ফিলোফোবিয়া পর্ব-৪৭+৪৮

0
630

ফিলোফোবিয়া

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির )

৪৭.

( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

গতকাল বিকালে পুলিশ ভাঙ্গা ব্রিজের খাঁদ থেকে শোয়েব হকের গাড়ি উদ্ধার করেছে। ভেতরে শোয়েব ছিল। দেহে প্রাণের স্পন্দন চলছিল। হাসপাতালে ভর্তি আছে, ধুঁকে ধুঁকে শ্বাস ফেলছে । আভিলাষা বেগম খবর পেয়ে কান্নাকাটি করে হুড়াহুড়ি বেরিয়ে যায়। যতই ঘৃ*ণা, দূরত্ব থাকুক। হাজার হোক শোয়েব তার ভাই। র*ক্তের টান। প্রিয় স্তব্ধ ছিল।মানুষটাকে তার প্রচন্ডরকম অপছন্দ। ভীষণ ঘৃ*ণা করে। শাস্তি চেয়েছিল, মৃ*ত্যু না! শোয়েব হক আইসিইউতে আছে। এখনো কোমায়। পুলিশ ভাষ্যমতে এটা এ*ক্সিডেন্ট না। এটেম টু মা*র্ডার। ট্রাকটা অনেক আগে থেকে শোয়েব হকের গাড়ি ফলো করছিল। তাদের সন্দেহ প্রিয়কে। কারণ শোয়েব হক প্রিয়’র সাথেই দেখা করে বাড়ি ফিরছিলেন। তাছাড়া কিছুদিন যাবত চলতে থাকা ঝামেলায় প্রিয়’র দিকেই পুরোপুরি সন্দেহ। ছবি বেগমও প্রিয়কে দো*ষী প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছে বারবার। আগুনে ঘি ঢালছে। শতাব্দের হুমকি ধমকিতে চুপ হলেও দমছে না। ভেতরে ভেতরে পুলিশকে দিয়ে প্রিয়কে জিজ্ঞাসা বাদের জন্য থানায় নিয়ে গেছে। শতাব্দ কোনরকম ক্ষমতার জোরে আপাতত ছাড়িয়ে এনেছে। এখন ট্রাক ড্রাইভারকে খোঁজাখুঁজি করছে পুলিশ।
সারারাত জেলখানা, হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করে সকালে বাড়ি ফিরেছে প্রিয়। নির্ঘুম, দুশ্চিন্তায় রাত কা*টিয়ে শরীর, মন ভীষণ ক্লান্ত।
ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। আনমনেই চোখের কোন গড়িয়ে জল পরে। বুক ভেঙ্গে চূড়ে কান্না আসছে। হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। ওই লোকটার জন্য একটু কাঁদলে কি, মায়ের প্রতি খুব বেশি অবিচার হবে তার।
প্রিয় ঘরে এলো শতাব্দ। চোখ বুজে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে প্রিয়। চোখের কোন বেয়ে জল পড়ে বিছানার চাদর ভিজছে। ফোঁসফোঁস শ্বাস ফেলছে। ফোপাঁচ্ছে। ভেতরের কষ্ট প্রকাশ করতে না পারার য*ন্ত্রণায় ছটফট করছে। বিছানার দিক এগিয়ে গেল শতাব্দ। প্রিয়’র পাশে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে। চোখ খুলে তাকাল প্রিয়। ঘাড় ফিরিয়ে পাশে তাকাতেই শতাব্দকে দেখল। তড়িঘড়ি হাতে চোখ মুছতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কারো সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করবে না কখনো। শতাব্দ উপর দিক তাকিয়ে, গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ চাইলে কাঁদতে পারো। আমি বাঁধা দিবোনা আর তোমার মায়ের সাথেও অন্যায় হবেনা।’
প্রিয় থমকে গেল। নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কতক্ষণ। মানুষটা তার মনের দ্বিধাদ্বন্দ, য*ন্ত্রণা গুলো কি করে বুঝল। আচমকা শতাব্দের বুকে ঝাপিয়ে পড়ল। জাপ্টে ধরল। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘ আমি তার শাস্তি চেয়েছিলাম, মৃ*ত্যু চাইনি কখনো।’
‘ জানি প্রিয়! আমাকে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই।’
‘ আছে। আমি সত্যি এমনটা চাইনি। আ..আমি কিছু করিনি।’
‘ আমি জানি, বিশ্বাস করি।’
বলেই প্রিয়কে বুকে জড়িয়ে ধরল শতাব্দ। হাউমাউ করে কান্না করছে প্রিয়। চোখের জলে বুক ভিজচ্ছে শতাব্দের। বাঁধা দিচ্ছেনা। কাঁদুক, খুব করে কাঁদুক। মন হালকা করুক। চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল শতাব্দ। আচমকাই খেয়াল হলো, প্রিয়’র শরীর প্রচন্ডরকম গরম। সারারাত দৌড়াদৌড়ি পেরেশানি ক্লান্তিতে জ্বর আসছে নিশ্চয়ই। ধীরেধীরে নিস্তেজ হচ্ছে প্রিয়। খানিক পর একদম চুপ। ঘাবড়ে গেল শতাব্দ। বুকে থেকে মুখ উঁচিয়ে ডাকল কয়েকবার। উত্তর দিলো না প্রিয়। ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছে।

শতাব্দের উচ্চ আওয়াজ শুনে জ্ঞান ফিরল প্রিয়’র। ফোনে কারো উপর রাগ ঝারছে। তটবটে রাগী গম্ভীর আওয়াজে বলছে,
‘ ওই ড্রাইভারের স্বীকারোক্তি আমার চাই। মানে চাই। যেই করেই হোক।’
ফোনের অপর পাশ থেকে কি বলল শোনা গেল না। শতাব্দ রেগে গেল আরো। গর্জিয়ে বলল,
‘ কিছু বলছেনা। মানে কি? ওয়েট আমি আসছি।ওর জবানে কতক্ষণ তালা লাগানো থাকে আমিও দেখছি।’
ফোন কে*টে মোবাইলটা একপ্রকার সোফায় ছুঁড়ে ফেলল শতাব্দ। অকপটে পা ফেলে বিছানায় গিয়ে বসল। মাথা চেপে বসল। রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।
পেছন থেকে প্রিয় ডাকল। বলল,
‘ কি হয়েছে?’
প্রিয়’র ডাকে টনক নড়ল। পেছন ফিরে তাকাল। বিছানা ছেড়ে উঠে বসেছে, কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে প্রিয়। শতাব্দ এগিয়ে গেল। ঠোঁটে মৃদু হাসির রেশ টেনে সামনের চুল গুলো কানের কাছে গুছিয়ে দিলো। কপালে হাত ছুঁয়ে আলতো স্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘ জ্বর কমেছে। এখন কেমন লাগছে?’
প্রিয়’র লঘু আওয়াজ,
‘ কিছুটা ভালো।’
একটু চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল আবার,
‘ কোথাও যাবেন?’
‘ হ্যাঁ একটু বের হতে হবে।’
‘ কেন?’
‘ একটা জরুরি কাজ পড়েছে।’
কৌশলে কথাটা এড়াতে চাইছে শতাব্দ। কোনকিছু আর জিজ্ঞেস করল না প্রিয়। শতাব্দ উঠে দাঁড়াল, সোফা থেকে মোবাইল তুলে হাতে নিলো। ঔষধ বের করে বিছানার পাশে রাখতে রাখতে আনমনা হয়ে বলল,
‘ মা হাসপাতালে, সমুদ্র প্রভা গ্রামে। খালা সাথে থাকবে। খাবার খেয়ে, ঔষধ গুলো খেয়ে নিও।’
বাধ্য মেয়ের মত মাথা নাড়াল প্রিয়। পাশে এসে বসল শতাব্দ। কপালে চুমু দিয়ে, গালে আলতো হাত ছুঁয়ে দিয়ে নিগূঢ় সুরে বলল,
‘ নিজের খেয়াল রেখো। খারাপ লাগলে ফোন করিও, চলে আসবো।’
প্রিয়’র শুকনো ঠোঁটে আলতো হাসি। আঁখি পল্লব নাড়িয়ে আওয়াজহীন উত্তর দিলো। যার অর্থ ‘আচ্ছা’

সন্ধ্যা নামছে। বেগতিক বাতাস বইছে। ঘন বর্ষণের পর আবার আকাশ কালো করে মেঘ জমেছে। চারিদিক অন্ধকার। বারান্দার পাশে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়। দূর আকাশে তার চোখ। কোন ভাবনায় মশগুল। আচমকা কলিং বেল বাজল। ঘোর কা*টল। ছিটকে উঠল। দ্রুত দরজার দিক পা বাড়াল। নুপুরের রিমিঝি্মি শব্দে ঘর মাতলো। দরজা খুলে দিলো প্রিয়। কাঁক ভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দ। চুল থেকে পানি বেয়ে একাকার।
মাথা ঝাড়তে ঝাড়তে চোখ তুলে তাকাল শতাব্দ। প্রিয়কে দেখে থমকে গেল। পড়নে কুচকুচে কালো শাড়ি, খোলা কেশ। চোখে গাঢ় কাজল লেপ্টে, মেরুন লালে ঠোঁট রাঙিয়ে। ভয়*ঙ্কর সুন্দর, মায়াদেবীর রূপে সেজেছে। সামনে কে? কোন মানবী। নাকি স্বর্গ রাজ্যের অপ্সরী।
নিশ্বাস খানিকের জন্য থমকে গেল। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে নিগূঢ় চেয়ে রইল। আনমনেই বুকের বাঁ পাশে যেয়ে ঠেকলো হাত। কি বলবে ভুলে গেছে। মুহূর্তেই যেন সব এলোমেলো হয়ে গেল।
প্রিয়’র ডাকে ঘোর কাটল। নড়েচড়ে উঠল শতাব্দ। কন্ঠে তাড়া দিয়ে প্রিয় বলল,
‘ ঠান্ডা বসে যাবে, তাড়াতাড়ি কাপড় পাল্টে নিন।’
কিছু বলল না শতাব্দ। যন্ত্রের মত ভিতরে চলে এলো। প্রিয় শুকনো কাপড় বের করে হাতে ধরিয়ে দিলো। থমথমে হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শতাব্দ। এটা সত্যি প্রিয় তো?
বাধ্য ছেলের মত ওয়াশরুমে চলে গেল। মিনিট দশেক পর ফিরল। মাথা মুছতে মুছতে আড়চোখে তাকালো। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়। ঘর জুড়ে অন্ধকার মাখানো। সন্ধ্যা বাতি জ্বালানো হয়নি এখনো। বেলা শেষের অনুজ্জ্বল আলো। বাতাসে অদ্ভুত মাদকতা মেশানো। দমকা হাওয়ায় শাড়ির আঁচল উঁড়ছে প্রিয়’র। শাড়ি সরে দুধে-আলতা গা ভেসে। ঝলমলে খোলা কেশ তার চোখেমুখে পড়ছে। হাত উঁচিয়ে চুল গোছাতে চাইল। কাঁচের চুড়ি ঝনঝনিয়ে উঠল। শব্দটা বুকে যেয়ে বিঁধল শতাব্দের। চোখ লাগল গভীর ঘোর। দিন দুনিয়ার সব ভাবনা এড়িয়ে। মন্ত্রমুগ্ধের মত সেদিকে এগিয়ে গেল। শাড়ির আঁচল মাড়িয়ে, পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে ধরল। নাক ঠেকলো, উন্মুক্ত পিঠে। গভীর করে, প্রিয়’র মিষ্টি সুভাস টানতে লাগল। টলটলে শরীর, মাতাল মাতাল মন। আবেশে শতাব্দের বুকে গা এলিয়ে দিলো প্রিয়। নিশ্বাসের গতি দ্রুত, শরীর কম্পন করছে প্রচন্ড। আলতো করে পিঠে ঠোঁট ছুঁয়ে দিচ্ছে শতাব্দ। পাগল, উন্মাদের মত আরো গভীর করে জাপ্টে ধরল। কানের কাছে মুখ এনে অগোছালো, নিগূঢ় কন্ঠে বলল,
‘ ডার্ক কালার পড়ে, চোখে কাজল লেপ্টে আমার সামনে আসতে বারণ করেছিলাম। এইযে আমি বদ্ধ উন্মাদ হলাম, এর দায়ভার কে নিবে এখন?’
প্রিয় চুপ। তার ঘনঘন নিশ্বাস। প্রিয়’র বাহু টেনে নিজের দিক ফেরাল। দেয়ালের সাথে মিশিয়ে, কপালের সাথে কপাল মিশাল। চোখ বুজে আছে প্রিয়। শতাব্দের উষ্ণ নিশ্বাস মুখে পড়ছে তার। নিমিষ নেশাতুর হয়ে চেয়ে আছে শতাব্দ। অধৈর্য, অস্থির কন্ঠে বলল,
‘আমার তোমাকে চাই প্রিয়। প্রচন্ড ভাবে চাই।’
প্রিয় উত্তর দিলো না। শতাব্দ অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করল। থরথর কাঁপছে প্রিয়। শতাব্দ ঝুঁকে এলো। আলতো করে প্রিয়’র ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। বাঁধা দিলো না প্রিয়। শতাব্দের পাগলামোতে তাল দিলো। শতাব্দ যেন আশ্বাস পেল। ঝট করে প্রিয়’কে কোলে তুলে নিলো। বিছানার দিক পা বাড়াল। অন্ধকারে মিলিয়ে আসা ঘরে, দুজনের তপ্ত নিশ্বাস ভাসছে। কোন এক স্বর্গিয় সুখে, দুজন প্রেমময় বৈধ সম্পর্কে জড়াচ্ছে। এতোবছরের অক্লান্ত এক অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটলো। দুজন প্রেমিকের আত্মার পরিতৃপ্তি পেল। তাদের প্রেম ভালোবাসা পূর্ণতা এলো।

ঘড়িতে তখন রাত দশটা। অক্লান্ত বর্ষণের পর স্নিগ্ধ হাওয়া বইছে। আকাশ এখন পরিষ্কার। মেঘেরা ঝরে গেছে। গোল ভরাট চাঁদটা, পূর্ণিমার উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে। চারিদিক স্পষ্ট। মাত্রই প্রিয় দোলনায় এসে বসেছে। ভেজা চুল থেকে টপটপ পানি ঝরছে। গা শিরশির করছে। স্লিভলেস নাইট গ্রাউনের কটিটা আরো আষ্টেপৃষ্টে গায়ে জড়িয়ে নিলো। অমনি চায়ের কাপ হাতে শতাব্দ এলো। প্রিয়’র পাশে দোলনায় বসল। কাপ এগিয়ে দিয়ে প্রিয়’র উদ্দেশ্যে বলল,
‘ খেয়ে নেও, মাথা ভারী ভাব কমবে।’
চায়ের কাপে চুমুক দিলো প্রিয়। পরিবেশ পিনপতন নীরব। নীরবতা ভাঙ্গল প্রিয়। বলল,
‘ একটা কথা জিজ্ঞেস করব।’
চায়ের কাপে চুপ দিয়ে উত্তর দিলো শতাব্দ, ‘হু’
একটু চুপ থেকে প্রিয় বলল,
‘ যখন আমি ইমান্দিপুর ছিলাম, শোয়েব হক থেকে আপনি দূরে থাকতে বলতেন কেন? আপনি তো তখনো জানতেন না আমি উনার সন্তান।’
‘ তুমি উনার সন্তান না জানলেও, তোমার চেহারা হুবহু তোমার মায়ের মত। আমি জানতাম উনার প্রতি দুর্বলতা ছিল, সেই সাথে ভয়া*নক রকম আ*ক্রোশ ছিল। তাই আমার ভয় ছিল, উনার আ*ক্রোশ তোমার উপর না ফেলে আবার। যদি প্রতি*শোধ নেশায় তোমাকে আঘা*ত করে ফেলে। তুমি ছিলে উনার(আয়শার) কন্যা সমান।’
মৃদু হাসল প্রিয়।বলল,
‘ আপনি সবসময় আমার আশেপাশে ছিলেন, তাইনা? আমার কলেজ ভার্সিটির ছেলেদের সবসময় শা*সিয়ে রাখতেন। আপনার জন্যই তারা আমার থেকে দূরেদূরে থাকত। কি ভয় ছিল আপনার? আমি অন্যকারো হয়ে যাবো!’
ঠোঁট মেলে হাসল শতাব্দ। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। প্রিয়’র চোখে অদ্ভুত চমক। চোখে চোখ ডুবিয়ে বলল,
‘ উহু, সেই ভয় আমি পাইনা। আমি জানতাম তুমি চিরকাল শুধুই আমার। তোমাকে নয়, এই দুনিয়ার হিং*স্র মানব নামের পশুদের ভয় ছিল। কেউ ক্ষ*তি না করে দেয় আমার সরল প্রিয়’র।’
‘ আর আমার জন্মদিন, প্রত্যেক ইভেন্টে ফ্যানদের নাম করে দামি দামি গিফট, ফুলের বুকে গুলো আপনারই পাঠানো ছিল। সত্যি তো!’
উত্তরে কিছু বলল না শতাব্দ। মুচকি হেসে, চোখ ফিরিয়ে নিলো। চায়ের কাপে চুমুক দিলো। নিগূঢ়, নিমিষ কন্ঠে বলল,
‘ আমি এক মূহুর্তের জন্যও তোমাকে ভালোবাসা বন্ধ করিনি প্রিয়। তোমার প্রতি ভালোবাসাটা আমার নিশ্বাসের মতই সত্য!’

প্রিয় নিমিষ চেয়ে রইল। এত সুদর্শন, রূপবান, বিচক্ষণ একজন পুরুষ তার প্রেমে অন্ধ, বদ্ধ উম্মদ। সত্যি কি সে এতোটা ভালোবাসার যোগ্য? এই যে সে অপূর্ণ। এই অপূর্ণতা দিয়ে কি মানুষটার ভালোবাসার প্রতুত্তর দিতে পারবে কখনো। একটা সুখী সুন্দর জীবন গড়তে পারবে আদৌ। উহু, তা কখনো সম্ভব না।
এইযে আজ তার একটুখানি সুখের জন্য মানুষটাকে এলোমেলো করে দিলো। প্রাণ ভরে ভালোবাসলো। তার ভালোবাসার জোয়ারে নিজেকে ভাসালো। এতে কি খুব বেশি অপ*রাধ হয়ে গেল। মানুষটাকে কি ঠকালো!
কিন্তু এতে তার-ই বা কি করার ছিল! ভাগ্য বড্ড নি*ষ্ঠুর! চিরকাল শুধু তাকেই ঠকালো। যেখানে শতাব্দকে ভালোবেসে, সুখে সংসার সাজানোর কথা ছিল। সেখানে তার অপূর্ণতার জন্য ছেড়ে যেতে হবে। ভালোবাসার মানুষটাকে কি করে একটা অপূর্ণ আফসোসের জীবন দিবে? সত্যি জানার পর শতাব্দ কখনোই প্রিয়কে ছাড়বেনা। বরং আগলে রাখবে কিন্তু ওইযে তার নারীত্বের অপূর্ণতা! সারাজীবন শতাব্দকে পিতা না হওয়ার আফসোসে পোঁ*ড়াবে। তখন সেই দাহন প্রিয় নিজ চোখে কি করে সইবে। পৃথিবীতে কখনো কারো জীবন থেমে থাকেনা। প্রিয়’র জায়গায় নতুন কেউ আসবে। শতাব্দকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসবে। শতাব্দের আদর নিবে, তাকে পূর্ণ করে দিবে। একটা সুন্দর পরিবার হবে তাদের। থাকনা একটা অপূর্ণ প্রিয়’র গল্প। নাইবা পেল শতাব্দকে। চিরদিন এই মধুর রাতের স্মৃতি আগলে বাঁচলো।
সবকাজ প্রায় শেষ। জাল বিছানো হয়ে গেছে। কালকের দিনটা অন্যরকম হবে। তার এতবছরের প্রতি*শোধ, আক্ষেপ পূর্ণতা পাবে। অপরা*ধীদের শাস্তি মিলবে। রাত পোহালেই চলে যাবে। তার ভালোবাসার শতাব্দকে চরম ভাবে ঠকিয়ে যাবে। হয়তো চরম ঘৃ*ণা করবে, দূরে ঠেলে দিবে প্রিয়কে। আফসোস নেই এটাই চাইছে সে। যেখানে মানুষ যুগের পর যুগ সত্যিকারের ভালোবাসার অভাবে পু*ড়ে। সেখানে প্রিয় পেয়েও ছেড়ে যাবে। কি নিষ্ঠুরতম ভাগ্য তার। চোখ ভিজে এলো প্রিয়’র। শতাব্দের চোখে বাঁধল। ভ্রু যুগল কুঁচকে এলো। কপালে হাত ছুঁয়ে চিন্তিত স্বরে বলল,
‘ জ্বর আসছে আবার। শরীর ব্যথা করছে? ঔষধ খেতে হবে, ঘরে চলো।’
উত্তরে কিছু বলল না প্রিয়। অপলক তার প্রেমিক পুরুষের দিক চেয়ে রইল। প্রিয়’র কোনরূপ হেলদোল না পেয়ে কোলে তুলে নিলো শতাব্দ। ঘরে নিয়ে বিছানায় শুয়িয়ে দিলো।

গভীর রাত চোখে ঘুম নেই প্রিয়’র। পাশ ফিরে মুখপানে চেয়ে আছে শতাব্দের। এত কাছ থেকে এই মুখখানা দেখার সুযোগ কোনদিন মিলবে কি আর! নিশ্বব্দ কান্নায় চোখ ভিজছে। বুকে প্রচন্ডরকম হাহাকার। ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল। আলতো হাতে শতাব্দের মুখখানায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘ ভালোবাসি শতাব্দ। প্রচন্ডরকম ভালোবাসি। আমি চিরকাল আপনার প্রিয় হয়েই বাঁচবো। হোকনা হাজার মাইলের দূরত্ব।’

চলবে…………

ফিলোফোবিয়া

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির)

৪৮.

( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

শতাব্দ,

কোথা থেকে শুরু করি? চিঠিটা যখন আপনার হাতে পৌঁছাবে। এই বাড়ি ছেড়ে আমি অনেক দূরে। জানি আপনি রাগবেন। বিরক্ত হবেন, ঘৃ*ণা করবেন। কিন্তু সত্যি এটাই যে, আমি আপনাকে কখনো ভালোবাসিনি। আমার ভালোবাসার সমাপ্তি অনেক বছর আগেই হয়েছিল। এইযে আপনার কাছে ফিরে আসাটা, পুরোটাই আমার সাজানো ছিল।সহজ অর্থে নাটক ও বলতে পারেন। একবার আপনি আমাকে ছেড়েছিলেন, আমি আপনাকে নিজের কাছে টেনে, ছেড়ে দিয়ে।শোধ নিলাম। আমার ফিরে আসার পেছনের কারণটা ছিল রহস্য উদঘাটন। আমি আপনাকে এক মুহূতে’র জন্যও ভালোবাসিনি। গতরাতে আপনার সাথে অন্তরঙ্গ সময় কা*টানোর পেছনেও উদ্দেশ্য ছিল। মূলত ডিস্ট্রাকড করে। আপনার ফোনে ড্রাইভারের স্বীকারোক্তির ভিডিও নেওয়া। পুলিশ নিশ্চয়ই শাস্তি দিবে, কিন্তু অপরাধীদের আমি আমার মত করে শাস্তি দিতে চাই। আমার মায়ের আত্মহ*ত্যা ছিল না। তাকে খু* ন করা হয়েছিল। শোয়েব হক, ছবি বেগম এই সমাজ তাকে খু ন করেছে।তাদের তিক্ত ধারালো বুলি আত্মহ*ত্যা করতে বাধ্য করেছে। আইন প্রমাণ চায়। মানহানির কোন কঠোর শাস্তি নাই। তাই আমিও হাল ছাড়িনি। তাদের কঠোর শাস্তি দিতে চেয়েছি। অপমানের বদলে অপমান, হ*ত্যার শাস্তি মৃ*ত্যুদন্ড। ভাইয়া ও তার ডিটেকটিভ বন্ধুর সাহায্যে ছবি বেগম ও তার ছেলেমেয়েদের সব কুকীর্তির প্রমাণ জোগাড় করি। যদিও তা যথেষ্ট ছিলনা। তাই উষ্ণচর যেয়ে তুরফাদের সাথে দেখা করি। আমি জানতাম ছবি বেগম আঁচ পেলে আমাকে মে*রে ফেলতে চাইবে। তাই ঢাল বানিয়ে আপনার আড়ালে থেকে নিজের কাজ করতে থাকি। কারণ আমি জানতাম আপনাকে ডিঙিয়ে আমার অবধি পৌঁছানোর সাধ্যি নেই তাদের। সহজ কথায় নিজের সেফটির জন্য আমি আপনাকে ব্যবহার করেছি।
হয়তো আপনার ভালোবাসায় কোন খাঁদ ছিলনা। কিন্তু আমার দ্বারা আপনার সাথে থাকা সম্ভব না। একটা প্রশ্নের উত্তর আমার এখনো মিলেনি! সেই রাতে ইমান্দিপুর কেন গিয়েছিলেন আপনি? জানি উত্তরটা আপনি বলবেন না। আমিও আর জানতে চাইব না। তবে হ্যাঁ, কোন কিন্তু নিয়ে আপনার সাথে সংসার সাজাতে পারবো না। যেখানে ভালোবাসার বাস নেই, সেখানে কি করে সংসার সাজাই? জানি, আমাকে খুঁজে বের করা আপনার জন্য কঠিন না। পাতালে লুকালেও খুঁজে বের করবেন। কিন্তু আমি চাইনা আমাদের আবার দেখা হোক। আমার উপর কোনপ্রকার জোর খাটানোর চেষ্টা করলে, আমি অনর্থ ঘটাবো। আর আপনি জানেন এমনটা করতে আমার একটুও হাত কাঁপবেনা। আমাদের জন্য বিচ্ছেদ-ই শ্রেয়।আমি আপনাকে ভালোবাসতে পারিনি শতাব্দ। ভুলে যান আমাকে। অন্যকারো সাথে নতুন করে সংসার সাজান। আপনি অনেক ভালোবাসার প্রাপ্য। আপনার ভাগের ভালোবাসা গুলো অন্যকারো কাছে তোলা আছে এখনো। পরিশেষে বলল, মাফ করবেন। আমার ব্যবহারের জন্য ক্ষমা করবেন।

ইতি
প্রিয়,

দেয়ালের পিঠে যেন চিঠির লেখা গুলো ভেসে উঠছে বারবার।বাহিরে উজ্জ্বল দিন হলেও, ঘরের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার। এলোমেলো চূর্ণবিচূর্ণ ঘর। ভাঙ্গাচুরা জিনিসে চারিদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে। শান্ত অগ্নিগিরি হ্ঠাৎ বিস্ফোরণে যেমন তান্ডব হয়। ঠিক তেমন। শতাব্দের রাগের মাত্রা আজ আসমান ছুঁই ছুঁই। ক্রোধান্বিত গর্জনের ফোঁসফোঁস নিশ্বাস দেয়ালে দেয়ালে বারি খাচ্ছে। চাপা চিৎকার, উত্তেজনা, ক্রোধ তাকে খাঁখাঁ করে পো*ড়াচ্ছে। কোথাও চূর্ণবিচূর্ণ ধা*রালো কিছুতে হাত লেগে অনর্গল র*ক্ত ঝরছে। সে দিকে তার খেয়াল নেই, ধৈর্য যেন সীমা ছেড়েছে। সবকিছু বিনাশ করেই যেন ক্ষান্ত হবে আজ!

সারাদেশ তোলপাড়। বাতাসে বাতাসে শুধু একটাই গুঞ্জন’ ছবি বেগম তার সন্তানদের ফাঁ*সি চাই’। ভোর রাতের দিক অজানা এক পেজ থেকে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। যেখানে লিমন হকের স্বীকারোক্তি আছে যে, সেই আর তার বন্ধুরা মিলে তদ্রাকে ধ*র্ষণ করেছে। নিশ্বাস তখনো চলছিল। দেহে প্রাণ ছিল। তা দেখে লুবনা ঘাবড়ে যায়। গলা টি* পে শ্বাসরোধ করে মে*রে ফেলে। তারপর পানিতে ভাসিয়ে দেয়। যখন লা*শ ভেসে উঠে, তখন ব্যাপারটা কুসংস্কারে ডেকে ফেলে। পানির নিচের খারাপ জিনিস তদ্রাকে মে*রেছে। সেই সাথে গ্রামে চলতে থাকা মা*দক ব্যবসা, চাঁদাবাজি সবকিছুর স্বীকারোক্তি আছে। উষ্ণচরের মানুষের উপর এতবছর অমানবিক নির্যাতন। সেই সাথে শোয়েব হকের এক্সিডেন্টের ব্যাপারটার ও খোলাসা হয়েছে। ড্রাইভারের স্বীকারোক্তি ভিডিও প্রমাণ সহ সব ফাঁস হয়েছে। সবমিলিয়ে তারা পুরোপুরি ফেঁ*সে গেছে। টাকা দিয়েও কোন কাজ হচ্ছেনা। সোস্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলছে বরাবর। মিনিটে মিনিটে শতশত লাইক, শেয়ার হচ্ছে। একটাই দাবি সবার ‘তাদের ফাঁসি চাই’। রাজনৈতিক দলও পিছিয়ে গেছে। ছবি বেগমকে সাহায্য করার জন্য আশেপাশে কেউ নেই। শাহরিয়ার হক সাহায্যের জন্য মুখের উপর নিষেধ করে দিয়েছেন। এদিকে শতাব্দ ফোন তুলছেনা। পুলিশ খোঁজাখুঁজি করছে। হাতের কাছে পেলেই এরেস্ট করবে। চারিপাশ থেকে অ*ন্যায়ের শিকড় যেন চেপে ধরেছে ছবিকে। মানুষের হাহাকার অভিশাপ যেন ফলে যাচ্ছে আজ। চারিদিকে শুধু অপমান আর অভিশাপ। এবার তার পালাবার কোন পথ নেই আর।

গতরাতে শোয়েব হকের জ্ঞান ফিরেছে। শরীরের ক্ষত অনেক। তবে বিপদ মুক্ত হলেও অভিশাপ ছাড়েনি তাকে। হাঁটা চলার জন্য অক্ষম সে। হার্ট অ্যাটাক করে প্যারালাইজড হয়ে পড়েছে। মুখ বেঁকে গেছে, হাতপা সব অচল। কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছে। ডাক্তারদের ভাষ্যমতে কোনদিন স্বাভাবিক হতে পারবেনা সে। যতদিন বাঁচবে, এভাবেই তাকে বাঁচতে হবে। অন্যের সাহায্য নিয়ে। আজ সাহায্যে জন্য কেউ নেই স্ত্রী সন্তান সবাই ছেড়ে গেছে। তাদের যতটুকু স্বার্থ ছিল সব গুছিয়ে কে*টে পড়েছে। আপাতত তারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। দুদিন ধরে অভিলাষা বেগম একাই তার সাথে হাসপাতালে আছে।
আচমকা বাড়ি থেকে ফোন আসতেই নার্সদের দায়িত্ব দিয়ে তড়িঘড়ি করে হাসপাতাল থেকে অভিলাষা বেরিয়ে গেছে। ওইদিকে বাড়িতে শতাব্দ হট্টগোল কান্ড বাঁধিয়েছে। যাওয়ার আগে বেশ কড়া করে বলে গেছে নার্সকে, কাউকে যেন ভেতরে প্রবেশ করতে না দেয়। এমনিতেও পরিস্থীতি খারাপ। সাংবাদিকরা নতুন খবরের জন্য উসখুস করছে। এখানে এসে তারা ঝামেলা করতে পারে।
অভিলাষা বেরিয়ে যেতেই বোরকা পড়া কেউ এক ভেতরে এলো। নার্স চমকালো। বিহ্বল কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ কে আপনি? পেশেন্টের আত্মীয়।’
বোরকা পরিহীতা মহিলার স্বাভাবিক আওয়াজ,
‘ জি, আমি উনার বন্ধু। উনার সাথে কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই।’
নার্সের সন্দেহ হলো। বলল,
‘ সরি আমাদের অনুমতি নেই।’
‘ উনার বোনের সাথে আমার কথা হয়েছে। আপনি চাইলে ফোন করে খোঁজ নিতে পারেন।’
নার্সের যেন খানিক বিশ্বাস হলো এবার। ফোন করে খোঁজ নেওয়ার মত এত সময় আছে কি তার? ছোট ছোট পা ফেলে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।
নার্স বেরিয়ে যেতেই শোয়েব পাশে চেয়ার টেনে বসল তিনি। মুখের মুখোশ তুলে। আলতো স্বরে ডাকল,
‘ শোয়েব! শোয়েব!’
পিটপিট দৃষ্টি মেলে তাকাল শোয়েব। চাহনি স্পষ্ট হতেই থমকে গেল সে। মৃ*ত মানুষ কি কখনো ফিরে আসে? এটা কি সত্যি সে? নাকি তার আত্মা এসেছে! কুসংস্কার কথাবার্তা মাথা ঝেঁকে ধরেছে। অধৈর্য, অস্থির হয়ে কিছু বলতে চাইল। পারছেনা সে। মুখ থেকে বোবার মত গোঙ্গানি আওয়াজ বেরচ্ছে। মুখ থেকে লালা বেরিয়ে পড়ছে। সামনের মানুষটা টিস্যু দিয়ে মুখে দিলো। শোয়েবের দিক ঝুঁকে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ আমাকে চিনতে পেরেছ শোয়েব। আমি আয়শা।’
শোয়েব অধৈর্য্য হলো আরো। হাউমাউ করে খাবলে পড়ল, কিছু বলতে চাইল। পারল না।
আয়শা স্মিত হাসল। বলল,
‘ কি ভাবছ বেঁচে আছি কি করে? হয়তো আজ এই দিনটা দেখাবে বলে, বিধাতা দূত করে সেদিন পাঠিয়েছিল শতাব্দকে। সত্যি বিধাতা মহান। কর্মের ফল এই দুনিয়াতেই ভোগ করতে হয় সবাইকে। দুনিয়াতে ‘রিভেঞ্জ অব নেচার ‘বলতেও কিছু আছে। যেই মানুষটার জন্য তুমি আমাকে ঠকিয়েছিলে। সেই মানুষটাই তোমার প্রাণ নিতে উঠে পড়ে লেগেছে। প্রকৃতির প্রতিশোধ কি অদ্ভুত তাইনা শোয়েব!’
শোয়েব থমকে আছে। চোখজোড়া থেকে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। কিছু বলতে চাইছে। পারছেনা, নিয়তি আজ তাকে বোবা বানিয়ে দিয়েছে। জীবনের অন্তিম সিড়িতে দাঁড়িয়ে, অথচ ক্ষমাটাও চাইতে পারছেনা। কি অদ্ভুত ভাগ্য তার।
আয়শা আবার বলল,
‘তোমাকে দেখে একটু কষ্ট হচ্ছেনা আজ। এসব তোমার প্রাপ্য। একদিন আমাকে ঠকিয়েছিলে। তোমার কারণে আমি নিঃস্ব হয়েছিলাম। নিজের সন্তান, আমার প্রিয়কে দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম। এই উচ্চ সমাজের চক্ষু লজ্জার ভয়ে মা হয়েও তাকে নিজের কাছে রাখতে পারিনি। খাঁখাঁ করে পুড়েছি প্রতিদিন। আমাদের একটা সুন্দর গোছানো সংসার হওয়ার কথা ছিল অথচ তোমার অর্থলোভ, ধড়িবাজিতে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। তবুও তোমার শান্তি মিলেনি! তোমাদের কারণে আমি আর আমার মেয়ে সমাজে ব্যা** বনেছি। শেষমেষ নিজেকে আত্নগোপন করতে বাধ্য হয়েছি।’
শোয়েব কিছু বলতে চাইল। আয়শা তাচ্ছিল্য হাসল। বলল,
‘ কি বলতে চাও? তুমি এসব করতে চাওনি! তোমার কোন যুক্তি -ই আমার কষ্ট যন্ত্রণার সামনে খাটবে না। প্রচন্ড ঘৃ*ণা করি তোমাকে। আর এই ঘৃ*ণাটা তুমিই তৈরি করেছ। নিয়তির জবাব দেখেছ শোয়েব! প্রতি*শোধ আমি কোনদিন চাইনি। অথচ সব এলোমেলো হলো। তোমার স্ত্রী সন্তানদের অপকর্ম বেরিয়ে এলো দুনিয়ার সামনে। নিরীহ মানুষের অভিশাপ ফলেছে। হাজার হাজার মানুষের অপমান ঘৃ*ণায় জর্জরীত হচ্ছে। সাহায্যের জন্য কেউ নাই পাশে। আর এসব কে করেছে জানো? আমার মেয়ে! আমার প্রিয়। আমি জানতাম, একটা বাঘিনী জন্ম দিয়েছি। খানিকের জন্য চুপ থাকলেও, শিকারীদের শিকার ঠিক করবে। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে খাবলে ছি*ড়েখুঁড়ে ফেলবে। আজ তোমাকে দেখে আমার একটু কষ্ট হচ্ছেনা শোয়েব। তুমি আমার কাছে অনেক আগেই ম*রে গেছ। যেদিন রাতে বাড়ি এসে হামতাম করলে। তোমার জন্য আমার নিষ্পাপ মেয়ের উপর দাগ লাগল। প্রতিবাদে তুমি চুপ ছিলে।সেদিন থেকেই তুমি আমার কাছে মৃ*ত। এসব তোমার প্রাপ্য ছিল।’
অঝোরে কাঁদছে শোয়েব। নোনা জলে চোখমুখ ভিজে। আয়শার পা ধরে বলতে চাইল, ‘ আমাকে ক্ষমা করো। একটু শান্তি দেও। এই অপ*রাধের দহনে কতকাল পুড়বো আর।’ কিন্তু পারলনা। তার অপ*রাধ ভাষা ছিনিয়ে নিয়েছে আজ।
আজ উঠল মুখের মুখোশ লাগাতে বলল,
‘ আসি আজ। আশাকরি আর কোনদিন দেখা হবেনা আমাদের। আমার মেয়ে থেকে দূরে থাকবে। এই জীবনের অফুরন্ত দুঃখ, বেদনা আর বিষন্নতার জন্য ধন্যবাদ। খোদা করুন কোনজীবনে যেন তোমার সাথে দেখা না হয় আর!’
ধপধপ পা ফেলে বেরিয়ে গেল আয়শা। র*ক্তিম তার চোখ। কয়েক ফোঁটা পানি যেন গড়িয়ে পড়ল।
যাওয়ার দিকে নিমিষ তাকিয়ে রইল শোয়েব। যেই অর্থ সম্পদের লোভে সে সোনার হরিণ নামক সুখ ছাড়ল। আজ সব ছেড়ে সেই নব্বইদশকে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে। সেই রঙিন দিন গুলোতে কি বাঁচা যাবে আবার? অন্তহীন আফসোসের নোনা জল গড়ালো। এই আফসোস যে শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত বইতে হবে তার। এরচেয়ে মৃ*ত্যু অনেক বেশি সুখের।

বাড়ি পৌঁছাতে না, পৌঁছাতে হাসপাতাল থেকে ফোন এলো অভিলাষার। কোন এক বোরকা পরিহীতা অগ্যত মহিলার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে শোয়েব হক অস্থির। অসুস্থ! অভিলাষা থমকে গেল? অগ্যত মহিলাটাকে কে ছবি নয়তো। পুলিশ মিডিয়ার ভয়ে লুকিয়ে এসেছে। প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না অভিলাষা। ‘আচ্ছা, আসছি’ বলে কে*টে দিলো ফোন। দরজা খুলে তড়িঘড়ি করে ছেলের ঘরে গেল। ঘরে যেতেই থমকে গেল। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। পুরোটা ঘর অগোছালো, এলোমেলো। মাটি, কাচের জিনিস গুলো ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ। ফ্লোরের জায়গায় জায়গায় র*ক্তের ফোঁটা লেগে। এই কি হাল করেছে তার ছেলে। একজন ধৈয্যশীল ম্যাচিউর মানুষটা যখন ধৈর্য হারায়। নিঃস্ব হয়। নিজের সর্বস্ব হারায়। তার অবস্থা বুঝি এমনি হয়! প্রিয়’র জন্য তার নিষ্ঠুর, জেদি ,অবাধ্য ছেলেটা নিজেকে বদলে নিয়েছিল। নিজের সবটা দিয়ে প্রিয়কে চেয়েছিল। আজ সেই প্রিয় কই? পাশে নেই কেন!
কাচের উপর ঝটপট পা চালিয়ে। ছেলের পাশে বসল। র*ক্তিম দৃষ্টিতে চিঠির দিক এখনো চেয়ে আছে শতাব্দ। হাতে জলন্ত সিগারেট। ফিল্টারে ফ্লোর বিছিয়ে। অভিলাষা ছেলের হাত থেকে সিগারেট ফেলে দিলো। বিষন্ন, অপ্রসন্ন, গম্ভীর ছেলেকে জড়িয়ে ধরল। কেঁদে ফেলল। কান্নাভেজা কাতর কন্ঠে বলল,
‘ এসব কি আব্বা! কি হয়েছে তোর।’
শতাব্দ চুপ, গম্ভীর। দৃষ্টিতে এখনো ক্রোধ জলন্ত। অভিলাষা কান্না কাঁপা কাঁপা কন্ঠে আবার বলল,
‘ প্রিয় কই?’
শতাব্দ চুপ। ছেলের চুপ থাকাটা অভিলাষার ভেতর নাড়িয়ে দিচ্ছে আরো। ভয় বাড়ছে প্রচন্ড। তিনি নিলেই কারণ খুঁজতে লাগল। শতাব্দের হাতের চিঠিটা টেনে নিলো। পড়তে শুরু করল। থমকে গেল। প্রিয় তার ছেলেটাকে এভাবে ঠকালো? এত ভালোবাসলো, বিনিময়ে এই দিলো! ছি!
অভিলাষা তড়িঘড়ি করে বলল,
‘ কোথায় গেছে প্রিয়? আমি যাবো, বুঝিয়ে আনবো।’
শতাব্দের গম্ভীর আওয়াজ,
‘ আসবেনা ও। ভীষণ জেদি মেয়ে।’
অভিলাষা বিহ্বল সুরে বলল,
‘ তো এখন?’
শতাব্দ দেয়ালে মাথা ঠেকালো। ক্লান্ত চোখজোড়া বুজে নিলো। গম্ভীর স্বরে বলল,
‘ উড়ছে, উড়তে দাও। সময় হোক, ওর ঘাড়ে ধরে ফিরিয়ে আনবো।’

শতাব্দের বাড়ি ছেড়ে প্রিয় নতুন বাড়িতে উঠেছে আজ তিনদিন। বান্ধবী ইরা-ই সব ঠিক করে দিয়েছে। কাউকে যেন নতুন বাড়ির ঠিকানা না দেয়, অনেক খোসামোদ, আকুতি মিনতি করে ইরাকে রাজি করেছে। এক রুম এডজাস্ট বাথরুম, কিচেন ছোট ড্রইং স্পেস সহ ছোটখাটো এপার্টমেন্ট। জরুরী ভিত্তিতে উঠেছে কোনরকম। প্রথম দিন ইরা রান্না করে নিয়ে এসেছে। এরপর রান্নাবান্না করেনি আর। কিছু ভালো লাগেনা। ঘুম নেই, খুদা নেই। সারাক্ষণ শুধু শতাব্দ ঘুরঘুর করে মাথায়। আচ্ছা শতাব্দ এখন কি করছে? নিশ্চই তাকে ঘৃ*ণা করছে। প্রচন্ডরকম ভাবে। তাইনা? হয়তো তাই সে এখন অবধি তার বাড়িতে এসে হানা দেয়নি। নয়তো এতক্ষণে এসে তোলপাড় করে ফেলত। নিজের বেহায়া মনের উপর রাগ হচ্ছে, খুব। শতাব্দ থেকে দূরেও থাকতে চাইছে। আবার শতাব্দকেও চাইছে। অদ্ভুত দ্বিধাদ্বন্দে ফেঁসেছে।
শুধু বুক ফেটে কান্না আসে। সারাদিন ঘরে কোনায়, এখানে সেখানে বসে শুধু কাঁদে। কতটা অসহায় হলে মানুষ ভালোবাসার মানুষকে পেয়েও দূরে ঠেলে দেয়! নিজের প্রতি, জীবনের প্রতি সে বিরক্ত! প্রচন্ডরকম বিরক্ত। অশান্তি কেন পিছু ছাড়েনা তার!
প্রান্তরে দিন ডুবছে। একটু একটু করে অন্ধকার ডাকছে। জানালায় মাথা ঠেকিয়ে প্রিয় দূর দিগন্তে চেয়ে। আচমকা ঘরের কলিং বেল বাজলো। এই অসময় কে এলো। ইরা? কপাল কুঁচকে দরজার দিক এগিয়ে গেল। দরজার অপর পাশের মানুষটাকে দেখে থমকে গেল। মৃ*ত মানুষ ফিরে আসতে পারে আদৌ! মুখ থেকে অফুটন্ত আওয়াজ বেরিয়ে এলো। বলল,
‘ মা!’

চলবে……..

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।