#প্রেমের_তাজমহল_২
#পর্ব১৯
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
এলোমেলো বিধ্বংস কক্ষ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আসবাপত্রর ধ্বংসাবশেষ। র*ক্তা*ক্ত পুরো মেঝে। জায়গায় জায়গায় ছোঁপ ছোঁপ র*ক্ত লেগে আছে। দেখে মনে হবে কারো র*ক্তের বন্যা বয়ে গেছে। সূর্যের আলো ধরণী হতে বিদায় নিয়েছে বহু পূর্বে। অমানিশায় ছেয়ে গেছে চারপাশ। রাগে ফোঁস ফোঁস করছে অর্ণব। গাঁ বেয়ে ঘাম দর দর করে বেয়ে পড়ছে। পরনের সাদা পাঞ্জাবীতে ছোঁপ ছোঁপ র*ক্তের দাগ। ঘামে ভিজে গাঁয়ের সাথে চিপকে গেছে পাঞ্জাবী। কনুই পর্যন্ত গোটানো পাঞ্জাবীর হাতা। রাগে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে রেখেছে। হাতের প্রতিটা রগ বোঝা যাচ্ছে। মাথায় শিরা গুলো রাগে ফুলে উঠেছে। বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে নিজেকে শান্ত করার জন্য। তবে শান্ত হওয়ার বদলে আরো বেশি অশান্ত হচ্ছে মন। ইচ্ছে করছে সব কিছু তছনছ করে ফেলতে। আগুন জ্বালিয়ে দিতে। সব ধ্বংস করেও অর্ণবের আক্রোশ কমেনি। এখনো রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। ওর থেকে কয়েক হাত দূরে আনায়া ভীতু চোখে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা ভয়ে সিটিয়ে আছে দেওয়ালের সাথে। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। চুল এলোমেলো। বিধ্বস্ত রূপে হাঁটুতে মুখ গুঁজে রয়েছে।
কয়েক ঘন্টা আগের ঘটনা,
আনায়া নিজের ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে লুটিয়ে পড়লো কারো বাহুডোরে। মানুষটার মুখে কুটিল হাসি। মস্তিষ্কে চলছে ধ্বংস খেলা। ঠোঁটের কোণে হাসি বজায় রেখে জ্ঞানহীন আনায়াকে এক ঝকটকায় কোলে তুলে নিলো। অতঃপর এগিয়ে চলল গন্তব্যে।
অর্ষা, রাইহা, দিয়া দাঁড়িয়ে আছে আধ ঘন্টা হবে। এখনো আনায়ার আসার নাম নেই। রাইহা বিরক্ত হয়ে বলল,
“ও কি দেখা করতে গেছে নাক প্রেম লীলা করতে গেছে?”
দিয়া বলল,
“শা*লার দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যাথা করছে। চল তো গিয়ে দেখি কি করছে”
অর্ষাও তাল মিলালো। তিন জন এগিয়ে গেল ক্যাম্পাসের পিছনের দিকটায়। জায়গাটা পুরো জন মানব শুন্য। আশেপাশে কারো অস্তিত্ব নেই। তিনজন এদিক সেদিক খুঁজেও কোথাও আনায়ার অস্তিত্ব পেল না। অর্ষা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
“গেল কোথায়? কেউই তো নেই এখানে?”
“সেটাই তো। গেলে তো আমাদের সামনে দিয়েই যেত”
তিনজনেরই মাথায় চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না। কোথায় খুজবে আনায়াকে? হটাৎ অর্ষার খেয়াল হলো সাদা পাঞ্জাবী পড়া অর্ণব না তো? তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ থেকে ফোন বের করলো। ডায়াল করলো অর্ণবের নাম্বার এ। একদিন কি মনে করে অর্ণবের নাম্বার টা ফোনে সেভ করেছিল সেটা যে আজ কাজে লেগে যাবে ভাবতেই পারেনি অর্ষা। রিং হচ্ছে তবে ফোন রিসিভ হচ্ছে না। দুই বারের মাথায় রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো,
“কে বলছেন?”
অর্ষা বুঝলো এটা তাপস এর কণ্ঠ স্বর। অর্ষা হন্ত দন্ত হয়ে সুধালো,
“অর্ণব ভাইয়া আছে? ওনাকে দিন আমার জরুরি কথা আছে”
“আপনি আগে পরিচয় দিন”
“আমি আনায়ার ফ্রেন্ড অর্ষা”
“আপনি লাইনে থাকুন আমি ভাই কে দিচ্ছি”
অর্ষার টেনশন হচ্ছে। মেয়েটা কোথায় হাওয়া হয়ে গেল। অর্ণবের কাছে ফোন দিলে অর্ণব বলল,
“হ্যাঁ, অর্ষা বলো”
“ভাইয়া আনায়া কি আপনার সাথে?”
অর্ণব অবাক হলো। আনায়া ওর সাথে আসবে কোথা থেকে? ওর তো এখন ভার্সিটি তে থাকার কথা। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো।
“আনায়ার তো এখন ভার্সিটি তে থাকার কথা। ও আমার সাথে আসবে কিভাবে? তুমি কোথায়?”
“আমি ভার্সিটি তে কিন্তু আনায়া কে খুঁজে পাচ্ছি না”
“খুঁজে পাচ্ছি না মানে কি?”
“ও আমার সাথেই ছিলো কিন্তু…”
অর্ষা অর্ণব কে সব খুলে বলল।
“আমরা ভেবেছি আপনি হয়তো আনায়ার সাথে দেখা করতে এসেছেন। কিন্তু ওকে এখন কোথাও পাচ্ছি না ভাইয়া”
অর্ষা কথা গুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেলল। এতক্ষন বহু কষ্টে কান্না আটকে রেখেছিলো। অর্ণব চিন্তিত হলো। মেয়েটা যাবে কোথায়? মাথা কাজ করছে না ওর। আনায়া তো এমন মেয়ে না যে না বলে হুট্ করে কোথাও চলে যাবে।
“আমাকে একটা কথা বলো তো আনায়ার কি ভার্সিটি তে কারো সাথে কোনো ঝামেলা হয়েছে? বা কারো সাথে কোনো ঝগড়া”
অর্ষা ভাবলো তবে তেমন কিছুই মাথায় এলো না।
“না, তেমন কারো সাথে ঝগড়া বলতে… হ্যাঁ মনে পড়ছে। আমাদের ভার্সিটির এক সিনিয়র কে একদিন থা*প্পড় মেরেছিলো”
“থা*প্পড় মারার কারণ”
অর্ষা অর্ণবকে সেদিনের সকল ঘটনা খুলে বলল। অর্ণব শান্ত মস্তিষ্কে সব কিছু শুনলো। অতঃপর অর্ষা কে বলল,
“তুমি বাসায় যাও আমি দেখছি”
কল কেটে গেল। ঘন্টার কাঁটা পেরিয়ে গেছে চার ঘর। এখনো আনায়ার কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। আনায়াদের বাড়িতে কান্নার রোল পড়েছে। আশালতা বেগম কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ছেন খানিক বাদে বাদে। নীলিমা আর আনায়ার চাচি তাকে সামলাচ্ছে। ছোটো মিহিও কাঁদছে। আশরাফ সাহেব বসে আছে সোফার এক কোণে। বড্ড আদরের এক মাত্র মেয়ে তার। তার কিছু হলে কি করবে? আবির, আয়ান গেছে অর্ণবের সাথে। আবির আগে থেকেই অর্ণব এর সাথে ছিলো। অর্ণব কিছু কাজে আবিরকে ডেকেছিল পার্টি অফিসে। দুজন বসে সেই বিষয়েই আলোচনা করছিলো। এমন সময় অর্ষার কল আসে। অর্ণবের মুখে বোনের নিখোঁজ হওয়ায় কথা শুনে দিগ্বিদিক শুন্য হয়ে পড়লো।
সবাই প্যানিক করলেও অর্ণব মস্তিস্ক ঠান্ডা রাখলো। এখন মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে নাহয় পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না। তাপস কে বলল গাড়ি বের করতে। যথা সম্ভব নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো।
গভীর ঘুমে আছন্ন আনায়া। খানিকটা দুর বসে কেউ ওর দিকে জঘন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নিকৃষ্ট তার চোখের চাহনি। গাঁ গুলিয়ে আসার মতো। আনায়া জেগে থাকলে নিশ্চই ফুসে উঠতো । ইচ্ছে হতো গরম সীসা ওই চোখে ঢেলে দিতে।
কেটে গেল আরো ঘন্টা খানেক সময়। আনায়ার মুখে পানির অস্তিত্ব টের পাচ্ছে। চোখ পিটপিট করছে। চোখ খুলে তাকাতে চাইছে তবে চোখ খুলতে পারছে না। মনে হচ্ছে ঘুম ওর চোখের পাতায় জেঁকে বসেছে। কোনো রকমে টেনে চোখ খুলল। চোখ বুলালো পুরো রুমে। আশেপাশে অপরিচিত সব কিছু। মাথা টা ঝিম মেরে আছে। উঠে বসতে নিবে এমন সময় মুখের সামনে নিশান কে দেখে ঘাবড়ে গেল।
“আপনি? আপনি এখানে কেন? এটা কোথায়?”
“হ্যাঁ আমি। আমি ছাড়া আর কে থাকবে বলো পরী? আমি ছাড়া তো তোমার কোনো গতি নেই”
“আমি এখানে কিভাবে এলাম? এটা কোন জায়গা?”
“এটা আমার এলাকা। এখন থেকে এখানেই হবে তোমার বসবাস”
আনায়া নিশান কে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো। আশেপাশে তাকিয়ে রুমের দরজা খোঁজার চেষ্টা করলে। অবশেষে পেয়েও গেল। দরজার লক খুলে টানাটানি করছে তবে দরজা খুলছে না। দূরে দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নিশান। “দরজা বাহির থেকে লক করা চাইলেও খুলতে পারবে না পরী। তোমাকে আমার আস্তানায় বন্দি হয়ে থাকতে হবে”
আনায়া রাগে ফুসে উঠলো। নিশানের কাছে এসে ওর কলার ধরে বলল,
“ভালোয় ভালোয় আমায় যেতে দিন নাহয় ভালো হবে না বলে দিচ্ছি”
নিশান কুটিল হাসি হেসে বলল,
“যেতে না দিলে কি করবে শুনি?”
আনায়া আশেপাশে খুঁজলো। তেমন কিছুই চোখে পড়ছে না। আচমকা চোখ পড়লো বিছানার পাশের টেবিলে ছুড়ি রাখা। আনায়া সেটা হাতে তুলে নিলো। নিশানের গলা বরাবর ধরলো।
“বেশি কিছু করবো না একদম খু*ন করে ফেলবো”
নিশান কথার প্রতি উত্তর করলো না। এক টানে আনায়ার হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে নিলো। অতঃপর ওর হাত মুচড়ে পিছনে ঘড়িয়ে হিস হিসিয়ে বলল,
“কি ভেবেছো প্রতিবার তুমি নিশান আহমেদ কে হারিয়ে দিবে? উহু সেটা মোটেও হবে না। সেদিন ওড়না ধরায় সকলের সামনে চড় মেরেছিলে না? আজ আমি তোমার এমন অবস্থা করবো কাউকে মুখ দেখানোর জো থাকবে না। যেখানে কেউ আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস পায় না সেখানে তুমি আমায় চড় মেরেছিলে। হিসাব তো এখনো বাকি রয়ে গেছে পরী”
নিশান উচ্চ স্বরে হেসে উঠলো। আনায়া কিছু করতে পারছে না। নিশান হাত মুচড়ে রাখায় ব্যথা পাচ্ছে। ওকে তো কিছু একটা করতেই হবে। কি করা যায়? কি করা যায়? আনায়ার মাথায় বুদ্ধি এলো। পা দিয়ে পাড়া দিলো নিশানের পায়ে। ব্যথায় মুখ কুঁচকে আনায়ার হাত ছেড়ে দিলো। আনায়া সাথে সাথে সরে এলো। হাত ঝাড়া দিলো। মুচড়ে ধরায় ব্যথা করছে। নিশান খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আনায়ার কাছে এলো। ওর চুলের মুঠি ধরে বলল,
“কি ভেবেছিস আমার কাছ থেকে মুক্তি পাবি? তোর ভাবনা ভুল। এই সামান্য আঘাতে নিশান আহমেদের কিছুই হয় না। নিজের ধ্বংসের জন্য প্রস্তুত হো”
নিশান আনায়া কে এক ধাক্কায় বিছানায় ফেলে দিলো। একটু একটু করে এগিয়ে আসছে আনায়ার পানে। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে কুৎসিত হাসি। নিশানের চোখের চাহনিতে আনায়ার গাঁ গুলিয়ে আসছে। ও পিছিয়ে যাচ্ছে। পিছনে পিছানোর জায়গা নেই। আনায়ার নিজেকে অসহায় লাগছে। মনে মনে আল্লাহ কে ডাকছে। ও এখন কি করবে? কিভাব রক্ষা করবে নিজেকে এই নর পিশাচের হাত থেকে। ওকে কিছু একটা করতেই হবে। এখানে ওকে রক্ষা করার কেও নেই। বারবার চোখের সামনে অর্ণবের মুখটা ভেসে উঠছে। আনায়া নিজেকে শান্ত করলো। আশেপাশে তাকালো। পাশে রাখা টেবিল ল্যাম্প তুলে নিলো হাতে। নিশান আনায়ার খুব কাছে এমন সময় আনায়া টেবিল ল্যাম্প দিয়ে বাড়ি দিলো নিশানের মাথায়। নিশান ছিটকে অপর পাশে পড়ে গেল। মাথা চেপে ধরে বসে পড়লো। কানের পাশ থেকে র*ক্ত ঝরছে। টপ টপ করে ফ্লোরে পড়ে সাফেদ মেঝে মুহূর্তেই লাল রঙে রাঙিয়ে গেল। নিশান কানের পাশে হাত ছোঁয়ালো। হাতে রক্ত দেখে উন্মাদ হয়ে গেল। ওকে দেখে মনে হচ্ছে ও পা*গল হয়ে গেছে। উচ্চস্বরে হেসে দিলো। হাসতে হাসতে বলল,
“মাথায় আঘাত করে ভালো করলে না পরী, একটু ও ভালো না। এখন এর ফল ভোগ করার জন্য প্রস্তুত হও। তোমার ধ্বংসের প্রহর শুরু হলো বলে, ধ্বংসের জন্য প্রস্তুতি নেও”
#চলবে?
#প্রেমের_তাজমহল_২
#পর্ব২০
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
বিধ্বস্ত অবস্থায় আবিরের বুকে মুখ গুঁজে বসে আছে আনায়া। ভয়ে এখনো খানিক বাদে কেঁপে কেঁপে উঠছে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। রুমের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এখানে তৃতীয় বিশ্ব যু*দ্ধ হয়ে গেছে। আনায়ার সামনে র*ক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে নিশান। প্রায় মৃ*ত অবস্থা ওর। কোনো নড়াচড়া নেই। নিস্প্রান অবস্থায় পড়ে রয়েছে। আনায়া ভীতু চোখে সেদিকে তাকিয়ে আছে। অর্ণব আনায়ার থেকে কিছুটা দূরত্বে চেয়ারে বসে র*ক্তিম চোখে নিশানের দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে এতটা মে*রেও অর্ণবের আক্রোশ মেটে নি। অর্ণব পারলে এখনই নিশানকে জীবিত কবর দিয়ে দেয়। ওর কতো বড় সাহস ও অর্ণব সিকাদারের মায়াবতীর পানে হাত বাড়ায়! তাকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করে? অর্ণবের এক পাশে তাপস দাঁড়ানো। আয়ান গম্ভীর মুখে এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। সবার মাঝে নীরবতা বিরাজমান।
একটু আগের ঘটনা, আনায়া নিশানকে টেবিল ল্যাম্প দিয়ে আঘাত করায় নিশান ছিটকে পড়ে যায়। অতঃপর ফুসে উঠে আনায়ার দিকে দ্বিগুন ক্রোধ নিয়ে এগিয়ে আসতে নেয়। আনায়া পুনরায় প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছো এবার নিশান কাছে এলে সর্ব শক্তি দিয়ে আঘাত করবে। এতে যদি নিশান ম*রেও যায় ওর কিছু যায় আসে না। ওর নিজে কে সেফ করতে হবে। আনায়া এতক্ষনে এটা বুঝে গেছে এখানে ওকে সাহায্য করার মতো কেউ নেই। আর না সিনেমার হিরোর মতো কেউ এসে ওকে বাঁচাবে। তবে মনে মনে কারো আগমনের প্রত্যাশা করছে। নিশান মাথা দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে উঠে দাঁড়ালো। মাথায় আঘাত লাগায় নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। চারপাশ কেমন ভন ভন করে ঘুরছে। এগিয়ে গেল আনায়ার দিকে। আনায়ার হাতে ধরতে নিবে এমন সময় রুমের দরজা ভেঙ্গে ফেলল কেউ। ধপাস করে দরজা নিচে পড়ার শব্দে নিশান সেদিকে তাকালো। অর্ণব, আবির, আয়ান, তাপস এক সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে চার জন্ একসাথে দরজায় আঘাত করেছে। নাহয় এতো মজবুত দরজা ভাঙার কথা না। অর্ণব একবার চোখ তুলে চাইলো আনায়ার পানে। আনায়ার বিদ্ধস্ত অবস্থা। মেয়েটার অবস্থা এলোমেলো। রুমে র*ক্তের অস্তিত্ব। তবে কি অর্ণব আসতে দেরি করে ফেলল? ওর মায়াবতী কে ও রক্ষা করতে পারলো না? অর্ণবের দৃষ্টি আটকালো নিশানের হাতের ওপর। যেটা এখন আনায়ার হাত ধরে রেখেছে। রাগে দপ দপ করে জ্বলে উঠলো অর্ণবের কপালের রগ গুলো। গট গট পায়ে ভিতর ঢুকে এক লাত্থি দিয়ে নিশানকে ফেলে দিলো। হুট্ করে আ*ক্রমণ করায় নিশান নিজেকে সমালানোর সময় পেল না। অর্ণব কোনো কথা না বলে নিশানকে মেঝে থেকে তুললো। অতঃপর শুরু করলো উত্তম মাধ্যম দেওয়া। নিশান পড়ে পড়ে অর্ণবের মার খাচ্ছে। উল্টো আক্রমণ করার শক্তি ওর নেই। মাথায় আঘাত লাগায় এখনো নিজেকে সামলেই উঠতে পারছে না। অর্ণব দিগ্বিদিক শুন্য হয়ে বেধড়ক মে*রে চলেছে নিশানকে। মারছে আর গর্জে উঠে বলছে,
“কু*ত্তার বাচ্চা। তোর এতো বড় সাহস তুই আমার কলিজায় হাত দিস। হা*রামির বাচ্চা তোর ওই কলিজা আজ আমি টেনে বের করবো। অতঃপর কুচি কুচি করে কুকুর কে খাওয়াবো জা*নো*য়ারের বাচ্চা”
অর্ণব হিতাহিত জ্ঞান শুন্য হয়ে পড়েছে। নিশানের অবস্থা নাজেহাল। মুখ ফেটে র*ক্ত বের হচ্ছে। এক পর্যায়ে তাপস অর্ণবকে আটকে ধরলো। অর্ণব রক্তিম চোখে তাকালো তাপসের দিকে।
“তাপস ছাড় আমাকে নাহয় তোকে সহ মা*রবো”
“ভাই ছেড়ে দিন ওকে। নাহয় ম*রে যাবে। তারপর পুলিশ কেস হবে, আরো কতো ঝামেলা”
“তুই আমাকে পুলিশ এর ভয় দেখাচ্ছিস? ওই দুই টাকার পুলিশ অর্ণব সিকদার পকেটে নিয়ে ঘোরে। ওর এতো বড় সাহস ও আমার মায়াবতীর দিকে হাত বাড়ায়? আমার মায়াবতীর দিকে যেi হাত বাড়াবে সে হাত আমি কুচি কুচি করে ফেলবো। তাকে আমি খু*ন করে ফেলবো। এতে যদি আমায় জেলে যেতে হয় তাতেও আমি রাজি আছি। লাগলে জেলে যাবো তাও আমি ওকে খু*ন করবো। মায়াবতীর জন্য জেলে যাওয়া কোনো ব্যাপারই না”
তাপস ব্যর্থ হলো অর্ণব কে আটকাতে। অর্ণব আরো কিছুক্ষন নিশান কে আঘাত করলো। নিশান লুটিয়ে পড়ছে মেঝেতে। অর্ণব উন্মাদের মতো এগিয়ে গেল আনায়ার দিকে। মেয়েটা ভীতু চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। অর্ণব আনায়ার গালে হাত রাখলো। সারা মুখে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ব্যাকুল কণ্ঠে সুধালো,
“মায়াবতী, এই মায়াবতী। কথা বলো আমার সাথে। আমায় বলো ও তোমার কোনো ক্ষতি করছে? ছুঁয়েছে তোমায়?”
আনায়া মাথা নেড়ে “না” জানালো। অতঃপর হাত বাড়িয়ে দিলো। অর্ণব হাত দেখতে লাগলো। কনুইয়ের আশপাশ টা নীলচে বর্ণ ধারণ করেছে। দেখে মনে হচ্ছে কেউ শক্ত করে চেপে ধরেছে। অর্ণবের খানিকটা শান্ত হওয়া রাগ যেন মুহূর্তেই ধপ করে বেড়ে গেল।
“ওই কু*ত্তার বাচ্চা তোমার হাত মুচড়ে দিয়েছিলো?”
আনায়া ইশারায় ‘হ্যাঁ’ বোঝালো। অর্ণব আনায়ার কাছ থেকে উঠে গিয়ে নিশানের হাতের ওপর পাড়া দিয়ে ধরলো। চি*ৎকার করে বলল,
“কোন হাত দিয়ে আঘাত করেছিস আমার মায়াবতী কে? ডান হাত নাকি বাম হাত?”
মুচড়ে ধরলো নিশানের হাত। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তোর যেই হাত দিয়ে ওকে আঘাত করেছিস সেই হাত আমি ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিবো কু*ত্তার বাচ্চা”
নিশান ব্যথায় আর্তনাদ করছে। তবে সেগুলো অর্ণবের কান পর্যন্ত পৌঁছলে তো? ও নিশানকে আঘাত করেই চলেছে। আচমকা অর্ণবের চোখ পড়লো মেঝেতে পড়ে থাকা ছুরির ওপর। সেটা তুলে নিলো হাতে। ছুড়ি দ্বারা আঘাত করলো নিশানের হাতে। হাত কেটে র*ক্ত গড়িয়ে পড়ছে। নিশান গলা কাঁ*টা মুরগির মতো ছট ফট করছে। কিন্তু অর্ণবের হুস নেই। ও উন্মাদ হয়ে গেছে। অর্ণবকে দেখে পুরো সাইকো সাইকো লাগছে। এক পর্যায়ে আয়ান আর সহ্য করতে পারলো না। এগিয়ে গেল অর্ণবের কাছে। ওর হাত থেকে ছুড়ি নিয়ে দূরে ছুড়ে ফেলল। ধমকানো স্বরে বলল,
‘অনেক হয়েছে অর্ণব। আর একটু বাড়াবাড়ি করলে ছেলেটা ম*রে যেতে পারে। শান্ত হও”
অর্ণব আয়ানের কথা ওপর কোনো কথা বলল না। ধপ করে বসে পড়লো এক কোণে রাখা চেয়ারে। মাথার চুল খামচে ধরলো। অর্ণব ভাবতে পারছে না ও আরেকটু দেরি করে এলে কি হতো? কতো বড় সর্বনাশ হয়ে যেত।
পুরো রুম জুড়ে পিন পতন নীরবতা। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। একটু পর পর গোঙ্গানোর শব্দ হচ্ছে। বিকট শব্দে বেজে উঠলো আয়ানের ফোন। পকেট থেকে ফোন বের করে রিসিভ করলো। অপর পাশ থেকে নীলিমা ব্যাকুল কণ্ঠে সুধালো,
“আনায়াকে পেয়েছো?”
“হ্যাঁ পেয়েছি”
“তাহলে তাড়াতাড়ি বাসায় এসো আম্মুর অবস্থা ভালো না। বার বার জ্ঞান হারাচ্ছেন। পা*গলামো করছে”
“আম্মু কে বলো আনায়াকে পাওয়ার গেছে। আমরা আসছি। টেনশন না করতে। আনায়া সহিহ সালামতে আছে”
নীলিমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আয়ান কল কেটে দিয়ে বলল,
“এবার বাড়ি চলো। বাড়িতে সবাই টেনশন করছে”
তাপস আগে বেরিয়ে গেল। অর্ণব আনায়ার দিকে এগিয়ে যেতে নিলে আনায়া আবিরের বুকে আরো কিছু টা গুটিয়ে গেল। অর্ণব বুঝলো মেয়েটা ভয় পেয়েছে। তাই আনায়া কে না ঘেটে বাহিরে চলে গেল। আবির বোনকে নিজের সাথে আগলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তাপস ড্রাইভ করছে, ওর পাশে অর্ণব। পিছনে আয়ান, আবির, আনায়া তিন ভাই বোন। আনায়া এখনো আবিরের বুকে মুখ গুঁজে রয়েছে। মুখ তোলে নি। অর্ণব লুকিং গ্লাসে আনায়ার দিকে তাকিয়ে হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল। গাড়ি চলতে লাগলো আপন গতিতে।
——
আনায়াদের ড্রয়িং রুমে সবাই বসে আছে। অর্ণবের পরিবার ও এসেছে। অর্ণবের বাবা আর আনায়ার বাবা কথা বলছেন। আবির, আয়ান, অর্ণব বসে কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে। মেহনাজ বেগম আশালতা বেগমকে বোঝাচ্ছেন। সান্তনা দিচ্ছেন। আনায়া নিজের রুমে আছে। বাড়িতে আসার পর মেয়েকে বুকে জড়িয়ে আশালতা বেগমের সেকি কান্না। এমনি সময় মেয়েকে বকে রাখেন না আর আজ মেয়েকে ছাড়তেই চাচ্ছিলেন না। ওনাকে দেখে মনে হচ্ছিলো উনি পারলে আনায়াকে বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখেন যেন তার মেয়ের ওপর কারো বদ নজর না পড়ে। খানিক সময় পরে আনায়াকে রুমে পাঠিয়ে দেয়। আনায়া রুমে এসে সোজা গোসলে চলে গেল। শরীর কেমন ঘিন ঘিন করছে। মাথা চক্কর দিচ্ছে। ক্লান্ত লাগছে। ক্লান্তিতে হাত পা ভেঙ্গে আসছে। আনায়া গোসল করে বেরিয়ে দেখলো আশালতা বেগম খাবার নিয়ে ওর জন্য বসে আছে। আনায়ার মলিন মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। আশালতা বেগম যত্নের সাথে মেয়েকে খাইয়ে দিচ্ছেন। আনায়াও তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। বহুদিন পড় যেন এতটা তৃপ্তি নিয়ে খেল। খাওয়া শেষে আশালতা বেগম বললেন,
“তুই শুয়ে পর আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ঘুমালে শরীর ভালো লাগবে”
আনায়া কথা বাড়ালো না। চুপচাপ শুয়ে পড়লো একদম বাচ্চা মেয়েদের মতো। আশালতা বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আনায়া ফিরে গেল ছোটো বেলার সময়টায়। যখন ওর আম্মু ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে ঘুম পারাতো। ক্লান্ত থাকায় কয়েক মিনিটের মাঝেই আনায়া ঘুমিয়ে গেল। আশালতা বেগম মেয়ের শরীরে চাদর টেনে দিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো।
আনায়া গভীর ঘুমে মগ্ন। অর্ণব আস্তে করে ওর রুমের দরজা খুলল। কোনো শব্দ ছাড়া প্রবেশ করলো। কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল আনায়ার মলিন মুখের দিকে। অর্ণবের সেই সময়টার কথা ভাবলেই বুকে মোচর দিয়ে ওঠে। অর্ণব এগিয়ে গেল আনায়ার কাছে। আনায়ার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। কিছু সময় এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল ওর মায়াবতীর পানে। আলগোছে আনায়ার হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিলো। মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিলো। অতঃপর আনায়ার ললাটে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিলো। বেরিয়ে এলো রুম থেকে।
সোফায় বসে আছে সবাই। গম্ভীর পরিস্থিতি। সবাই গম্ভীর মুখে অধির আগ্রহে অর্ণবের পানে চেয়ে আছে। অর্ণব বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু একটা ভাবছে। ভাবনা শেষে মুখ খুলল,
“আমি আপনাদের একটা কথা বলতে চাই”
#চলবে?
#প্রেমের_তাজমহল_২
#পর্ব২১ [বিয়ে স্পেশাল পর্ব]
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
❝আজ এই মুহূর্তে আমি আনায়াকে বিয়ে করতে চাই❞
অর্ণবের কথাটা ছোটো খাটো বিস্ফোরণ ঘটালো সবার মাঝে। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে অর্ণবের পানে। এমন সময় অর্ণবের থেকে এমন কথা আশা করেনি কেউ। যেখানে আনায়ার এমন অবস্থা। ও এক প্রকার ট্রমার মধ্যে আছে সেই মুহূর্তে অর্ণব কিভাবে বিয়ের কথা বলতে পারে? আর বললেও আনায়া কি সেটা মেনে নিবে? রাজি হবে বিয়েতে? ইমতিয়াজ সাহেব আশরাফ সাহেব একে অপরে দিকে দিকে চাওয়া চাওয়ি করছেন। ইমতিয়াজ সাহেব অসহায় দৃষ্টিতে ছেলের দিক তাকিয়ে আছে। এমন সিরিয়াস মুহূর্তে ছেলে তার এমন কথা বলবে উনি সেটা আশা করেনি। অবাকতার সাথে সুধালো,
“বিয়ে?”
“হ্যাঁ বিয়ে। তোমরা যেভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছ মনে হচ্ছে আমি বিয়ে করতে না কারো হাত ধরে পালিয়ে যেতে চাইছি। আরে বাবা ছেলে বড় হয়েছে। ছেলেকে বিয়ে করিয়ে নাতি, নাতনির মুখ দেখবে তা না তুমি বিয়ের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ছো যেন”
ইমতিয়াজ সাহেব বুঝলো এই ছেলেকে ঘটানো যাবে না। ছেলে তার বিয়ে পা*গল হয়ে গেছে এখন বিয়েটা না দিলে তার মান সম্মান এখানেই শেষ! ইমতিয়াজ সাহেব আশরাফ সাহেবের দিক তাকালো। আশরাফ সাহেবের বুঝতে একটুও সময় লাগলো না তার ইশারা। তিনি দোনা মনা করে বলল,
“কিন্তু আনায়া রাজি হবে তো?”
“আনায়ার বিষয়টা আপনি আমার ওপর ছেড়ে দিন আঙ্কেল। ওকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার। আজকের ঘটনার পর ওকে নিয়ে আমি আর কোনো রিস্ক নিতে চাই না”
“ওকে রাজি করাতে পারলে আমাদের তেমন কোনো সমস্যা নেই”
অর্ণবের বুকের ওপর থেকে কিছুটা বোঝা কমে গেছে। ও প্রথমে ভয় পেয়েছিলো এই ঘটনার পরে আনায়ার বাবা- মা বিয়েতে রাজি হবে তো? তাঁদের থেকে সম্মতি পেয়ে খুশি হলো। এখন আনায়া কে রাজি করাতে পারলেই হলো।
আনায়া বিষন্ন মনে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে রাতের আকাশের পানে। কালো মেঘে ঢাকা আকাশ। এক ফালি চাঁদ কালো মেঘেদের মাঝ থেকে উঁকি দিতে চাইছে তবে সফল হচ্ছে না। আনায়ার এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো ওর জীবনটাও তো কালো মেঘে ঢেকে যেতেই নিচ্ছিলো। শেষ মুহূর্তে এসে কালো মেঘ গুলো সরে আলোর উৎস দেখা দিয়েছে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আনায়ার সেই সময়টার কথা ভাবলেও গাঁয়ে কাঁ*টা দিয়ে ওঠে। দম বন্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মস্তিস্ক এলোমেলো হয়ে যায়। জ*ঘন্য সেই অনুভূতি। আনায়া সেসব থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তবে পারছে আর কই! আমরা যেসব স্মৃতি ভোলার চেষ্টা করি কেন যেন সেগুলোই বেশি বেশি আমার মস্তিষ্কে গেথে যায়। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
কক্ষের আটকে রাখা দ্বার খুলে কেউ প্রবেশ করলো। হয়তো আঁধারের মাঝে আলোর অস্তিত্ব নিয়েই তার আগমন ঘটলো। আঁধার কে সরিয়ে আলোয় রাঙিয়ে তোলার জন্য। নিঃশব্দে এগিয়ে গেল কয়েক ধাপ। আশেপাশে খুঁজেও কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটিকে পেল না। অকস্মাৎ দেখা মিললো কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির ওড়নার কোণা। ধারণা হলো তার কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি ব্যালকনি তে আছে। এগিয়ে গেল সেদিকে। পিছনে দাঁড়িয়ে কাশি দিলো। আনায়া নিজ ধ্যানে মগ্ন ছিলো। কারো আগমনে চমকে উঠে ফিরে তাকালো। তবে সামনে দাঁড়ানো মানুষটা কে দেখে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো করলো না। আলগোছে নজর ঘুরিয়ে নিলো। চোখের সমানে ভেসে ওঠলো সেই সময়কার বীভৎস কিছু দৃশ্য। অর্ণবের অমানবিক আচরণ। উন্মাদের মতো নিশানকে আঘাত করার সেই বিভীষিকা ময় দৃশ্য গুলো। আনায়া চোখ বুজে নিলো। মনে করতে চায় না সেসব স্মৃতি। ফোঁস করে দম ফেলল। অর্ণব এগিয়ে এসে আনায়ার থেকে কিছুটা দূরত্ব নিয়ে দাঁড়ালো। আনায়াকে কিছুটা সময় দিলো নিজেকে সামলে নেওয়ার। অতঃপর গলা ঝেড়ে সুধালো,
“এখন কেমন লাগছে? শরীর বেশি খারাপ লাগলে বলো ডক্টর কে ডাকি”
আনায়া ভেবেছিলো চুপচাপ থাকবে। কিন্তু এই লোক ওকে চুপচাপ থাকতে দিলে তো! জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল,
“তার দরকার নেই আমি ঠিক আছি”
“শিওর?”
“হ্যাঁ”
দুজনের মাঝে নীরবতা। আনায়া আকাশের দিক তাকিয়ে আছে। অর্ণব ভাবছে কিভাবে কথাটা বলবে। আনায়া কিভাবে নিবে! রাজি হবে তো ওর মায়াবতী? অর্ণব বুক ভোরে নিঃশ্বাস নিলো। মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দেওয়ার সময়ও ওর এতটা নার্ভাস লাগে না যতটা এখন আনায়ার সামনে লাগছে। এই জন্যই বোধ হয় বলে,
“ছেলেরা দুনিয়ার সবার সামনে বাঘ হলেও শখের নারীর কিংবা বউয়ের সামনে বিড়াল হয়ে যায়”
অর্ণবের অবস্থাও তেমনই হয়েছে। বড় বড় নেতাদের সামনে বুক চওড়া করে রাশভারী কণ্ঠে বক্তব্য দেওয়ার বেলায় সামান্য ভয় হয়না তবে এখন হচ্ছে। এই যে পুচকে একটা মেয়ের সামনে সামান্য কথা বলতে তার বুক ধড়ফড় করছে, হাঁটু কাঁপছে, ভয় হচ্ছে যদি ফিরিয়ে দেয়। অর্ণব সকল ভাবনা বাদ দিলো। গলা খাকারি দিয়ে বলল,
“এটা কথা বলার ছিলো”
“বলে ফেলুন”
“বিয়ে করতে চাই”
“করে ফেলুন। বাঁধা দিয়েছে কে?”
“তুমি”
“আমি? আমি কিভাবে?”
“তোমাকেই তো বিয়েটা করতে চাচ্ছি। কিন্তু তুমি তো রাজিই হচ্ছ না। হ্যান্ডসাম, ড্যাসিং,তাগড়া যুবক এমপি, শত শত মেয়েদের ক্রাশ কে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছ”
আনায়া ভ্রু উচু করে তাকালো,
“আমি কি বলেছি শত শত মেয়েদের ক্রাশ নামক বাঁশ এমপি কে আমার পিছনে ঘুরতে?”
“সেটা বলো নি কিন্তু রাজিও তো হচ্ছ না”
“রাজি হওয়া না হওয়া পুরোটা আমার ইচ্ছে”
অর্ণব কথার পৃষ্ঠে বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না। আনায়া কি ওর কথা গুলো মজা হিসেবে নিলো? মনে তো তাই হচ্ছে। সিরিয়াসলি নিলে উত্তর গুলো এমন হতো না। অর্ণব ফের বলে উঠলো,
“আনায়া আমি কিন্তু সিরিয়াস। মজা করছি না তোমার সাথে। আজ এই মুহূর্তে আমি তোমায় বিয়ে করতে চাই”
আনায়ার কপালে কয়েক টা ভাজ পড়লো। গম্ভীর কণ্ঠে সুধালো,
“করুণা করতে চাইছেন?”
“ভালোবাসতে চাইছি”
“আমার তো মনে হচ্ছে না। ভাবছেন আজকের পর অন্য কেউ মেয়েটা কে বিয়ে করবে না। তার ওপর করুণা করা যেতেই পারে। করুণা করলে কান খুলে শুনে রাখুন আমার আপনার করুণা চাই না”
অর্ণবের রাগ হলো। ও বুঝতে পারছে আনায়া এই মুহূর্তে যা বলছে ভেবে চিন্তে বলছে না। ও এখনো ট্রমার মধ্যে আছে। কিন্তু তাই বলে এসব বলবে! অর্ণব এক টানে আনায়াকে নিজের কাছে নিয়ে এলো। দুজনের মাঝে এক হাত সম পরিমান দূরত্ব। অর্ণব চোখে চোখ রেখে বলল,
“করুণা নয় এটা আমার ভালোবাসা। ভালোবেসে সারাজীবন আগলে রাখতে চাইছি আমার হৃদ কঠোরে, করুণা করে নয়। আমি তোমাকে নিয়ে কোনো প্রকার রিস্ক নিতে চাইনা। আর একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো আমার মায়াবতী পবিত্র, স্নিগ্ধ। সে আমার কাছে সব সময়ই স্নিগ্ধ থাকবে। এই অর্ণব সিকদার বেঁচে থাকতে তার গায়ে কোনো কলঙ্ক আমি আসতে দিবো না, গট ইট”
আনায়া কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলল। নির্বাক ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল অর্ণবের চোখে। মানুষ টা ওকে এতটা ভালোবাসে? ওর বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু এটা তো সত্যি অর্ণব ওকে যথেষ্ট ভালোবাসে। নাহয় লোকটা ওর জন্য একটা মানুষ কে আধমরাই বানিয়ে ফেলেছিলো। পারলে খু*নই করে ফেলতো। শুধু আয়ান বাঁধা দিয়েছে বলে। অর্ণব গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“বিয়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করো একটু পড় আমাদের বিয়ে”
“এই বিয়েতে আমার মত নেই”
অর্ণব যেতে গিয়েও থেমে গেল। পিছু ফিরে বলল,
“মত না থাকলে মত পাল্টাও এখনো অনেক সময় আছে। বিয়ে হবে এবং সেটা আজকেই হবে”
কথা শেষ করে অর্ণব গট গট পায়ে চলে গেল। আনায়া বিড়বিড় করে বলল,
“খ*বিস লোক”
আনায়া নিজের রুমে বসে আছে। এর মাঝে আগমন ঘটলো অর্ষা, নীলিমা এর মিহির। নীলিমার হাতে লাল রঙের বেনারসি শাড়ি সাথে কিছু গহনা। নীলিমা আনায়া কে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিলো চেঞ্জ করে আসার জন্য। নিজ হাতে বোন সমতুল্য ননদ কে শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছে। মিহি খোঁচা মেরে বলল,
“শেষ পর্যন্ত রাজনীতি করা এমপি সাহেব কেই বিয়ে করছো?”
আনায়া বিড়বিড় করে বলল,
“বিয়ে না করে উপায় আছে? যেভাবে হু*মকি দিয়ে গেছে বিয়ে করবো না বললে দেখা যাবে তুলে নিয়ে চলে যাবে। ব*জ্জাত লোক”
“কি বিড়বিড় করছো?”
“হ্যাঁ করছি বিয়ে তাতে তোর কি? তোর পছন্দ হলে বল তোর সাথেই বিয়ে টা দিয়ে দেই”
“আ*স্তা*গফিরুল্লাহ, নাউযুবিল্লাহ। এসব কি বলো? অর্ণব ভাইয়া কে আমি জিজুর নজরে দেখি। আর আমি এখনো ছোটো আমার এখনো বিয়ের বয়স হয়েছে নাকি?”
“কে যেন দুদিন আগে বিয়ের জন্য কান্না কাটি করছিলো? তার নামটা বোধ হয় মি…”
মিহি আনায়ার মুখ চেপে ধরলো। কাকুতি মিনতি করলো নীলিমা অর্ষার সামনে না বলতে। আনায়া ওকে আশ্বাস দিলো বলবে না। মিহি সরে এলো। নীলিমা আনায়াকে সাজিয়ে দিলো। বেশি সাজালো না। শাড়ি সাথে যতো টুকু মানান সই ঠিক তত টুকু। আনায়াকে রেডি করা হলে নীলিমা আর মিহির ডাক পড়লো। বাড়ির আদরের মেয়ের বিয়ে বলে কথা আয়োজন তো করতেই হবে। রয়ে গেছে অর্ষা আর আনায়া। অর্ষা হুট্ করে আনায়াকে জড়িয়ে ধরলো। আনায়া ওকে নিজের সাথে আগলে নিলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুই জানিস আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। যখন গিয়ে দেখালাম তুই নেই পুরো জায়গাটা ফাঁকা তখন আমার মাথা কাজ করছিলো না। বার বার মনে হচ্ছিলো আমি কেন তোকে একা ছাড়লাম। নিজেকে দোষী মনে হচ্ছিলো। আমি আর কখনো তোকে একা ছাড়বো না, কখনো না”
কথা গুলো বলতে বলতে অর্ষা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। আনায়া হতবাক হয়ে গেল। ও ভাবেনি অর্ষা এভাব কান্না করে দিবে। আনায়া অর্ষার পিঠে হাত বুলিয়ে ওকে শান্তনা দিচ্ছে।
“বোকা মেয়ে কান্না করছিস কেন? তুই থাকলেই বা কি হতো? উল্টো তুই থাকলে ওরা তোর ও ক্ষতি করতো। কষ্ট পাস না। এই দেখ আমি তোর সামনে সুস্থ শরীর দাঁড়িয়ে আছি”
অর্ষা আনায়া কে ছেড়ে দিলো। মুখোমুখি দুজন। আনায়া হাত বাড়িয়ে অর্ষার চোখের পানি মুছে দিলো। এর মাঝেই আনায়ার ডাক পড়লো। ওকে নিচে নিয়ে যাওয়ার জন্য ডাকছে। অর্ষা বিছানা থেকে লাল রঙের ওড়না নিয়ে আনায়ার মাথায় দিয়ে দিলো।
“মাশাআল্লাহ ইয়ার তোকে অনেক সুন্দর লাগছে। আজকে দেখবি অর্ণব ভাইয়া ছোটো খাটো হার্ট অ্যাটাক করবে”
আনায়া লজ্জায় লাল হলো। অর্ষা আনায়াকে ধরে নিচে নিয়ে এলো। সোফায় এক পাশে বসিয়ে দিলো। অপর পাশের সোফায় অর্ণব বসা। অর্ণবের পাশে অহনা বসা। আনায়া ওড়নার ফাঁকা দিয়ে আড়চোখে অর্ণবের দিক তাকালো। অর্ণবের পরনে সাফেদ রঙা পাঞ্জাবী। আজকের দিনেও লোকাটাকে সাদা হলো? অন্য রঙ ছিলো না বুঝি? আনায়া চোখ নামিয়ে নিলো।
অর্ণব অধির আগ্রহে বসে ছিলো বউ রূপে আনায়াকে দেখার জন্য। এতক্ষনের অপেক্ষার ফল ওর সামনে। লাল বেনারসি, দু হাত ভর্তি লাল চুড়ি, মুখে প্রসাধনীর ছোঁয়া। সব মিলিয়ে ‘লাল টুকটুকে বউ”। অর্ণব চোখে ফেরাতে পারছে না। সময়ের ব্যাবধানে বিয়ে পড়ানো শুরু হলো। আগে আনায়াকে ‘কবুল’ বলতে বলা হলো। আনায়া চুপ মেরে বসে আছে। কাজী সাহেব আবার বলল। এবারও আনায়ার নড়চড় নেই। আবির এসে বোনের পাশে বসলো। অপর পাশে বসলো আয়ান। দুজন দুপাশ থেকে বোনের হাত ধরলো। ভরসা দিলো ‘কবুল’ বলার জন্য। আনায়া বুক ভরে শ্বাস নিলো। অতঃপর বলে দিলো কাঙ্ক্ষিত শব্দ টি। এবার পালা অর্ণবের। অর্ণব কে বলতে বললে ও এক মিনিটও সময় নিলো না। ফটা ফট বলে ফেলল। অর্ণবের ‘কবুল’ বলার ধারনে পাশে বসা অহনা ফিক করে হেসে দিলো। অহনার সাথে হেসে উঠলো বাকিরাও। সবাই সমস্বরে বলে উঠলো,
“আলহামদুলিল্লাহ”
#চলবে?