ফিলোফোবিয়া
ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির )
১৬.
( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )
পরেরদিন খালার সাথে দেখা করতে মজনু ভাই এলো সকাল সকাল। খালা বেশ ঘটা আয়োজন করেছে। হরেক রকম রান্নাবান্না খাবারদাবার।
কোচিং শেষে বাড়ি ফিরে হল ঘরে শিহাবকে বসে থাকতে দেখল প্রিয়। ভ্রু কুঁচকে এলো সামান্য। প্রিয়কে দেখে শিহাব উঠে দাঁড়ালো। বিনয়ী স্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘ এতো দেরি হলো যে? সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি তোমার!’
শিহাবের কন্ঠে স্পষ্ট অধিকারবোধ। যেন অনেক বছরের পরিচীত। প্রিয় বিস্ময় কাটিয়ে সালাম জানিয়ে বলল,
‘ স্যার আসতে দেরি করেছে তাই দেরি। কেমন আছেন আপনি?’
‘ ভালো থাকি কি করে? সারাদিন শুধু তুমি মাথায় ঘুরঘুর করো।’
কথার অর্থ বুঝল না প্রিয়। গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে থাকলো শুধু। চোখমুখে স্পষ্ট হতভম্ব ফুটে। কথা এড়িয়ে প্রিয় বলল,
‘ আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।’
ঘরে চলে এলো প্রিয়। গোসল করে বেরিয়ে দেখল তার ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে শিহাব। বিরক্ত হলো প্রিয়। হুট করে তার ঘরে অনুমতি ছাড়া শিহাবের ঢুকে পড়ার ব্যাপারটা একদম পছন্দ হলোনা। বিব্রত হলো খুব। বলল,
‘ আপনি এখানে?’
‘ তোমার অপেক্ষা করছিলাম। লাঞ্চ করবে না?’
কপাল কুঁচকে নিলো প্রিয়। শিহাবের কথাবার্তা আচরণ গায়েপড়া লাগছে তার। বিমূঢ় কন্ঠে বলল,
‘ আপনি লাঞ্চ করে ফেলুন। দেরি হবে আমার।’
‘ সমস্যা নেই আমি এখানে বসছি। তুমি তৈরি হও। এক সাথে লাঞ্চ করবো।’
জবাবে কিছু বলল না প্রিয়। বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে রইল শুধু। অমনি খালার আওয়াজ কানে এলো। দ্রুত পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। দুপুরের খাবার পর। ছাদ ঘুরে দেখার আবদার করল শিহাব। খালা প্রিয়কে ছাদ ঘুরিয়ে দেখাতে বলল। বিরক্ত হলো প্রিয়। খালার কথার পিঠে অমান্য করার সাধ্যি নাই তার। চোখমুখ অন্ধকার করে শিহাবকে ছাদে নিয়ে গেল। মেহমান কিনা! শিহাব ছাদ ঘুরছিল। ছাদ ঘুরে দেখা মূলত বাহানা ছিল। আসল উদ্দেশ্য প্রিয়’র সাথে সময় কাটানো।
ছাদের চেয়ারে বসে ছিল প্রিয়। শিহাব সামনের চেয়ারে বসে কথা বলছে অনবরত। নিজেদের নিয়ে বাড়িয়ে চড়িয়ে গপ্পো করে। প্রচন্ড বিরক্তি বিতৃষ্ণা চেপে ধরেছে প্রিয়কে। তবুও ভদ্রতার খাতিরে চুপচাপ শুনছে। ঘুমে চোখজোড়া টলমল করছে। খালার উপর রাগ হচ্ছে খুব। প্রিয়কে না পাঠালে কি হতো! হাই টানতে টানতে ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে তাকালো। গতির ভেতর শতাব্দদের গাড়ি ঢুকছে। চোখমুখ নেচে উঠল প্রিয়’র। ঘুমঘুম ভাবটা মুহূর্তেই কেটে গেল। শতাব্দ কি ঢাকা থেকে ফিরল তবে। চেয়ার ছেড়ে উঠে রেলিং এর পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। মাথা উঁচিয়ে উঁকি দিলো। খয়রি গাড়িটা থেকে শতাব্দ নামছে। প্রচন্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে। চোখমুখ মুড়ছে আছে একদম। আচমকা ছাদের দিক চাইল শতাব্দ। প্রিয়’র পাশে শিহাবকে দেখে গম্ভীর করে নিলো মুখ। কপাল কুঁচকে ভিতরে চলে গেল। প্রিয় হতাশ চেয়ে রইল। দুজনকে সন্দিহান দৃষ্টিতে পরখ করলো শিহাব। তাদের মধ্যে কিছু চলছে তা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। তবে কি চেয়ারম্যানের ছেলে শতাব্দের সাথে প্রিয়’র প্রেম চলছে!
আজ নির্বাচন। গ্রাম জুড়ে চাপা উত্তেজনা। এলোমেলো সব। নির্বাচন কেন্দ্র থেকে খবর এসেছে খানিক আগে। ভ*য়ানক গন্ডগোল হয়েছে সেখানে। মা*রামা*রি হা*তাহাতি হচ্ছে কেন্দ্রের বাহিরে। গভীরভাবে আ*হত, র*ক্তাক্ত কয়েকজন। কো*পাকুপি হয়েছে। কারো হাত খুয়েছে, কার পা। হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। অনেকের জীবন সংকটে। এখনো ঠিকঠাক কারো খবর পাচ্ছেনা। পরিস্থিতী ভীষণ বা*জে। নিয়ন্ত্রণে আনার পুলিশ চেষ্টা চালাচ্ছে। শুনে হাতপা কাঁপাকাঁপি শুরু করেছে প্রিয়’র। বুক চেপে ধরেছে ভয়ে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ডেকে যাচ্ছে হাজারবার।
দুপুরে যখন শতাব্দের সাথে কথা হয়েছিল। বলেছে, এই কেন্দ্রের বাহিরে আছে। এখন অবধি সব ঠিক আছে। সব কেন্দ্র মিলিয়ে জয়লাভের সম্ভাবনা বেশি। তাদের পক্ষে জনগন। পরিস্থীতি ভালো দেখে বিরোধী দল ক্ষেপেছে। এটা ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র। ঝামেলার আশংকা আছে। তাই ফলাফল অবধি এখানেই থাকবে। তারপর আর কথা হয়নি। একটু আগে চেয়ারম্যান বাড়ির লোকজনকে ছুটাছুটি করে বেরিয়ে যেতে দেখেছে। সেই থেকে আরো বেশি ভয় করছে। তার আবার কিছু হয়নি তো! ঠিক আছে তো শতাব্দ?
চিন্তায় মাথা ভার হয়ে আসছে। বারবার চোখ ভরে আসছে। এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে। বারান্দায় ছুটে যাচ্ছে বারবার। যদি চেয়ারম্যান বাড়ির কাউকে দেখা যায়। কোন একটা খবর পাওয়া যায়! খালার ফোন থেকে ফোন করছে শতাব্দকে তুলছেনা সে। প্রিয়’র চিন্তা আরো বেশি বেড়ে গেল। ভ*য়ে কেঁদেই ফেলল। খালা বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করল। উত্তরে কিছু খুলে বলল না প্রিয়। বিরবির করে শুধু বলল, ‘ শ.শতাব্দ ভাই ঠিক আছে তো খালা?’
আয়েশা বেগম বিমূঢ় চেয়ে রইল। শতাব্দের প্রতি প্রিয়’র এমন চিন্তা, স্পর্শানুভূতি দেখে আশ্চর্যান্বিত সে। ভীষণরকম অস্বাভাবিক লাগছে। এভাবে চিন্তা, ভয়ে কাঁদতে দেখেনি কখনো প্রিয়’কে। হাউমাউ করে কাঁদছে প্রিয়। তবে কি তার সন্দেহ ঠিক। শতাব্দের সাথে কোন সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে প্রিয়? আঁতকে উঠল সে। তড়িঘড়ি করে প্রিয় কাছে গেল। ফ্লোরে বসে হাতপা ছড়িয়ে কাঁদছে প্রিয়। আয়শা বেগম কাছে যেতে কাঁধ ঝাকিয়ে ভনিতা বিহীন জিজ্ঞেস করল,
‘ আমার দিকে তাকা। আমার দিকে তাকা প্রিয়। শুন, কি হয়েছে তোর?’
আয়েশা বেগমের ভয়ার্ত এলোমেলো আওয়াজ। অশ্রু ভরাক্রান্ত দৃষ্টিতে তাকালো প্রিয়। চোখমুখ অশ্রুতে ভিজে। শক্তিহীন নেতিয়ে আছে সে। আয়েশা বেগম আবার জিজ্ঞেস করল,
‘ শতাব্দের সাথে তোর সম্পর্ক কি? প্রেম করছিস?’
প্রিয় উত্তর দিলো না কোন। ডর ভয়ে লজ্জায় মাথা ঝুকে অনবরত কেঁদে যাচ্ছে। খালা চিন্তিত। অধৈর্য কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি প্রিয়! শতাব্দের সাথে তোর কিসের সম্পর্ক?’
শেষ কথাটা বেশ ধমকে বললেন। এবারো নিশ্চুপ প্রিয়। রেগে গেলেন খালা। কাঁধ ঝাকিয়ে শক্ত ধমকে চেঁচিয়ে বলল,
‘ কিছু জিজ্ঞেস করছি প্রিয়! উত্তর দে!
খালা রাগে হাত উঁচু করতেই ডুকরে কেঁদে ফেলল প্রিয়। হুঁহুঁ করে কেঁদে উঠলো। জড়সড় বসে আছে প্রিয়। কান্না ভেজা চাপা কন্ঠে বলল,
‘ আমি তাকে ভালোবাসি খালা।’
আয়েশা বেগম বিস্ময়ের চরম পর্যায়। ধপ করে বসে পড়ল মাটিতে। প্রিয়’র কথা গুলো গরম শিসার মত কানে ঢুকছে তার। কিছু ভেবে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল হ্ঠাৎ। ফিসফিস করে বলল,
‘ এটা হতে পারেনা। তুই শতাব্দকে ভালোবাসতে পারবিনা। এটা অসম্ভব। অসম্ভব!’
এই শীতেও প্রচন্ডরকম ঘামছে সে। ভারী ভারী নিশ্বাস পড়ছে। হাঁপিয়ে উঠেছে। প্রেসার বেড়ে গেল কি?
একটু সময় নিয়ে শান্ত হলো। রাশভারি কন্ঠে বলল,
‘ এটা সম্ভব না প্রিয়। অসম্ভব। এসব বাদ দে। ভুলে যা শতাব্দকে।’
‘ আমি পারবোনা খালা। ভালোবাসি তাকে।’
প্রিয়’র স্পষ্ট উত্তর। উত্তরে ভড়কে উঠলেন তিনি। প্রিয়’র চোখের দিকে তাকালেন। চোখে আজ কোন ভয় নেই তার। কন্ঠে জড়িয়ে আছে সামান্য লজ্জা, জড়তার প্রলেপ। অদ্ভুত, নিদারুণ সাহস নিয়ে মেয়েটা কথা গুলো বলছে। এইটুকু মেয়ে এত সাহস পাচ্ছে কোথা থেকে? এই সাহসের কি নাম দিবে? বেয়াদবি! নাকি উঠতি বয়সের চরম বোকামি। তিনি নিজেকে শান্ত করলেন নরম বোঝানোর স্বরে বললেন,
‘ এসব প্রেম, ভালোবাসা খানিকের মোহ সব। এখনো তোর পুরো জীবন পড়ে। অল্পবয়সের সামান্য আবেগে গা ভাসালে সব বি*নাশ হবে। আজীবন ধুকে ধুকে ম*রতে হবে।’
শক্ত বনে বসে আছে প্রিয়। খালার কোন কথা কানে তুলছেনা সে। হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে আয়েশা বেগম উঠে দাঁড়ালো। বললেন,
‘ তুই না বুঝতে চাইলে আমার আর কিছু করার নেই। তোর বাবাকে জানাতে হবে সব। ওদের মেয়ে ভরণপোষণ করে এতবড় করেছে। ভালো ভবিষ্যতের জন্য ভরসা করে আমার কাছে পাঠিয়েছে। বিশ্বাসঘা*তকতা করতে পারবোনা তাদের সাথে। সবটা জানাতে হবে তাদেরকে। তারপর যা করার তারা সিদ্ধান্ত নিবে।’
বলে ঘর থেকে বের হবার জন্য পা বাড়ালো। প্রিয় আরো জোরে কেঁদে উঠল। হামাগুড়ি দিয়ে তড়িঘড়ি পা জড়িয়ে ধরল। ঝাপটে ধরে কেঁদে কেঁদে বলল,
‘ খালা, খালা বাবাকে জানাবেনা প্লিজ। জানাবেনা তুমি। বাবা জানলে ঢাকায় নিয়ে যাবে আমাকে।কোন দিন ইমান্দিপুরে আসতে দিবেনা আর। তুমি যা বলবে সব সেই ভাবে চলবে। আমি তার সাথে কথা বলবোনা। দেখা করবো না। এখানে থেকে শুধু দূর থেকে একটু দেখবো খালা। প্লিজ জানাবেনা বাবাকে।’
প্রিয়’র কান্নাভেজা এলোমেলো অগোছালো কথায় থমকে গেল খালা। চোখ চিকচিক করছে জলে। অনেক বছর আগের কিশোরী নিজেকে দেখছে। একদিন এমন ভাবেই বাবার পা জড়িয়ে কাউকে চেয়েছে। আকুতি মিনতি করেছে। দুর্বল হয়ে পড়ল সে। ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল আবার। কাঁপাকাঁপি হাতে প্রিয়’র কান্নাভেজা মুখটা তুলল। ভেজা কন্ঠে আওড়াল,
‘ শতাব্দ’ই কেন? এই প্রেম বি*নাশ আনবে।’
‘ আসুক।’
‘ য*ন্ত্রণায় জ্বলে পুড়ে ছারখার হবি!’
‘ রাজি আছি।’
‘ নিঃ*স্ব করে দিবে সব।’
‘ অভিশাপ দিচ্ছো?’
‘ না, বাস্তবতা দেখাচ্ছি।
‘ এইটুকু যন্ত্রণা পেয়ে যদি তাকে পাওয়া যায়। এই যন্ত্রণাকে হাজারবার কবুল।’
প্রিয়’র ব্যাকুল চোখজোড়ায় করুণ আকুলতা। ব্যর্থ নিশ্বাস ফেলল আয়েশা বেগম। চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে গাল বেয়ে ঝরলো। টলমল শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। নিজের ঘরের দিক পা বাড়ালো। পেছনে বসে রইল প্রিয়। নিশ্চুপ, শব্দহীন অশ্রু ঝরালো।
রাত আটটা বাজতে চলেছে। ঠান্ডা ফ্লোরে গুটিসুটি মেরে প্রিয় শুয়ে। চোখজোড়া এখনো ভিজে। অশ্রু গাল গড়িয়ে ফ্লোরে ঝরছে টপটপ। বিকালের পর খালার সাথে কথা হয়নি আর। না শতাব্দের কোন খবর পেয়েছে। এক আকাশ হতাশা জুড়ে পড়ে আছে নিমিষ। আচমকা ঢোল বাজনার আওয়াজ ভেসে এলো কানে। এলোমেলো হাতে ওড়না খুঁজে। তড়িঘড়ি উঠে। বারান্দার দিকে ছুটে গেল সে। শতাব্দের বাবা শাহরিয়ার খাঁন তৃতীয় বারের মত বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছে। ফুলের মালা পড়ে ব্যান্ড, বাজনা নিয়ে আসছে।
শতাব্দকে দেখছেনা কোথাও। ছটফট করছে প্রিয়। খানিক বাদেই ভীড়ের মধ্যে শতাব্দকে দেখলো। গলায় মালা পড়ে গাড়ির সানরুফ খুলে দাঁড়িয়ে। চোখেমুখে জয়ের হাসি। হাত উঁচিয়। আশেপাশে সবাই বাপ ছেলের ছবি তুলছে। চিন্তা মুক্ত হলো প্রিয়। ছোট শ্বাস ফেলল। হ্ঠাৎ অন্ধকারে শতাব্দের হাতে সাদা ব্যান্ডেজে চোখ আটকাতেই। আঁতকে উঠল প্রিয়। অনেক বড়সড় ব্যান্ডেজ। খুব বেশি আঘা*ত লেগেছে কি?
প্রিয়দের বাড়ির সামনে গাড়ি করে বিজয় মিছিল যাওয়ার সময় চোখাচোখি হলো। প্রিয়’র ফোলাফোলা অশ্রুভেজা চোখমুখ দেখে কপাল কুঁচকে নিলো শতাব্দ। খটকা লাগলো তার। মোবাইল বের করে কল করল প্রিয়’র নাম্বারে।
চলবে……
ফিলোফোবিয়া
ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির )
১৭.
( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )
ঘুম থেকে জেগে বাড়ি ভর্তি লোক দেখে হতভম্ব প্রিয়। বলা নেই, কওয়া নেই একদল লোক সুড়সুড় করে বাড়িতে ঢুকছে। হাতে হরেক রকম মিস্টান্ন, ফল ফলাদি সহ আরো অনেক কিছুর ডালা। চোখ পাকিয়ে বিমূঢ় দৃষ্টিতে খালার দিকে তাকালো। খালার চোখমুখেও বিভ্রান্তির ছায়া। কারণটা তারও অজানা। সেখানে তদারকি করা এক লোককে ডেকে জিজ্ঞেস করল খালা,
‘ আশ্চর্য! এসব কি হচ্ছে? তোমরা কারা? ‘
লোকটা খালার কথাহ তেমন গুরুত্ব দিলো না। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে ডালার হিসাব নিতে নিতে উত্তরে বলল,
‘ মেজবাহ চেয়ারম্যান এসব পাঠিয়েছে।’
মেজবাহ চেয়ারম্যান মজনু ভাইয়ের চাচা। শিহাবের বাবা। গতকালই তো চেয়ারম্যান নির্বাচনে হারলো। আজই এসব কেন পাঠালো? গভীর ভাবনায় ডুব দিলো।
অমনি সদর দরজার কড়া নড়ল। হকচকিয়ে উঠল প্রিয়। শিহাব সহ তার পুরো পরিবার দাঁড়িয়ে। মজনু ভাইও আছে পাশে। গম্ভীর চোখে ঠাহর করল প্রিয়। মোটামুটি সকলেই আ*হত। হাতে পায়ে টুকটাক ব্যান্ডেজ। মজনু ভাইয়ের মাথায় ইয়া বড় ব্যান্ডেজ করা। বেচারার ফসলহীন টাকটা ছিদ্র করল কে? নিশ্চয়ই গতকাল গন্ডগোলে হয়েছে।
প্রিয়’র বিস্ময় কা*টল মেজবাহ সাহেবের আওয়াজে। খালার সাথে কুশল বিনিময় করছে। ভদ্রতার হাসি হেসে আয়েশা বেগম তাদের বসতে বললেন। মেজবাহ সাহেব ভীষণ খোশমেজাজে। চোখমুখ দেখে বুঝবার কায়দা নেই যে গতকাল নির্বাচনে হেরেছে। খানিক এদিক সেদিকের কথা বলে বিনয়ী সুরে জিজ্ঞেস করলেন খালা,
‘ হুট সকাল সকাল আপনারা! মানে…’
মেজবাহ সাহেব বুক ফুলিয়ে বসে আছে। দেড় ইঞ্চি পেটটা ভিতরে টেনে সোজা হয়ে বসলেন। হাস্যোজ্জ্বল চোখমুখ করে বললেন,
‘ আমি অল্প কথার লোক। যা বলার সরাসরি বলতে পছন্দ করি। সেদিন আপনার ভাগ্নী প্রিয়কে দেখে আমার বড় ছেলে শিহাবের মনে ধরেছে। আমার বাড়িওয়ালিরও পছন্দের। আপনাদের বাড়ির দাওয়াত থেকে ফিরে প্রিয়’কে বিয়ে করবে বলে আবদার করছে ছেলে। আমি বলেছি, বাপ কয়েকদিন ধৈর্য ধর। নির্বাচনের যায় ঝামেলা কাটুক। ঠান্ডা মাথায় ব্যপারটা দেখবো। এই কয়দিন ঠিক চললেও। গতরাত থেকে ছেলে আমার বেঁকে বসেছে। ভোরেই এখানে এসে বিয়ের কথাবার্তা পাকা করবে।
সাথে বাড়িওয়ালিও যোগ দিয়েছে। তাই সকাল সকাল প্রিয়’র হাত চাইতে চলে আসলাম। যদিও আপনার ভাগ্নীকে আহামরি তেমন কিছু আমার লাগেনি। ওইতো দেখতে সুন্দরীই যা। আজকাল বিয়ের বাজারে দেখতে সুন্দর হলেই চলে? বাবার ব্যাংক ব্যালেন্সও থাকতে হয়। তাছাড়া কি আছে বাবার? ওইতো শহরের ডাক্তার। আমাদের সামনে এসব ডাক্তার-ফাক্তার পান্তা ভাত। তবুও ছেলে আর বাড়িওয়ালির পছন্দ। তাই মানা করতে পারিনি। শতহোক এই বিশাল সয় সম্পত্তি সব তো তাদেরই জন্য।’
সব শুনে হতভম্ব প্রিয়। ভয় শঙ্কা চেপে ধরেছে মন। সেই সাথে চোখমুখে প্রচন্ড বিরক্তি। প্রিয়’র মনে হলো মেজবাহ সাহেব লোকটা প্রচন্ডরকম অহংকারী আর অশিক্ষিত একটা মানুষ। যার কথা বলার নূন্যতম ভদ্রতা নেই।
মেজবাহ সাহেবের দাম্ভিক কথা বার্তায় আয়েশা বেগমেরও ভালো ঠেকলো না। রাগ হলো খুব। রাগ চাপিয়ে ভদ্রতার হাসি হেসে বললেন,
‘তো কি করে শিহাব?’
‘ আমার ছেলেকে আবার কি করতে হবে? ও কিছু করলে আমার এত এত সম্পত্তি কে খাবে?’
মেজবাহ সাহেবের দাম্ভিক আওয়াজ। ঠোঁট মেলে আবারো হাসলেন আয়েশা বেগম। চোখমুখে চাপা ক্রোধের চমক। খানিক চুপ থেকে বলল,
‘ বেকার আপনার ছেলে? বিয়ের পর বউকে কি খাওয়াবে? বাপের কামাই!’
আয়েশা বেগমের কথায় মেজবাহ সাহেব রেগে গেল। দৃঢ় কন্ঠে বলল,
‘ বাপের এত আছে ছেলেকে কেন করতে হবে?’
আয়েশা বেগম কথা উত্তরে কিছু বললেন না। চোখ বাঁকিয়ে শিহাবকে জিজ্ঞেস করল সরাসরি
‘ পড়াশোনা কতদূর তোমার? ‘
শিহাব বুক ফুলিয়ে বললেন, ‘ এইট পাশ’
আয়েশা বেগমের হাসিটা আরো গাঢ় হলো। মেজবাহ সাহেবের দিক চোখ ঘুরিয়ে বেশ খোশমেজাজে বলল,
‘ আমাদের প্রিয় এবার নিউ টেনে। আপনার ছেলে থেকে পড়ালেখায় দুই ক্লাস উপরে। দেখতে শুনতেও মাশাল্লাহ। জানেননি তো আজকাল বিয়ের বাজারে সুন্দরী মেয়েদের কি ডিমান্ড। বড় বড় বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে। বাপের কিছু থাক না থাক, মেয়ে সুন্দরী চাই। সেখানে আপনার ছেলের প্রিয়কে বিয়ে করার মত কি আদৌ কোন যোগ্যতা আছে। বাপের কামাইয়ে আয়েশ করা ছাড়া তো গুন দেখছিনা কোন।’
রেগে গেল মেজবাহ সাহেব। হুঙ্কার দিয়ে বললেন,
‘ এত বড় সাহস আমার পোলারে অপমান।জানেন আমি কে?’
‘ আপনি যেই হোন না কেন। তা দেখার বিষয় না। আমাদের মেয়েকে এমন মেরুদণ্ডহীন ছেলের হাতে দিবো না।’
‘ কাজটা ঠিক করলেন না। এর ফল বড্ড খারাপ হবে।’
‘ দেশে আইন এখনো বেঁচে আছে। কোনকিছু করার চেষ্টা করলে বাপছেলেকে জেলের ঘানি টানতে হবে।’
বলতে বলতে আয়েশা বেগম সোফা ছেড়ে উঠলেন। ঠোঁটে চমৎকার হাসি টেনে মেজবাহ সাহেবের দিক তাকিয়ে বললেন,
‘ যা নিয়ে এসেছেন সাথে করে নিয়ে যাবেন। আর হ্যাঁ , চুলায় চা করছি খেয়ে যাবেন অবশ্যই।’
মেজবাহ সাহেব তেড়ে হুড়মুড়ে বেরিয়ে গেলেন। প্রিয় খালার দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে চেয়ে। মানুষটাকে রোজ নতুন নতুন রূপে দেখছে। কি নিদারুণ সাহস নিয়ে মেজবাহ সাহেবের অপমানের জবাব দিয়েছে। তার মা হলে কি এমন করে ওই লোকটাকে জবাব দিতে পারতো? কোনদিন পারতো না বোধহয়।
সারারাত জেগে জয়ের আনন্দ উল্লাস করে ভোর চারটায় বাড়ি ফিরেছে সবাই। বিছানায় শুতেই চোখ লেগে এসেছে শতাব্দের। গভীর ঘুমে তলিয়ে। আচমকা সমুদ্র এসে ডাকলো। ভ্রু কুঁচকে চোখ মেলল শতাব্দ। মুখ জুড়ে একরাশ বিরক্তি। সমুদ্রের চোখমুখে ভয়। ভাইকে এভাবে জাগাতে চায়নি। কিন্তু ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। না জানালেই নয়। সমুদ্র কাচুমাচু স্বরে বলল,
‘ ভাই..ভাই মেজবাহ চেয়ারম্যান শিহাব এলাকায় এসেছে।’
শতাব্দের কুঁচকানো কপালটা আরো কুঁচকে গেল। গম্ভীর কন্ঠে আওড়াল,
‘ কোথায়?’
‘ প্রিয়দের বাড়িতে। পুরো পরিবার সহ। বোধহয় সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে।’
তড়াক করে উঠে বসলো শতাব্দ। চিৎকার করে বলল,
‘ ওই বা*স্টার্ডটার এত বড় সাহস! আমার জিনিসে ওর নজর।’
রাগে দাঁত কিড়মিড় করছে। থরথর কাঁপছে শতাব্দ। মাথা অবশ হয়ে আসছে। নির্বাচনে গো হারা অপমানের শোধ এভাবে নিতে চাইছে শিহাব। শতাব্দের দু*র্বল জায়গায় আঘা*ত করে!
তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠল শতাব্দ। গায়ে শার্ট জড়াতে জড়াতে বলল,
‘ আই উইল কি*ল দ্যাট বাস্*টার্ড।’
ভাইয়ের ক্রোধান্বিত চোখমুখ দেখে ঘাবড়ে গেল সমুদ্র। শান্ত করার চেষ্টায় বলল,
‘ ভাই শান্ত হও। এখন কিছু করলে বড় ঝামেলা বাঁধবে। আগামীকাল বাবার শপথ পাঠের পর না হয় ব্যাপারটা….
জোর ধমকে থামিয়ে দিলো শতাব্দ। রাগে দাঁত চিবাতে চিবাতে বলল,
‘ কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবো আমি? আমার জিনিসে নজর দেওয়াত সাহস কি করে হয় ওর! ওকে আজ….
বলতে বলতে বেরিয়ে গেল শতাব্দ। ভাইয়ের রাগ সম্পর্কে ধারণা আছে সমুদ্রের। ভীষণ ভয়ংকর। কি থেকে হয়। এবার নিজের উপর রাগ হচ্ছে সমুদ্রের। এখনি ব্যাপারটা ভাইকে কেন জানাতে গেল! উফ! এখন কি থেকে কি হবে কে জানে!
বিকালে পাড়ায় পাড়ায় খবর ভাসছে। চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলে শতাব্দ শিহাবকে বেদম পি*টানো পিটি*য়েছে। হাত পা অচল। মাথা ফে*টে ভাগ। গুরুতর অবস্থা ছেলেটার। লোকজন ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। ভীষণ সিরিয়াস অবস্থা। কেউকেউ বলেছে, নির্বাচনকে ঘিরে মা*রধর করেছে। কেউ আবার মেয়ে জনিত কারণে বলছে। কথাটা ভাসতে ভাসতে প্রিয়দের বাড়িতে এলো। খালা প্রিয় দুজনেই চিন্তিত। দুইজনের চিন্তা দুই রকম।
দুদিন পর বিচার সালিশ বসবে। সেখানে নিশ্চয়ই প্রিয়’র নামও উঠবে। লোকে পাঁচকান জানবে। প্রিয়’র বদনাম হবে। চিন্তায় মাথা ফাটছে খালার।
অন্যদিকে শতাব্দের চিন্তায় বিভোর প্রিয়। মা*রামা*রিতে শতাব্দের কিছু হয়নি তো আবার? ঠিক আছে তো সে। এই যে শিহাবের বাড়ি থেকে সম্বন্ধ আসলো। তা শুনেই কি এত রেগে! তার রাগের প্রকো*প কি প্রিয়’র উপরও পড়বে!
কেউ ঠিক বলেছে, প্রেম সর্বনা*শা। দিন দুনিয়া সব ভুলায়।
চিন্তায় চিন্তায় বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামালো। চারিপাশ কালো করে অন্ধকার নামছে। সন্ধ্যা বাতি জ্বালিয়ে নিজের ঘরে যাচ্ছিল প্রিয়। এমন সময়ই সদর দরজার কড়া নড়ল। দরজা খোলার জন্য পা বাড়াল। তার আগেই খালা এসে দরজা খুলল। শতাব্দ এসেছে। থেমে গেল প্রিয়। অগোচরে দরজার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। শতাব্দকে ভীষণ এলোমেলো দেখাচ্ছে। চোখজোড়া মাত্রাতিরিক্ত লাল। হাতের ব্যান্ডেজটা র*ক্তে ভিজে। মারামারিতে বোধহয় আবারো লেগেছে। দূর আড়াল থেকে সবটা পরখ করছে প্রিয়।
এই সময় শতাব্দকে দেখে গম্ভীর হলো আয়েশা বেগম। কপালে চিন্তার ছাপটা আরো গাঢ় হলো। আবার ঝা*মেলা হলো না তো কোন? শতাব্দের বিধস্ত অবস্থায় দেখে চিন্তাটা আরো বাড়ল। ভিতরে এসে বসতে বলল। বিব্রত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘ চা করবো?’
‘ হুম, কড়া লিগারে।’
আয়েশা বেগম চা করতে চলে গেলেন। দূর থেকে দেখছে প্রিয়। খালাকে এতো স্বাভাবিক শান্ত দেখে হতভম্ব। গতকালকের ঘটনার পর, শতাব্দের সাথে খালার এমন স্বাভাবিক আচরণ হওয়ার তো কথা নয়। খটকা লাগলো প্রিয়। ভয়ে জড়সড় দাঁড়িয়ে রইল। এর মাঝে শতাব্দের সাথে একবার চোখাচোখিও হলো। ভীষণ শান্ত স্বাভাবিক দৃষ্টি তার। ভিতরে কি চলছে বোঝার কায়দা নাই। প্রিয়’র ভয়টা আরো বাড়ল। এই শান্তি বড় কোন ঝড়ের পূর্বাভাস নয় তো!
খানিক বাদে চায়ের ট্রে হাতে ফিরে এলো খালা। শতাব্দের দিক এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে সামনের সোফায় যেয়ে বসলো। বলল,
‘ তুমি এই সময় এখানে। সব ঠিক আছে তো।’
আয়েশা বেগম বেশ কায়দা করে কথা বলছে। চোখমুখ স্বাভাবিক ভীষণ।গতকাল সে যে তাদের সম্পর্কের কথা জেনে গিয়েছে। সেই কথা ঘুনাক্ষরে আঁচ করতে দিবেনা শতাব্দকে। শতাব্দ চায়ের কাপ উঠিয়ে চুমুক দিলো। বেশ স্বাভাবিক শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ আমি প্রিয়’কে ভালোবাসি। বিয়ে করতে চাই।’
আয়েশা বেগম চমকে উঠলেন। চোখমুখে উত্তেজনা সামান্য। বিমূঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ আমার থেকে কি রকম উত্তর আশা করছ?’
নড়েচড়ে বসলো শতাব্দ। বেশ ফরমাল হয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ পজিটিভ উত্তরের।’
‘ কেন রাজি হবো? তোমার বাবার অনেক টাকা আছে তাই! নাকি গ্রামের চেয়ারম্যান…
থামিয়ে দিলো শতাব্দ বলল,
‘ কোনটাই না। আমি প্রিয়’কে নিজ যোগ্যতায় অর্জন করতে চাই। প্রিয় এখনো ছোট। আমার মেডিক্যাল কমপ্লিট করে বিসিএস দিতে মোট পাঁচ বছর সময় লাগবে। এই কয়’বছর প্রিয় আপনার কাছে আমার আমানত হয়ে থাকবে। কোন সম্বন্ধ যেন না আসে। আশাকরি, আমার আমানতের খিয়ানত করবেন না আপনি।’
আয়েশা বেগমের গম্ভীর চাহনি। বললেন,
‘ যদি তোমার কথা না রাখি।’
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তীর্যক হাসলো শতাব্দ। শীতল কন্ঠে বলল,
‘ তাহলে ক্ষমতার জোর দেখাতে বাধ্য হবো। বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাবো আপনার ভাগ্নিকে।’
আয়েশা বেগম চমকালো। শতাব্দের দৃষ্টিতে সুপ্ত ক্রো*ধ। চোখজোড়া লাল টকটকে। ভীষণ ভ*য়ঙ্কর! শতাব্দের এই রূপ দেখেনি আগে। ভালোবাসার জন্য এমন পাগলামো। তবে কি শতাব্দ সেই মানুষটা থেকে ভিন্ন!
বিড়বিড় করে বলল শতাব্দ,
‘ আমার প্রিয়কে চাই। মানে চাই। ওকেই লাগবে আমার।’
চলবে……..