ফেরার কোন পথ নেই পর্ব-১৩

0
222

#ফেরার_কোন_পথ_নেই ( ১৩)
কলমে #রেহানা_পুতুল
আমি দ্রুতপদে রান্নাঘরে ছুটে গেলাম। দা নিয়ে এসে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে তাকে বললাম,
তিন কোপে তোর কল্লা আলগা করে দিব। যেইনা আমার সুদিন দেখছিস। বাচ্চাদের ভালো রেজাল্ট দেখছিস। অমনি এসবের লোভে এখন বিয়ের বাহানা তুলছিস। লোভী! অমানবিক! জালিম কোথাকার।

এহসান তিন পা সরে দাঁড়ালো হতচকিত হয়ে। মা কেন যেন সরে গেল আমাদের সামনে থেকে। তবে আমি চেয়েছি মা থাকুক। যেই মানুষটার সাথে আমার নেই কোন হৃদয়ের লেনাদেনা। যেই মানুষটার সাথে আমার ইহজগতের সমস্ত বন্ধন সাঙ্গ হলো। সেই মানুষটার জীবন্ত অস্তিত্ব দিয়ে আমার যে আর কোন কাজ নেই। নেই তার সাথে ব্যক্তিগত আলাপচারিতা।

এহসান আমার দিকে চেয়ে মরা সুরে বলল,
শিলা আমি বাইরে গিয়ে চিকিৎসা নিব। তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তার বলছে উন্নত চিকিৎসা করালেই আগের মত স্বাভাবিক হয়ে যাব আমি। দীর্ঘদিন অতিরিক্ত চা,কফি,মদ্যপানের জন্য আমার ফিজিক্যালি পাওয়ার ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে৷ মাদ্রাজ গিয়ে উন্নত চিকিৎসা করলেই স্বাভাবিক হয়ে যাব।

আমি তীর্যক হাসি হাসলাম। বাঁকা ঠোঁটে বললাম,
এত বেশরম, ব্যক্তিত্বহীন, বেহায়া মানুষ আমি সাতজনমেও দেখিনি। এই তুই না খুউব দম্ভ করে সুখ সুখ গলায় আমায় বললি,
মিতা তোর জীবনে প্রথম ও শেষ ভালোবাসা? তাহলে এখন আমার কাছে কি? আমিতো তোর লাইফে মাঝখান দিয়ে এসে শুধু গড়াগড়িই খেলাম স্রোতে ভাসা শ্যাওলার মতন। এটা তোর ভাষ্যমতে। তার সাথে তোর প্রণয়ের বিচ্ছেদ হলো কি করে? দেখলিতো এবার। যত মধু তত বিষ। অতি মধুতে পিঁপড়া বাসা বাঁধে।

এহসান ঠান্ডা গলায় বলতে লাগল,
আমার সাথে তার বনিবনা হচ্ছিলনা। আসলে আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি। কিছু সম্পর্ক দূরে থেকেই সুন্দর। কাছে জড়ালেই যত সর্বনাশ। কারণ তখন সেই মানুষটার স্বরূপ উন্মোচিত হয়ে যায়। খোলস থেকে বেরিয়ে আসে ছলনার আড়ালে থাকা তার মুখোশখানি।

আমি মিতাকে সত্যিই অনেক ভালোবাসতাম। এট ধ্রুবসত্যি। সেও আমাকে প্রচন্ডভাবে ভালোবাসত।
তবে সেখানে ফাঁকফোকর রয়েছে।।যেটা আগে আমার নজরে পড়েইনি।
আমাকে যখন পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। তারপর সে তার সঞ্চিত টাকা খরচ করে করে চলছিল। আমি ছাড়া পেয়ে আসার পর হতেই মিতা হা-হুতাশ করতে লাগল।

অভিযোগ করে সকাল বিকাল বলতে লাগল,
আমি আমার জায়গায় ভালোই ছিলাম। তোমার জন্য সন্তান, সমাজ, সংসারে অবহেলিত হলাম। তোমার সংসারে থেকে আমার নিজের টাকা খরচ করে চলতে হলো। গ্রামে মেয়ের মাদ্রাসার খরচ ও দিতে হচ্ছে। তো কি লাভ হলো এতসব ত্যাগ, আর সম্মান জলাঞ্জলী দিয়ে তোমার কাছে এসে? তোমার নতুন দোকান ও চলেনা। কত বিপর্যয়ের মুখোমুখি তুমি। আমাকে কিভাবে চালাবে?

আমি গোপনে বললাম,
অভাব যখন দুয়ারে এসে দাঁড়ায়
ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়৷ ভাঙ্গাবাসা হয়ে।

ও আরও বলল,
শিলা এটার চেয়েও বড় সমস্যা দেখা দিল ফিজিক্যালি সম্পর্কে নিয়ে। সে তুমুল ঝগড়া বাঁধিয়ে দিল আমার সাথে। বলল,আমি তোমার কাছে থাকলে ভাবছি একটা সন্তান নিব। তাতে আমার অবস্থান মজবুত হবে শিলার কাছে। এখন সেই পথ ও রুদ্ধ। মিছে গুড়েবালি। তুমি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে, আমার প্রাপ্য দুই লাখ টাকা কাবিন দিয়ে দাও। আমি চলে যাব আমার আগের সংসারে। দুই লাখ টাকা ছেলেদের হাতে দিলে ওরা আমাকে গ্রহণ করবে। বের করে দিবেনা।

ওকে অনেক মানানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। পরে নিজ থেকে ইচ্ছে করেই তাকে ডিভোর্স দিই। আমার লাইফে ওকে এখন জঞ্জাল ছাড়া আর কিছুই মনে হয়না। নগদ দুই লক্ষ টাকাও দিয়ে দিয়েছি। যোগাযোগ ও বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি।

তুমি আমাকে ডিভোর্স দিতে পার এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি শিলা। তোমার এত অগ্নিরূপতো আগে কখনই ছিলনা।

হ্যাঁ ছিলনা। আমি আগে ছিলাম দিঘির শান্ত শীতল জল। এখন হয়েছি সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ। আমার থেকে যোজন যোজন দূরে থাকবে যদি প্রাণে বাঁচার ইচ্ছা থাকে।

নয়তো আমার উত্তাল ঢেউয়ের প্রবল স্রোতের টানে ভেসে গিয়ে পতিত হবে গভীর গিরিখাদে।

এহসান স্তম্ভিত! বাকরুদ্ধ হয়ে গেল আমার তেজস্বী কন্ঠ শুনে ও চেহারা দেখে। মুমূর্ষুর মত হেলতে দুলতে বেরিয়ে গেল এলোমেলো পায়ে।

বাচ্চাদের মুখ দেখতে চেয়ে শত আকুতি করেও পারলনা। এশা বাকি দুই ভাইবোনকে নিয়ে তার রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভিতরে বসে রইলো।

ও চলে গেল সেজোখালাকে ফোন দিলাম। মিতার অবস্থা জানতে চাইলাম। এহসানের বলা কতটা সত্যি তা স্পষ্ট হওয়ার জন্যই। মা আমার পাশেই বসা ছিল।

খালা বলল,
এদিকে ধুন্ধুমার অবস্থা। মিতাকে তার ছেলেরা ও বাড়ির সবাই বের করে দিয়েছে। বাড়ির মুরুব্বিদের কথা হলো, তুই এই বাড়ির বউ হয়ে দূর সম্পর্কের ভাগনি জামাইকে বিয়ে করেছিস। মুন্সী বাড়ির মান ইঞ্জত ধূলায় লুটালো তোর জন্য। এই বাড়ির সমস্ত কিছুর থেকে তুই অধিকার হারালি। তুই এই বাড়িতে থাকতে পারবিনা। তবে তোর ছেলেরা তাদের মা হিসেবে চাইলে তোকে ঘরে জায়গা দিতে পারে।

কিন্তু তার ভরসাস্থল ছেলেরাও মুখ ফিরিয়ে নিল। বিমুখ হয়ে ওরা বলল,

উনার জন্য রাস্তাঘাটে পা রাখতে পারিনা। সবাই জিজ্ঞেস করে বাজে ইঙ্গিত দিয়ে। সুতরাং এমন মাকে আমাদের লাইফে প্রয়োজন নেই। যেই মায়ের জন্য দূর্নাম রটে গেল পুরো গ্রামে। পরে ছেলেদের বেয়াড়া আচরণে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ছাড়ল। বাবার বাড়িতেও ঠাইঁ মেলেনি মিতার। তারাও নাকি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছে আরো আগেই। শুনলাম এখন চরের দিকে এক রুম ভাড়া নিয়ে একাকী জীবন যাপন করছে। কি মর্যাদার জীবন ছিল স্বামীর সংসারে। কথায় আছেনা সুখে থাকতে ভূতে কিলায়। অতি লোভে তাঁতী নষ্ট। নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারল। ছি’ না’ ল মেয়েলোকের দূর্গতির জিন্দেগীর জন্য নিজেই দায়ী। আর কেউই নয়।

আমি তার পরের মাসেই বাসা চেঞ্জ করে ফেলি। হারামিটা যেন যখন তখন হুটহাট না এসে পড়তে পারে। একরাম ভাইকেও মানা করেছি যেন না বলে। আমার নিরানন্দ জীবন পার হচ্ছে জীবনের নিয়মে।

সে কোথায় আছে না আছে আমরা কিছুই জানিনা। কোন খোঁজখবর ও রাখছিনা কেউই। এভাবে কেটে গেল আরো কয়েকমাস।

আমার নিষ্ঠা, ধৈর্য, সততা, অক্লান্ত পরিশ্রম,মেধা, ও সময়ের পিঠের সওয়ারি হয়ে ‘ সুইঁ সুতা ফোঁড়’ সেলাই ঘর এগিয়ে গেল বহুদূর। তাকাতে হয়নি পিছনে। সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল সবদিকে। সংগ্রামী নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আমি শিলা হোসেন অনেকের চেনা প্রিয় মুখ হয়ে যাচ্ছি। অনুকরণীয় হয়ে উঠছি বহু টানাপোড়েনে থাকা নিষ্পেষিত নারীর।

এদিকে বছর শেষে বাদল ভাই বিয়ে করে ফেলল পরিবারের চাপে। বিয়েতে মা সহ আমরা সবাই গেলাম। উনার আবদার অনুযায়ী ফুলসজ্জা সাজিয়ে দিলাম আমার নিজের হাতেই।

মা ও নানুর ঐকান্তিক আদরে যত্নে তরতর করে বেড়ে উঠছে আমার কলিজার তিন সন্তান। ক্লাসের দিক দিয়েও আরেক ধাপ উপরে উঠে গেল। ওদের দেখলেই আনন্দে অন্তরখানি জুড়িয়ে যায় আমার। গর্ব হয় নিজেকে নিয়ে। হয়তো আমি পেরে উঠছি।

” পৃথিবীতে যত বড় সমস্যাই হোক। তা কখনোই চিরস্থায়ী হয়না।”

দুই বছরের মাথায় আমরাও তাকে ভুলে গিয়ে স্বাভাবিক জীবন পার করছি। জীবনের অজস্র বাঁক রয়েছে। কণ্টকাকীর্ণ পথ চলায় কে কখন কোন বাঁকে চলে যায়। তা আগে থেকে কোন মহাঋষিও বলতে পারবেনা। কেননা এই বাঁকগুলো সব মসৃণ নয়। এবড়োথেবড়ো। উঁচুনিচু। এর রংগুলোও সব রংধনুর মত উজ্জ্বল নয়। কোনটা গাঢ় ধূসর। কোনটা শুভ্র সাদা। কোনটা আঁধার কালো। কোনটা আবার বেশ ঝলমলে।

এই যে আমি শুরুতেই ছিলাম ঝলমলে ভুবনের বাঁকে। তারপরে আবার চলে গেলাম এক ক্রুশ অন্ধকারের অতলে। এখন যাচ্ছি হয়তো শুভ্র সাদা বাঁকের ভুবনে।

কিন্তু তবুও বুকের চিলেকোঠায় কি যেন নেই একটা। শূন্য শূন্য লাগে খানিক। একান্ত একজন মানুষ নেই। কি হয় না থাকলে। কি হয় না বলতে পারলে। ফোন কলে নাইবা বলল কেউ,

আসনা বাইরে। গল্পে আড্ডায় কফির কাপে ঝড় তুলি। তুমুল প্রেমে হারিয়ে যাই মহাকালের দিকে।

ওহ! নিঃশ্বাস্টা বড় ভারি হয়ে এলো।

” জীবনের সবকথা সবাইকে বলতে নেই। কিছু কথা গোপন থাকতে হয় নিজের জন্য।”

আজ ফাগুনের কোন এক শুক্রবার। চারদিকে পাতা ঝরা রঙিন বসন্ত। ফাগুনের উদাসী ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে। ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।

আমার সাথে আছে আরো কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষী। ক্ষুধার্তদের রাজকীয় ভোজন করাচ্ছি আমি। অনেকদিনের এই ইচ্ছে ছিল আমার। যদি কোনদিন নিজে স্বাবলম্বী হতে পারি। প্রতিমাসে একবেলা করে গরীব অনাহারীদের খাওয়াব আমি। এদের যোগাড় করেছে আমার সেলাইকর্মীর ছেলেমেয়েরা।

আমি নিজ হাতে সবার প্লেটে খাবার বেড়ে দিচ্ছি। একদম শেষমাথায় গিয়ে খাবার দিতেই আমার হাত থেমে গেল। কেমন যেন চেনা লাগছে লোকটাকে। বুভুক্ষুর ন্যায় সে আমার দিকে নয় খাবারের দিকে চেয়ে আছে। কেবল ঘোলাটে চোখে আমাকে একবার দেখল রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে। মুখভর্তি দাঁড়িগোঁফ। বিদীর্ণ চেহারা। উসকোখুসকো চুল। ময়লা ছেঁড়া পোশাক। রুগ্ন শরীর।

অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করলাম আপনিইই…?

কন্ঠকে খাদে নামিয়ে আস্তে করে জবাব দিল।
শিলা আমি এহসান।
চলবে।