#ফিরে_আসা২
৬১+৬২
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
শাফকাত আলমের ধ্বংসের চিত্রনাট্য আরশাদ নিজ হাতেই লিখলো। মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে পরপর এতগুলো ঘটনা ঘটে গেল যে, দেশের নিউজ মিডিয়ার সাংবাদিকদের তা কভার করতে রীতিমত ঘাম ছুটে গেল।
টাকা ছড়ালে অভাবী মানুষের অভাব হয় না। শাফকাতও টাকা দিয়ে সুজানা এবং মাহমুদ – এই দুই অভাবীকে কিনে নিয়েছিল। আরশাদ একটু খোঁজ করতেই পেয়ে গেল আরেক অভাবীর সন্ধান। সিনেব্লাস্ট মিডিয়ার প্রাক্তন ম্যানেজিং ডিরেক্টর রবিউলকে। মাস ছয়েক আগে তার চাকরি চলে যায়। চাকরি হারানোর কারণ আরশাদ জানে না, জানার কোনো ইচ্ছাও নেই। চাকরি যেহেতু হারিয়েছে সুতরাং সিনেব্লাস্টের ওপর স্বাভাবিকভাবেই তার ক্ষোভ রয়েছে। ক্ষোভটাকে কাজে লাগানোর সুযোগ হাতছাড়া করলো না আরশাদ রবিউলকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে বলা হলো সিনেব্লাস্টের সকল অনিয়ম তুলে ধরে একটা ভিডিও তৈরি করতে।
আরশাদ এবং শাফকাতের মধ্যে সবথেকে বড় যে পার্থক্য সেটা হলো, শাফকাত টাকা ছড়িয়ে নোংরা ষড়যন্ত্র করেছে আরশাদের বিরুদ্ধে। সুজানাকে দিয়ে মিথ্যা ছবি বানিয়ে তা ভাইরাল করেছে ইন্টারনেটে। মানুষকে ভাবতে বাধ্য করেছে – আরশাদ চরিত্রহীন। আরশাদ টাকা ছড়িয়ে কেবলমাত্র যা সত্যি, তাই সকলের সামনে আনার চেষ্টা করছে। রবিউলকে তার ম্যানেজার অয়ন কড়াকড়িভাবে বলে দিয়েছে, যা সত্যি ভিডিওতে যেন তাই বলে সে। একবিন্দুও মিথ্যা যোগ করার প্রয়োজন নেই।
৮ মিনিট ২১ সেকেন্ডের ভিডিওতে রবিউল সিনেব্লাস্টের সমস্ত কুকীর্তি সামনে নিয়ে এলো। সিনেব্লাস্টে নতুন নায়িকাদের বড় বাজেটের সিনেমায় সুযোগ দেওয়ার নাম করে ডেকে আনা হয়। এরপর তাদেরকে পাঠানো হয় বিদেশি প্রযোজকদের কাছে। সিনেব্লাস্ট কয়েক বছর ধরে মূলত টিকেই আছে যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত সিনেমার ওপরে। বিদেশি প্রযোজকদের খুশি করার জন্যে তাই এসব নায়িকাদের ব্যবহার করা হয়। বেশির ভাগ নায়িকারই এতে মত থাকে না। তখন শুরু হয় নানাপ্রকার ব্ল্যাক-মেইল।
এছাড়াও সিনেব্লাস্ট মিডিয়ার ব্যানারে নির্মিত বেশির ভাগ সিনেমাতেই পর্দার পেছনে যারা কাজ করে তাদের টাকা দেওয়া হয় না। লাইট, ক্যামেরা, প্রোডাকশন – একটা সিনেমায় বিভিন্ন বিভাগে অনেক অনেক মানুষকে কাজ করতে হয়। সিনেমার কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও এসব মানুষদের দেওয়া হয় না প্রাপ্য টাকা। টাকা চাইতে এলে, ক্ষমতার গরম দেখিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।
এমনিতেই গত রাত থেকে সুজানার ওই নকল ছবি এবং আজ সকালে সীমার সত্যি উদঘাটনের পোস্টে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরগরম, তার ওপরে রবিউলের এই ভিডিওটাও ভাইরাল হতে খুব বেশি একটা সময় লাগলো না। সিনেব্লাস্টের সিনেমা আজকাল তেমন একটা সফলতার মুখ না দেখলেও একটা সুনাম তাদের আছে। এক কালে ব্যবসাসফল সিনেমা নির্মাণ করার জন্যেই সিনেমাপ্রেমীরা এখনো মনে রেখেছে তাদের। এমন একটা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এত বড় অভিযোগ মোটেও সহজভাবে নিতে পারছে না কেউই।
রবিউলের ভিডিও ফেসবুকে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ার কারণেই হয়তো পুলিশের ওপর একপ্রকার চাপ পড়লো। উত্তরা থানা থেকে ততক্ষণে একটি জিপভর্তি পুলিশ ফোর্স পৌঁছে গেল সিনেব্লাস্ট মিডিয়ার অফিসে। অফিসের সামনে উৎসুক জনতার ভীড়। ভীড় ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই কাজ শুরু করে দিলো পুলিশ।
প্রাথমিক তদন্তে উঠে এলো রবিউলের প্রথম অভিযোগটা সত্যি। অফিসের তৃতীয় তলায় একটি ড্রয়ার ভরে আছে বিভিন্ন হার্ডড্রাইভে। হার্ডড্রাইভগুলো ওপেন করতেই পাওয়া গেল সেসব নতুন নায়িকাদের সঙ্গে বিদেশি প্রযোজকদের ঘনিষ্ট ভিডিও। এসব ভিডিও দিয়েই পরবর্তীতে নায়িকাদের ব্ল্যাকমেইল করা হতো।
ব্ল্যাকমেইলের সত্যতাও মিলেছে। অফিসের একটা কম্পিউটার থেকেও বিভিন্ন ইমেইল আইডির মাধ্যমে তাদের ব্ল্যাকমেইল করা হয়।
ওদিকে যাদেরকে অন্যায়ভাবে প্রাপ্য টাকা থেকে বঞ্চিত করা হয়, তারাও এসে ভীড় জমিয়েছে অফিসের নিচতলায়।
এদিকে পুলিশের তদন্ত শেষ হতে না হতেই ওদিকে আরেকটা ভিডিওতে সরগরম হয়ে উঠলো ফেসবুক। আজ সকালে সাইবার ক্রাইম মামলায় পুলিশ গ্রেফতার করেছে সুজানা এবং মাহমুদকে। সুজানা যেহেতু ওই নকল ছবিগুলো পোস্ট করে জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে, তার গ্রেফতার হওয়াটাই স্বাভাবিক। ওদিকে মাহমুদ ভিডিওগুলো এডিট করেছে বলে গ্রেফতার করা হয়েছে তাকে।
থানার অভ্যন্তরেই চলে সুজানার প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ। এক বাক্যে সে স্বীকার করো নেয়, সবকিছুই ছিল সাজানো নাটক। সিনেব্লাস্ট থেকে তাকে মোটা অংকের টাকা দেওয়া হয় আরশাদ হকের ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেওয়ার জন্যে। প্ল্যানের অংশ হিসেবেই ‘দিগন্ত’ সিনেমায় অভিনয় করার জন্যে অডিশন দেয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের এই ভিডিও আরশাদের নির্দেশেই গোপনে মোবাইলে ধারণ করে থানার এক কনস্টিবেল। গোপনে ধারণ করা হয়েছে বলে সুজানার মুখ দেখা যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ পর পর দুয়েক সেকেন্ডের জন্যে দেখা মিলছে তার। তবে কণ্ঠস্বর শুনে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, কথাগুলো সুজানার।
সুজানার এই ভিডিও রীতিমত শোরগোল ফেলে দিয়েছে ফেসবুকজুড়ে। মানুষ দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে শুরু করেছে। আজ সকালেই সিনেব্লাস্টের নামে এতগুলো অভিযোগ এলো, তার ওপরে এই মেয়েটাও বলছে এই সমস্ত ষড়যন্ত্রের পেছনে সিনেব্লাস্টের ভূমিকাই মুখ্য। দেশের এক কালের সবথেকে বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নোংরামি অচিরেই চলে এলো সকলের সামনে।
গ্রুপে গ্রুপে লেখালেখি হচ্ছে সিনেব্লাস্টের অপকর্ম নিয়ে। মানুষ কয়েক বছর আগের নিউজ আর্টিকেল খুঁজে বের করে পোস্ট করছে। আরশাদের সঙ্গে সিনেব্লাস্টের দ্বন্দ্বের ঘটনা এসেছিল গণমাধ্যমে। সেই নিউজ আর্টিকেল থেকে মানুষের বুঝতে বাকি নেই কেন দেশের সবথেকে বড় সুপারস্টারকে সুকৌশলে ফাঁসানোর চেষ্টা করলো সিনেব্লাস্ট।
অফিসে এত এত প্রমাণ, সুজানার জবানবন্দি – এতকিছু থাকা সত্ত্বেও শাফকাত আলমের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া গেল না। সিনেব্লাস্ট মিডিয়ার চেয়ারম্যান পদ থেকে বছর খানেক হলো সরে দাঁড়িয়েছে সে। এই প্রতিষ্ঠানে তার বিনিয়োগকৃত অর্থ আছে, কিন্তু তার কোনো ভূমিকা নেই।
গ্রেফতার করা হলো সিনেব্লাস্ট মিডিয়ার সিইও রাশেদ জামানসহ আরও সাত কর্মকর্তাকে। সিলগালা করে দেওয়া হলো সিনেব্লাস্টের অফিস।
শাফকাত সুপরিকল্পিতভাবে আরশাদের ক্যারিয়ার শেষ করে দেওয়ার খেলায় মেতেছিল। চেয়েছিল তার ইমেজ নষ্ট করে দেশের সকলের ঘৃণার পাত্র বানাতে তাকে। অথচ তার নিজের ইমেজই এখন সংকটের মুখে। যে সিনেব্লাস্ট মিডিয়ার মাধ্যমে সিনেপাড়ায় একটু খ্যাতি সে লাভ করেছিল, তাও এখন ধুলিস্যাৎ!
তবে শাফকাতের ইমেজ নষ্ট করেই কেবল ক্ষান্ত হওয়ার পাত্র নয় আরশাদ। শাফকাতকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে এই খেলায় নেমেছে সে। ধ্বংস করে তবেই দম নেবে।
কে ফিল্মসের অফিসে নিজের কেবিনের সোফায় গা এলিয়ে বসে আছে আরশাদ। তার হাতে থাকা জ্বলন্ত সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে তাকালো টিভির দিকে। টিভির স্ক্রিনে সিনেব্লাস্টের অফিস থেকে সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছে সংবাদ। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানটির নামে এত এত অভিযোগ এলো, অথচ সাংবাদিক বিস্তারিতভাবে আরশাদের আর সুজানার ওই নকল ছবিগুলোর সঙ্গে সিনেব্লাস্টের যোগসূত্রই তুলে ধরছে।
ডোরবেল বেজে উঠলো। আরশাদ গম্ভীর গলায় বলল, “এসো!”
তুফান ব্যস্ত ভঙ্গিতে প্রবেশ করলো কেবিনে। দ্রুত পায়ে আরশাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “মুখ খুলছে স্যার!”
ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠলো আরশাদের ঠোঁটের কোণে। মুখ না খুলে যাবে কোথায়? আরশাদ হকের হাতে ধরা পড়েছে বলে কথা!
আরশাদ হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বলল, “কী বলল?”
তুফান উপচে পড়া আগ্রহ নিয়ে বলল, “ওই মেয়েটাকে ও-ই কিডন্যাপ করছে স্যার, শাফকাত আলমের কথা মতো! ম্যাসেজ, কল রেকর্ড সব এই ছেলের ফোনেই আছে। শাফকাত আলম নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে ওকে পঞ্চাশ লাখ টাকা দেয়। সেই ডিটেইলসও ব্যাংক থেকে বের করা যাবে।”
এত বড় একটা সংবাদে কোনপ্রকার হেলদোল হলো না আরশাদের মাঝে। আগের গাম্ভীর্য ধরে রেখেই বলল, “মেয়েটা এখন কোথায়?”
“সেইটা এই ছেলে জানে না স্যার। শাফকাত আলম জানে।”
আরশাদ শীতল গলায় বলল, “গাড়িতে উঠাও এই ছেলেকে। পুলিশ স্টেশনের সামনে নামাবে। নিজ পায়ে হেঁটে গিয়ে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করবে ও।”
“জি স্যার!”
তুফান যেভাবে দ্রুত গতিতে এসেছিল, সেই গতিতেই বেরিয়ে গেল। আবারও সোফায় গা এলিয়ে দিলো আরশাদ। তার ঠোঁটজুড়ে রহস্যের হাসি। এবার শাফকাত আলমকে কে বাঁচাবে?
শাফকাত যে ভয়ঙ্কর মানুষ এটা আরশাদের থেকে ভালো করে কেউ জানে না। ভয়ঙ্কর মানুষের বিরুদ্ধে তাই ভয়ঙ্কর প্রমাণ জোগাড়ে নেমে পড়ে কাল রাতে।
আজ সকাল সকাল তুফানকে একজনের খোঁজে গাজীপুরে পাঠিয়ে দেয় আরশাদ। সেই একজনটা হলো রাব্বি। সিনেব্লাস্টের সিনেমায় অভিনয় করার সময় থেকেই আরশাদ দেখেছে, শাফকাতের চামচ রাব্বি। শাফকাত যা বলবে এই ছেলে তাই করবে। শাফকাত ডানে যেতে বললে ডানে যাবে, বামে যেতে বললে বামে যাবে, আগুনে ঝাঁপ দিতে বললেও নির্দ্বিধায় আগুনে ঝাঁপ দেবে।
গাজীপুরে শাফকাতের একাধিক ফ্যাক্টরি রয়েছে। খোঁজ নিয়ে আরশাদ জানতে পারে ওই ফ্যাক্টরিগুলোর একটা সামলানোর দায়িত্ব এখন রাব্বিকে দেওয়া হয়েছে।
এক পরিচিত সাংবাদিকের কাছ থেকে আরশাদ খবর পায়, ছয় মাস আগে রাব্বি যে ফ্যাক্টরির দায়িত্বে আছে সেই ফ্যাক্টরির কর্মচারী একটা মেয়ে আচমকা অদৃশ্য হয়ে যায়। বাড়ি থেকে কাজে যাবার কথা বলে বেরিয়ে আসেনি, কিন্তু আর বাড়ি ফেরেনি কখনো। মেয়েটার বাবা পুলিশের শরণাপন্ন হলে তারা ধরে নিয়ে যায় রাব্বিকে। যদিও প্রমাণ না পাওয়ায় কদিন যেতে না যেতেই ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে।
কেন জানি আরশাদের মন বলছিল, ওই মেয়েটার নিখোঁজের পেছনে শাফকাতের ভূমিকা আছে। তাই আর সময় অপচয় না করে তুফানকে পাঠিয়ে দেয় রাব্বির খোঁজে। তুফান যথানিয়মে তাকে গাজীপুর থেকে ঢাকায় তুলে আনে। প্রথমে রাব্বি খুব চোটপাট দেখাচ্ছিল। তার বস যদি জানতে পারে তাকে অন্যায়ভাবে তুলে আনা হয়েছে, তাহলে না-কি তুফানকে রীতিমত খুন করে ফেলবে। খুন হবার আকাঙ্ক্ষার ধার না ধেরে মাহমুদের থেকেও তীব্রভাবে খাতির-যত্ন করা হলো রাব্বিকে। ইলেকট্রিক শক পর্যন্ত দেওয়া হলো। অবশেষে সত্যিটা স্বীকারই করলো রাব্বি।
আরশাদ টিভির সামনে বসে রইলো কাঙ্ক্ষিত দৃশ্যটা দেখার জন্যে। ঘন্টাখানেক বাদেই দেখা গেল সেই দৃশ্য। বনানীতে শাফকাতের বিলাসবহুল দোতলা বাড়ি থেকে একটি মেয়েকে গুম করার দায়ে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
শাফকাতের চোখেমুখে চমক স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। যা হচ্ছে, তা যেন তার কল্পনারও বাইরে। হয়তো কখনো ভাবতেই পারেনি তার সত্যিটা এভাবে চলে আসবে সকলের সামনে।
ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠলো আরশাদের ঠোঁটের কোণে। তার ক্যারিয়ার ধ্বংস করার খেলায় মেতেছিল শাফকাত। অথচ তার নিজের পুরো জীবনটাই এখন হুমকির মুখে। প্রতিশোধ নেওয়ার থেকে না-কি ক্ষমা করে দেওয়াটাই ভালো। মাহাত্ম্যের প্রকাশ ঘটে এতে। প্রতিশোধ নেওয়া হয়তো সব সময় ভালো নয়। কিন্তু সব ক্ষেত্রে ক্ষমা করে দেওয়াটাও কি ঠিক? যে মানুষগুলো ক্ষমার যোগ্য নয়, তাদের জন্যেই জন্ম হয়েছে প্রতিশোধ শব্দটার।
শাফকাতের হাতে ক্যান্ডকাফ পড়িয়ে পুলিশের জিপে তোলা হচ্ছে তাকে। আশেপাশে সাংবাদিকের উপচে পড়া ভিড়। সকলে একসঙ্গে একের পর এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে শাফকাতের দিকে।
“ওই মেয়েটার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী?”
“মেয়েটির নিখোঁজ হওয়ার পেছনে কি আপনারই হাত রয়েছে?”
“মেয়েটা কি বেঁচে আছে?”
এমন হাজারটা প্রশ্ন উপেক্ষা করে শাফকাত জিপে গিয়ে বসলো। আসলেই, কী হয়েছিল মেয়েটার সঙ্গে? তাকে কেন গুম করলো শাফকাত? পূর্বশত্রুতার জেরে? কিন্তু ফ্যাক্টরির সামান্য কর্মচারীর সঙ্গে কীসের পূর্বশত্রুতা থাকবে তার?
রিমোটের বাটন চেপে টিভিটা বন্ধ করলো আরশাদ। এতকিছু ভাবতে আর ভালো লাগছে না। ক্লান্তিতে ছেয়ে আছে পুরো শরীর। কম ঝড় তো গেল না কাল থেকে।
অফিস থেকে বেরিয়ে নিজের গাড়িতে উঠে বসলো আরশাদ। একটু একটু করে বিকেল হতে শুরু করেছে। সূর্যের আলোর তীক্ষ্ণতাও আর অসহনীয় লাগছে না। চব্বিশ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে জেগে আছে আরশাদ। মাথার দুপাশের রগ দপদপ করে জ্বলছে তার। কেমন একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে মাথায়। মনে হচ্ছে যেন এখনই ঢলে পড়ে যাবে মাটিতে।
তবুও নিজেই ড্রাইভ করে বাড়ি ফিরলো। গাড়িটা বাড়ির সামনে এসে থামলেও নামছে না আরশাদ। ফিরতে ইচ্ছা করছে না বাড়িতে। বাড়িটা আলোকিত করে রাখার মানুষটাই তো চলে গেল। শাফকাতের ওপর প্রতিশোধ নিয়ে মনের মাঝে তীব্র এক তৃপ্তি অনুভব করার কথা ছিল আরশাদের। তবে তৃপ্তি তো পাচ্ছেই না, মনটা কেবলই অস্থিরতায় ছেয়ে আছে।
বুকের মাঝে একখন্ড শূন্যতা এসে বসেছে। তাকে শ্বাস নিতে দিচ্ছে না। প্রতিবার শ্বাস নেওয়ার সময়েই মনে হচ্ছে ফুসফুসের বড় একটা অংশ ফাঁকা রয়ে গেল। এই পৃথিবীর সকল সুখ, সকল আনন্দ, সকল সাফল্য – কোনোকিছুই আরশাদকে স্পর্শ করতে পারবে না – যদি না তার পাশে অরা থাকে। কিন্তু মেয়েটাকে যে আর কোনোদিনও পাশে পাবে না সে।
আরশাদ তো বলেছিল, সে সবকিছু ঠিক করে ফেলবে। চব্বিশ ঘন্টার ব্যবধানে সব ঠিক করেও ফেললো সে। একটা বারের জন্যেও বিশ্বাস করতে পারলো না তাকে মেয়েটা? সামান্যতম ভরসা কি তাকে করা যায় না?
অভিমান খেলে বেড়াচ্ছে মনের চারপাশ দিয়ে। আরশাদের জায়গায় অন্য কেউ হলে সবটুকু সত্যি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতো অরাকে। কিন্তু আরশাদ কিছুই করবে না। নিজ জ্ঞানে মিথ্যাটাকে আপন করে নিয়েছে সে। মিথ্যা আঁকড়েই থাকুক!
গাড়ি থেকে নামলো আরশাদ। ক্লান্ত ভঙ্গিতে কলিংবেল বাজালো। মুহূর্তের মাঝেই দরজা খুলে দিলো আশফিয়া। কাল কথাকে তার কাছেই রেখেই বেরিয়েছিল আরশাদ। তাড়াহুড়োয় ঘটনার বিস্তারিত বলার সময় পায়নি। শুধু বলেছে, “অরা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। তুমি কথাকে সামলাও, আমি আসছি।” নিউজ-মিডিয়া আর ফেসবুকে যেভাবে সবটা ছড়িয়ে পড়েছে, কোনোকিছুই জানতে বাকি নেই আশফিয়ার। বুঝতেও বাকি নেই, কেন তার ভাইকে ছেড়ে চলে গেছে অরা।
দরজার অপরপ্রান্তে আরশাদকে দেখে ধ্বক করে কেঁপে উঠলো আশফিয়ার বুকটা। মাত্রাতিরিক্ত ক্লান্ত লাগছে আরশাদকে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে কপালের ওপর। চোখদুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।
আশফিয়া উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, “আরশাদ? ঠিক আছিস তুই?”
আরশাদ ঘরের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “হ্যাঁ আপা। ঠিক থাকবো না কেন?”
আশফিয়া চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “সারাটা রাত বাইরে বাইরে কাটিয়ে দিলি। কেমন টায়ার্ড দেখাচ্ছে তোকে!”
আরশাদ যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলল, “সেসব কিছু না। একটু রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। কথা কোথায়?”
আশফিয়া কিছু বলতে যাবে তখনই ছোট ছোট পায়ে ছুটে দরজার কাছে এলো আরশাদ। মিষ্টি গলায় ডাকলো, “বাবা!”
নিজের অজান্তেই হাজার ক্লান্তির ভিড়ে প্রচ্ছন্ন হাসি ফুটে উঠলো আরশাদের ঠোঁটে। সেই শুরু থেকে হাজার যন্ত্রণার ভিড়েও এই মানুষটাই সবসময় তাকে বেঁচে থাকার উৎসাহ দিয়ে এসেছে।
আরশাদ মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “বাবা? ফুপিকে বিরক্ত করিসনি তো?”
কথা আরশাদের গলা জড়িয়ে ধরে দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “একদম না! ফুপি, তুমি বলো বাবাকে। আমি কি তোমাকে বিরক্ত করেছি?”
আশফিয়া কিছুই বলতে পারলো না। তার বিস্মিত চোখদুটো আরশাদের দিকে আবদ্ধ। আরশাদকে নিয়ে এমনিতেই তার ভাবনার শেষ নেই। হাজারো মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে গেছে ছেলেটা। এখনো মানসিকভাবে যুদ্ধ করে যাচ্ছে নিজের সঙ্গে। কাল থেকে পরপর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো যে আরশাদের মনের মাঝে তোলপাড় সৃষ্টি করে দিয়েছে, বুঝতে বাকি রইলো না আশফিয়া। ভাইয়ের এই কষ্ট একেবারেই সহ্য করতে পারছে না সে।
কথা আরশাদের কাঁধে মাথা রেখে অভিমানী কণ্ঠে বলল, “বাবা তুমি কোথায় ছিলে? কাল রাতে আমি তোমার জন্য ওয়েট করতে করতে ঘুমিয়েই পড়েছি। সকালে উঠেও দেখি তুমি নেই।”
আরশাদ অপরাধীর ন্যায় বলল, “একটা জরুরি কাজে ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু এখন তো বাবা চলে এসেছি। এখন শুধু কথার সাথে ভিডিও গেম খেলবো।”
কথা চমকে উঠে উৎফুল্ল গলায় বলল, “সত্যি?”
“সত্যি!”
হাজার ক্লান্তি সত্ত্বেও গোসল করে এসে বসার ঘরের টিভিতে কথার সঙ্গে ভিডিও গেল খেলতে বসলো আরশাদ। মেয়েকে যথাসম্ভব বেশি বেশি সময় দিতে চায় সে। যেন কথার শৈশবটা তার মতো না হয়।
আরশাদ এবং কথা দুজনের হাতেই কনসোল। কথা অতি উচ্ছ্বাস নিয়ে প্রত্যেকটা গেমে হারিয়ে দিচ্ছে আরশাদকে। এদিকে ইচ্ছা করে হেরে যাওয়া সত্বেও আক্ষেপের কোনো শেষ নেই আরশাদের মাঝে।
আশফিয়া শান্ত ভঙ্গিতে এসে বসলো পাশের সোফাটাতে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে ভাইকে। তার এবং কথার সামনে প্রাণপণ চেষ্টা করছে স্বাভাবিক থাকার। ভেতরে ভেতরে যে যন্ত্রণা তাকে নিঃশেষ করে রাখছে, সেটাকে চাপা দিয়ে রাখবার। তবে চোখেই মানুষের ভেতরকার সকল অনুভূতিগুলো ফুটে ওঠে। সেটা কি করে আড়াল করবে আরশাদ?
আশফিয়া থমথমে গলায় বলল, “যার জন্য এতকিছু হলো তার কী হবে?”
আরশাদ টিভির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রেখেই না বোঝার ভান করে বলল, “কী বলতে চাইছো আপা?”
আশফিয়া কঠিন গলায় বলল, “বলতে চাইছি যে ওকে ধরে নিয়ে আয়। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দে সত্যিটা।”
আরশাদ কিছুই বলল না। ধীরেসুস্থে এই গেমটা শেষ করলো কথার সঙ্গে। আরশাদের এই শান্ত ভঙ্গিতে যেন রাগ বাড়িয়ে দিলো আশফিয়ার। একটা মানুষ বারবার এত কষ্ট পেয়েও কী করে নিজেকে সামলে রাখতে পারে? আরশাদের জায়গায় সে হলে তো এতদিনে নেহায়েত পাগল হয়ে যেত।
আশফিয়া ধমকের সুরে বলল, “কী হলো? উত্তর দিচ্ছিস না কেন?”
আপার ধমকে দমে গেল না আরশাদ। মুখে একটা হাসি টেনে এনে কথার দিকে তাকিয়ে বলল, “বাবা, আমরা কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে গেম খেলছি। তোর না এই উইকে প্রজেক্ট সাবমিট করতে হবে?”
কথা অবাক গলায় বলল, “ওহ হ্যাঁ! আমি তো ভুলেই গিয়েছিল।”
“সমস্যা কী? বাবা মনে করিয়ে দিলো না?”
কথা বাবার গালে চুমু খেয়ে বলল, “এজন্যেই তো তুমি আমার সুপারম্যান!”
আরশাদ হেসে বলল, “এখন যা, প্রজেক্টে কাজ কর। আমরা আবার পরে খেলবো।”
কথা বাধ্য মেয়ের মতো চলে গেল তার ঘরে। আরশাদ চায় না অরাকে নিয়ে কোনপ্রকার নেতিবাচক কথা অতটুকু বাচ্চার কানে যাক। আশফিয়া যে অরার ওপরে রেগে আছে, বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে আরশাদ। তাই সুকৌশলে কথাকে সরিয়ে দেওয়া।
আশফিয়া ক্ষোভে ভরা গলায় বলল, “আমি সারাটাজীবন তোকে নিজের ভুল একসেপ্ট করা শিখিয়েছি। যতবারই তোদের মধ্যে কোনো ঝামেলা হয়েছে, অরার দোষ না খুঁজে আমি তোকে শুধরেছি। ক্ষমা চাইতে বলেছি
ওর কাছে। কিন্তু এবার যা হলো…”
রাগে নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে আশফিয়ার পক্ষে। আরশাদের একমাত্র দোষ,
তার ভালোবাসায় কোনো খুঁত নেই। এজন্যেই যে যেভাবে পারে আঘাত করে যায় তাকে। অরাকে কে অধিকার দিয়েছে তার ভাইকে এভাবে আঘাত করার?
আশফিয়া ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “মানে একটাবারের জন্য বিশ্বাস করা গেল না তোকে? একবারের জন্যেও তার মনে হলো না চোখের সামনে যা দেখছে তা মিথ্যাও হতে পারে?”
আরশাদ তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “বাদ দাও না আপা।”
আশফিয়া ধমকের সুরে বলল, “না কেন বাদ দেবো? তুই এক্ষুনি আসতে বল অরাকে? কী পেয়েছে সে? নিজে ভুল করে নিজেই অন্য বাড়িতে গিয়ে…”
আরশাদ হঠাৎ আশফিয়াকে থামিয়ে দিয়ে শীতল গলায় বলল, “না আপা।”
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো আশফিয়া। অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, “না মানে?”
আরশাদ ব্যাথাতুর কণ্ঠে বলল, “আমি আসতে বলবো না অরাকে।”
“মানে কী?”
আরশাদ এক আকাশ অভিমান নিয়ে বলল, “এতদিন ধরে আমি অরাকে কষ্ট ছাড়া কিছুই দিইনি। আমার সঙ্গে থাকলে প্রতিনিয়ত আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে ও।”
আশফিয়া অরার ওপর রাগ করে আছে ঠিকই, তবে সে বেশ জানে – ওই মেয়েটাকে ছাড়া তার ভাইয়ের বেঁচে থাকা অসম্ভব।
পূর্বের রাগ ঝেড়ে ফেলে কিছুটা নরম কণ্ঠে আশফিয়া বলল, “এই আরশাদ? তুই নিজেও জানিস, কী বলছিস তুই?”
আশফিয়া বিষাদের হাসি হেসে বলল, “জানি আপা। অরার জীবনে সব অশান্তির কারণ শুধুই আমি। আমি না থাকলে ওর জীবনটা আরও সুন্দর হতে পারতো।”
আশফিয়া অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরশাদের দিকে। ছেলেটা কি একেবারেই পাগল হয়ে গেল?
আরশাদ শুকনো গলায় বলল, “নিজের মতো থাকতে চাইছে থাকুক। আমি বাঁধা দেবো না।”
আশফিয়া কম্পিত স্বরে বলল, “আর তুই পারবি অরাকে ছাড়া থাকতে?”
আরশাদ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “পারবো না। কিন্তু শিখে নিতে হবে। শিখে নিলে মানুষ সবই পারে।”
“ভালো থাকবি?”
“আমার থেকে দূরে থাকলে অরা ভালো থাকবে। আর ও ভালো থাকলেই আমার ভালো থাকে।”
“আর তোর সন্তান?”
এই প্রশ্নের উত্তর নেই আরশাদের কাছে। তার সমস্ত অভিমান এই একটা জায়গায় এসে আটকে যায়।
ক্লান্ত ভঙ্গিতে তাই উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “এত কিছু ভাবতে ইচ্ছা করছে না। প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে। আমি ঘুমাতে গেলাম, কথাকে দেখো।”
সারাটা রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও সহজে ঘুমাতে পারছে না আরশাদ। চোখদুটোতে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা করছে। অস্থির লাগছে মনের মাঝে। অরার জাপটে ধরে, তার গায়ের গন্ধে নিজেকে মেখে ঘুমানোর অভ্যাস তো! ওসব ছাড়া ঘুম আসে কী করে?
(চলবে)
#ফিরে_আসা২
৬৩ (বোনাস পর্ব)
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
সময়টা বছর দেড়েক আগে। ইন্দোনেশিয়ার বালি প্রদেশের সেমিনইয়াক সী বীচের পাড়ে বসে আছে দুজনে। যদিও বসার জন্যে সারি সারি রঙিন উঁচু ইজিচেয়ার রয়েছে। তবুও বালির মধ্যে বসে আছে তারা। সমুদ্রের ঢেউ একটু পর পর এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে তাদের। তবুও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তাদের। আকাশে আজ রোদ নেই। মেঘলা এক আবহাওয়া চারিদিকে। মেঘের মাঝে সমুদ্রকে অন্যরকম লাগে। মিষ্টি এক হাওয়া বয়ে যাচ্ছে চারিদিকে।
নিজ দেশে ঘুরে বেড়াবার জন্যে অসংখ্য সুন্দর জায়গা থাকলেও, ঘুরতে যাওয়ার জন্যে ভিনদেশই আরশাদের সবথেকে পছন্দের। এর পেছনে অবশ্য দুটো কারণ আছে। এখানে কেউ তাকে চেনে না। রাস্তা দিয়ে হেঁটে বেড়ালেও কেউ আশেপাশে ভীড় জমায় না। নির্বিঘ্নে ছুটি কাটাতে পারে সে। আর দ্বিতীয় কারণ, বউকে ভালোবাসতে গেলেও কারও কটাক্ষের স্বীকার হতে হয় না।
এই যে সে ভরা সী বীচে এক হাতে অরাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে রেখেছে,বাংলাদেশে কখনো সম্ভব হতো এটা? যতই তারা স্বামী-স্ত্রী হোক না কেন, মানুষ বাঁকা চোখে তাকিয়ে “অসভ্যের দল!” বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করতো না। অরার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে তাদের দিকে অগ্রসর হওয়া ঢেউগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো আরশাদ।
অরা হঠাৎ অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো, “মেয়েটা কী সুন্দর!”
আরশাদ অবাক হয়ে বলল, “কোন মেয়ে?”
অরা তাদের পেছনের দিকে দেখিয়ে বলল, “চলে গেল তো।”
আরশাদ মজার ছলে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে বলল, “কই দেখি তো!”
অরা খিলখিল করে হেসে ফেলে তার মুখটা আবারও সামনের দিকে ফিরিয়ে এনে বলল, “থাক! দেখতে হবে না।”
দুজনেই হেসে ফেলল একসঙ্গে। অরা খুব ভালো করেই জানে, সে বাদে এই পৃথিবীর কোনো মেয়ের প্রতি আগ্রহ নেই তার। তবুও উষ্কে দেওয়ার জন্যে সুন্দরী মেয়েটার প্রসঙ্গ টেনে আনলো। আরশাদও জানে, অরা তাকে নিয়ে বিন্দুমাত্র ইনসিকিউরড নয়। তাই তাকে ঈর্ষায় উষ্কে দেওয়ার জন্যে দেখতে চাইলো মেয়েটাকে। দুজনেই যেন দুজনেই এই দুষ্টুমির খেয়াল হেরে গেল।
অরা ঠোঁটে প্রচ্ছন্ন একটা হাসি বজায় রেখে বলল, “একটা প্রশ্ন করি?”
আরশাদ ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “কী সর্বনাশ! আমি তো ভেবেছিলাম তোমার এই বদভ্যাস চলে গেছে।”
অরা হেসে ফেলে বলল, “আচ্ছা সরি!”
“কী প্রশ্ন করবে? করো!”
অরা ইতস্তত করে বলল, “এই যে তোমার আশেপাশে এত সুন্দরী মেয়েরা ঘোরাফেরা করে। শুটিং সেটে, অফিসে সব জায়গায়। তুমি এদের কাউকেই খেয়াল করে দেখো না কেন? বেশির ভাগ ছেলেরাই তো এটা করে।”
আরশাদ বিভ্রান্ত গলায় বলল, “খেয়াল করে দেখিনা বলতে?”
অরা কী বলবে ভেবে না পেয়ে বলল, “ছেলেরা একভাবে তাকিয়ে থাকে মেয়েদের দিকে। কীভাবে বোঝাই! খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকে!”
অরার সরল কথায় হেসে ফেলল আরশাদ।
অরা কৌতুহলমাখা গলায় বলল, “বলো না! তুমি কেন ওভাবে দেখো না কোনো মেয়েকে?”
আরশাদ দুষ্টুমির ছলে বলল, “আমি স্ট্যান্ডার্ড অনেক হাই বুঝেছো! আমি যার তার দিকে বেহায়ার মতো তাকাই না।”
অরা আরশাদের দুষ্টুমিটা প্রশয় দিয়ে বলল, “তাই না-কি? তা কার কার দিকে ওভাবে তাকাও? কেমন মেয়ে ম্যাচ করে তোমার স্ট্যান্ডার্ড?”
আরশাদ কী যেন চিন্তা করার ভান করে বলল, “বেশি কেউ না, একজনের দিকেই তাকাই। সে-ই আমার স্ট্যান্ডার্ড ম্যাচ করে।”
“কে সে?”
“নাম তো মনে পড়ছে না। কিন্তু এই মুহূর্তে সে আমার বুকে মাথা রেখে বসে আছে।”
একরাশ লজ্জা এসে ঘিরে ধরলো অরাকে। তবুও খিলখিল করে হেসে উঠলো সে। প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে অসম্ভব সুন্দর কিছু স্মৃতি থাকে। শংকটাপন্ন সময়ে মানুষ বারবার ওই স্মৃতিতেই ফিরে যেতে চায়। এই স্মৃতিটা অরার কাছে ঠিক তেমনই।
মানুষ কি তার ফেলে আসা দিনগুলোকে স্বপ্নে দেখতে পারে? অরা জানে না। তবে এই ঘটনা তার মনে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠলো। যেন ওই দিনের প্রত্যেকটা মুহূর্ত জীবন্ত হয়ে উঠেছে। প্রত্যেকটা অনুভূতি অনুভব করতে পারছে সে। এটা কি আদৌ স্বপ্ন ছিল? না-কি অবচেতন মন থেকে আসা সূক্ষ্ম কোনো বার্তা?
ধীরেসুস্থে চোখ মেলে তাকালো অরা। সে কোথায় আছে বুঝে উঠতে আরও কয়েক মুহূর্ত লাগলো। উঠে বসলো ধীরে ধীরে। মাথাটা কেমন ভার হয়ে আছে। শরীরজুড়েও ঘোলাটে এক অনুভূতি। আধবোজা চোখে বিছানা হাতড়ে ফোনটা খোঁজার চেষ্টা করলো সে। তখনই মনে পড়লো, ফোন তো গতকাল সে আছড়ে ভেঙে ফেলেছে।
সেই সঙ্গে মনে পড়ে গেল কাল ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা। সুজানার সঙ্গে তার ওই কথোপকথন, আরশাদের সঙ্গে রাগারাগি, অবশেষে বাড়ি ছেড়ে চলে আসা। দুহাতে মাথাটা চেপে ধরলো অরা। কিছুই বুঝতে পারছে না সে। কাল সারাটা রাত জেগে ভোর রাতে ঘুমিয়েছে সে। তার মস্তিষ্কে কেবল ভর করে ছিল সুজানার বলা কথাগুলোই। এর বাইরে আর কিছুই ভাবতে পারছিল না অরা।
আরশাদের জ্যাকেটে সুজানার পারফিউমের গন্ধ, সুজানার বলা ওই কথাগুলো, ওই কুৎসিত ছবিগুলো – তার বিস্ফোরিত অনুভূতিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। বিষ্ফোরণ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে।
সুজানার বলা কথাগুলো নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয় উঠেছিল অরা, যে একবারের জন্যেও আরশাদের দিকটা ভেবে দেখার প্রয়োজন মনে করেনি? কম্পিত নিঃশ্বাস ফেলছে অরা, তার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে।
না, না। আরশাদ এমনটা করতে পারে না। সে ছেলে অরা বাদে কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে পর্যন্ত তাকানোর আগ্রহ বোধ করে না – সে এমনটা করতে পারে না। কাল রাতে বারবার মনে হচ্ছিল সবটা আরশাদের অভিনয়। কিন্তু না, আরশাদের সকল অভিনয় তো কেবল ক্যামেরার সামনেই। বাস্তবে অনুভূতি লুকানোর চেষ্টা করলেই ধরে ফেলে অরা। যে মানুষটাকে সে এত ভালোবাসলো, তাতে এতটুকু অন্তত চেনে।
আচমকা সংবিৎ ফিরে পেলো অরা। এটা সে কী করলো? এই অসম্ভব দুর্যোগঘন সময়ে আরশাদকে একা ফেলে চলে এলো সে? এই সময়টায় তো তার উচিত ছিল আরশাদের পাশে থাকা। এত বড় একটা ভুল কী করে করলো অরা? কী করে পারলো এতটা নিষ্ঠুর হতে?
অরার বিছানা থেকে নামার জন্যে ছটফট করছে। তখনই ঘরে আগমন ঘটলো সীমার।
সীমা অরার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, “কী রে? মরার ঘুম দিয়ে উঠলি তো! এখন না উঠে একেবারে কাল সকালেই উঠতি।”
সীমার কথায় বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে অরা অস্থির গলায় বলল, “সীমা! আমার না কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। অনেক বড় ভুল।”
সীমা অরার পাশে বসতে বসতে ভাবলেশহীন গলায় বলল, “তাই বুঝি?”
অরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আরশাদ… আরশাদ এমনটা করতে পারে না।”
সীমা শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “এতটা নিশ্চিত হলি কী করে হঠাৎ?”
অরা দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল “এতদিন ধরে চিনি ওকে আমি, আমি জানি। এটা ও করতেই পারে না।”
সীমা ধমকের সুরে বলল, “এই একই কথা গত রাতে এক কোটি বার বলেছি তোকে আমি। তখন হুস হয়নি?”
অরা ভয়ার্ত কন্ঠে বলল, “আমার মাথা কাজ করছিল সীমা। পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। কিছুই চিন্তাভাবনা করতে পারছিলাম না।”
“শান্ত হ! দোয়া কর ওই সুজানা মেয়েটা তোকে যা যা বলছে, তা যেন সত্যি হয়।”
অরা বিস্ময় নিয়ে তাকালো সীমার দিকে।
সীমা আবারও বলল, “না হলে যে পরিমাণ কষ্ট আরশাদ ভাইয়াকে দিয়ে এসেছিস, তার পরে নিজেকে ক্ষমা করবি কী করে?”
সীমার কথার আগা-মাথা কিছুই বুঝতে পারছে না অরা। বোঝার কোনপ্রকার চেষ্টাও তার মধ্যে নেই।
অরা ব্যস্ত গলায় বলল, “আমি আরশাদের কাছে যাবো!”
অরা বিছানা ছেড়ে উঠতে যাবে, সীমা তখনই তার হাত ধরে আটকে দিলো তাকে।
শীতল কণ্ঠে বলল, “যাবি তো, আগে এটা দেখে যা।”
মোবাইলে ফেসবুকের হোম পেজ বের করে তা অরার হাতে ধরিয়ে দিলো সীমা। কাল থেকে যা যা ঘটে গেল, সবকিছুরই বর্ণনা ঘুরে বেড়াচ্ছে ফেসবুকজুড়ে। অরাকে কিছুই বলতে হলো না। সে নিজেই খুঁজে খুঁজে সব সত্যি জেনে নিলো।
অরার চোখমুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। হাত-পায়ের কম্পন বেড়ে গেল কয়েকগুণ। চোখ দুটো দিয়ে অঝোরে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। চোখে লেগে আছে একরাশ বিস্ময়। নিজেকে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। এটা সে কী করে করলো? কী করে পারলো একবারও সত্যিটা যাচাই না করে আরশাদের মনটাকে ক্ষত-বিক্ষত করতে? অরা দুহাতে মুখ লুকিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো।
সীমা কঠোর গলায় বলল, “আরশাদ ভাইয়া যদি তোকে কোনোদিন ক্ষমা না করে, আজীবনের জন্যে তোর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় – তাহলে আমার থেকে বেশি খুশি আর কেউ হবে না।”
অরা কাঁদতে কাঁদতে উদভ্রান্তের মতো বলল, “আমি এটা কী করলাম সীমা? কী করে পারলাম আমি?”
সীমা যন্ত্রের মতো বসে রইলো। প্রাণপ্রিয় বান্ধবীকে সহমর্মিতা জানাবার কোনো উদ্যোগ তার মাঝে নেই।
অরা ভয়ার্ত ভঙ্গিতে বলল, “এখন কী করে মুখ দেখাবো ওকে আমি? তুই জানিস ওকে আমি কী বলেছি? আমি বলেছি…”
কথাটা আর শেষ করতে পারলো না অরা। সে জানে তার বলা প্রতিটা কথাই তীক্ষ্ণ শূলের মতো গিয়ে বেঁধেছে আরশাদের বুকে। এতটা কষ্ট যে আরশাদ তার কাছ থেকে পাবে, এটা তো কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেনি অরা।
যে মানুষটার একমাত্র ভয় তাকে হারিয়ে ফেলা, তাকেই ছেড়ে চলে এলো অরা? কী পারলো নিজের করা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে অমন নিষ্ঠুরতা দেখাতে?
অরা নিজের চুল নিজেই টেনে ধরে বলল, “আমি একটু বিশ্বাস কেন করলাম না আরশাদকে? কেন এত কষ্ট দিলাম? এত খারাপ কী করে হতে পারলাম?”
সীমার মন বোধ হয় কিছুটা নরম হলো। অরার কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় বলল, “কাঁদিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
অরা কান্না থামানোর কোনো প্রচেষ্টা না করেই বলল, “আরশাদ আমাকে কখনোই ক্ষমা করবে না। কখনোই না! ও একবার যার সঙ্গে রাগ হয়, তার দিক থেকে আজীবনের জন্যে মুখ ফিরিয়ে নেয়।”
নিজের প্রতি একরাশ রাগ আর ভয় ভেতর থেকে শেষ করে দিচ্ছে অরাকে। যে আরশাদ রেগে গেলে পৃথিবীর কোনো কিছুই তোয়াক্কা করে না, সে কি কোনোদিন করবে তাকে ক্ষমা? করবে না, নির্ঘাত করবে না।
আরশাদের ঘুম ভাঙলো রাত আটটার দিকে। একটা গোটা রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দেওয়ার পর মাত্র চারঘন্টা ঘুমানো হতাশাজনক। আরশাদ ভেবেছিল এক ঘুম দিয়ে কাল সকালেই উঠবে। তবে মনটা অস্থির থাকলে হয়তো মানুষ শান্তির ঘুম ঘুমাতে পারে না।
জেগে উঠতেই সেই বিচিত্র শূন্যতা ছেয়ে গেল সমস্ত শরীরে। আবারও বেড়ে গেল শ্বাস নেওয়ার কষ্ট। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায় কোথায়? একটা উপায়, অরার কাছে গিয়ে তার মায়ামাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকা। সেটা হয়তো আর কখনোই সম্ভব নয়। কালকের ওই ঘটনার পর মেয়েটা চোখে নিজের জন্যে স্পষ্ট ঘৃণা দেখেছে সে। আরেকটা উপায় হলো, দিন দুনিয়া ভুলে সারাদিন শুধু এভাবেই ঘুমিয়ে থাকা। ঘুমটাই বাস্তবতা ভুলিয়ে রাখে মানুষকে।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিছানা ছেড়ে উঠলো আরশাদ। একটা জরুরি কাজ তাকে করতে হবে। হাত-মুখ ধুয়ে এসে মোবাইলটা নিয়ে বসলো আরশাদ। ততক্ষণে তার ঘরে প্রবেশ ঘটেছে আশফিয়ার।
আশফিয়া শুকনো গলায় বলল, “উঠলি এতক্ষণে?”
আরশাদ তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মোবাইলের দিকে দৃষ্টি আটকে রেখেই বলল, “আপা শোনো, তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।”
“কী কাজ?”
আরশাদ ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, “সামনের সপ্তাহে তো অরার ডেলিভারি ডেট। এর আগেই যেকোনো সময় লেবর শুরু হয়ে যেতে পারে। তাই আজকেই সীমাদের বাসার নিচে একটা অ্যাম্বুলেন্স স্ট্যান্ড বাই রাখতে। আমি সব ব্যবস্থা করেই রেখেছি, তুমি শুধু সীমাকে জানিয়ে দাও। আর একটা ওষুধ ও ফেলে গেছে, ওটাও পাঠিয়ে দেওয়ার…”
আরশাদকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আশফিয়ার শীতল গলায় বলল, “এসবের আর দরকার হবে না।”
আরশাদ বিস্মিত গলায় বলল, “মানে?”
“সে এসেছে।”
আরশাদ হৃদপিন্ডটা যেন এক মুহূর্তের জন্যে ধুকপুক করতে ভুলে গেল। যা সে কল্পনাতেও আশা করেনি, তাই হচ্ছে তার সঙ্গে?
আরশাদ কম্পিত স্বরে বলল, “কোথায়?”
আশফিয়া থমথমে গলায় বলল, “লাইব্রেরিতে। অন্ধকারের মধ্যে বসে বসে কাঁদছে।”
আরশাদ থেমে থেমে বলল, “কখন এসেছে?”
“ঘন্টাখানেক হলো।”
আরশাদ তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “মানে কী আপা? অরা ঘন্টাখানেক আগে এসেছে আর তুমি এখন বলছো আমাকে?”
আশফিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল, “তুই তো ঘুমিয়ে ছিলি!”
আরশাদ বিরক্ত গলায় বলল, “ডাকলে না কেন আমাকে?”
প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেও উত্তরটা শোনার সময় তার কাছে নেই। ঝড়ের গতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে। তার চোখদুটো অরাকে দেখার তৃষ্ণায় এতক্ষণ ছটফট করছিল, সেই তৃষ্ণা যেন ঠিক এই মুহূর্তে কয়েক হাজার গুণ বেড়ে গেল। গতকালই তো রাগ করে চলে গেল মেয়েটা, অথচ মনে হচ্ছে যেন সেই ঘটনা কয়েক বছর আগের। অনেক অনেক দিন সে না দেখে কাটিয়ে দিয়েছে অরাকে।
আরশাদের হৃদস্পন্দন ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। আচ্ছা অরা কি এখনো তার ওপরে রেগে আছে? না-কি সব সত্যিটা জেনেই এসেছে? কিচ্ছু ভাবতে চাইছে না আরশাদ। ফিরে এসেছে অরা, ফিরে এসেছে তার কাছে। এর থেকে বেশি আর কী চাই তার?
দ্রুত পায়ে লাইব্রেরির কাছে এসে দাঁড়িয়েও হঠাৎ থেমে গেল আরশাদ। আচমকাই পা দুটো কাঁপতে শুরু করেছে। যে অরা তার একান্ত নিজস্ব, তার মুখোমুখি হতেই কেমন একটা সূক্ষ্ম ভয় অনুভূত হচ্ছে। পরিস্থিতি যদি আবারও সব এলোমেলো করে দেয়?
ছোট ছোট পা ফেলে লাইব্রেরির দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো আরশাদ। জায়গায় জায়গায় সূক্ষ্ম হলদেটে বাল্ব জ্বলছে। তবুও ঘোলাটে অস্পষ্ট এক অন্ধকার চারিদিকে।
কিছুটা এগিয়ে যেতেই থেমে দাঁড়ালো আরশাদ।
চোখদুটো যেন বহুক্ষণ পর শান্তি পেলো, হৃদস্পন্দন বহুক্ষণ পর নিজ গতিতে ফিরলো। নিঃশ্বাসের কষ্টটা এখন আর হচ্ছে না, বুকের ভেতরে চাপা অস্থিরতাও অনুভূত হচ্ছে না। মনের মাঝে জমে থাকা সকল অভিমান এক নিমিষে গলে জল হয়ে গেল। তবুও থমকে দাঁড়িয়ে রইলো আরশাদ। তার দৃষ্টি মেঝেতে বসে থাকা মেয়েটার দিকে আবদ্ধ।
অরা দুহাতে মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে। সে বেশ টের পাচ্ছে আরশাদের উপস্থিতি। তবুও হাতদুটো সরিয়ে আরশাদের মুখোমুখি হওয়ার সাহস সে পাচ্ছে না। কোন মুখে মুখোমুখি হবে সে আরশাদের?
আরশাদ হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো অরার সামনে। অরার কান্না যেন বহুগুণ বেড়ে গেল। মেয়েটার মুখ সে দেখতে পাচ্ছে না, তবে তার উপস্থিতিটুকুই হৃদয়কে জুড়িয়ে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট।
আরশাদ কী বলবে বুঝতে পারছে না। ভাষা হারিয়ে গেছে তার। অতিরিক্ত আনন্দে না আবেগে বুঝতে পারছে না সে।
আরশাদ নীরবতা ভঙ্গ করে কৃত্রিম অভিমান নিয়ে বলল, “হাতটা সরাও। নিজেকে না দেখিয়ে দেখিয়ে মেরে ফেলতে চাও না-কি আমাকে?”
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না অরা। মুখের ওপর হাতটা সরিয়ে এক নিমিষে জড়িয়ে ধরলো আরশাদকে। মিশে রইলো তার বুকের মাঝে। আরশাদও পরম মমতায় আগলে ধরলো তাকে। ছেলেটা এমন কেন? অরা তো ভেবেছিল আর কোনোদিনও তার মুখোমুখি হতে চাইবে না আরশাদ। রাগ পুষে রাখবে তার প্রতি আজীবন। আর সেই মানুষটাই এভাবে আগলে ধরছে তাকে?
অতিরিক্ত আবেগে গলে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে অরা অস্থির গলায় বলল, “আরশাদ আমাকে মাফ করে দাও! মাফ করে দাও আমাকে।”
আরশাদের বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে অরা। তার অশ্রু ভিজিয়ে দিচ্ছে আরশাদের টি-শার্টের বুকের কাছটা। তবুও থামবার কোনপ্রকার প্রচেষ্টা নেই অরার মাঝে।
অরা কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল, “অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তোমাকে। আমি অনেক খারাপ! তাও মাফ করে দাও প্লিজ!”
আরশাদ অরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত পরিতৃপ্ত ভঙ্গিতে বলল, “কাঁদে না, একদম কাঁদে না।”
আরশাদের এই সামান্য স্নেহে দিশেহারা হয়ে পড়লো অরা। তার টিশার্ট আঁকড়ে ধরে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লো।
আরশাদ উদ্বেগ নিয়ে অরাকে আশ্বাস দিয়ে বলল, “অরা আমি তোমাকে বলেছি না কখনো কাঁদবে না। তাও কেঁদে যাচ্ছো তখন থেকে। আমি তোমার ওপর রাগ করিনি তো! একটুও রাগ করিনি। তোমার ওপর আমি রাগ করতে পারি?”
যে আরশাদ হকের রাগ সবকিছু তছনছ করে দিতে পারে, রেগে গেলে যে মানুষটা কাউকে তোয়াক্কা করে না – সেই মানুষটারই না-কি কোনো রাগ নেই অরার ওপরে!
দুজনে কতটা সময় এভাবে রইলো কেউ জানে না। কারও মুখেই আর কোনো কথা নেই। কিছু কিছু অনুভূতি অনুভব করার জন্যে কথার প্রয়োজন হয় না, ভালোবাসার মানুষটাকে কাছে প্রয়োজন হয় কেবল। বিচিত্র প্রশান্তি ছেয়ে যাচ্ছে আরশাদের সমস্ত শরীর-মন জুড়ে। নতুন করে যেন জীবন দিলো তাকে অরার ফিরে আসা।
(চলবে)