিল। নিশাতের পার্স থেকে ঔষধগুলো বের করে চিনতে অসুবিধা হলো না তার। ব্যথার ঔষধ সে-ও এনে রেখেছিল মেয়েটার জন্য, সাথে পিলও। কিন্তু এগুলোতে এত ভয় পাওয়ার কারণ কী! সাময়িক চিন্তায় কপালে কয়েকটা কুঞ্চিত রেখার ভাঁজ পড়ল। তীক্ষ্ণ ফলার ন্যায় প্রশ্ন ছুঁড়ে মা-রল,
” এগুলো কে দিয়েছে তোকে?”
নিশাত অনেক কসরৎ করে কান্না জমানো গলায় প্রতুত্তর করে,” পিংকি। ”
প্রহরের ঘন ভ্রু যুগল প্রায় সূচালো রূপ ধারণ করে। শুধাল, ” এগুলো দেওয়ার সময় তোকে কী বলে দিয়েছে? ”
এহেন প্রশ্নে নিশাতের গোলগাল ছাঁচে গড়া ফ্যাকাশে চেহারাটা চুপসে যেতে থাকল। পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের কোমল, রক্তিম আভা যেন এসে পড়ল মেয়েটার দু গালে। অতর্কিতে লালের আস্তরণে ঢাকা পরেছে তার দু গাল। ব্যাপারটা অত্যন্ত গাঢ়ভাবে খেয়াল করল প্রহর। ভয়ের সাথে সাথে লজ্জার পাহাড় জমেছে নিশাতের ভিতর তার প্রশ্নে, বিষয়টা বুঝতে একটুও বেগ পোহাতে হয় নি। দরজা খুলে বেরিয়ে গেল লম্বা পদক্ষেপে। একা ঘরে, ফুলের সুবাসের রাজ্যে রেখে গেল ভয়ার্ত নিশাতকে।
ঊষা বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমের মিছে মিছে ভাব ধরে আছে। প্রত্যয় প্রথম কয়েক বার একনাগাড়ে ডেকে কণ্ঠটা শ্রান্ত হলে হাল ছেড়ে দেয়। তার মন বলছে মেয়েটা ঘুমোয় নি। এমন গোলাপের মতো বধূ সেজে, পুতুলের মতো একটা মেয়ে ঘুমাল কীভাবে এই মধুর রাতটা রেখে? এতটা পাষাণ নয় ঊষা। নিশ্চিত ভং ধরে আছে। এজন্য সে অন্য ট্রিক শুরু করল তাকে ভাগে আনার জন্য।
ঊষা অন্য দিকে মুখ করে চোখ বুঁজে শুয়ে ছিল। নরম ঠোঁট উন্মুক্ত পিঠে গভীরভাবে ছুঁয়ে দিতেই শরীরের শিরশির অনুভূতি ঠেকাতে লেহেঙ্গার কিছু অংশ পুরো নিল মুঠোয়। ঠিক রাখতে চাইল নিজেকে। কিন্তু ওষ্ঠজোড়ার মালিক নিমিষেই উন্মাদভাবে ছুঁয়ে দিতে লাগল ঘাড়ে,পিঠে। একটা সময় ওর লেহেঙ্গা মুঠো করে রাখা হাতটা চেপে ধরল সে। ফিসফিস করে ফিচেল স্বরে বলল,
” আমার সাথে চালাকি? উফ! কাজে দিল না। ”
ঊষা পাশ ফিরতেই প্রত্যয় জাপটে ধরল ওকে। চিল্লিয়ে উঠল ও আ””গুন গলায়,
” উফ! ব্যথা পাচ্ছি, সরো তুমি।”
প্রত্যয়ের মুখচ্ছবি করুণ হলো,” আমি তোকে শক্ত করে ধরি নি। ব্যথা পেলি কীভাবে? ”
” অনেক শক্ত করে ধরেছ তুমি, আমার শরীরটা পিষে ফেলছ। সরো আমি ঘুমাব। ”
” আমাদের আজ বাসর রাত, ঊষা। ”
ভোরের স্নিগ্ধ কুয়াশার মতো আবছা ও সাদা দেখাচ্ছে প্রত্যয়ের দাপুটে চেহারাটা। অস্পষ্টভাবে তার প্রত্যাখানে মুখটা পাণ্ডুর হয়ে গেছে। আসলে, গত তিনদিন ধরে ঊষার একটা চাপা রাগ ছিল। সে যেদিন মজুমদার বাড়িতে যাচ্ছিল,সেখানে যাওয়া নিয়ে ছোটোখাটো একটা ঝ-গড়া হয়েছিল প্রত্যয়ের সাথে। ঝ-গড়ার এক পর্যায়ে প্রত্যয় বলে ‘তুই আর আসবি না,আমিও তোর কাছে যাব না। দূরে থাকার ইচ্ছে হয়েছে, দূরে থাক।’ তৎক্ষনাৎ কথাটার বদলে বুকে অভিমান পুষে ফেলে ঊষা ঝট করে। তবে বেহায়া মন জানত,প্রত্যয় নামক বেহায়া ও তার প্রেমে মগ্ন পুরুষটা ঠিক ঠিক ঝগড়াঝাটি ভুলে, সকল বাধাকে পায়ে ঠেলে দিয়ে ওর কাছে যাবে। গিয়েছিলও। কিন্তু ঊষা সেই হলুদের রাত্রিরে একদমই দেখা করে নি তার সাথে। অভিমান সময়ের সাথে সূর্যের কৃষ্ণ অম্বরে মিলিয়ে যাওয়ার মতোন নিঃশেষ হয়ে গেলেও প্রত্যয়কে অল্পমাত্রায় শা-স্তি দেবার ইচ্ছে হয় ওর, এবং দিচ্ছেও। বার বার রিজেক্ট হওয়ায় প্রত্যয়ের বিমর্ষ অবস্থা দেখে আনন্দ পাচ্ছে। আরেকটু তেজী গলায় বলল,
” বাসর রাত কয়বার হয়? আমাদের এরকম ভালোবাসাবাসি না হয়ে গেল? আর বিশেষ হওয়ার কিছু অবশিষ্ট নেই। একবার বিশেষভাবে হয়েই গেছে। ”
প্রত্যয় ওর কোমরের নিচে হাত নিয়ে বিছানা থেকে দেহটা একটু শূন্যে তুলে স্ফীত হাসল। চোখে উন্মত্ত চোখ রেখে একরোখা গলায় বলল,
” কে বলল তোকে ভালোবাসার মিলনে একবারই ‘ বিশেষ ‘ শব্দটা আসে? আমাদের প্রতিটি রাত বিশেষ, প্রতিটি মুহূর্ত বিশেষ। তোর অনুপস্থিতে আমি যখন তোকে নিয়ে ভাবি,সেই সময়টাও বিশেষ। মোদ্দা কথা হলো তুই-ই আমার কাছে বিশেষ, ঊষা। আর এই বিশেষ মানুটাকে আমি আদর করতে চাই,ভালোবাসতে চাই, তার সান্নিধ্যে থেকে আমিও তার কাছে বিশেষ হতে চাই। ”
পাছে প্রত্যয় একটু বেশি সাহস পেয়ে যাবে বলে, উম্মাদ হয়ে যাবে বলে ঊষা নিজমনে বলে, ” তুমিও আমার কাছে বিশেষ, আমার কৈশোর ও যৌবনের প্রেম,আমার প্রথম প্রেম। ”
দরজায় করাঘাতের আওয়াজ পেয়ে ঊষাকে সে কপালে চুমু খেয়ে ছেড়ে দিল। ঊষাও বিছানা থেকে নেমে লেহেঙ্গার ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে এলো পিছু পিছু। দরজা খুলে দেখল প্রহর দোতলার রেলিংয়ে দুই হাত রেখে মাথা নুইয়ে রেখেছে। প্রত্যয়ের বুঝতে বাকি রইল না,ভাই কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত। নয়তো এখন আসবার কথা নয়। নম্র ও হালকা উদ্বেলিত হয়ে হাঁক ছাড়ে,” ভাই!”
প্রহর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঊষাকে পানসে গলায় বলল,” আই নিড ইউর হেল্প,ঊষা। ”
ভাইয়ের বিষাদিত মুখোভঙ্গি দেখে ঊষা ভাবনার মনোরাজ্যে প্রবেশ করে বলল,” কী হয়েছে, ভাইয়া?”
” নিশাতের কাছে যা। আমার মনে হয় এখন ওর তোকে দরকার। ”
বলার সাথে সাথে ঊষা ছুট লাগাল প্রহরের ঘরে। নিশাত গুটিসুটি মে-রে বসে আছে। শরীরে একটুআধটু কাঁপুনি। রক্ত-শূন্য মুখশ্রী বলে দিচ্ছে কোনো এক ভয়মাখা গল্পকথা। দৈহিক গঠনে বড়োসড়ো, পরিপূর্ণ নারী মনে হলেও মেয়েটা সদ্য যৌবনে পা ছুঁই ছুঁই। কিশোরী তকমাটা এখনো মুছে নি। যৌবনে পা রাখার আগেই কর্তব্য, বিশ্বাস, চাহিদাপূরণ,ভালোবাসা এ সকল কিছু দিয়ে তৈরি সুরক্ষিত বলয়ে টিকে থাকা বিয়ে নামক সম্পর্কে জড়িয়ে গেল আমরণের জন্য। তাছাড়া অতিরিক্ত সারল্য ধাঁচের সে। বুদ্ধির দিক থেকে ওকে বিবেচনা করলে সেক্ষেত্রে নিশাত বোধহয় শূন্য পাবে। ঊষার এখন রাগ হচ্ছে নিজের ওপর। সে কেন ভুলে গেল মেয়েটাকে ভালোবাসার মাঝেও যে কিছু চাহিদা থাকে সেগুলোকে কীভাবে সহজে গ্রহণ করতে হবে সেটা বুঝাতে? সে বড়ো ছিল, এসব সম্পর্কে জ্ঞান ছিল,তাকে কেউ বুঝাতে হয় নি। কিন্তু নিশাত ছোট, ছোট মানুষের মাঝে এসব নিয়ে অন্যরকম ধারণা হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয় এবং খুবই অস্বস্তিকর। সে পাশে বসে হাতটা ধরে বলল,
” ভাইয়া পাঠাল। কী হয়েছে হলুদিয়া পাখি? ভাইয়ার কাছে বলতে লজ্জা পাচ্ছিলে? তুমি আমায় নির্দ্বিধায় বলতে পারো। ”
নিশাত মাথা নুইয়ে প্রশ্ন করে মিইয়ে গলায়,
” ভালোবাসার মিলন কি যন্ত্রণা-দায়ক হয় আপু? ”
ঊষা হতবিহ্বল কণ্ঠে বলল,
” যন্ত্রণাদায়ক কেন হবে? তুমি স্বস্তিভাবে নিলে একটুও যন্ত্রণার নয়। ভালোবাসার আদর কখনোই কষ্ট দেয় না। উলটো একটু কষ্ট হলেও ভালোবাসা ভেবে সেটা সাদরে গ্রহণ করা যায়। কারণ এই ভালোবাসায় ধোঁ-কা নেই, বিচ্ছেদ নেই, মনের কষ্ট নেই, আছে তৃপ্ততা। কিন্তু সবটা নির্ভর করছে তোমার ওপর। তুমি কীভাবে ভাইয়াকে গ্রহণ করতে পারছ সেটার ওপর। এবার বলো,যন্ত্রণা, এসব আউল ফাউল কথা তুমি কোথায় শুনেছ?”
” পিংকি বলেছে। সে আমায় বলল পুরুষলোকের এই ভালোবাসার ধরনটা ভিন্ন। এই ভালোবাসায় অনেক যন্ত্রণা। সে আরও অনেক কিছু বলেছে,এসবে আমার মনে ভয় ঢুকে গিয়েছিল। উনি কোথায়? উনি কি আমায় খারাপ ভাবছেন?”
ঊষার রাগটা এবার গিয়ে পিংকির ওপর পড়ল। না জানি,ওই মেয়েটা কীভাবে এই সহজ বিষয়টাকে জটিল করে তুলে ধরেছিল নিশাতের সামনে,যার ফলস্বরূপ মেয়েটার মাঝে ভালোবাসা ও আদর এ দুটো দ্বিধা আবার ইচ্ছে হয়ে দুইটি মিশ্র অনুভূতি রূপে কাজ করছে। এক পা আগাচ্ছে স্বেচ্ছায়, আবার এক পা শঙ্কায় পিছিয়ে নিচ্ছে। এমন করে এক নতুন অধ্যায়ের শুরু হতে পারে না।
” ভাইয়া, বাহিরে আছে। আমি চলে যাচ্ছি। কিছু কথা মন দিয়ে শুনো নিশাত। গাছের সবথেকে সুন্দর গোলাপটা নজরে পড়ে গেলে তুমি কি লোভ সামলে রাখতে পারবে? পারবে না। কাটাতে হাত ক্ষ-ত করে হলেও সেই গোলাপটা তুমি নিবেই নিবে। ভালোবাসা এমনই। বরং বেশিই আকর্ষণীয় ও মধুর। আর এই মধুর জিনিসটা চিরতরে পেতে গেলে কিছু মিষ্টি যন্ত্রণার প্রহার আমাদের সহ্য করতে হয়। তুমি সহজ হও, শুধু প্রাপ্তি কল্পনা করো, সামান্য কিছু যন্ত্রণাও মিষ্টি লাগবে। তারপর একদিন কল্পনা করবে কিছু মধুর ব্যথা সইয়ে গিয়ে তুমি জীবনে অনেক বেশি সুখের নাগাল পেয়ে গেছ। অল দ্যা বেস্ট, জলদি ফুপু, খালা, কাকি হতে চাই কিন্তু। ”
শেষোক্ত কথাটা চোখ টিপে বলল ঊষা। নিশাত আরক্তিম হয়ে নিশ্চুপ রইল। তারও পিংকির প্রতি প্রবল জেদ চাপল। অ–সভ্য মেয়ে! এই মেয়ের কারণে প্রহরকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে ও,সুন্দর মুহূর্তগুলো নষ্ট করে ফেলেছে, কি না কি ভয়ংকর ভাবনা ভেবে ফেলেছিল! অথচ সহজভাবে কেন নিতে পারল না সবকিছু! ঊষা বের হয়ে যেতেই প্রহর ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। ওয়ারড্রব থেকে একটা শাড়ি বের করে নিশাতের সামনে রাখল। কমলা ফলের রংয়ের মতো দেখতে শাড়িটা। শাড়িটার জমিনে সবুজ ঘাস আঁকা। ঘাসের ওপরে আবার নানান রঙের বন্যফুল। এই হ্যান্ড পেইন্টেড শাড়িগুলো দারুণ লাগে নিশাতের। দেখেই মন ময়ূরীটা নৃত্য করতে থাকল। কল্পনা করতে থাকল এই শাড়িটা তার হলদেটে বর্ণের দেহটায় বেশ ঝলমল করবে,মিশে যাবে একদম। কর্ণকুহরে ধাক্কা খেল ভরাট স্বর,
” শাড়িটা পাল্টে আয়,ঘুমাবি। এসব জঙ্গল গায়ে রেখে ঘুমাতে পারবি না। ”
নিশাত হতবাক। ঘুমাবে মানে! প্রহর কি তার সাথে রেগে আছে,কষ্ট পেয়েছে, অভিমান করেছে? করারই কথা। মা বার বার করে বুঝিয়েছেন প্রহর এখন তার স্বামী। ছোট থেকে ভাই ডেকেছে, তখন হিসেব ছিল অন্যরকম। আর এখন স্বামী, অভ্যাস হলেও ছাড়তে হবেই এটা। তাই ভুল করেও এখন আর ভাই শব্দটা ওর মুখ ফসকেও বের হয় না। রুমের নৈঃশব্দ্যকে তাড়িয়ে বলল,
” লেহেঙ্গাই ঠিক আছে, শাড়ি লাগবে না। ”
প্রহর আগু-ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। অর্ধ ঝুঁকে এসে ওর দুই পাশে বিছানার ওপর হাত রেখে বলল,
” তোকে জিজ্ঞেস করেছি ঠিক আছে কি-না? তুই বুঝিস কিছু গর্দভ? বুঝলে কি আর আমার এই দিন আসে! যা, শাড়ি পরে আয়, জলদি যাহ্।”
ধমক খেয়ে নিশাত শাড়ি, ব্লাউজ নিয়ে চলে গেল ওয়াশরুমে। বিড়বিড় করল কতক্ষণ, ” বাসর রাতে বউকে কে ধমকায়! মায়া নেই একটুও। ঠিকঠাক জানতাম না বলে হয়ে গেছে ভুল আমার দ্বারা,তাই বলে এত অভিমান করতে হবে! ”
নিশাতের মনটা তাকে বলল,” তুই গভীর মুহূর্তে গিয়ে তার ভালোবাসার আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করেছিস। তোকে যে তিনি এখনো রাগ দেখান নি,কিছু বলেন নি সেটা কি ভালোবাসা না? কত ভালোবাসে তোকে! জোরজবরদস্তিও করেন নি। ”
মনের সাথে তাল মিলাল নিশাত। একটা কথাও ফেলনা নয়। কেন সে বঞ্চিত করবে প্রহরকে অধিকার থেকে? গিয়ে নিক মজুমদার বাড়িতে, পিংকির খবর আছে। শাড়ি পরে বেরিয়ে দেখে প্রহর পাঞ্জাবি খুলে কালো টি শার্ট পরে নিয়েছে। বিছানায় বসে মাথার চুল টানছে ক্রমাগত। তাকে দেখে চোখের কোণা দিয়ে একবার তাকাল। তৎপরে শুয়ে পড়ল বিছানার এক পাশে। তাকেও বলল,
” এসে শুয়ে পড়। ”
এমন প্রেমহীন কণ্ঠটা মানতে পারল না নিশাত। বুকের উচাটন বেড়ে গেল। এত শান্ত, নিশ্চুপ, স্থির কখনো থাকে নি প্রহর। বকেছে, দাঁতে দাঁত চিবিয়ে কথা বলেছে, যখন তখন আদর করেছে ওইসব স্বভাবের মানুষটাকে পছন্দ করে নিশাত। নিজের সহজাত বৈশিষ্ট্য ছেড়ে অন্যরকম আচরণ করা এই প্রহর ওকে কষ্ট দিচ্ছে, লোনাজল জমে জমে ক্ষণিকের মাঝেই চোখ পরিণত হচ্ছে সমুদ্রে। এই সমুদ্রে বাধ দিয়ে ঢেউ আটকে রাখার কোনো উপায় নেই। পারেও নি সে। অশ্রুতে ভেসে যাওয়া চোখ নিয়ে বিছানার এক পাশে শুয়ে একটু শব্দ করেই কেঁদে দিল অনুশোচনায়। প্রহর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরল ওর দিকে। উত্তেজিত হলো খুব,
” আবার কান্না করছিস কেন? আজ কি কান্না দিবস রে নিশু? এটা বাসর রাত না-কি কান্নার রাত?”
নিশাত লজ্জা -শরম এক সাইডে যত্ন করে রেখে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল,
” বাসর রাত হলে আপনি ঘুমাচ্ছেন কেন?”
” কারণ, আমি তোকে ছুঁবো না। আবার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখাও কঠিন। তাই ঘুম-ই সলিউশন। তোকে ছুঁয়ে আর কষ্ট দিতে চাই না। আমি ভুল করেছি,এটাই আমার প্রাপ্য। ”
গুমোট গলায় বলল প্রহর। নিশাত নেত্রপল্লব নেতিয়ে বলল,
” কী ভুল করেছেন আপনি? ”
প্রহর প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে তার মুখে চোখজোড়া রেখে বলল,
” আমার উচিত ছিল তুই আরেকটু বড়ো হলে বিয়ে করা। যদি আরও দুটো বছর পর করতাম তাহলে আজকের পরিস্থিতি ফেস করতে হতো না,এতে তোর দোষ নেই। তোর বয়সটাই এমন। দোষ আমার যে নিজের ইমোশন নিয়ন্ত্রণ করতে পারি নি,প্রতিক্ষণ তোকে হারানোর ভয়ে হাহাকার করত ভেতরটা। ”
কথার মাঝে নিশাত একটু একটু করে ঘনিষ্ঠ হলো। ধীরে ধীরে পদক্ষেপ ফেলছে সে প্রহরের দিকে। প্রহর মুহূর্তেই ওর শীর্ণ দেহটা দুই হাতের মাঝে চেপে ধরে মুখের ওপর ঝুঁকল। নিশাত চোখ বুঁজে ফেলল তৎক্ষনাৎ। খামচে ধরল নিঃশ্বাসের সাথে নিঃশ্বাসের মিলন ঘটানো পুরুষের সুপুষ্ট বাহু। প্রহর ওর গালে নাক ঘষতে ঘষতে উষ্ণ শ্বাস টেনে নিয়ে গাঢ় কণ্ঠে বলতে লাগল,
” নিশু রে…,তোরে অনেক ভালোবাসি৷ তুই সামনে থাকলেই আমার চোখের শান্তি, আমার ভিতরের চাপা যন্ত্রণাটা কমে যায়। ”
বলে প্রহর সরে যেতে নিলে নিশাত আরও শক্ত করে বাহু খামচে ধরল। কিছুটা হলেও নখের আঁচর লাগল বাহুতে। সে তার দিক থেকে সম্মতি বুঝাতে চাচ্ছিল, কিন্তু এই ত্যাড়া লোকটা বুঝেও উপহাসের সুরে বলল,
” মালিকানা পেয়ে এখুনি দখলদারিত্ব খাটাচ্ছিস? ভাগে পেয়ে কখন শুধু নিজের অধিকার দেখানো শুরু করবি,এই আশাতে ছিলি,তাই না? আর আমি তোকে কত সহজ-সরল ভাবছিলাম! এভাবে ইজ্জত লুন্ঠন করা দস্যুদের কাজ। তুই কি দস্যু? মাংসও ছিঁড়ে ফেলেছিস মনে হয় খামচি দিয়ে। আমার আবার শরমভরম আছে। যা হবে বাতি নিভিয়ে হবে। দাঁড়া বাতি নিভিয়ে আসি। দেখা যাবে, আদরের গভীরতম সময়ে তুই নিজেকে দেখেই জ্ঞান হারিয়েছিস লজ্জায়। তার থেকে বাতি নেভানোই উত্তম। ”
সত্যি সত্যি প্রহর ঘরে যে অল্পস্বল্প আলোর বিচ্ছুরণের খেলা চলছিল,সেটাও থামিয়ে দিল। অন্ধকারের মাঝে কেবল এক ফালি চাঁদের আলো ভরসা হলো নিশাতের জন্য। সেই আলোর রেখায়, আবছা দীপ্ততায় সে প্রহরের প্রমত্ত চাহনি দেখে দু হাতে মুখ ঢেকে ফেলল সলজ্জে। প্রশ্ন করল,
” শাড়িটা সুন্দর। কোথায় থেকে নিয়েছেন?”
প্রহর মুখটা কাছে নিয়ে ঘোরে নিমজ্জিত হয়ে বলল,
” ওয়ারড্রব থেকে। দেখিস নি? তুই দেখি আজকাল চোখেও কম দেখিস। তোকে বেশি করে ছোটমাছ খাওয়াতে হবে। ”
” আমি সেটা বলি নি। মানে কোথা থেকে কিনেছেন। ”
” তুই জেনে কী করবি? তোর জানার দরকার নেই। যেগুলো আছে আগে সেগুলো পরে ত্যানা কর,তারপর আরও নতুন কিনে দেব। ”
” আরও আছে? কয়টা আছে?”
” গুনে দেখি নি। যেদিন থেকে তোকে ভালোবাসতে শুরু করেছি,সেদিন থেকে প্রতি মাসে আমি তোর জন্য একটা করে হ্যান্ড পেইন্টেড শাড়ি কিনেছি। ”
” এত শাড়ি কেন কিনেছেন?”
” তোর পছন্দ বলে। আমার তিলবতীর সব পছন্দ আমার পছন্দ। তুই হ্যান্ড পেইন্টেড শাড়ি ভালোবাসিস, আর সেই শাড়ি পরিহিতা তোকে আমি ভালোবাসি। আর ভালোবাসি বলেই কিনেছি। প্লিজ আর কোনো প্রশ্ন করিস না। ”
নিশাত আর কোনো প্রশ্ন করল না। হাত সরিয়ে ফেলল মুখের ওপর থেকে। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে খামচে ধরল বিছানা। তার অধরযুগলে সমুখের পুরুষের ওষ্ঠের বিচরণ। সেই পুরুষের বলিষ্ঠ হাত জোড়ার বিচরণ তার কোমর ও উন্মুক্ত পিঠে। প্রহরের ওষ্ঠ আস্তে আস্তে নেমে এলো নিশাতের কণ্ঠনালীর কাছাকাছি। দাঁতের স্পর্শে সূচ ফোটাবার ন্যায় সূক্ষ্ম ব্যথায় নিশাত অস্ফুটে আহ! করে ওঠে। গলা থেকে প্রহরের ঠোঁটজোড়া সরে যায় তক্ষুনি। বিচলিত কণ্ঠে জানতে চায়,
” তুই ভয়ে বেহুঁশ হয়ে যাবি না তো?”
নিশাত লাজুক হেসে বলে,
” হমু না।”
শাড়ির আঁচল কাঁধ থেকে নামিয়ে দেয় প্রহর। শিরা-উপশিরায় রক্ত ছলকে ওঠে দুজনেরই। উভয় দেহে বেড়ে যায় ব্যাকুলতা। এক প্রবল নেশায় ছেয়ে যায় হৃদয়ভূমি। দেহ জুড়ে চলতে থাকে তুমুল আন্দোলন। প্রহর দামাল বৃষ্টির মতো ভালোবাসার বৃষ্টিতে ভিজিয়ে দিতে শুরু করে প্রেমের উষ্ণতায় অস্থির হওয়া মেয়েটাকে। কানের পাতায় ঠোঁট ছুঁয়ে বলে,
” সকালে ঔষধ খেলেই ব্যথা সেড়ে যাবে,জান। ”
________________________
ঊষা আপত্তিকর গলায় বলল,” না,না আমি যাব না তোমার সাথে। ফেলে দিয়ে আমার হাত-পা ভাঙার বুদ্ধি। ডাক্তার হবার আগেই রোগী হয়ে যাব আমি। ”
প্রত্যয় স্মিত হেসে বলল,” সাইকেল থেকে পড়ে বেশি হলে হাত-পা ছিলে র-ক্ত আসবে, ভাঙবে না। এরকম সুন্দর একটা রাতে ক’জন বউ নিয়ে সাইকেলে গ্রাম ভ্রমণে বের হয়, বল?”
” তোমার মতো মাথামোটা লোকেরা বের হয়। ”
বলে পেছনে ওঠে বসল ঊষা। প্রত্যয় হুট করে আবদার জুড়ে দিয়েছে এই রাতটা স্মরণ রাখতে সাইকেল ভ্রমণে বের হবে ওরা। রাতের শেষভাগে এসে কেই এমন পাগলামি করে? অঢেল বিরক্তি নিয়েই রাজি হলো ও। প্রত্যয় হাতটা ধরে উঠিয়ে বলল,
” তুই সামনে বোস। আমি পেছনে বসে চালাব। ”
” মুভির নায়ক-নায়িকার মতো! আমি কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে লিপকিস করতে পারব না তোমাকে। ”
হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বলল প্রত্যয়,
” কিছু করতে হবে না তোকে,এখন বোস। ”
ঊষা সামনে বসলে, প্রত্যয় তাকে বাহুবন্ধনীতে বন্দি করে সাইকেলের প্যাডেল ঘুরাল। সাইলেকের টিংটিং আওয়াজটা মিশে গেল জোনাকি পোকাদের কলতানের সাথে। নিশিথের শীতল হাওয়া এসে স্পর্শ করতে লাগল ওদের শরীরের ভাঁজে ভাঁজে। গ্রাম হলেও বেশ সমৃদ্ধ করেছে উজ্জ্বল সাহেব। রাস্তার ধারে ধারে দু একটা করে নিয়ন বাতির ব্যবস্থা করেছেন। তবে পুরো গ্রামে করা সম্ভব হয় নি এখনো। কিছু বাড়ির আঙিনার হলদেটে রশ্মি অস্পষ্টভাবে আলো ছড়াচ্ছে খরখরে কাঁচা রাস্তায়। প্রথমত ঊষার বিরক্তি লাগলেও এখন সকল বিরক্তি উবে গিয়ে আলো-আঁধারের ডুবে থাকা গ্রামের সৌন্দর্যের মায়া পড়ে গেল। কয়েকটা জোনাকি পোকা এসে কাছে ভিড়তে লাগল ওদের। ঊষা খুশিতে উচ্ছল কিশোরীর মতো ধরতে চাইল ওদের। হাতের মাঝে এলো একটা৷ জোনাকির ছড়ানো আলোর সবটা পড়ছে ঊষার মুখের ওপর। প্রত্যয় বিমোহিত হয়ে অপলক দেখতে থাকল সোনালিরাঙা বদনখানি। এই খুশিতে ঝলমল চেহারা তার নিঃশ্বাস ভারী করে তুলল। হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল। নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা আর করল না। ঠোঁটের ছোঁয়ায় এঁকে দিল স্নিগ্ধ মুখটার এক পাশে। ঊষা সেই গালে হাত রেখে বলল,
” সাইকেল থেকে পড়ে গেলে তোমাকে ছাড়ব না। ”
প্রত্যয়ও হার না মেনে জানাল,
” আমি তো চাই-ই তুই আমায় কখনো না ছাড়িস। ”
ওদের সাইকেল পিচঢালা রাস্তায় ওঠে বা দিকে ঘুরে চলে গেল। ডান দিকে মাথা ঘুরিয়ে ভালো করে লক্ষ্য করলে একটুখানি দূরে একটা গাড়ি দেখতে পেত। গাড়ির হেড লাইটের আলো নিভিয়ে চুপচাপ বসে ছিল সমীরণ ভিতরে। প্রত্যয় ও ঊষার বিয়ের অনুষ্ঠানের কথা কানে যেতেই ছটফট করছিল সারাটাদিন বেইমান হৃদয়টা। থাকতে না পেরে সন্ধ্যার দিকেই ঢাকা থেকে মহানন্দ গ্রামে ছুটে এসেছে হন্য হয়ে। জানে, ঊষার কাছে যেতে পারবে না, বিয়েতে যেতে পারবে না, মুখোমুখি হতে পারবে না তবুও বেহায়া মনকে আটকে রাখতে পারে নি সে। ফিরেও যেতে পারে নি। ভালোবাসার শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়ে রইল এখানে। এখন এই দৃশ্যটুকু দেখে সারাদিনের চেয়ে আরও বেশি যন্ত্রণা হতে লাগল তার। শ্বাস নিতে পারছে না ঠিকঠাক। অক্সিজেনের অভাব অনুভব করছে। দাউদাউ করে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে অন্তর্দেশ। পাগল হয়ে যাচ্ছে সে ঊষাকে ছাড়া। মনটা একবার চায় ঊষাকে ছিনিয়ে নিজের করে ফেলতে, আবার ওই অবাধ্য মনটাই তাকে শাসিয়ে বলে, ‘যাকে ভালোবাসিস তার চোখে ঘৃণা দেখার চেয়ে ম-রে যাওয়া ভালো, তার সাথে জোরজবরদস্তি করে সেই ঘৃণা দেখার মতো দুঃসাহস করিস না সমীরণ।’ সারা শরীরে ভালোবাসা না পাওয়ার ব্যথা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে লাগল। নিজেকে শক্ত, ক্ষমতাশীল ভাবা অহংকারী সমীরণকে কাবু করে ফেলল সেই ব্যথা। তার টকটকে লাল হয়ে থাকা দু চোখ থেকে ঝরল জল। ভালোবাসা না পাবার যন্ত্রণা থেকে নিস্তার পেল না আর। গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে কাতর সুরে উচ্চারণ করল,
” ঊষা,ঊষা,ঊষা……এই ঊষা!”
কিন্তু হায়! ওর এই ভালোবাসার ডাক যে ঊষা কখনোই বুঝবে না, কখনোই শুনবে না,কখনোই না।
#চলবে!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। শব্দসংখ্যা ৩২০০+)