ফরগেট মি নট পর্ব-১৪

0
20

#ফরগেট_মি_নট
#রক্তিমা(লেখনীতে)
১৪.
বাহুবন্ধনে মানব-মানবী!দৃষ্টি একে-অপরের চক্ষুপানে।তেজপূর্ণভাবে তাকিয়ে আছে মৃত্তিকা।আচনকা কল্পনাতীত বজ্রপাতে পিলে চমকে উঠে তার।ভয়ে তার দেহ অনিচ্ছাকৃতভাবে আরো ছিটিয়ে যায় দর্শনের সাথে।আলগোছে হাসে দর্শন।মৃত্তিকাকে চেপে ধরে শক্ত করে।বাহিরে তখন ঝড়ের আনাগোনা।এমনি এক ঝড় কি বয়ে গেল মৃত্তিকার মানস্পটে?গেল বোধয়!

দর্শনের বাহু থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে মৃত্তিকা।এবং তাতে সফলও হয়।ভুল বলা হলো হয়ত!দর্শন স্বইচ্ছায় ছেড়ে না দিলে সেই বন্ধন ভাঙার সক্ষমতা মৃত্তিকার নেই।ছাড়া পেয়ে দুকদম এগোতেই পুনরায় পেছন থেকে টান অনুভব করে মৃত্তিকা।চোখ বড়বড় করে দর্শনের দিকে তাকায় সে।শক্ত কন্ঠে বলে উঠে,

“এসব কি হচ্ছে?”

“টানাটানি!”

স্বাভাবিক উত্তর দর্শনের।মৃত্তিকা চোখ খিঁচে নেয়।দর্শনের ছোঁয়ায় তার ঘৃণা ও অন্য এক অনুভূতি মিশ্রিত।
বাইরে তখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে।শীতের শুরুতে অপ্রত্যাশিত বর্ষন!এমনিতেই দর্শনের রুমের টেম্পারেচার সবসময় অধিক শীতল করে রাখে সে।তারপর এখন বাইরের শীতলতা রুমের ভেতরটাকে আরো শীতল করে তুলছে।মৃত্তিকা চোখ বুঁজে,মৃদু কাঁপন ধরেছে তার দেহে।
দর্শন মৃত্তিকাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছে।ওষ্ঠদ্বয় মৃত্তিকার কানের নিকট নিয়ে একটা শুকনো ঢোক গিলে সে।তারপর ফিসফিসয়ে বলে উঠে,

“তোমার ঘৃণার পরিমাণ আরেকটু বাড়াতে ইচ্ছে করছে!আরেকটু বাড়াই কেমন?যাতে ইহ জনমে আমাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা তুমি স্বপ্নেও ভাবতে না পারো!”
.

রাতের ঘোর অনামিশা কাটিয়ে নিত্য নিয়মে সূর্য পূর্বদিকে উদিত হয়ে তার কর্তব্য পালনে নিযুক্ত হয়েছে।শীতের মৌসুম হওয়ায় সকালের রোদ একটুকরো সুখের মত লাগছে।পথে পথে থাকা মানব,পশুরা রোদ পোহাচ্ছে সানন্দে।বাইরে থেকে কিছুক্ষণ দৌড়ে এসে সদর দরজায় পৌঁছাতেই দর্শনের শ্বাস দ্রুত হয়।হাঁটুর উপর দুহাত রেখে শ্বাস ফেলে দর্শন।বাড়িতে তখন ডেকোরেশনের লোক পৌছে গেছে।আভিজাত্যে পূণ বাড়িতে আরো আর্কষনীয় করা হচ্ছে।দোতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় বাড়িটিকে ভ্রু কুঁচকে পর্যবেক্ষণ করে মৃত্তিকা।পরণে কৃষ্ণ বর্ণের শাড়ি।আঁচল সেট করে কাঁধে পিন দিয়ে আটকানো।হাঁটার দরুন ফর্সা উদর উন্মুক্ত হচ্ছে মাঝে মাঝে।মৃত্তিকাকে আসতে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায় দর্শন।পরনে ব্যাক হুডি,ব্লু জিন্স।ঘামের দরুন কপালের চুল ভেজা লাগছে!আরো স্নিগ্ধ লাগছে সুদর্শন মানবটিকে।মৃত্তিকা দর্শনের নিকটে এসে বিরক্ত চোখে তাকায়।জিজ্ঞেস করে,

“কোন দূঃখে বাড়ির এই সাজসজ্জা?”

কথাটা বলেই কপাল ভাজ করে মৃত্তিকা।দর্শন কৃত্রিম হা-হুতাশ করে বলে,

“আপনার পরম শত্রু আজ সকলের সামনে গলায় দড়ি দিবে।”

মৃত্তিকার কুঁচকানো ভ্রু আরো কুঁচকে আসে।দর্শনের কৃত্রিম প্রতিক্রিয়াও বাস্তব মনে হচ্ছে।কিন্তু মৃত্তিকা এই সম্পর্কে জ্ঞাত যে এটা শুধুই চোখের ধোঁকা।
পরক্ষণেই শক্ত স্বরে বলে উঠে,

“কালকের কথা তুমি ভুলে গেছো হয়ত।সত্য বলো আমাকে।নয়ত…”

“চুমু খাবে?”

কথাটা খানিক উচ্চস্বরে হওয়ায় মৃত্তিকা ইতস্তত বোধ করে।কাজে আসা লোকগুলো আড়চোখে তাকায়।দর্শন পকেটে হাত পুরে মিটিমিটি হাসে।মনে করে কালকে রাতের সেই দৃশ্য।

নিজের কথা সমাপ্ত করে দর্শন মৃত্তিকার কাধে ওষ্ঠ ছোঁয়ায়।মুহুর্তেই মৃত্তিকা সামান্য কেঁপে তড়িৎ বেগে সরে আসে।পাশেই থাকা একটা ছোট ফুলদানি নিয়ে ঠাস করে মারে দর্শনের মাথায়।মৃত্তিকার এমন বিরুপ আচরণে বর বড় চোখে তাকায় দর্শন।মৃত্তিকা নাকের পাটা ফুলিয়ে ফুসতে ফুসতে জানিয়েছিল এমন কিছু করার চিন্তা দ্বিতীয়বার দর্শনের মাথায় এলে মাথাটাই ফাটিয়ে দিবে সে।

দর্শন সেই দৃশ্য থেকে বেটিয়ে আসে মৃত্তিকার কথায়।ইস কি ঝাঁঝালো সে স্বর!

“অসভ্য লোক!আমার কথার উত্তর সোজাভাবে দাও।”

হুহ!দর্শন সোজা লোক হলে তবে তো!কোন প্রকার উত্তর না দিয়ে সে শীষ বাজাতে বাজাতে সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হয়।পেছন থেকে রুষ্ট চোখে তাকিয়ে রয় মৃত্তিকা।
সিঁড়ির মাঝে এসে দীপনের সাথে সাক্ষাৎ হয় দর্শনের।দীপন অতি শান্ত স্বরে জানায় বাবা তাকে রুমে যেতে বলেছে।কথাটা না শোনার মতো করে এভয়েড করে দর্শন পুনরায় শীষ বাজাতে বাজাতে নিজের রুমের পানে পা চালায়।দর্শনের এরুপ গা ছাড়া ভাব দেখে গা জ্বলে উঠে দীপনের।
রুমে ঢুকেই শাওয়ার নেয় দর্শন।তারপর ফোন লাগায় রাফিনের নাম্বরে।গাধাটার এতক্ষণে তার সামনে হাজির হওয়ার কথা ছিল না?
আরো কিছু সময় ব্যয় করে রুম থেকে বেরোয় দর্শন।মৃত্তিকাকে চোখে পড়ছে না আর।কোথায় গেল?

ভাবনা সহ গুটানো কপাল নিয়েই বাবার রুমে প্রবেশ করে দর্শন।দানিশ মির্জার হাতে তখন একটা মরণাস্র।কিন্তু ছেলেকে আসতে দেখেও তার কোন ভাবালেশ হয় না।বরং সেটা নেড়েচেড়ে সন্তর্পণে ড্রয়ারে রেখে দেন দানিশ মির্জা।বাবার এই কান্ডে দর্শনের মনোযোগ নেই বললেই চলে।দর্শনকে বসতে বলে নিজে একটা চেয়ারে বসে পরেন দানিশ মির্জা।কারুকাজ খচিত দামি চেয়ার।বাবার আদেশ অমান্য করে দাড়িয়ে রয় দর্শন।এখন তার পরনে কৃষ্ণবর্ণের শার্ট,যার হাতাটা ফোল্ট করে রাখা।হাতদুটে পকেটে পুরে দর্শন গম্ভীর আওয়াজে বলে উঠে,

“আমাকে ডাকার কারণ?”

দর্শনের দিকে গাঢ় চোখে তাকায় দানিশ মির্জা।তারপরই উনার ওষ্ঠকোণে সুক্ষ্ম এক হাসি ফুটে উঠে।তিনি বলে উঠেন,

“তোমাকে যতটা বোকা মনে করেছিলাম তুমি তার থেকেও অধিক চতুর,মাই সন!”

বাবার কথার ইঙ্গিত ধরতে পেরে অদ্ভুত এক হাসি ফুটে দর্শনের ঠোঁটে।দানিশ মির্জা ফের বলে উঠেন,

“যতদূর বোঝা গেল ইরফানের মেয়ে তোমাকে বিয়ে করতে রাজি ছিল না।জোর করে বিয়ে করেছো তুমি!সেটা ব্যাপার না।এখন চেষ্টা কর তাকে বশে আনার।এতে তারই মঙ্গল!”

“তার কিসে মঙ্গল সেটা আপনাকে ভাবতে হবে না ড্যাড।আপনি কিভাবে তার ক্ষতি করতে পারেন সেটা ভাবুন নাহয়!কেননা আপনি যেটা ভেবে ওর উপর চালানো সমস্ত ষড়যন্ত্র তুলে নিচ্ছেন সেটা বোধহয় আর হবে না।”

দর্শনের কথা অতি স্বাভাবিক কিন্তু এতেই দানিশ মির্জার মুখে লেগে থাকা চওড়া হাসিটা কর্পূরের ন্যায় উবে যায়।
দর্শন ফের বলে,

“মৃত্তিকাকে সরল মনে হয় আপনার?কিংবা যা হয়েছে তা হয়েছে এমন মনমানসিকতার?”

কথাখান বলে হেসে ফেলে দর্শন।

“ড্যাড জাস্ট ইমাজিন সেই ভিডিও ফুটেজ একবার যদি মৃত্তিকার কাছে পৌঁছায় তবে…?আশা করে আপনি বুঝতে পেরেছেন!”

হঠাৎ শক্ত হয়ে উঠে দানিশ মির্জার মুখমণ্ডল।ক্ষিপ্ত স্বরে তিনি বলে উঠেন,

“তাকে সামলানো তোমার দায়িত্ব দর্শন।ওকে বোঝাও যেন এই কেস নিয়ে মাথা আর ঘামায়।এরকম শত পিএ আসবে যাবে।আর হ্যা আজ হলুদে যেন কোন নাটক না করে সে।”

.

সূর্য অস্তমিত গিয়ে সন্ধ্যে হতে না হতেই দানিশ মির্জার ভুবন আলোয় আলোকিত হয়ে উঠে।আজকে যেন সে ভিন্ন সাজে সেজেছে।পুরো বাড়িতে হলুদের সাজ।আফটার অল মির্জা বাড়ির দুই পুত্রের একই সঙ্গে বিয়ে হতে চলেছে।আজকে আর প্রি ওয়েডিং অনুষ্ঠান।মৃত্তিকা এই ব্যাপারে অজ্ঞাত ছিল বললে ভুল হবে তার ধারণা ছিল এমন কিছু হবে।কিন্তু পুনরায় তার আর দর্শনের সো কল্ড বিয়ে!ভাবতেই এক তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে তার মুখে।ক্ষনপরেই তা মিলিয়ে যায় অন্তরীক্ষে।
মৃত্তিকার রুমে এখন পার্লারের মেয়েদের ভীড়।তাকে হলুদের সাজে সাজাচ্ছে কয়েকজন মিলে।মৃত্তিকা লর পরনে কাঁচা হলুদ রঙের লেহেঙ্গা,সোজা সিঁথি করে হেয়ার স্টাইল করা হয়েছে।মৃত্তিকার পিঠ সমান চুলেই তাজা ফুল পেছানো হয়েছে।সাজ সম্পন্ন হলে আরশিতে নিজেকে প্রতক্ষ করে মৃত্তিকা।তখনই কানে এসে বাজে একটা তিক্ত বাক্য,

“শেষমেশ দর্শন তোমার মত ব্যাকডেটেট মেয়েকে বিয়ে করলো!আফসোস!”

কন্ঠস্বরের মালিককে শনাক্ত করে একাট মৃদু হাসি ফুটে।

চলবে…