ফিলোফোবিয়া
ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির )
৪৩.
( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )
সমাবেশের ব্যাপারটা তাজা খবর হয়ে নিউজফিড়ে ঘুরঘুর করছে। ছোট বড় বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেল গুলো ব্যাপারটা টেনে বড় ইস্যু বানাচ্ছে। আজেবাজে শিরোনাম দিয়ে বিরাট স্ক্যান্ডাল বাঁধাচ্ছে। কিছুকিছু সাংবাদিক প্রিয়’র চরিত্রেও দাগ লাগাচ্ছে। রাত থেকে পরিচীত অপরিচীত অনেকের ফোন আসছে। কেউকেউ সান্ত্বনা দিচ্ছে, কেউ আবার কা*টা ঘাঁ’য়ে ঘাঁটা দিচ্ছে। এসবের জন্য প্রিয় নিজেকে অনেক আগেই প্রস্তুত করে রেখেছে। সত্যিটা সামনে এলে, এমন বিব্রতকর পরিস্থীতির সম্মোখীন হতে হবে। তা সে জানত। হয়তো তার ক্যারিয়ারেও ধস নামবে। তবুও সত্যিটা সামনে আনার দরকার ছিল। অন্তত সবটা শেষ করার জন্য হলেও, এমনটা করার প্রয়োজন ছিল। নিজেকে যথাসাধ্য শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। গতকাল কাজের সুবাদে লাইভে এলে, সেখানে মানুষজন অপ্রস্তুত, বিব্রতকর প্রশ্ন ছুঁ*ড়ে। প্রথমে শান্ত ভাবে ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলেও, একটা সময় হাল ছেড়ে দেয়। অতিষ্ঠ হয়ে লাইভ থেকে বেরিয়ে আসে। প্রিয়’র মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে, কিছুদিনের জন্য কাজ থেকে ছুটি দিয়েছে প্রত্যাশা ম্যাম।
সকাল থেকে বাড়িতে প্রিয়। ক্লাস নেই। শতাব্দের’ও ছুটি আজ। ভোর সকালে বেরিয়েছে কোথাও। পাশের পার্কে জগিং-এ হয়তো। নাস্তা সেরে চা নিয়ে বারান্দায় বসেছিল প্রিয়। উজ্জ্বল সকালের চকচকে রোদ। ভেজা চুলের আড়াল হতে মুখে এসে লাগছে। চোখ খিঁচে অন্যদিক ঘুরে বসলো প্রিয়। চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়াতেই বাহিরের হৈচৈ আওয়াজ কানে এসে লাগল। অভিলাষা বেগম কারো উপর চিৎকার করছে। কপাল কুঁচকে নিলো প্রিয়। অভিলাষা বেগমকে বরাবরই শান্ত স্বভাবের। কঠোর, বিচক্ষণ মানুষ। অত্যন্ত রেগে গেলেও খুব কায়দা করে শান্ত হয়ে সবকিছু মিটমাট করে। উনার উঁচু আওয়াজ শুনেনি কখনো। চেয়ার ছেড়ে উঠল প্রিয়। বড়বড় পা ফেলে দরজার সামনে দাঁড়াল। এবার পুরুষালি কান্নাভেজা আওয়াজে কানে এলো। ছটফট পা চালিয়ে ড্রইং রুমের দিক এগিয়ে গেল। শোয়েব হককে দেখেই থমকে গেল প্রিয়। দরজা ধরে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করল।
অভিলাষার সামনে হাত জোর করে কান্না করছে শোয়েব হক। ‘ আমার মেয়েটার সাথে একটাবার দেখা করতে দে বোন’ বলে বারবার কান্নাভেজা আহাজারি করছে। অভিলাষা’র কঠোর শক্ত আওয়াজ,
‘ ও তোমার মেয়ে না ভাই। ও আয়শার মেয়ে। এতবছর যাদের কোন খবর নেওনি। জন্মের আগেই যার মাকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছিলে তার উপর আবার কিসের অধিকার?’
শোয়েব হকের কান্নাভেজা আওয়াজ,
‘ আমি জানতাম না প্রিয় আমার মেয়ে। আয়শা বলেছিল, গর্ভেই আমার সন্তান মে*রে ফেলেছে।’
তাচ্ছিল্য হাসল অভিলাষা। বলল,
‘ তো কি করবে? তোমার মত কাপুরুষের কাছে সত্যি বলবে? যে একদিন অ*ন্যায় অপমান করে রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছিল তাকে! তুমি মানুষের পর্যায় পড়ো না। তুমি একটা অমানুষ!’
কাতর দৃষ্টিতে তাকাল শোয়েব। নিস্তেজ কন্ঠে আওড়াল,
‘ ছবি আমাকে ফাঁ*সিয়েছিল। তোর সংসার বাঁচাতে আমাকে বিয়ে করতে হয়েছিল। সত্যিটা জেনেও তুই এভাবে বলছিস?’
অভিলাষা আরো তেতে গেল। চিৎকার করে বলল,
‘ আমি তোমাকে বলেছিলাম আমার সংসার বাঁচাতে ছবিকে বিয়ে করতে? আর কোন সত্যির কথা বলছো? আমার শ্বশুরের টাকা দেখে তুমি ছবিকে বিয়ে করেছিলে।’
‘ অভিলাষা!’
‘ চেঁচাবে না ভাই। এটা সত্যি। তুমি টাকার লোভে পড়ে আয়শাকে ছেড়ে ছবিকে বিয়ে করেছ। তোমার সব ভালোবাসা অভিনয় ঠুনকো ছিল। যেই মেয়েটা তোমাকে ভালোবেসে নিজের বাড়িঘর সব ছাড়ল। তুমি টাকার মহে পড়ে তাকেই ছেড়ে দিয়েছিলে ভাই। এমনকি যখন তোমার স্ত্রী ওদের গ্রামের লোকের সামনে অপদস্ত করল তুমি চুপ ছিলে। তখন তোমার বীরত্ব কোথায় ছিল? আয়শার মৃ*ত্যু শোকে তুমি এতবছর দেশের বাহিরে ছিলে। তাই বলে মরে যাওনি। যে তুমি আমার সহানুভূতি পাবে!’
শোয়েব হক অস্থির হয়ে পড়ল। তেজি কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ আমার মেয়ে কোথায়? আমি আমার মেয়ের সাথে দেখা করব।’
অভিলাষা বিরক্তি কন্ঠে বলল,
‘ আমার মনে হয়না প্রিয় তোমার সাথে দেখা করবতে চাইবে। তোমাকে যথেষ্ট ঘৃ*ণা করে ওঁ।’
শোয়েব হক তড়িঘড়ি আওয়াজে বলল,
‘ ঘৃ*ণা করলে এত মানুষের সামনে আমার মেয়ে বলে নিজেকে কেন পরিচয় দিবে? ও আমার মেয়ে। অনেক হয়েছে। এতবছর আয়শা আমার থেকে আমার মেয়েকে লুকিয়ে রেখেছে। আর না। এবার আমি ওকে নিয়ে যাবো সাথে।’
অভিলাষা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
‘ যেই জানলে প্রিয় তোমার মেয়ে অধিকার খাটাতে চলে এলে। যখন আয়শা গ্রামে গিয়ে সম্পর্ক বাঁচাতে আহাজারি করছিল, তখন তোমার এই পিতৃপ্রেম কোথায় ছিল? যখন গ্রামের লোক তোমার মেয়েকে ব্যা* বলছিল তখন কেন চুপ ছিলে? জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না। যোগ্যতা লাগে। যা তোমার নাই!’
অনুতপ্তার আগুনে শোয়েব পুড়ছে। চিৎকার করে বলল,
‘ আমি আভাস করেছিলাম প্রিয় আমার মেয়ে। কিন্তু তা যুক্তি’র সামনে বরাবরই পরাজিত। তখন আমি প্রতিবাদ করতে চেয়েও পারিনি। লুবনার ভবিষ্যৎ ভেবে! আমি প্রিয়’কে…’
এদিক সেদিক তাকাতেই শোয়েব চোখ আটকালো দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয়’তে। থরথর করে কাঁপছে। ভ*য়ে মুখ লুকিয়ে আছে। মেয়ের দিকে ছুটে গেল শোয়েব। হাত বাড়াতেই প্রিয় দু’কদম পিছিয়ে গেল। ভেজা টলমলে ঘৃ*ণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
কেঁদে ফেলল শোয়েব হক। কাঁপা কাঁপা হাত জোড়া উঁচিয়ে মেয়ের দিক এগিয়ে গেল। কান্নাভেজা কাঁপাকাঁপি কন্ঠে প্রিয় বলল,
‘ আমাকে ছুবেন না। আপনাকে ঘৃ*ণা হয় আমার!’
শোয়েব হক থমকে গেল। ব্যথাতুর কাতর দৃষ্টিতে মেয়ের ফিরিয়ে নেওয়া মুখখানায় চেয়ে রইল। কান্নাভেজা অস্পষ্ট কন্ঠে বলল,
‘ আমাকে একটা বাত বলার সুযোগ দে। আমার কথা একবার শুন মা।’
ঘাবড়ে গেল প্রিয়। প্রথমবার নিজের জন্মদাতা পরিচয়ে মানুষটাকে দেখে প্রচন্ড আঘা*ত পেয়েছে হয়তো।হাতপা কাঁপছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ঝাড়ি দিয়ে হাত ঠেলে দিলো। অচেতন, উন্মাদের মত আচরণ করছে। চিৎকার করে বলছে,
‘ দুরে থাকুন আমার থেকে।’
শোয়েব হক শুনল না। এতবছর পর মেয়ের পরিচয় পেয়ে সাথে সাথে টিকেট কে’টে দেশে এসেছে। মেয়েটাকে একবার জড়িয়ে ধরবে বলে। ফ্লাইটের পুরোটা সময় ছটফট করে কাটিয়েছে। এই সময়টার কত অপেক্ষা করেছে। এখন এই কাঙ্ক্ষিত সময়টায় এসে কি করে পিছিয়ে যাবে সে?
একপ্রকার বোঝানোর জেদ ধরে এগিয়ে গেল মেয়ের দিকে। প্রিয় হাউমাউ করে কাঁদছে। শ্বাস ফেলতে কষ্ঠ হচ্ছে তার। যেই শোয়েব হাত বাড়াবে, অমনি শতাব্দ এসে দাঁড়াল মাঝে। ভয়ে কাঁপতে থাকা প্রিয়কে জড়িয়ে নিলো বুকে। শোয়েবের দিকে আঙুল তাক করে ক্রোধে চেঁচিয়ে উঠল,
‘ হাত বাড়াবেন না আমার বউয়ের দিকে।’
শোয়েব শুনল না। এগিয়ে আসতে চাইল। প্রিয় যেন আরো ঘাবড়ে গেল। জড়সড় হয়ে শতাব্দের বুকে লেপ্টে রইল। শোয়েবের কাঁধে হাত রেখে বাঁধা দিলো শতাব্দ। মাঝে এক হাত দূরত্ব রাখল। গম্ভীর কন্ঠে আওড়াল,
‘ আমার বউয়ের থেকে দূরে থাকতে বলেছি।’
‘ প্রিয় আমার মেয়ে। ওর উপর আমার অধিকার বেশি!’
শোয়েবের অকপটে আওয়াজ। শতাব্দ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। প্রিয়’কে ছেড়ে দু’পা এগিয়ে শোয়েবের মুখোমুখি দাঁড়াল। ঝুকে এসে শোয়ের বুকে আঙুল ঠেকিয়ে গম্ভীর শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ যখন ওদের আপনাকে প্রয়োজন ছিল, তখন এই অধিকার কোথায় ছিল! আপনি বাবা না কাপুরষ। না ভালো স্বামী হতে পেরেছেন, না ভালো বাবা। আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। নয়তো জোর করে বের করতে বাধ্য হবো!’
শোয়েব আ*হত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। যেই ভাগিনা একটা সময় তার ভক্ত ছিল, আজ তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাইছে! নিজের সন্তানের দৃষ্টিতে অগাধ ঘৃ*ণা। এত ঘৃ*ণা, অভিশাপ নিয়ে কি করে বাঁচবে সে? কোনদিন কি ক্ষমা মিলবে!
শোয়েব হক বেরিয়ে গেল।
শতাব্দ প্রিয়’কে ঘরে নিয়ে এলো। বিছানায় বসালো। প্রিয়’র তখনো থরথর কাঁপছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। শরীর প্রচন্ড রকম ঠান্ডা। শতাব্দ পানি এগিয়ে দিলো। প্রিয় ঢকঢক করে পুরোটা পানি শেষ করল। প্রিয়’র হাত জোড়া ধরে, হাঁটু গেড়ে মুখোমুখি বসে আছে শতাব্দ। কপাল কুঁচকে চিন্তিত মুখ করে চেয়ে। প্রিয়’র এনজাইটির সমস্যাটা দিনদিন বাড়ছে। এভাবে বাড়তে থাকলে আদৌ কি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে প্রিয়? প্রিয়’র অশ্রুসিক্ত চোখজোড়া মুছে দিতেই। ভীতু কন্ঠে হুড়মুড়িয়ে প্রিয় বলল,
‘ ওই লোকটা কেন ফিরে এলো। কেন এসেছে উনি। উনাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলুন। আমার ভয় হয় তাকে! প্রচন্ড ভয়..’
অনবরত অস্থির কন্ঠে, বিড়বিড়িয়ে বলে যাচ্ছে প্রিয়। শ্বাস কষ্ঠ হচ্ছে এখনো। শতাব্দ কাছে এসে জড়িয়ে ধরল। শতাব্দের মুঠোবন্দী হাতটা আরো শক্ত করে খা*মচে ধরল। শতাব্দ কানের কাছে চুমু দিলো। আস্বস্ত স্বরে বলল,
‘ শান্ত হও প্রিয়। আমি আছি। সবঠিক করে দিবো।’
চোখ বুজে শতাব্দকে আরো শক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরল প্রিয়। ধীরেধীরে শান্ত হচ্ছে। নিশ্বাসের গতি স্বাভাবিককে নামছে। প্রিয় জানে শতাব্দকে ঠকাচ্ছে সে। এই মানুষটা থেকে তার দূরে থাকা উচিত। কিন্তু পারছেনা। মানুষটা কাছে এলে এমন অদ্ভূতরকম শান্তি লাগে যে, সব ভুলে তাতেই ডুবে থাকে! অনুভূতিরা কি কোনদিন পরিবর্তন হবেনা। বারবার কেন শতাব্দ’তে আটকে যায়।
চলবে……
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
ফিলোফোবিয়া
ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির )
৪৪.
( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )
আজ অনেকদিন পর ক্লাসে এসেছে প্রিয়। পরিস্থীতি আগের তুলনায় কিছুটা স্বাভাবিক হলেও। লোকজনের কানাঘুষা চলছে এখনো। ক্লাস শেষে ইরার সাথে ক্যানটিনের দিকে যাচ্ছিল। আচমকা পেছন থেকে কেউ এসে ধাক্কা দিলো। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটল যে, তাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেল প্রিয়। হাতের কনুই ছিলেছে, গোড়ালিতে লেগেছে। ইরা ছুটে এসে টেনে তুলল। ব্যথাতুর হাত নিয়ে পেছনে ফিরল প্রিয়। হতভম্ব দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। লুবনা এসেছে। রাগে ক্ষো*ভে ফোসফাস করছে। প্রচন্ড বিরক্ত হলো প্রিয়। চেঁচিয়ে বলল,
‘ কি সমস্যা তোমার?’
লুবনা আরো বেশি ফুলেফেঁপে উঠল। ধুপধাপ পা ফেলে প্রিয়’র দিক এগিয়ে গেল। প্রিয়’র চুলের মুঠি ধরল। ছাড়াতে চেষ্টা করল প্রিয়। ইরা এসে আটকাতে চাইলে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। লুবনা শরীরের সব শক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে প্রিয়’র চুল। রাগে গরগর করে বলল,
‘ রা*ক্ষসী ডাই*নি শতাব্দ’কে ছিনিয়ে মন ভরেনি? এখন আমার বাপকেও তোর চাই! আমার সবকিছু ছিনিয়ে নিতে এসেছিস। কপি ক্যাট, ব্লাডি বিচ, এত সাহস তোর। আজ তোকে খু*ন করেই এই কেচ্ছা শেষ করব। যেমন মা তেমন মেয়ে দুইটাই খা** ব্যা**’
তেতে উঠল প্রিয়। রেগে জোরে লুবনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। লুবনা তেড়ে আসলে তার হাত মুচড়ে পিঠের সাথে ধরল। বেসামাল হওয়ায় লুবনা নিজেকে ছাড়াতে পারল না। প্রিয় আরো শক্ত ভাবে এঁটে ধরল। রাগে কিড়মিড়িয়ে বলল,
‘তোমার কাছে এখন যা যা আছে তা সব আমার হওয়ার কথা ছিল। চাইলেই অধিকার খাটিয়ে, আইন টেনে এক্ষুনি সবকিছু ছিনিয়ে নিতে পারি। কিন্তু তা করব না। যেই লোকটাকে বাপ বলে পরিচয় দিতে আমার রুচিতে বাঁধে। তার কামানো সম্পদে ভাগ বসাবো? এত নিম্ন আত্মসম্মানহীন মেয়ে আমি না। আর রইল শতাব্দের কথা। উনি সবসময় আমার ছিল, আছে আর আমারই থাকবে। অনেক বছর তো আমি ছিলাম না। তখন নিজের করতে পেরেছিলে? পারবেনাও না। কারণ শতাব্দের মন মস্তিষ্ক জুড়ে শুধুই প্রিয়।’
গর্জিয়ে উঠল লুবনা। প্রিয়’কে আঘা*ত করতে চাইল। পারল না। ইরা এসে চেপে ধরল। উশখুশ করছে লুবনা। চড়া ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলো প্রিয়। শান্ত গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ হুশ! আর একটা কথাও না। চেঁচালে জিব ছিঁড়ে ফেলব। অনেক হয়েছে। জীবনে যা অ*ন্যায় করেছ, তার শাস্তি পেতে প্রস্তুত হও। আর মাত্র কয়েকটা দিন। খুব তাড়াতাড়ি চৌদ্দ শিকের ভেতর ঢুকবে তুমি। সেই ব্যবস্থা করে রেখেছি।’
আশেপাশে লোক জমেছে। লুবনাকে ছেড়ে দিলো প্রিয়। ইরার সাথে রিকশা চড়ল। পেছন থেকে লুবনা আ*ক্রোশ পূর্ণ চাহনিতে চেয়ে রইল।
ক্লান্ত শরীরে ঘরে ঢুকতে হতভম্ব প্রিয়। পা ঝুলিয়ে, বিছানায় দু’হাত ভর দিয়ে বসে আছে শতাব্দ। চেহারা ভীষণরকম গম্ভীর । এসময় শতাব্দ এখানে দেখবে, আশা করেনি প্রিয়। গতরাতে তার নাইট শিফট ছিল। সাধারণত বাড়ি ফিরে ঘুমে তলিয়ে থাকার কথা।
এক পলক দেখে, বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকল। আয়নার সামনে ব্যাগ রাখতেই, পেছন থেকে শতাব্দের গম্ভীর আওয়াজ ভেসে এলো,
‘ গতরাতে কোথায় ছিলে প্রিয়?’
কয়েক মুহূর্তের জন্য থামল প্রিয়। শতাব্দের প্রশ্নে চমকালেও, তা প্রকাশ করল না। বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,
‘ বাড়িতে। বাবা মায়ের কাছে।’
শতাব্দ আগের মত গম্ভীর গভীর কন্ঠে আওড়াল,
‘ কেন মিথ্যা বলছ? বাবার সাথে সকালে কথা হয়েছে। তুমি সেখানে ছিলেনা গতরাতে।’
প্রিয় চুপ। শতাব্দ ফোনটা প্রিয়’র দিক এগিয়ে দিলো। যেখানে গতরাতে হোটেলের ছবি গুলো ভেসে উঠল। শান্ত কন্ঠে শতাব্দ জিজ্ঞেস করল,
‘ তোমার সাথে লোকটা কে? গতরাতে পাঁচ তারকা হোটেলে উনার নামে বুক করা রুমে তুমি ছিলে! কেন?’
কানের দুল খুলতে খুলতে তাচ্ছিল্য স্বরে উত্তর দিলো প্রিয়,
‘ লোক লাগিয়ে আমার উপর নজর রাখছেন?’
শতাব্দের শক্ত অকপট আওয়াজ,
‘ তোমার সেফটি’র জন্য দরকার।’
‘ সন্দেহ করছেন?’
‘ সন্দেহ করার মত কাজ নয়কি?’
‘ যদি বলি সে আপনজন?’
ক্ষে*পে উঠল শতাব্দ। প্রিয়’র গাল চেপে ধরে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে নিলো। রাগী কন্ঠে গরগর করে বলল,
‘ মে*রে ফেলবো! তুমি একান্তই আমার। শুধু আমার প্রিয়। হেয়ালি না, স্পষ্ট উত্তর জানতে চাই।’
শতাব্দের অকপটে রাগী দৃষ্টিতে অপলক চেয়ে আছে প্রিয়। কি ভয়*ঙ্কর তার রাগ! কেননা তাকে আরেকটু রাগিয়ে দেওয়া যাক! ঠোঁট মেলে হাসল প্রিয়। বলল,
‘ আপনার এক্স ভার্সিটি এসেছিল।’
কপাল কুঁচকে নিলো শতাব্দ,
‘ আমার এক্স?’
‘ লুবনা!’
রেগে গেল শতাব্দ,
‘ ও আমার এক্স না!’
প্রিয় কানে তুলল না। কথা কে*টে বলল,
‘ তুমুল ঝামেলা বাঁধিয়েছে। আমার চুল টেনে অর্ধেক উঠিয়ে ফেলেছে!’
কপালের রগ ফুলে উঠল শতাব্দের। রাগে উশখুশ করছে। শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে গম্ভীর গর্জনী দিয়ে বলল,
‘ ওই কু**** অমানুষটার এতো বড় সাহস ওকে আমি…..’
এইটুকু বলে থেমে গেল শতাব্দ। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। প্রিয়’র হাত টেনে নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে নিলো। চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ তুমি ঠিক আছো? কোথাও লাগেনি তো!’
হাত ছাড়াতে চাইল প্রিয়। ছাড়ল না শতাব্দ। প্রিয় ভ্রু নাচিয়ে বলল,
‘ আপনার কি ধারণা আমি এতই দুর্বল, যে লুবনা এসে আমাকে মে*রে চলে যাবে। আমি তাকিয়ে দেখবো? আমিও তার হাত মচকে দিয়েছি। দেখেন গিয়ে, কোনো হাসপাতালে পড়ে আছে হয়তো।’
ভ্রু যুগল উঁচিয়ে নিলো শতাব্দ। বলল,
‘ গুড! দ্যাটস মাই গার্ল।’
প্রিয়’র দিক দু’কদম এগিয়ে গেল। আলতো করে থুতনি তুলে চোখে চোখ ডোবাল শতাব্দ। ঠোঁটে আলতো আঙ্গুল ছুঁয়ে দিতে দিতে গভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘আমার প্রিয় অগ্নির মত পবিত্র, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। এবার সত্যিটা বলো, ওই লোকটা কে ছিল? কি তোমার উদ্দেশ্য?’
শতাব্দের নেশাতুর গভীর দৃষ্টিতে বিবস চেয়ে আছে প্রিয়। ঠোঁট মেলে কিঞ্চিৎ হাসল। বলল,
‘ সত্যি জানতে চান?’
‘ হুম’
‘ তাহলে আজ বিকালে চলুন। নিজেই তার সাথে পরিচয় হয়ে নিন।’
প্রিয়’র রহস্যময়ী চাহনি আর কথাবার্তায়, কপাল কুঁচকে চেয়ে রইল শতাব্দ।
ঝিমিয়ে যাওয়া বিকাল। আকাশ জুড়ে কালো মেঘেদের ছড়াছড়ি। বৃষ্টি নামবে কি? হয়তো! গাড়ি এসে গতকালকে পাঁচ তারকা হোটেলের সামনে থামলো। শাড়ির কুচি গোছাতে গোছাতে নেমে দাঁড়াল প্রিয়। গাড়ি পার্কিং করে আসতেই দেখল কারো সাথে ফোনে কথা বলছে প্রিয়। ফোন ব্যাগে ঢুকাতে ঢুকাতে শতাব্দের উদ্দেশ্যে বলল,
‘ উনারা লাউঞ্জে আছে, আমাদের যেতে বলেছে।’
প্রিয়’র উচ্ছাসীত মুখখানায় চেয়ে রইল।উত্তরে কিছু বলল না শতাব্দ।
লাউঞ্জে ঢুকে সোজা পেছনের বাগানের পাশে পুলের দিক চলে গেল। সেখানে প্রিয়’র সাথে ছবিতে থাকা সেই লোকটাকে দেখা যাচ্ছে। পাশেই একজন বিদেশিনী মহিলা দাঁড়িয়ে। দ্রুত পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল প্রিয়। উচ্ছাসে আবেগাপ্লুত হয়ে বিদেশিনী মহিলাকে আলিংগন করল। হাত মেলানোর উদ্দেশ্যে লোকটা শতাব্দের দিক হাত বাড়িয়ে দিলো, বলল,
‘ হাই, আমি তানিম জাফর প্রিয়’র বড় ভাই। আর ও আমার ওয়াইফ ডক্টর ইডিলি বেথানি জাফর।’
শতাব্দ হতভম্ব। তার মানে উনি জাফর সাহেবের বড় ছেলে তানিম জাফর। আমেরিকায় ছিল এতবছর! পরিবারের বিরুদ্ধে বিদেশিনী বিয়ে করায়, যার সাথে জাফর সাহেব সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।
বিস্ময় ছাপিয়ে হাত বাড়ালো শতাব্দ। বলল,
‘ আমি ডক্টর আহসান খাঁন শতাব্দ। প্রি..
কথা কাটলো তানিম,
‘ উহু, বলতে হবেনা। আমি জানি, আমার বোনের বর। বোন জামাই! এত ওপেন ইন্ট্রো দিয়ে হবেনা। তুমি আমাদের না চিনলেও আমরা তোমাকে চিনি। প্রিয় তোমার কথা বলে রোজ।’
‘ সত্যি, রোজ বলে প্রিয়?’
ঠোঁটে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে প্রিয়’র দিক তাকাল শতাব্দ। কপাল কুঁচকে চোখ ফিরিয়ে নিলো প্রিয়, ইডিলির ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা কথায় মনযোগ দিলো।
বিকালের শেষ প্রহর পেরিয়ে গেছে অনেক আগে। চারিদিক আঁধার করে সন্ধ্যা নেমেছে। মেঘ ডাকছে। প্রিয় আমারা, ইসামের সাথে গল্প গুজবে মগ্ন। আমারা বয়স ছয়বছর, ইসাম সবে কথা আধোআধো কথা বলতে শিখেছে। মাত্র দুদিনেই প্রিয়’র সাথে মিশে গেছে। দূর থেকে তানিম সবটা দেখছে। বোনের বাচ্চাদের প্রতি স্নেহ মমতা দেখে চোখ ভরে এলো। বোনদের প্রতি তানিমের ছোট থেকেই অন্যরকম দুর্বলতা। ছোট থেকেই প্রিয় সবচেয়ে আদরের ছিল। যখন পুরো পরিবার তানিমের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। একমাত্র প্রিয়’ই পাশে ছিল। লুকিয়ে-চুরিয়ে যোগাযোগ রাখত। প্রিতীর মৃ*ত্যু সংবাদ শুনে দেশে এসেছিল। জাফর সাহেবের রুষ্টতার কারণে বাড়িতে আসেনি। কবর জিয়ারত করে আমেরিকা ফিরে গিয়েছিল। সেখানে ফিরে মূলত প্রিয়’র থেকেই পরিবারের সব খবরাখবর রাখতো। কিন্তু হ্ঠাৎ একদিন খালার মৃ*ত্যু সংবাদ পেল। সেই সাথে প্রিয়’র মানসিক অবস্থার কথাও জানলো। বরাবরই দূরে থেকেও বোনের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল। ধীরেধীরে প্রিয় স্বাভাবিক হলো। হ্ঠাৎ একদিন বলল, তার প্রতি*শোধ চাই। অতীতের কিছু রহস্য উদঘাটন করবে সে। প্রথমে অবাক হলেও, তেমন গুরুত্ব দেয় না। ছেলেমানুষী ভেবে কানে তুলেনি সে। হ্ঠাৎ একদিন খবর এলো ইমান্দিপুরের চেয়ারম্যানের ছেলেকে বিয়ে করেছে প্রিয়। প্রিয়’র উদ্দেশ্য বুঝতে দেরি হলো না তার। প্রিয় ছোট থেকে ভীষণ জেদি। বাঁধা দিলে মানবেনা।যা চায়, তা পেয়েই ক্ষান্ত হয়। তাই বোনের সেফটির জন্য সবরকম ব্যবস্থা করে দেয় সে। মানুষ লাগিয়ে সবরকম তথ্য জোগাড় করে দেয়। নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছে প্রিয়। আচমকা প্রিয়’র অসুস্থতার খবর এলো। দ্রুত সেদিকের কামকাজ গুছিয়ে দেশের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে।
ছেলেমেয়েদের খিলখিল হাসির শব্দে ধ্যান ভাঙ্গল তানিমের। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে হাসছে প্রিয়। তানিম এসে প্রিয়’র মুখোমুখি চেয়ারটায় বসল। প্রিয় হাস্যোজ্জ্বল কন্ঠে বলল,
‘ একবছর আগেও কত শান্ত ছিল, এখন তোমার ছেলেমেয়ে যা দুষ্ট হয়েছে না! উফফ। তোমরা কি করে সামলাও বলতো?’
উত্তরে তানিম হাসল। প্রিয় আবারও বলল,
‘ ওই টেবিলে কি নিয়ে কথা চলছে। যেহেতু দুই ডাক্তার বসেছে নিশ্চয়ই রোগ আর রোগী নিয়ে কথা হচ্ছে। এখানে আব্বা বসলে ব্যপারটা আরো জমে যেত। তাই না ভাই?’
বাবার কথা শুনতেই তানিমের হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা বুজে এলো। তানিমের মলিন মুখের কারণ বুঝল প্রিয়। এতবছর হয়েছে বাবা এখনো রুষ্ট। মেনে নেয়নি তানিম ইডিলিকে। অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে তারা। কিন্তু জাফর সাহেব মানতে নারাজ। এতবছর ধরে সেই আক্ষেপ বয়ে বেড়াচ্ছে তানিম। সচরাচর প্রিয় সেসব কথা তুলে না। আজ হ্ঠাৎ কথায় কথায় বাবার কথা বলে ফেলেছে। খানিক চুপ থেকে প্রিয় বলল,
‘ দেশে এসেছ একবার বাবার সাথে দেখা করবে? হয়তো আমারা ইসামের উছিলায় সবকিছু ঠিক হয়ে যায়। তোমাদের ক্ষমা করে দেয়!’
তানিমের উদাসীন আওয়াজ,
‘ ক্ষমা করার হলে আগেই করত। মা প্রভা আমার কথা মনে করে?’
‘ রোজ এক বেলা তোমার কথা মনে করে মা কাঁদে।’
‘ আর প্রভা?’
‘ তুমি তো চিনো ওকে, কতটা অকপটে। উপরে শক্ত ভেতরে নরম। বুক ফাটবে তবুও মুখ খুলবেনা।’
মলিন হাসল তানিম। প্রিয় ভাইয়ের হাতে উপর হাত রাখল। বুঝানোর কন্ঠে বলল,
‘ একবার বাবার সাথে সামনা সামনি কথা বলে দেখো-ই না! যদি ঠিক হয় সব।’
তানিম কথা এড়ালো। বলল,
‘ সেসব কথা ছাড় প্রিয়। তোর শরীরের কন্ডিশন এখন কেমন বল। সু*ইসাইড করতে চেয়েছিস? বছর ঘুরলো না, এতবড় একটা মেজর অপারেশন হলো। তোর জীবনের কি কোন মূল্য নাই প্রিয়?’
তাচ্ছিল্য হাসলো প্রিয়। বলল,
‘ আর জীবনের মূল্য! যেখানে পুরোটাই শূন্যতায় পরিপূর্ণ!’
‘ এত ভেঙ্গে পরার মত কিছু হয়নি প্রিয়। অসুস্থতা জীবনে আসতেই পারে।…অসুস্থতার ব্যাপারটা কি শতাব্দ জানে?’
‘ না। আর আমি জানাতেও চাইনা।’
অবাক হলো তানিম। ভড়কে কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ কেন?’
প্রিয়’র নিস্তেজ আওয়াজ,
‘ তার ভালোবাসাকে দুর্বলতার হা*তিয়ার বানাতে চাইনা ভাই। আমি অপূর্ণ। আমার অপূর্ণতা তার শূন্যতা বাড়াবে। পূর্নতা আনবেনা কখনো।’
‘ সে তোকে ভালোবাসে প্রিয়!’
‘ শুধু ভালোবাসা দিয়ে সংসার গড়া যায়না ভাই! আমার জরায়ুতে টিউমার ছিল, অপারেশন করা হয়েছে। আমি কখনো মা হতে পারবো না। সব জেনেশুনে তার সাথে কি করে সংসার সাজাই? তার সাথে থেকে আমি তাকে প্রতিমুহূর্ত ঠকাচ্ছি ভাই! সে আমাকে ভালোবাসছে, মনে মনে সংসার সাজাচ্ছে, পরিবার বাড়ানোর স্বপ্ন দেখছে। আমি তাকে কি দিচ্ছি? ঠুনকো আশা!’
তানিমের শান্ত উত্তর,
‘ এটাকে ঠকানো বলে না প্রিয়। তোর হাতে কিছু নেই। তুই তাকে ভালোবাসিস অস্বীকার করতে পারবি?’
‘ সবটা আমার হাতেই ভাই! আমি চাইলেই তার থেকে দূরে যেয়ে জীবনটা গুছিয়ে দিতে পারি। আমার জন্য তার জীবনের অনেক সময় নষ্ট করেছে। আর না। তার জীবনে কেউ আসুক তার শূন্য জীবনে পূর্নতা বয়ে আনুক।’
প্রিয়’র আওয়াজ ভেঙ্গে ভেঙ্গে আসলো। একটু চুপ থেকে আবার বলল,
‘ আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল তার কাছে ফিরে আসা। নিজের জেদের বসে, প্রতি*শোধ পরায়ন হয়ে আমি তার সাথে বড্ড অন্যায় করে ফেলেছি ভাই। আমি ভুল ছিলাম ,সে আমাকে ঠকায়নি। এত বছরে কিছুই বদলায়নি। সে এখনো আমাকে ততটাই ভালোবাসে। আগে যতটা ভালোবাসতো। সেই প্রথমবারের মত!’
বোনের ছলছল চাহনি দেখে তানিম বলল,
‘ একবার শতাব্দের সাথে খোলামেলা কথা বল। ওর দিকটা এক..
কথা কাটল প্রিয়। ভাঙ্গা স্বরে বলল,
‘ তাকে কি বোঝাব ভাই? বুঝবেনা সে। আমি যদি তার বুকে ছু*ড়িও ঢুকাই তবুও সে ভালোবাসবে আমায়। তার ভালোবাসা নিখুঁত, নিস্বার্থ! আমি কি করে স্বার্থপর হই? আমি অপূর্ণ নারী। মা হওয়ার ক্ষমতা নেই। পরিবার গড়ার জোর নেই। সারাজীবনের জন্য তাকে কি করে আফসোসের সাগরে ডুবাই? থাকনা কিছু অপূর্ণ। জীবনের সব চাওয়া পূর্নতা পাবে তার মানে আছে কি কোন? আমার অপূর্ণতা গুলো শুধু আমার হয়েই থাক।’
‘ আগামী প্লান কি?’
‘ যেই উদ্দেশ্যে এসেছিলাম, তা সফল করে শতাব্দের জীবন থেকে বেরিয়ে যাবো। হাতেগোনা আর কয়েকদিন। লুবনা লিমনের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করতে শাদকে লাগিয়েছি। প্রমাণ হাতে আসতেই, প্লান অনুযায়ী সব করে নিজ গন্তব্যে চলে যাবো।’
‘ আর আয়শা খালার ব্যাপারটা?’
‘ কিছু আন্দাজ করতে পারছি। সত্যিটা হয়তো আমাদের কল্পনার বাহিরে। অনাকাঙ্ক্ষিত! আমি এখনো শিয়োর না। তবে এতটুকু নিশ্চিত যে শতাব্দ অ*ন্যায় কিছু করতে পারেনা।’
‘ শতাব্দকে ছেড়ে যাওয়াটা সে মানবে?’
এবার সামান্য ঘা*বড়ে গেল প্রিয়। শতাব্দের হিং*স্র স্বভাবের সাথে সে ভালোভাবে পরিচিত। আদৌ শতাব্দ মানবে তো?
খানিক চুপ থেকে প্রিয় উত্তর দিলো,
‘ আমি মানতে বাধ্য করবো!’
বোনের গম্ভীর মুখপানে চেয়ে আছে তানিম। প্রিয়’র টলমল চোখ। এখনি কেঁদে দিবে যেন।
প্রসংগ পাল্টালো তানিম,
‘ ইন্ডিয়া যেয়ে আরেকবার চেকআপ করাবি? আমি আর ইডিলিও সাথে যাবো তোর।’
প্রিয়’র অলস আওয়াজ,
‘ দরকার নেই ভাই! আমি সুস্থ আছি। দেশে ডাক্তার দেখাচ্ছি। ভাবি, তার পরিবার আমার জন্য অনেক করেছে। বাড়িতে এখনো জানেনা কেউ। সবাই ভাবে বছর খানেক আগে ইন্ডিয়া ট্রিপে গিয়েছিলাম।এবার গেলে নিশ্চয়ই সন্দেহ করবে! ‘
‘ সন্দেহের কি আছে! বিপদ কে*টেছে, কিন্তু রেগুলার চেকআপটা তো করতে হবে। এমিলি আন্টি সেদিন তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল।’
হাসলো প্রিয় বলল,
‘ ভাবির মায়ের বাড়ি ইন্ডিয়া হওয়ায় ভীষণ সুবিধা হয়েছিল। আবার কখনো ইন্ডিয়া গেলে অবশ্যই এমিলি আন্টির সাথে দেখা করব।’
কথার ফাঁকে তানিম ঘড়ির দিক তাকালো। শতাব্দ ইডিলি এখনো গল্পে মগ্ন। তাদের কথার মূল প্রসংগ রোগ আর রোগীকে ঘিরে। এদিকে ডিনারের টাইম হয়ে এসেছে। বুফেতে রিজার্ভেশন দিতে হবে। তানিম সেদিকে পা বাড়াল। অমনি পেছন থেকে ডাকল প্রিয়। বলল,
‘ তুমি আগে থেকেই জানতে আয়েশা খালা আমার মা। তাই না ভাই?’
তানিম মৃদু হাসলো। শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ তাতে কিছু আসেযায় না। তুই আমার বোন। এটাই সত্য।’
(নোট: তানিম প্রভার বড় ভাই যা প্রথম খন্ডে চতুর্থ পর্বে বলা হয়েছিল। প্রিয়’র অপারেশনের ব্যাপারটা তানিম আর তার বউ ইডিলি জানতো। বাড়ির সবাই জানতো প্রিয় ইন্ডিয়া ট্রিপে গিয়েছিল। ইডিলি আমেরিকান হলেও তার মায়ের জন্মসূত্র ইন্ডিয়াতে। পাঠকদের বিভ্রান্তি দূর করার জন্য )
চলবে……
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।