প্রেমের জোয়ার ভাটা পর্ব-০৭

0
274

#প্রেমের_জোয়ার_ভাটা
#পর্ব_সাত
#অধির_রায়

জন্মস্থান প্রতিটি মানুষের কাছে প্রিয় স্থান৷ নাড়ির টানে দেশ থেকে দেশান্তর থেকে ছুটে আসে নিজ জন্মভূমিতে৷ অনেক আকুলতা কাজ করে৷ মীরা নেতাদ্বয় বন্ধ করে আকন্দপুরের শীতল হাওয়া মাখতে ব্যস্ত৷ অনেক যুগ পর মীরা আকন্দপুর আসছে৷ চির চেনা পথ ঘাড়ে রঙিন প্রজাপতির মতো ডানা মেলে উড়ছে৷ আরুশ পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

“কেমন অনুভূতি হচ্ছে৷ খুব মিস করছিলে প্রকৃতির ছোঁয়াকে৷”

মীরা আঁখি বন্ধ করেই বলল,

“আমার কাছে আমার গ্রামই সব৷ প্রকৃতির ভালোবাসায় সব সময় হারিয়ে যেতে চাই৷ আমি অনেক ভালোবাসি আমার গ্রামকে৷”

“তুমি তোমার বাড়িতে গেলে নিজেই সারপ্রাইজ হয়ে যাবে৷ তোমার জন্য একটা বঠ সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে৷ এখানে না দাঁড়িয়ে জলদি বাড়িতে চল।”

“আর একটু প্রকৃতির সাথে সময় কাটিয়ে যায়না৷ বাড়িতে গেলে বের হতে পারব কিনা জানি না৷ মা, বাবা, ইহান ভাইয়া ঘিরে বসবে৷”

“তোমার জন্য সকলে অধীর আগ্রহে বসে আছে৷ আমরা পড়ন্ত দুপুরে এদিকে ঘুরে যাব৷ আমার ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে৷ সবার আগে তোমার বাড়িতে যেতে হবে৷”

মীরা মন খারাপ করে গাড়িতে উঠল৷ গাড়ির গ্লাস নামিয়ে সবুজে ঘেরা ধানের ক্ষেত দেখতে ব্যস্ত৷ কিছু সময়ের মাঝে মীরা বাড়িতে পৌঁছে গেল৷
চারিদিকে বাজনা বাজছে। সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো সবকিছু। দেখে মনে হচ্ছে বিয়ে বাড়ি। চিন্তিত কন্ঠে মীরা প্রশ্ন করল,

“আমাদের বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে কার? ইমন ভাইয়া ছাড়া তো কেউ নেই৷”

আরুশ দুই হাত ব্যঙ্গ করে বলল,

“আমরা বরং বাড়িতে প্রবেশ করি৷ জানা যাবে কার বিয়ে হচ্ছে? এখানে দাঁড়িয়ে টেনশন না করাই তোমার জন্য মঙ্গল।”

মীরা খুবই অবাক হয় বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে৷ অন্য কারোর বিয়ে নয়৷ বরং তার ভাইয়া ইহানের বিয়ে৷ মীরা এতোটা সারপ্রাইজ হবে বুঝতে পারিনি। সবাই মীরাকে না জানিয়েই সকল কাজ সম্পুর্ন করেছে৷ মীরা ইহান ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে ভবিষ্যৎ জীবন যেন সুখের হয় তার শুভেচ্ছা জানাল৷

বিয়ের কাজ সম্পুর্ন হওয়ার পর দুইদিন পর মীরা আরুশ ঢাকায় ফিরে আসে৷ বিয়ের পর মেয়েদের স্বামীর ঘরই হয় আসল ঘর৷ ইচ্ছা থাকলেও বাবার বাসায় বেশিদিন থাকা যায়না৷ মীরা ঢাকায় আসার পরই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে৷ হসপিটালের করিডরে উদাসীন হয়ে বসে আছে আরুশ৷ মীরাকে নিয়ে খুব ভয় হচ্ছে৷ মেয়েটা হঠাৎ করেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল কেন? ডক্টর মীরার চেকআপ করিয়ে বলল,

“মি. আরুশ চিন্তার কিছু নেই৷ আপনি বাবা হতে চলছেন৷”

আরুশ বাবা হতে চলছে খবর শুনে খুব খুশি হয়৷ আরুশের পকেটে যা ছিল তাই ডক্টরকে দিয়ে দেয়৷ মুচকি হেঁসে ডক্টর সেখান থেকে প্রস্থান করেন৷
__________

আয়াত চৌধুরী এখন মীরার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন না৷ মীরার যথেষ্ট খেয়াল রাখেন৷ আরুশ অফিসের কাজ দ্রুত শেষ করে বাসায় চলে আসেন। মীরার উদরে আলতো করে ভালোবাসার পরশ দিয়ে বলল,

“আমি খুব খুশি৷ আমি কোনদিন ভাবিনি আমাদের লাইফে ছোট একটা বেবি আসবে৷ আমরা ছোট একটা ঘর বাঁধব৷ এক শনে থাকব দু’জন।”

মীরা আরুশের কাঁধে মাথা রেখে বলল,

“আপনার বাচ্চা খুব ভালো লাগে! দেখবেন আমাদের ফুটফুটে সুন্দর একটা ছেলে সন্তান হবে৷”

মীরা নাক টেনে বলল,

“জ্বি না মহারানী! আমাদের ঘরে ফুটফুটে একটা কন্যা সন্তান আসবে৷ আমার কথা মিলিয়ে নিও৷”

“আপনি ভুল জানেন৷ আপনার কথার কোন দান নেই৷ আমার ছেলে সন্তান চাই৷ তার মানে আমার কোল জুড়ে ছেলে সন্তান আসবে৷”

আয়াত চৌধুরী রুমে প্রবেশ করতে করতে বলল,

“ছেলে হোক বা মেয়ে হোক আমাদের একজন হলেই হবে৷ আমার খেলার সাথী চাই৷ যার সাথে সারাদিন খেলা করব৷”

মীরা আহ্লাদী স্বরে বলল,

“ঠিক বলছেন মম৷ আমার যেন ছেলে সন্তান হয়৷ কারণ দাদীদের খুব ভালোভাবে নাতীরা৷”

“এখন ঝগড়া না করে খেতে আসো৷ অনেক রাত হয়েছে৷ তোমাদের জন্য না খেয়ে বসে আছি৷ ২ মিনিটের মাঝে টেবিলে তোমাদের দু’জনকে দেখতে চাই৷”

আয়াত চৌধুরী কড়া গলায় শাসন করে সেখান থেকে প্রস্থান করেন। একে অপরের দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে চাকিয়ে রাতের খাবার খেতে চলে যায়৷ খাবার শেষে আরুশ মীরাকে পাঁজা কোলা করে ছাঁদে নিয়ে আসে৷ পূর্ণিমার জ্যােংসা চকচক থালার মতো নীলাম্বরের জায়গা করে নিয়েছে৷ পূর্ণিমার আলোতে মীরার মায়াবী মুখ ঝলমল করছে৷ মীরা ওষ্ঠদ্বয়ে আরুশ নিজের ওষ্ঠদ্বয় দ্বারা স্পর্শ করে৷ মীরার সমস্ত দেহে ভালোবাসার কম্পন ছড়িয়ে পড়ে৷ খিঁচে আঁখি বন্ধ করে ফেলে৷ লজ্জায় এখনও আঁখি বুঝে রয়েছে৷ মীরার পায়ে নুপুর পড়িয়ে দিল আরুশ৷ হাত ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করে বলল,

“নুপুর গুলো তোমার পায়ে খুব সুন্দর মানিয়েছে৷ তোমাকে একদম পরীর মতে লাগছে।”

মীরা লজ্জায় আরুশের বুকে মুখ লুকায়৷ মীরার সব থেকে নিরাপদ স্থান হলো আরুশের বুকে মাথা রাখা৷ আরুশের বুকে মাথা রাখলে সকল দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায়৷ মীরা লজ্জা মাখা কন্ঠে বলল,

“আমি আপনার উপস্থিতি বুঝতে পারি৷ আমি আপনাকে অন্ধকারের চিনে নিতে পারব৷ আপনার মতো জীবন সঙ্গী পেয়ে আমি খুব খুশি।”

আরুশ আলতো করে মীরাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল৷ মুচকি হেঁসে বলল,

“আমাকে ছেড়ে কোনদিন যাবে না তো৷ আমাকে ছেড়ে গেলে আমি মারা যাব। তোমায় ছাড়া আমি এক মুহুর্তও থাকত পারব না৷”

“আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি কোনদিন ছেড়ে যাব না৷ সব সময় আপনার সাথে থাকব৷ আপনার ছায়া হয়ে আপনার পাশে থাকব৷ একমাত্র মৃত্যু আপনার কাছ থেকে আমায় আলাদা করতে পারবে৷”
_________

হসপিটালের করিডরে পায়েচারী করছে আরুশ, ইহান এবং তাদের মা বাবা বসে আছে৷ সকলেই মীরার জন্য প্রার্থনা করছে। প্রায় ১ ঘন্টা হয়ে গেল তবুও মীরার কোন খুঁজ পাচ্ছে না৷ ঠান্ডা মৌসুমে রীতিমতো ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছে৷ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অপারেশন থিয়েটার থেকে ডক্টর বের হলেন। বের হতে কিঞ্চিৎ দেরি হলেও ডক্টরকে ঘিরে ধরতে দেরি হয়নি৷ আরুশ উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

“ম্যাম মীরা ঠিক আছে তো?মীরার কিছু হয়নি তো? আমি মীরার সাথে দেখা করতে চাই৷”

ডক্টর মুচকি হেঁসে বলল,

” অপারেশন সাকসেসফুল। মা ও মেয়ে দু’জনই সুস্থ আছে। চিন্তার কোন কারণ নেই৷ আমরা অবজারভেশনে রাখব মাকে৷ আপনারা দেখা করতে পারবেন৷ কিন্তু কথা কম বলবেন৷”

ডক্টর একজন নার্সকে ইশারা করে আসতে বলেন৷ কোলে তার ফুটফুটে রাজকন্যা। মাত্র ফুটে উঠা রাজকন্যা। পৃথিবীর আলো তাকে সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছে৷ নার্স বাচ্চাকে আরুশের কোলে তুলে দিল৷ আরুশের চোখে কোণা থেকে দুই ফোঁটা নোনা জল গড়িয়ে পড়ল৷ খুশিতে চোখের কোণে জল এসেছে৷ বাবা হওয়ার অনুভুতি সত্যিই খুব মহান৷ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে৷ পলক ফেলা দায় হয়ে পড়ছে৷ খুশিতে যেন হাত কাঁপছে। তবুও দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে আগলে ধরে রেখেছে মেয়েকে৷

একে একে সবাই মীরার সাথে দেখা করল৷ আরুশ মীরার সাথে দেখা করতে যায়৷ হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে মীরা৷ আঁখি বুঝে রয়েছে৷ মুখে হাজারও চিন্তার ছাঁপ। এক হাতে ক্যানোলায় সেলাইন পু’শ হচ্ছে৷ অন্য হাত সঙ্গী খুঁজার জন্য আসফাস করছে৷ চোখ দেখে বুঝা যাচ্ছে অনেক কান্না করেছে৷ তবুও যেন মা হবার অনুভূতি মীরাকে স্বর্গ সুখ দিয়েছে৷ আরুশ মীরার হাতের উপর আলতো করে হাত রাখল৷ মীরা আঁখি মেলে তাকায়। কথা বলার চেষ্টা করলে আরুশ মীরার ওষ্ঠে আঙ্গুল দিয়ে মানা করে৷ তবুও কাঁপা গলায় বলল,

“আমার মেয়ে কোথায়? আমি আমার মেয়েকে একবার জড়িয়ে ধরতে চাই৷ আমাদের সোনার টুকরো মেয়ে কেমন আছে?”

উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,

“অনেক ভালো আছে। তুমি রেস্ট নাও৷ তোমাকে কাছে নিয়ে আসতেছি৷ তাকে নিয়ে কোন চিন্তা করতে হবে না৷ তার পাশে সবাই আছে৷”
_______
সুখে শান্তিতে কেটে যায় দুইটি বছর৷ মীরা, স্বামী সংসার নিয়ে ভালোই দিন কাটাচ্ছে। কথায় আছে না সুখ মানুষের জীবনে চিরস্থায়ী থাকে না৷ দুঃখ এসে হানা দিতেই হবে৷ অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা চলছে৷ বাহিরে ঝুমঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির জন্য বাসায় ফিরতে পারছে না৷ বেলকনিতে বসে বন্ধুর সাথে আড্ডা দিচ্ছে৷ সাথে আছে আরও অনেকে৷ বন্ধু থাকলে শত্রুর অভাব পড়ে না৷ কোন এক সময় এক বন্ধু প্যাং করার জন্য তাদের নিয়ে কিছু ভিডিও করে৷ কথা এডিট করে পাঠিয়ে দেয় আয়াত চৌধুরীর কাছে৷ যা ঘটার ঘটে যায়৷ মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ার জন্য বাসায় ফিরতে পারছে না৷ এক সময় বাধ্য হয়ে বৃষ্টিতে ভিজে বাসায় ফিরে যায়৷ হাঁচি আসছে শুধু৷ আরুশ রাগান্বিত হয়ে বাসায় ফিরে৷ সকল দিক বিবেচনা না করে মীরার গায়ে হাত তুলে। তার সাথে সংসার করা সম্ভব নয় বলে দেয়৷ সে যদি বাসায় থাকে তাহলে মেয়েকে মেরে ফেলবে৷ ডিভোর্স লেটার মীরার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে৷ ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই মীরা তার মেয়েকে নিয়ে আকন্দপুর চলে যায়৷

আর কিছু মনে পড়ছে না৷ মর্মান্তিক কথা মনে করেই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে৷ কান্না করতে করতে বলল,

“আরু আমিই তোমার বাবা৷ আমি তোমার মা৷ এর বাহিরে তোমার কোন পরিচয় নেই।”

চলবে…….