#ফিরে_আসা২
৪০
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে আরশাদ। সিগারেটের ধোঁয়া ঘিরে রেখেছে আরশাদকে চারিদিক থেকে। তবুও লোকটার মুখভঙ্গি দেখতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হচ্ছে না তার। লোকটা ভয় রীতিমত কাঁপছে। কাঁচুমাচু হয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। একবার চোখ তুলে আরশাদের অগ্নিদৃষ্টি দেখে আবারও দমে গিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো মেঝের দিকে।
আরশাদ সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে বলল, “আপনি কাঁপছেন কেন? হাত-পা কাঁপাকাঁপির তো কিছু নেই। সিম্পল একটা প্রশ্ন করেছি, যত তাড়াতাড়ি উত্তর দিবেন তত
তাড়াতাড়িই আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হবে।”
লোকটি ভীত ভঙ্গিতে বসে রইলো। বিনোদন বাংলার বার্তা বিভাগের প্রধান এই লোকের নাম খায়রুল। অফিসের এত বড় কর্মকর্তা, নিশ্চয়ই তার দাপটে অন্যান্য সাংবাদিকরা অফিসে জড়োসড়ো হয়ে থাকে। অথচ সে কিনা আজ নিজেই জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে আরশাদের সামনে!
প্রচন্ড রেগে আছে আরশাদ। সিগারেটের বারবার টান দিয়ে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। শুটিংয়ের মাঝে কোনপ্রকার ব্যাঘাত তাকে অসম্ভব বিরক্ত করে। সেই ব্যাঘাতটাই আজ ঘটলো বিনোদন বাংলার নিউজে। তাদের একটা নিউজের কারণে শুটিং হাউজের সামনে অন্যান্য সকল পত্র-পত্রিকা আর টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরা ভীড় করেছে। শুটিংটাও এ কারণে আজ স্থগিত করতে হয়েছে আরশাদকে। তার দুজন বডিগার্ড আর শুটিং হাউজের সিকিউরিটি গার্ডরা আপাতত সামনের ভীড় সামাল দিতে ব্যস্ত। তবে কাজটা বেশ কঠিন। উৎসুক সাংবাদিক যেন সুযোগ পেলেই ঢুকে যাবে শুটিং হাউজের ভেতরে।
এরই মাঝে আরশাদ খবর দিয়ে ডেকে এনেছে খায়রুলকে। বিনোদন বাংলায় যেকোনো নিউজ সম্প্রচারের আগে এই ব্যক্তির অনুমতির প্রয়োজন হয়।
খায়রুল আমতা আমতা করে বলল, “না মানে স্যার…”
আরশাদ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “না মানে, হ্যাঁ মানে তো সেই আধ ঘন্টা ধরে করছেন। তাড়াতাড়ি উত্তরটা দিন, আপনার-আমার দুজনেরই সময় বাঁচবে।”
আবারও চুপ মেরে গেল লোকটা। রাগে-বিরক্তিতে গা জ্বলে যাচ্ছে আরশাদের। তবুও বহুকষ্টে নিজেকে সামলে বলল, “আপনি জানেন তো এই ইন্ডাস্ট্রিতে আমার দারুণ একটা রেকর্ড আছে! সবথেকে বেশি সংখ্যক টিভি চ্যানেল আর পত্রিকার নামে কেস করার রেকর্ড। আপনি নিশ্চয়ই চান না আপনার টিভি চ্যানেলের নামেও আমি কেস করি।”
খায়রুল সঙ্গে সঙ্গে বলল, “না স্যার।”
আরশাদ কঠিন স্বরে বলল, “তাহলে বলে দিন। আমার কোন ঘনিষ্ট সূত্র বলেছে যে আমি আমার ওয়াইফকে ডিভোর্স দিচ্ছি?”
খায়রুল কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আমাদের এক জুনিয়র রিপোর্টারের কাছে অজ্ঞাত মেইল নম্বর থেকে একটা মেইল এসেছিল স্যার। মেইলে লেখা ছিল আপনাদের না-কি খুব শীঘ্রই ডিভোর্স হতে চলেছে। আপনিই এই নিউজটা আমাদের জানাতে চাইছেন।”
চিন্তায় পড়ে গেল আরশাদ। তার মুখোমুখি বসে থাকা লোকটার ওপর রাগের মাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। অজ্ঞাত একটা মেইল নম্বর থেকে মেইল এলো আর সঙ্গে সঙ্গে এরা রসিয়ে রসিয়ে নিউজ করতে বসে গেল? একবারও তথ্যের সত্যতা যাচাই করার প্রয়োজন মনে করলো না?
বহুকষ্টে রাগটা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে আরশাদ। এই মুহূর্তে টিভি চ্যানেলের ওপর রাগ দেখানোটা নিতান্ত অযৌক্তিক। এরা তো বসেই থাকে কখন সেলিব্রিটিদের নিয়ে রসালো তথ্য পাবে, আর সেটা নিয়ে নিউজ করে টিআরপি কামাবে। আপাতত আরশাদকে খুঁজে বের করতে হয় ওই অজ্ঞাত মেইল নম্বরের পেছনে থাকা মানুষটাকে।
আরশাদ থমথমে স্বরে বলল, “মেইল নম্বর?”
খায়রুল ব্যস্ততার সঙ্গে তার পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে তাতে বের করলো সেই অজ্ঞাত মেইল।
মোবাইলটা আরশাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এই যে স্যার।”
মেইলে কী লেখা আছে পড়ার প্রয়োজন বোধ করলো না আরশাদ। তার দরকার মেইল নম্বরটা।
আরশাদ গম্ভীর গলায় বলল, “অয়ন!”
একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল আরশাদের ম্যানেজার অয়ন। আরশাদ ডাকতেই সে বুঝে গেল কী করতে হবে তাকে। এগিয়ে গিয়ে খায়রুল হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে মেইল নম্বরটা নিজের ফোনে তুলে ফেলল।
আরশাদ রাগী ভঙ্গিতে বলল, “নাম নেই, পরিচয় নেই এমন একটা মেইলের তথ্য দিয়ে আপনারা নিউজ করে ফেললেন? তাও আবার আমার ঘনিষ্ট সূত্র বলে চালিয়ে দিলেন?”
খায়রুল ভীত কণ্ঠে বলল, “ভুল হয়ে গেছে স্যার।”
আরশাদ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,“ভুল হয় কী করে? আপনারা তো চুনোপুটি কোনো ইউটিউব চ্যানেল নন। ইউটিউবে নিউজ চ্যানেলগুলোর তথ্যের কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। তাদের নিউজ বিশ্বাস করার আগেও মানুষ দুবার ভাবে। কিন্তু আপনারা তো রেজিস্টার্ড স্যাটেলাইট চ্যানেল। এত বড় ভুল আপনারা কী করে করতে পারেন? কোনো দায়িত্ববোধ নেই আপনাদের মাঝে?”
লোকটা কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বসে রইলো। একে নিয়ে ঘাটাঘাটি করার আর কোনো মানে হয় না।
আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “যান।”
খায়রুল উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “Sorry sir…”
আরশাদ তার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকাতেই লোকটা ভীত হয়ে আবারও বলল, “Thank you sir!”
আরশাদ অগ্নিকণ্ঠে বলে উঠলো, “Out!”
খায়রুল যেন এক দৌড়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
আরশাদ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,“অয়ন!”
অয়ন এগিয়ে এসে ভদ্রভাবে বলল, “জি স্যার?”
“মেইল নম্বরটা পুলিশের কাছে পাঠিয়ে দাও। তারা যেন দ্রুত খুঁজে বের করার চেষ্টা করে এর পেছনে কে আছে।”
অয়ন হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে আরশাদের মোবাইল তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “স্যার আপনার ফোন।”
শুটিংয়ের সময় আরশাদের ফোন অয়নের কাছেই থাকে। আজ শুটিংয়ের মাঝে নিউজটা দেখা, খায়রুলকে ডেকে পাঠানো, বাইরে সাংবাদিকদের ভীড় – এসবের মাঝে ফোনের কথা সে ভুলেই গিয়েছিল। ফোনটা হাতেই নিতেই আরশাদ দেখতে পেলো অরার এগারোটা মিসড কল আর তিনটা টেক্সট এসে জমেছে।
ইশ! মেয়েটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে নিউজটা দেখেছে, আর চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। আরশাদের আগেই উচিত ছিল অরাকে ফোন করে শান্ত করা। তবে এখানকার পরিস্থিতি এতটাই নাগালের বাইরে চলে গিয়েছিল যে অরাকে ফোন করার কথা সে ভুলেই গেছে।
এক মুহূর্তেও অপচয় না করে অরাকে ফোন করলো আরশাদ। একটা রিং বাজতেই রিসিভ হলো। অপরপ্রান্ত থেকে শোনা গেল অরার চিন্তিত কণ্ঠস্বর, “আরশাদ! আমার ফোন রিসিভ করছিলে না কেন এতক্ষণ? কোথায় তুমি?”
মুহূর্তেই এতক্ষণ জমে থাকা সব রাগ গলে পানি হয়ে গেল আরশাদের। এই কণ্ঠস্বর তার বুকের মাঝে অদ্ভুতভাবে প্রশান্তি ছড়িয়ে দেয়। অরার কণ্ঠ শুনে বোঝা যাচ্ছে, মেয়েটা প্রচন্ড দুশ্চিন্তায় ভুগছে। আরশাদের ইচ্ছা করলো ঠিক এই মুহূর্তে কোনো এক অদৃশ্য জাদুর বলে মেয়েটার সমস্ত দুশ্চিন্তা দূর করে দিতে।
আরশাদ নরম সুরে বলল, “অরা! সরি, অরা আমি ফোনের কাছে ছিলাম না।”
অরা কম্পিত স্বরে বলল, “এসব কী হচ্ছে আরশাদ? কী বলছে এসব নিউজে?”
আরশাদ অরাকে আশ্বস্ত করে বলল, “কিচ্ছু হয়নি অরা। তুমি শান্ত হও, কিচ্ছু হয়নি।”
অরা বোধ আশ্বস্ত হতে পারলো না। এখনো ছটফট করছে তার কণ্ঠস্বর, “ওরা কীসব বলছে! তুমি না-কি আমাকে…”
অরাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই আরশাদ বলল, “তুমি লক্ষ্মী মেয়ের মতো টিভি বন্ধ করে বসে থাকবে। আমি আসছি।”
শুটিং হাউজের পেছনের দরজায়ও সাংবাদিক ভীড় করেছে। তবে এই ভীড় নিয়ন্ত্রণযোগ্য। বডিগার্ডরা এই ভীড় নিয়ন্ত্রণে আনলে আরশাদ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। চিন্তা হচ্ছে তার অরার জন্য। মেয়েটা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী আর ম্যাচিউরড। তবুও যে কেন এসব উল্টো-পাল্টা নিউজ একবার দেখেই বিশ্বাস করে ফেলে!
একবার আরশাদ শুটিং করতে গিয়েছিল বান্দরবানে। সেখানে নেটওয়ার্ক নেই। দিন সাতেক তারা যোগাযোগের বাইরে। হঠাৎ নিউজ এলো আরশাদ না-কি কোন পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে গুরুতর আঘাত পেয়েছে। তাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে, বাঁচার কোনো সম্ভাবনাই নেই। অরা অস্থির হয়ে পড়লো। ফোন করে যখন কাউকেই পাওয়া গেল না, নিজেই ছুটে গেল বান্দরবানের উদ্দেশ্যে। আরশাদকে সচক্ষে অক্ষত দেখে তার স্বস্তি হলো। আরশাদকে সেটভর্তি মানুষের সামনে জড়িয়ে ধরে তার সে কী কান্না!
অবশ্য অরাকে দোষ দিয়েও কোনো লাভ নেই। মেয়েটা যতটা বুদ্ধিমতী, তার ভালোবাসা তার থেকে হাজারগুণ বেশি। ভালোবাসার ক্ষেত্রে কোনো যুক্তি খাটে না।
বাড়িতে পা রাখতেই আরশাদ দেখতে পেলো বসার ঘরের সোফায় বসে রয়েছে অরা। তার চোখমুখ রক্তশূন্য হয়ে আছে। আরশাদকে দেখতে পেয়েই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো অরা তাকে। আরশাদও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। অরা কেঁপে উঠছে আর কাঁদছে নিঃশব্দে। তার চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে আরশাদের বুকের কাছটা।
আরশাদ অরার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “অরা, তুমি আস্ত বোকা একটা মেয়ে! টিভিতে যা দেখবে তাই বিশ্বাস করবে? আমাকে তো প্রায়ই এমন উল্টো-পাল্টা নিউজ হয়। সব নিউজই কী বিশ্বাস করতে হবে, হুঁম?”
অরা আরশাদের বুকে মুখ লুকিয়ে রেখেই অস্পষ্ট গলায় বলল, “আমি অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
আরশাদ হেসে বলল, “ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই তো! এই পৃথিবীতে কার সাধ্য আছে আমাদের আলাদা করার?”
অরা কিছুই বলল না। তার কান্না যেন থামছেই না। আসলেই বড্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। আরশাদকে ছাড়া নিজের অস্তিত্ব সে কল্পনাই করতে পারে না। আর সেখানে যদি অমন একটা নিউজ দেখে, তাহলে তো আত্মা উড়ে যাওয়ারই কথা।
আরশাদ বুক থেকে অরার মুখটা তুলে দুহাতে তার চোখের জলগুলো মুছে দিয়ে বলল, “কাঁদে না। তুমি কাঁদলে আমার বাবুটা মন খারাপ করবে।”
কিছুটা শান্ত হলো অরা। কান্নাকাটি করার কারণে তার হিচকি উঠছে। আরশাদ ডাইনিং টেবিল থেকে পানির গ্লাস এনে অরাকে যত্ন করে পানি খাইয়ে দিলো।
অরা দুর্বল স্বরে বলল, “এসব কী হলো আরশাদ?”
আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ফেক নিউজ। এদের খেয়েদেয়ে আর তো কোনো কাজ নেই, মানুষের জীবন নিয়ে ফেক নিউজ করাটাই এদের ব্যবসা। ইডিয়েটের দল সব! কয়েকদিন একসঙ্গে দেখা না গেলে কি মানুষের ডিভোর্স হয়ে যায়? একটা প্রেগন্যান্ট মানুষ এখন দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াবে?”
“কিন্তু অফিসের ব্যাপারটা জানলো কীভাবে? এত ভেতরের ঘটনা তো সাংবাদিকদের জানার কথা নয়।”
“অফিসের ভেতর থেকে কেউ একজন তথ্য পাচার করছে।”
অরা অবাক গলায় বলল, “মানে?”
আরশাদ ইমেইলের ঘটনাটা বুঝিয়ে বলল অরা।
অরা বিস্মিত ভঙ্গিতে বলল, “কিন্তু কে?”
আরশাদ চিন্তিত হয়ে বলল, “বুঝতে পারছি না। তবে এতটুকু বুঝতে পারছি, খুব কাছ থেকে কেউ একজন আমাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। সাবধানে থাকতে হবে অরা।”
অরা ভীত ভঙ্গিতে বলল, “ক্ষতি করবে? কী করে?”
অরার ভয় দেখে আরশাদ তাকে আবারও বুকে টেনে নিয়ে বলল, “এত ভয় পাচ্ছো কেন? আমি আছি না?”
আসলেই ভয় পাচ্ছে অরা। হাজারো ঝড়-ঝাপটা পেরিয়ে আজকের দিনটায় এসে দাঁড়াতে পেরেছে দুজনে। অরা চায় না আর কোনো কালবৈশাখীর ঝড় এসে এলোমেলো করে দিয়ে যাক তাদের।
আরশাদ কোমল স্বরে বলল, “কিছু খাওনি না?”
অরা না-সূচক মাথা নাড়লো।
আরশাদ মেকি রাগ নিয়ে বলল, “অরা! তোমাকে কতবার বোঝাবো এই সময়ে টাইমলি খাওয়া-দাওয়া করতে হবে। তুমি তো এখন আর একা নও। তোমার ভেতরে আরও একটা মানুষ বসবাস করছে। তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে না?”
অরা শুকনো গলায় বলল, “Sorry.”
“It’s okay. চলো আমি তোমাকে খাইয়ে দিই। কথা ঘুমিয়েছে?”
“হ্যাঁ। তোমার আমাকে খাইয়ে দিতে হবে না। চলো আমরা একসাথে বসি। তোমারও নিশ্চয়ই ক্ষুধা লেগেছে।”
আরশাদ হেসে আদুরে গলায় বলল, “আমার বউটার কত চিন্তা আমাকে নিয়ে! চিন্তা কোরো না, তোমাকে খাইয়ে দিয়ে আমি ঠিক খেয়ে নেবো।”
আরশাদ ফ্রেশ হয়ে এসে অরাকে খাইয়ে দিতে বসলো। অরা বাধ্য মেয়ের মতো খেয়ে নিলো। আরশাদ তাকে রেস্ট নেওয়ার জন্যে ওপরে পাঠিয়ে দিতে চাইলো, তবে আরশাদের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত অরা ডাইনিংয়েই। দুজনে একসঙ্গে ঘরে গেল আরও কিছুক্ষণ পর।
আরশাদ অরাকে ওষুধ খাইয়ে, শুইয়ে দিতেই তার ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে অয়নের নাম।
আরশাদ কল রিসিভ করে বলল, “হ্যাঁ অয়ন বলো।”
অয়ন অপরপ্রান্ত থেকে বলল, “স্যার ওই মেইল নম্বরটা একেবারেই নতুন। এক সপ্তাহ আগে একটা সাইবার ক্যাফেতে খোলা হয়েছিল। সাইবার ক্যাফেতে রেজিষ্টার নেই বলে বোঝা যাচ্ছে না কে খুলেছে ওই মেইল আইডি।”
মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরশাদ। সে জানত এমন কিছু একটাই হতে যাচ্ছে। যে তাদের ক্ষতি করতে চাইছে সে নিশ্চয়ই নিজস্ব মেইল আইডি দিয়ে ওই মেইল পাঠাবে না।
আরশাদ গম্ভীর গলায় বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। রাখো।”
আরশাদ ফোন রাখতেই অরা উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “কী হয়েছে?”
সত্যিটা বললে অরা দুশ্চিন্তা করতে পারে। অনেক কষ্টে মেয়েটাকে শান্ত করেছে আরশাদ।
আরশাদ মোহনীয় এক হাসি হেসে বলল, “তেমন কিছু না। কালকের কল টাইম দিলো।”
আরশাদ বিছানায় অরার পাশে শুয়ে ব্ল্যাঙ্কেট। টেনে নিলো নিজেদের গায়ে। অরাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে একটা চুমু খেলো তার কপালে।
অরা শক্ত করে আরশাদকে আঁকড়ে ধরে বলল, “সত্যিই অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আরশাদ। তোমাকে ছাড়া এক সেকেন্ডও বেঁচে থাকার কথা কল্পনা করতেও আমার কষ্ট হয়।”
আরশাদ অরার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “কল্পনা করতে হবেই বা কেন? কোথায় যাবো আমি?”
অরা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “আরশাদ?”
“হুঁ?”
“এত ভালোবাসো কেন আমাকে? আমি কি সত্যিই এতটা ভালোবাসার যোগ্য?”
আরশাদ সঙ্গে সঙ্গে বলল, “না।”
অবাক চোখে কয়েক মুহূর্তে তাকিয়ে রইলো অরা। আরশাদ হেসে বলল, “এর থেকেও অনেক বেশি ভালোবাসা ডিজার্ভ করো তুমি। প্রতিদিন একটু একটু করে, আগের দিনের থেকেও বেশি করে ভালোবাসার চেষ্টা করি তোমাকে। জানি না কতটা সফল হই।”
অরা মুখ লুকালো আরশাদের বুকে। এই বুকটার মাঝেই লুকিয়ে আছে পৃথিবীর সমস্ত প্রশান্তি। কয়েক মিনিটের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়লো অরা।
অরাকে সাবধানে নিজের থেকে ছাড়িয়ে ফোনটা বেডসাইড টেবিল থেকে নিলো আরশাদ। এই মিথ্যা সংবাদ নিশ্চয়ই ভক্তকুলের মাঝে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। যে মানুষগুলো তাকে এতটা ভালোবাসে, তাদেরকে বিভ্রান্তির মাঝে রাখার কোনো মানে হয় না।
গ্যালারি ঘেঁটে দুজনের সুন্দর একটা ছবি বেড়ে করলো আরশাদ। কিছুদিন আগে আশফিয়ার বাড়িতে গিয়েছিল আরশাদ, অরা আর কথা। সেখানেই আশফিয়া তুলেছে। আরশাদ অরার কানে কানে কিছু একটা বলছে, আর অরা খিলখিল করে হাসছে। দুজনের কেউই জানে না দূর থেকে তাদের ছবি তোলা হচ্ছে।
ছবিটা ইনস্টাগ্রাম আর ফেসবুক পেজে পোস্ট করে দীর্ঘ বর্ণনায় গেল না আরশাদ। ক্যাপশনে লিখলো একটা মাত্র বাক্য, “Light spreader of life.”
একটা মাত্র ছবি আর ক্যাপশনের চারটি শব্দই সারা বিশ্বের কাছে তাদের ভালোবাসার জানান দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট।
(চলবে)
#ফিরে_আসা২
৪১
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
কে ফিল্মসের অফিসের তিনতলায় বিশাল বিশাল অনেকগুলো স্টুডিও আছে। এই স্টুডিওগুলোতে মাঝে মাঝে সেট তৈরি করে সিনেমার শুটিং হয়, সিনেমার পোস্টারের জন্য ফটোশুট করা হয়, সিনেমার প্রচারণার জন্য ইন্টারভিউয়ের শুটও করা হয়। তেমনই এক স্টুডিওতে আজ অভিনেত্রী সুজানার অডিশন চলছে।
অডিশনের জন্যে একজন অভিনয়শিল্পীকে বহুল আলোকসজ্জার নিচে দাঁড়াতে হয়। তার সামনে ক্যামেরা থাকে। তাকে হুট করে যেকোনো একটা সিনেমার দৃশ্য ধরিয়ে দেওয়া হয়। বলা হয় সেই দৃশ্যের একটা চরিত্র হয়ে অভিনয় করতে, সংলাপগুলো বলতে। অনেকের মতে অডিশনে অভিনয় করা না-কি সিনেমায় অভিনয়ের থেকেও কঠিন। সিনেমায় সহঅভিনেতার সঙ্গে অভিনয় করা হয়। তবে অডিশনে কেউ থাকে। সহঅভিনেতাকে কল্পনা করে অভিনয় করতে হয়।
সুজানাকে এখন দেওয়া হয়েছে কয়েক বছরে আগে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘রোদেলার উপাখ্যান’ সিনেমার একটি দৃশ্য। এই সিনেমায় রোদেলা চরিত্রটির সঙ্গে ‘দিগন্ত’ সিনেমার প্রধান নারী চরিত্রের বেশ মিল আছে। দুজনের মানসিক ভারসাম্যহীন।
সুজানা সুদক্ষভাবে অভিনয় করে গেল দৃশ্যটায়। এরপর ওই একই সিনেমা থেকে আরও কয়েকটি দৃশ্য দেওয়া হলো তাকে। সবগুলোতেই অভিনয়ের দক্ষতার ছাপ রেখে গেছে সে।
সুজানার অভিনয় করা দৃশ্যগুলো ক্যামেরায় ধারণ করা হচ্ছে। আর সেই ক্যামেরাকে সরাসরি সংযোগ দেওয়া হয়েছে একটু দূরে থাকা একটা মনিটরের সঙ্গে। মনিটরে ভেসে উঠেছে তার অভিনয়। মনিটরের সামনে বসে আছে অরা এবং ‘দিগন্ত’র পরিচালক রাহাত।
অরার সুজানাকে ভালোই লাগছে। ‘দিগন্ত’র চিত্রনাট্যের সঙ্গে বেশ ভালো ভাবেই মানিয়ে যাবে সে। তবে চূড়ান্ত কাস্টিং অরার পছন্দের ওপর নির্ভর করে না। পরিচালকের পছন্দ হলে তবেই সুজানাকে চুক্তিবদ্ধ করা হবে সিনেমাটির সঙ্গে।
অরা রাহাতকে উদ্দেশ্য করে বলল, “কী মনে হচ্ছে রাহাত ভাই? পারবে?”
রাহাত চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “বুঝতে পারছি না আপু। পোটেনশিয়াল আছে, ক্যামেরার সামনে জড়তাও নেই। তবে আমি বুঝতে পারছি না এত কঠিন চরিত্রে অভিনয় করতে পারবে কিনা।”
“আলাদা করে কথা বলে দেখবেন? ডাকবো?”
“তাহলে তো ভালোই হয়।”
অডিশন থামিয়ে সুজানাকে ডাকা হলো। মেয়েটার অভিনয় যতটা ভালো লাগলো, অরার তার থেকেও বেশি ভালো লাগলো তার ব্যক্তিত্ব। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে অভিনেত্রী মানেই জমকালো পোশাক, ভারী মেকআপ আর কথাবার্তায় উপচে পড়া ঢং। সুজানার মধ্যে সেসব কিছুই নেই। সাধারণ একটা সবুজ রঙের সালোয়ার কামিজ পড়েছে, মুখেই নেই মেকআপের আধিক্য।
অরা এবং রাহাত যেখানে বসে ছিল সেখানে এসেই সুজানা ভদ্রভাবে বলল, “আসসালামুয়ালাইকুম ম্যাম।”
অরা হাসিমুখে বলল, “ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমাকে ম্যাম ডাকতে হবে না। বসো।”
তাদের সামনে থাকা একটা সোফায় গিয়ে বসলো সুজানা। নিজেকে ভাইভা বোর্ডের সদস্য বলে মনে হচ্ছে অরার। তার ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির আগে ভাইভার সময় এভাবেই তাকে দুজন শিক্ষকের সামনে বসতে হয়েছিল।
অরা অবশ্য তেমন কিছুই বলল না। রাহাত পুরো সিনেমার গল্পটা সুজানাকে বুঝিয়ে বলল। সেই সঙ্গে চরিত্রের গভীরতাও তুলে ধরলো। এই সিনেমায় প্রধান দুটো চরিত্রে অভিনয় করা যেকোনো অভিনেতার জন্যেই চ্যালেঞ্জিং বিষয়। একটা চরিত্রে অভিনয় করছে আরশাদ। তাই সেটা নিয়ে কোনো চিন্তা নেই রাহাতের। তার সকল চিন্তা এই প্রধান নারী চরিত্রেটা নিয়েই।
রাহাত সুজানাকে সবকিছু বুঝিয়ে দেওয়ার পর বলল, “তুমি পারবে তো?”
সুজানা আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে বলল, “আমার নিজের ওপরে কনফিডেন্স আছে ভাইয়া। আপনাদের ভরসা থাকলেই আমি পারবো।”
মেয়েটার আত্মবিশ্বাস মুগ্ধ করলো অরাকে। সাধারণত নতুনদের মাঝে সবসময়ই আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি থাকে। অভিনয় শুরুর আগেই এরা দমে যায়।
রাহাত বলল, “তাহলে স্ক্রিপ্টের একটা দৃশ্যে তোমার অভিনয় দেখা যাক?”
এবারই হবে আসল অডিশন! এতক্ষণ ভিন্ন সিনেমার দৃশ্যে সুজানার অভিনয় দেখে তার অভিনয়ের দক্ষতা পরখ করে নেওয়া হচ্ছিল। এবার ‘দিগন্ত’র একটা দৃশ্যে তার অভিনয় দেখা হবে। এতেই বোঝা যাবে মেয়েটা এই সিনেমায় অভিনয়ের যোগ্য কিনা।
সুজানা আত্মবিশ্বাস নিয়ে আবারও আগের জায়গায় ফিরে গেল। একবার স্ক্রিপ্টের ওপর চোখ বুলাতেই সংলাপগুলো তার মুখস্ত হয়ে গেল। রাহাত “অ্যাকশন!” বলতেই শুরু হলো তার অভিনয়।
“আপনার কি আমাকে পাগল মনে হচ্ছে? আমি পাগল নই বিশ্বাস করুন। আমি চাই যে বাবা-মা আমাকে জন্ম দিয়েছে, তারা যেন জাস্টিস পায়। আমি খুন করেছি তাদের। নিজের হাতে খুন করেছি। এই যে দেখুন! আমার হাতে কাটা দাগ! বাবার পেটে ছুরি চালানোর সময় হাতটা কেটে দিয়েছিল। এখনো বিশ্বাস করছেন না আমাকে?”
সুজানার অভিনয়ে প্রাণ আছে। মনে হচ্ছে যেন তার জন্মই হয়েছে এই চরিত্রে অভিনয়ের জন্যে। এতটা নিখুঁত অভিনয়ের দক্ষতা এই ইন্ডাস্ট্রির অভিনেত্রীদের মধ্যে কমই আছে। অরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো মনিটরের দিকে। ‘দিগন্ত’ সিনেমায় সুজানার থেকে ভালো আর কেউ অভিনয় করতে পারবে না।
পরিচালকেরও সুজানাকে পছন্দ হলো। তবে এই মুহুর্তেই তাকে সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ করা যাবে না। তার আগে প্রয়োজন আরশাদের অনুমতির। সুপারস্টারদের সঙ্গে সিনেমা করার এই এক সমস্যা! সিনেমার প্রত্যেকটা চরিত্রে কে কে অভিনয় করছে তা এদের জানাতে হয়।
এই ব্যাপারটা সাধারণত কাস্টিং টিমই আরশাদকে জানিয়ে থাকে। তবে আজ যেহেতু অরা এখানে আছে, তাই সে নিজেই ফোনটা করলো।
আরশাদ আজও তার বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ে ব্যস্ত। কয়েকদিন পরে যেহেতু সিনেমার শুটিং শুরু হচ্ছে তাই বিজ্ঞাপনের কাজগুলো আগেভাগেই মিটিয়ে নিচ্ছে। যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন, অরার কল রিসিভ করে সে দেরি করে না বিন্দুমাত্র।
আরশাদ কল রিসিভ করতেই অরা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “তোমার নায়িকা পেয়ে গেছি।”
আরশাদ কিছুই বিস্ময় নিয়ে বলল, “তাই না-কি?”
“হুঁ, সুজানা।”
“ওই নতুন মেয়েটা?”
অরা প্রশংসার ভঙ্গিতে বলল, “হ্যাঁ। নতুন হলে কী হবে? অভিনয় দারুণ করে। আজ রাহাত ভাই আর আমি অডিশন নিলাম। একেবারে মানিয়ে গেছে ক্যারেক্টারের সাথে।”
আগে সহঅভিনেত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে আরশাদের বেশ কড়াকড়ি ছিল। আগে বলতে কে ফিল্মস প্রতিষ্ঠার আগে, যখন সে অন্যান্য প্রোডাকশন হাউজের ব্যানারে অভিনয় করতো। তবে কে ফিল্মসের প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই দায়িত্ব অরার হাতে দিয়ে এখন সে বেশ নিশ্চিন্ত।
আরশাদ বলল, “বাহ্! তাহলে তো ভালোই।”
অরা মজার ছলে বলল, “তোমার কোনো আপত্তি নেই তো? যেমন-তেমন নায়িকার সাথে তো আবার তুমি অভিনয় করো না।”
আরশাদের মাথায় হঠাৎ দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো। কণ্ঠে কিছুটা দুষ্টুমির রেশ রেখেই সে বলল, “তোমার পছন্দ হলে আমার আর কীসের আপত্তি থাকবে। তবে একটা শর্ত আছে।”
অরা অবাক গলায় বলল, “কী শর্ত?”
আরশাদ দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, “নায়িকা যেন ফ্লার্টিশিয়াস হয়। কতদিন কোনো মেয়ে ফ্লার্ট করে না আমার সাথে!”
আরশাদের এই দুষ্টুমিগুলো দারুণ উপভোগ করে অরা। মাঝে মাঝে যদিও রাগ লাগে।
অরা রাগী রাগী কণ্ঠে বলল, “তাই? খুব শখ না?”
অরাকে আরেকটু রাগিয়ে দেওয়ার জন্যে আরশাদ দুষ্টুমির ছলে বলল, “ভীষণ!”
অরা হুমকির সুরে বলল, “বাসায় আসো আজকে। দেখাচ্ছি ফ্লার্ট কাকে বলে!”
আরশাদ ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, “Can’t wait!”
অরা হেসে ফেলল। এই ছেলেটাকে নিয়ে আর পারা যায় না!
অরা ঠোঁটে হাসির রেশ রেখেই বলল, “রাখছি।”
আরশাদ হঠাৎ অন্যরকম স্বরে বলল, “Love you.”
এবার অরার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো। খুব তো এতক্ষণ তাকে রাগাচ্ছিল আরশাদ। এবার রাগানোর পালা অরার।
অরা হাসি হাসি কণ্ঠে বলল, “Good for you.”
আরশাদ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “তাই না? আচ্ছা, মনে থাকবে।”
আবারও হেসে ফেলল অরা। এই মানুষটা না থাকলে তার কী যে হতো!
অরা কোমল স্বরে বলল, “Love you too!”
আরশাদের সঙ্গে মিষ্টি কথোপকথন সেরে অরা চলে গেল তার কেবিনে। আজকাল নিয়মিত অফিসে আসা হচ্ছে না বলে প্রতিদিনই একরাশ পেপারওয়ার্ক জমছে। মাতৃত্বকালীন ছুটি নিলেও একেবারে অফিস ভুলে থাকতে পারছে না অরা। জরুরি কাজে প্রায়ই ছুটে আসে। এছাড়াও ঘরে বসে প্রায় প্রতিদিনই কয়েকবার অফিসে ফোন করে খবরাখবর নিচ্ছে সে। আরশাদ আসলেই ভাগ্যবান। নিজের কোম্পানির জন্যে এতটা দায়িত্বশীল সিইও আর কোথায় পেত সে?
কাজ করতে করতে পেটে তীব্র ব্যাথা অনুভব হলো অরার। বাবুর অসুবিধার কথা ভেবে আঁতকে উঠতেই তার খেয়াল হলো, বাবু নিজেই এই ব্যথার উৎস। পেটে হাত রাখলো অরা। আবারও অনুভূত হলো একই ব্যথা। বাবু লাথি দিচ্ছে। জীবনে এতটা মধুর ব্যথা আগে কখনো তো অনুভব হয়নি। চোখে জল এসে গেল অরার। অনুভূতিগুলো জমিয়ে রাখার ব্যবস্থা থাকলে ঠিক এই অনুভূতিটা জমিয়ে রাখতো অরা। সারাজীবন একইভাবে অনুভব করতো বারবার।
অফিসের সকল কাজ শেষ করতে করতে বেজে গেল বেলা সাড়ে চারটা। কথার গভর্নেন্স পায়েল ফোন এসেছিল একটু আগে। অরার যেহেতু একেবারেই ঘর থেকে বের হওয়া মানা, তাই কথাকে স্কুল থেকে তুলতে এখন পায়েলই যায়। কিছুক্ষণ আগে বাড়ি ফিরেছে তারা। আজ কথার স্কুলে বার্ষিক বিতর্ক প্রতিযোগিতা ছিল। তাই বাড়ি ফিরতে এতটা দেরি হয়ে গেল।
অরা নিচতলায় যাওয়ার জন্যে লিফটের বাটনে চাপ দিয়েছে, তখনই তার চোখে পড়লো সেদিনের ওই ফ্লোর বয়টায়কে। এই ছেলেটাকে এত পরিচিত কেন মনে হচ্ছে? আগে কি কোথায় দেখেছে তাকে অরা? কিন্তু কোথায়?
কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে অরা ডেকেই ফেলল এই ওয়ার্ড বয়কে, “এই দাঁড়াও!”
ছেলেটা চমকে উঠে তার দিকে ফিরে বলল, “আমি?”
“হ্যাঁ।”
ছেলেটা অরার দিকে এগিয়ে এসে ভদ্রভাবে বলল, “জে ম্যাডাম?”
অরা আন্তরিক ভঙ্গিতে বলল, “অফিসে নতুন এসেছো?”
ছেলেটা জড়োসড়ো হয়ে বলল, “জে ম্যাডাম। এক মাস হইলো চাকরি পাইসি।”
“অফিসে ভালো লাগছে?”
“জে ম্যাডাম। মেলা সুন্দর অফিস।”
“কেউ খারাপ আচরণ করেনি তো?”
“না, না ম্যাডাম! সবাই অনেক ভালো।”
অরার এই ব্যাপারটা মুগ্ধ করে অফিসের সবাইকে। অফিসে তার অবস্থান সকলের শীর্ষে হলেও সকল কর্মচারীর সঙ্গে অরার ব্যবহার অমায়িক। হাজার ব্যস্ততার মাঝেও আলাদাভাবে প্রত্যেকের খোঁজ রাখে সে।
অরা কৌতুহল নিয়ে বলল, “আচ্ছা তোমাকে কোথায় দেখেছি বলো তো?”
ছেলেটা অবাক হয়ে বলল, “আমারে আবার কই দেখবেন ম্যাডাম। অফিসেই দেখছেন।”
অরা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “না, না। অফিসের বাইরেও কোথাও দেখেছি। চেনা চেনা লাগছে তোমার মুখটা।”
ছেলেটা লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, “আপনার মতো বড় মানুষ, অফিসের বাইরে আমারে আর কই দেখবেন?”
“আরে ধুর! কী যে বলো। আচ্ছা যাও, তোমার কাজে যাও।”
ছেলেটা চলেই যাচ্ছিল। অরা কী যেন মনে করে আবারও ডাকলো তাকে, “আচ্ছা শোনো!”
“জে ম্যাডাম?”
“তোমার নামটাই তো জানা হলো না।”
ছেলেটা হেসে বলল, “আমার নাম মোবারক, ম্যাডাম।”
অরার গা বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। এক মোবারককে খুব ভালো করে চেনা আছে তার।
এই মোবারক কি সেই মোবারক? এ কারণেই এতটা চেনা চেনা লাগছিল তাকে? যার সঙ্গে জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছে অরা। যাকে মমতামাখা ভালোবাসায় মুড়ে রেখেছে একটা সময়ে? অরার বিশ্বাস হচ্ছে না।
অবিশ্বাস নিয়ে সে জিজ্ঞেস করলো, “কী নাম বললে?”
“মোবারক।”
অরার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। প্রকৃতি যে তাকে এই মুহূর্তের মুখোমুখি করবে, কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেনি।
অরা বিড়বিড় করে বলল, “হাফিজ মিয়ার ছেলে?”
মোবারক বিস্মিত ভঙ্গিতে বলল, “জে। আপনে আমার বাপজানরে চিনলেন কেমনে ম্যাডাম?”
অরা অস্পষ্ট গলায় বলল, “কারণ তিনি আমারও বাপজান।”
(চলবে)
#ফিরে_আসা২
৪২
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
নিজের কেবিনে সাদা রঙের বিশাল সোফার ওপরে বসে আছে অরা। বাড়িতে না গিয়ে আবারও কেবিনে ফিরে এসেছে সে। তার বিপরীতে থাকা কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বসে আছে মোবারক। যদিও তার চোখেমুখে বিস্ময়ের ছড়াছড়ি। কোন ছোটবেলায় তার হারিয়ে যাওয়া বুবু, সেই না-কি তার অফিসের বড় ম্যাডাম! তার বিশ্বাস হচ্ছে না। অরাও বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারছে না। কোনোদিনও ভাবতে পারেনি এ দিনটার মুখোমুখি হতে হবে তাকে। গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে আসার সময় অরা সেখানকার সকল স্মৃতি সকল টান ফেলে এসেছিল।
তার সামনে বসে থাকা এই ছেলেটি হয়তো তার আপন ভাই নয়। তবে ছোট থেকে নিজ হাতে তার যত্ন নিয়েছে অরা। তার দেখাশোনা করা, তাকে খাইয়ে দেওয়া, ব্যথা পেলে মলম লাগিয়ে দেওয়া। সার্বক্ষণিক তার তিন ভাইয়ের যত্নে কোনো ত্রুটি রাখেনি অরা। তার ওপর দিনরাত নির্মম অত্যাচার হতো ঠিকই। তবে এই বাচ্চাগুলোর ওপরে কোনোদিন কোনো রাগ পুষে রাখেনি অরা। কোনদিন তাদের ‘সৎ ভাই’ বলেও মনে করেনি।
মমতার চাদরে মুড়ে রেখেছিল অরা তার ভাইদের। তবে সময়ের ব্যবধানে সেই বন্ধন ভেঙে চুরমার। অরা আগের মতো তার ভাইকে তুইতুকারি করতে পারছে না। মোবারকও আগেরকার মতো তাকে “বুবু” ডাকতে পারছে না।
মোবারক আমতা আমতা করে বলল, “আপনে চইলা যাওনের পর গেরামের মানুষজন সারাদিন খুঁজছে। গেরামের মধ্যে না পাইয়া পাশের গেরামে গেছে। কোত্থাও পাইলো না আপনেরে। আপনে কি ঢাকায় আইসা গেছিলেন?”
অরা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, “হুঁ। মলিনা খালা আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসে।”
অরার সেই পুরোনো বান্ধবীর মা মলিনা বেগম। যার বাড়িতে থেকে অরা এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। যে মানুষটি না থাকলে কোনোদিনও এই সুন্দর জীবনের স্বাদ সে পেত না।
মোবারক ভয়ে ভয়ে বলল, “ঢাকায় কই আসিলেন?”
“একটা এতিমখানায়।”
মোবারক কী যেন ভেবে বলল, “ভালোই করছেন। বাপজানে কইছিল, এইবার আপনেরে খুঁইজা পাইলে আর বিয়া দিবে না। একেবারে মাইরাই ফেলবে।”
অরার মনের মাঝে এক উত্তাল স্রোত বয়ে গেল। প্রত্যেকটা মানুষের কথা বলার আলাদা একটা ধরন থাকে। এই কথার ধরনটা যে তার বাবার, বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না অরার।
মোবারক নিচু গলায় বলল, “সোবহানউদ্দিন যেই শুনলো আপনেরে পাওয়া যাইতেছে না, সেই বাপজানের নামে বিচার বসাইলো চেয়ারম্যানের কাছে। চেয়ারম্যানে আমগো সবাইরে গেরাম থেইকা বাইর করা দেয়।”
সোবহানউদ্দিন, পাশের গ্রামের ষাট বছর বয়সী ধনী ব্যক্তি। এই লোকটার লোভী দৃষ্টি পড়েছিল অরার ওপরে। হাফিজ মিয়াকে একগাদা টাকা দিয়ে তার অরাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল সে।
অরা ক্ষীণ স্বরে বলল, “কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?”
“ফুলমুরি, দুই গেরাম পরে। আমগো বাড়িটা চেয়ারম্যান দখল কইরা নেয়। ওইটা বেইচ্চা যে কয়টা টাকা পামু, তারও পথ নাই। ফুলমুরিতে বাপজান আবারও জুতা সিলাইয়ের। মায় মাইনসের বাড়ি বাড়ি কাম করে। কেলাস এইটের পর আমিও আর পড়ি নাই। গাড়ি সারানোর দোকানে কাম নিসি।”
অরা ভারী কণ্ঠে বলল, “অনেক কষ্টে ফেলে দিয়েছিলাম না তোমাদের?”
মোবারক সামান্য হেসে বলল, “হ। তয় বাপজান আর মায় মিল্লা আপনেরে যে কষ্ট
দিসে, তার কাছে এই কষ্ট কিছুই না।”
নিজের ভেতরকার অনুভুতিগুলো নিজের সাথেই আজ লুকোচুরি খেলছে। অরা বুঝতে পারছে না তার কেমন অনুভব হচ্ছে! এত বছর পর ভাইকে ফিরে পাওয়ার পর আনন্দ হচ্ছে, না-কি তাদের বিপদে ফেলে দেওয়ায় অপরাধবোধ হচ্ছে? অরা কিছুই বুঝতে পারছে না।
অরা চাপা স্বরে বলল, “আমার আর কোনো উপায় ছিল না মোবারক। ছোটবেলা থেকে তাদের অত্যাচার সহ্য করে বড় হয়েছি। আরও সহ্য করতাম। পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা কখনো আমার মাথাতেই আসেনি। কিন্তু যেই না ওই লোকটার সাথে বাবা আমার বিয়ে ঠিক করলো, আমার মনে হলো অনেক হয়েছে! আর সহ্য করার কোনো মানে হয় না। তাদের কথা চিন্তা করিনি। তারাও তো কখনো আমার কথা চিন্তা করেনি।”
“ভালো করছেন। তখন তো বুঝতাম না, এখন বুঝি। আপনের জায়গায় থাকলে আমিও একই কাজ করতাম।”
অরা হঠাৎ কী যেন মনে করে জিজ্ঞেস করলো, “বাবা মারা গেল কীভাবে?”
মোবারক হালকা স্বরে বলল, “কী জানি হইছিল। একদিন কাম সাইরা বাড়ি ফিরত আইসা বিছানায় পড়লো। শইল জ্বালাপোড়া করে, মাথায় ব্যদনা। কয় দিন বিছানায় পইড়া থাইকাই মইরা গেল।”
ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো অরা। ওই পরিবার কখনোই আপন করে নেয়নি তাকে। পদে পদে অত্যাচারে জর্জরিত করে রেখেছিল তার তাকে। ওই পরিবারের প্রতি সমস্ত টান বহু আগেই ত্যাগ করেছে সে। তবুও কেন তাদের কষ্টে খারাপ লাগা কাজ করছে অরার মধ্যে।
মোবারক আনমনে বলল, “চেয়ারম্যানের পায়ে ধইরা নিজেগো গেরামে মাটি দিতে পারছিলাম বাপজনরে।”
ঢাকায় এসে আরশাদের ম্যানেজার হিসেবে চাকরি পাওয়ার পর থেকেই বেশ সচ্ছল অবস্থায় ছিল অরা। তবুও কোনোদিন মাথায় আসেনি পরিবারের খোঁজ নেওয়ার। পরিবার বলতে বাবার খোঁজ নেওয়ার। আসবেই বা কী করে? তার প্রতি হওয়া অন্যায়গুলো যে আজও দুঃস্বপ্ন হয়ে ভেসে আসে!
অরা আর্দ্র কণ্ঠে বলল, “অনেক স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম না? এখানে আমি নিজে ভালো ছিলাম, অথচ তোমরা কতটা কষ্টে ছিলে। তোমাদের পাশে দাঁড়ানোর চিন্তাও করিনি। তোমাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করিনি।”
মোবারক জোর গলায় বলল, “আপনের পাশে কে আছিল? আমার মা না বাপজান? মায় তো প্রত্যেক দিন আপনারে মরণের ঘর দেখায় আনতো। আর বাপজানে কোনদিন আপনেরে নিজের সন্তানের জায়গা দিসে? এরার পাশে দাঁড়াবেন আপনে?”
অরা উত্তর দিলো না মোবারকের প্রশ্নের। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, “তোমরা ঢাকায় এলে কবে?”
“দুই-তিন বৎসর হইলো। বাপজান মরার পর থেইকা বাড়তি আয়ের লইয়া একসাথে অনেকগুলা কাম করতাম। তাও সুবিধা করতে পারি নাই। ঢাকায় আইসা এতদিন এক হোটেলে বাবুর্চির এসিস্ট্যান্টের কাম করছি।”
অরার হঠাৎ মনে পড়লো তার আরও দুই ভাইয়ের কথা। একজন মোবারক থেকে কয়েক বছরের ছোট। আরেকজন তো একেবারেই ছোট!
অরা কৌতুহল নিয়ে বলল, “সোলেমান, জাহান – ওরা কেমন আছে?”
“কেউই লেখাপড়া করতে পারে নাই। সোলেমান গার্মেন্টে কাম পাইছে। আর জাহান একটা জুতার ফ্যাক্টরিতে।”
অরা অবাক গলায় বলল, “কিন্তু জাহান তো অনেক ছোট। কত বয়স হবে এখন ওর? দশ-বারো? অতটুকু একটা বাচ্চা আজ করে?”
“কী আর করা? সংসার তো চালাইতে হইবো। পড়ালেখা করাইতে চাইছিলাম, তয় ঢাকা শহরের স্কুলের বেতন দিতে গেলে আর সংসার চালানো লাগবো না।”
অরার বুকটা ধ্বক করে কেঁপে উঠলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো ফেলে আসা দিনগুলোর ঝলক। জাহানের বয়স তখন কয়েক মাস হবে। অরাকে সামনে পেলেই খপ করে তার একটা আঙুল পুরে ফেলতো তার ছোট্ট হাতের মুঠোয়। অরা ওড়না দিয়ে নিজের মুখটা আড়াল করলে জাহান অবাক হয়ে খুঁজে বেড়াতো চারিদিকে। ওড়নার বাইরে বেরিয়ে আসতেই খিলখিল করে হেসে উঠলো। সেই ছেলেটা না-কি আজ ফ্যাক্টরিতে কাজ করে!
চোখে জল চলে আসছে রীতিমত। অরা বহুকষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “কোথায় থাকো এখন তোমরা?”
“মিরপুরের বস্তিতে। ওইখানে ছোট্ট একটা ঘর ভাড়া কইরা আমরা চাইরজন থাকি।”
অফিস থেকে বেরিয়ে এলো অরা। ভাইয়ের সঙ্গে পুনর্মিলন খুব একটা সুখকর হলো না। সিনেমার মতো কেউ একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো না, অরা ভাইকে সঙ্গে করে নিয়ে এলো না সারাজীবন নিজের কাছে রাখবে বলে। নিজের গন্তব্যে বেরিয়ে পড়লো অরা। মোবারকও হয়তো ডিউটি শেষে বেরিয়ে পড়বে তার নিজস্ব গন্তব্যে।
মোবারক, সোলেমান, জাহান – কেউই তার আপন ভাই নয়। তাদের প্রতি সুতীব্র টান থাকার কথাও নয়। তবুও খারাপ লাগছে অরার। ছোট থেকে নিজের হাতে যত্ন নিয়েছে এদের। সবসময় এদের পাশে ছিল সে। আজ তাদের এই দুর্দিন আসলেই ভাবাচ্ছে অরাকে।
বাড়ি ফিরতেই ব্যস্ত হয়ে গেল অরা। মোবারকের সঙ্গে সাক্ষাতের ঘটনা কিছুক্ষণের জন্যে তার মাথা থেকেই চলে গেল। কথার আজ প্রচন্ড মেজাজ খারাপ। আজ তার স্কুলে ছিল বার্ষিক বিতর্ক প্রতিযোগিতা। কথা বরাবরই চমৎকার বিতর্ক করে। এই প্রতিযোগিতার বিজয়ী সে ছাড়া অন্য কেউ হওয়ার সাধ্য নেই। অথচ টানা দুইবারের বিজয়ীকে না-কি বিতর্কের মাঝেই ডিসকোয়ালিফাই করে দেওয়া হয়েছে।
আজ বিতর্ক চলছিল ‘মোবাইল – অপকারী না উপকারী?’ এই বিষয়ের ওপর। একদল মোবাইলের পক্ষ নিয়ে কথা বলবে, আরেকদল বিপক্ষে। কথা মোবাইলের পক্ষ নিয়ে কথা বলবে। বেশ সুন্দর করে নিজের বক্তব্য পেশ করে সে। আর অপরপক্ষে থাকা ছেলেটা উঠে দাঁড়িয়েই বলে, “মাননীয় বিচারকমন্ডলী, মোবাইল যে কতটা ক্ষতিকর তা বোঝার জন্যে আমার অপরপক্ষে থাকা বন্ধুটিই যথেষ্ট। সে আগে প্রত্যেকটা গণিত পরীক্ষায় একশতে একশ পেত, আর এখন পাচ্ছে আশির নিচে। শুধুমাত্র মোবাইলের ব্যবহার বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে। এরকম আরও হাজারো উদাহরণ…”
বক্তব্য আর শেষ করতে পারেনি ছেলেটা। তার আগেই কথা উঠে এসে দুহাতে তার চুল টেনে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে তাসমিয়া হক কথা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা থেকে ডিসকোয়ালিফাইড।
অরা ভেবে পাচ্ছে না হাসবে না-কি কাঁদবে। এত শান্ত-শিষ্ট একটা মেয়ে কিনা শেষমেশ মাঝ প্রতিযোগিতায় এক ছেলের চুল টেনে ধরলো? অবিকল বাবার রাগটা পেয়েছে কথা। হয় একেবারেই রাগ করবে না, না হলে রেগে গেলে একেবারে ধ্বংসযজ্ঞ বাঁধিয়ে দেবে।
অরা হাসি চেপে রেখে বলল, “তোর কিন্তু মাম্মাম ছেলেটার চুল টেনে ধরা উচিত হয়নি।”
কথা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, “ও আমাকে সবার সামনে ইনসাল্ট করলো কেন?”
“তুইও না হয় পরে ইনসাল্ট করতি। তাই বলে চুল টানবি?”
কথা ভ্রু কুঁচকে বলল, “ধুর অরা! তুমি কিছুই বোঝো না। বাবা আসলে আমি বাবার কাছে বিচার দিবো!”
কথা উঠে চলে গেল তার ঘরে। আনমনে হেসে উঠলো অরা। মেয়েটা দিন দিন একটু একটু করে বড় হয়ে যাচ্ছে। অরার মনটা এখন হালকা লাগছে। আগে সেই ভারটা আপাতত অনুভব হচ্ছে না।
ঘরে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে বসে রইলো অরা। আজকাল বই পড়ার মতো ধৈর্য পেয়ে ওঠে না। দুয়েক পৃষ্ঠা পড়তেই ক্লান্তিতে গা ভেঙে আসে। তবুও একটা বই নিয়ে বসলো অরা। সত্যজিৎ রায়ের ‘গল্প ১০১’। প্রথম গল্পের নাম ‘পুরষ্কার’ – এটাই দিয়েই শুরু করলো অরা।
কয়েক মিনিট পর তার কানে ভেসে এলো অতি পরিচিত মোহনীয় এক কণ্ঠস্বর। আরশাদের কণ্ঠস্বর। আরশাদ বাড়ি ফিরেছে তাহলে? নিচে এক স্টাফের সঙ্গে কী নিয়ে যেন কথা বলছে। ঘড়ির দিকে তাকালো অরা। মোটে সাতটা চুয়ান্ন। শুটিং থাকলে আরশাদ গভীর রাত করে বাড়ি ফেরে। দুয়েকদিন আগে আগে শুটিং শেষ হয়ে যায়, যেমন আজ।
উৎফুল্ল ভঙ্গিতে অরা বইটা বন্ধ করে বিছানা থেকে নামতে যাবে, তখনই ঘরে প্রবেশ করলো আরশাদ। অরার দিকে নিঃশব্দে নিক্ষেপ করলো তার মায়াময় হাসিটা। অরা জমে রইলো বিছানায়। এই মানুষটা অগণিতবার দুচোখ ভরে দেখেছে সে। তবু আজও দেখলে বুকের ভেতরটায় তোলপাড় শুরু হয়।
আরশাদ তার লেদার ব্যাকপ্যাক ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে দুষ্টুমিমাখা কণ্ঠে বলল, “Hi gorgeous!”
অরা পাল্টা উত্তর দিয়ে বলল, “Hi handsome!”
আরশাদ ছোট ছোট পা ফেলে বিছানায় অরার সামনে এসে বসলো। অরার কানের নিচে হাত রেখে গাঢ় চুমু খেল তার কপালে। শিরশির করে কেঁপে উঠলো অরা। এই চেনা স্পর্শ প্রত্যেকবার তার ভেতরে বিচিত্র এক তুফানে সৃষ্টি করে।
আরশাদ আচমকা অরার জামাটা পেটের ওপর থেকে তুলে অনবরত কতগুলো চুমু খেয়ে গেল তার স্ফীত পেটে।
অরা কম্পিত স্বরে বলল, “আমাকে একটা, আর বাবুকে এতগুলো?”
সঙ্গে সঙ্গে অরার মনে হলো প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি। এই একটা প্রশ্ন নিয়ে আরশাদ লজ্জা দিয়ে মারবে তাকে!
আরশাদ অরার পেট থেকে মুখ তুলে বাঁকা হাসি হেসে বলল, “কেন তুমি জেলাস?”
অরা লজ্জা পেয়ে বলল, “আরে না! আমি তো শুধু বলছিলাম তুমি কীভাবে ডিসক্রিমিনেশন করো!”
আরশাদ দুষ্টুমির স্বরে বলল, “সরাসরি বললেই তো পারো তোমারও অতগুলো লাগবে।”
অরা লজ্জায় লাল হয়ে বলল, “মোটেই না।”
আরশাদ গাঢ় স্বরে বলল, “না লাগলে কী হবে? এখন তো তোমাকে পেতেই হবে।”
আরশাদ আবারও তার কানের নিচে হাত রেখে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো তার ঠোঁটে। ব্যস্ততা, ক্লান্তি আর বিষাদে ভরা দিনটা নিমিষেই আলোকিত হয়ে উঠলো। অরা একটু একটু করে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। এ জগতে যেন তার বসবাস নয়, সে ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। যে জগতে কেবলই ভালোবাসার ছড়াছড়ি।
দুজনে কতক্ষণ এভাবে রইলো তার হিসাব নেই কারো কাছেই। অনেকটা সময় পর আরশাদ ছাড়লো অরাকে। লজ্জা কাটিয়ে উঠতে আরও কিছুটা সময় লাগলো অরার।
অবশেষে বলল, “আগে আগে এসেছো ভালোই হয়েছে। কথার তোমাকে দরকার।’
আরশাদ চিন্তিত স্বরে বলল, “কেন? কী হয়েছে?”
“তেমন সিরিয়াস কিছু না, আবার অনেকটাই সিরিয়াস।”
“মানে?”
“মেয়ের কাছে যাও, নিজেই বুঝতে পারবে।”
আরশাদ ফ্রেশ হয়ে কথাকে কোলে নিয়ে বসার ঘর জুড়ে পায়চারি করছে আর তার অভিযোগগুলো শুনছে। অরা বসে রয়েছে বসার ঘরের সোফায়। হঠাৎ করে আবারও মনে পড়লো মোবারকের সঙ্গে তার হওয়া পুনর্মিলনের ঘটনা। আবারও থমথমে পরিবেশের সৃষ্টি হলো মনে। তাদের সাথে যা হয়েছে তাতে অরার কি আদৌ কোনো দোষ আছে? চিন্তায় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে।
কথার কথা শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে আরশাদের চোখ পড়লো অরার ওপরে। এক দেখাতেই বুঝে ফেলল কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত সে।
আরশাদ নরম স্বরে ডাকলো, “অরা?”
অরা সংবিৎ ফিরে পেয়ে চোখ তুলে তাকালো আরশাদের দিকে। অস্পষ্ট স্বরে বলল, “হুঁ?”
“মন খারাপ?”
অরা হেসে বলল, “কই না তো!”
“তাহলে কী হয়েছে?”
“কিছু না।”
অরা মুখে “কিছু না” বললেও আরশাদ ঠিকই বুঝে ফেলল কিছু একটা ঠিকই ভাবাচ্ছে তাকে। এখন অরাকে আর প্রশ্ন করলো না আরশাদ। আগে কথার সমস্যার সমাধান করতে হবে।
কথার সঙ্গে দীর্ঘ কথোপকথন শেষে আরশাদ তাকে বুঝিয়ে বলতে সক্ষম হলো, যে দোষ কথারও নেহায়েত কম ছিল না। এবং আগামীকাল তাকে ওই ছেলেটাকে সরি বলতে হবে। এবং সেই সাথে আসলেই মোবাইলে গেম খেলা কমিয়ে আবারও অংকে একশতে একশ আনতে হবে। বাবা ভক্ত মেয়ে বটে কথা! বাবার সব কথা বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিলো।
তিনজন একসাথে ডিনার করে, আরশাদ কথাকে ঘুম পাড়িয়ে এলো। এতক্ষণে অরাও ব্ল্যাঙ্কেট টেনে শুয়ে পড়েছে। আরশাদ ঘরে এসে বাতিগুলো সব নিভিয়ে ব্ল্যাঙ্কেটের ভেতর ঢুকে পড়লো। অরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে টেনে তার মাথাটা রাখলো নিজের বুকের ওপরে।
কয়েক মুহূর্ত প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলল অরা। আরশাদ তার চিন্তার কারণ জিজ্ঞেস করতে যাবে, তার আগে অরা নিজেই বলল, “আজ আমার সাথে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটেছে জানো?”
আরশাদ কৌতুহল নিয়ে বলল, “কী হয়েছে?”
“আমি একজনকে খুঁজে পেয়েছি।”
“কাকে?”
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে অরা বলল, “আমার ভাই, মোবারককে।”
আরশাদ বিস্মিত গলায় বলল, “এত বছর পর? কোথায় পেলে?”
অরা ক্ষীণ স্বরে বলল, “আমাদের অফিসেই। ফ্লোর বয় হিসেবে কাজ করছিল। আগে থেকেই চেনা চেনা লাগছিল। মানুষ যতই বড় হয়ে যাক না কেন, ছোটবেলার একটা ছাপ তো ঠিকই রয়ে যায় তার মধ্যে। আমাকে দেখে চিনতে পারেনি। আমিও চিনিনি, মুখটাই দেখা দেখা মনে হচ্ছিল। নামটা জানার পর নিশ্চিত হলাম।”
আরশাদ অরার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “অরা? তুমি ঠিক আছো তো?”
“হ্যাঁ। আসলে কখনো ভাবিনি তো ওর সঙ্গে আবারও দেখা হয়ে যাবে, তাই কিছুটা শকড।”
“তোমার পরিচয় দিয়েছো?”
“হুঁ, দিয়েছি। আরশাদ জানো, নিজের সম্পর্কে একটা উপলব্ধি আজ করলাম।”
“কী?”
অরা গম্ভীর গলায় বলল, “আমি কখনো ওই পরিবারটাকে নিয়ে ভাবিনি। এক মুহূর্তের জন্যেও না। ঢাকায় পালিয়ে আসার সময় ওই পরিবারের প্রতি সমস্ত টান ফেলে এসেছি। ঢাকায় তো আমি মোটামুটি ভালোই ছিলাম। তোমার ম্যানেজার হিসেবে চাকরি পাওয়ার পর তো আরও ভালো ছিলাম। ভালো থাকার মাঝে কখনো আমার মাথায় আসেনি, ওরা কেমন আছে। কোনো বিপদে পড়েছে কিনা!”
“সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? তোমার ভালো থাকার কথা কোনোদিন চিন্তা করেছিল তারা? ছোটবেলা থেকে ঢাকায় আসার আগ পর্যন্ত একটা দিনও শান্তিতে কাটিয়েছিলে তুমি? তাদের অত্যাচার তোমার মনে চিরস্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি করেছে।”
“জানি। সেজন্যেই হয়তো কখনো ভাবিনি তাদের নিয়ে।”
আরশাদ ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “কী বলল আজ তোমাকে? তুমি চলে আসার পর কষ্টে ছিল তারা?”
“হ্যাঁ। গ্রামে যা হয় আর কি! আমি পালিয়ে গেলাম, বাবাকে গ্রাম থেকে বের করে দিলো। পাশের গ্রামেও ভালো কোনো কাজ পেলো না। চিকিৎসার অভাবে মারা গেল।”
“আর সেজন্য তুমি অপরাধবোধে ভুগছো। তাই না?”
“তুমি বুঝলে কীভাবে?”
আরশাদ হেসে বলল, “অরা আমি তোমাকে তোমার থেকেও ভালো করে চিনি। তোমার মতো ভালো মনের মানুষ, খুব কম আছে পৃথিবীতে।”
অরা বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে বলল, “অপরাধবোধ ঠিক না। তোমার কথাটাও সত্যি। আমার বাবা কোনোদিনও আমার পাশে দাঁড়ায়নি। দিনের পর দিন আমার ওপর অত্যাচার করা হতো, সে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতো। ওই সময়টায় তার জন্যে কিছু করার মানসিকতাও ছিল না। কিন্তু এখন…”
“এখন কী?”
“দেখো আমি কখনোই আমার ভাইদের বিপদে ফেলতে চাইনি। আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম বলে ওদেরকেও তো অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।”
“নিজেকে দোষ দেওয়াটা বন্ধ করো অরা। তোমার কারণে ওদের কষ্ট করতে হয়নি, কষ্ট করতে হয়েছে ওদের বাবার লোভের কারণে।”
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই আরশাদের মনে হলো, মানুষটা অরার ওপরে যতই অবিচার করে থাকুক না কেন সে এখন মৃত। তাই শুকনো গলায় বলল, “Sorry to say.”
অরা চিন্তার স্বরে বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু কষ্ট তো করতে হয়েছেই। আমি যখন শেষ বারের মতো ওদের দেখেছিলাম, তখন তিনজনই ছোট ছোট। মোবারক থ্রি-ফোরে পড়ে, সোলেমান কেবল স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। আর জাহানের বয়স তো কয়েক মাস মাত্র। ওইটুকু একটা বাচ্চাও না-কি এখন ফ্যাক্টরিতে কাজ করে।”
“অরা, তোমাকে বুঝতে হবে যা হয়েছে তাতে তোমার কোনো দোষ নেই।”
“বুঝতে পারছি। আমি শুধু চাচ্ছি এই তিনজনের পাশে দাঁড়াতে। অপরাধবোধ থেকে না, দায়িত্ববোধ থেকে। পৃথিবীতে তাদের একটা বোন এত ভালোভাবে বেঁচে থাকবে আর তারা এত কষ্টের মধ্যে জীবন যাপন করবে?”
আরশাদ অন্যরকম স্বরে বলল, “অরা তুমি জানো তো, ওদের হেল্প করলে সেই হেল্পটা ওদের মায়ের ওপরেও গিয়ে পড়বে।”
অরা থমথমে মুখে বলল, “ওই ভদ্রমহিলার জন্যে আমি কিছুই করতে চাই না। শুধু এই তিনজনের জন্যে ভালো একটা ব্যবস্থা করতে চাই। এই তিনজন যদি ভালো অবস্থানে পৌঁছে তাদের মায়ের সাহায্য করতে চায়, সেটা তাদের ব্যাপার।”
অরার এই চিন্তা মুগ্ধ করলো আরশাদকে। ওই পরিবার মেয়েটাকে কষ্ট ছাড়া আর কিছুই দেয়নি। তবুও তাদের পাশে দাঁড়াতে চাচ্ছে অরা।
আরশাদ অরার কপালে চুমু খেয়ে বলল, “I’m so proud of you!”
(চলবে)