ফিরে আসা পর্ব-০২

0
243

#ফিরে_আসা__
লেখা: ShoheL Rana শামী
পর্ব:-০২

রাজ দরবারে সভা চলছিল। সভার সদস্যরা রাজার সিদ্ধান্ত জানার জন্য অপেক্ষা করছে। রাজা হেনরি কয়েকবার এদিক-ওদিক পায়-চারি করে সিংহাসনে বসলেন। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-আমাদের এখন উচিত প্রোটেস্টাণ্টদের পক্ষে যুদ্ধ করা। ক্যাথলিকদের এখনই দমিয়ে না রাখলে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠবে ওরা। আমরা বাইবেল এবং একমাত্র ঈশ্বরের উপরই পূর্ণ বিশ্বাসী। ক্যাথলিকদের ধর্মীয় গোঁড়ামি প্রশ্রয় দিতে পারি না আমরা। পিটার…
-ইউর ম্যাজেস্টি…’ বুকে হাত রেখে মাথানত করলো জেমস পিটার।
-তুমি সৈন্যদল রেডি করো। তাদের নিয়ে যাও যুদ্ধক্ষেত্রে। ক্যাথলিক সম্প্রদায় যেন নিস্তার না পায়।’
মাথা নত করে রাজসভা থেকে বের হয়ে গেল পিটার।

করিডর দিয়ে হাঁটার সময় ডায়ানা দেখলো, সেনা প্রধান জেমস পিটার ঘোড়ায় চড়ে সৈন্যদের নেতৃত্ব দিচ্ছে। হাতের ইশারায় ডায়ানা তাকে ডাকলো। পিটার তার ঘোড়া থেকে নেমে অন্দরমহলের দিকে হেঁটে আসতে লাগলো। কাছাকাছি আসতেই ডায়ানা প্রশ্ন করলো,
-কোনো যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে নাকি?
-হুমম, ক্যাথলিকদের বিরুদ্ধে।
-এভাবে আর কতো যুদ্ধ চলবে? ওরা তো আমাদেরই ভাই। আমাদের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের একটা অংশ।’ ধীরপায়ে হেঁটে নিজের কক্ষে এলো ডায়ানা। পেছন পেছন ঢুকলো পিটারও।
-রাজার হুকুম। কী করতে পারি?’
-যুদ্ধে যদি তোমার কিছু হয়ে যায়?’ পিটারেের দিকে ঘুরলো ডায়ানা। ভয়ার্ত দৃষ্টি তার।
-তোমার জন্য হলেও বেঁচে ফিরে আসবো আমি।
-আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।’
ডায়ানার কপালে চুমু খেলো পিটার। পিটারের চোখের দিকে তাকিয়ে নিচু কণ্ঠে ডায়ানা বলে ওঠলো,
-আমি অপেক্ষা করবো সেইদিনের জন্য, আরও একটা যুদ্ধে তুমি আমাকে এই বন্দীজীবন থেকে মুক্ত করে নিয়ে যাবে। আমাকে একান্তই তোমার করে নেবে।’
মাথা দুলিয়ে বের হয়ে গেল পিটার। ডায়ানা করিডরে গিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ালো। পিটার পৌঁছে গেছে সৈন্যদলের কাছে। ঘোড়ায় চড়ে বসে সে। তারপর সৈন্যদের নেতৃত্ব দিয়ে ঘোড়া ছুটালো৷ ওদের গমনপথ থেকে দৃষ্টি সরলো না ডায়ানার। পাশে এসে দাঁড়ালো মেরি। নিচুকণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
-কোথায় যাচ্ছে ওরা?’
-ক্যাথলিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে।
-এটা তো অন্যায় মা। আমাদের উচিত ওদেরকে রুখা। ক্যাথলিকদের বিশ্বাসে ওরা আঘাত করতে পারে না এভাবে।
-মহামান্য রাজার আদেশ এটা।’
মুখটা মলিন করে ডায়ানার দিকে চেয়ে থাকলো সদ্য কিশোরী মেয়েটা। কিছুক্ষণ কী যেন ভেবে প্রশ্ন করলো,
-আমি এবং আমার মা ক্যাথলিকে বিশ্বাসী। আমাদেরকেও কি মেরে ফেলবে?
-নাহ্, তোমাদের কিছু করবে না।’ মেরির মাথায় হাত বুলালো ডায়ানা। সেই মুহূর্তে কাছে এসে কুর্নিশ করে দাঁড়ালো বার্তাবাহক লরেন। ডায়ানা তাকে প্রশ্ন করলো,
-কী ব্যাপার লরেন, কোনে বার্তা আছে?’
-জি, রানি ক্যাথরিনের ওখান থেকে খবর এসেছে, উনি মৃত্যুশয্যায়। উনি মৃত্যুর আগে একবার রাজকুমারীকে দেখতে চায়ছেন।
-আমার মায়ের কী হয়েছে? আমি দেখতে যাবো আমার মাকে। বলো লরেন, আমার মায়ের কী হয়েছে বলো?’
-উনি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। হয়তো এবার আর বাঁচবেন না।
-নাহ্, আমি এখনই যাবো। আমি প্রস্তুত হয়ে আসছি।
-কোথাও যাবে না তুমি। তুমি এখানেই থাকবে।’ বলতে বলতে হেঁটে আসতে লাগলেন রাজা হেনরি। তাঁকে দেখে সবাই কুর্নিশ করলো। মেরি বললো,
-বাবা, আমার মা মৃত্যুশয্যায়। আপনি আমাকে বাঁধা দিচ্ছেন তাঁকে দেখতে যেতে?
-নির্বাসনের সময় রাজপ্রাসাদের কেউ তার সাথে দেখা করতে পারবে না। নির্বাসনে যদি তার মৃত্যু হয়, তবে কফিনে করে শুধু তার লাশটাই ফিরবে।’
-বাবা আপনি এতো কঠোর হবেন না দয়া করে।’ কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললো মেরি।
-এটাই আমার আদেশ।’ বলেই আবার হেঁটে চলে যেতে লাগলেন রাজা হেনরি। মেরি আবেগজড়িত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো ডায়ানার দিকে। তারপর ‘হু হু’ করে কেঁদে উঠে জড়িয়ে ধরলো ডায়ানাকে।

নিজের ক্ষতস্থানে গরমের ছ্যাঁকা দিচ্ছে জেমস পিটার। ক্যাথলিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময় গায়ে তরবারির আঘাত লেগেছিল। অনেকখানি কেটে গেছে। গরমের ছ্যাঁক দিয়ে কিছুটা সুস্থ সে এখন। দরজায় টোকার শব্দ হলো।
-কে? ভেতরে এসো।’
ডায়ানা ভেতরে প্রবেশ করলো। তাকে দেখে চমকে ওঠলো পিটার। অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
-তুমি! তুমি এখানে?
-শুনেছি তোমার জখম হয়েছে, তাই নিজেকে প্রাসাদে আটকে রাখতে পারিনি। ছুটে এলাম দেখতে।
-রাজা মহাশয় জানতে পারলে তোমাকে আর আমাকে সন্দেহ করতে পারে।
-জানবে না। উনি রাজ সভায়। আমাকে কেউ আসতে দেখেনি। ছদ্মবেশ নিয়ে এসেছি।
-এভাবে তোমার আসা ঠিক হয়নি।
-আমি একটু তোমাকে দেখেই চলে যাবো। এ কী অবস্থা হলো তোমার? অনেকখানি কেটে গেছে।’ আলতো করে পিটারের ক্ষতস্থানে হাত বুলিয়ে দিলো ডায়ানা। ‘আউচ’ করে কেঁপে ওঠলো পিটার।
-ব্যাথা না খুব?’
-তা তো হবেই। শুনো এখানে যেকোনো মুহূর্তে সৈন্যদের কেউ চলে আসতে পারে। তোমাকে চিনে ফেললে সমস্যা হবে। তুমি এখনই বের হয়ে যাও।
-তুমি নিজের যত্ন নিও। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো।’ ওঠে দাঁড়ালো ডায়ানা।
-সাবধানে যেও…’ সতর্ক করলো পিটার। বের হয়ে গেল ডায়ানা।

প্রাসাদে ফিরেই রাজা হেনরির মুখোমুখি হলো ডায়ানা। সে কিছুটা ভীতগ্রস্ত হয়ে পড়লো স্বামীকে দেখে। বুকটা কাঁপতে লাগলো তার। রাজা মহাশয় হঠাৎ কী প্রশ্ন করে বসে সংশয়ে আছে সে।
-কী ব্যাপার, তোমাকে এমন ভীতিগ্রস্ত দেখাচ্ছে কেন?’ প্রশ্ন করলেন রাজা হেনরি।
-কই? না তো… আমি ঠিক আছি।’
-নাহ্, তোমাকে ঠিক দেখাচ্ছে না।’ দুহাতে শক্ত করে ডায়ানার দুই বাহু ধরলেন হেনরি। ‘এই যে ঘামছো তুমি। আর কেঁপে কেঁপে ওঠছো।’ ডায়ানার কপালের ঘাম আঙুলের ডগায় নিয়ে দেখালেন হেনরি।
-কই? ঘামছি না তো। একটু বাইরে ঘোড়া নিয়ে ঘুরছিলাম। প্রাসাদে কেমন যেন একা একা লাগছিল। বাইরে থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছি, তাই হয়তো একটু কাঁপছি।
-আচ্ছা, এখন একটু বিশ্রাম নাও।’ বলেই বের হয়ে গেলেন বাইরে। দ্রুত পা চালালেন তিনি রাজ কারাগারের দিকে। কারাগারের সামনে যেতেই দুজন কারারক্ষী কুর্নিশ করলেন তাঁকে। হেনরি ইশারা করলেন তালা খুলতে। তালা খুলে দিলেন একজন কারারক্ষী। হেনরি কারার ভেতরে প্রবেশ করলেন। একজন বন্দী বৃদ্ধা ভয়ে কুঁকড়ে গেল তাঁকে দেখে। দুহাত জোড় করে ক্রন্দনরত হয়ে বৃদ্ধা বলতে লাগলো,
-ইউর ম্যাজেস্টি, আমাকে শুধু শুধু বন্দী করা হয়েছে। আমার কোনো দোষ নেই।
-রাজ প্রাসাদে তোমার কী কাজ বলো? তুমি কার সাথে দেখা করতে এসেছো? কী কারণে এসেছো?
-আমি একজন ভিক্ষুক, ভিক্ষা করতে এসেছি।
-কোনো ভিক্ষুকের রাজ প্রাসাদের ভেতরে ঢুকে যাওয়ার সাহস নেই। তোমাকে এর আগেও অনেকবার দেখা গেছে রাজ প্রাসাদে ঢুকতে। তোমার কী উদ্দেশ্য বলো। নয়তো তোমার মৃত্যুদণ্ড দেবো আমি।
-আমি সত্যি বলছি, আমি ভিক্ষা করতেই এসেছি। আমাকে যেতে দিন, আমি আর কখনও আসবো না।’
একজন সৈন্য এসে সেই মুহূর্তে রাজাকে কুর্নিশ করে দাঁড়ালো কারার বাইরে। হাতে তার একটা শিশিবোতল, শিশিতে কিছু তরল। শিশিবোতলটা দেখিয়ে সৈন্যটা বললো,
-ইউর ম্যাজেস্টি, এটা প্রাসাদের সামনে পাওয়া গেছে। এটা হয়তো এই বৃদ্ধার।’
রাজা হেনরি একবার শিশিবোতলের দিকে তাকালো, আরেকবার বৃদ্ধার দিকে। বৃদ্ধার চেহারাটা তখন আরও বেশি ভয়ার্ত হয়ে ওঠলো। রাজা সৈন্যকে আদেশ দিলেন,
-শিশিটা পরীক্ষাগারে পাঠাও। এটা কীসের তরল পরীক্ষা করতে বলো।’
বলতে বলতে কারা থেকে বের হয়ে এলেন হেনরি।

রাজ দরবারের সামনে এসে দাঁড়ালো জেমস পিটার। ভেতরে ঢোকার অনুমতি চায়লো সে। রাজা তাকে ঢোকার অনুমতি দিলেন। ধীরপায়ে হেঁটে ভেতরে প্রবেশ করলো পিটার। সভার সদস্যদের সবাইকে একবার দেখে নিলো সে। রাজা তাঁকে প্রশ্ন করলেন,
-কী অবস্থা বলো পিটার? যুদ্ধের পরিস্থিতি কেমন? আর তোমার ক্ষতের কী অবস্থা?
-আমি অনেকটা সুস্থ হয়েছি ইউর ম্যাজেস্টি। যুদ্ধের পরিস্থিতি এখন অনেকটা শীতল। আমরা অনেক ক্যাথলিককে বন্দী করেছি।
-ঠিক আছে, তোমার এই মুহূর্তে সভায় না থাকলেও চলবে। তুমি বিশ্রাম নাও। তোমার বিশ্রাম দরকার।
-যথা আজ্ঞা, ইউর ম্যাজেস্টি।’ মাথা নত করে বের হয়ে গেল পিটার।

গভীর রাতে প্রাসাদের বাইরে দেখা করলো ডায়ানা আর পিটার। দুজনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো অনেকক্ষণ। চাঁদের ক্ষীণ আলো চারপাশটা হালকা আলোকিত করে রেখেছে। হঠাৎ নীরবতা ভেঙে প্রশ্ন করলো পিটার,
-এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবে?
-আমার খুব ভয় হচ্ছে পিটার।
-তোমার এভাবে আমার সাথে দেখা করা উচিত হয়নি।
-উনি ঘুমোচ্ছেন। ভোর হওয়ার আগে উনার ঘুম ভাঙবে না জানি।
-কেন দেখা করেছো বলো।
-উনি আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছেন হয়তো।
-হয়তো?
-অনেকটাই শিওর…
-কীভাবে শিওর হলে?
-তোমার সাথে দেখা করে ফেরার পর উনার মুখোমুখি পড়ে গেছিলাম।
-তারপর?
-অনেক প্রশ্ন করেন আমাকে।
-প্রশ্ন?
-হুমম… কিন্তু ব্যাপার ওটা না। আমার সাথে যে বৃদ্ধাটা মাঝেমাঝে দেখা করতে আসতো, সেই বৃদ্ধা ধরা পড়েছে। তাকে বন্দী করা হয়েছে।
-বৃদ্ধা কিছু বলে দেয়নি তো?
-বলেনি হয়তো এখনও। বললে রাজা মহাশয় আমার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করতেন না এখনও।’
চিন্তিত দেখালো দুজনকে। কিছুক্ষণ কী যেন চিন্তা করলো দুজন। হঠাৎ পিটার বলে ওঠলো,
-আমরা খুব শীঘ্রই ধরা পড়তে পারি। সবকিছু ফাঁস হয়ে যেতে পারে।
-আর সবকিছু ফাঁস হয়ে গেলে আমাদের নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ড দেবেন।
-হুমম…
-আমরা কি তাহলে আর এক হতে পারবো না দুজন? আমাদের ভালোবাসা কি তবে ব্যর্থ হয়ে যাবে?’
কোনো জবাব দিতে পারলো না পিটার। দুজন আবারও চুপ হয়ে রইলো অনেকক্ষণ। একসময় ক্ষীণকণ্ঠে ডাক দিলো ডায়ানা,
-পিটার…
-হুমম…
-আমরা যদি মারা যাই, আমাদের কী হবে?
-জানি না।
-এমন কি কোনো ব্যবস্থা করা যায় না, মারা গেলে আমরা আবার ফিরে আসবো?’
নিরুত্তর পিটার কী যেন ভাবতে লাগলো গভীরভাবে।

রৌদ্রতপ্ত প্রহর। চারপাশটা যেন খাঁ খাঁ করছে। কয়েকজন প্রহরী মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে রাজ দরবারের সামনে। নিজেদের ডিউটিতে ব্যস্ত ওরা। এক হাত কোষবদ্ধ তরোয়ালের হাতল ধরা। আর দৃষ্টি তাদের দূর দিগন্ত পর্যন্ত। দূর থেকে দুজন অশ্বারোহী এগিয়ে আসছে। রাজ দরবারের সামনে আসতেই তাদের ঘোড়ার বেগ থামলো। ঘোড়া থেকে নেমে ওরা সোজা ঢুকে গেল দরবারে। সিংহাসনে রাজাকে দেখে কুর্নিশ করলো। রাজা হেনরি গম্ভীরভাবে চেয়ে আছেন তাদের দিকে। অপেক্ষা করছেন তাদের কথা শোনার জন্য। একজন তখন বলে ওঠলো,
-ইউর ম্যাজেস্টি, আমরা একটা তথ্য নিয়ে এসেছি। যে শিশিটা আমরা নিয়ে গেছিলাম, শিশির তরলটুকু পরীক্ষা করা হয়েছে।’ থামলো লোকটা। হেনরি অপেক্ষা করছেন তার বাকি কথাটা শোনার জন্য। লোকটা আবার বলে ওঠলো,
-তরলটুকু আসলে গর্ভের বাচ্চা নষ্ট করতে পান করা হয়।’
সিংহাসন থেকে ওঠে দাঁড়ালেন হেনরি। দ্রুত বেগে সদস্যদের পাশ কাটিয়ে বের হয়ে গেলেন দরবার থেকে। রাজ কারাগারের দিকে পা চালালেন তিনি। সেই মুহূর্তে একজন সৈন্য এসে মুখ নিচু করে দাঁড়ালো তাঁর সামনে।
-দুঃসংবাদ আছে ইউর ম্যাজেস্টি।’ ইতস্তত করে বললো সৈন্য।
-বলো…’ দু’হাত পেছনে জোড় করে দাঁড়ালেন হেনরি।
-বন্দী যে বৃদ্ধাটা ছিল, উনি মারা গেছেন কারাগারে।
-কী বলছো তুমি?
-ইউর ম্যাজেস্টি, আমি ঠিক বলছি। তবে মৃত্যুটা স্বাভাবিক না। কেউ মনে হয় বিষ দিয়েছে।
-বিষ দিয়েছে? বিষ কীভাবে দিলো? তোমরা রক্ষীরা কী করছো? এসব খেয়াল রাখবে না?
-মনে হচ্ছে খাবারের সাথেই কেউ বিষ দিয়েছে। আমরা বুঝতে পারিনি।
-তোমাদের দায়িত্বে অবহেলার শাস্তি পরে হবে। যে লোকটা খাবার পরিবেশন করেছে তাকে বন্দী করে জিজ্ঞাসাবাদ করো আগে। এর পেছনে আর কে কে আছে বের করো।
-যথা আজ্ঞা, ইউর ম্যাজেস্টি।’ মাথা নত করে চলে গেল সৈন্য।

নিজের কক্ষে পায়-চারি করছিল ডায়ানা। কী এক অজানা ভয়ে বারবার আতঙ্কিত হয়ে ওঠছে সে। ভয়ে ঘেমে ওঠছে পুরো শরীর। কে যেন আসার পায়ের শব্দ শুনতেই থমকে দাঁড়ালো ডায়ানা। ভেতরে প্রবেশ করলেন রাজা হেনরি। তিনি এসে মুখোমুখি দাঁড়ালেন ডায়ানার। ভনিতা না করে সোজা প্রশ্ন করলেন,
-বৃদ্ধাটা তাহলে তোমার কাছেই আসতো?
-কী বলছেন মহারাজ, আমার কাছে কেন আসবে? আমার সাথে কী সম্পর্ক থাকতে পারে ওর?’ ইতস্তত করলো ডায়ানা।
-তুমি ছাড়া এই মহলে আর কোনো গর্ভবতী মহিলা ছিল না গত তিন বছরে।’
চুপ করে রইলো ডায়ানা। হেনরির পরবর্তী কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করলো। হেনরি আবার বলে ওঠলেন,
-বৃদ্ধার যে শিশিটা পাওয়া গেছে, ঐ শিশির তরলটুকু কোন কাজে ব্যবহার করা হয় জানো?
-কোন কাজে?’ ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলো ডায়ানা।
-বাচ্চা নষ্ট করার কাজে। আর এই পর্যন্ত তোমার গর্ভের সন্তান দুবার নষ্ট হয়েছে।
-মহারাজ আমি…’ কথা শেষ করতে পারলো না ডায়ানা। হেনরি তার গালে কষে এক চড় বসিয়ে গর্জে ওঠলেন,
-কেন করেছো এমন?’
চুপ করে রইলো ডায়ানা। হেনরি আবার প্রশ্ন করলেন,
-বৃদ্ধার খাবারে তুমি বিষ মিশিয়েছো?’
-না, না মহারাজ, আমি এসব করিনি, বিশ্বাস করুন।
-তদন্ত চলছে। এই অপরাধের সাথেও যদি তোমার নাম বেরিয়ে আসে, তবে ভয়াবহ শাস্তি হবে তোমার, মনে রেখো।’ বলেই হনহন করে বের হয়ে গেলেন হেনরি।

বৃদ্ধাকে যে খাবার পরিবেশন করেছিল তাকে কারায় বন্দী করা হয়েছে। অনেক মারধর করা হয়েছে তাকে। তবে সে কিছুতেই স্বীকার করছে না যে কাজটা তার। দায়িত্বপ্রাপ্ত সৈন্য তাকে শেষবারের মতো হুমকি দিলেন,
-কার আদেশে তুমি খাবারে বিষ মিশিয়েছো, বলো?’ আবার ঘুষি চালালো সৈন্য বন্দীর মুখে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হলো তার ঠোঁট থেকে। মার খেয়ে অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে সে। কথাও ঠিকমতো বলতে পারছে না। অনেক কষ্টে বললো,
-আমি আমার কক্ষে খাবারগুলো রেখে একটু বের হয়েছিলাম। তখন সেনাপতি পিটারকে আমার কক্ষের দিকে যেতে দেখেছিলাম। এছাড়া আমি আর কিছুই জানি না। আমি নির্দোষ।’
সেই মুহূর্তে কারার সামনে এসে দাঁড়ালেন রাজা হেনরি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
-মুখ থেকে কিছু বের হয়েছে ওর?’
-ইউর ম্যাজেস্টি, ও কিছু জানে না বলছে। তবে ও নিজের কক্ষে খাবার রেখে নাকি বের হয়েছিল, তখন সেনাপতি পিটারকে ও নিজের কক্ষের দিকে যেতে দেখেছিল।’
-পিটার…’ নামটা নিজে নিজে উচ্চারণ করলেন হেনরি। তারপর সৈন্যের উদ্দেশ্যে বললেন,
-সেনাপতি পিটারকে আমার দরবারে নিয়ে এসো।’
-জি, ইউর ম্যাজেস্টি।’ বুকে হাত রেখে মাথা নত করলো সৈন্য। হেনরি হনহন পায়ে চলে যেতে লাগলেন।

-ইউর ম্যাজেস্টি, যদি অভয় দেন, তবে আমি কিছু কথা বলতে চাই আপনাকে।’ সভার এক সদস্য বলে ওঠলেন রাজা হেনরির উদ্দেশ্যে। সিংহাসনের সামনে পায়-চারি করছিলেন হেনরি। সভার সদস্যের কথা শুনে তিনি গম্ভীরমুখে দাঁড়ালেন।
-বলো, কী বলবে?’
-ইউর ম্যাজেস্টি, ব্যাপারটা আসলে খুব লজ্জাজনক। সেনাপতি পিটারের সাথে আমাদের রানিকে খুব বেশি মিশতে দেখা যায়।
-আপনি কী বলছেন, বুঝতে পারছেন?’ ধমকে ওঠলেন হেনরি।
-আপনি আমাকে ধমকাতে পারেন, তবুও আপনার সম্মানের কথা চিন্তা করে আমাকে বলতেই হবে কথাটা। আমাদের সৈন্যরা অনেকবার তাদের দুজনকে একসাথে দেখেছে। এমনকি…’ বলতে বলতে থামলেন সদস্য। ভ্রু কুঁচকে হেনরি আগ্রহ দেখালেন,
-এমনকি?’
সদস্য আবার বলে ওঠলেন,
-এমনকি যেদিন পিটার আঘাত পায়, সেদিন নাকি আমাদের রানি ছদ্মবেশ নিয়ে ছুটে গেছিলো তার কাছে। আমাদের এক সৈন্য রানিকে দেখে চিনে ফেলেন। সেনাপতি পিটারের সাথে নাকি খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছে সে রানিকে।
-যথেষ্ট হয়েছে, থামো…’ ধমক দিয়ে ওঠলেন রাজা হেনরি। ‘যদি তোমার কথা মিথ্যা হয়, তবে আমি নিজহাতে তোমার গর্দান নেবো।’
-সে আপনার ইচ্ছে, ইউর ম্যাজেস্টি।’ বলেই মাথানিচু করলেন সদস্য। হেনরি চিন্তিত হয়ে আবার একইভাবে পায়-চারি শুরু করলেন। তারপর ছুটে বের হয়ে গেলেন রাজ দরবার থেকে। দেখে মনে হলো খুবই রাগান্বিত তিনি। কোনোদিকে না থাকিয়ে ছুটে চললেন রাজপ্রাসাদের দিকে। প্রাসাদের সামনে আসতেই একটা জটলা দেখতে পেলেন তিনি। জটলার পাশেই একটা ঘোড়ার গাড়ি থেমে আছে। রাজা হেনরিকে দেখতে পেয়ে জটলাটা একপাশে সরে গেল। হেনরি দেখলেন একটা কফিনের ভেতর ক্যাথরিনের লাশ। আর মায়ের লাশ ধরে কেঁদে চলেছে মেরি। রাজা হেনরি মেরির পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলালেন। কিছুক্ষণ ক্যাথরিনের লাশের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবলেন। তারপর হঠাৎ দাঁড়িয়ে গর্জে ওঠলেন,
-রানি ডায়ানা আর সেনাপতি পিটারকে বন্দী করো।’
রাজার হুকুম শুনে জটলার সবাই একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। রাজার এমন হুকুমের জন্য তারা কেউ যেন প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু কয়েকজন সৈন্য ছুটে গেলেন রানি আর সেনাপতিকে বন্দী করতে।

রানি ক্যাথরিনের লাশ নিয়ে সবাই বাইরে জটলা বেঁধেছে। এই সুযোগে সেনাপতি পিটার ডায়ানাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে চায়ছিল। যখনই দুজন কক্ষ থেকে বের হতে চায়লো, কয়েকজন সৈন্য তাদের পথ আটকালো।
-তোমরা কার পথ আটকায়ছো ভেবে দেখেছো? আমি তোমাদের সেনাপ্রধান।’ কড়া সুরে বললো সেনাপতি পিটার। ইতোমধ্যে তরবারির হাতল স্পর্শ করেছে সে। একজন সৈন্য তাকে সাবধান করলো,
-সেনাপতি পিটার, আপনার উপর তরবারি চালাতে বাধ্য করবেন না। মহারাজ আপনাদের দুজনকে বন্দী করার আদেশ দিয়েছেন।
-তবে আসো বন্দী করো।’ বলেই তরবারি বের করে ঝাপিয়ে পড়লো পিটার সৈন্যদের উপর। সৈন্যরাও প্রস্তুত ছিল। তরবারি যুদ্ধ শুরু হলো দুপক্ষের মাঝে। কিন্তু সেনাপতি পিটারের তরবারি চালনার দক্ষতার কাছে বেশিক্ষণ টিকতে পারলো না সৈন্যরা। জখম হয়ে পড়ে রইলো মেঝেতে। পিটার ডায়ানার হাত ধরে গোপনে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর সেই স্থানে আরও কয়েকজন সৈন্য এসে আহত সৈন্যদের দেখে পুনরায় ছুটে গেল রাজার কাছে। রাজা হেনরি বিষয়টা জানতে পেরে দ্রুত সৈন্যদের হুকুম দিলেন,
-যেখানে পাও ধরে আনো দুজনকে। আমি নিজেই ওদের মৃত্যুদণ্ড দেবো।’
রাজার হুকুমে বিশাল এক সৈন্যবাহিনী বেরিয়ে পড়লো ওদের খোঁজে।

একটা উপত্যকায় এসে থামলো পিটার আর ডায়ানার ঘোড়া। দুপাশে পাহাড়। থাকার জায়গা খুঁজছে ওরা। আর ছুটতে পারছে না এভাবে। হাঁপাচ্ছে দুজন। হাঁপাতে হাঁপাতে ডায়ানা বললো,
-পিটার… আমরা এভাবে পালাতে পারবো না। রাজার সৈন্যদের হাতে অবশ্যই ধরা পড়বো।
-এখন কী করতে পারি বলো?
-আমাদের বেঁচে থাকার সব আশার দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। ধরা পড়লেই রাজা আমাদের মৃত্যুদণ্ড দেবেন।
-তুমি যে বলেছিলা মরে গিয়ে ফিরে আসার কোনো ব্যবস্থা আছে কি না। যদি আমরা কারও সাহায্য চাই এই ব্যাপারে?
-কার সাহায্য চাইবো? ও হ্যাঁ, একজন আছে। ঐ পাদ্রি, যিনি মেরির ব্যাপারেও ভবিষ্যত বাণী করেছেন। তিনি যদি কিছু করতে পারেন?
-চলো, তার কাছে যাই…
-চলো…’
আবার ঘোড়া ছুটালো ওরা। দুজন এক হওয়ার জন্য যেন মরিয়া হয়ে ওঠেছে। জানে না তারা তাদের সাথে কী ঘটতে যাচ্ছে।

ওরা চলে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর সেই উপত্যকায় এসে থামলো রাজা হেনরির বিশাল বাহিনী। চারপাশে থাকালো ওরা। একজন সৈন্য ঘোড়া থেকে নেমে চারপাশে খুঁটিয়ে দেখলো। মাটিতে ঘোড়ার পদচিহ্ন দেখে বললো,
-ওরা এখানে এসেছিল। ঘোড়ার চিহ্নগুলো ওইদিকে গেছে। চলো সৈন্যরা, ওদেরকে ধরতে হবে।’ বলতে বলতে সৈন্যটা উঠে বসলো ঘোড়ায়। সবগুলো ঘোড়া একসাথে হ্রেষাধ্বনি করে ওঠলো। তারপর টগবগ করে ছুটতে লাগলো একসাথে।

[[চলবে…]]