বড়ো আপা পর্ব-১৩+১৪

0
77

#বড়ো আপা
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১৩

এমন সময় আমজাদ সাহেবের মোবাইলটা বেজে উঠল। উনি বারবার কল কাটছেন। তবুও কলটা যেন বেজেই চলেছে। যতবার উনি কল কাটছেন ততবারেই অপরপক্ষ পুনরায় কল দিচ্ছেন। এবার বেশ বিরক্ত হয়েই মোবাইলটা হাতে নিয়ে সামনের দিকে এগুলেন। করিডোরের এক পাশে আসলেন। আমি কেন জানি না উনার পিছু পিছু গেলাম। আমাকে উনি চেনেন না। তাই হয়তো আমার উপস্থিতি তিনি বেশি পাত্তা দিলেন না। কলটা ধরেই বলে উঠলেন

“মালিহা ডোন্ট কল মি নাউ। আমি এখন খুব ঝামেলায় আছি। ভেবেছিলাম খুব দ্রূত সবকিছুর মালিক হব কিন্তু এখন সবকিছুই ভেস্তে যাচ্ছে। আনহারি বেঁচে আছে। আমি আর তুমি মিলে তাকে হত্যা করেছিলাম। কীভাবে ও বেঁচে রইল। মৃত মানুষ কীভাবে বেঁচে উঠে? রতন আমাদের সাহায্য করেছিল। সে তো আনহারিকে দেখে কোমায় চলে গেছে হয়তো। ব্রেন স্ট্রোক হয়েছে তার।”

কথোপকথনে যতদূর বুঝলাম মালিহা আমজাদ সাহেবের প্রেমিকা। আর সেই নিজের হাতে তার সন্তানকে খু/ন করেছিল। একটা বাবা এটা কীভাবে পারে। তাহলে বড়ো আপার খু/নের সাথেও কী আমার বাবা জড়িত? সবমিলিয়ে আমি যেন পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমি আরও ভালো করে তার কথোপকথনে মন দিলাম। কথোপকথনের স্রোত দেখে বুঝতে পারলাম অপর পক্ষ বলছে

“এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আনহারির মৃত্যুর পর আমরায় তাকে মর্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। মর্গের লোককে টাকা খাইয়ে রিপোর্টে রোড এক্সিডেন্ট লিখতে বলেছিলাম। এমন না তার মুখ থেতলে গিয়েছিল। তার মুখ অবয়ব একদম স্পষ্ট ছিল। ময়না তদন্তে নিজ চোখে তাকে নিতে দেখেছি। আনহারি বেঁচে থাকবে এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। নিশ্চয় মেয়েটা ফেইক। ভালো করে খোঁজ লাগাও। ডি এন এ টেস্ট করাও। কোনোভাবেই আনহারি বাঁচবে না। এটা কখনই সম্ভব না।”

আমজাদ সাহেবের অস্থিরতা বাড়ছে সেটা তার মুখের প্রতিচ্ছবি দেখেই মনে হচ্ছে। ফর্সা মানুষটা একদম ঘেমে একাকার। নীল হয়ে গেছে তার মুখ। বড়োলোকের চরিত্র হয়তো এমনই হয়। তিনি নির্দ্বিধায় একটি মেয়ের জন্য নিজের মেয়েকে খুন করেছিল। কিন্তু এখানেও প্রশ্ন তাহলে এ মেয়েটি কে? এসব ভাবতে ভাবতেই তিনি কল কেটে দিলেন। আমি এ পাশ থেকে সরে দাঁড়ালাম। হয়তো খুব শীঘ্রই বিষয়টা ক্লিয়ার হয়ে যাবে। আমজাদ সাহেব আনহারির সামনে আসতেই আনহারি বলে উঠল

“পাপা তুমি কোথায় গিয়েছিলে? রতন এমন কেন বলল আমাকে?”

আমজাদ সাহেব রেগে গেলেন। আনাহরির মুখের উপর বলে উঠলেন

“তুমি আমার মেয়ে নও। আমার মেয়ে মারা গেছে। কে পাঠিয়েছে আমার মেয়ে সাজিয়ে বলো? মনে হচ্ছে এত এত টাকার লোভে কেউ তোমাকে সার্জারি করে পাঠিয়েছে।”

এ কথা শুনে আনহারির মা তীব্র গলায় বলে উঠল

“আমার বিশ্বাস ছিল আমার মেয়ে বেঁচে আছে। এবং বলেছিও আমার মেয়ে বেঁচে আছে একদিন তোমাকে এসে সারপ্রাইজ দিবে। দেখো আমার মেয়ে ঠিকই ফিরে এসেছে। এরকম কথা আর বলবে না। এটাই আমাদের আনহারি। মা কখনও মেয়েকে চিনতে ভুল করবে না।”

“লাবু তুমি আবেগে সব গুলিয়ে ফেলছো। আমাদের মেয়ে মারা গেছে। নিজ হাতে তাকে কুরবানী করেছি।”

আনহারির মা আমজাদ সাহেবের এ কথা শুনে সাথে সাথে জিজ্ঞেস করলেন

“কুরবানী করেছো মানে?”

আমজাদ সাহেবের মুখ ফসকে সত্যিটা বের হয়ে গেলেও তিনি কথার স্রোত পাল্টিয়ে বললেন

“কুরবানী কবর কেন? কবর দিয়েছি। আমি আমার মেয়েকে নিজ হাতে কবর দিয়েছি। এটা আমাদের মেয়ে না।”

আনহারি কপাল কুচকে জবাব দিল

“বাবা আমি মরিনি। সেদিন এক্সিডেন্টের পর আমাকে মা বিদেশে ট্রিটমেন্ট করতে নিয়ে গিয়েছিল। আমি সুস্থ হয়ে সেখানেই থেকে যাই। আমার এক্সিডেন্টের পর পর মা সিঙ্গাপুর ছিল না একমাস? তুমি কী ভুলে গেছো সব?”

আমজাদ সাহেব আমতা আমতা করে জবাব দিলেন

“হ্যা ছিল তবে সেটা লাবুর ট্রিটমেন্টের জন্য।”

লাবু এর পুরো নাম হচ্ছে লাবনী জোহা। আনহারির মায়ের নাম লাবনী জোহা । লাবনী জোহা আমজাদ সাহেবকে থামিয়ে বললেন

“এটা একটা সারপ্রাইজ। আমার মেয়ে তোমাকে সারপ্রাইজ দিবে বলেই আমাকে নিষেধ করেছিল ওর ব্যাপারে যেন না বলি৷ এখন সে পড়াশোনা শেষ করে সারপ্রাইজ দিতে এসেছে। এখানে আর কোনো কথা থাকতে পারে না আমজাদ। এটাই আমাদের মেয়ে। ”

আনহারি এবার আবেগী গলায় বলে উঠল

“মা.. বাবা তো আমাকে একদম মানতেই পারছে না। আমি মরে গেলেই হয়তো বাবা খুশি হত। রতনেরও আমার জন্য এ হাল। একদম ভালো লাগছে না আমার।”

লাবনী জোহা একটু দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন

“এখানের সবাই জানে তুমি মারা গেছো। অনেকবার বলেছি তারা তো আমাকে মানসিক রোগী বানিয়ে দিত। তুমি চায়তে একেরবারে দেশে এসে কথা বলবে তাই কাউকে যেন তোমার নম্বর বা কিছু না দিই৷ সেজন্য প্রমাণও করতে পারিনি। তোমার বাবার কথায় কিছু মনে করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে আস্তে আস্তে। রতন শকে চলে গেছে এর বাইরে কিছু নয়।”

তারপর লাবনী জোহা আমজাদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন

“তুমি চাচ্ছ তার ডি এন এ টেস্ট হোক। তবে সেটাই হবে। কাল আনহারির ডি এন এ টেস্ট করাব। সে আমাদের মেয়েই এটা যদি প্রমাণ হয় তখন তো মানতে অসুবিধা নেই?”

আমজাদ সাহেব স্বাভাবিক এবং পরিপক্ক গলায় উত্তর দিলেন

“আলবাদ ফেইক প্রমাণ হবে। মৃত মানুষ কখনও ফিরে আসতে পারে না। এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।”

“আচ্ছা এখন আমরা রতনের বিষয় নিয়েই আলোচনা করি। আনহারির বিষয়টা কাল বুঝবো। আমি রাতে ডাক্তারের সাথে কথা বলে রাখব৷ অবশ্যই বিষয়টি গোপন রাখবে। কারণ মান সম্মান জড়িয়ে আছে এতে।”

আমি এসব কথার মধ্যে একদম চুপ রইলাম। একটু আগের শুনা সব কথায় আমি বুকে চেপে রাখলাম। কারণ এখন এসব বলতে গেলে কেউ বিশ্বাস নাও করতে পারে। আর আমজাদ সাহেবও পল্টি নিতে পারে। বুদ্ধিমানের কাজ হলো চুপ হয়ে থাকা।

এদিকে রতনকে হাসপাতালের আই সি ইউ তে রাখা হলো। সন্ধ্যা নেমে আসলো। অনেকক্ষণ বাসার বাইরে। মা কল দিল। কল দিয়েই বলতে লাগল এত দেরি কেন করছি। আমি মাকে কোনোরকম একটা বুঝ দিলাম। তারপর আনহারি আর লাবনী জোহার কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলাম। বিদায় নিয়ে আসার সময় আনহারি আমার হাতটা চেপে ধরে বলল

“নম্বরটা দিয়ে যাও তুমি। কাল অবশ্যই দেখা করবে। তারপর বাকি কথা হবে। তোমার বোন অনন্যার সাথে ঘটে যাওয়া প্রতিটা কাহিনি আমাকে বলবে।”

আনহারির মুখ থেকে অনন্যা নাম শুনে আমি চমকে গেলাম। একটা বারের জন্যও আমি তাদের বড়ো আপার নাম বলিনি তাহলে সে কী করে নাম জানল? আমি আর কিছুই ভাবতে পারছি না। ভেতরে ভেতরে একটা ভয় জাগতে লাগল। ভয়টা কেন হচ্ছে জানি না। আমি কী কোনো গোলক ধাঁধায় ফেসে যাচ্ছি না তো? আমি কাঁপা গলায় বললাম

“আপনি আমার আপার নাম জানলেন কীভাবে?”

জোর দিয়ে তিনি উত্তর দিলেন

“কথায় কথায় তুমিই বলেছিলে।”

আমি আর কিছু বললাম না। বিদায় নিয়ে বাসায় চলে আসলাম। বাসায় আসার পর থেকে আমার কেবল এটাই মনে হচ্ছে এই আনহারিই অনন্যা। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যায় মারা গেল কে? মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম এ বাড়িতে যে করেই হোক আমি ঢুকে থাকব। এমন সময় মা এসে রেগে গিয়ে বললেন

“কই ছিলি সারাদিন? দুইটা টিউশন থেকে কল দিয়েছে তুই সেখানে যাস নি। ছিলি কোথায় তুই? তুই ও যদি বড়োটার পথ ধরিস, বলার কিছু নাই। এক মেয়ে মুখ পুড়লো। আর সেজন্য গ্রামে থাকতে পারলাম না। আর তুই যদি মুখ পুড়াস শহরেও থাকতে পারব না।”

মায়ের কথায় কিছুটা রাগ চড়লেও। আমি সেটা দমিয়ে নিয়ে মৃদু গলায় বললাম

“মা আমি একটা চাকুরি পেয়েছি। আমি কাল থেকে সেখানেই থাকব। টিউশন আর করতে হবে না। ঐখানে থাকা খাওয়া ফ্রি আর কিছু টাকাও পাব। পড়াশোনাটাও আরেকটু ভালো করে করতে পারব। তুমি না করো না প্লিজ।”

আমি জানি মায়ের না করার সাধ্য নেই। কারণ অভাবের সংসারে আমার গতি হয়েছে এতেই তিনি খুশি। মা সহজে রাজি হয়ে গেলে।

ভাবনার সাগরে ডুবতে ডুবতে কখন যে ঘুমের সাগরে ডুবে গেলাম খেয়াল নেই। ঘুম থেকে উঠে লক্ষ্য করলাম ১১ টা বেজে গেছে। আমি তাড়াহুড়ো করে উঠলাম। মাকে অনেক পটিয়ে জবের নাম করে আনহারির ভবনের দিকে রওনা দিলাম। সে বাসায় যাওয়ার একটায় লক্ষ্য, রহস্য উদঘাটন করা।

এবার কেউ আমাকে ভবনে ঢুকতে আটকায় নি। খুব সহজে ভবনে ঢুকে গিয়েছি আমি। তবে ঢুকার সাথে সাথে একটা বিষয় আমার পরিষ্কার হয়ে গেছে। যেটা নিয়ে আমি দ্বিধাদ্বন্ধে ছিলাম সেটা কেটে গেছে। সে সাথে আনহারির এবং আনহারির বাবার সকল প্রশ্নের উত্তর মিলে গেছে। কারণ এ আনহারিই হলো, কী মনে হচ্ছে? এ আনহারি কী অনন্যা নাকি সত্যিই আনহারি?

কপি করা নিষেধ

#বড়ো আপা
#পর্ব-১৪
#শারমিন আঁচল নিপা

আনহারির ফিংগার প্রিন্ট ম্যাচ করেছে। আগের ফিংগার প্রিন্ট এর সাথে এখনের টা হুবুহু ম্যাচিং। ভোটার আইডি কার্ড করার সময় সে এ ফিংগার প্রিন্ট দিয়েছিল। আজকে সেটার সাথে একদম মিলে গেছে। একজনের ফিংগার প্রিন্ট আরেকজন কপি করতে পারে না। সবকিছু মিলে বুঝায় যাচ্ছে এ মেয়ে আনহারি। তাহলে আমি এটা নিশ্চিত ঐদিন আমার বড়ো আপায় মারা গেছে। তবে দুই বছর আগে আমজাদ সাহেব কাকে মেরেছে সেটা এখনও ধোয়াশায় রয়ে গেছে। ডি এন এ টেস্টের আর দরকার পড়েনি। এতেই প্রমাণ হয় তারা দুজন এক।

আমি প্রবেশ করতেই আমজাদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন

“এই মেয়ে কে?”

লাবনী জোহা উত্তর দিলেন

“আনহারির বান্ধবী।”

আমজাদ সাহেব আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলেন। একে তো আমি বয়সে আনহারির অনেক ছোটো তার উপর ভালো কাপড়চোপড় পরা নেই। এমন মেয়ে কী করে আনহারির বান্ধবী হয় সেটাই হয়তো তিনি ভাবছেন। আমার দিকে কয়েকবার তাকালেন। তারপর ক্লান্ত একটা মন নিয়ে উনার রুমে চলে গেলেন। লাবনী জোহা আমাকে দেখে বললেন,

“আমি জানি না তোমার বোন কে? তার সাথে কী হয়েছিল। জানার আগ্রহও আমার নেই। কারণ এসব আমার ভীষণ প্যারা লাগে। আনহারিকে ফিরে পেয়েছি এটাই আমার জীবনের সব। বাকি সব আমার কাছে কেবল মলিনতা ছাড়া কিছু নয়। আনহারির যেহেতু জানার আগ্রহ আছে। তুমি আনহারিকে সবটা বলতে পারো। এ বিষয়ে আমি না জানলেও চলবে।”

বুঝতে পারলাম লাবনী জোহা আনহারিকে পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। আর কিছুতে তার কিছু আসে যায় না। এদিকে আমার মনে অনেক কিছুই ঘুরছে। দুই বছর আগে কে মারা গেল। আনহারি আর বড়ো আপার মধ্যে এত সাদৃশ্য কেন। সবমিলিয়ে ভাবনার অতল গহ্বর থেকে যেন আমি বের হতে পারছি না।

লাবনী জোহা সেখান থেকে প্রস্থান নিলেন। আনহারি আমাকে ডেকে বলল

“আমার সাথে আমার রুমে এসো। এরপর নাহয় তোমার বড়ো আপার কথা শুনব। এখন আগে বলো কী খাবে? আমি মদিনাকে বলছি তা করে দিতে।”

আনহারির চারিত্রিক বৈশিষ্ট একদম মিশুক প্রকৃতির। এত বড়ো ঘরের মেয়ের ব্যবহার এত অমায়িক সেটা দেখে মনটা ভরে উঠল। বড়োলোকদের প্রতি একটা ধারণা আমার পাল্টে গেল। বুঝতে পারলাম সব বড়োলোক এক নয়। হাতের আঙ্গুল যেহেতু সমান না সেহেতু সব বড়োলোকের আচার ব্যবহারও সমান না। অনেকেই আছে দুলাভাইয়ের মতো নির্দয়, কঠোর আবার অনেকেই আছে আনহারির মতো স্নিগ্ধ, সজীব আর মিশুক।

আনহারির কথার প্রেক্ষিতে আমি বললাম

“আমি বাসা থেকে খেয়ে এসেছি। কিছুই খাব না। আপনার কিছু খেতে ইচ্ছা করলে খেতে পারেন। আমার জন্য ভাববেন না।”

“তা বললে হবে না। আচ্ছা তোমার জন্য মদিনাকে বলি গুড়ের পায়েস করে দিতে। এটা তো তোমার পছন্দ তাই না?”

আনহারির মুখে এ কথা শুনে আমি থমকে গেলাম। আমার ভেতরটা কেঁপে উঠল। উনি কী করে জানলেন আমার এটা পছন্দ। আমি আমতা আমতা করে বললাম

“আপু আপনি জানলেন কী করে এটা আমার পছন্দ? আমি তো আপনাকে বলিনি। বড়ো আপা জানত। বড়ো আপা তো গত হয়েছে সেই বারো বছর আগে। আর আপনার মা বলল আপনার জন্ম বিদেশে তাই আপনারা জমজ কেউ ছিলেন এটাও বলা যায় না। কারণ আমার বোনের জন্ম অজপাড়াগাঁয়ে। মাঝে মাঝে মনে হয় আপনিই আমার বড়ো আপা। আর আপনার এ কথাগুলো আমাকে মনে করতে বাধ্য করে। আচ্ছা পূর্ণজন্ম বলে কী কিছু আছে?”

আনহারি আমার কথা শুনে হাসলেন। হেসেই জবাব দিল

“পূর্ণজন্ম বলতে কিছু নেই। আমি শুধু আন্দাজে এ কথাটা বলেছিলাম। আমার ভীষণ পছন্দ তো তাই। যাইহোক তোমার বড়ো আপা আমি নই তবে আমাকে ভাবতে পারো। যেহেতু দেখতে দুজন এক। আবার বলছো আচার আচরণেও বেশ সাদৃশ্য আছে। সুতরাং আমাকে বড়ো আপা বলেই ডেকো। এখন আমার রুমে এসো। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছো। আর কত দাঁড়িয়ে থাকবে?”

আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়েই আনহারির সাথে তার রুমে প্রবেশ করলাম। পুরো রুমটা সুসজ্জিত। আমি রুমের আনাচে কানাচে দেখতে লাগলাম ভালো করে। হঠাৎ করে আমার চোখ পড়ল একটা ময়ূরের পালকের উপর। এ পালকটা আমি বড়ো আপার কাছেও দেখেছিলাম। বড়ো আপা বলেছিল এটা তার ভীষণ প্রিয়। বইয়ে নাকি এরকম পালক রেখে দিলে নতুন পালক গজায়। কিন্তু এ নিয়ে কোনো কথা বলার সাহস পেলাম না। যেখানে প্রমাণিত সে আনহারি সেখানে অনন্যা প্রমাণ করাটা বোকামি। তবে এ মেয়ের সবকিছু আমার বড়ো আপার সাথে মিলে। জমজ না হয়েও এতটা মিল আমি সত্যিই মানতে পারছি না। মনে হচ্ছে এতে অনেক বড়ো রহস্য লুকিয়ে আছে তবে রহস্য ভেদ করতে পারছি না। আমি কেবল চুপ হয়ে বসে পড়লাম। মনের ভেতরে থাকা প্রশ্ন গুলো মনের মধ্যেই গেঁথে রাখলাম। এর মধ্যেই আনহারি বলে উঠল

“এবার তোমার বড়ো আপার কাহিনি বলো কী হয়েছিল।”

আমি কিছুক্ষণ চুপ রইলাম। তারপর হালকা গলায় প্রথম থেকে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা বলে উঠলাম। আপা কীভাবে মারা গেল। আপার কেন জানাজা হলো না। আমরা কেন গ্রামে থাকতে কেন পারলাম না। নিজেদের একটা ভিটা থাকার পরও কেন ভোগ করতে পারলাম না।
সব শুনার পর আনহারির চোখের জল থই থই করছিল। যেকোনো সময় গড়িয়ে পড়ার উপক্রম। গড়িয়ে পড়ার আগেই হাতের উল্টে পিঠ দিয়ে মুছে নিল। তারপর হালকা গলায় বলল

“আমিও চাই তোমার বড়ো আপার খুনীদের শাস্তি হোক। তোমার বড়ো আপা আত্মহত্যা করলেও এ খুনের জন্য পরোক্ষভাবে তারা দায়ী। আর এমনও হতে পারে তাকে খু/ন করা হয়েছে। সবমিলিয়ে বিষয়টা একটু ঘাটা দরকার। অপরাধীর শাস্তি পাওয়া দরকার। তবে আমি কোনো পুলিশ বা কিছু নিয়ে যাব না। তিলে তিলে মারব।”

আনহারির কথা শুনে কিছুটা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম

“তিলে তিলে মারবেন মানে?”

“মানে তারা যেন আতঙ্কে থাকে, ভয়ে থাকে। আমি সেখানে অনন্যা সেজেই যাব। আর বলব সেদিন যে খুন হয়েছিল সেটা অনন্যা না অন্য কেউ। দাবার কোর্টে রাজাকে যেভাবে চেক দেয়। আমিও ঠিক সেভাবেই তাদের চেক দিব।”

আমি আর কোনো মতামত দিলাম না। এটাই হয়তো বেষ্ট হবে। আমি কেবল মাথা নাড়লাম। দুজন সিদ্ধান্ত নিলাম কালকেই কুঁড়গাও যাব। দীর্ঘ বারো বছর পর সে গ্রামে পা রাখব ভাবতেই যেন মনটা উতলা হয়ে যাচ্ছে। আপার করবটা দেখতে পারব। আপার স্মৃতি জড়িত জায়গা গুলো স্পর্শ করতে পারব। এটা ভেবেই আমার ভেতরটায় অদ্ভুত একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বুকটা ফেটে কান্না আসছে৷ আপাকে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমাকে ঝেঁকে ধরেছে। আমি কেন জানি না নিজেকে সামলাতে পারলাম না। আনহারিকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম।

কান্নার এক পর্যায়ে মদিনা প্রবেশ করায় আমি থেমে গেলাম। গুড়ের পায়েস চলে এসেছে। পায়েস খাই না অনেকদিন হয়ে গেল। মা রান্না করে না। অভাবের সংসারে এতকিছু হয়ে উঠে না। আনহারি মদিনার থেকে পায়েসের বাটি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিল। এবং সে তার নিজের জন্যও এক বাটি পায়েস নিল। তারপর মদিনাকে বিদায় করে দিল। আমি চামচ দিয়ে পায়েসটা মুখে নিলাম। নিজের পছন্দের খাবার টা খেয়ে যেন তৃপ্তি অনুভব করলাম। কার রিজিক কখন আল্লাহ কোথায় লিখে রাখে… এটা বুঝা সত্যিই অনেক কঠিন। দুদিন আগে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি এখানে এসে কিছু খাব।

এসব ভাবতে ভাবতে কয়েক চামচ মুখে নিয়ে আনহারির দিকে তাকিয়ে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। ভাবতে লাগলাম এটা কী দেখছি। এটা সত্যিই নাকি আমার মনের ভুল?

কপি করা নিষেধ

শারমিন নিপা
শারমিন আক্তার