#প্রেমের_তাজমহল_২
#পর্ব২৮
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
কোলাহলে পরিপূর্ণ পরিবেশ। বিয়ে বাড়ি বলে কথা! সবাই সবাই ছুটোছুটি করছে এদিক সেদিক। মেয়ে পক্ষের বাড়ি ব্যাস্ততা তো থাকবেই। একটু পড়েই বর পক্ষ চলে আসবে। সবাই আয়োজনে ব্যাস্ত। বাচ্চারা দৌড়া দৌড়ি করে খেলা করছে। মেয়েরা ব্যাস্ত সাজায় আর ছেলেরা ব্যাস্ত কাজে। আনায়াকে ওর ঘরে সাজানো হচ্ছে। ব্রাইডাল সাজ, লাল টুকটুকে রঙের লেহেঙ্গা,দু হাত ভর্তি চুড়ি, গাঁ ভর্তি ভারী ভারী গহনা সব মিলিয়ে পুরো পুতুল পুতুল লাগছে। আনায়ার রুমে মিহি আর প্রিয়া সাজছে। দুজন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। মিহি কাজল পরছে তো প্রিয়া লিপস্টিক। মিহি প্রিয়াকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“প্রিয়ার বাচ্চা সর না। আমাকে কাজল লাগাতে দে, তারপর তুই লিপস্টিক পর”
“তুই পড়ে কাজল পর, আমি আগে লিপস্টিক পড়ে নেই”
কেউ কেউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। দুজন আয়নার সামনে এক প্রকার যু*দ্ধ করে চলেছে। অর্ষা বসে আছে আনায়ার পাশে। আনায়া অনেক বলেও ওকে সাজাতে পারেনি। ওর কথা ও বেশি সাজবে না যেটুকু আছে এটুকুই ব্যাস। এর মাঝেই নিচ থেকে শোনা গেল,
“বর এসেছে, বর এসেছে”
মিহি আর প্রিয়া ছুটলো সেদিকে। অর্ষা বসে রইলো। ওকে বসে থাকতে দেখে আনায়া বলল,
“তু্ই বসে আছিস কেন? তু্ইও যা”
“না রে ভালো লাগছে না”
“তোর কি হয়েছে আমায় বলবি? ইদানিং কেমন অদ্ভুত ব্যবহার করছিস। সারাদিন মন ম*রা হয়ে থাকিস। আগের মতো বাসায় ও আসিস না। আমায় বল কি হয়েছে?”
অর্ষা ঢোক গিললো। আনায়াকে এই মুহূর্তে কিছুতেই সত্যি টা বলা যাবে না।
“আরে তু্ই একটু বেশিই ভাবছিস। জ্বরের কারণে এখন কিছুই ভালো লাগে না। তু্ই এটা নিয়ে বেশি ভাবিস না”
গেটে বেঝেছে তুমুল ঝগড়া। মিহি আর অর্ণবের কাজিন জারিফের মধ্যে। জারিফ ওদের ডিমান্ড মানবে না তো মিহিও গেট ছাড়বে না। দুপক্ষের তুমুল ঝগড়া যাকে বলে। অবশেষে ওদের ঝগড়া থামাতে আগমন হলো আবিরের। বেচারা এতক্ষন খাবারের দিকটায় ছিলো। রান্না ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা সেটা দেখছিলো। একটু আগেই ফ্রেশ হতে গিয়েছে। এসে দেখে এখানে ছোটো খাটো যুদ্ধ বেঁধে গেছে। আবির সমাধান করে দিলো। গেটের ঝামেলা চুকলে বর পক্ষ ভিতরে ঢুকলো।
অর্ণব সেই কখন থেকে অধির আগ্রহে বসে আছে। কিন্তু ওর অপেক্ষা যেন শেষ হওয়ার নামই নিচ্ছে না। পাশে বসা আবিরকে ফিসফিস করে বলল,
“তোর বোন কোথায়? এখনো আসছে না কেন? এতদিন আমায় অপেক্ষা করিয়েও শান্তি হয়নি? আজও সেই অপেক্ষাই করাচ্ছে”
“আরে বেটা এতো উতলা হচ্ছিস কেন? তোর বউ তো কেউ নিয়ে যাচ্ছে না। সবুর কর, সবুরে মেওয়া ফলে”
“আমার মেওয়ার দরকার নেই, আপাতত বউ হলেই চলবে”
আবির অর্ণবের বাহুতে চাপর দিয়ে বলল,
“শা*লা আমি তোর বউয়ের বড় ভাই হই সেটা ভুলে খেয়েছিস?”
“আমি তোর শা*লা না তুই আমার শা*লা”
আবির বিড়বিড় করে বলল,
“কে কার শা*লা সেটা দেখা যাবে”
একটু পড়েই আনায়াকে নিয়ে আসা হলো। লাল রঙের মোড়া রমণী। অর্ণবের চোখ তার মায়াবতীতেই আটকে গেল। মন্ত্র মুগ্ধের ন্যায় চেয়ে রইলো তার শখের নারীর পানে। লাল ওড়নায় ঢাকা মুখশ্রী দেখার জন্য অর্ণবের তর সইছে না। ইচ্ছে করছে সব নিয়ম কানুন বাদ দিয়ে সবাই কে সরিয়ে ও শুধু ওর মায়াবতীর দিকে তাকিয়ে থাকুক। এই মেয়েটার মাঝে আলাদা এক আকর্ষণ আছে। নাহয় অর্ণব কেন ওর আশেপাশে গেলে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। আনায়াকে এনে অপর পাশে বসানো হলো। দুজনের মাঝে ফুলের পর্দা। আনায়া ঘোমটার আড়াল থেকে অর্ণবের দিকে তাকালো। মানুষটাকে নিজের দিকে এভাবে বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে লজ্জা পেল। এই লোক কি এই জীবনেও সুধরবে না? মন বলল ‘না’।
আনায়া অর্ণবরের পূর্বে শরীয়ত মোতাবেক বিয়ে হলেও আজকে আবার বিয়ে পড়ানো হচ্ছে। আনায়াকে আজকে ‘কবুল’ বলতে বললে বেশি সময় নেয় নি। অর্ণব তো ফটাফট বলে দিয়েছে। ওর ‘কবুল’ বলার ধরন দেখে মনে হচ্ছে বেচারার ট্রেন ছুটে যাচ্ছে। এক দফা হাসাহাসি হলো এটা নিয়ে। আনায়ার তো লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার মতো অবস্থা। সেদিন বাড়ির সবাই ছিলো কিন্তু আজ সবার সামনে বেলাজ লোকটা ওর মান সম্মান রাখলো না! কোন দুঃখে যে আনায়ার কপালে এমন বেলাজ লোক জুটলো! এরপর রেজিস্ট্রির পালা। দুজন রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করে দিলো। অর্ণব ফুলের পর্দা সরিয়ে এগিয়ে গেল ওর মায়াবতীর পানে। আলতো হাতে ঘোমটা তুললো। কয়েক সেকেন্ড ‘থ’ মেরে সেভাবেই তাকিয়ে রইলো। ওর চোখ যেন সরতেই চাচ্ছে না। আনায়া এক পলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিয়েছে। অর্ণব শুষ্ক ঠোঁটের স্পর্শ একে দিলো তার মায়াবতীর ললাটে। অতঃপর সরে এলো।
মিহি গেছে আয়না আনতে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাগানের দিকে আসতে নিলে পায়ে মোচর লাগলো। বেচারি আশেপাশে ধরার মতো কিছু না পেয়ে পড়ে যেতে নিলো। ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো মনে মনে ভাবছে এই বুঝি স্বাদের কোমর টা গেল। বিড়বিড় করে বলল,
“মিহি তোর কোমর টা বোধ হয় গেল রে! আম্মু তোমার মেয়ের আর বিয়ে হবে না। তোমার কোমর ভাঙা মেয়েকে কেউ বিয়ে করবে না, আম্মু”
ঘড়ির কাঁটা গড়ালো। শরীরে কোনো আঘাতের অস্তিত্ব টের না পেয়ে মিহি পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো। চোখের সামনে জারিফের মুখশ্রী ভেসে উঠলো। মিহি বাক্কেলের মতো তাকিয়ে রইলো জারিফের দিকে। জারিফ মিহিকে ঠিক মতো দাঁড় করিয়ে দিলো।
“এইযে মেডাম শুধু গলা বাজি করতে জানলেই হবে? নিজেকে ব্যালেন্স করাটাও তো জানতে হবে নাকি?”
থেমে ভালো করে তাকালো মিহির দিকে। অতঃপর বলল,
“যেই বডি হওয়ায় উড়ে যেতে দুই মিনিট সময় লাগবে না। মানুষ এই টুকু হিল পড়ছে দ্বিগুন। বলি কি সামলাতে না পারলে পরে লাভ কি বলো?”
মিহি এতক্ষন চুপ থাকলেও আর সহ্য হলো না। তেজি কণ্ঠে বলল,
“আমি উড়ে গেলে আপনার কি? আপনাকে কেউ বলেছে আমাকে ধরতে?”
“বলা লাগবে কেন? চোখের সামনে সুন্দরী রমণী বেয়ান সাহেবা এভাবে পড়ে যেয়ে কোমর ভাঙবে সেটা তো আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে পারিনা। জিম করে বডি বানিয়ে কি লাভ বলো! যদি সুন্দরী বেয়ান দের পড়ে যাওয়া থেকে আটকাতেই না পারি?”
“ফ্লাট করছেন?”
“উহু! প্রশংসা করছি। এমনিতে আমার আবার দয়ার শরীর”
“দয়া না ছাই। এই সরুন তো সামনে থেকে”
মিহি চলে যেতে নিলে জারিফ পিছন থেকে ডেকে বলল,
“সামলে যেও বেয়ান সাহেবা। আমার গাঁয়ে পড়েছো ভালো কথা অন্য আরো গাঁয়ে যেন না পড়ো”
মিহি জিভে বের করে ভেঙিয়ে দিলো। ওর ভেঙ্গানো দেখে জারিফ হেসে দিয়ে বলল,
“বাচ্চা মেয়ে”
অর্ষা এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। ওর থেকে কিছুটা দূরে আবির বসা। পরনে কালো রঙের পাঞ্জাবী। হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো। ছেলেটা কে কালো রঙের বড্ড সুন্দর লাগে। অর্ষার ইচ্ছে করে শুধুই তাকিয়ে থাকতে। এই যে এখনো যেমন তাকিয়ে আছে। ও জানে মানুষটা ওর হবে না তাও কেন যেন মানতে পারে না। কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করছে মানুষটা কে ভুলে যাওয়ার। মনে মনে এক প্রকার প্রতিজ্ঞা করলো আনায়া শশুর বাড়ি যাওয়ার পর ও আর এ বাড়িতে আসবে না। না মানুষটা কে দেখবে, আর না মায়া বাড়বে। আবিরের পাশে এসে অহনা বসলো। অর্ষা ওদের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো। বিড়বিড় করে বলল,
“আবির ভাই আপনি যে আমার না সেটা আমি বুঝি, কিন্তু আমার মন যে বোঝে না”
তাপস একপাশে দাঁড়িয়ে ফোন কথা বলছিলো। পায়ের সামনে ছোটো একটা ইটের টুকরো পড়ে থাকতে দেখে কি মনে করে সেটায় লাত্থি দিলো। ইটের টুকরো টা যেয়ে পড়লো সোজা অর্ষার পায়ের ওপর। তাপস খেয়াল করে জিভে কামড় দিলো। নিঃঘাত মেয়েটা এখন ওর সাথে ঝগড়া শুরু করে দিবে। তাপস কল কেটে নিজেকে তৈরি করলো অর্ষার ঝাড়ি খাওয়ার জন্য। এগিয়ে এসে মুখটা কাচুমাচু করে বলল,
“সরি! আমি খেয়াল করিনি। আপনি ব্যাথা পেয়েছেন?”
অর্ষা মলিন কণ্ঠে বলল,
“ইটস ওকে। সমস্যা নেই। ব্যাথা লাগেনি”
অর্ষার নমনীয় কণ্ঠে তাপস অবাক হলো। এর আগে মায়েটাকে এতো শান্ত স্বরে কথা বলতে শোনেনি। তাপস খেয়াল করে দেখলো অর্ষার পায়ের যেখানটায় ইটের টুকরোটা পড়েছে সেখানে খানিকটা লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। কিন্তু মেয়েটা বলছে ব্যাথা লাগেনি। এমনি সময় তো পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করে। আজকে কি হলো যে ব্যাথা পেয়েও এতো চুপ। তাপস ভাবলো হয়তো বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তাই মন খারাপ।
“আপনার কি মন খারাপ মিস?”
“তেমন কিছু না”
“মন খারাপ করবেন না। আপনার ফেন্ড তো আর বেশি দূরের যাচ্ছে না। যখন ইচ্ছে হবে দেখা করতে চলে যাবেন”
তাপসের কথা শুনে অর্ষা হাসলো। হাসি বজায় রেখেই সেখান থেকে প্রস্থান করলো।
অর্ণব আর আনায়ার মাঝে আয়নার ধরে রেখেছে মিহি আর প্রিয়া। দুজনের মাঝে উচ্ছাসের শেষ নেই। অর্ণব আনায়া আয়নায় একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। অর্ণবের মুগ্ধ চোখের চাহনি। আনায়া লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিয়েছে। কিন্তু অর্ণব চোখ সরানো তো দূর চোখের পলক ও ফেলছে না। মনে হচ্ছে ধ্যানে বসেছে। মিহি অর্ণবকে জিজ্ঞেস করলো,
“আয়নায় কাকে দেখা যায় জিজু?”
অর্ণবের ঠোঁটের কোণের হাসি চওড়া হলো। হাসি বজায় রেখে বলল,
“আমার মায়াবতী”
সবাই চি*ল্লিয়ে উঠলো। এবার আনায়ার পালা। আনায়াকে জিজ্ঞেস করা হলে একবার অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলল,
“অ*সভ্য পুরুষ”
#চলবে?
#প্রেমের_তাজমহল_২
#পর্ব২৯
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
(প্রাপ্তবয়স্ক-প্রাপ্তমনস্কদের জন্যে)
অবশেষে চলে এলো বিদায় মুহুর্ত । দুঃখ ভরাক্রান্ত পরিবেশ। সবার মাঝেই দুঃখের ছোঁয়া। আনন্দ, উল্লাস শেষে এবার বিদায়ের পালা। আনায়া সেই কখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছে। কান্না থামার নামই নেই। ওর সাথে সবাই কাঁদছে। আশালতা বেগম মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কান্না করতে করতে কিছু কথা বললেন। সাংসারিক জ্ঞান দিলেন। আশরাফ সাহেব মেয়েকে দোয়া করলেন। ওনার চোখে ও পানি। তার একমাত্র আদরের রাজকন্যা পরের বাড়ি চলে যাচ্ছে। আয়ান বোনকে জড়িয়ে মাথায় চুমু একে দিলো। আবিরের সাথে আনায়ার বন্ডিং স্ট্রং হলেও বড় ভাই হিসেবে আয়ান এর কাছে আনায়া আদরের। দুজনের মাঝের সম্পর্কটা একটু দূরত্বের। নীলিমা তো সেই কখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছে। নীলিমার আপন কোনো বোন নেই। বিয়ে হয়ে আসার পর আনায়াকে ছোটো বোনের মতো আদর যত্নে বড় করেছে। ওর প্রতি নীলিমার টানই আলাদা। নীলিমার পাশে দাঁড়ানো নাদিরাকে আনায়া কোলে তুলে নিলো। নাদিরা কান্না করতে করতে আনায়ার গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“ফুপ্পি মনি আজ থেকে কে আমার সাথে খেলা করবে? কে আমায় আম্মুর থেকে লুকিয়ে চকলেট দিবে। আমায় আম্মুর মাইর থেকে বাঁচাবে। তুমি যেও না ফুপ্পি মনি। তুমি যেও না”
আনায়ার চোখের পানি বাধা মানছে না। কান্না করতে করতে বেচারির অবস্থা কাহিল। আনায়া আশেপাশে কাউকে খুঁজছে কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানুষটার দেখা মিলছে না। অতঃপর জিজ্ঞেস করেই বসলো,
“ছোটো ভাইয়া কোথায়?”
“একটু আগেই তো এখানে ছিলো। গেল কোথায়?”
আনায়ার বুঝতে একটুও দেরি হলো না আবির কোথায়? ও যে ইচ্ছে করেই এখানে নেই এটাও আনায়া জানে। আনায়া লেহেঙ্গা দুই হাতে তুলে বাড়ির দিকে চলল। কাঙ্ক্ষিত কক্ষের সামনে এসে থামলো। এক ধাক্কায় দরজা খুলে ফেলল। ও নিশ্চিত মানুষটা এখানেই আছে। আস্তে আস্তে ভিতরে প্রবেশ করলো। অবশেষে মানুষটার দেখা মিললো। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বাগানের দিকে তাকিয়ে অশ্রু ফেলছে আবির। আদরের বোনের বিদায়ের মুহূর্ত সামনে থেকে দেখতে পরবে না বলেই এতো আয়োজন। আনায়া পিছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরলো। আবির অবাক হলো না। যেন ও আগে থেকেই জানতো এটা হবেই।
“তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আর ও দিকে আমি চলে যাচ্ছি সে খেয়াল আছে তোমার? আমি চলে যাচ্ছি ভাইয়া! এখন থেকে আর কেউ তোমায় জ্বালাবে না, তোমায় বিরক্ত করবে না, তোমার সাথে কেউ টিভির রিমোট নিয়ে মা*রা মা*রিও করবে না, পায়ে পা দিয়ে ঝগড়াও করবে না, রাতে আবদার করবে না বাহিরে যাওয়ার। তোমার অগোছালো রুম কেউ বকতে বকতে গোছাবে না। হুটহাট এটা সেটা আবদার করবে না। আমার জন্য তোমায় আম্মুর থেকে বকাও খেতে হবে না। তোমায় জ্বালাতন করা মানুষটা চলে যাচ্ছে ভাইয়া। এখন থেকে তুমি ফ্রি”
আনায়া ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে। আবির আনায়ার দিকে ফিরলো। বোনকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত রেখে কন্দনরত কণ্ঠে বলল,
“আমায় জ্বালাতন করার জন্য হলেও থেকে যা বনু। তুই না থাকলে আমি ঝগড়া, মা*রামা*রি করবো কার সাথে? কার চুল ধরে যখন তখন টান দিবো? কার জিনিস এলোমেলো করবো? কার সাথে টিভির রিমোট নিয়ে মা*রামা*রি করবো? যাস না বনু, যাস না”
দুই ভাই বোনের চোখেই পানি। দুজনই কাঁদছে। এর মাঝে আগমন ঘটলো অর্ণবের। অর্ণব বলল,
“আবিরের বাচ্চা তোর জন্য আমার বউ যদি আর একটু কান্না করেছে তো তোর খবর আছে! শা*লা তোর সাহস তো কম না। তু্ই আমার বিয়ে করা বউ রেখে দিতে চাইছিস?”
“নিয়ে যা তোর বউ। কে ধরে রেখেছে?”
“তু্ই”
“আমি? কিভাবে?”
“এই যে দুই ভাই বোন মিলে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিস”
” তু্ই যা আমি বনুকে বুঝিয়ে নিয়ে আসছি”
অর্ণব চলে গেল। আবিরও আনায়াকে নিয়ে নিচে নামলো। আনায়া কান্না করছে আর বলছে,
‘ভাইয়া আমি যাবো না। তোদের ছেড়ে আমি যাব না”
আবির বুঝিয়ে সুজিয়ে আনায়াকে গাড়িতে বসালো। অর্ণবের হাত হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
“ভাই আমার বোনটাকে দেখে রাখিস। বড্ড আদরের বোন আমার”
অর্ণব ওকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
“তু্ই চিন্তা করিস না। আমি তোর বোনকে আমার মন মহলের রানী বানিয়ে রাখবো”
গাড়ি চলতে শুরু করলো গন্তব্যে। আনায়ার কান্না থামার নামই নেই। অর্ণব আনায়াকে টেনে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো। আনায়ার মাথাটা বুকে চেপে ধরে সান্তনা দিচ্ছে। কিন্তু তাও আনায়ার কান্না থামার নাম নেই। অর্ণব এবার ভিন্ন পন্থা ট্রাই করলো। ফিসফিস করে বলল,
“এখনই সব অশ্রু বিসর্জন দিলে হবে মিসেস? কিছু কান্না রাতের জন্যও জমিয়ে রাখো”
আনায়ার বুঝতে দেরি হলো না অর্ণবের ইঙ্গিত। লাজে রাঙা হলো মুখশ্রী। লজ্জায় মিইয়ে গেল আরেকটু। অর্ণবের বুকের হালকা আঘাত করে মৃদু স্বরে বলল,
“অ*সভ্য পুরুষ”
অর্ণব উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বলল,
“সব পুরুষরাই তাঁদের বউয়ের কাছে অ*সভ্য”
আনায়া কান্না থেমে গেল। ক্লান্ত থাকায় নেতিয়ে পড়লো। মিশে রইলো অর্ণবের বুকে। অর্ণব আলতো হাতে আনায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। খানিক বাদে গাড়ি এসে থামলো অর্ণবদের বাড়ির সামনে। অর্ণব নেমে আনায়ার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। আনায়া ধীরে সুস্থে ভারী লেহেঙ্গা নিয়ে নামলো। আশেপাশে মানুষের ঢল। অর্ণবদের আগে সব গাড়ি চলে এসেছে। ভারী লেহেঙ্গা সামলে আনায়ার অবস্থা বেহাল। অর্ণব সেটা খেয়াল করলো। এক ঝটকায় কোলে তুলে নিলো আনায়াকে। পাশ থেকে জারিফ শিস বাজিয়ে উঠলো। আনায়া লজ্জায় মুখ নিমিয়ে ফেলল।
“আস্তে শিস বাজা আমার বউ লজ্জা পাচ্ছে”
আনায়া লজ্জায় আরো নেতিয়ে গেল। অর্ণব আনায়াকে কোলে নিয়ে গেট পেরিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো। গেটের পাশে বাগানে গুরুজনেরা বসে কথা বলছে। আনায়া তা দেখে ফিসফিস কণ্ঠে বলল,
“আমায় নামিয়ে দিন আমি যেতে পারবো”
“চুপ থাকো”
“আশেপাশে এতো মানুষের সামনে এভাবে কোলে নিয়েছেন তারা কি ভাববে? লজ্জা সরমহীন পুরুষ”
“লজ্জা নারীর ভূষণ পুরুষের নয়। আশেপাশের মানুষ কি ভাবলো সেটা আমার দেখার বিষয় না। আমার বউয়ের সমস্যা হচ্ছে কিনা সেটা দেখা দরকার আমার”
“তাই বলে….”
“তুমি চুপ করো”
আনায়া আর কথা বলল না। এই পা*গল লোককে বুজিয়ে লাভ নেই। যা বুঝবে তাই বৃথা যাবে। অর্ণব বাড়ির ভিতরে গিয়ে একেবারে সোফার সামনে নামালো আনায়াকে। মেহনাজ বেগম শরবত হাতে এগিয়ে এলেন। একটা গ্লাস অর্ণবের হাতে দিয়ে আনায়ার পাশে বসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু কথা বললেন। অর্ণব শরবত শেষ করে গ্লাস মেহনাজ বেগমের হাতে দিয়ে বললেন,
“দেখা হলে আনায়াকে ওপরে আমার রুমে পাঠিয়ে দিও। এতো ভারী লেহেঙ্গা পড়ে থাকতে ওর কষ্ট হচ্ছে। আমি বাহিরে যাচ্ছি”
অর্ণব চলে গেল। অর্ণবদের বাড়িতে তেমন ভীড় নেই। তাও কিছু প্রতিবেশীরা এসেছে বউ দেখতে। কিছুক্ষন পর মেহনাজ বেগম অহনাকে ডেকে আনায়াকে অর্ণবের ঘরে দিয়ে আসতে বলল। অর্ণবের রুম বিশাল। রুমে এক পাশে মাস্টার বেড, বেডের এক পাশে সোফা, টি-টেবিল। অপর পাশে কাবার্ড। কাবার্ড এর পাশে ড্রেসিং টেবিল। বিছানার বরাবর অপর পাশে পড়ার টেবিল। টেবিলের পাশে বড় বুকসেলফ। বুক সেল্ফ এর পাশে বিশাল আলমারি। পুরো গোছালো রুম। আনায়া এই প্রথম দেখলো কোনো ছেলের রুম এতটা গোছালো। স্বভাবত ছেলেদের রুম থাকে এলোমেলো। আনায়া ভাবলো হয়তো বাড়িতে অনুষ্ঠান দেখে গোছানো। অহনাকে জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার ভাইয়ার রুম কি সব সময়ই এমন গোছানো থাকে?”
“হ্যাঁ। আম্মুর পুত্রের অগোছালো রুম পছন্দ না। তার সব কিছু গোছানো পারফেক্ট চাই”
আনায়া যেয়ে ফুলে সজ্জিত বিছানার এক কোণে বসলো। এই ভারী লেহেঙ্গা পড়ে ওর বিরক্ত লাগছে। চেঞ্জ করতে পারলে ভালো হয়। “ভাবি কাবার্ডে দেখো তোমার জন্য শাড়ি রাখা আছে। চেঞ্জ করে নেও। এতো ভারী লেহেঙ্গায় নিশ্চই তোমার কষ্ট হচ্ছে”
আনায়া সায় জানিয়ে এগিয়ে গেল। লাল রঙের জামদানি শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। কিছুক্ষনের মাঝে বেরিয়ে এলো। এখন শান্তি লাগছে। এতক্ষন মনে হচ্ছিলো বস্তা পড়ে বসে আছে। অহনা আর আনায়া মিলে অনেকটা সময় গল্প করলো।
রাত দশটা বাজে। আনায়া ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। শীতল হওয়া বইছে। হালকা ঠান্ডা অনুভব হচ্ছে। অর্ণব সেই যে বেরিয়েছে আর আসেনি। সবার খাওয়া শেষ। আনায়ার খাবার অহনা রুমে নিয়ে এসেছিলো। দুজন একসাথে খেয়েছে। আনায়া ভাবনায় মত্ত এমন সময় দরজার ওপাশে তর্ক বিতর্কের শব্দ পেল। অহনা আর ওর কাজিনরা মিলে দরজার সামনে অর্ণবkকে আটকিয়েছে। অর্ণব কথা বাড়ালো না। রাত অনেক হয়েছে। ওরা যা চাইছে দিয়ে ওদের বিদায় করলো। রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। আনায়া শব্দ পেলেও নড়চড় করলো না। বেচারির মনের মাঝে ভয় জেঁকে বসলো। অর্ণব খেয়াল করলো পুরো রুমে ককারো অস্তিত্ব নেই। রুমের লাইট নিভানো। ড্রিম লাইটের আবছা আলো জ্বলছে। অর্ণব এগিয়ে গেল ব্যালকনি র দিকে। ব্যালকনির দরজার দাঁড়াতেই ওর চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। চোখের সামনে প্রিয়সীর বিধ্বংস রূপ। আনায়ার পরনে লাল জর্জেট শাড়ি, হাতে লাল রঙের রেশমি চুরি। শাড়ির আবরণ ভেদ করে আনায়ার ফর্সা মেদহীন পেট ও কোমর দৃশ্যমান। চোখে গাঢ় কাজল, মুখে অল্প বিস্তর প্রসাধনীর ছোঁয়া। ঠোঁটে গাঢ় লাল রঙের আবরণ। চুড়ির রিনঝিন শব্দ অর্ণবকে খুব করে আকর্ষণ করছে। অর্ণবের হৃদস্পন্দন কিছুক্ষনের জন্য থমকে গেল। প্রিয়সীর লাস্যময়ী রূপ বুকে ঝড়ের সৃষ্টি করছে। অর্ণব ঘোরের মাঝে এগিয়ে গেলো আনায়ার পানে।
আনায়া অর্ণবের উপস্থিতি টের পেল। অর্ণব যতো এগিয়ে আসছে আনায়ার হৃদস্পন্দন ততো বেড়ে যাচ্ছে। মনের মাঝে অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে যাচ্ছে। অর্ণব এগিয়ে এসে পিছন থেকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলো আনায়াকে। অর্ণবের স্পর্শে কেঁপে উঠলো আনায়া। অর্ণব আনায়ার কানের সাথে মুখ মিশিয়ে ফিসফিস কণ্ঠে সুধালো,
“আমায় খুন করার পরিকল্পনা করেছো মায়াবতী? তোমার এই রূপ যে আমার বেসলাম করে তুলছে। আহ্বান করছে প্রণয়ের ধ্বংসলীলার পানে। তোমার সর্বনাশা রূপ আমার বুকে ছুরির মতো বিধছে। তবে সর্বনাশ হলে তো আমি সর্বনাশা হবো না সাথে তোমার সর্বনাশও নিশ্চিত মায়াবতী। আজ পুরোপুরি আমার হবে মায়াবতী”
আনায়া শুকনো ঢোক গিললো। খামচে ধরলো শাড়ি আঁচল। বেচারির গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। অর্ণব আনায়াকে নিজের দিকে ঘোরালো। অর্ণবের ঘোর মাখা চাওনি আনায়াকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। অর্ণব উত্তরের আশায় আনায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। আনায়া কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। লজ্জা, ভয়, সংকোচ সব ঘিরে ধরছে ওকে। আনায়া হুট্ করে অর্ণবকে জড়িয়ে ধরলো।
প্রিয়সীর কাছ থেকে অনুমুতি পেয়ে অর্ণবের মন উচ্চাসিত হয়ে গেল। শক্ত আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নিলো। অর্ণব আলতো করে ওষ্ঠ ডুবিয়ে দিলো আনায়ার লাল রঙা ওষ্ঠে। আনায়াও কোনো বাঁধা দিলো না। অর্ণব অবাধ বিচরণ করছে আনায়ার ওষ্ঠ জুড়ে। তবে আনায়ার রেসপন্স নেই। অর্ণব হাল্কা করে বাইট দিলো আনায়ার ওষ্ঠে। এবার আনায়াও রেসপন্স করছে। কিছুক্ষন পর অর্ণব আনায়ার ওষ্ঠ ছেড়ে গোলদেশে নেমে এলো। অর্ণবের পুরুষালি ওষ্ঠের ছোয়ার ভরিয়ে দিচ্ছে আনায়ার গোলদেশ। অর্ণব আর নিজের মাঝে নেই। ঘোরের মাঝে ডুবে রয়েছে। আনায়া অর্ণবকে থামিয়ে দিলো। অর্ণব ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কোনো সমস্যা? আটকালে যে?”
আনায়া মাথা নিচু করে জবাব দিলো,
“এটা আপনার বেড রুম নয় এমপি সাহেব, এটা ব্যালকনি”
“আগে বললেই পারতে”
অর্ণব এক ঝটকায় আনায়াকে কোলে তুলে নিল। রুমে ঢুকে আলতো করে আনায়াকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। আনায়ার মনে কিছুটা ভয় কাজ করছে। অর্ণব পুনরায় আঁকড়ে ধরলো আনায়ার ওষ্ঠ। অর্ণব রীতিমতো অত্যাচার চালাচ্ছে আনায়ার ওষ্ঠ জুড়ে। আনায়ার তাই মনে হচ্ছে। ওর দম আটকে আসছে। অর্ণব আনায়ার ওষ্ঠ ছেড়ে দিলো। গাঁয়ে থাকা পাঞ্জাবির বোতাম একে একে খুলে ফেলল। পুনরায় ডুব দিলো আনায়ার মাঝে। ধীরে ধীরে দুজন দুজনের মাঝে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। পুরো রুম জুড়ে উত্তপ্ততা। দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। অর্ণবের স্পর্শে আনায়া বার বার কেঁপে উঠছে। রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে গভীর হচ্ছে অর্ণবের ভালোবাসা। আনায়া মাঝে মাঝে গুঙিয়ে উঠছে। অর্ণব বলে উঠলো,
“একটু কষ্ট করে সামলে নাও জান”
#চলবে?
#প্রেমের_তাজমহল_২
#পর্ব৩০
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
রাতের আঁধার কাটিয়ে ধরণী আলোয় আলোয় সেজে উঠছে। নতুন দিনের সূচনা, নতুন অনুভূতি, নতুন পরিবেশ। সকালের মিষ্টি আলো এসে আনায়ার মুখে পড়লে বেচারির ঘুম ভেঙ্গে যায়। পিট পিট করে চোখ খুলে নিজেকে আবিষ্কার করে নতুন এক জায়গায়। এটা কোথায়? ভালো করে খেয়াল করলে মনে পড়লো এটা তো অর্ণবের রুম। পাশে ফিরে দেখলো সেখানে কেউ নেই। জায়গাটা ফাঁকা। তাহলে অর্ণব গেল কোথায়? সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লো নাকি? ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ আসছে। আনায়ার ভাবনার মাঝে খট করে ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজ হলো। আনায়া সেদিকে ফিরে তাকালো। ফর্সা উন্মুক্ত বলিষ্ঠ দেহ, কোমরে সাফেদ রঙের টাওয়াল জড়ানো। লোমস বুকে বিন্দু বিন্দু পানির অস্তিত্ব। ভেজা চুল থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। অর্ণবকে আনায়ার নিকট খুবই আকর্ষণীয় লাগছে। আনায়া শুকনো ঢোক গিললো। অর্ণবের বুক পিঠের দিকে নজর যেতেই আনায়া লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো। লজ্জায় বেচারির গাল লাল হয়ে যাচ্ছে। অর্ণবের প্রশস্ত বুকে, পিঠে লালচে আঁচড়ের দাগ দৃশ্যমান। আনায়া লজ্জায় ফের চাঁদর মুড়ি দিলো। স্মরণ হলো কাল রাতের ঘটনা।
ফজরের আজান দিচ্ছে। অর্ণব মৃদু স্বরে আনায়াকে ডাকছে। কিন্তু ওর ওঠার নাম নেই। এক পর্যায়ে অর্ণব বউয়ের ঘুম ভাঙাতে সফল হলো। আনায়া চোখ খুলে এক পলক অর্ণবের দিকে তাকালো অতঃপর নিজের দিকে তাকিয়ে চাদরের নিচে লুকিয়ে পড়লো। অর্ণব ডাকছে,
“বউ ওঠো। ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে তারপর ঘুমিও”
আনায়া লাজুক কণ্ঠে বলল,
“আমার লজ্জা লাগছে”
“তুমি লজ্জা পাবে বলে নিজের গাঁয়ের পাঞ্জাবী তোমায় এতো যত্নে পড়িয়ে দিলাম এর পরও তুমি লজ্জা পাচ্ছ? ইটস নট ফেয়ার বউ?”
আনায়া নিজের দিকে তাকালো। আসলেই ওর পরনে অর্ণবের সাফেদ রঙা পাঞ্জাবী। বজ্জাত লোক এই কাণ্ড ঘটালো কখন? আনায়া ভালো করেই বুঝতে পারছে বেলাজ লোকটা ইচ্ছে করে জেনে শুনে বারবার রাতের কথা তুলে আনায়াকে লজ্জা দিতে চাইছে।
“আর যদি তাও লজ্জা লাগে বলো। আমি রেডি। পুনরায় লজ্জা ভেঙ্গে দিতে আমার কোনো প্রবলেম নেই”
আনায়া বিড়বিড় করে বলল,
“অ*সভ্য পুরুষ”
অর্ণব চাদর সহ আনায়াকে এক ঝটকায় কোলে তুলে নিলো। আনায়া ঘাবড়ে যেয়ে দু হাতে অর্ণবের গলা জড়িয়ে ধরলো। মনে মনে বকতে শুরু করলো বজ্জাত লোকটা কে।
“আমায় বকার সময় অনেক পাবে এখন ফ্রেশ হয়ে আগে নামাজ পড়ে নেও”
অর্ণব আনায়াকে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। দুজন একসাথে ফজরের নামাজ পড়ে তারপর ঘুমিয়েছে।
——
“শুভ সকাল বউ। উঠে পড়ো। তুমি যে জেগে আছো আমি কিন্ত সেটা জানি”
আনায়া চাদর থেকে মাথা বের করলো। অর্ণব আয়নার সামনে একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। আনায়া কর্কশ কণ্ঠে বলল,
“আয়নার সামনে সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে তাড়াতাড়ি জামা কাপড় পড়ুন”
অর্ণব ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কেন?”
আনায়া লাজুক কণ্ঠে বলল,
“আমার লজ্জা লাগছে”
“আমার তো লাগছে না”
“বেসরম মানুষের আবার লজ্জা আছে নাকি?”
অর্ণব আয়নার সামনে থেকে সরে আনায়ার দিকে এগিয়ে গেল। বিছানার দুপাশে হাত দিয়ে ভর করে ঝুঁকলো। অতঃপর ফিসফিস করে বলল,
“লজ্জা থাকলে এ জীবনে আর বাবা ডাক শোনা লাগবে না। আর এমনিও আমি বাকি সবার সামনেই বেলাজ। আর বউয়ের সামনে তো বেলজা প্রো ম্যাক্স”
অর্ণব চোখ টিপ দিলো। এগিয়ে গেল খানিকটা নিকটে। আনায়ার কপালে, গালে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিলো। মুহূর্তের ব্যবধানে সরে এলো। আনায়া উঠে বসে জিজ্ঞেস করলো,
“আবার শাওয়ার নিলেন যে?”
“সকালে আর রাতে শাওয়ার নেওয়া আমার অভ্যাস”
আনায়া ভেবে পায় না এই ঠান্ডার দিনেও মানুষ দু বেলা কিভাবে গোলস করে? এগুলো কি মানুষ নাকি এলিয়েন? যদিও এখনো তেমন শীত পড়েনি তবে একেবারে নেই তেমনটাও না। গ্রামে এখন কুয়াশা পড়া শুরু করে দিয়েছে। শহরে খুব একটা শীত বোঝা যায় না।
“উঠে ফ্রেশ হয়ে নেও। তারপর একসাথে নিচে যাবো”
আনায়া ফ্রেশ হতে চলে গেল। বেরিয়ে দেখলো এমপি সাহেব পুরো মাঞ্জা মে*রে রেডি। সাদা পাঞ্জাবী পায়জামা। পাঞ্জাবীর হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো। চুলগুলো গুছিয়ে রাখা, হাতে ঘড়ি। সব মিলিয়ে অর্ণব কে যথেষ্ট সুন্দর লাগছে। কিন্তু এই লোকের কি সাদা ছাড়া অন্য পাঞ্জাবী নেই নাকি?
“আপনার কি অন্য রঙের পাঞ্জাবী নেই?”
অর্ণব ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কেন? খারাপ লাগছে? ”
“না! তবে সব সময় দেখি একই রঙের পাঞ্জাবী পড়তে। অন্য রঙ পড়েন না যে”
“এমনি পড়া হয় না। আলমারি খুলে দেখো। যেটা তোমার পছন্দ হয় সেটা দেও। আজ থেকে বউয়ের পছন্দে পাঞ্জাবী পড়বো”
আনায়া এগিয়ে গেল আলমারির কাছে। আলমারির এক পাশ জুড়ে অর্ণবের পাঞ্জাবী। বিভিন্ন রঙের পাঞ্জাবী আছে। তবে এগুলোর মাঝে সাদা সংখ্যা বেশি। আনায়া সব গুলোর মধ্যে থেকে বেছে নীল কালারের পাঞ্জাবী বের করলো। অর্ণবের হাতে দিয়ে বলল,
“এটা সুন্দর আছে। আপনাকে মানাবেও”
অর্ণব আনায়ার হাত থেকে পাঞ্জাবী টা নিয়ে চেঞ্জ করতে নিলে আনায়া চেঁ*চিয়ে উঠে বলল,
“রুমে চেঞ্জ করছেন কেন? ওয়াশরুমে যান”
“না আমি রুমেই চেঞ্জ করবো”
“ঠিক আছে আপনি রুমে চেঞ্জ করুণ আমি বাহিরে গেলাম”
“তোমার যাওয়া লাগবে না আমিই যাচ্ছি। কপাল করে এক খান বউ পেয়েছি। বউ নয় যেন লজ্জায় গোডাউন”
অর্ণব ওয়াশরুমে চলে গেল। আনায়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ে খোপা করে মাথায় কাপড় দিলো। আনায়া চোখে কাজল পড়ছে এমন সময় অর্ণব বেরিয়ে এলো। আনায়া ফিরে তাকালো। নীল পাঞ্জাবীতে অর্ণবকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। ফর্সা শরীরে নীল রঙ ফুটে রয়েছে। আনায়া নজর ঘুরিয়ে নিলো। অর্ণব এগিয়ে এলো। আনায়া কাজল পড়া শেষে অর্ণব কে ওর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ঘুরে দাঁড়ালো। কাছে এসে অর্ণব আনায়ার চোখে চোখ রাখলো। এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল খানিক ক্ষণ। অতঃপর জিজ্ঞেস করেই বসলো,
❝আচ্ছা তোমার ঐ দু চোখে কি আছে বলতো?❞
আনায়া ভাবলো। কই ওর চোখে কিছু নেই তো! থাকার মধ্যে খানিক ক্ষণ আগে চোখে কাজল দিয়েছিলো। আনায়া ক্যাবলাকান্তের মতো বলল,
❝কাজল❞
আনায়ার বোকামোতে অর্ণব উচ্চ স্বরে হেসে উঠলো। আনায়া অবাক চোখে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে রইল। ও এমন কি বলল যে অর্ণব এভাবে হাসছে? এভাবে হাসার মতো কিছু তো আনায়া বলেনি। তাহলে! অর্ণব হাসি থামিয়ে আনায়ার কপালে টোকা দিয়ে বলল,
❝বোকা বউ আমার❞
আনায়া কিছু বুঝলো না। তাকিয়ে রইলো অর্ণবের দিকে। অর্ণব আনায়ার হাত নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে বলল,
“এতো ভেবে লাভ নেই। চলো”
দুজন একসাথে নিচে নামছে। সকাল সাড়ে নয়টা । অর্ণবদের বাড়িতে বৌভাতের অনুষ্ঠান থাকায় অল্প বিস্তর মানুষ এসেছে। বাকিরা বেলা বাড়লে আসবে। ড্রয়িং রুমের সোফায় অহনা, জারিফ, জিয়া বসে গল্প করছে। অর্ণব যেয়ে ওদের পাশে বসলো। আনায়াকে ওর পাশে বসতে বলল। আনায়া মৃদু কণ্ঠে বলল,
“আপনি বসুন আমি রান্না ঘরে যাই। আম্মু একা একা সব করছেন। আমি যেয়ে তাকে সাহায্য করি”
আনায়া এগিয়ে গেল রান্না ঘরের দিকে। মেহনাজ বেগম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তার পিছু পিছু দুজন সার্ভেন্ট খাবার নিয়ে এলো। একে একে সমস্ত খাবার এনে টেবিলে রাখলো। মেহনাজ বেগম এগিয়ে এলেন। বউমার হাত হাতের মাঝে নিয়ে বললেন,
“তোমায় আসতে হবে না মা। রান্না সব শেষ”
আনায়া মন খারাপ করে বলল,
“আমি ঘুম থেকে উঠতে দেরি করে ফেলেছি। আপনাকে একা একা সব কাজ করতে হলো”
মেহনাজ বেগম থুতনিতে ধরে আনায়ার মুখ ওপরে তুলল। কপালে চুমু বসিয়ে দিয়ে বলল,
“কে বলল? আমাকে হেল্প করার জন্য সার্ভেন্টরা আছে তো। তুমি নতুন বউ। এখনই তোমার রান্না ঘরে আসতে হবে না। সবে এসেছো নিজেকে আমাদের সাথে মানিয়ে নেও। সংসার সামলানোর জন্য তো বাকি জীবনটা পড়ে রয়েছে”
আনায়া মনে মনে খুশি হলো। কপাল করে অর্ণবের মতো জামাই আর এমন শশুর বাড়ি পেয়েছে। মেহনাজ বেগম তাড়া দিয়ে বলল,
“এই অহনা, জারিফ, জিয়া খেতে আয়। একটু পর বাড়িতে মেহমান আসা শুরু হবে। তুমিও ওদের সাথে বসে যাও”
“ওরা আগে খেয়ে নেক। আমি আপনার সাথে খাবো”
মেহনাজ বেগম হাসলেন। হাসি মুখে বললেন,
“কালকে খেও। একটু পর সবাই নতুন বউ দেখতে চলে আসবে। পড়ে খাওয়ার সময় পাবে না”
আনায়া ভদ্র মেয়ের মতো সায় জানালো। সবাই একসাথে খেতে বসেছে। মেহনাজ বেগম সবাইকে বেড়ে দিচ্ছেন। আনায়া বসেছে অর্ণবের পাশে। অর্ণব পা দিয়ে আনায়ার পায়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। আনায়া রক্তিম চোখে ওর দিকে তাকালে এমন ভাব করলো যেন কিছুই হয়নি। আনায়া খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।
বেলা বাড়ছে। তার সাথে বাড়ছে রৌদ্রের তাপমাত্রা। সকালে ঠান্ডা অনুভূত হলেও সূর্যের তাপে গরম লাগছে। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে অহনা, আর জিয়ার সাথে বসে আনায়া গল্প করছে। কিছু মহিলা এসেছে নতুন বউ দেখতে। তারা আনায়াকে এটা সেটা জিজ্ঞাসা করছে। আনায়াও ভদ্র মেয়ের মতো তাঁদের কথার জবাব দিচ্ছে। অর্ণব বাগানে গেছে। অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি কেমন চলছে সেটা দেখতে। এমন সময় এলো অর্ণবের ফুপ্পি। মেহনাজ বেগমকে টেবিল গুছাতে দেখে বলে উঠলেন,
“বউ থাকতে এগুলো তুমি করছো কেন ভাবি?”
“ও নতুন বউ। এগুলো করার সময় এখনো পড়ে আছে”
“বউকে বেশি লাই দিও না ভাবি। পড়ে দেখা যাবে মাথায় উঠে নাচবে”
এতো গুলো মহিলাদের সামনে এভাবে বলায় আনায়ার খারাপ লাগলো। চোখের কোণে অশ্রু জমতে শুরু করলো। মেহনাজ বেগম একবার আনায়ার দিকে তাকালেন। মেয়েটার মনের অবস্থা বুঝতে সময় লাগলো না। মেহনাজ বেগম শক্ত কণ্ঠে উত্তর দিলেন,
“বউটা যেহেতু আমার ছেলের, তাহলে সে মাথায় উঠে নাচুক বা আকাশে উড়ে বেড়াক তাতে আপনার কিছু যায় আসার কথা না আপা?”
অর্ণবের ফুপ্পির থোতা মুখ ভোঁতা হয়ে গেল। পুনরায় বলে উঠল,
“আমিতো তোমার ভালোর জন্যই বলছিলাম”
“আমার ভালো নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না আপা”
অর্ণবের ফুপ্পি প্রস্থান করলো। আনায়া তাঁদের কথোপকথন শুনলো। প্রথমে অর্ণবের ফুপ্পির কথায় মন খারাপ হলেও ওর শাশুড়ির জবাবে ওর মনটা খুশিতে ভরে গেল। ভাগ্য করে ও এমন শাশুড়ি পেয়েছে। আনায়া সত্যি অনেক ভাগ্যবতী। মনের মতো একজন জীবনসঙ্গী, মায়ের মতো শাশুড়ি, বোনের মত ননদ, বাবার মতো শশুর কয়জন মেয়ের ভাগ্যে জোটে। আনায়া আবার ওদের আড্ডায় সামিল হলো।
আনায়া রুমে এসেছে। খেয়াল করে দেখলো অর্ণব ঘেমে গেছে। পাঞ্জাবীর হাতায় মুখ মুচ্ছে। আনায়া চট করে নিচে নেমে এলো। সোজা রান্না ঘরে ঢুকলো। আনায়াকে রান্না ঘরে দেখে মেহনাজ বেগম জিজ্ঞাসা করলো,
“কিছু দরকার?”
“আপনার ছেলে গরমে ঘেমে যাচ্ছে। তাই ভাবলাম ওনার জন্য ঠান্ডা এক গ্লাস শরবত বানিয়ে নিয়ে যাই”
মেহনাজ বেগম হাসলো। ছেলের প্রতি বউমার টান দেখে। বেশি কিছু না বলল না।
“ভালো করছো। অন্য কিছু লাগলে আমায় বলো”
আনায়া মাথা নেড়ে সায় জানালো। শরবত বানানো হলে ট্রে তে করে নিয়ে বাগানের দিকে এগিয়ে গেল। বাগানের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে অর্ণব। আনায়া ওর পাশে গিয়ে কাশি দিলো। অর্ণব পাশ ফিরে চাইলো। আনায়াকে দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু লাগবে?”
আনায়া নাকোচ করে বলল,
“দেখলাম গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। তাই আপনার জন্য ঠান্ডা শরবত নিয়ে এসেছি”
অর্ণব আশেপাশে তাকালো। ঝুঁকে এলো আনায়ার দিকে। ফিসফিস করে বলল,
“ঠান্ডা শরবত না এনে টুপ্ করে দুই চারটা চুমুও তো খেতে পারো নাকি? এতে মনে ও ঠান্ডা থাকবে সাথে আমিও”
#চলবে?
(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। পর্বটা কেমন হয়েছে জানাবেন। ধন্যবাদ)