#ফিরে_আসা২
৩৭
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
অদ্ভুত একটা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। ভোর বেলা পাখির কিচির-মিচির শোনা যায়, কাকের কর্কশ ডাক শোনা। তবে এমন ডাক তো শোনা যায় না। পাখির ডাক নিয়ে আরশাদ খুব যে একটা মাথা ঘামালো তাও নয়। বহুদিন পর শান্তিতে ঘুমিয়েছে সে। এই কয়েকটা দিন যে ঝড় বয়ে গেল তার ওপর দিয়ে! ঘুমাবার কোনো অবকাশই বেচারা পায়নি। শান্তিতে ঘুমিয়েছে তার বুকের সঙ্গে লেপ্টে থাকা মানুষটাও। আরশাদের বুকের সঙ্গে পিঠ লাগিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে অরা। মেয়েটা এদিকে ফিরে থাকলে ভালো হতো। একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারতো আরশাদ। ঘুমন্ত অরাকে দেখার চেয়ে শান্তিময় আর কিছুই হতে পারে না তার কাছে।
এক হাতে দিয়ে অরাকে জড়িয়ে ধরে বিছানা থেকে সামান্য মাথা উঠিয়ে বেডসাইড টেবিলে থাকা ডিজিটাল ঘড়ির দিকে তাকালো আরশাদ। ছয়টা আটচল্লিশ বাজছে কেবল। কেবল শুটিং ছাড়া আর কোনো কারণেই এত সকালে ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছা করে না আরশাদের। অফিসে কোনো মিটিং থাকলে সেগুলোও রাখে বারোটার পর।
অরা হঠাৎ কিছুটা নড়ে উঠলো। আরশাদের নড়াচড়ায় তার ঘুম ভেঙে গেল না-কি? আরশাদ তার হাতটা রাখলো অরার কপালে। শীতে তার হাত সর্বক্ষণ বরফের ন্যায় জমে থাকে। আরশাদের এমন শীতল স্পর্শ পেয়ে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো অরা।
অস্ফুটস্বরে আওয়াজ করলো, “উঁ!”
তবুও হাতটা সরিয়ে নিলো না আরশাদ। অরার গায়ের উষ্ণতার মাঝে ডুবিয়ে দিলো তার শীতল হাতটা। যেভাবে অরা তার সমস্ত কষ্টগুলো দূর করে তাকে নতুন জীবন দিয়েছে, ঠিক সেভাবেই তার শীতলতাকে উষ্ণতায় পরিণত করছে।
আরশাদ আদুরে গলায় বলল, “উঠেছো?”
অরা ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল, “হুঁ!”
অরার কানের সঙ্গে ঠোঁট মিশিয়ে আরশাদ বলল, “Good morning.”
আরশাদ এমন ছোট ছোট কাজ, ছোট ছোট কথা ভয়ানক লজ্জায় ফেলে দেয় অরাকে। লজ্জায় কয়েক মুহূর্তের জন্যে জমে গেল অরা। তার সমস্ত শরীর জুড়ে বয়ে গেল বিচিত্র এক হাওয়া।
অরা ফিসফিস করে বলল, “Good morning.”
আরশাদ আচমকা অরার জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে হাতটা রাখলো তার পেটের ওপরে। শান্ত ভঙ্গিতে হাতটা বুলিয়েই যাচ্ছে পেটের ওপরে। হয়তো শুভ সকাল জানাচ্ছে তার সন্তানকেও।
কয়েক মুহূর্ত এভাবেই কেটে গেল নীরবতায়। এমন ভয়ঙ্কর সুন্দর মুহূর্তের জন্যেই তো বেঁচে থাকা দুজনের। দিনভর যতই ঝড়-ঝাঁপটা বয়ে যাক না কেন, দিনশেষে এমন সুন্দর একটা মুহূর্ত আসবেই! অরা চোখদুটো বন্ধ করে চিন্তায় হারিয়ে গেল। এই মানুষটাই তো তার সব। এই কয়েকদিনে আরশাদকে বাদ দিয়ে একটা জীবনের কল্পনা করার চেষ্টা করেছে অরা। পারেনি, সম্ভব হয়নি। তার সবখানে কেবলই আরশাদ। প্রত্যেকটা প্রিয় বইয়ের ভাঁজে আরশাদ, প্রত্যেকটা গানের লাইনে আরশাদ।
কয়েক মিনিট পর আরশাদের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে অরা বলল, “ছাড়ো, উঠবো।”
আরশাদ আরও শক্ত করে তাকে জাপটে ধরে বলল, “উহুঁ। থাকো আরেকটু।”
আর বাঁধা দিলো না অরা। তার নিজেও আসলে উঠতে ইচ্ছা করছে না। ইচ্ছা করছে সময়টাকে থামিয়ে দিতে। পুরোটা দিন এভাবেই আরশাদের বুকের মাঝে কাটিয়ে দিতে।
আরশাদ হঠাৎ নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো অরাকে। আরশাদের দিকে চোখ পড়তেই ধ্বক করে উঠলো তার বুকটা। পুরুষ মানুষের চেহারা এত নিখুঁত হয় কী করে? দেখলেই যেন চোখে নেশা লেগে যায়। অন্য দিকে তাকাতেই ইচ্ছা করে না।
অরা অবশ্য অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিলো। আবারও ভয়ানক লজ্জা ঝেঁকে ধরেছে তাকে। আরশাদ একদৃষ্টিতে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এমনভাবে দেখছে যেন জীবনে কোনোদিন দেখেনি তাকে। কোনোদিন আর দেখার সুযোগও পাবে না।
অরা লজ্জামাখা গলায় বলল, “কী দেখো?”
আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “তোমাকে।”
“আগে দেখোনি কখনো?”
আরশাদ তার মোহনীয় কণ্ঠে বলল, “দেখেছি তো। তবুও প্রতিবারই অন্যরকম লাগে। একেক সময়ে একেক রকম সুন্দর লাগে তোমাকে।”
অরা কৌতূহলী গলায় বলল, “সেটা কী রকম?”
আরশাদ নেশালো কণ্ঠে বলল, “সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর এক রকম সুন্দর লাগে, গোসল করে বেরিয়ে আসার পর আরেক রকম সুন্দর লাগে, হাসলে আবার অন্যরকম সুন্দর লাগে। কাঁদলেও সুন্দর লাগে, তবে সেই সুন্দরটা ভয়ঙ্কর। এত সৌন্দর্য আমি সহ্য করতে পারি না। তুমি কখনো কাঁদবে না অরা। বুঝেছো?”
প্রচ্ছন্ন হাসি ফুটে উঠলো অরার ঠোঁট জুড়ে। তার প্রশংসা কেউ কোনোদিন করেনি। অরাও চায়নি কেউ করুক।
অরা আরশাদকে আশ্বস্ত করে বলল, “আচ্ছা, কাঁদবো না।”
অরার চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে দিয়ে আরশাদ বলল, “আজ কিন্তু আমাদের অনেক প্ল্যান!”
“কীসের প্ল্যান?”
“তোমার বার্থডে সেলিব্রেশনের প্ল্যান। আমরা আজ তোমার প্রিয় রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করবো, তারপর লংড্রাইভ। তিনশ ফিটে একটা ইকো রিসোর্ট বুক করে রেখেছি। সেখানে বাকি দিনটা কাটাবো। সন্ধ্যার দিকে পুরনো দিনের কোনো একটা সিনেমা দেখবো, আর রাতে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার।”
অরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “এত কিছু করতে হবে? তার থেকে বরং পুরো দিন এভাবেই বিছানায় পড়ে থেকে কাটিয়ে দিই।”
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আরশাদ কোমল স্বরে বলল, “তোমার তাই ইচ্ছা করছে?”
“হুঁ।”
“তাহলে সেটাই করি।”
অরা কী যেন ভেবে বলল, “না থাক, যাবো ঘুরতে।”
“তোমার ইচ্ছা না করলে যেতে হবে না অরা।”
“ইচ্ছা করছে তো!”
“সত্যি?”
“সত্যি!”
জন্মদিন যে আবার উদযাপন করতে হয় এটাই অরা জানতো না। নিজের জন্মদিন নিজে উদযাপন করা যায় না, উদযাপন করে কাছের মানুষগুলো। কাছের মানুষ বলতে কোনোদিনই অরার কেউ ছিল না। এই মানুষটার বদৌলতে জন্মদিনের স্বাদ পাচ্ছে অরা। এত সুন্দর করে দিনটা সাজিয়ে রেখেছে আরশাদ। তার পরিকল্পনা কী করে ভেস্তে যেতে দিতে পারে অরা?
“আচ্ছা তাহলে উঠে ফ্রেশ হও। আমি আজ নিজের হাতে তোমার জন্য ব্রেকফাস্ট বানাবো।”
অরা উঠতে বসতে বসতে আগ্রহ নিয়ে বলল, “তাহলে আমি আসি তোমাকে হেল্প করতে।”
আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “একদমই না! তোমাকে না বলেছি বাবু পৃথিবীতে না আসা পর্যন্ত কিচেন থেকে দূরে থাকতে?”
“আমি তো শুধু হেল্প করবো তোমাকে।”
“Thank you for your concern, কিন্তু আমার হেল্প লাগবে না।”
অরা গোমড়া মুখে বলল, “তুমি এমন একটা ভাব করো যেন আমার আগে কেউ প্রেগন্যান্ট হয়নি। জানো, পৃথিবীতে কত মেয়ে প্রেগন্যান্ট হয়েও প্রতিদিন রান্নাবান্না করছে?”
আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “পৃথিবীর কোন মেয়ে কী করছে সেটা দিয়ে আমার দরকার কী? তুমি কিচেনের ধারের কাছেও যাবে না, এটাই আমার সোজা কথা।”
গোমড়া মুখে বসে রইল অরা। এই ছেলেটাকে নিয়ে আর পারা যায় না। যেদিন থেকে জানতে পেরেছে অরা মা হতে যাচ্ছে, সেদিন থেকে রীতিমত পুতুল বানিয়ে রেখে তাকে। অরার বাচ্চাদের মতো গোমড়া মুখ করে রাখা দেখে হাসি পেয়ে গেল আরশাদের। কে বলবে এই মেয়েটা দুদিন নিজেই বাচ্চার মা হবে!
সূক্ষ্ম এক হাসি হেসে আরশাদ বলল, “আচ্ছা তোমাকে একটা কাজ দিচ্ছি। নিজে ফ্রেশ হয়ে গিয়ে কথাকে উঠাও, ওকে ব্রাশ করতে হেল্প করো।”
অরা বিছানা থেকে উঠতে উঠতে গম্ভীর গলায় বলল, “তোমাকে দিতে হবে না, এই কাজ আমি প্রতিদিনই করি।”
আরেকদফা হাসি পেয়ে গেল আরশাদের। বাইরের দুনিয়ার কাছে অরা তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা আর বিচক্ষণতা সম্পন্ন একজন মানুষ। শুধুমাত্র আরশাদই জানে, ওই মানুষটার মাঝে লুকিয়ে আছে ছটফটে একটা বাচ্চা মেয়ে।
আরশাদ ফ্রেশ হয়ে চলে গেল ব্রেকফাস্ট বানাতে। বাবুর্চি আব্দুর তাকে সাহায্য করছে। মাঝেমধ্যেই অরার জন্যে রান্না করে আরশাদ। যতবারই আরশাদ রান্নাঘরে পা রাখে, ততবারই আব্দুর তাকে রান্না বিষয়ক জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করে। আরশাদ পৃথিবীর আর সবকিছু সহ্য করতে পারলেও, বিনামূল্যে পাওয়া জ্ঞান সহ্য করতে পারে না। তাই আরশাদ রান্নাঘরে এলেই কয়েকদফা তর্ক বেঁধে যায় আব্দুরের সঙ্গে।
বিশাল সাইজের টেডি বিয়ারকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে কথা। নিঃশব্দে তার ঘরে প্রবেশ করে জানালার কাছে গিয়ে পর্দা টেনে সরালো অরা। কদিন হলো ডিসেম্বরের আগমন ঘটেছে। দিনের অন্যান্য সময়ে শীতটা তেমন অনুভূত না হলেও সকালের দিকে শীতে রীতিমত কাঁপতে হয়। আকাশেও নেই রোদের দেখা।
অরা কথার বিছানায় বসে তার গায়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল, “কথা? ওঠ সোনা।”
মেয়ের মাঝে কোনো হেলদোল নেই। অরা প্রবল ধৈর্যশক্তি সম্পন্ন বলেই রোজ সকালে কথাকে ডাকার সাহস পায়। কয় হাজারবার ডাকার পর যে তার ঘুম ভাঙে, সেই হিসাব কারও কাছেই নেই।
অরা আবারও ডাকলো, “কথা? কথা ওঠ!”
মিনিট কয়েক ডাকাডাকির পর কথার ঘুম ভাঙলো। ঘুমজড়ানো কণ্ঠে সে বলল, “সকাল হয়েছে?”
অরা মিষ্টি গলায় বলল, “হয়েছে তো।”
কথা হাই তুলতে তুলতে বলল, “আজকে স্কুল আছে?”
অরা উৎফুল্ল গলায় বলল, “না। আজকে উইকএন্ড!”
কথা কী যেন মনে করে এক লাফে উঠে বসলো। অরা ভাবলো হয়তো স্কুলে যেতে হবে বলে আনন্দে উঠে পড়েছে কথা।
অরা অবাক গলায় বলল, “দিন দিন তো ভালোই বিচ্ছু হয়ে যাচ্ছিস কথা। স্কুল থাকলে তো জীবনেও এক ডাকে উঠাতে পারি না।”
অরার কথাগুলোয় তেমন গুরুত্ব না দিয়ে কথা তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “Happy Birthday Aura!”
বিস্ময়ে কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলো অরা। বিস্মিত ভঙ্গিতেই কথাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুই জানলি কীভাবে?”
কথা উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “বাবা বলেছে! জানো, কালকে অনেক রাত পর্যন্ত আমি তোমার জন্য ওয়েট করছিলাম। তুমি এত দেরি করছিলে! আমি তো ঘুমিয়েই পড়লাম!”
অরা আদুরে গলায় বলল, “সরি সোনা। আর দেরি হবে না।”
কথা হঠাৎ অরা ছেড়ে বিছানা থেকে নেমে গেল।
অরা বলল, “কোথায় যাচ্ছিস?”
“দাঁড়াও না!”
কথা তার পড়ার টেবিলের কাছ নিয়ে একটা কাগজ নিয়ে এলো। কাগজটা গোল করে ভাঁজ করা, একটা লাল ফিতা দিয়ে বাঁধা।
অরার দিকে সেটা বাড়িয়ে দিয়ে কথা বলল, “এই নাও, তোমার বার্থডে প্রেজেন্ট।”
অবাক হয়ে অরা দেখছে কথাকে। এতটুকু একটা মেয়েরও তার জন্মদিন নিয়ে কত চিন্তা! অরা আসলেই ভাগ্যবতী। বহু ভাগ্য করে মানুষ এত সুন্দর একটা পরিবার পায়।
তার জন্মদিন নিয়ে আরশাদ আর কথা দুজনের মাঝেই ব্যস্ততার শেষ নেই। অরা যে বিশেষ কেউ, এই দুজন সেটা বারবার তাকে বোঝাতে সচেষ্ট।
লাল ফিতার বাঁধনটা খুলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো চমৎকার এক ছবি। অরা মুগ্ধ হয়ে দেখছে ছবিটা। কথা আঁকা অন্য সব অসাধারণ ছবির মতোই একটি অসাধারণ ছবি। ছবিতে অরা আর কথা পাহাড়ের চূড়ায় উঠেছে। পাহাড়টাকে ঘিরে রেখেছে অসংখ্য গাছপালা। অরার পরনে লাল শাড়ি আর কথার পড়েছে লাল টুকটুকে ফ্রক। পাহাড়ে চূড়ায় দাঁড়িয়ে হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে রংধনু দেখছে দুজনে। ছবিটা জুড়ে রঙয়ের খেলা। দেখলেই যেন চোখটা জুড়িয়ে যায়।
অরার চোখে জল চলে এলো। সাবধানে সেই জল মুছে কথার কপালে চুমু খেয়ে অরা বলল, “থ্যাংক ইউ মাম্মাম।”
এই প্রথম কথাকে মা জাতীয় কিছু ডাকল অরা। তার মনে এই সুপ্ত ইচ্ছাটা বহুদিন ধরে লুকিয়ে ছিল। প্রকাশ করতে পারেনি কখনো। ভেবেছে কথা হয়তো পছন্দ করবে না। তবে আজ কোনো ভয় নেই। কারণ অরা জানে কথা আর যাই হোক, রাগ তার ওপরে কোনোদিনই করতে পারে না।
ব্রেকফাস্ট তৈরি করে দুজনকে ডাকলো আরশাদ। বাগানে টেবিল-চেয়ার এনে এখানেই ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আগে তো প্রায় সকালেই মাটিতে ঘাসের ওপর বসে ব্রেকফাস্ট করতো তারা। মাটিতে বসতে অরা আর বাবু দুজনেই কষ্ট হবে বলে টেবিল-চেয়ারের ব্যবস্থা।
সকালে একসঙ্গে বসার কয়েক মিনিটের মাথায় কথা বায়না ধরে বলল, “বাবা আমি টিভি দেখতে দেখতে ব্রেকফাস্ট করি?”
আরশাদ বলল, “না বাবা, আমরা সবাই এখানে বসে ব্রেকফাস্ট করছি না? তুইও এখানে বসবি।”
কথা জেদ ধরে বলল, “কিন্তু বাবা এখানে বসে ব্রেকফাস্ট করতে আমার বোর লাগে। একটু টিভি দেখি? প্লিজ?”
মেয়েটা দিন দিন একটু একটু করে টিভির আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। আরশাদের উচিত নয় তাকে এই মুহূর্ত টিভি দেখতে যেতে দেওয়া। তবুও মেয়েকে কী করে না বলতে হয় সে শেখেনি।
নিজের কাছে তাই নিজেই ব্যর্থ হয়ে বলল,
“আচ্ছা যা!”
সঙ্গে সঙ্গে কথার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এক লাফে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “Thank you Baba!”
কথা দৌড়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। একজন স্টাফ এসে তার ব্রেকফাস্টের প্লেট নিয়ে গেল।
অরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কীভাবে যে ওর এই টিভির অ্যাডিকশন শেষ করি!”
আরশাদ কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, “এক কাজ করি চলো, বাসা থেকে সব টিভিগুলোই তুলে ফেলি।”
অরা কিঞ্চিৎ হেসে বলল, “এটা একটা সমাধান হলো?”
“এটাই বেস্ট সমাধান অরা। হাজারবার রিকুয়েস্ট করেও তো কথাকে টিভি থেকে দূরে রাখা যায় না।”
আরশাদের তৈরি করা স্যান্ডউইচে কামড় দিতেই এর সুস্বাদের তীব্রতায় চোখ বন্ধ করলো অরা। সুপারস্টার আরশাদের হকের অভিনয়ে মুগ্ধ তো সবাই হয়। কয়জন সুযোগ পেয়ে তার স্যান্ডউইচ খেয়ে মুগ্ধ হবার? নিজেকে আরেকদফা ভাগ্যবতী বলে মনে হলো অরার।
আরশাদ আগ্রহ নিয়ে বলল, “কেমন হয়েছে?”
অরা উৎফুল্ল গলায় বলল, “বেস্ট!”
আরশাদ খানিক হেসে চুমুক দিলো কফির কাপে।
অরা শুকনো গলায় বলল, “তোমার কফি দেখে খুব লোভ লাগছে।”
আরশাদ মজার ছলে বলল, “এত লোভী হওয়া ভালো না অরা।”
প্রেগন্যান্সির শুরু থেকে চা-কফি জাতীয় জিনিসপত্র একেবারেই নিষিদ্ধ অরার জন্যে। ক্যাফেইন বাবুর বিকাশে বাঁধা দেয়। যদিও ডক্টর প্রথম তিন মাস চা-কফি থেকে দূরে থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু আরশাদ নিজের নিয়মে সেই তিন মাসকে নয় মাসে পরিণত করেছে।
অরা উদগ্রীব কণ্ঠে বলল, “এক চুমুক খেতে দেও না।”
আরশাদ বাঁকা হাসি হেসে বলল, “ক টা বাদ দিয়ে চাইলে দিতে পারতাম।”
প্রথমে কথাটার মানে বুঝতে পারলো না অরা। যখন বুঝতে পারলো, তার গালদুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো।
নিচু স্বরে বলে উঠলো, “অসভ্য!”
আরশাদ হাসিমুখে অরাকে আশ্বাস দিয়ে বলল, “বাবুকে একবার পৃথিবীতে আসতে দাও, তারপর তোমাকে আস্ত একটা কফির ফ্যাক্টরিতে নিয়ে যাবো। তখন যত খুশি কফি খেও, কিন্তু এখন না প্লিজ।”
অরা হুমকির স্বরে বলল, “আমি কিন্তু সিরিয়াসলি নিলাম! সত্যি সত্যিই কফির ফ্যাক্টরিতে নিয়ে যেতে হবে কিন্তু।”
“সত্যিই নিয়ে যাবো। আমাকে কখনো দেখেছো ঠাট্টা করতে?”
স্যান্ডউইচ শেষ করে ফ্রুট সালাদে মনোযোগ দিলো অরা। খেতে গিয়ে অসাবধানতাবশত
কাঁটাচামচটা সরাসরি এসে পড়লো অরার হাতের ওপর। ব্যাথা একটুও লাগেনি তবে আরশাদের চোখেমুখে নিমিষেই ধরা দিলো একরাশ উদ্বেগ।
আরশাদ ব্যস্ত গলায় বলল, “সাবধানে অরা! ব্যাথা পেয়েছো?”
“না।”
আরশাদ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, “দাও আমি খাইয়ে দিই।”
অরার সালাদের বোল নিজের দিকে নিয়ে যত্ন করে তাকে খাইয়ে দিচ্ছে আরশাদ। ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো অরা। কতটা যত্ন করে আরশাদ তাকে। অরাও কি পারে ঠিকমতো তাকে যত্ন করতে? অতীতে পাওয়া একটা আঘাতের জন্যে ছেলেটা আজও ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছে। অরা কি পারে না নিমিষেই কোনো এক যাদুর বলে তার সকল কষ্টগুলোকে দূর করে দিতে? তার মনটার যত্ন নিতে?
অরা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, “আরশাদ?”
“হুঁ?”
অরা অন্যরকম গলায় বলল, “অনেক ভালোবাসো না আমাকে?”
আরশাদ সঙ্গে সঙ্গে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল, “নিজের থেকেও বেশি।”
“নিজের থেকে বেশি তো হবেই। নিজেকে তো এক ফোঁটাও ভালোবাসো না।”
“মানে?”
অরা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “আমাদের জীবনে এমন কিছু সমস্যা থাকে যার সমাধান আমরা নিজেরা ছাড়া আর কেউই করতে পারি না। তোমার জীবনে যতগুলো সমস্যা এসেছে, সবগুলোর জন্যেই তুমি নিজেকে দোষারোপ করেছো। এজন্যেই ট্রমা তোমাকে আক্রমণ করেছে।”
চুপ করে রইলো আরশাদ। অরার কথাগুলো আবারও তাকে মনে করিয়ে দিলো, অতীতের এই ট্রমার কারণে কী ভয়ানক কষ্ট সে দিয়ে ফেলেছিল অরাকে। অরা তাকে ক্ষমা কর দিলেও সে নিজে এখনো ক্ষমা করতে পারেনি নিজেকে। চেষ্টা করছে। কখনো পারছে, কখনো পারছে না।
আরশাদকে হঠাৎ অন্যমনস্ক হতে দেখে ধ্বক করে কেঁপে উঠলো অরার বুকটা। শক্ত করে নিজের দুহাত দিয়ে চেপে ধরলো আরশাদের ডান হাতটা।
অরা কোমল স্বরে বলল, “আরশাদ আমি আছি তোমার সাথে। সবসময় তোমাকে সাপোর্ট করার জন্যে, যেকোনো কঠিন সময়ে তোমাকে ভরসা দেওয়ার জন্যে। কিন্তু তোমার ভেতরের সমস্যাগুলোকে একেবারে শেষ তো আমি করে দিতে পারবো না আরশাদ। এটা তোমাকেই করে নিতে হবে। নিজেকে বোঝাতে হবে যা হয়েছে তার জন্যে তোমার কোনো দোষ নেই। তোমাকে বুঝতে শিখতে হবে কোনটা অতীত আর কোনটা বর্তমান। আর বিশ্বাস করো আরশাদ, বর্তমানে কেউ তোমাকে আঘাত দিতে পারবে না। আমি অন্তত সেটা হতে দিবো না।”
আরশাদ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শুকনো গলায় বলল, “আমি একেবারেই পারফেক্ট নই অরা। Thank you for accepting my flaws.”
আরশাদের কপালের ওপর এসে পড়া চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে অরা মিষ্টি একটা হাসি হেসে বলল, “You’re perfect!”
“অরা?”
“হুঁ?”
“কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?”
ছেড়ে যাওয়ার কথাটা বলার সময়ে রীতিমত কাঁপছিল আরশাদের কণ্ঠস্বর। যেন অরা তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা কল্পনা করলেও অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে সে।
অরা জোর গলায় বলল, “ধুর বোকা! কোথায় যাবো? মনে নেই, সিলেটে আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠানের আগের দিন তোমাকে কী কথা দিয়েছিলাম।”
আরশাদ ভীত গলায় বলল, “মনে আছে তো। তবুও ভয় হয়।”
“এত ভয়ের কোনো প্রয়োজন নেই তো আরশাদ। আমি সবসময় তোমার কাছেই থাকবো।”
(চলবে)
#ফিরে_আসা২
৩৮
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
জন্মদিন উপলক্ষে আরশাদের কাছ থেকে নীল রঙের একটা শাড়ি পেয়েছে অরা। গাঢ় নীলের ওপরে সাদার সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কাজ। শাড়িতে অরা, আরশাদের সবথেকে প্রিয় দৃশ্য।আগে প্রায়ই শাড়ি পড়া হতো। কনসিভ করার পর থেকে নিজেকে সামলানোই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে, শাড়ি সামলানোর মতো শক্তি আর অবশিষ্ট থাকে না। বহুদিন পর আজ আবারও শাড়ি পড়ছে অরা।
কুচিগুলো ঠিক করতে গিয়েই অরার মনে পড়লো, তার তো ঝুঁকে কোনো কাজ করা বারণ। নাহ্! ঝুঁকে কুচি ঠিক করা সম্ভব হচ্ছে না। আরশাদ পাশেই লাইব্রেরিতে ল্যাপটপ নিয়ে কী যেন করছে। অরা তাকে কল দিয়ে বলল, “আরশাদ, একটু ঘরে আসো না!”
মুহূর্তেই ঘরে আগমন ঘটলো আরশাদের। শাড়িটা এখনো ঠিকভাবে পড়তে পারেনি অরা। পুরো শাড়িটা এলোমেলোভাবে লেপ্টে আছে তার শরীরে। অরা কুচি নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে আঁচলটা যে ক্রমশ বুক থেকে সরে যাচ্ছে সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। এই এতটুকু দৃশ্যই আরশাদের ভেতরটাকে এলোমেলো করে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট। বিদ্যুৎ খেলে গেল তার সমস্ত শরীরে। স্বাভাবিক চিনাভবনার পর্যায়ে রইল না মস্তিষ্ক।
ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরার দিকে।
অরা ব্যস্ত গলায় বলল, “আরশাদ? কুচিটা একটু ধরে দিবে?”
ধীর গতিতে ছোট ছোট পা ফেলে আরশাদ এগিয়ে গেল অরার দিকে। তার চোখেমুখে ঘোরের ছাপ।
অস্পষ্ট গলায় আরশাদ বলল, “অবশ্যই।”
যত্ন নিয়ে কুচিগুলো ঠিক করে দিলো আরশাদ। অরাকে কিছুই করতে হলো না। কুচি ঠিক করা শেষে নিজ দায়িত্ব সেগুলো গুঁজে দিলো আরশাদ। গুঁজে দেওয়ার সময় তার আড়ষ্ট হাতের ছোঁয়া লাগে অরার উন্মুক্ত মসৃণ কোমরে। এতটুকু স্পর্শেই তরঙ্গের ন্যায় কেঁপে উঠলো অরা।
কাঁপা কাঁপা গলাতেই বলল, “Thank you!”
আরশাদ তো এখনো ঘোরের মধ্যেই আছে। সামান্য ধন্যবাদ দিয়ে তার পোষাবে না। এই মুহূর্তে অরার কাছ থেকে আরও অনেক বেশি কিছু চাই তার।
আচমকা অরার খোঁপা করে রাখা চুলগুলোর বাঁধনমুক্ত করে ফেলল আরশাদ। বাঁধনহারা হয়ে চুলগুলো তার ছড়িয়ে পড়লো পিঠজুড়ে।
অরার মুখের সামনে এসে পড়া চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে আরশাদ নেশালো কণ্ঠে বলল,“এত সুন্দর চুলগুলো বেঁধে রাখো কেন তুমি?”
অরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক টানে তাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো আরশাদ। দুজনের নিঃশ্বাস মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। শিহরণে শিহরণে পাগল হয়ে আরশাদের টি শার্ট খামচে ধরলো অরা। লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পারছে না বেচারি। আর এদিকে আরশাদের চোখদুটো আবদ্ধ অরার ঠোঁটের দিকে। পৃথিবীর কোনো দিকেই আর খেয়াল নেই তার।
এদিকে অরার মনে পড়লো দরজাটা লক করা হয়নি। বাড়িভর্তি স্টাফ, দিনের এই সময়টায় পুরো বাড়ির ক্লিনিং চলে। যে কেউ যখন তখন যে কোনো ঘরে ঢুকে পড়ে।
অরা ভীত ভঙ্গিতে বলল, “আরশাদ…”
অরার ঠোঁটে আঙুল রেখে আরশাদ প্রায় ফিসফিস করে বলল, “হুশ! একদম ডিস্টার্ব করবে না আমাকে।”
অরা আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ঠোঁটের সঙ্গে ঠোঁট মিশিয়ে দিলো আরশাদ। অরার মাঝে ডুবে নিজেকেই হারিয়ে ফেলতে চাইছে সে।
অরা তৎক্ষণাৎ সরে এসে আতঙ্কগ্রস্ত গলায় বলল, “কী করছো? দরজাটা লক করা নেই, বাড়িভর্তি স্টাফ! যে কেউ চলে আসতে পারে।”
এমন ভয়ঙ্কর মুহূর্তে বাধাপ্রাপ্ত হলে যে কারোরই বিরক্তিতে গা জ্বলে যাওয়ার কথা। আরশাদের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হলো না।
ভ্রু কুঁচকে সে বলল, “তাতে কী হয়েছে?”
এমন কথা শুনে অরা বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে বলল, “কী হয়েছে মানে? ছাড়ো আমাকে আরশাদ!”
অরাকে ছেড়ে দিয়ে আরশাদ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “উফ! খুব বিরক্ত করো তুমি!”
দরজার দিকে পা বাড়ালো আরশাদ। অরা একবার ভাবলো হয়তো রাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে সে। কিন্তু না, লকের পাসওয়ার্ড অ্যাকক্টিভেট করে আবারও অরার দিকে এগিয়ে আসছে সে। ঠোঁটজুড়ে খেলা করছে দুষ্টুমিময় হাসি।
অরার খুব কাছাকাছি গিয়ে তার কানের সঙ্গে ঠোঁট মিশিয়ে বলল, “এবার কোন অজুহাতে আটকাবে আমাকে?”
লজ্জায় চুপসে গেল অরা। আরশাদের চোখে পরিষ্কার নিজের সর্বনাশ দেখতে পাচ্ছে সে। আর কোনোভাবেই নিজেকে বাঁচাতে পারবে না সে। বাঁচাতে চায়ও না। হারিয়ে যেতে চায় আরশাদের ভালোবাসার মাঝে।
অরাকে এক টানে বিছানায় ফেলে দিলো আরশাদ। নরম তুলতুলে বিছানা হওয়ায় একদমই ব্যথা পেলো না অরা। আরশাদ তার ওপরে এসে আচমকা মুখ ডুবিয়ে দিলো তার ঘাড়ে। সবকিছু এত তাড়াতাড়ি ঘটলো যেন অরা চোখের পলক ফেলার আগেই সে বন্দী হয়ে গেল আরশাদের কাছে।
আরশাদের অবাধ্য হাতটা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। অবাধে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে অরার শরীর জুড়ে। সদ্য ঠিক করা শাড়িটা নিমিষেই এলোমেলো করে দিলো আরশাদ। উত্তেজনায় আরশাদের চুল খামচে ধরলো।
আরশাদ অরার ঘাড় থেকে মুখ তুলে সরাসরি তাকালো তার চোখের দিকে। আরশাদের ওই চোখদুটোর মাঝে খেলা করছে এক সমুদ্র সমান ভালোবাসা। তীব্র লজ্জা আঁকড়ে ধরেছে অরাকে। সে চাইছে চোখ ফিরিয়ে নিতে, কিছুতেই পারছে না। চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে ওই চোখদুটো।
আরশাদ ফিসফিস করে গাঢ় স্বরে বলল, “এত ভালোবাসি কেন তোমাকে বলো তো? যাদু করেছো আমাকে?”
অরার গা বেয়ে শীতল হাওয়া বয়ে গেল। কিছু কিছু “ভালোবাসি” কেবল বলার জন্যে বলা হয়। আর কিছু “ভালোবাসি” প্রয়োজনে বলা। আরশাদকে দেখে মনে হচ্ছে এই “ভালোবাসি”টা বলার প্রয়োজন এতক্ষণে মরে যাচ্ছিল।
অরা কিছু বলতে যাচ্ছিল, তবে সেই সুযোগ আর তাকে দিলো না আরশাদ। আবারও অরার ঠোঁটে মিশিয়ে দিলো তার শীতল ঠোঁট। এবার আর কোনো অজুহাত নেই অরার সরে আসার। অরা সরে আসতেও চায় না। আজীবন এভাবেই হারিয়ে যেতে চায় আরশাদের মাঝে।
দুজনে কতটা সময় এভাবে ছিল তার হিসাব কারো কাছেই নেই। হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ার শব্দে মোহনীয় এক জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো দুজনে।
“বাবা!” দরজার বাইরে থেকে শোনা গেল কথার অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর।
তৎক্ষণাৎ অরাকে ছেড়ে দরজার দিকে পা বাড়ালো আরশাদ। অরাও উঠে বসে গুছিয়ে নিলো নিজেকে।
দরজা খুলতেই কথা বিরক্তির সুরে বলল, “বাবা! আমার সব লেগো পিসগুলো খুলে গেছে।”
আরশাদ কম্পিত স্বরে বলল, “চল, আমি জোড়া লাগিয়ে দিচ্ছি।”
কথার পিছু পিছু ঘর থেকে বের হওয়ার সময়ে অরার দিকে দুষ্টুমিভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গেল আরশাদ। যে দৃষ্টি বেচারির ভেতরটাকে এলোমেলো করে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট।
অরার জন্মদিনটা আরশাদের পরিকল্পনা মোতাবেকই কাটলো। আজকের এই দিনটাকে বিশেষভাবে সাজিয়েছে আরশাদ। তবে অরার উপলব্ধি হলো ভিন্ন কিছু। সে আজ উপলব্ধি করলো, শুধু আজকের দিনটাই নয়। আরশাদ আশেপাশে থাকলে তার জীবনের প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্তই বিশেষ হয়ে ওঠে।
দুই মাস পর,
গভীর মনোযোগ দিয়ে মোবাইল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে আরশাদ। বিরক্তিতে রীতিমত গা জ্বলে যাচ্ছে তার। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে তার পরবর্তী দিনগুলোর শিডিউল। আগামী সপ্তাহের পুরোটাই তাকে কাটাতে হবে বিজ্ঞাপনের শুটিং করে। তার পরের সপ্তাহ ডাবিং আর কয়েকটা ইন্টারভিউয়ের মধ্যে কাটাতে হবে। তার পরের সপ্তাহে আরও কতগুলো ইন্টারভিউ আর বিজ্ঞাপনের শুটিং।
সিনেমার কোনো শুটিং এ মাসে আরশাদ রাখেনি। কারণ সামনের মাস থেকেই শুরু হতে যাচ্ছে তার নতুন সিনেমা ‘দিগন্ত’র শুটিং। ভক্তদের মাঝে এই সিনেমা নিয়ে উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। কারণ এই প্রথমবারের মতো আরশাদ হককে দেখা যাবে একজন ডক্টরের চরিত্রে। তাও আবার যেমন তেমন ডক্টর নয়, একজন সাইক্রিয়াটিস্ট রূপে। তার কাছে এমন একটি মেয়ে চিকিৎসার জন্যে আসে যে কিনা দাবি করে, তার বাবা-মায়ের খুনের জন্যে দায়ী সে নিজেই। অথচ তার বাবা-মা যখন খুন হয় তখন তার বয়স মাত্র আট বছর। আর যে তাদের খুন করেছে, তারাও সাজা পেয়ে গেছে।
তবে এই মেয়েটা যেমন দৃঢ়ভাবে প্রমাণসহ দাবি করছে, খুনটা সেই করেছে তার দাবিকে একেবারে ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না। পুলিশ নিতান্তই পাগলের প্রলাপ ভেবে মেয়েটার দাবিগুলো অগ্রাহ্য করে যায়। নিতান্তই কৌতূহলের বশে রহস্যের উদঘাটন করতে নেমে পড়ে মেয়েটির ডক্টর, আরশাদ।
আমাদের দেশে এমন গল্পনির্ভর সিনেমা তৈরি করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এদেশের মানুষ কমার্শিয়াল সিনেমা দেখে অভ্যস্ত, যা হয় রোমান্টিক, না হয় অ্যাকশনধর্মী হবে। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে প্রচুর রোমান্টিক সিনেমায় অভিনয় করেছে আরশাদ। অ্যাকশনধর্মী সিনেমাও নেহায়েত কম করেনি। যদিও সেই শুরু থেকেই তার মনে প্রবল ইচ্ছা ছিল ভিন্ন ভিন্ন গল্পনির্ভর সিনেমায় অভিনয় করায়। এদেশের প্রযোজকরা গল্পনির্ভর সিনেমায় বিনিয়োগ করার সাহস করে উঠতে পারে না। তাই আরশাদের অভিনয় করাও হয়ে ওঠেনি।
কে ফিল্মস শুরু করার পর আরশাদ নিজে প্রযোজক হিসেবে গল্পনির্ভর সিনেমায় বিনিয়োগের সাহস করে উঠতে পেরেছে। গত তিন বছর ধরে চমৎকার সব গল্প নিয়ে কাজ করছে সে। ক্রাইম থ্রিলার, সাইকোলজিকাল থ্রিলার, সোশ্যাল ইস্যুর সিনেমায় বিনিয়োগ করছে সে। দর্শকের সাড়াও পাচ্ছে অভূতপূর্ব।
শিডিউলের দিকে আরেকদফা চোখ বুলিয়ে নিলো আরশাদ। সিনেমার শুটিং শুরু হচ্ছে আগামী মাসে। এর আগে তার প্রস্তুতিও একটা ব্যাপার আছে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ অভিনেতারা শুটিংয়ের আগে প্রস্তুতি তো দূরের কথা, স্ক্রিপ্টটাও ভালোভাবে পড়ে দেখে কিনা সন্দেহ। তবে অন্যান্য অভিনেতাদের মতো সুপারস্টার আরশাদ হক নয়। কাজের ব্যাপারে যথেষ্ট সিরিয়াস সে। ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর আগে প্রত্যেকটা দৃশ্যের জন্যে পর্যাপ্ত প্রস্তুতির প্রয়োজন তার।
গাড়ি চলছে বাড়ির পথে। আজ সারাটাদিন শুটিংয়ে কাটিয়েছে আরশাদ। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। মনে হচ্ছে বাড়িতে পা রাখা মাত্রই বিছানায় তলিয়ে যাবে সে।
বিরক্তি নিয়ে অয়নকে ফোন করলো আরশাদ। তিন বছর ধরে ছেলেটা তার ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছে। অথচ এখনো আরশাদের সুবিধা মতো শিডিউল তৈরি করতে শিখলো না। অরা যখন তার ম্যানেজার ছিল, তখন এসব ঝামেলার সম্মুখীন হতে হতো না। মাঝে মাঝে তো ইচ্ছা হয় অরার কাছে গিয়ে বলতে, “এই শোনো! তুমি সব কাজ ছেড়ে আবারও আমার ম্যানেজার হয়ে যাও!”
অয়ন ফোনটা রিসিভ করতেই আরশাদ ধমকের সুরে বলল, “এই শিডিউল বানাও অয়ন? তোমাকে বলেছিলাম না শেষ সপ্তাহটা ফাঁকা রাখতে?”
অয়ন ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “আমি দেখছি স্যার।”
ফোনটা রেখে গাড়ির সিটের সঙ্গে হেলান দিয়ে চোখ বুজে ফেলল আরশাদ। কাজের আধিক্য নিয়ে কখনোই অভিযোগ করে না সে। তবে আজ বহুদিন পর এমন ক্লান্ত লাগছে।
বাড়িতে পা রাখতেই বসার ঘর থেকে টিভির আওয়াজ ভেসে এলো। সিসিমপুরের হালুমের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে কানে। আনমনেই এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো আরশাদের ঠোঁটের কোণে। এতদিন কার্টুন দেখার মতো মানুষ একজনই ছিল এ বাড়িতে, কথা। তবে এখন বাজছে রাত বারোটা। এত রাত অব্দি তার জেগে থাকার কথা নয়। তার মানে কার্টুন দেখার মতো নতুন মানুষটাই দেখছে।
বসার ঘরের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে গেল আরশাদ। সোফার ওপরে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে অরা। তার আগ্রহভরা চোখদুটো
টিভির ওপরে আবদ্ধ। আগ্রহ নিয়ে সে দেখছে হালুম আর ইকরির কান্ড। নিমিষেই আরশাদের সকল ক্লান্তিগুলো যেন ছুটে পালালো।
একটু একটু করে বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। কে বলবে সে না-কি দুদিন পর নিজেই বাচ্চার মা হবে! অরার পেটের দিকে চোখ পড়লো আরশাদের। তার পেট ভালোই স্ফীত হয়ে উঠেছে। পাঁচ মাসের প্রেগন্যান্ট সে। এখন তার প্রতিদিন অফিসে যাওয়া একেবারেই নিষেধ। কেবল জরুরি প্রয়োজনেই অফিসে যায় সে।
সোফার পেছনে দাঁড়িয়ে কোমল স্পর্শে অরার পেটের ওপরে হাত রাখলো আরশাদ। অরা হাসিমুখে পেছনে ঘুরে তাকাতেই তার কপালে চুমু খেল সে।
অরা আদুরে গলায় বলল, “এতক্ষণে আসলে! তোমার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে আমি টায়ার্ড হয়ে গেলাম।”
আরশাদ অরার চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে বলল, “সরি, শুটিং শেষ হতে দেরি হয়ে গেল।”
“সরি বলার কী আছে?”
আরশাদ কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই তার চোখ পড়লো সোফার সামনে থাকা কাঁচের টেবিলের ওপর। টেবিলজুড়ে ছড়িয়ে আছে একরাশ চকলেটের র্যাপার।
আরশাদ বিস্মিত গলায় বলল, “এ কী?”
অরা অবাক গলায় বলল, “কী?”
আরশাদ উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “অরা! এতগুলো চকলেট তুমি কথাকে খেতে দিলে কেন? এমনিতেই ডেন্টিস্ট ওকে চকলেট খেতে একদমই নিষেধ করে দিয়েছে। তার ওপরে…”
অরা লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, “তোমাকে কে বলল কথা একা এই সবগুলো চকলেট খেয়েছে?”
“তার মানে তুমি?”
অরা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুরে বলল, “আরে আমি কি ইচ্ছা করে খেয়েছি না-কি এসব বাচ্চাদের জিনিস? তোমার বাবুর খেতে ইচ্ছা করলো তাই।”
অরার এমন জবাবে আরশাদ হেসে ফেলে বলল, “আমার বাবুর চকলেট খেতে ইচ্ছা করেছে?”
“হ্যাঁ!”
আরশাদ অরার গাল টিপে দিয়ে বলল, “অরা! তুমি কি জানো নিজেই দিন দিন একটা বাবু হয়ে যাচ্ছো।”
আরশাদ ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।
অরা তার পাশে বসতে বসতে বলল, “আরশাদ কাল কিন্তু আমাকে অফিসে যেতেই হবে।”
“কেন?”
“দিগন্তের কাস্টিং ফাইনালাইজ করতে হবে তো!”
‘দিগন্ত’ সিনেমার প্রায় সকল চরিত্রের কাস্টিং করা হয়ে গেছে। আসল কাস্টিংটাই বাকি এখনো। নায়িকার কাস্টিং। সিনেমার প্রধান নারী চরিত্রে কে অভিনয় করছে এটাই এতদিনে ঠিক হলো না। অরা অফিসে না থাকলে এমনই হয়। কোনো কাজ সময়মতো এগোয় না।
আরশাদ চিন্তিত স্বরে বলল, “সেটা ঘরে বসে করা যায় না অরা? এই সময়টায় তো ঘন ঘন বাইরে যাওয়া ঠিক না।”
অরা থমথমে গলায় বলল, “সব কাজ ভিডিও কনফারেন্সে করা যায় না আরশাদ। সেটা তুমিও জানো।”
“তাহলে ওদেরকে বাসায় ডাকো।”
অরা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “শুধু নিজের কমফোর্টের কথাই চিন্তা করবো? অফিসে যে কাজের পরিবেশ, বাসায় কি সেই পরিবেশ পাওয়া যাবে? তুমি আমাকে এতটা স্বার্থপর মনে করো কেন?”
আরশাদ হেসে বলল, “দিন দিন এত রাগী হয়ে যাচ্ছো কেন বলো তো। কথায় কথায় বকাঝকা করো আমাকে!”
অরা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে অনুতাপমাখা স্বরে বলল, “সব জুনিয়র আরশাদের দোষ।”
“জুনিয়র আরশাদ? কেন? জুনিয়র অরাও তো হতে পারে।”
অরা কৌতূহলী গলায় বলল, “তোমার কী মনে হয় আরশাদ? আমাদের মেয়ে হবে, না-কি ছেলে?”
“সেটা কি আদৌ ম্যাটার করে। যা ম্যাটার করে তা হলো আমাদের ভালোবাসার ফসল আর কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের কাছে আসতে যাচ্ছে।”
অরা কিছু একটা বলতে যাবে, তখনই ঘটলো অদ্ভুত সুন্দর এক ঘটনা। বিস্ময়ে রীতিমত জমে গিয়ে সে নিজের হাত রাখলো পেটের ওপরে। আরশাদ ভাবলো, অরার হয়তো কষ্ট হচ্ছে।
চট করে তাই উঠে বসে অরার কাছে গিয়ে বলল, “অরা? কী হয়েছে? ঠিক আছে তুমি?”
অরা কথা বলতে পারছে না। তার চোখে জল এসে গেছে।
আরশাদ কণ্ঠে আরও দ্বিগুণ চিন্তা নিয়ে বলল, “কী হয়েছে অরা?”
অরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলল, “বাবু নড়ছে!”
আরশাদ বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো অরার দিকে। যেন তার বলা কথাগুলোকে বিশ্বাস করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিস্মিত ভঙ্গিতে আরশাদ তার হাত রাখলো অরার পেটের ওপরে। স্পর্শেই টের পেলো, ভেতরে কেউ অদ্ভুত ছন্দে নড়ে উঠছে। এর থেকে সুন্দর মুহূর্ত আর কীই বা হতে পারে। আরশাদ আর অরার ভালোবাসার ফসলের অস্তিত্ব আজ তারা নিজেরাই অনুভব করতে পারছে।
(চলবে)
#ফিরে_আসা২
৩৯
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
প্রায় দুই মাস পর অফিসে এসেছে অরা। এই দুই মাসে বহু বদভ্যাস বাসা বেঁধেছে তার মধ্যে। আগের কর্মঠ কাজপাগল মানুষটা সে আর নেই। ঘুম থেকে উঠতে আলসেমি লাগে, অফিসে আসার কথা চিন্তা করলেই বিরক্ত লাগে। সব দোষ বাবুর! তার কারণেই দিন দিন এমন হয়ে যাচ্ছে অরা।
নিজের কেবিনে ডেস্কে মাথা রেখে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে অরা। অফিসে পা রেখেছে মাত্র ঘন্টাখানেক হয়েছে। ক্লান্ত হওয়ার মতো কোনো কাজও সে করেনি। তবুও ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। সামনে একগাদা ফাইল পড়ে আছে। এই দুই মাস ধরে প্রয়োজনীয় ফাইলগুলো অফিস থেকে কেউ একজন বাড়িতে নিয়ে যায়, অরা সাইন করে দেয়। আজ যেহেতু সে নিজেই এসেছে তাই ফাইলগুলো অফিসে বসেই সাইন করবে বলে ঠিক করেছিল। তবে এখন মনে হচ্ছে বিরাট ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। ফাইল সাইন করা বিরাট কঠিন কাজে পরিণত হয়েছে এখন।
হঠাৎ এক স্টাফ এসে বলল, “ম্যাম, মিটিংয়ের সময় হয়ে গেছে।”
আরেকদফা আলসেমির প্রবল স্রোত বয়ে গেল অরার গা বেয়ে। মিটিংটা জরুরি, সকলে হয়তো মিটিং রুমে পৌঁছেও গেছে। অপেক্ষায় বসে আছে তার জন্যে। এমন সময়ে মিটিংটাই করতে ইচ্ছা করছে না অরার? ইচ্ছা করছে বাড়ি ফিরে ব্যাঙ্কেটে নিজেকে মুড়িয়ে শুয়ে থাকতে। এ কী হলো তার? দিন দিন এমন কেন হয়ে যাচ্ছে সে?
সৌভাগ্যবশত, মিটিং রুমে পা রাখতে নিমিষেই অরার সকল আলসেমি দূর হয়ে গেল। সমানে একের পর এক সমস্যা। সবগুলো সমস্যা অপেক্ষা করছে অরার সমাধানের। আলসেমির আর অবকাশ কোথায়?
সাধারণত যে সিনেমাগুলোতে আরশাদ অভিনয় করে, সেই সিনেমাগুলো নিয়ে একটু বেশি চাপে থাকতে হয় কে ফিল্মসকে। কারণ এই সিনেমাগুলোর বাজেটও বেশি, বেশি দর্শকের আকাঙ্ক্ষাও। যদিও সবথেকে বেশি লাভ এই সিনেমাগুলো থেকেই হয়।
মিটিংয়ের প্রথম ঘন্টা কাটলো বাজেট সংক্রান্ত মিটিং করে। কে ফিল্মসের ফাইন্যান্স টিম বাজেট যা করেছে, তার থেকেও বেশি খরচ হচ্ছে সিনেমার শুটিং শুরুর আগেই আগেই। ফাইন্যান্স টিমের সঙ্গে মিটিং করে অরাই এই সমস্যার সমাধান করে দিলো। সে নিয়মিত অফিস করলে এই সমস্যার সমাধান বহু আগেই হয়ে যেত।
এরপর মিটিং শুরু হলো কাস্টিং টিমের সঙ্গে। ক্রিয়েটিভ টিমের কিছু সদস্যরাও উপস্থিত আছে এখানে। কাস্টিং টিমের কাজ হলো সিনেমার স্ক্রিপ্ট পড়ে প্রত্যেকটা চরিত্রে কোন কোন অভিনেতাকে মানাবে তা নির্ধারণ করা। এরপর সেই অভিনেতাকে সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব দেওয়া। অভিনেতা রাজি হলে তো ভালোই, রাজি না হলে অন্য কোন অভিনেতাকে চরিত্রের সঙ্গে মানাবে তা ঠিক করে তাকে সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব দেওয়া।
কাস্টিং টিমের প্রধান নাফিসা। মেয়েটার বয়স কম, কিন্তু খুব কাজের। ইন্ডাস্ট্রির রাঘব-বোয়াল থেকে চুনোপুটি সকল অভিনয়শিল্পীর সঙ্গেই তার যোগাযোগ আছে।
‘দিগন্ত’ সিনেমায় প্রধান নারী চরিত্রটা অভিনয়ের জন্যে খুব একটা জটিল। কারণ সিনেমায় বিভিন্ন পর্যায়ে এই চরিত্রের বৈশিষ্ট্য আর দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে। এক পর্যায়ে তাকে মনে হবে ভালো, আবার এক পর্যায়ে খারাপ।
আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে নায়িকার অভাব নেই, অভাব আছে অভিনেত্রীর। আর এই সিনেমার জন্যে দরকার সেরকমই একজন শক্তিশালী অভিনেত্রীর। অভিনয় দিয়ে যে দর্শককে পর্দার সঙ্গে আঁকড়ে ধরে রাখবে।
‘দিগন্ত’র স্ক্রিপ্ট পড়ে সবার আগে একজনের কথাই মাথায় এসেছিল নাফিসার। যার মতো নিখুঁত অভিনেত্রী এই ইন্ডাস্ট্রি খুব কমই পেয়েছে। স্ক্রিপ্ট পড়ে মনে হয়েছে যেন এই গল্পটা তাকে ভেবেই লেখা। তবে সেই অভিনেত্রীকে সিনেমার প্রস্তাব দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ সে এখন কারাগারের বন্দিনী। বন্দিনী না হলেও যে সিনেমার প্রস্তাব দেওয়া যেত তা নয়। আরশাদ হকের সিনেমায় কেন, তার জীবনে ওই মানুষটার কোনো ছায়াও সে চায় না।
নাফিসা তাই সিনেমার প্রস্তাব দিয়েছিল মোহরের কাছে। মোহরও নেহায়েত কম ভালো অভিনেত্রী নয়। ইদানিং অ্যাওয়ার্ড-ট্যাওয়ার্ড পাচ্ছে, সমালোচকদের প্রশংসা কুড়াচ্ছে।
নাফিসা চিন্তিত গলায় বলল, “মোহরকে গল্পটা শোনানো হয়েছিল ম্যাম। তার পছন্দও হয়েছিল। ডিরেক্টরের এই চরিত্রের জন্যে তাকে পারফেক্ট মনে হয়েছিল। এ সপ্তাহেই আমরা মোহরের সঙ্গে মিটিংয়ে বসতাম। হঠাৎ করে তার পা ভেঙে গিয়েই ঝামেলাটা হলো।”
মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরা। যত বিপত্তি ঘটার শুটিংয়ের সময়েই ঘটতে হয় কেন?
অরা থমথমে গলায় বলল, “এখন?”
“এখন তার শুটিংয়ে ফিরতে ফিরতে মিনিমাম তিন মাস।”
“কিন্তু এতটা সময় তো আমাদের কাছে নেই। সিনেমার এনাউন্সমেন্ট হয়ে গেছে, আগামী মাস থেকে শুটিং। এখন আমাদের অন্য কোনো নায়িকাকে অ্যাপ্রোচ করতে হবে।”
নায়িকা বলতে অনেকেই তো আছে। আরশাদ হকের সঙ্গে সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পেলে ইন্ডাস্ট্রির যেকোনো নায়িকা ছুটে আসবে। তবে ওই যে, নায়িকা দিয়ে কাজ হবে না। এই চরিত্রের জন্যে প্রয়োজন একজন পাকা অভিনেত্রীর।
কোন অভিনেত্রী এই চরিত্রের জন্যে মানানসই তাই খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে সকলে। কয়েকটা নামও উঠে এলো।
মাহমুদ হঠাৎ উৎফুল্ল গলায় বলল, “ম্যাম সুজানা কেমন হয়?”
অরা চিন্তায় পড়ে গেল। সুজানা ইন্ডাস্ট্রির নাম করা কোনো অভিনেত্রী নয়। সবে গত বছর তার প্রথম সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। যদিও সেই সিনেমা সফলতার মুখ দেখেনি, তবে অভিনয়ের জন্যে প্রশংসা কামিয়েছে।
অরা কী যেন ভেবে বলল, “সে তো একেবারে নতুন। এত বড় বাজেটের সিনেমায় তাকে কাস্ট করাটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে না?”
মাহমুদ দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “তা একটু হয় ম্যাম। কিন্তু সুজানাকে এই চরিত্রের সঙ্গে মানাতো। তাছাড়া অভিনয়ও সে ভালো করতো।”
অরা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “না, না। অযথা এই রিস্ক নেওয়ার কোনো মানে হয় না। তাছাড়া আরশাদ নতুনদের সাথে অভিনয় করতে পছন্দ করে না। এরা না-কি ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেই ঘাবড়ে যায়।”
মাহমুদ জোর গলায় বলল, “ঘাবড়াবে কেন ম্যাম? সুজানার প্রথম সিনেমায় ওর অভিনয় দেখেননি? যাকে বলে জাত অভিনেত্রী সে! দরকার হলে আমরা সুজানার অডিশন নিই।”
মাহমুদ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ক্রিয়েটিভ টিমের হেড যুথী ধমকের সুরে বলল, “তোমাকে সুজানার হয়ে ওকালতি করতে বলেছে কেউ? ম্যামকে প্রেশারাইজ করা বন্ধ করো!”
ধমক খেয়ে মাহমুদ চুপ করে রইলেও তাকে দেখে মনে হচ্ছে নীরবতায় সে সন্তুষ্ট নয়। নাফিসা এতটা সময় চুপ করেই ছিল।
নীরবতা ভঙ্গ করে বিচক্ষণ কণ্ঠে বলল, “মাহমুদ ভুল কিছু বলেনি কিন্তু ম্যাম। সুজানা অভিনয় ভালোই করে। আমরা তাকে একটা সুযোগ দিতেই পারি। অডিশন অবশ্যই নেওয়া হবে। অডিশনে ভালো করলে আমি নিশ্চিত আরশাদ স্যারেরও কোনো আপত্তি থাকবে না।”
গভীর চিন্তায় ডুবে গেল অরা। বুঝতে পারছে না এত বড় সিনেমায় এই নতুন অভিনেত্রীকে সুযোগ দেওয়া কতটুকু যৌক্তিক হবে।
হঠাৎ বেজে উঠলো অরার ফোনের রিংটোন। ফোনটা এতক্ষণ উল্টো করে রাখা ছিল ডেস্কের ওপরে। অরা হাতে নিতেই দেখতে পেলো স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে সীমার নাম।
ফোনটা আবারও উল্টো করে রাখলো অরা। জরুরি মিটিংয়ে কোনপ্রকার বাঁধা তার অপছন্দের। আর সেখানে সে নিজেই ব্যাঘাত ঘটায় কী করে? সীমা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে। সে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে অরা এখন ব্যস্ত। ফ্রি হয়ে সবার আগে সে যে কাজটা করবে সেটা হলো, সীমাকে কলব্যাক করা।
মিটিংয়ে মনোযোগ ফেরালো অরা। মিনিট কয়েক বাদে আবারও বেজে উঠলো রিংটোন।এবার কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেল অরা। একবার ফোন করে না পেলে নিতান্তই জরুরি প্রয়োজন ছাড়া দ্বিতীয়বার তো ফোন করে না সীমা।
অরা সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল, “Excuse me.”
উঠে এসে টেবিল থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ফোনটা রিসিভ করলো অরা।
সঙ্গে সঙ্গে ভেসে এলো সীমার উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর, “অরা? তুই ঠিক আছিস তো?”
অরা বিভ্রান্ত গলায় বলল, “হ্যাঁ! ঠিক থাকবো না কেন?”
সীমা ইতস্তত করে বলল, “তুই জানিস না?”
অরা কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে বলল, “না! কী জানি না?”
সীমা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “নিউজ দেখ। জেনে যাবি।”
অরা চিন্তিত গলায় বলল, “কী জানবো?”
“আহ্! দেখ তো!”
অরা ইমার্জেন্সির অজুহাতে মিটিং রুম থেকে বেরিয়ে সোজা দাঁড়ালো লিফটের সামনে। এক তলা ওপরেই তার কেবিন। তবে ডক্টরের কড়া নিষেধাজ্ঞা, অরা যেন যথাসম্ভব সিঁড়ি কম ব্যবহার করে।
লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে দুশ্চিন্তায় অতিষ্ট হয়ে পড়েছে অরা। সীমা এত তাড়াহুড়ো করে নিউজ দেখতে বলল কেন? আরশাদের কোনো ক্ষতি হয়নি তো? আরশাদের ক্ষতির চিন্তা মাথায় আসতে গা বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে অরা নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে, ক্রমেই ব্যর্থ হচ্ছে। অনবরত মনে একটাই প্রশ্ন জাগছে, “আরশাদ ঠিক আছে তো?”
লিফট পাঁচতলায় এসে থামতেই, অরা লিফট থেকে বেরিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। রাস্তায় তার সামনে পড়লো এক ফ্লোর বয়। এই অফিসে অসংখ্য ফ্লোর বয় কাজ করে। এদের কাজ চা-কফি বানানো, ফাইলপত্র এই ঘর থেকে অন্য ঘরে নিয়ে যাওয়া। ফ্লোর বয়টাকে থেকে এক মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়ালো অরা। একে কোথায় যেন দেখেছে বলে মনে হচ্ছে। অফিসে আগে দেখেছে বলে মনে পড়ছে না, তবে চেহারাটা খুবই পরিচিত।
ফ্লোর বয়ের চিন্তা আপাতত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে নিজের কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল অরা। টিভি অন করে খুঁজে বের করলো বিনোদন বাংলা চ্যানেল। বিনোদন বাংলা নিউজ চ্যানেল হলেও দেশে বা বিশ্বের কোথায় কী হচ্ছে, তা নিয়ে এদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। এদের সকল মাথা ব্যথা সেলিব্রিটিদের জীবনকে কেন্দ্র করে। কোন সেলিব্রিটি কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে যাচ্ছে, কী খাচ্ছে – এই নিয়েই মেতে থাকে তারা।
বিনোদন বাংলা খুলতেই চমকে উঠলো অরা। ব্রেকিং নিউজ হিসেবে ভাসছে, “সুপারস্টার আরশাদ হক ডিভোর্স দিতে যাচ্ছে তার স্ত্রী আফরোজা অরা হককে।”
উপস্থাপিকা হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে বলছে, “আরশাদ হক তার স্ত্রীর মাঝে বেশ কিছুদিনের দূরত্ব। ইদানিং এক সঙ্গে খুব একট দেখা যাচ্ছে না তাদের। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, আরশাদ হকের প্রোডাকশন কোম্পানি কে ফিল্মসের সকল পরিচালনার দায়িত্বে আছেন তার স্ত্রী অরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যক্তি জানিয়েছেন, অফিসেও তারা একে অপরের সঙ্গে কাজের বাইরে কোনো কথা বলেন না। আজ সকালে আরশাদ হকের ঘনিষ্ট সূত্র আমাদের নিশ্চিত করেছে, তিনি খুব শীঘ্রই তার স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহিত জীবনের ইতি টানতে যাচ্ছেন। তাদের সন্তান পৃথিবীতে এলেই শুরু হবে ডিভোর্সের আনুষ্ঠানিকতা। দর্শক ডিভোর্সের কারণ এখনো জানা যায়নি, তবে ধারণা করা হচ্ছে…”
উপস্থাপিকার কোনো কথা মাথায় ঢুকছে না অরার। চিন্তা-চেতনা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। সদ্য ঘুম ভাঙ্গার পর যেমন অনুভূত হয়, তেমনটাই অনুভব করছে অরা। মনে হচ্ছে যেন এই পৃথিবীর সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
যদিও এটা টিভি চ্যানেলের নিউজ। টিভি চ্যানেলের নিউজ দেখে এতটা বিচলিত হয়ে ওঠার কিছু নেই। ওদের তথ্য সবসময় ঠিক হয় না। তবে একটা তথ্য তো এরা ঠিকই দিলো। আসলেই গত কয়েকদিনে কোথায় সঙ্গে দেখা যায়নি আরশাদ আর অরাকে। আসলেই তো অফিসে তারা কাজের বাইরে কোনো কথা বলেনি।
কিন্তু তা তো ওই ঘটনার জন্যে। ওই সমস্যার সমাধানও তো হয়ে গেছে তাদের মাঝে। আরশাদ তাকে ডিভোর্স দিতে যাচ্ছে মানে কী?
কোন ঘনিষ্ট সূত্র তাদের এই তথ্য নিশ্চিত করেছে? আজ সকালেও তো সবকিছু ঠিক ছিল তাদের মধ্যে!
অরার মাথা ঘুরছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। ধপ করে সোফার ওপরে বসে পড়লো। তার এখন উচিত আরশাদকে ফোন করা। তবে হাতদুটো তার জমে গেছে। সারা শরীরই জমে গেছে। বুক ভেঙে কান্না পাচ্ছে তার। এই তথ্য কি আদৌ সত্যি? আবার কী করলো সে?
(চলবে)