ফিরে আসা পর্ব-৬১+৬২

0
763

#ফিরে_আসা
৬১+৬২
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

দিন শুরু হওয়ার আগেই বিয়েবাড়ির উৎসাহ-উত্তেজনায় ভাটা পড়লো। সকলের মুখ থেকে উচ্ছ্বাস দূর হয়ে জায়গা করে নিলো একরাশ দুশ্চিন্তা। দুশ্চিন্তাটা অরাকে ঘিরে। সকাল থেকে বেচারির জ্বর। আজ আরশাদ-অরার বিয়ে। কোথায় মেয়েটা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে থাকবে! তা না বরং গলা পর্যন্ত চাদর টেনে শুয়ে আছে বাংলাঘরের বিছানায়।

চিন্তিত মুখগুলো সব বাংলাঘরে জড়ো হয়েছে। সীমা অরার কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ওদিকে দিশা তার হাত ডলে দিচ্ছে। সেলিনা হক প্রচন্ড দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। বৌ যদি জ্বরে কাত হয়ে পড়ে থাকে তাহলে বিয়েটা হবে কী করে? তবে কি শেষমেশ বিয়েটা স্থগিত করতে হবে? তা কী করে হয়? সকল অতিথিদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই ঢাকা থেকে রওনা দিতে শুরু করেছে ইন্ডাস্ট্রির নামিদামি তারকারা।

খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বাংলাঘরে ছুটে এলো আরশাদ। যদিও তার এবং অরার দেখা করার নিষেধাজ্ঞা এখনো জারি আছে। সেই নিষেধাজ্ঞার কোনপ্রকার তোয়াক্কা না করে আরশাদ গেল অরার কাছে। ঘর ভর্তি আরশাদের মামী-চাচীরা। তার ওপর আবার তার মাও আছেন। তবুও কোনপ্রকার সংকোচ না করে আরশাদ অরার পাশে বসে হাত রাখলো তার কপালে। একান্ত নিজের জিনিসকে স্পর্শ করতে সংকোচ কীসের?

আরশাদ নিচু গলায় বলল, “অরা? ঠিক আছো তুমি?”

অরা অস্পষ্ট গলায় বলল, “হুঁ।”

মুখে “হুঁ” বললেও আরশাদ বুঝতে পারছে অরা ঠিক নেই। জ্বরে তার গা রীতিমত কাঁপছে। কপালটাও উত্তপ্ত।

সেলিনা হক চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “বিয়েটা আজকের মতো ক্যানসেল করবি না-কি আরশাদ?”

আরশাদ কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “আমার মনে হয় না তার দরকার হবে মা। অরার ঘন ঘন জ্বরের টেন্ডেন্সি আছে।”

সেলিনা হক উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, “তবুও, বৌমাকে প্রেশার দিস না। ওর কষ্ট হলে বিয়েটা পিছিয়ে দেই।”

অরা বিছানায় পড়ে থেকেই ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “কোনো দরকার নেই মা। আজকেই বিয়ে হবে।”

“তুমি সিওর বৌমা?”

“হ্যাঁ মা।”

আরশাদ আশ্বাস দিয়ে বলল, “তুমি চিন্তা কোরো না মা। বললাম না, অরার ঘন ঘন জ্বর হয়। কয়েক ঘন্টা ভুগিয়ে আবার সেরে যায়। তোমরা এমন মুখ গোমড়া করে আছো কেন? যে যার কাজে যাও তো। এই দিশা! দৌড় দিয়ে ফ্রিজ থেকে আইস ব্যাগ নিয়ে আয়।”

দিশা ঝড়ের গতিতে আইস ব্যাগ নিয়ে এলো। এই মুহূর্তে কেউ নেই বাংলাঘরে, কেবল আরশাদ আর অরা। বাড়িতে আজ কাজের অভাব নেই। সকলে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না।

আরশাদ এক হাত দিয়ে অরার কপালে আইস ব্যাগ চেপে দিচ্ছে। আরেক হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে অরার হাত।

আরশাদ নরম স্বরে বলল, “জ্বর আসলো কীভাবে?”

অরা অস্পষ্ট গলায় বলল, “আমি কী করে জানবো?”

আরশাদ সন্দেহমিশ্রিত কণ্ঠে বলল, “বৃষ্টি তো কাল হয়নি। ঠান্ডা কিছু খেয়েছিলে?”

“ঠান্ডা কিছু খেলেই কারোর জ্বর হয় না-কি?”

আরশাদ বাঁকা হাসি হেসে বলল, “জানতাম! কাল রাতে যখন সবাইকে আইস্ক্রিম খেতে দেখলাম তখনি বুঝেছিলাম।”

অরা হঠাৎ বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠে বলল, “আমার সাথেই কেন এমন হয়?”

আরশাদ ব্যস্ত ভঙ্গিতে অরার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, “কাঁদছো কেন? এভাবে কেউ কাঁদে বোকা মেয়ে? ডক্টরকে ফোন করেছি, এখনই সব ঠিক হয়ে যাবে।”

আধ ঘন্টার মধ্যে ডাক্তার সাহেব চলে এলেন। সেদিন ওই হোটেলে অরা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর, আরশাদ তাকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে এই ডাক্তারকেই খবর দিয়েছিল। জ্বর খুব বেশি না হলেও অগ্রাহ্য করার মতো নয়। এক’শ পয়েন্ট ছয়। ডাক্তার সাহেব কতগুলো ওষুধ লিখে দিয়ে গেলেন। সেই সঙ্গে বলে গেলেন, জ্বর দ্রুত কমাতে মাথায় পানি দিতে।

আরশাদ আর কাউকে বিরক্ত করতে গেল না। বউটা যখন তার, তখন মাথায় পানিও সেই দেবে। অরার হাজার বারণ সত্ত্বেও আরশাদ বাথরুম থেকে পানিভর্তি বালতি নিয়ে এলো। সুপারস্টার আরশাদ হক, যার সামান্যতম কাজ করে দেওয়ার জন্যেও বাড়িভর্তি স্টাফ আছে, সে কিনা কারও মাথায় পানি ঢেলে দিচ্ছে। ভাবা যায়?

মাথায় পানি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরামে আচ্ছন্ন হয়ে গেল অরার পুরো শরীর। মনটাও নেহায়েত কম আরাম পেলো না। নিজের ভাগ্য ক্রমশই বিস্মিত করে তুলছে তাকে। এই ভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে না এলে সত্যিই বিরাট ক্ষতি হয়ে যেত।

মাথায় পানি ঢালায় কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল অরা। ওষুধগুলোতে সম্ভবত ঘুমের প্রভাব ছিল। আরশাদ সকলকে বারণ করে দিলো যেন দুপুরের আগে তাকে ঘুম থেকে না তোলা হয়। ভাগ্যিস বিয়েটা দুপুরে নয়, রাতে।

বিয়ের অনুষ্ঠান বাড়িতে করা হবে না। বিয়ে হবে সিলেটের সবথেকে জমকালো এবং বিলাসবহুল পাঁচতারকা হোটেলে। সেই হোটেল, যেখানে প্রথমবারের মতো বিয়ে করেছিল আরশাদ-অরা। ওই হোটেলে তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আরও একটা স্মৃতি যোগ হলে মন্দ হয় না।

বিয়ের অনুষ্ঠান উপলক্ষে পুরো হোটেলটা আগে থেকে বুক করেছিল আরশাদ। আজ হোটেলে বাইরের কোনো অতিথি নেই, কেবলই বিয়ে বাড়ির অতিথি। বেলা একটার দিকে আরশাদের কাজিনরা দল বেঁধে চলে গেল হোটেলে। নিচ তলার গ্র্যান্ড হলে তাদের বিয়েটা হবে। সেই উপলক্ষে গ্র্যান্ডভাবেই সাজসজ্জা চলছে। ওরা সবাই সেই সাজসজ্জার তদারকি করবে।

ওদিকে আরশাদের মামা আর চাচারাও চলে গেলেন খানিকক্ষণের মধ্যে। ঢাকা থেকে আগত অতিথিরা সিলেটে ল্যান্ড করে ফেলেছে। তাদের স্বাগতম জানতেই যাওয়া।

অরার ঘুম ভাঙলো বেলা সাড়ে তিনটায়। জ্বরটা একেবারেই উড়ে গেছে। সবই আরশাদের মাথায় পানি ঢালার ফল। তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো অরা। আরশাদ এতটা সময় তার পাশেই ছিল।

অরা চোখদুটো কচলে বলল, “অনেক দেরি করে ফেলেছি না?”

আরশাদ নিশ্চিন্ত গলায় বলল, “দেরির কী আছে?”

অরা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে বলল, “ঠিক দুইটায় আমার সাজতে বসার কথা! তুমি আমাকে ডাকলে না কেন?”

আরশাদ হালকা গলায় বলল, “এত সেজে কী করবে? তুমি তো এমনিতেই সুন্দর।”

প্রশংসায় বিগলিত হয়ে উঠে গেল অরা। গোসল সেরে কোনমতে খাওয়া-দাওয়া করে তাকে ছুটতে হবে হোটেলের উদ্দেশ্যে। ওই হোটেলেই মেকআপ আর্টিস্টরা অপেক্ষা করছে তার জন্যে।

দুপুরের খাবার শেষে সেলিনা হক অরাকে বললেন, “বৌমা, দেরি যখন করেই ফেলেছো তখন আরেকটু দেরি করো। সুন্দর একটা শাড়ি পরে যাও। অতিথিরা হোটেলে আসতে শুরু করেছে। সাজতে বসার আগেই অনেকের সঙ্গে দেখা হবে।”

শাশুড়ির পরামর্শ মোটেও অগ্রাহ্য করলো না অরা। চট করে সবুজ রঙের একটা শাড়ি পরে নিলো। অরাকে হোটেলে নিয়ে যাবে আরশাদ। যদিও এত আগে থেকে তাকে রেডি হতে হবে না, তবুও যাচ্ছে। তার ইন্ডাস্ট্রির অনেক বন্ধুরা এসেছে। সকলের সঙ্গে আড্ডায় সময়টা পাড় হয়ে যাবে। অরা চেয়েছিল কথাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে। তবে সেটা আর সম্ভব হলো না। কাল সারারাত কথা দিশা আর মেহেরের সঙ্গে হইচই করে ক্লান্ত। ঘুমিয়েছে ভোর পাঁচটায়। সেই ঘুম এখনো ভাঙেনি।

অরার ইচ্ছা ছিল, আজ নিজের হাতে সে সাজিয়ে দেবে কথাকে। সেলিনা হক আশ্বাস দিলেন অরার সেই ইচ্ছা অপূর্ণ রাখবেন না। ঠিক সময়মতো কথাকে নিয়ে হোটেলে হাজির হবেন তিনি।

দুই ধারে সবুজ চা বাগান। আর মাঝপথে ছুটে চলছে আরশাদের বিখ্যাত গাঢ় সবুজ রঙের ছাদখোলা গাড়ি। ঢাকায় এই গাড়ির ছাদ খুলে রাখার উপায় নেই। বরং কালো জানালা টেনে রাখতে হয়। আরশাদকে রাস্তায় দেখলে অফুরন্ত ভীড় জমে যাবে। এই দিকটাতে তেমন একটা লোকালয় নেই বলে রক্ষা।

অরা একটু পর পর আড়চোখে তাকাচ্ছে আরশাদের দিকে। তার পরনে ডার্ক ব্লু শার্ট আর ডেনিম জিন্স, আর চোখে কালো সানগ্লাস। ছেলেটা নেহায়েত রাজপুত্রের মতো লাগছে। নাহ্! রাজপুত্ররাও এত সুন্দর হয় না।

আরশাদ আচমকা শীতল গলায় বলল, “নিজের হাসবেন্ডের দিকে কেউ আড়চোখে তাকায়? তাকাতে চাইলে সরাসরিই তাকাতে পারো। কোনো বাঁধা নেই।”

অরা তড়িৎ গতিতে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ছেলেটা বুঝে ফেলল কী করে?

হোটেলের সামনে গাড়ি থামতেই তাদের ওয়েলকাম করার জন্যে এগিয়ে এলেন হোটেলের ম্যানেজার ও কিছু স্টাফ। তার হাতে মস্ত এক ফুলের তোরা। ফুলটা তারা আরশাদের দিকে বাড়িয়ে দিলে আরশাদ ইশারায় দিতে বলল অরাকে।

হোটেলের বাইরে রয়েছে এদের নিজস্ব চা বাগান। এই চা বাগান ঘুরে দেখতে হয় হোটেলের নিজস্ব গাড়িতে। এই চা বাগানের কাছে দাঁড়িয়েই ছবি তুলছিল আরিয়ান, সাদেক, রেহান এবং নাসিম। সকলেই সিনেমা জগতের চেনা মুখ। এদের সকলের ক্যারিয়ারই শুরু হয়েছিল আরশাদের সমসাময়িক সময়ে।

আরিয়ান এতদিন পর নিজের প্রিয় বন্ধুকে পেয়ে ছুটে এলো। আরশাদের মুখেও ফুটে উঠলো প্রচ্ছন্ন একটা হাসি। এই হাসিটা এক পলক দেখার জন্যেই হাজার বছর কাটিয়ে দেওয়া যায়। পুরনো বন্ধু, আড্ডা – এসব যে আরশাদ একেবারেই পছন্দ করতো না সে আরশাদ আজ নিজে থেকে আড্ডায় যোগ দিচ্ছে।

আরশাদ তাদের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আগে অরার দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, “তুমি একা যেতে পারবে তো?”

অরা হাসিমুখে আশ্বাস দিয়ে বলল, “পারবো।”

হোটেলের সামনে থেকে শুরু করে লবি পর্যন্ত সবখানে চলছে সাজসজ্জা। লবিতে পৌঁছাতেই অরার দেখা হয়ে গেল অভিনেত্রী শেহনাজের সঙ্গে। এই অভিনেত্রীকে সে সানরাইজ স্টার অ্যাওয়ার্ডে পারফর্ম করতে দেখেছিল। শেহনাজের সঙ্গে কতক্ষণ হাসিমুখে আলাপ করে লিফটের দিকে এগিয়ে যেতেই অরার সামনে পড়লো আরও কয়েকজন অভিনেত্রী। সকলের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতে হলো, ছবি তুলতে হলো।
সেলিব্রিটিদের সামনে কেমন জড়োসড়ো হয়ে যায় অরা। অদ্ভুত কান্ড! আরশাদের ম্যানেজার থাকার সময়ে তো কখনো এমনটা অনুভব হয়নি। হয়তো তখন সেলিব্রিটিরা তাকে দেখতো আরশাদের ম্যানেজার হিসেবে আর এখন দেখে তার স্ত্রী হিসেবে, এজন্যে।

অরার সাজগোজের জন্যে বরাদ্দ করা রুমটায় গিয়ে সে জানলো পারলো, মেকআপ আর্টিস্টরা লাঞ্চে গেছে। যারা আছে তারা হেয়ার স্টাইলিস্ট। মেকআপ আর্টিস্টদের ফিরতে ফিরতে বিশ মিনিটের মতো লাগবে। বসে বসে অপেক্ষা করতে ইচ্ছা করছে না। অরা তাই ঘুরে বেড়াবার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। নিচতলায় ব্যাপক ডেকোরেশন হচ্ছে। সেসব না হয় দেখা যাবে।

লিফটে উঠেই হঠাৎ অরার মস্তিষ্কে ভেসে উঠলো একটা চিত্র। এই হোটেলের সাতটার ওই হলওয়ের চিত্র। যে হলওয়েতেই নির্ধারণ হয়ে গিয়েছিল আরশাদ আর অরা বাকিটা জীবন একসঙ্গে থাকবে। নিচতলায় না গিয়ে অরা কী যেন মনে করে সাত লেখা বোতামটা চাপলো। একবার নিজ চোখে গিয়ে জায়গাটা দেখতে ইচ্ছা করছে, জায়গাটাকে অনুভব করতে ইচ্ছা করছে।

সাততলায় অতিথিদের জন্যে কোনো রুম বুক করা হয়নি। এই তলায় আজ আরশাদের পরিবারের লোকজন থাকবে। তারা কেউ এই মুহূর্তে কাজে ব্যস্ত, আর কেউ এখনো বাড়িতে। তাই এই তলাটা ফাঁকাই পড়ে আছে।

সাততলায় পৌঁছে রীতিমত চমকে গেল অরা। হলওয়ের অপরপ্রান্তে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরশাদ। হাত দুটো ভাঁজ করে বুকের কাছে বাঁধা। অন্যমনস্ক থাকায় টের পায়নি অরার উপস্থিতি। টের পেলো যখন অরা গিয়ে দাঁড়ালো তার সামনে।

অরা অবাক গলায় বলল, “তুমি এখানে?”

আরশাদ সংবিৎ ফিরে পেয়ে চোখ তুলে তাকালো অরার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে তার ঠোঁটে ফুটে উঠলো মোহনীয় একটা হাসি। এই মেয়েটা আশেপাশে থাকতে তার মনটা যেন এমনিতেই হেসে ওঠে।

অরা আশ্চর্য গলায় বলল, “এখানে কী মনে করে?”

আরশাদ অরা হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তাকে নিজের বুকে ফেলে বলল, “তুমি যা মনে করে এসেছো!”

আরশাদের এমন আকস্মিক কান্ডে লজ্জায় লাল হয়ে গেল অরা। তবুও তাকে জড়িয়ে ধরতে বিন্দুমাত্র ভুল করলো না।

অরা আরশাদের দিকে তাকিয়ে কৌতূহল নিয়ে বলল, “অত গম্ভীরভাবে কী ভাবছিলে?”

আরশাদ শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “ওই দিনটার কথা ভাবছিলাম। যেদিন তুমি ঠিক ওখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলে। আর আমি তোমাকে কোলে করে আমার ঘরে নিয়ে গেলাম।”

কয়েক মুহূর্ত নীরবতায় কেটে গেল। অরা হঠাৎ কী যেন মনে করে শুকনো গলায় বলল, “আচ্ছা আরশাদ? এই সত্যিটা কি কেউ কোনোদিন জানবে না?”

“কোন সত্যি?”

অরা ইতস্তত করে বলল, “সবাই জানে ওই ভিডিওটা ভাইরাল হওয়ার আগে আমাদের বিয়ে হয়েছিল। তুমি যখন আমাকে তোমার ঘরে নিয়ে গেলে তখন আমরা ম্যারিড ছিলাম। কিন্তু সেটা তো আর সত্যি না। তখনও তো আমাদের বিয়ে হয়নি।”

আরশাদ সূক্ষ্ম হাসি হেসে বলল, “তুমি চাও এটা সবাই জানুক?”

“না মানে, সবাইকে সব সত্যিই তো জানিয়ে দিলে। তাহলে এটা গোপন রাখলে কেন?”

আরশাদ ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “কিছু সত্যি গোপনে থাকাই ভালো অরা। ওইদিন তোমাকে আমার ঘরে নিয়ে গিয়েছিলাম কারণ তুমি অসুস্থ ছিলে। মানুষ তো আর সেটা বুঝলো না। তারা মনে করেছিল, আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিল। আসলে তো আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। But you can’t change people’s minds. তারা যা ভাবার তাই ভাববে। তাদের ওই নোংরা চিন্তাগুলোকে দমিয়ে দেওয়ার জন্যই তো বিয়েটা করলাম আমরা। এখন যদি আসল সত্যিটা জানিয়ে দিই সবাইকে, তখন তারা আর আমাদের এই বিয়েটাকে পবিত্র বলে মনে করবে না। স্বামী-স্ত্রী হিসেবে আমাদের সম্মান করবে না। আর আমি নিশ্চয়ই চাই না কেউ তোমাকে অসম্মান করুক। সবার কাছে যেটা সত্যি সেটাকে প্রকৃত সত্যি হিসেবে মেনে নাও।”

মনে মনে নিজেকে হাজারো দোষারোপ করতে ব্যস্ত হয়ে গেল অরা। কী দরকার ছিল আরশাদকে এই প্রশ্নটা করার? আজকের এই সুন্দর দিনের হওয়াটাকে অহেতুক ভারী করে তোলার?

পরিস্থিতি হালকা করার জন্যে অরা বলল,
“সবাই তো জানে তুমি আমাকে প্রোপজ করেছিলে। আসলে তো করোনি!”

“করেছিলাম তো! সেদিন ছাদে, মনে নেই?”

প্রবল হওয়া বয়ে গেল অরার গা বেয়ে। ওই রাতটার কথা মনে করলেও অরা আর নিজের মধ্য থাকে না। কোথায় যেন হারিয়ে যেন।

বহুকষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে অরা বলল, “আরে ধুর! এই বিয়ের আগে না। প্রথমবার বিয়ের আগে।”

অরাশাদ দুষ্টুমিমাখা স্বরে বলল, “সবকিছুই দুইবার দুইবার লাগবে তাই না? দুইবার প্রোপজ, দুইবার বিয়ে, দুইবার বাসর!”

অরা আরশাদকে ছেড়ে লজ্জারাঙ্গা গলায় বলল, “উফ! তোমার মতো অসভ্যের সাথে কথা বলতে আসাটাই আমার ভুল হয়েছে।”

মেকআপ আর্টিস্টরা তাদের কাজে বেশ পারদর্শী। নির্ধারিত সময়ের দুই ঘন্টা পর মেকআপ শুরু করলেও, শেষ করতে খুব একটা সময় লাগলো না। মেকআপ শেষে অরা তার টকটকে লাল লেহেঙ্গা পরে এলো। তার বিয়ের লেহেঙ্গা! এই লেহেঙ্গা আরশাদ নিজে পছন্দ করে কিনেছে। হেয়ার স্টাইলিস্টরা অদ্ভুত সুন্দরভাবে অরার চুলগুলো বেঁধে দিলো। চুলের ফাঁকে ফাঁকে সাদা আর গোলাপী ফুল। অরার লেহেঙ্গার ওড়নাটা নেটের। নেট ভেদ করে এই ফুলগুলো দেখতে অপরুপ সুন্দর লাগবে।

অরার বিয়ের গয়না-গাটিও আরশাদের পছন্দের। বিয়ের শপিং নিয়ে তাকে কোনো দুশ্চিন্তাই করতে হয়নি। ভারী গয়না অরার কখনোই পছন্দ করে না। তবে আজ সকল অপছন্দকে দমিয়ে রেখে হাসিমুখে গয়নাগুলো পরলো অরা। বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ দিনে একটা মেয়ে ভারী সাজে সাজবে না, এটা কেমন কথা?

সাজ শেষে নিজেকে আয়নায় দেখে নিজেই বিস্ময়ের চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে গেল অরা। নিজেকে বিয়ের সাজে যেমনটা কল্পনা করেছিল, ঠিক তেমনই লাগছে তাকে। বিয়ে হয়ে গেলেও এতদিন এই একটা আফসোস তার ছিল। বৌ সাজতে না পারার আফসোস। আজকের পর থেকে আর কোনো আফসোস থাকবে না।

সন্ধ্যার আগে আগে সেলিনা হক কথাকে নিয়ে এলেন। বাড়ির সবাই অনেক আগেই চলে এসেছে। তারাও যে যার মতো সাজগোজ করছে।

কথা অরাকে দেখে বিস্ময়ে খাবি খেয়ে বলল, “অরা! তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে।”

অরা হাসিমুখে বলল, “তাই না-কি? কোন প্রিন্সেসের মতো লাগছে।”

কথা অনেক ভাবনা-চিন্তা করেও কোনো প্রিন্সেসের নাম খুঁজে পেলো না। শেষমেশ পরাজিত গলায় বলল, “প্রিন্সেসরা তোমার মতো সুন্দর না।”

অরা যত্ন নিয়ে সাজিয়ে দিলো তার আদরের কথাকে। কথা নিজে পছন্দ করে বিয়ে উপলক্ষে লাল আর সোনালী রঙয়ের জমকালো একটা গাউন কিনেছে। অরা তাকে সেই গাউন পরিয়ে তার ছোট ছোট গয়নাগুলো পরিয়ে দিলো। বাচ্চাদের মুখে মেকআপ মানায় না। তবুও কথা জোরাজুরি করছিল বলে তার ঠোঁটে হালকা লিপগ্লস লাগিয়ে দিলো অরা।

অরার জ্বরটা পুরোপুরি চলে গেলেও যেকোনো সময় তার ফিরবার আশঙ্কা আছে। তাছাড়া মাথাটাও সেই তখন থেকে ঝিমঝিম করছে। হয়তো অতিরিক্ত উত্তেজনার কারণে। অরা চট করে দুটো প্যারাসিটামল খেয়ে নিলো। আজকের মতো দিনে সে কিছুতেই অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকতে চায় না।

হোটেলের গ্র্যান্ড হল উজ্জ্বল আলোয় চকচক করছে। হলজুরে উপস্থিত সেলিব্রিটি ও তাদের জাকজমক পোশাক যেন সেই উজ্জ্বলতা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আরশাদের পরিবারের সকলে হলজুড়ে ঘোরাফেরা করছে, নিজেদের মতো ছবি তুলছে। কেউ মোবাইলে, কেউ ফটোগ্রাফারদের ক্যামেরায়।
সকলের ঠোঁটে লেগে থাকা প্রচ্ছন্ন হাসি যেন উৎসবের আমেজে বাড়তি রঙ যোগ করছে।

আরশাদ আর অরা যেখানে বসবে, সেই জায়গাটা রাজকীয়ভাবে সাজানো হয়েছে। সাদা আর সোনালীর সমাহারে একটা সোফা,
সোফার নিচে লাল রঙয়ের কার্পেট। স্টেজজুড়ে অসংখ্য নাম না জানা ফুলের ছড়াছড়ি। স্টেজের ঠিক বিপরীতে ভারী ভারী প্রচুর লাইট লাগানো হয়েছে। ছবি তোলার সময়ে যাতে তাদের চেহারা স্পষ্ট বোঝা যায়।

বিয়ে পড়ানো শেষ হলে আরশাদ আর অরা একসঙ্গে এই স্টেজে এসে বসবে। তবে বিয়ে পড়ানো হবে ভিন্ন একটা স্টেজে। ওই স্টেজ এই হলের আরেক দিকে। স্টেজের মাঝ বরাবর গোলাপ আর বেলিফুলের পর্দা। পর্দার এ পাশে মেয়েরা অরাকে নিয়ে বসবে আর ওপাশে ছেলেটা বসবে আরশাদকে নিয়ে।

কোনপ্রকার আগাম বার্তা ছাড়াই হলে আগমন ঘটলো আরশাদের। তাকে দেখে অতিথিদের মাঝে যেন হইচই পড়ে গেল। ফটোগ্রাফাররা যে যেখানে ছিল, ছবি তোলা ফেলে আরশাদের দিকে ছুটে এলো। আরশাদ দৃপ্ত পায়ে হলে প্রবেশ করছে, এই দৃশ্যটা ক্যামেরায় বন্দী না করলে বিরাট ভুল হয়ে যাবে। অতিথিরাও যে যার মোবাইল বের করে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

ইন্ডাস্ট্রির অনেক নামকরা নায়িকারা উপস্থিত আছে এই বিয়েতে। আরশাদকে দেখে তারা যেন ধাক্কার মতো খেল। এই ছেলেটার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে তাদের। সোনালী শেরওয়ানিতে তাকে আজ লাগছে হ্যান্ডসামের চূড়ান্ত! লালের ওপর সোনালী কাজ করা একটা ওড়না গলার সঙ্গে পেঁচিয়ে রাখায় সেই হ্যান্ডসামনেস যেন আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। আরশাদের উপস্থিতি এই হলের জাকজমকতা যেন হাজারগুণ বাড়িয়ে দিলো।

বিয়ে পড়ানোর স্টেজে ফুলেল পর্দার এপাশে নিজের আসনে গিয়ে বসলো আরশাদ। তাকে ঘিরে সমস্ত অতিথিরা। আরশাদ হাসছে, সবার সঙ্গে কথা বলছে। ঠিক যেন সেই আগেকার আরশাদ।

ছেলেদের জীবনের দীর্ঘ সময় কাটে মেয়েদের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে। আরশাদও তার ব্যতিক্রম নয়। অরার অপেক্ষায় কাটানো মুহূর্তগুলো কিছুতেই শেষ হচ্ছে। তার সাজগোজে শেষ মুহূর্তের টাচআপ চলছে।

মিনিট দশেক পর আবারও হইচই পড়ে হলে। ছোট ছোট বাচ্চারা, “বৌ এসেছে!” বলে ছুটে গেল হলের মূল দরজার দিকে। কথার হাত ধরে প্রবেশ করলো অরা। তাকে যে দেখছে, সেই মুগ্ধ হচ্ছে। তবে যার মুগ্ধ হতে সবথেকে বেশি ইচ্ছা করছে সে আর দেখতে পারলো না। ইচ্ছাটা দমিয়ে স্থির হয়ে বসে রইলো। না জানি তার প্রাণপাখিটাকে বধূবেশে কেমন লাগছে।

বিয়ে পড়ানো শুরু হলো। সকল অতিথিরা এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। অরার হৃদস্পন্দন যেন ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। অচেনা এক আনন্দে নেচে উঠছে তার অন্তরাত্মা। কেন এমন লাগছে? সে তো প্রথম বিয়ে করছে না। তাকে ঠিক এভাবেই বিয়ে পড়ানো হয়েছিল। কই? তখন তো এমন অনুভব হয়নি!

কাজী সাহেব যখন কবুল বলতে বললেন, হিমবাহের ন্যায় জমে গেল অরা। প্রত্যেকটা মেয়েই কী কবুল বলার আগে এমন অনুভব করে? গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে অরার। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এসেছে। কী অদ্ভুত ব্যাপার! কবুল শব্দটা সে আগেও তো বলেছে। অবশ্য সেই পরিস্থিতি আর আজকের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন।

সাত-পাঁচ চিন্তাগুলোকে মনের খাঁচায় বন্দী করো অরা কম্পিত স্বরে বলল, “আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”

আরশাদ অবশ্য কবুল বলতে অরার মতো সময় অপচয় করলো না। কাজী সাহেব বলার সঙ্গে সঙ্গে কবুল বলে ফেলল সে। যেন শব্দটা উচ্চারণ করেই ছুটে গিয়ে ট্রেন ধরতে হবে তাকে।

বিয়ে শেষে ফুলের চাদরটা সরিয়ে ফেলা হলো। চাদর সরিয়ে ফেলার আগেই দিশা আর আসফিয়া অরার মুখটা চাদর দিয়ে ঢেকে ফেলেছিল। ফুলের চাদর সরে যেতেই তাই বিরক্তিতে গা জ্বলে গেল আরশাদের। এত প্রতীক্ষার পরও বধূবেশে দেখতে পারবে না নিজের বউকে?

মেয়েরা অরাকে এনে বসলো আরশাদের পাশে। প্রতীক্ষার অবসান অবশেষে হতে যাচ্ছে। আরশাদের বুক ইতোমধ্যেই ধুকপুক করতে শুরু করেছে। দিশা একটা গোলাকার আয়না এনে অরার মুখের সামনে ধরলো। সেই আয়নায় আরশাদ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে অরার প্রতিচ্ছবি।

কয়েক মুহূর্তের জন্যে নির্বাক বনে গেল আরশাদ। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতেও যেন কষ্ট হচ্ছে। অরাকে তো কতভাবেই দেখেছে সে। কখনো স্যুট-শার্টে, কখনো সালোয়ার-কামিজে, আবারও কখনো শাড়িতে। তবে আজ এই নববধূ রূপে তাকে সবথেকে সুন্দর লাগছে। এই সুন্দরের কোনো সংজ্ঞা নেই। একে ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। আয়নার প্রতিফলনের মাঝেই হারিয়ে গেল আরশাদ। ওদিক থেকে দিশা কিছু একটা জিজ্ঞেস করছে তাকে, সে বুঝতে পারছে তবে প্রশ্নটা তার কর্ণকুহুরে প্রবেশ করছে না।

দিশা আরেকটু জোর দিয়ে বলল, “এই ভাইয়া!”

আরশাদ সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলল, “কী?”

“বলো!”

“কী বলবো?”

দিশা হাসিহাসি মুখে বলল, “কী দেখা যায়?”

আরশাদ খানিকক্ষণ ভেবে প্রচ্ছন্ন একটা হাসি হেসে বলল, “আমার বেস্টফ্রেন্ডকে।”

অরার গায়ের ওপর থেকে চাদরটা সরিয়ে দেওয়া হলো। নিজ চোখে এবার আরশাদ দেখতে পাচ্ছে তাকে। অরা চোখ তুলে আরশাদের দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে দুজনের ঠোঁটেই ফুটে উঠলো মোহনীয় এই
হাসি।

আজকের এই দিনটার জন্যে আরশাদ না জানি কতদিন ধরে অপেক্ষা করে ছিল। তার একান্ত ব্যক্তিগত অরাকে আবারও নিজের করে নেওয়ার অপেক্ষায়। প্রথমবার বিয়েটা তারা করেছিল লুকিয়ে লুকিয়ে, সকলের আড়ালে। আর আজ পুরো পৃথিবীর সামনে অরাকে নিজের করে নিলো আরশাদ।

মূল স্টেজে গিয়ে পাশাপাশি বসলো আরশাদ-অরা। দুজনকে একসঙ্গে দারুণ মানিয়েছে। আগত অতিথিদের মাঝে প্রশংসার বন্যা বয়ে গেল। আরশাদ শক্ত করে অরার একটা হাত ধরে রেখেছে। হাজার লজ্জা সত্বেও সেই হাতটা ছাড়িয়ে নিলো না অরা। ওই হাতটা ধরে থাকার চেয়ে প্রশান্তি এই পৃথিবীর কোনো কিছুতেই নেই।

আরশাদ হঠাৎ নিচু গলায় বলল, “আমাদের বাসর কোথায় হবে বলো তো!”

অরা অবাক গলায় বলল, “তোমার মাথায় সারাদিন এই এক চিন্তাই ঘোরে?”

“হ্যাঁ। এখন গেস করো কোথায় বাসর হবে।”

“কোথায়?”

আরশাদ খানিকটা রহস্যমাখা গলায় বলল, “তুমি অজ্ঞান হওয়ার পর তোমাকে যে রুমটায় নিয়ে গিয়েছিলাম, সেখানে।”

অরা হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “তুমি কি পাগল?”

আরশাদ হালকা গলায় বলল, “এর উত্তর তো তোমার জানা।”

“ওই ঘরটাই কেন?”

“প্রথমবার বিয়ের পর ওই ঘরে আমাদের বাসর হলেও হতে পারতো। কিন্তু হয়নি। আজ হবে।”

লজ্জায় অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো অরা। এই ছেলেটা নিয়ে আর পারা যায় না!

বাসর ঘরে আরশাদের অপেক্ষায় সময় পার করছে অরা। কতগুলো মানুষের সামনে তাকে বাসর ঘরে নিয়ে আসা হলো। লজ্জায় অরার মাথা কাটা যাচ্ছে। ঘটা করে বাসর ঘোর সাজানোর কী দরকার ছিল? এবারই তাদের প্রথম বিয়ে? সব কুবুদ্ধি আরশাদের!

এই ঘরটায় প্রবেশ করার পর থেকে কেমন স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছে অরা। সাত-আট মাসে আগে, আচমকা এক সকালে ঠিক এই ঘরে ঘুম ভাঙে তার। বিভ্রান্তি আর ভয় যেন ঝেঁকে ধরেছিল তাকে। কিছুতেই অরা বুঝতে পারছিল না কী করে তার স্যারের ঘরে এসে পৌঁছালো সে। সেদিনের অনুভূতির সাথে আজকের অনুভূতির কোনো মিল নেই। আজ অরার মনটা সেই শুরু থেকে একুলিবিকুলি করছে আরশাদকে দেখার জন্যে।

দরজা খোলার আওয়াজ কানে আসতেই সাত-পাঁচ ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো অরা। এতক্ষণ যাকে দেখার জন্যে মনটা ছটফট করছিল, অবশেষে তারই আগমন ঘটলো। অথচ চোখ তুলে তাকানোর সাহসটুকু করে উঠতে পারছে না অরা।

ছোট ছোট পা ফেলে আরশাদ এসে বসলো অরার সামনে। তার দিকে নিজের মোহগ্রস্ত দৃষ্টিগুলো নিক্ষেপ করে রইলো কিছুক্ষণ। হঠাৎ অরার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ঠোঁটের আলতো স্পর্শ ছোঁয়ালো তার হাত। তড়িৎ গতিতে তরঙ্গ খেলে অরার সমস্ত শরীরে। আরশাদের প্রতিটা স্পর্শই তার সাজানো-গোছানো অন্তরাত্মাকে এলোমেলো করে দেয়।

অরা কী যেন মনে করে অগ্রসর হলো আরশাদের পায়ের দিকে।

আরশাদ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “কী করছো?”

অরা ইতস্তত করে বলল, “সালাম করবো তোমাকে।”

“সালাম করতে হবে না।”

অরা দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “করতে হবে। এটাই নিয়ম।”

আরশাদ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে সূক্ষ্ম এক হাসি হেসে বলল, “তাহলে করো।”

আরশাদকে সালাম করে অরা বলল, “জানো, আমি জীবনে প্রথম কাউকে সালাম করলাম।”

“সত্যি?”

“হুঁ। ছোটবেলায় কখনো কাউকে সালাম করতে চাইতাম না। কেউ তেমন জোরাজুরিও করেনি। আর বড় হয়ে সালাম করার মতো কাউকে পাইনি। সিলেটে আসার পর অবশ্য মাকে পেয়েছিলাম। কিন্তু সে তো সালাম করতেই দিলো না। মাঝপথে আটকে দিয়ে জড়িয়ে ধরলো।”

অরা যখন কথাগুলো বলছিল, আরশাদ নেশাগ্রস্তের মতো তাকিয়ে ছিল। ওই মুখটা, ওই কথা বলার ভঙ্গি, ওই হাসি – তার কাছে নেশাদ্রব্য।

আরশাদ মোহগ্রস্তের মতো বলল, “আরেকটু কথা বলো। আমি শুনতে থাকি।”

আরশাদের এমন কথায় অরা হুট করে লজ্জা পেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। তার গালদুটো নিমিষেই রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।

আরশাদ বাঁকা হাসি হেসে বলল, “তোমার অনর্গল কথা বলে যাওয়া যেমন সুন্দর, লজ্জায় চুপ হয়ে যাওয়াও ঠিক ততটাই সুন্দর।”

লজ্জায় জড়সড় হয়ে অরা বেডসাইড টেবিল থেকে একটা গ্লাস এনে আরশাদের দিকে বাড়িয়ে দিলো। গ্লাসভর্তি দুধ আর বাদামের একটা শরবত।

অরা কম্পিত স্বরে বলল, “এটা খাও।”

“এটাও নিয়মের মধ্যে পড়ে?”

“হুঁ।”

আরশাদ অরার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে বলল, “কিন্তু আমি তো ল্যাকটোজ ইন্টোলারেন্ট। তুমি ভুলে গেছ?”

অরা হঠাৎ চমকে উঠে বলল, “ও হ্যাঁ, তাই তো! এখন কী হবে?”

আরশাদ সহজভাবে বলল, “কী আর হবে। এটা তুমি খাবে।”

“আমি? কিন্তু…”

আরশাদ অরার মুখের কাছে গ্লাসটা ধরে বলল, “খাও তো অরা! একজন খেলেই নিয়ম রক্ষা হয়।”

অরা বাধ্য মেয়ের মতো দুধ আর বাদামের শরবতটা খেয়ে নিলো। যদিও সবটা শেষ করতে পারলো না।

আরশাদ গ্লাসটা আবারও বেডসাইড টেবিলে রাখতে রাখতে বলল, “চাঁদ দেখবে?”

আরশাদের চাঁদ দেখার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য অরার নেই। সে ফিরিয়ে দিতেও চায় না। প্রকৃতি আর আরশাদের মাঝে সময় কাটানোর মতো আনন্দের আর কিছুই নেই। আরশাদ তাকে হাত ধরে নিয়ে গেল এই রুমের ব্যালকনিতে।

বিশাল এই ব্যালকনিটাও ঘরের মতো ফুল দিয়ে সাজানো। আকাশটা এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। পূর্ণিমার চাঁদ আলো ছড়াচ্ছে চারিদিকে। আরশাদ আর অরা ব্যালকনিতে রাখা সোফাটার ওপর পাশাপশি বসলো। অরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরশাদ তার মাথাটা নিজের বুকের ওপর রাখলো। অরাও সরে গেল না। চোখ দুটো বন্ধ করলো শুনতে লাগলো আরশাদের শান্ত হৃদয়ের ধুকপুক।
প্রশান্তিময় নীরবতার মাঝে কেটে গেল অনেকটা সময়।

আরশাদ হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, “একটা সিক্রেট শুনবে?”

অরা আরশাদের বুকের মাঝেই মুখ লুকিয়ে উৎফুল্ল স্বরে বলল, “অবশ্যই শুনবো।”

আরশাদ অরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “প্রথমবার যেদিন আমাদের বিয়ে হলো, সেদিন মনে মনে খুব গিল্টি ফিল করছিলাম। মনে হচ্ছিলো নিজের ইমেজ রক্ষা করতে গিয়ে একটা মেয়ের জীবন পুরোপুরি এলোমেলো করে দিলাম।”

অরা লজ্জাসরমের মাথা খেয়ে বলল, “এলোমেলো তো করেছোই। এমনভাবে এলোমেলো করেছো যে তোমাকে ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি না।”

আরশাদ প্রশংসার ভঙ্গিতে বলল, “বাব্বাহ! তুমি এত রোমান্টিক হলে কবে থেকে?”

“যেদিন থেকে তোমার হয়েছি!”

অরা আরশাদের বুক থেকে মাথা তুলে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “একটা প্রশ্ন করি?”

আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “না। চুপ করে চাঁদ দেখো!”

কিছু কিছু অভ্যাস কখনোই যায় না। অরা খুব ভালো করেই জানে কোনো প্রশ্ন করার আগে অনুমতি নেওয়া আরশাদ পছন্দ করে না। তাকে অনুমতি নিতে হবে কেন? সে কি আর এখনও আরশাদের ম্যানেজার আছে? সে তো এখন আরশাদের একান্ত ব্যক্তিগত।

অরা খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, “আচ্ছা সরি। আর কখনো পারমিশন চাইবো না। এবার বলি?”

অরার ওই হাসিটায় দুর্বল হয়ে আরশাদ বলল, “বলো।”

“তুমি আমাকে ভালোবাসলে কী করে?”

“সেটা তো বলতে পারবো না। মানুষ কি আর জেনেবুঝে ভালোবাসে।”

“তারপরেও… একটা সময়ে আমাকে দেখতে ম্যানেজারের মতো। সেখান থেকে ভালোবাসায় পৌঁছানো তো সহজ কথা নয়।”

আরশাদ কিছুটা সময় চিন্তা করে বলল, “Maybe because I was comfortable around you!”

অরা ভ্রুযুগল ওপরে তুলে বলল, “Was?”

“I am! তুমি খুব ভালো করেই জানো এই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে গেলে সবসময়ই একটা মুখোশ পরে থাকতে হয়। প্রতিটা কথা বলার সময় সতর্ক থাকতে হয়। কারণ আমার কথাগুলো ক্যামেরায় রেকর্ড হচ্ছে। আমাকে এমনভাবে কথা বলতে হয়, যাতে আমার কোনো কথায় কেউ কখনো কষ্ট না পায়। এভাবে কথা বলতে গিয়ে অনেক সময় প্রকৃত নিজেকেই আড়ালে লুকিয়ে ফেলি। কিন্তু একমাত্র তোমার কাছেই নিজেকে আড়ালে রাখতে হয় না। আমি যেমন, তেমনভাবেই ধরা দিতে পারি তোমার সামনে। আমি জানি, যাই হয়ে যাক না কেন তুমি আমাকে বুঝবে, সাপোর্ট করবে।”

“এভাবেই ভালোবাসলে?”

“না। মনের কথাগুলো শেয়ার করতে করতে আমার সবথেকে ভালো বন্ধুকে খুঁজে পাই। যে বন্ধুকে একটা সময়ে ভালোবেসে ফেলি। তুমি আমাকে কীভাবে ভালোবাসলে?”

নিজের করা প্রশ্ন নিজের কাছেই ফিরে আসায় খুব একটা স্বস্তি পেলো না অরা। কারণ এর উত্তর তারও ঠিক জানা নেই।

অরা বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে বলল, “এটা তো বলতে পারছি না।”

“দেখেছো! কী কঠিন একটা প্রশ্ন। আমি উত্তর দিয়েছি না? এবার তোমাকেও দিতে হবে।”

অরা কিছুটা সময় ভেবে বলল, “আমাদের বিয়ের পর প্রথম যেদিন তুমি শুটিংয়ে গেলে, সারাদিন আমি বাসায় একা, সেই দিনটা খুব অদ্ভুত ছিল। আমার মনটা শুধু ছটফট করছিল। বারবার গলা শুকিয়ে কাঠ যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু দিনশেষে তুমি যখন বাসায় ফিরে এলে, তখন সব ঠিকঠাক। যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। সেদিনই মনে হলো, এই মানুষটা তো কেবলই আমার বস না। বা কেবলই আমার ভালো বন্ধু না। এই মানুষটা আমার ভালোবাসার।”

আরশাদ হতবাক গলায় বলল, “কী সাংঘাতিক! এত আগে উইক হয়ে পড়েছিলে তুমি? আগে বললেই পারতে?”

“আগে বললে কী করতে?”

আরশাদ দুষ্টুমিমাখা গলায় বলল, “থাক, সেটা না হয় নাই বললাম।”

অরা এমন কথায় লজ্জায় আচ্ছন্ন হয়ে রইল।

“অরা?”

“হুঁ?”

আরশাদ মলিন কণ্ঠে বলল, “যেভাবে আমার ক্যারিয়ারটা গুছিয়ে রাখতে, ঠিক সেভাবেই আমার জীবনটাকে গুছিয়ে রাখবে তো?”

অরা হাসিমুখে বলল, “তা ছাড়া আর কোনো উপায় আছে?”

“আমার আজ নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে লাকি মানুষ বলে মনে হচ্ছে। তোমাকে নিজের বউ ডাকার সুযোগ পাচ্ছি।”

“লাকি তো আমার নিজেকে মনে করার কথা। সুপারস্টার সাহেবকে দিনরাত যখন খুশি চোখের সামনে পাবো।”

“আরে ধুর! কীসের সুপারস্টার? আচ্ছা বলো তো, কেমন লাগলো বিয়ের পুরো আয়োজনটা?”

অরা মুগ্ধ গলায় বলল, “অসম্ভব সুন্দর! জানো, আমি কখনো বিয়ে করতে চাইতাম না ঠিকই কিন্তু আমারও মাঝে মাঝে ইচ্ছা হতো এরকম জমকালো একটা আয়োজনের মধ্যে আমার বিয়ে হোক। গায়ে হলুদ হবে, হাতে মেহেদি পরবো, বউ সাজবো! প্রথমবার বিয়ে পর এজন্যে মনটা একটু খারাপ ছিল।”

“এখন মন ভালো হয়েছে?”

“অনেক! Thank you!”

অরার হঠাৎ কী যেন হলো, ঝড়ের গতিতে একটা চুমু খেয়ে ফেলল আরশাদের গালে। অরার এমন আকস্মিক কান্ডে হতবাক না হয়ে পারলো না আরশাদ। বিয়ের পর থেকে প্রতিবারই আরশাদ অরার কাছে গেছে। অরা কখনো আগ বাড়িয়ে তার কাছে এসে এমন গভীরভাবে স্পর্শ করেনি। আজ আচমকা কী হলো মেয়েটার?

আরশাদ হতবিহ্বল কণ্ঠে বলল, “এই অরা? তোমার হঠাৎ কী হলো বলো তো? আজ বাসর ঘরে তোমার তো লজ্জায় মিইয়ে যাওয়ার কথা। আর সেখানে তুমি একটু পর পর রোমান্টিক হয়ে যাচ্ছো?”

অরা লজ্জারাঙা কণ্ঠে বলল, “রোমান্টিক কোথায় হলাম? এটা তো আমার অধিকার।”

আরশাদ দুষ্টুমির হাসি হেসে অন্যরকম গলায় বলল, “তাহলে তো এখন আমার অধিকার গুলোও নিজের করে নেওয়ার সময় এসেছে!”

(চলবে)