ফিরে আসা পর্ব-৫৯+৬০

0
732

#ফিরে_আসা
৫৯
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

বিরক্ত ভঙ্গিতে নিজের ঘরে বসে আছে আরশাদ। বাড়িটা মানুষে মানুষে গিজগিজ করছে। কোথাও পা ফেলার জায়গা পর্যন্ত নেই। একমাত্র এই ঘরটাতেই শান্তি! এমনিতেই রাগে তার গা জ্বলে যাচ্ছে। সেই কখন থেকে অরাকে ফোন করে যাচ্ছে, অথচ তার ফোন তোলার নামগন্ধ নেই। আরশাদ বুঝতে পারছে, অরা জেনেবুঝে ইগনোর করছে না তাকে। সেই সাধ্য প্রকৃতি তাকে দেয়নি। রাজ্যের মানুষজনের সামনে পড়ে যাওয়ায় ফোন রিসিভ করতে পারছে না।

হঠাৎ দরজার দিকে চোখ পড়লো আরশাদের। রনি, আকাশ, পবন আর মিশান এক লাইন দিয়ে তার ঘরের ভেতরে ঢুকছে। এদের মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যেন অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়েছে। পবন আরশাদের ফুপাতো ভাই। আর মিশান চাচাতো, অর্থাৎ সে মেহেরের ভাই। আর এদিকে রনি তার বড় মামার ছেলে।

সারা দেশের তরুণেরা আরশাদকে নিজের আইডল মনে করতে শুরু করেছে সে সুপারস্টারে পরিণত হবার পর। অথচ রনি সেই ছোটবেলা থেকে আইডল মনে করে তার আরশাদ ভাইকে। কাজিনদের মধ্যে রনিই তার সবচেয়ে প্রিয়। আরশাদের বৈশিষ্ট্যই বোধ হয়, যাদের একটু বেশি ভালোবাসে তাদের ধমকের ওপর রাখে। রনির বেলায়ও তার ব্যতিক্রম নয়।

আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “কী চাই?”

রনি হাসি মুখে এসে আরশাদের পাশে বসে বলল, “কেন? আমরা তোমার সঙ্গে গল্প করতে আসতে পারি না?”

আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “না পারিস না।”

রনি আহত গলায় বলল, “আরশাদ ভাই? এমন ফায়ার হয়ে আছো কেন? তোমার বিয়ে। কোথাও আনন্দ ফুর্তি করবে, নাচ-গান করবে?”

“যার বিয়ে সে নাচ-গান করে? আগে জানতাম না তো!”

রনি থতমত খেয়ে বলল, “নতুন কিছু করতে অসুবিধা কোথায় আরশাদ ভাই?”

আরশাদ ক্লান্ত গলায় বলল, “অনেক সময় নষ্ট করেছিস। এবার তোরা কী উদ্দেশ্যে এসেছিস বল।”

রনি ইতস্তত করে বলল, “একটা সমস্যা হয়ে গেছে আরশাদ ভাই।”

“কী সমস্যা।”

রনি মনে মনে কথা গোছাচ্ছে। তাকে নীরবতায় দেখে পবন এক লাফ দিয়ে বলল, “আমরা নাচতে পারি না!”

রনি চোখ গরম করে তাকাতেই চুপসে গেল পবন।

আরশাদ ধমকের সুরে বলল, “নাচতে পারিস না মানে?”

রনি নিজেকে সামলে যথাসম্ভব হাসিমুখে বলল, “আসলে কী আরশাদ ভাই, বিয়ে বাড়িতে কত কাজ! আমি আজ তিনবার বাজারে গিয়েছি। একবার গ্যাস সিলিন্ডার আনতে, একবার ফুলের মালা আনতে, একবার চাচার সিগারেট আনতে। এই পবন! তুই কী করেছিস রে?”

পবন জোর গলায় বলল, “আমি সারাদিন ডেকোরেটরের লোকদের পেছন পেছন ঘুরেছি।”

মিশান বলল, “আর আমি আজ সন্ধ্যায় বাড়ির সবার জন্যে চা বানিয়েছি।”

রনি মুগ্ধ গলায় বলল, “Proud of you boys! দেখছো ভাইয়া, আমাদের পরিবারের ছেলেরা কত কাজের? এই আকাশ? তুই কী করেছিস রে?”

আকাশ মাথা চুলকে বলল, “আমি মই ধরে দাঁড়িয়েছিলাম।”

বিরক্ত চোখে রনি তাকালো আকাশের দিকে। এই গাধাটাকে কিছু জিজ্ঞেস করাই ভুল হয়েছে!

আরশাদ কৃত্রিম বিস্ময় নিয়ে থমথমে গলায় বলল, “বাব্বাহ! তোদের এই ঋণ আমি শোধ করি কী করে? তোরা না থাকলে তো আমার বিয়েটাই হতো না।”

রনি বিগলিত গলায় বলল, “কী যে বলো না আরশাদ ভাই! তোমার জন্য তো জান হাজির।”

“আসল কথাটা বল না বাবা!”

“সারাদিন এত এত কাজের চাপে আমরা আর প্রাকটিস করার সময় পাইনি। অথচ গায়ে হলুদ কালকে।”

আরশাদ অবাক গলায় বলল, “তোরা তো হারবি! ওদিকে মেয়েরা আজ সারাদিন লাউডস্পিকারে গান বাজিয়ে প্রাকটিস করেছে।”

“সেজন্যেই তো তোমার কাছে এসেছি!”

আরশাদ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “মানে?”

“আরশাদ ভাই, আমাদের নাচ শিখিয়ে দাও না! প্লিজ!”

আরশাদ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বিরক্ত গলায় বলল, “অসম্ভব! আমি কোনো নাচ-টাচ পারি না।”

রনি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে আরশাদের পেছনে ছুটতে ছুটতে বলল, “এটা একটা কথা বললে আরশাদ ভাই? তোমার ড্যান্স স্টেপের জন্যে সারাদেশের মেয়েরা পাগল।”

আকাশ ওদিক থেকে জোর গলায় বলল, “শুধু মেয়েরাই কেন? ছেলেরাও পাগল।”

আরশাদ গম্ভীরমুখে বলল, “সেই সময় কোরিওগ্রাফার থাকে। শটের আগমুহূর্ত পর্যন্ত প্র্যাকটিসের সুযোগ থাকে।”

রনি বলল, “শোনো না আরশাদ ভাই! মোটামুটি একটা প্ল্যান আমরা করেছি। মেয়েরা কোন কোন গানে নাচছে তুমি জানো?”

আরশাদ গম্ভীর গলায় বলল, “না জেনে উপায় কী? সারাদিন শুনতে শুনতে সবগুলো গান মুখস্ত হয়ে গেছে।”

রনি বুঝ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “বাংলাদেশের মেয়ে, বিয়াইনসাব আর লিলাবালি! এই তিনটা গান হলো যেকোনো বিয়েবাড়ির জাতীয় সঙ্গীত। কিন্তু আমরা নাচবো ভিন্ন গানে। তোমার সিনেমার গানে! যার বিয়ে আমরা তার সিনেমার গানে নাচছি। কতটা ক্রিয়েটিভ থট একবার ভেবে দেখো! গানের সিকেক্টশনের জন্যেও তো বিচারক প্যানেলের ব্রাউনি পয়েন্ট পাবো।”

আরশাদ রাগী কণ্ঠে বলল, “নাচ না জানলে ব্রাউনি পয়েন্টে কোনো কাজ হবে না। আর আমি এ ব্যাপারে তোদের কোনো হেল্প করতে পারবো না। কথা ছিল তোরা নিজেরা কোরিওগ্রাফ করে পারফর্ম করবি।”

আকাশ এগিয়ে এসে অসহায় গলায় বলল, “মেয়েরা একলাখ তেষট্টির চেকটা নিয়ে যাবে আর আমরা কিছুই করতে পারবো না?”

কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল আরশাদ। গভীর চিন্তাভাবনায় ডুবে গেল সে। আসলেই তো! জেনেবুঝে নিজের ভাইগুলো ব্যর্থতার মুখে ঠেলে দেবে সে? তার আবার কাদের বিপক্ষে? ওই মেয়েদের দলের বিপক্ষে! মেয়েরা সবাই আরশাদের বোন, তবুও বিয়ে বাড়িতে পা রাখার পর থেকে আরশাদের চোখের বিষে পরিণত হয়েছে তারা। তাদের কুবুদ্ধির কারণেই তো বেচারা দুদিন ধরে বউহীনতায় ভুগছে।

আরশাদ হক কাউকে ছেড়ে দেয় না। প্রতিশোধ নেওয়ার এই মোক্ষম সুযোগ।

আরশাদ হঠাৎ সুর পাল্টে বলল, “কোন গানে নাচবি তোরা?”

রনি আনন্দে আত্নহারা হয়ে আরশাদকে জড়িয়ে ধরে বলল, “থ্যাংক ইউ আরশাদ ভাই!”

আরশাদ প্রচন্ড এক ধমক দিয়ে বলল, “ছাড়! কম্পিটিশনের আর বারো ঘন্টাও বাকি নেই, কী নাচবি তার ঠিক নেই। আর এদিকে তুই হাসছিস?”

“সরি, সরি! গান ঠিক করেছি তো। তোমার চলো হারিয়ে যাই গানটার সাথে নাচবো।”

‘চলো হারিয়ে যাই’ আরশাদের ক্যারিয়ারের সুপারহিট গানগুলোর একটা। এই গানে তার হিপ-হপের স্টেপগুলো দেখে মুগ্ধ হয়নি এমন মানুষ খুব কম পাওয়া যাবে।

আরশাদ তার মোবাইলে ইউটিউব থেকে গানটা প্লে করলো। বান্দরবানের সবুজ অরণ্যের মাঝে জমকালো সেট তৈরি করে গানটার শুটিং করা হয়েছে। এই গানে আরশাদের পরনের সাদা টিশার্ট আর লাল জ্যাকেট, গানটার মতোই বিখ্যাত।

গানটা শেষ হবার পর আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এই স্টেপগুলো যদি তোরা হুবহু করতে চাস, তাহলে কমপক্ষে দশ-বারো বছর সময় লাগবে।”

রনি অসহায় গলায় বলল, “তাহলে উপায়?”

আরশাদ কন্ট্যাক্ট লিস্ট থেকে একটা নম্বর খুঁজতে খুঁজতে বলল, “তোরা এক লাইনে দাঁড়িয়ে গানটার সাথে একটু হাত-পা নাড়াচাড়া করে, আমি আসছি।”

আরশাদ বারান্দায় গিয়ে ফোন করলো শাহীনকে। ‘চলো হারিয়ে যাই’ গানটার কোরিওগ্রাফি করেছিল সে। আরশাদ তাকে পুরো ঘটনা বুঝিয়ে বলল। আসল গানে যে স্টেপগুলোতে আরশাদ নেচেছিল তা সত্যিই অনেক কঠিন। রনিদের পক্ষে একদিনের মাথায় ওই জিনিস আয়ত্ব করা সম্ভব নয়। তাই সে শাহীনকে বলল, এই গানটার সঙ্গে যায় এমন সহজ কোনো নাচের স্টেপ তৈরি করতে।
শাহীন আশ্বাস দিয়ে বলল, অত্যন্ত সহজ কতগুলো স্টেপ গানটার সাথে সাজিয়ে সে একঘন্টার মধ্যে ভিডিও করে পাঠিয়ে দিবে।

একঘন্টা পার হবার আগেই শাহীন নতুন স্টেপের ভিডিও রেকর্ড করে পাঠিয়ে দিলো। এবারের স্টেপগুলো খুবই সহজ। সহজ বলে যে তার মাঝে কোনো সৌন্দর্য নেই এমনটা নয়। রনির মনে হলো এই স্টেপে ঠিকভাবে নাচতে পারলে প্রতিযোগিতা তারাই জিতবে।

শাহীনের ভিডিও প্লে করা হয়েছে আরশাদের ল্যাপটপে। তারা চারজন সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে নতুন স্টেপগুলো আয়ত্ব করার চেষ্টা করছে, আর একটু ভুল হলেও আরশাদ কড়া শিক্ষকের মতো ধমকাধমকি করছে।

সেলিনা হক রান্নাঘরে বসে মশলা বাটছেন। বাড়িতে কাল প্রচুর রান্নাবান্না। আগে থেকে প্রস্তুতি না নিয়ে রাখলে বিপদে পড়তে হবে। যদিও আরশাদের চাচী, ফুপুরা তার সঙ্গে থেকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেলিনা হক সবাইকে বিশ্রাম নিতে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেই সব করছেন। সারাদিন প্রচুর ধকল গেছে, এখনও যাচ্ছে। তবুও কোনো কষ্ট হচ্ছে না তার। বহু বছর পর এমন উৎসবের রঙ লেগেছে তার বাড়িতে। প্রিয় মুখগুলো একসঙ্গে দেখতে পাচ্ছেন। এর থেকে আনন্দের আর কিই বা হতে পারে?

হঠাৎ আসফিয়া আগমন ঘটলো রান্নাঘরে। আসফিয়া টুলের ওপর বসতে বসতে হাস্যোজ্বল গলায় বলল, “আরশাদের কান্ড দেখেছো মা? রনিদের নাচ শেখাচ্ছে।”

সেলিনা হক মশলা বাটায় বিরতি দিয়ে সোজা হয়ে বসতে বসতে বললেন, “ছেলেটাকে কতদিন পর এমন হাসিখুশি দেখছি! আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে!”

“আরশাদ আরেকবার বিয়ে করার বায়না ধরে ভালোই করেছে। আমরা সবাই আনন্দ করতে পারছি। আমাদের পরিবারে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়না অনেক বছর হলো, তাই না মা? নওশীনের সঙ্গে বিয়ের পরও তো কোনো অনুষ্ঠান করেনি আরশাদ।”

নিমিষেই গম্ভীর হয়ে গেল সেলিনা হকের মুখভঙ্গি। তিনি কিছুতেই চাইছিলেন না এই বিয়েবাড়িতে কেউ নওশীনের প্রসঙ্গে কথা বলুক। অথচ তার মেয়েই এই প্রসঙ্গ তুলল!

আসফিয়া আবারও বলল, “একটা সত্যি কথা বলবো মা? নওশীনকে কখনো আমার এই পরিবারের সদস্য বলে মনে হতো না। যখনই আমাদের পরিবারে কোনো অনুষ্ঠানে আসতো, মনে হলো বাইরের কোনো অথিতি বেড়াতে এসেছে। অথচ অরা মাত্র কয়েকদিনের মাঝেই এই পরিবারটাকে আপন করে নিয়েছে। সকলের সঙ্গে হাসছে, গল্পগুজব করছে।”

সেলিনা হক কঠিন গলায় বললেন, “আমার বৌমার সঙ্গে ওই বদ মেয়েটার তুলনা করবি না তো!”

আসফিয়া অবাক গলায় বলল, “ওমা! তুমি রেগে যাচ্ছো কেন? আমি কি ভুল কিছু বলেছি?”

“ঠিক ভুল বুঝি না। ওই মেয়েটার নাম এ বাড়িতে কখনো তুলবি না, এটাই আমার শেষ কথা! ওই মেয়ের কারণে আমার ছেলে চারটা বছর পরিবার থেকে আলাদা থেকেছে। আরশাদ যখন নিজের জীবনটাকে একটু গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো, তখন ওই মেয়ে আমার বৌমাকে তার থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। ছি! মেয়েমানুষ এত খারাপ হয়?”

আসফিয়া ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “থাক। ওসব কথা আর না-ই বা বলি। আরশাদ ভালো আছে এটাই বড় কথা।”

সেলিনা হক আর্দ্র গলায় বললেন, “অরার ওপর আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো জানিস? ওর কারণেই তো আমার ছেলেটা নতুন করে বাঁচতে শিখছে। স্বাভাবিক হতে শিখেছে।”

“সবাই বলে অরা অনেক ভাগ্যবতী বলে আরশাদকে পেয়েছে। অথচ আমার কী মনে হয় জানো মা?”

“কী?”

“আরশাদ অনেক ভাগ্যবান। সেজন্যেই অরাকে পেয়েছে। মেয়েটার কী প্রয়োজন ছিল আরশাদের অসুস্থ মনটাকে সুস্থ করে তোলার? আরশাদ অতীত নিয়ে মাথা না ঘামানোর?”

বাংলাঘরের মেঝেতে ঘুমের আয়োজন চলছে। দিশা কোথা থেকে যেন বিশাল একটা পাটি জোগাড় করেছে। পাটির ওপরে পরপর দুটো চাদর বিছানো হয়েছে। দিশা ও মেহেরের সঙ্গে যোগ দিয়েছে টগর ও নূপুর। এরা দুজন আরশাদের ফুপাতো বোন। কথা ছিল এরা চারজন মেঝেতে ঘুমাবে এবং অরা আর আসফিয়া বিছানায়। কিন্তু এদের নিচে রেখে বিছানায় ঘুমানোর মেয়ে অরা নয়। সেও মেঝের বিছানায় যোগ দিলো।

মেয়েরা একসঙ্গে হইচই করছে, ঠিক তখনি মোবাইলের নোটিফিকেশনের শব্দ কানে এল অরার। ভাগ্যিস শব্দটা শুনতে পায়নি মেহের। শুনলেই তো ছুটে এসে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে যেত।

আরশাদ ম্যাসেজ পাঠিয়েছে, “অরা? আজ রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে বাড়ির পেছন দিকটাতে আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে?”

অরা সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই করলো, “মোটেই না! কেউ দেখে ফেললে?”

আর কোনো ম্যাসেজ এলো না অপরপ্রান্ত থেকে। আরশাদ কি তবে অভিমান করলো অরার ওপরে? এই ছেলেটাকে নিয়ে আর পারা যায় না! কাল গায়ে হলুদের সময়েই তো দেখা হবে দুজনের। আজ রাতে আবার দেখা করার কী দরকার?

পরমুহূর্তেই আবার অরার মনে হলো, আহারে! বেচারা বউকে দেখার তৃষ্ণায় একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছে। শুধু একটু দেখাই তো করতে চেয়েছে। ছেলেটার এইটুকু আশা পূরণ করলে তো বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না।

অরা লিখলো, “আচ্ছা, করবো দেখা।”

একটু পর রিপ্লাই এলো অপরপ্রান্ত থেকে, “That’s why I love you!”

কর্মব্যস্ত দিনটা অবশেষে শেষ হলো। উৎসবমুখর বাড়িটার ব্যস্ততা কয়েক ঘন্টার জন্যে থেমে গেল। রাতটা পেরোলেই তো শুরু হবে আসল উৎসব! বাড়ির সবগুলো বাতি নিভে গেছে। দিনভর খাটাখাটনি শেষে সকলেই ক্লান্ত। তাই ঘুমে তলিয়ে যেতে কারোরই বেশি একটা সময় লাগলো না।

অরা অপেক্ষা করছে বাংলাঘরের সকলের ঘুমিয়ে পড়ার। ক্লান্তি এখনো কাবু করতে পারেনি দিশা এবং মেহেরকে। বাতি নিভে যাওয়ার পরও এরা ফিসফিস করে একে অপরের সঙ্গে গল্প করছে। ধুর! এভাবে চলতে থাকলে তো আরশাদের সঙ্গে দেখা করাটাই হবে না। ছেলেটা ওদিকে ভুল বুঝে অভিমানের পাল্লা ভারী করবে।

অরার দুশ্চিন্তা দূর করে আসফিয়া এক ধমক দিয়ে বলল, “এবার থাম তোরা! কাল সকাল সকাল উঠতে হবে তো!”

আসফিয়ার এক ধমকেই নিশ্চুপ হয়ে গেল দুজনে। মনে মনে যেন অরা হাফ ছেড়ে বাঁচলো।

আধ ঘন্টার মতো পার হয়েছে। অরা বুঝতে পারছে না এরা কেউ ঘুমিয়ে আছে না-কি জেগে? নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো অরা। ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। তার মানে কেউ জেগে নেই! জেগে থাকলে তো তার উঠে যাওয়া টের পেয়ে বলতো, “কোথায় যাচ্ছো ভাবি?”

কেউ এমনটা জিজ্ঞেস করলে অরা বলতো, “পানি খেতে যাচ্ছি।”

যেহেতু কেউ জেগে নেই, তাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অরা বাংলাঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো। ভাগ্যিস দরজায় শব্দ হয়নি। এমনিতেই চারিদিক নিস্তব্ধ, ছোট্ট একটা শব্দ হলেই তো কারো না কারোর জেগে যাওয়ার কথা।

এ বাড়ির পেছন থেকে সুন্দর একটা বাঁধাই করা পুকুর। পুকুরঘাটে বসে আড্ডা দেওয়ার মতো সুন্দর একটা জায়গা আছে। সেখানে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো অরা। আরশাদকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কোথায় গেল ছেলেটা? অরাকে দেখা করতে ডেকে শেষমেশ নিজেই ঘুমিয়ে পড়লো না-কি?

সাত-পাঁচ ভাবনার মাঝেই এগিয়ে যাচ্ছে। আচমকা পেছন একটা হাত হ্যাঁচকা টানে তার হাতটা ধরে তাকে দেওয়ালের সঙ্গে মিশিয়ে দিলো। আকস্মিক এ ঘটনার অরার আত্মা উড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। অথচ যে মানুষটা এমন ঘটনা ঘটালো, তার মুখভঙ্গি একেবারে শান্তশিষ্ট। একদৃষ্টিতে অরার দিকে তাকিয়ে আছে আরশাদ। যেন হাজার হাজার বছর তাকে দেখেনি। অরা সরে যেতে যাবে, ঠিক তখনই তার কোমর জড়িয়ে আবারও দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরলো আরশাদ। অরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজের শীতল ঠোঁটের স্পর্শ দিলো তার ঠোঁটে।

অরা সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠে তার ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে বলল, “এসব কী করছো তুমি? ছাড়ো আমাকে, কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”

আরশাদ নেশাভরা গলায় বলল, “আমার বউকে আমি আদর করছি। এতে সর্বনাশের কী হলো?”

অরা ভয়ার্ত কন্ঠে বলল, “প্লিজ আরশাদ! পাগলামি কোরো না। যে কেউ চলে আসতে পারে এখানে।”

আরশাদ ব্যস্ত গলায় বলল, “আসুক!”

অরকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আরশাদ আবারও ব্যস্ত হয়ে পড়লো তার ঠোঁটদুটো নিয়ে। প্রথমদিকে বারবার অরা ছাড়ানোর চেষ্টা করছিল তাকে। তবে এক পর্যায়ে সে নিজেই কোথায় যেন হারিয়ে যায়। ডুবে যেতে থাকে আরশাদের ভালোবাসাময় জগতে। নিজের অজান্তে কখন যেন শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে আরশাদকে।

দুজনে এভাবে কতক্ষণ ছিল, সেই সময়ের হিসাব কারোর কাছেই নেই। অনেকটা সময় পর আরশাদ অরার ঠোঁটদুটো ছেড়ে দিয়ে তার কপালে কপাল ঠেকলো। দুজনেই সমানতালে হাপাচ্ছে। আরশাদের উত্তপ্ত নিঃশ্বাসগুলো একটু একটু করে পাগল করে তুলছে অরাকে।

আরশাদ যতবারই তার কাছে আসে, ততবারই বিচিত্র লজ্জায় রেঙে ওঠে তার সমস্ত অন্তরাত্মা। আজও তার ব্যাতিক্রম হলো না। লজ্জায় চোখদুটো বুজে দাঁড়িয়ে আছে অরা। তবুও বেশ বুঝতে পারছে আরশাদের তৃষ্ণার্ত চোখদুটো নিষ্পলক তার দিকেই চেয়ে আছে।

অরা চোখদুটো বন্ধ রেখেই অস্পষ্ট গলায় বলল, “আমি এখন যাই?”

আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “যাবে মানে? আমি কি তোমাকে শুধু চুমু খেতে ডেকেছি?”

আরশাদের এমন কথায় অরার লজ্জারা কয়েকগুণ বেড়ে গেল। ছেলেটা এমন কেন? কথাবার্তায় বিন্দুমাত্র লাগাম নেই!

অরা কম্পিত স্বরে বলল, “তাহলে?”

“শখ মিটিয়ে দেখবো তোমাকে। একবার কল্পনা করে দেখো গত দুটো দিন কী কষ্টে কাটিয়েছি আমি।”

অরা চোখদুটো খুলে হাসি হাসি মুখে বলল, “আগে তো ঠিকমত তাকাতেই না আমার দিকে। আর এখন দেখার জন্যে কত কান্ড! মানুষ তোমাকে কী বলে জানো?”

“কী বলে?”

“বউপাগল!”

আরশাদ হেসে বলল, “ঠিকই তো বলে। আমি আসলে একটু বেশিই বউপাগল। এরকম বউ থাকলে কেউ বউপাগল না হয়ে পারে।”

অরা মুচকি হেসে চুপ করে রইলো।

“অরা?”

“হুঁ?”

“আমার সাথে একটা জায়গায় যাবে?”

অরা হতবাক হয়ে বলল, “এখন?”

আরশাদ জোর দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, এখন!”

অরা ভয়ার্ত কন্ঠে বলল, “না, না! কেউ যদি উঠে দেখে আমরা বাড়িতে নেই, তাহলে তুলকালাম কান্ড ঘটবে।”

আরশাদ হালকা গলায় বলল, “এত ভীতু কেন তুমি? ভয় পেলে প্রেমটা করবে কী করে?”

“প্রেম?”

আরশাদ দুষ্টুমিমাখা গলায় বলল, “কেন? বিয়ে হয়ে গেছে বলে প্রেম করা যাবে না?”

আরশাদের জোরাজুরিতে একপ্রকার বাধ্য হয়ে অরা এই ‘একটা জায়গায়’ যেতে রাজি হলো। দুজনে হাত ধরে সাবধানে বাড়ির মূল দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। আরশাদ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না অরা। বুঝতে যে খুব চাইছে এমনটাও নয়। রাতের অন্ধকারে প্রিয় মানুষটার হাত ধরে হাঁটার মাঝে অন্যরকম এক প্রশান্তি কাজ করে।

মিনিট কয়েকের মাঝে তারা পৌঁছে গেল একটা চা বাগানে। পাহাড়ঘেরা বাগানে সরু রাস্তার দুপাশেই চা গাছ। দুজনে পাশাপাশি হাঁটার মতো জায়গা নেই। অরা সামনে হাঁটছে, তার হাতটা ধরে রেখে তার পেছনেই হাঁটছে আরশাদ।

একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো দুজনে। এখান থেকে পুরো চা বাগানটা দেখা যাচ্ছে। চাঁদের চকচকে আলো এসে পড়েছে আরশাদের মুখের ওপরে। তার চেহারার স্নিগ্ধতা যেন এতে হাজারগুণ বেড়ে গেছে।

আরশাদ হঠাৎ স্মৃতিচারণ করে বলল, “ছোটবেলায় আমার যখন রাতে ঘুম আসতো না তখন চুপি চুপি চলে আসতাম এখানে। গভীর রাত পর্যন্ত বসে থাকতাম।”

অরা বলল, “ভয় লাগতো না?”

“নাহ্! বরং ভেতরে ভেতরে একটা থ্রিল কাজ করতো। এখন যেমন সবাইকে ফাঁকি দিয়ে তোমাকে এখানে নিয়ে আসায় থ্রিল কাজ করছে।”

অরা হেসে বলল, “তুমি আস্ত একটা পাগল!”

আরশাদ মুচকি হাসি হেসে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “অরা?”

“হুঁ?”

আরশাদ তার মোহনীয় গলায় বলল, “তুমি এই পৃথিবীতে সবথেকে বেশি কাকে ভালোবাসো?”

অরা সঙ্গে সঙ্গে দৃঢ় গলায় বলল, “তোমাকে!”

আরশাদ অন্যমনস্ক গলায় বলল, “তুমি তো জানো আমি কেমন। সেই কবে থেকে দেখছো আমাকে। হুটহাট রেগে যাই, রেগে গেলে কিছু না ভেবেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, এমন সব পাগলামি করি। সহ্য করতে পারবে তো আমাকে?”

“কেন পারবো না? তুমি হঠাৎ এমন প্রশ্ন করছো কেন?”

“কারণ আমার ভয় হয়। কখনো যদি রেগে গিয়ে তোমাকে কষ্ট দিয়ে ফেলি? আর তুমি যদি কষ্ট পেয়ে আমাকে ছেড়ে চলে যাও? আমি তো বাঁচতে পারবো না তাহলে।”

অরা আঁতকে উঠে বলল, “আরশাদ!”

আর এক মুহুর্তও অপচয় না করে অরা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আরশাদকে। যেন দুহাত দিয়ে আগলে রেখে তার এই অহেতুক ভয়গুলো দূর করার চেষ্টা করছে। আরশাদও জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মাথা রাখলো।

অরা কোমল স্বরে বলল, “আমার জীবন যতদিন আছে ততদিন আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।”

“প্রমিজ করলে?”

“প্রমিজ!”

(চলবে)

#ফিরে_আসা
৬০
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

স্টেজের সামনে রীতিমত ঝগড়া বেঁধে গেছে দিশা ও রনির মাঝে। কে আগে পারফর্ম করবে এই নিয়ে ঝগড়া।

রনি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “খুব না ইকুয়ালিটির গান গাও? এখন আবার এসেছো লেডিস ফার্স্টের দাবি নিয়ে? ভন্ডামীর একটা লিমিট থাকা দরকার!”

দিশা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ফালতু কথা বলবে না রনি! আমি মোটেও বলিনি লেডিস ফার্স্ট। আমরা আগে পারফর্ম করবো কারণ সবথেকে বেশি প্র্যাকটিস আমরাই করেছি।”

“বেশি প্র্যাকটিস করলে আগে নাচতে দিতে হবে এটা আবার কোন দেশি লজিক? তোমরা বেশি বেশি প্র্যাকটিস করেছো কারণ তোমরা নাচতে পারো না।”

দিশা অগ্নিদৃষ্টিতে রনির দিকে তাকিয়ে বলল,“ঠিক আছে। দেখা যাবে আজকে চেকটা কে পায়?”

আসফিয়া ছুটে এসে দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলল, “কী বাচ্চাদের মতো শুরু করলি তোরা দুজন?”

দিশা ঠোঁটে উল্টে বলল, “আপা! আমরা কত কষ্ট করে দুদিন প্র্যাকটিস করলাম! এখন না-কি ওরা আগে পারফর্ম করবে।”

আসফিয়া ঠান্ডা গলায় বলল, “আয় কয়েন টস করি। যে জিতবে সে আগে পারফর্ম করবে।”

কয়েন টসের সিদ্ধান্তে রনিকে সন্তুষ্ট মনে হলেও দিশাকে খুব একটা সন্তুষ্ট বলে মনে হলো না।

দিশা গোমড়া মুখে বলল, “আমি শাপলা নিবো!”

“আচ্ছা বাবা! এই রনি? তোর কোনো আপত্তি নেই তো?”

রনি কৃত্রিম হাই তুলে বলল, “নাহ্! আমার আবার কীসের আপত্তি থাকবে? শাপলা-টাপলা এমনিতেও মেয়েদের জিনিস।”

দিশা তার অগ্নিদৃষ্টি এখনো নিক্ষেপ করে যাচ্ছে রনির দিকে। যদিও সেই দৃষ্টিতে খুব একটা গা মাখাচ্ছে না রনি। আসফিয়া একটা পাঁচ টাকার কয়েন ছুঁড়ে মারলো আকাশে। সঙ্গে সঙ্গে কয়েনটা আবারও ফিরে এলো তার হাতের মুঠোয়।

আসফিয়া হাসি হাসি মুখে বলল, “শাপলা!”

দিশা উৎফুল্ল গলায় বলল, “ইয়েস! আমি জানতাম! শুধু শুধু ঝামেলা করলে রনি।”

রনি আসনের দিকে পা বাড়িয়ে বলল, “টসে জিতলেই ম্যাচ জেতা যায় না।”

বাড়ির সামনের দিকটা আজ চমৎকারভাবে সাজানো হয়েছে। গাঁদা আর গোলাপের মালায় মুড়ে দেওয়া হয়েছে বাড়িটাকে। বাড়ির সামনে বিশাল স্টেজ। স্টেজ বসানো হয়েছে আজ খুব ভোরে। ওপরে হলুদ রঙয়ের সামিয়ানা আর মরিচবাতি। স্টেজের চারপাশটাতেও ফুলের অপরূপ সজ্জা।

স্টেজের সামনে সকলের বসার আসন। সবগুলো সোফা হলুদ রঙের। সোফার প্রথম সারিতে বসেছে বিচারক প্যানেলের সদস্যরা। প্যানেলের বাইরে অরা বসে আছে প্রথম সারিতে। তার শাশুড়ি এবং মামী-শাশুড়ির মাঝখানে। দ্বিতীয় সারিতে অন্যান্য মুরুব্বীদের সঙ্গে বসেছে আরশাদ। নিজের পরিবারটার ওপরে বড্ড বিরক্ত লাগছে। বড় বড় অ্যাওয়ার্ড শোতে আরশাদের জন্যে প্রথম সারিটা বরাদ্দ রাখা হয়, অথচ নিজ বাড়িতেই তাকে সম্মান দেওয়া হচ্ছে না। প্রথম সারিতে বসা তার মূল লক্ষ্য নয়। মূল লক্ষ্য বউয়ের পাশে বসা।

প্রতিযোগিতার সঞ্চালনা করছে সীমা। তার হাতে একটা মাইক্রোফোন।

সীমা স্টেজে উঠে ঘোষণা করলো, “আপনাদের ধৈর্যের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। অল্প সময়ের মধ্যেই দিশার নেতৃত্বে স্টেজে পারফর্ম করতে যাচ্ছে এ বাড়ির সুন্দরী মেয়েরা।”

রনি দর্শকের আসন থেকে চিৎকার করে বলল, “আর কবে পারফর্ম করবে? দুই মিনিটের বেশি দেরি করলে তাদের বহিষ্কার করে দেওয়া উচিত!”

রনির সে আশা অবশ্য অপূর্ণই রয়ে গেল। দু মিনিটের আগেই স্টেজে উঠে গেল দিশা, মেহের, টগর আর নূপুর। চারজনের পরনেই হলুদ আর কমলার সমাহারের শাড়ি। দিশা স্কুলের সকল প্রোগ্রামই নাচের দলে থাকতো। সেই অভিজ্ঞতা থেকে পুরো নাচটা কোরিওগ্রাফ করেছে সে। নাচ মোটামুটি খারাপ হয়নি। দর্শক বেশ ভালোই উপভোগ করেছে।

তাদের পারফরমেন্স শেষে আবারও মাইক্রোফোন হাতে উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে সীমা বলল, “বিচারক প্যানেলের চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে মেয়েদের পারফরমেন্স তাদের খুবই পছন্দ হয়েছে। দেখা যাক এ বাড়ির ছেলেদের নাচ তাদের কেমন লাগে! এবার রনির নেতৃত্বে পারফর্ম করতে আসছে এ বাড়ির ছেলেরা।”

ছেলেদের কাছ থেকে এমনিতেও কারও কোনো প্রত্যাশা নেই। তাই তাদের পারফরমেন্সের প্রতি সকলের তেমন আগ্রহ নেই। চারজনের পরনেই নীল পাঞ্জাবি। এই বুদ্ধিটা অবশ্য আরশাদের। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে মেয়েরা তো হলুদ পরবেই। তাদের থেকে নিজেদের আলাদা করার জন্যে আরশাদের এই নির্দেশনা।

গানটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে সকলের আগ্রহ যেন কয়েক গুণ বেড়ে গেল। এই গান তো আরশাদের! কোনো বিয়ে বাড়ির গান নয়, তবে গানটা শুনলেই মনের অজান্তে সকলের পা দোলাতে ইচ্ছে করে। রনি ও তার দল, শাহীনের শিখিয়ে দেওয়া স্টেপগুলো পরপর অনুসরণ করে যাচ্ছে। আরশাদ বলে দিয়েছিল, “কোনো প্রেশার নিবি না। স্টেজে উঠে মনে করবি কেউ তোদের দেখছে না। প্রেশার নিলেই পারফরমেন্স খারাপ হয়ে যাবে।” ওরা আরশাদের কথা মতো বিন্দুমাত্র প্রেশার নিচ্ছে না। সকলে হা করে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। এ বাড়ির ছেলেরা এত সুন্দর নাচতে পারে?

ছেলেদের পারফরমেন্স শেষ হতেই সীমা আবারও স্টেজে উঠে বলল, “এবার শুরু হতে যাচ্ছে আমাদের মেইন প্রোগ্রাম। আমার প্রাণের বান্ধবী অরা আর আমার সুপারস্টার দুলাভাই আরশাদ ভাইয়ার গায়ে হলুদ! গায়ে হলুদের পর্ব শেষে আমাদের বিচারকেরা বিজয়ী দলের নাম ঘোষণা করবে।”

দর্শকের আসন থেকে দিশা উদগ্রীব কণ্ঠে বলল, “এটা কেমন কথা সীমা আপু? এখনি বিজয়ীর নাম ঘোষণা করো!”

সীমা মিষ্টি গলায় বলল, “দিশা, এই প্রতিযোগিতায় যেমন একটা দল জিতবে তেমনি একটা দল হারবে। যে দল হারবে তারা সারাক্ষণ গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে মন খারাপ করে থাকবে। আমরা নিশ্চয়ই চাই না গায়ে হলুদের এই অনুষ্ঠানে কেউ মন খারাপ করে থাকুক!”

শূণ্য স্টেজে সুন্দর একটা সোফা উঠানো হলো। মুহূর্তের মাঝে সোফাটাকে হলুদ আর সাদা কাপড় দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে ফেলা হলো। এই সব কাজই করছে একটা ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন কোম্পানির লোকজন। সোফার সামনে মার্বেল পাথরের একটা টেবিল এনে রাখা হলো। টেবিল ভর্তি করে রাখা হলো ফুল আর মিষ্টি।

সবার আগে আরশাদ গিয়ে উঠলো স্টেজে। তাকে দেখেই বুকে ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেল অরা। সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে বহু তারকা আছে। তবে তাদের মাঝে সবথেকে উজ্জ্বল তারাটা এই মানুষটা। অরার জীবনেও তাই। তার হলুদ পাঞ্জাবীর ওপরে সোনালী কাজ করা। ওপরের দুটো বোতাম খোলা রাখার তার জিম করা বডির কিছুটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে। পরিপাটি করে রাখা চুল আর চোখের সানগ্লাসে যেন হ্যান্ডসামনেস হাজারগুণ বেড়ে গেছে।

অরাকেও নেহায়েত কম সুন্দর লাগছে না। পরনে হলুদ লেহেঙ্গা। তার কোমর ছাড়িয়ে যাওয়া চুলগুলো আজ বাঁধনমুক্ত। গলায় আর কানে হালকা ধরনের গয়না। আর কপালে অত্যন্ত সূক্ষ্ম একটা কালো টিপ। অরাকে হলুদের ফুলেল গয়নাগুলো এখনো পরানো হয়নি। সে স্টেজে উঠলেই তাকে সেগুলো পরিয়ে দেবে দিশারা।

অরা স্টেজে উঠে আরশাদের পাশে গিয়ে বসলো। আরশাদের ভাবটা এমন যেন অরাকে খেয়ালই করেনি। ওদিকে ফিরে বড় মামাকে কী যেন বলছে। অরা বেশ বুঝতে পারছে, কাজিনদের সঙ্গে ভাব নিচ্ছে আরশাদ। কাজিনরা জানে তিনদিন ধরে অরাকে দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে আছে সে। তারা যে গত রাতেই চুপি চুপি সে দেখা সেরে ফেলেছে, এটা তো আর কেউ যাবে না।

দিশা আর সীমা একেক করে অরাকে ফুলেল গয়নাগুলো পড়িয়ে দিলো। এই গয়নাগুলো ছাড়া যেন গায়ে হলুদ পরিপূর্ণ হয় না। স্টেজ সাজানো এখনো শেষ হয়নি। যে যার মতো ব্যস্ত।

আরশাদ অরার কানে কাছে ফিসফিস করে বলল, “তুমি এত সুন্দর কেন বলতো? না মানে, নিজেকে সুন্দর রাখার জন্যে স্পেশাল কিছু করো, না-কি বাই বর্ন এতটা সুন্দর।”

অরা মুচকি হেসে ফিসফিস করে বলল, “এই একই প্রশ্ন তো আমিও তোমাকে করতে পারি।”

আরশাদ বাঁকা হাসি হেসে বলল, “আমি তো বাই বর্নই সুন্দর। ওয়ান পিস মেড, কারিগর ডেড টাইপ অবস্থা। কিন্তু তোমার রহস্যটা কী?”

অরা কিছুটা ভেবে বলল, “তোমার দেখার চোখ।”

আরশাদ বিভ্রান্ত গলায় বলল, “মানে?”

“আগে আমাকে যেভাবে দেখতে, সেভাবে অতটা সুন্দর মনে হতো না। কিন্তু এখন যেভাবে দেখো, সেভাবে সুন্দর মনে হয়।”

আরশাদ কিছুটা একটা বলার জন্যে মুখ খুলেছে, কিন্তু সেটা আর বলতে পারলো না। কথা গুটি গুটি পায়ে স্টেজে উঠে হাসিমুখে অরার দিকে ছুটে আসছে। হলুদ রংয়ের একটা ফ্রকে আজ তাকে রূপকথার রাজকন্যাদের মতো লাগছে।

কথা অরার কাছে এসে বায়না ধরে বলল, “অরা! আমিও এখানে বসবো।”

পাশ থেকে কথার বায়না শুনে সেলিনা হক তার দিকে তাকিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল, “এখানে বসে না দাদুভাই, চলো আমরা নিচে গিয়ে বসি।”

অরা বলল, “থাকুক না মা। এখানে বসতে চাইছে, বসুক।”

অরা আরশাদের কাছ থেকে সরে গিয়ে কথার জন্যে জায়গা করে দিলো। কথাও তড়িৎ গতিতে উঠে বসলো দুজনের মাঝে। দৃশ্যটা দেখে যেন সেলিনা হকের চোখ জুড়িয়ে গেল। সুন্দর সুখী পরিবারের দৃশ্য। তিনি মনে মনে প্রার্থনা করলেন, ওরা যেন আজীবন এমন সুখেই থাকে।

গায়ে হলুদের পর্ব শুরু হলো। একেক করে আত্মীয় স্বজনেরা স্টেজে উঠছেন, দুজনের গালে বা কপালে কাঁচা হলুদ ছুঁইয়ে দিচ্ছেন আর সেই সঙ্গে তাদের মিষ্টি খাইয়ে দিচ্ছেন। এরই নাম তাহলে গায়ে হলুদ? অরা কখনো কোনো গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যায়নি বলে জানতো না এ অনুষ্ঠানে বর-কনের ওপর এমন মিষ্টির অত্যাচার করা হয়। মিষ্টি খেতে খেতে বেচারির মুখের স্বাদই চলে গেছে। ওদিকে সুপারস্টার সাহেবের ডায়েটের বারোটাও ইতোমধ্যে বেজে গেছে।

একের পর এক ছবি তুলতে তুলতে এবং প্রতিটা ছবি ঠোঁটের হাসি বজায় রাখতে রাখতে অরার গালে রীতিমত ব্যথা শুরু হয়েছে। ওদিকে লাউডস্পিকারে বিয়ে বাড়ির গান বাজছে। আত্মীয়-স্বজনেরা হলুদ ছোঁয়াতে এসে কী বলছেন, বোঝার কোনো উপায় নেই।

উচ্চ শব্দের মাঝেও অরার কানে এসে পৌঁছালো আরশাদের ডাক।

“অরা?”

অরা তার দিকে ফিরে তাকাতেই আরশাদ কাঁচা হলুদের বাটিতে একবার হাত ডুবিয়ে কোমল স্পর্শে হলুদ ছোঁয়ালো অরার গালে। লজ্জায় অরা স্তম্ভের আকার ধারণ করলো। এত নির্লজ্জ কেন এই ছেলেটা? পরিবারের সকলের সামনে কেউ এভাবে বউকে ছুঁয়ে দেয়? ভাগ্যিস ব্যাপারটা কেউ লক্ষ্য করেনি। লক্ষ্য করলেও কিছু মনে করেনি।

ওদিকে ফটোগ্রাফারের ক্যামেরায় সুন্দর একট ছবি ধরা পড়লো। আরশাদ অরার গালে হলুদ ছুঁইয়ে দিচ্ছে, আর কথা চকচকে চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বসার ঘরে বড় করে বাঁধাই করে রাখার মতো একটা ছবি।

গায়েহলুদের পর্ব শেষে আরশাদ আর অরা কথাকে নিয়ে স্টেজ থেকে নেমে গিয়ে বসলো দর্শকের আসনে। এবার আর কেউ তাদের আলাদা বসাতে পারেনি। সীমা দুই দলকে স্টেজে ডেকে নিলো। সীমার ডান দিকে দাঁড়িয়েছে টিম দিশা আর বাম দিকে টিম রনি।
এরপর সে ডেকে নিলো বিচারক প্যানেলের
সদস্যদের।

সীমা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “এখন সেই মুহূর্ত যার জন্যে আমরা শুরু থেকে অপেক্ষা করে আছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আজকের বিশেষ ড্যান্স কম্পিটিশনের বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে। আপনাদের আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছি, বিজয়ী দল পাবে এক লক্ষ তেষট্টি হাজার টাকার চেক। আর পরাজিত দল সান্তনা পুরস্কার হিসেবে পাবে হাফ কেজি কালো জাম।”

সীমা হেঁটে গিয়ে সেলিনা হকের কাছে দাঁড়িয়ে বলল, “খালা তোমরা বিজয়ীর নাম নির্ধারণ করেছো?”

সেলিনা হক হাসিমুখে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।

সীমা উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে বলল, “তাহলে কে হতে যাচ্ছে আজকের বিজয়ী? টিম দিশা না-কি টিম রনি?”

সীমা তার মাইক্রোফোন নিয়ে ধরলো সেলিনা হকের সামনে। সেলিনা হক কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে রহস্যের সৃষ্টি করলেন। দিশা এবং রনি দুজনেই ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। অবশেষে সেলিনা হক নীরবতা ভঙ্গ করে হাসিমুখে বললেন, “টিম রনি!”

রনি, আকাশ, পবন আর মিশান উচ্ছ্বাসে ঝাঁপিয়ে পড়লো একে অপরের উপর। ওদিকে দিশা, মেহের, টগর ও নূপুরের চোখেমুখে যেন অন্ধকার নেমে এসেছে। দিশা ধরেই নিয়েছিল তার দল বিজয়ী হবে। তবে এটা কী হয়ে গেল? রনিরা যে বিজয়ী হতে পারে এটা তার কল্পনাতেও আসেনি।

রনি ছুটে গিয়ে স্টেজ থেকে নেমে আরশাদকে জড়িয়ে ধরলো। আরশাদ তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, “Proud of you.”

রনি আবারও ফিরে গেল স্টেজের দিকে।

অরা আরশাদের দিকে তাকিয়ে সন্দেহযুক্ত কণ্ঠে বলল, “ওদের জেতার পেছনে তোমার হাত আছে তাই না?”

আরশাদ হালকা গলায় বলল, “থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে।”

অরা আগ্রহ নিয়ে বলল, “কাহিনীটা কী?”

আরশাদ অন্যরকম গলায় বলল, “সব গল্প এখনই শুনবে?”

অরা জবাব না দিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো স্টেজের দিকে। এই ছেলেকে ভরসা নেই। যখন তখন এত মানুষের ভিড়ে নিজের লাগামছাড়া কথার মেলা খুলে বসবে।

সীমা গিয়ে ঘরের ভেতর থেকে চেকটা নিয়ে এলো। আবার মাইক্রোফোন হাতে বলল, “এবার আমাদের বিচারক প্যানেলের সদস্যদের অনুরোধ করছি এক লাখ তেষট্টি হাজার টাকার এই চেক টিম রনির হাতে তুলে দেওয়ার জন্যে।”

সীমার এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে রনি হাত তুলে বলল, “আমি কিছু বলতে চাই!”

সীমা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে মাইক্রোফোনটা তুলে দিলো রনির হাতে।

রনি মাইক্রোফোন হাতে দৃঢ় গলায় বলল, “আমরা এই পুরস্কার টিম দিশার সঙ্গে শেয়ার করতে যাই।”

উপস্থিত সকলে অবাক না হয়ে পারলো না। কেউ ভাবতেই পারেনি রনি এমন একটা কথা বলবে। এ যেন রনিদের জয়ের থেকেও বড় বিস্ময়!

দিশা ভ্রু কুঁচকে বলল, “তোমাদের পুরষ্কার আমরা নিতে যাবো কেন?”

রনি খানিক হেসে বলল, “এই কম্পিটিশনের জন্যে আমরা দুই দলই কষ্ট করেছি। তাই পুরষ্কার আমাদের সবার প্রাপ্য। আমরা এখানে জিতছে এসেছিলাম, পুরষ্কার নিতে না। জিতেছি এটাই অনেক। পুরষ্কার দুইদলের মধ্যে ভাগব হলেই আমরা খুশি।”

রনির এমন কথায় মুগ্ধ হয়ে গেল সকলে। দিশাও মনে মনে মুগ্ধ না হয়ে পারলো না। তার দল জিতলে সে মোটেও পুরষ্কার ভাগাভাগি করে নিতো না রনিদের সঙ্গে। কিন্তু রনির ভাবনাচিন্তা একেবারেই আলাদা।

দিশাকে দ্বিধা-দ্বন্দে দেখে রনি বলল, “মনে করো আমাদের টিমের পক্ষ থেকে এটা তোমাদের জন্য গিফট। আর গিফট তো ফিরিয়ে দিতে হয় না কখনো।”

রনির ইচ্ছা অনুযায়ী শেষমেশ দুটো দলই পেলো চেকটা। এক লাখ তেষট্টি হাজার টাকার চারভাগ না হয়ে হলো আটভাগ। রনির প্রতি দিশার দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই বদলে গেল। আগে তার মনে হতো এই ছেলে নিতান্তই বেকার টাইপ। দিনভর বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যার কাজ। অথচ আজ তার মনে হচ্ছে, রনির অসম্ভব সুন্দর একটা মন আছে।

উৎসবের আমেজ যেন শেষই হচ্ছে না এ বাড়িতে। সকালের আনন্দঘন গায়ে হলুদের পর্ব শেষ হতে না হতেই সন্ধ্যায় শুরু হলো হাত মেহেদিতে রাঙানোর উৎসব। ঢাকা থেকে প্রায় দশজন গুণী মেহেদি আর্টিস্ট এসেছেন এ বাড়ির মেয়েদের হাত রাঙিয়ে দিতে। বাড়ির সামনে মেয়েরা ছোট ছোট আসনে বসে হাতে মেহেদি দিচ্ছে। সবথেকে আয়োজন করে মেহেদি দেওয়া হচ্ছে অরার হাতে। সে যে আসনটায় বসেছে সেটা ফুলে সাজানো। আসনের চারিদিক আবার কুশনে ভরে গেছে। আরাম করে কুশনে হেলান দিয়ে বসে হাতে মেহেদি পরছে অরা।

দুজন ফটোগ্রাফার বিভিন্ন জায়গা থেকে এই দৃশ্য ধারণ করছে। তবুও অরার পাশে বসে পুরো দৃশ্যটার ভিডিও মোবাইলে ধারণ করছে সীমা।

অরা ক্লান্ত স্বরে বলল, “আর কত ভিডিও করবি? যা তুইও গিয়ে মেহেদি লাগিয়ে ফেল!”

সীমা বিরক্ত গলায় বলল, “আরে বাবা, আরশাদ ভাইয়ার নামটা লেখা হলেই চলে যাবো। তোর হাতে ভাইয়ার নাম লেখা হচ্ছে, এই জিনিসটা ভিডিও করা দরকার না?”

মুক্তার মতো অক্ষরে বাংলায় অরার হাতে লেখা হলো, ‘আরশাদ’। লেখাটার ওপর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অরা। এই নামটা একান্তই তার। এ পৃথিবীতে আর কারও সাধ্য নেই নামটাকে নিজের করে নেওয়ার।

মেহেদিতে হাত রাঙানো শেষে অরা অপেক্ষা করে রইলো মেহেদি শুকাবার। হাতে যতক্ষণ মেহেদি রেখে দেওয়া হয়, রঙ না-কি ততই গাঢ় হয়। প্রায় ঘন্টাখানেকের পর অরার ধৈর্য হারিয়ে গেল। হাত ধুয়ে চোখে পড়লো টকটকে লালে ফুটে ওঠা ডিজাইন। আর সেই সঙ্গে অতি প্রিয় ওই নামটা।

নিজের হাতে ফুটে ওঠা মেহেদির রঙ কাউকে দেখালো না অরা। যার নামে হাত রাঙিয়েছে তাকেই আগে দেখাবে। আরশাদকে পাওয়া গেল তার ঘরেই। তার গম্ভীর চোখদুটো আটকে আছে ল্যাপটপের দিকে। সবগুলো ব্যস্ত চোখকে ফাঁকি দিয়ে অরা তার ঘরে প্রবেশ করে তৎক্ষণাৎ দরজা লাগিয়ে দিলো। দরজার শব্দে আরশাদের ধ্যানভঙ্গ হলো।

চোখ তুলে অরাকে দেখতে পেয়েই দুষ্টুমিমাখা গলায় বলল, “সবসময় আমাকে অসভ্য অসভ্য বলে এখন নিজেই অসভ্যতা করছো?”

অরা চমকে উঠে বলল, “আমি আবার কী করলাম?”

“ভরা বাড়িতে দরজা বন্ধ করছো কেন?”

অরা লজ্জাভরা গলায় বলল, “ফালতু কথা বলবে না তো! এমনিতেই একটা জরুরি কাজে এসেছি।”

“কী কাজ?”

অরা এসে আরশাদের পাশে দাঁড়িয়ে তার হাতটা আরশাদের দিকে বাড়িয়ে দিলো। কোমল স্পর্শে তার হাতটা ধরলো আরশাদ। ভাবটা এমন যেন কোমল পদ্ম ফুল ধরছে সে। একটু জোর দিয়ে ধরলেই ফুল ছিঁড়ে যাবে।
অরা মেহেদিরাঙা হাতটা দেখেই প্রচ্ছন্ন এক হাসি ফুটে উঠলো আরশাদের ঠোঁটে। তার সবথেকে বেশি আনন্দ লাগছে নিজের নামটা দেখে। একটু একটু করে শেষমেশ অরার সবটাই নিজের অধিকারে নিয়ে ফেলল আরশাদ!

(চলবে)