প্রেমের মরা জলে ডুবে পর্ব-২১

0
344

#প্রেমের_মরা_জলে_ডুবে

#তানিয়া

পর্ব:২১

তিমির আর শুভার ধুমসে পড়াশোনা চলছে।নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশটুকুও নেই। আর দুদিন পর পরীক্ষা তার ওপর তিমির শুভার নোটগুলো ফলো করছে কারণ সে ভালো কোনো কোচিং এ এডমিট নেয় নি এতদিন।যদিও শুভ্র বলেছিল তাকে ভর্তি হতে তবে সব কোচিং কোর্স সিস্টেম এখন ভর্তি হলে অযথা টাকা যাবে পড়া হবে না তাই তিমির একেবারে কোনোরকমে টেনেটুনে প্রি টেস্ট দেওয়ার পর ফাইনাল পরীক্ষার জন্য পড়বে ঠিক করলো।এরমধ্যে শুভ্র ঠিক করেছে পরীক্ষা চলাকালীন তিমির শুভার সাথেই থাকবে।কারণ পরীক্ষার প্রশ্ন বিভিন্ন, গার্ড এটা ওটা নিয়ে শুভ্র খুব ব্যস্ত থাকে এ ক্ষেত্রে শুভ্র চাই না তিমির তাকে নিয়ে দুষ্টমি করুক। তাছাড়া দুজনে এক জায়গায় হলেই তিমির যা সব করে তাতে দুজনেরই ক্ষতি হয়।কেননা তিমির পড়াশোনা বাদ দিয়ে শুভ্রকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে যার জন্য তিমিরের পড়াশোনা হয় না।একদিন শুভ্র তিমিরকে মোটা গলায় শুধালো,

তিমির আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যতদিন তোমার পরীক্ষা চলবে ততদিন তুমি শুভার সাথেই থাকবে।কারণ আমার কাছে থাকলে তোমার না পড়া হবে আর না আমাকে কাজ করতে দিবে।তারচেয়ে তুমি শুভার সাথে থেকে গ্রুপ স্টাডি করো এতে ভালো বেনিফিট পাবা।

আজব আমার পড়া তো ভালোই চলছে তাছাড়া আপনার কেনো মনে হচ্ছে আপনার সাথে থাকলে আমার ক্ষতি হবে।আপনিই তো আমার সৌভাগ্য আপনার সংস্পর্শে থাকলে আমার কখনো ক্ষতি হবে না।আমি খুব ভালো করে পড়াশোনা করছি ইনশাআল্লাহ পাশ আমি করবই।

শুধু পাশ করলে হবে না ভালো পাশ করতে হবে।কারণ টেস্টে এলাউ না হলে তুমি পরীক্ষায় বসতে পারবে না এতে আমার সম্মান যাবে

আরে দূর কিছুই হবে না আমি পারব যখন বলেছি তখন পাশ করবই। এখন আমাকে আদর দিন।

শুভ্র একটা শ্বাস ফেললো।সারারাত রামায়ণ পড়ে এখন বলে সীতা কার বাপ।এতক্ষণ যা বোঝালো তার সবটা অগ্রাহ্য করে সে একি কথা নিয়ে তিমির পড়ে আছে।না সম্ভব না তিমির এসবি করবে তারচেয়ে তাকে জোর করে শুভার ঘরে পাঠাতে হবে।যে ভাবা সে কাজ, তিমিরকে শুভার ঘরে জোর করে পাঠিয়ে দিলো তিমির নাছোড়বান্দার মতো সবকিছু করলেও শেষ পর্যন্ত শুভ্রর কথার অমান্য করতে পারলো না।

শুভা তিমিরকে দেখে হেসে কুটি কুটি।

কিরে ননদিনী রায় বাঘিনী এত খুশি কিসের?

এই যে ভাই য়া তোকে উষ্ঠা মে*রে বের করলো সেই খুশিতে।

বাহ্ ভালোই মজা নিচ্ছিস তাই না।যেমন ভাই তার তেমন বোন।যা তোদের ভাই বোনের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলাম।দুজনি আমাকে কষ্ট দিতে মজা পাস।

শুভা এগিয়ে এসে তিমিরকে জড়িয়ে একটা চুমু দিলো গালে।

ওরে আমার ভাই পাগল ভাবি কেমনে বুঝায় তোর সাথে ভাই য়ার খুনসুটি দেখলেই আমার ভালো লাগে।আল্লাহ তোদের এ সম্পর্কটা জিইয়ে রাখুক।ভাই য়া তোর ভালোর জন্য সব করে কেনো বুঝিস না গাধী?আর আমার সাথে আড়ি দিলে না হয় চলবে কিন্তু ভাই য়ার সাথে আড়ি দিলে তুই থাকতে পারবি কি?

খুব পারবো তোর ভাই পারলে আমি নয় কেন?

কারণ ওটা ভাই য়া তুই না?ভাইয়া যা পারবে তুই করতে গেলে তোর এ সরল হৃদয় কেঁদে দিবে।সব কাজ সবার না।আর এমন করছিস কেন,এমনিতেও তোর সাথে কত কথা থাকে সব তো আর মনে থাকে না। রাতে ঘুমানোর সময় সবগুলো মনে পড়লে তোকে পাই না এখন সুবিধা হলো রাতে দুই সই গল্প করবো।

শুভা কালো মুখ করে তিমিরকে এমন করে তার একাকিত্ব বোঝালো যে তিমির হেসেই দিলো।

আগামীকাল পরীক্ষা অথচ তিমিরের কত পড়া বাকি।এতদিন অন্য পড়াগুলো কমবেশি টাচ হলেও ইংরেজিটা তার কম ধরা হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে বেশকিছু প্যারাগ্রাফ, সিভি জমে আছে।পড়া দেখেই তিমিরের কান্না পেলো।শুভ্র দুজনের পরীক্ষার জন্য নিজে গাইড দিচ্ছে কারণ দুই ইবলিশ এক হলে পড়ার চেয়ে আড্ডা বেশি চলে তাই শুভ্র সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরীক্ষা চলাকালীন তারা দুজনে তার কাছেই পড়বে।যেই ভাবা সেই কাজ।দুজনে শুভ্রর রুমে বইখাতা নিয়ে আসে।টেবিলের দুই মাথায় বসে পড়াশোনা করে কথা বলতে গেলে শুভ্রর ধমক খেয়ে পড়া শুরু করে।এভাবে বেশকিছু সময় চলার পর শুভার কল এলে সে বারান্দায় যায় আর তখনি শুভ্র তার পা দিয়ে তিমিরের পায়ে একটা নাড়া দেয়। তিমির পাত্তা না দিয়ে পড়তেই থাকে।শুভ্র আবারও দেয় তিমির ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করে,

কি সমস্যা পা কে বারবার নাড়া দিচ্ছেন কেনো?

তুমিই তো বলেছিলে পায়ের সাথে পা ঘষলে নাকি বাচ্চা হয় তাই একটু দেখছি সত্যি এ পদ্ধতি কাজের কিনা?

এত ঢং না করলেও চলবে।বউকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে পা ঘষাঘষিতে বাচ্চা পয়দা করতে চান কি বুদ্ধি? এসব বুদ্ধি আমার ওপর এক্সপেরিমেন্ট না করলেও চলবে।

তিমির গজগজিয়ে কথা বলে পড়া শুরু করে।শুভাও চলে আসে এরমধ্যে। শুভ্র কথা না বাড়িয়ে চুপ থাকে কারণ তিমির তার ওপর অনেক রেগে আছে। বারবার মানা করার পরও সে তিমিরকে শুভার রুমে পাঠিয়েছে এ অভিমানে তিমির শুভ্রর সাথে ভালো করে কথাও বলে না।

দুজনের পড়ার চেকিং শেষ করে খাওয়া দাওয়া করে শুভ্র বিছানায় গা এলাতেই দরজায় টোকা পড়ে। শুভ্র ভেবেছিল হয়তো মা এসেছে কিন্তু দরজা খুলে দেখে তিমির।আসলে তখন যেভাবে শুভ্রকে কথা শোনাল তিমির এরপরও যে তিমির আসবে এটা কল্পনা করে নি শুভ্র।

তিমির তুমি হঠাৎ এত রাতে?

আপনার সাথে থাকবো বলে এসেছি, সরুন ঘুমাবো?

শুভ্রকে ঠেলে তিমির ঢুকে সটান বিছানায় শুয়ে গেলো।শুভ্র আরকিছু বললো না কারণ এমনিতেই তিমির তার ওপর রেগে আছে যদি কোনো সমস্যা করে আবার তাই সে আর কোনো কথা বললো না।শুভ্র নিজের জায়গায় গিয়ে ঘুমোতে গেলো।তিমির বুঝলো একটু আগে বলা কথাগুলো শুভ্রর গায়ে লেগেছে তাই সে চুপচাপ তাকে সম্মতি দিয়েছে এখানে থাকার।তিমির হুট করে শুভ্রর বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।

আরে আরে কি করছো কি তুমি,বালিশে ঘুমাও?

না বালিশটা খুব শক্ত আর শক্ত বালিশের জন্য মাথার পড়া সব ভ্যানিশ হয়ে যাবে।তাই আপনার বুকে শুয়েছি যাতে আপনার বুকে জমানো পড়া আমার মাথায় স্থানান্তরিত হয়।আর যদি আপনি চান আপনি ফেল্টুস বউয়ের জামাই হবেন তাহলে সরে যেতে পারি কারণ আপনার বউ ফেল করবে তাতে নিশ্চয়ই আপনার গর্ব হবে না?

শুভ্র জানে এ মেয়ের সাথে কথায় পারা যাবে না তাই তিমিরের কথা মেনে নিয়ে ঘুমিয়ে গেলো।

তিমির শুভা দুজনে আল্লাহর নাম জপ করছে কারণ আজ পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে।শুভা আর তিমিরের দুজনের পরীক্ষা মোটামুটি ভালো হলেও তিমিরের আইসিটি একটু খারাপ হয়েছে কারণ এ বিষয়ে কোথাি না পড়াতে সে ভালো করে অংকগুলো বুঝতে পারে নি।তাছাড়া সারাবছর পড়ালেখা থেকে দূরে থেকে পরীক্ষার আগে পড়তে গেলে যা হয় তাই করলো তিমির।এখন আল্লাহ ভরসা।কলেজ গিয়ে নোটিশ বোর্ড চেক করলো।এখনো রেজাল্ট ঝুলাই নি।প্রায় আধঘন্টা পর রেজাল্ট দিতে শুভা এগিয়ে গেলেও তিমির ভয়ে যায় নি।যদি ফেল দেখে তাহলে শুভ্র তাকে শাস্তি দিবে।রেজাল্টের চেয়ে শুভ্রর শাস্তিটা মনে করতে হাত পা অসাড় লাগলো তিমিরের। শুভা মুখ কালো করে এগিয়ে এসে নিজের রেজাল্ট জানালো।সে এ মাইনাস পেয়েছে। তিমির নিজেরটা জানার জন্য অধীর আগ্রহে চেয়ে আছে শুভার পানে। কিন্তু শুভা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো,

তিমির তোর রেজাল্ট ভালো না রে,তুই

শুভা মাথা নিচু করে নাক তুললো।তিমির কান্না করবে করবে এমন অবস্থা ঠিক তখনি শুভা হেসে দিলো

ভাবি জি আপনি পাশ করেছেন কিন্তু পাশটা একদম টেনেটুনে। ফেল করতে গিয়ে পা পিছলে পাশটা দিয়ে দিয়েছে।

তিমির শুভার কথা শুনে শুভার পিঠে এক ঘা লাগালো।তখনি প্রিন্সিপাল স্যার এসে জানালো এইচএসসি ব্যাচের সকল স্টুডেন্টকে নিয়ে পিকনিকে যাওয়া হবে।সেটা শুনে তিমির শুভা দুজনে হইহই করা শুরু করলো।

পিকনিকের জন্য বাধ সাধলো শুভ্র কারণ তিমিরের রেজাল্ট দেখে সে এতটাই রেগে গেছে যে সোজা জানিয়ে দিয়েছে শুভা বা তিমির কেউ পিকনিকে যেতে পারবে না।শুভা তো কান্নাকাটি করে একাকার। ইন্টার জীবনের শেষ একটা ভালো মুহুর্তে সে যাবে না এটা মানতে নারাজ সে।নিপা মেয়ে আর বউয়ের বিষয় ্টা নিয়ে শুভ্রর সাথে কথা বললে সে শুনতে চায় না।অবশেষে জিন্নাহ সাহেবকে জানালে শুভ্র বাবার কথা অমান্য করতে পারে না।

পিকনিক স্পট হিসেবে গোপালগঞ্জ ঠিক করা হয়।বঙ্গবন্ধুর বাসভবন সেই সাথে আশেপাশের ঐতিহাসিক এলাকাগুলো ভ্রমণ নিয়ে একটা লিস্ট করা হয়।সকালে গোপালগঞ্জ পৌঁছে তারা আগে অন্য জায়গা গুলো ঘুরতে যায়। এরমধ্যে শুভার সাথে শুভ্রর কথা হলেও তিমিরের সাথে কোনো কথা বলেনি।শুভ্র তিমিরের ওপর খুব ক্ষেপে আছে সেটা তিমির জানে কিন্তু কথা না বলে থাকার বিষয়টা তাকে কষ্ট দিচ্ছে। এরমধ্যে কয়েকটা বোটে করে সবাই শাপলা ভরা ঝিলে বেড়াতে নামলো।শুভা তিমির এক বোটে শুভ্র ভিন্ন এক বোটে।শুভ্র দুজনের দিকে নজর রাখছে কারণ সে জানে এক জায়গায় হলে ট দুজনের বাঁদরামি বেড়ে যায়। তাই সে শুভাকে বারবার বোটের মাথা থেকে সরে আসতে বলছে সেই সাথে শুভাকে ইঙ্গিত দিলো যাতে তিমিরকেও নিয়ে আসে।কিন্তু তিমির তো তিমিরই সে বোটের মাথায় গিয়ে কিছু দূরে একটা শাপলার দিকে হাত বাড়াতপ পা ফসকে ঝপাং করে পড়লো পানিতে।আর পানির আওয়াজ শুনে সবাই তাকাতে দেখে তিমির পানিতে ঝাপটা ঝাপটি করছে।শুভ্র নামতে গেলে তার আগে এক বোট চালক নেমে তিমিরকে তুললে শুভ্র টেনে বোটে শোয়াই দেয়।তাড়াতাড়ি তিমিরের পেট থেকে পানি বের করতে তিমির চোখ গুলো আধো খোলা আধো বন্ধ অবস্থায় রাখে।

কিছু সময়ের জন্য সবাই হোটেল বুক করে সেখানে তিমিরকে রাখা হয়।শুভ্র তিমিরকে দেখবে বলে সবাই ্কে ঘুরতে পাঠিয়ে দেয়।তিমির তখনো হুঁশে আসে নি পুরো।শুভ্র মাথার কাছে বসেছিল।ডাক্তার এসে কিছু ঔষধ দিলে আর লেবু পানি খাওয়ালে পেটের বাকি পানি বের হয়ে যায়। পেট খালি হওয়াতে তিমির দূর্বল অনুভব করছে তবুও চোখ খুলতে শুভ্র ্কে দেখে হাসলো।

আপনি যান নি ঘুরতে?

না এখন কেমন লাগছে।

ভালো। তা আমার জন্য আপনার ঘোরাটা কেনো বন্ধ রাখবেন, ঘুরে আসুন এমনিতেও আমার সাথে তো আপনি কথা বলেন না।তাহলে এত গুরুত্ব দিচ্ছেন কেনো?

তিমির বেশি কথা বলো চুপ থেকে শুয়ে থাকো।

শুয়েই তো আছি যদি বলতেন চুপ থেকে উঠে বসো তাহলে আপনার কোলে বসার সুযোগ পেতাম।হি হি হি।

এমন একটা বিপদের মুখে পড়েও ভয় লাগে না তোমার। আল্লাহ তোমার ভয় কই রাখছে?

কোথাও রাখেনি আমার যা ভয় সব আপনাকে নিয়ে কারণ আমি নিজের চেয়ে আপনাকে ভালোবাসি নিজের ক্ষতি হলে সইবো কিন্তু আপনার হলে ম*রেই যাবো।

তিমির??

চোখ রাঙিয়ে ধমক দেয় শুভ্র।

ভয় পাচ্ছেন কেনো এত তাড়াতাড়ি ম*রবো না।শুনুন আমি জানি আমার রেজাল্টে আপনি কষ্ট পেয়েছেন।আমি কথা দিচ্ছি বোর্ড পরীক্ষায় আমি ভালো রেজাল্ট করবো।আমি সবটা দিয়ে পড়াশোনা করবো কিন্তু আপনাকে কথা দিতে হবে আমার রেজাল্ট ভালো হলে আমি যা চাই তাই দিবেন।

তিমির সব পরে দেখবো এখন অন্তত চুপ থাকো।তুমি দূর্বল আছো পরে কথা বলবো?

আচ্ছা জানতে চান না পরীক্ষায় পাশ করলে কি চাইবো?

শুভ্র এবার নিজেই ক্লান্ত হলো এতবার চুপ থাকার কথা বলেও এ মেয়েকে ক্ষান্ত করা গেলো না তাই সে চেয়ে রইলো বাকি কথা শুনার।

কি বিরক্ত হচ্ছেন,ওকে পুরস্কারটা আমি বলেই চুপ হবো।আমি একটা বাচ্চা চাই খুব ফুটফুটে আর ফটফটে বাচ্চা যে দেখতে হবে আপনার মতো আর স্বভাব হবে আমার মতো।কারণ আপনি মানুষটা সুন্দর আর আমি মানুষটা চঞ্চল দুজনের সমন্বয়ে একটা সুন্দর মিষ্টি বাচ্চার মা হলে মন্দ হয় না তাই না?

শুভ্রর উত্তরের আশা না করে তিমির হেসে দিলো, সেই সাথে কান্না। শুভ্র অবাক হয়ে দেখলো এ মেয়ের অপরূপ সৌন্দর্য যে কিনা হাসির সাথে সন্ধি করে কান্নাকে নিমন্ত্রণ দেয়!
,
,
,
চলবে………