বড়ো আপা পর্ব-১৫+১৬

0
80

#বড়ো আপা
#পর্ব-১৫
#শারমিন আঁচল নিপা

আনহারি চামচ দিয়ে পায়েস না খেয়ে বাটি ধরে খাচ্ছে। এমনটা কেবল আমার বড়ো আপা করত। মানুষের চেহারার সাদৃশ্য মানা যায় তবে আচরণের সাদৃশ্য গুলো কেন মানতে পারছি না। আনহারি কোনোভাবে আমার বড়ো আপা নয়তো? এসব ভেবেও আমি চুপ করে রইলাম। কথা বললাম না। হয়তো বড়ো আপার ঘোরে আছি তাই এমনটা মনে হচ্ছে। আমি আর কিছুই যেন নিতে পারছিলাম না। ঠিক তখনই চোখ পড়ল আনহারির হাতের কনুইয়ের দিকে৷ একটা কাটা দাগ যেটা বড়ো আপারও ছিল৷

আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি আর বড়ো আপা শালুক তুলতে গিয়েছিলাম বিলে। ক্ষুধার জ্বালায় অনেক সময় শালুক তুলে খেতাম আমরা। সেদিন শালুক তুলতে গিয়ে আপার কনুইটা বাশের কন্চি দিয়ে কেটে যায়। সে কি রক্ত যাচ্ছিল। আমি তখন আপাকে দূর্বা ঘাস চিবিয়ে ঘাসের রস করে দিয়েছিলাম। এটা কী করে সম্ভব আনহারির হাতেও একই দাগ। আমি এবার কিছুটা নড়েচড়ে আনহারির দিকে তাকিয়ে বললাম

“আচ্ছা সত্যি করে বলেন তো আপনি কী আমার বড়ো আপা? এই যে কনুইয়ের দাগটা আপনার হাতে সেটা কীভাবে হলো? আমার বড়ো আপারও একই রকম একই আকৃতির দাগ। চেহারার সাদৃশ্য মানা যায়। তবে সবকিছুর সাদৃশ্য আমি কেন মানতে পারছি না৷ আমি কেন আপনাকে বারবার আমার আপা ভাবছি। [এটেনশন যে পেইজ থেকে গল্প পড়ছেন আপনারা পেইজটা লক্ষ্য করুন। যদি পেইজের নাম শারমিন আঁচল নিপা না হয় তাহলে দয়াকরে ঐ পেইজ থেকে গল্প না পড়ে রিয়েল লেখিকার পেইজ সার্চ দিয়ে পড়ুন। এরা কপি করছে]

আনহারি আমার কথা শুনে হালকা হেসে বলল

” মাঝে মাঝে দুটো মানুষের মাঝে একই স্বত্ত্বা বসবাস করে। হয়তো এজন্য তোমার বড়ো আপার সাথে আমার এত মিল। অন্যথায় তো এত মিল হত না তাই না। সময় হয়তো সব সামনে আনবে। তুমি বিষয়গুলো নিয়ে অনেক চিন্তা করছো তাই এমনটা হচ্ছে। তুমি যদি চিন্তা কমিয়ে বিচক্ষণ ভাবে সব ভাবতে তাহলে অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে যেত। অস্থিরতা মানুষের স্বাভাবিক বোধ শক্তি কেড়ে নেয়। তোমার বেলাতেও তাই হচ্ছে। এত অস্থির না হয়ে পায়েস টা শেষ করো। আমি একটু ঘুমাব। সকাল থেকে আমার ঘুম হচ্ছে না। চোখগুলো আর খুলতে পারছি না ঘুমের জন্য। তুমি চায়লেও খাওয়া শেষ হলে আমার পাশে ঘুমাতে পারো। আর কালকে সকালে রওনা দিব তোমার গ্রামের উদ্দেশ্যে। এখন আর এসব নিয়ে কথা না বলি। যতই কথা বলছি ততই সব গুলিয়ে যাচ্ছে। ”

আনহারির কথা শুনে আমি চুপ হয়ে গেলাম। আর কথা বাড়ালাম না। সময়ের অপেক্ষা করতে লাগলাম। আনহারি খাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়ল। আর আমিও খাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়লাম।

দুজনের ঘুম ভাঙলো বিকেল বেলা। আনহারি চা নিয়ে বসেছে৷ আমি উঠতেই বলে উঠল

“পাশের টেবিলে খাবার রাখা আছে খেয়ে নিও। আর আমি আমার কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিয়েছি। তোমার তো সব গুছানো। রাতটা কোনোরকম পার করে সকালে আমরা তোমাদের গ্রামে যাব। সব প্ল্যান তোমাকে রাতে বুঝিয়ে দিব। কী করতে হবে কী করা উচিত। এবং আমাদের লক্ষ্য কী।”

আমি একটা লম্বা হাই তুললাম। তারপর মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করলাম। একটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তারপর টেবিলে রাখা খাবারগুলো খেয়ে নিলাম। এ বাসায় খাবার এবং আরামের অভাব নেই। কিন্তু যেটার অভাব আছে সেটা হচ্ছে বিশ্বাস আর ভালোবাসার। আমজাদ সাহেবের ঘটনাটা আমার ভীষণ বলতে মন চাচ্ছে। কিন্তু ঘটনা যদি উল্টো মোড় নেয় তাই কিছুই বলছি না। সব মিলে চুপ হয়ে বসে আছি।

দিন পেরিয়ে রাত নামল। আমার একটায় চাওয়া এ অমানিশা কেটে সত্যটা সামনে আসুক। বড়ো আপার অত্যচারকারীরা শাস্তি পাক। জানি না সেখানের কী অবস্থা? তারা সেখানে আছে কি’না তাও জানি না। অস্থির অস্থির লাগছে শুধু। এ অস্থিরতা যেন কাটছেই না। আনহারি বিভোড় ঘুমে মগ্ন। আমার ঘুম আসছে না৷ এ ঘরের শীতল এসিও আমার সহ্য হচ্ছে না৷ গরমে হা হুতাশ করে ঘুমিয়ে অভ্যাস৷ হুট করে এত শীতলতা যেন আমাকে গ্রাস করছে৷ আশেপাশে কোনো কাঁথা নেই। তাই বাধ্য হয়েই রুমের বাইরে গিয়ে বসার সিদ্ধান্ত নিলাম।

পা টিপে টিপে আমি রুম থেকে বের হলাম। ড্রইং রুমের একটা চিপায় বসে রইলাম। হঠাৎ করে আধো আধো আলোতে লক্ষ্য করলাম আমজাদ সাহেব ঘর থেকে বের হচ্ছেন৷ কেমন যেন সন্দেহ লাগল। তিনি এত রাতে নিশ্চয় ব্যবসার কাজে যাচ্ছেন না৷ আর গেলেও নিশ্চয় পরিপাটি হয়ে যেতেন। এভাবে ঘরের জামা কাপড় পরে যেতেন না। সব মিলিয়ে আমার সন্দেহ বেড়ে গেল। উনি বের হওয়ার পর পরই আমি পা টিপে বের হলাম। উনি গ্যারেজের দিকে যাচ্ছেন। আমি সেখানের একটা পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটা সাদা গাড়ির কাছে গেলেন৷ গাড়িতে কী যেন করছেন। তারপর কিছুক্ষণ থেকে সেখান থেকে চলে আসলেন।

আমিও তার পিছু নিয়ে আবার গৃহে প্রবেশ করলাম৷ ড্রইং রুমের এক ফাঁকে লুকিয়ে গেলাম। তিনি সোফায় বসে সিগারেট ধরালেন। তারপর মালিহাকে কল দিলেন। তার সাথে আস্তে গলায় কথা বললেও বেশ জোরে শুনা যাচ্ছিল। কারণ পুরো জায়গাটা নিস্তব। সে আস্তে গলায় বলল

“আনহারি কীভাবে বেঁচে গেল সেটা আমি বুঝতেছি না। তবে তাকে আবার উপরে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি। গাড়ির ব্রেকটা কেটে দিয়েছি। আমি জানি সে সাদা গাড়ি নিয়েই বের হবে। কারণ এটা তার পছন্দের গাড়ি। আর বিকেল বেলা লক্ষ্য করেছিলাম সে কাপড় গুছাচ্ছে। জিজ্ঞেস করেছিলাম কোথায় যাবে, বলল একটা গ্রামে ঘুরতে যাবে। আর এ সুযোগটায় কাজে লাগালাম। ভেবেছিলাম আমি সকল সম্পত্তির মালিক হব তোমাকে বিয়ে করে সুখী শান্তিতে ঘর করব ডার্লিং। এখন আর সেটা সহজে হচ্ছে না। মৃত মানুষ কী করে বেঁচে উঠে।”

অপর পাশ থেকে বলে উঠছে

“আমি নিজে আনহারিকে গাড়ি চাপা দিয়েছিলাম। তাকে নিজের হাতে খু/ন করেছিলাম৷ ফিংগার প্রিন্ট যেহেতু ম্যাচ হয়েছে এটা আনহারিই। কিন্তু এটা কী করে সম্ভব। এ মেয়ে মরে গিয়ে বেঁচে ফিরল বিষয়টা সত্যিই অদ্ভুত। সমস্যা নেই ও যতবার বাঁচবে আমি ঠিক একইভাবে ততবার তাকে খুন করব৷ আমার জীবনের একটায় লক্ষ্য এ আনহারি ভবনের রাণী হওয়া। তোমার সাথে সংসার করা৷ আনহারির একটা ব্যবস্থা করেই তোমাকে বিয়ে করব। মনে আছে তো কাবিন হিসেবে ভবনটা আমাকে লিখে দিবে তো।”

“জান সব কিছুই তো তোমার হবে। তবে আনহারি বেঁচে থাকতে নয়। আনাহারি মারা গেলে আনাহরির মাকে আস্তে আস্তে পাগল বানিয়ে সব লিখে নিব। কিন্তু দুই বছরে যখনই সব রেডি করলাম তখন এ মেয়ে উড়ে এসে জুড়ে বসল।”

অপর পাশ থেকে রাগী কণ্ঠ ধেয়ে আসলো

“দু বছরে পারোনি। দু’শ বছরেও পারবে বলে মনে হয় না। আমি তোমাকে দু মাস সময় দিলাম এর মধ্যে যা করার করো।”

“ডার্লিং রাগ করো না। আমি দেখছি।”

ফোনটা কেটে গেল। আমজাদ সাহেব ফোনটা কান থেকে নামিয়ে টি টেবিলে রাখল। তারপর সোফায় হেলান দিয়ে বসে রইল চুপ হয়ে। আমি কেবল ভাবছি নারীর ছলনা কত প্রখর হলে একটা পুরুষ বুঝছে না। এ নারী চায় আমজাদ সাহেবের সম্পদ। অথচ আমজাদ সাহেব এত বুদ্ধিমান হয়েও সেটা ধরতে পারছে না। এ নারীর মোহে পড়ে নিজের সন্তানকেও খু/ন করতে পিছ পা হচ্ছে না। আগের বার এমন কাহিনি করার জন্যও তার মনে কোনো অনুসূচণা নেই। নেই কোনো ভ্রূক্ষেপ। নারীর ছলনা সত্যিই অনেক ভয়ংকর।

কিন্তু বিপাকে পড়লাম আমি উনি না উঠা পর্যন্ত এখান থেকে নড়তে পারছি না। উঠতেও পারছি না। উঠলেই ধরা পড়ে যাব। কী করব সেটাই চিন্তা করছি। তবে চিন্তা করার আগেই ধরা পড়ে গেলাম। আমাজাদ সাহেব আমার হাতটা চেপে ধরে বসা থেকে উঠালেন। তারপর রুষ্ঠ গলায় জিজ্ঞেস করলেন

“এখানে কী করছিস? আমাকে ফলো করছিস? তোর এত বড়ো স্পর্ধা। আমজাদ সাহেবের সাথে লাগতে আসিস।”

আমি আমতা আমতা করে উত্তর দিলাম

“আমার তে এসির বাতাস সহ্য হচ্ছিল না। তাই এখানে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সত্যিই আমি কিছু জানি না। আপনাকে ফলোও করিনি। আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”

আমার কথা শুনে তিনি হাতটা ছেড়ে দিলেন। আর বাড়াবাড়ি করলেন না। স্বাভাবিক গলায় বললেন

“হুম।”

এতটুকু বলেই তিনি ভেতরে চলে গেলেন।

আমি আর এখানে ঘুমানোর সাহস পেলাম না। আবারও আনহারির রুমে চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতেই এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে গেলাম।

সকাল বেলা ঘুম ভাঙলো চিৎকার চেঁচামেচিতে। চিৎকার উৎস বরাবর বাইরে বের হয়ে লক্ষ্য করলাম আমজাদ সাহেব সিলিং ফ্যানে ঝুলছে।

#বড়ো আপা
#পর্ব- ১৬
#শারমিন আঁচল নিপা

নিজের চোখকেও যেন আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। লাবনী জোহা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। আনহারি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। অতি শোকে সে হয়তো পাথর হয়ে গেছে। বাসায় পুলিশ ডাকা হলো। মদিনা কোনো কথায় বলছে না। কী হচ্ছে, না হচ্ছে এটা নিয়ে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। কে মরল, কে বাঁচল তাতে তার কী আসে যায়। তার চাকুরি থাকলেই হয়তো সে খুশি। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে বড়োলোকদের ব্যপার স্যাপারে সে একদম নেই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ আসলো। আমজাদ সাহেবকে ফ্যান থেকে নামানো হলো। আমজাদ সাহেবের শরীরটা দেখে কেন জানি না মনে হচ্ছে এটা খুন, আত্মহত্যা নয়। আচ্ছা আনহারি কী কোনোভাবে আমজাদ সাহেবের সবকিছু জানতো। আর সেজন্যই কী তাকে খুন করে দিয়েছে। নাহ! এটা আমি কী ভাবছি। আনহারি জানলে তো খুন করার প্রয়োজন ছিল না। আইনের মাধ্যমেই সবটা করতে পারত। ভাবনা যেন আমার পিছু ছাড়ছে না।

আমজাদ সাহেবের লাশটা ময়না তদন্তের জন্য পাঠানো হলো। পুলিশ ভালো করে ঘরটা চেক দিল। ঘরে একটা চিঠি পেল। সেটাতে আমজাদ সাহেব নিজের হাতে লিখেছেন,,

“আমি মালিহাকে ভীষণ ভালোবাসি। মালিহার জন্য আমি নিজের মেয়ে আনহারিকে খুন করার এটেম্পড নিয়েছিলাম। আমার মেয়ের দুই বছর আগের এক্সিডেন্টের জন্য আমিই দায়ী। ভেবেছিলাম আমার মেয়ে মারা গেলে আমি সকল সম্পত্তি লাবনীর কাছ থেকে নিয়ে মালিহাকে দিব। আর দুজন সুখের সংসার গড়ব। কিন্তু দুই বছরে যখন আমি সবটা প্রস্তুত করি তখন আনহারি ফিরে আসে। মৃত মানুষ কীভাবে ফিরে আসে জানি না। তবে আনহারি ফিরে আসায় মালিহার সাথে আমার দ্বন্ধ বাজে। আর সে জন্য মালিহা আমাকে রেখে অন্য ছেলের সাথে রাত কাটায়। যেটা জানতে পেরে আমি আর নিজেকে সামলাতে পারিনি। একমাত্র ভালোবাসার মানুষের এ পরিবর্তন আমি মেনে নিতে পারিনি। আমার কাছে সবকিছু ছিল টাকা, পয়সা, বউ, মেয়ে, ভালোবসা। তবে একটা জিনিসেই ছিল না আমার ভালোবাসার মানুষ মালিহা। তাকে ছাড়া পুরো পৃথীবি আমার শূন্য লাগছে। বেঁচে থাকার কারণ পাচ্ছি না। তাই নিজেকে শেষ করে দিলাম। আমার স্ত্রীর কাছে আমি ক্ষমা চাচ্ছি তাকে ঠকানোর জন্য। দীর্ঘ পাঁচবছর যাবত আমি এক্সট্রা ম্যারিটাল সম্পর্কে আছি। আর সেজন্যও আমি অনুতপ্ত। আমার মেয়ের কাছে আমি ক্ষমা চাচ্ছি। কারণ আমি আমার মেয়ের ভালো বাবা হতে পারিনি। প্রেমের মোহে নিজের মেয়েকেই খুন করতে চেয়েছি। আমি আমার জীবন স্ব ইচ্ছায় ত্যাগ করছি। এতে আমার পরিবার দায়ী নয়। কেউ যদি দায়ী থাকে সেটা মালিহা। আমার মৃত্যুর জন্য পরোক্ষভাবে সে দায়ী।”

পুলিশ অফিসার আলবিদ সাহেব জোরে চিঠিটা পড়লেন। তারপর আনহারি আর লাবনী জোহার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন

“এটা কী আমজাদ চৌধুরির হাতের লেখা?”

লাবনী জোহা কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিলেন

“লিখা দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। তারপরও একবার এক্সপার্ট দিয়ে সবটা চেক আপ করুন। আমার স্বামীর এক্সট্রা ম্যারিটাল সম্পর্ক ছিল আমি মানতেই পারছি না। আমার স্বামী তার মেয়েকে খুন করতে চাচ্ছিল এটাও আমি মানতে পারছি না। এত বড়ো সত্য আমার থেকে লুকিয়ে ছিল আমার তো বিশ্বাসেই হচ্ছে না। সবকিছু এলোমেলো লাগছে আমার। ”

বলেই ঢেকুড় তুলে কান্না শুরু করলেন। পুলিশ অফিসার এবার আনহারির দিকে তাকিয়ে বললেন

“আপনার কিছু বলার আছে? আপনার বাবার কী কোনো শত্রু আছে?”

আনহারি পাথরের মতো উত্তর দিল

“যে পিতা নিজের সন্তানকে খুন করতে পারে সে পিতার ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাই না। দুনিয়াতে মায়ের পর আমি বাবাকেই ভালোবাসতাম। আর সে বাবা নাকি আমাকেই খুন করতে চেয়েছে। আমার তো এখন ঘৃনায় বমি আসছে। আপনারা দয়াকরে মালিহাকে এরেস্ট করুন। আমি তার নামে অভিযোগ দায়ের করে মামলা করব। মালিহার শেষ পরিনতি আমি দেখতে চাই। এ মেয়ের জন্যই আজকে আমাদের এ হাল।”

পুলিশ অফিসার আশ্বাস দিয়ে বললেন

“আপনারা সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষজন। আমরা যতটা পারি আপনাদের জন্য করব। মালিহাকে আজকের মধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আপনি কী তাকে চিনেন?”

“আমি তাকে চিনি না। এবং নামটাও জানতাম না। আজকে নাম জানলাম শুধু। হয়তো বাবার সাথে সংযোগ আছে কোনো। অপরাধীদের ধরার দায়িত্ব তো আপনাদের, আমাদের না। এ সময়ে নতুন কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত নই আমরা। আমাদের উপর কী যাচ্ছে সেটা তো বুঝতেই পারছেন।”

আলবিদ সাহেব আর কথা বাড়ালেন না। আলামতের সকল ছবি তুললেন। আমজাদ সাহেবকে ময়না তদন্ত করতে অলরেডি পাঠানো হয়েছে। এবং বলে গেলেন সাতদিন যেন এ ঘরে কেউ প্রবেশ না করে।

আলবিদ সাহেবের কথা শুনে আনহারি কিছুটা রেগে বলল

“সাতদিন একটু বেশি সময় হয়ে যায়। দুদিন সময় নিন। বাবার প্রতি বিন্দু মাত্র আবেগ আমার কাজ করছে না। ঘর থেকে যত তাড়াতাড়ি সব স্মৃতি মুছব তত তাড়াতাড়ি শান্তি পাব।”
আলবিদ সাহেব বুঝতে পারছেন আনহারি বেশ রেগে গেছে। তাই তেমন কথা না বাড়িয়ে উত্তর দিল

“আচ্ছা আমরা চেষ্টা করব। হয়তো আবার যোগাযোগ করা হবে। আর নিজের পিতার প্রতি এত রাগ ভালো নয়। যতই হোক পিতা।”

“তাকে আর আমি পিতা বলে স্বীকার করিনা। যে পিতা নিজের সন্তানকে অন্য মেয়ের জন্য মারার চেষ্টা করতে পারে সে কোনোভাবেই মানুষের কাঁতারে পড়ে না।”

পুলিশ অফিসার আলবিদ চলে গেলেন। লাবনী জোহা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। লাবনী জোহা কাঁদতে কাঁদতে বললেন

“আমজাদকে আমি বিয়ে করেছিলাম শুধু তার ভালোবাসা দেখে। টাকা পয়সা কিছুই ছিল না। তবে অনেক মেধাবী ছিল। কিন্তু সে এমনভাবে ধোঁকা দিবে আমি মানতে পারছি না। ওর মৃত্যুটা আমাকে দাগ কাটছে না তেমন, ওর ধোঁকাটা যেভাবে দাগ কাটছে । প্রতারণার আঘাত এত প্রখর কেন যেটা মৃত্যুটাকেও ভুলিয়ে দেয়। সে সাধারণভাবে মরে গেলে যতটা না কষ্ট পেতাম তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছি আমাকে ঠকিয়েছে এটা ভেবে। এ টাকাটাকেই সে বড়ো করে দেখল আমার ভালোবাসা কে না। আমি তো মানতে পারছি না। আমার যন্ত্রণা আমি তো কাউকে দেখাতে পারছি না।”

আনহারি লাবনী জোহাকে জড়িয়ে ধরে বলল

“যে তোমার ছিল না তাকে নিয়ে ভাবার তো কোনো দরকার নেই। বাবা ৫ বছর আগেই তোমার পর হয়ে গেছে। এখন কেবল এটা অতীত ছাড়া কিছু না। অতীত নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না মা। নিজেকে সামলাও। ঘরে চলো। কিছু খেয়ে নাও। নাহয় তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে। এ দুনিয়ায় তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই। তোমাকে হারালে আমি কী নিয়ে বাঁচব বলো। আমার জন্য হলেও তোমাকে বাঁচতে হবে মা।”

লাবনী জোহার কান্নার আওয়াজ টা স্মিমিত হয়ে গেল আনহারির কথা শুনে। আনহারি তাকে ভেতরে নিয়ে গেল। হালকা খাবার খাইয়ে দিল তাকে। তারপর ঔষধ খাইয়ে শুইয়ে দিল। আনহারি এবার আমার কাছে এসে বলল

“ঐ গ্রামে আর আজকে যেতে পারলাম না। হয়তো আগামী এক সপ্তাহেও পারব না। সময় দাও আমাকে। কথা যেহেতু দিয়েছি তোমাকে। তোমার বড়ো আপার অপরাধীদের আমি শাস্তি দিব।”

আমি কেবল আনহারির দিকে তাকিয়ে আছি। বাবাকে হারিয়েও কত শক্ত সে। কত অবলীলায় কথা বলছে সে। একটুও স্বজন হারানোর যন্ত্রণা তাকে ঘিরে ধরেনি। একদম স্বাভাবিক লাগছে। পুনরায় মনে প্রশ্ন জাগল তাহলে কী আনহারিই তার বাবাকে খু/ন করছে। সব যেন গুলিয়ে যাচ্ছে আমার। আনহারি তার রুমে গেল। বাড়িটাকে কেমন যেন ভুতুরে বাড়ি লাগছে। ভয়ে যেন গা ছমছম করছে। কিসের জন্য এসেছিলাম আর কী হচ্ছে এসব। সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

আমি সোফায় বসেই চিন্তা করছিলাম এগুলো। এর মধ্যে মদিনা এসে বলল

“আপা এটুকু খাবার খেয়ে নিন। মরা বাড়ি কখন খাবার মিলে কে জানে।”

মদিনার কথা শুনে আমি একটু বিরক্ত হয়ে গেলাম। এমন সময় সে খাবার নিয়ে পড়ে আছে। ভীষণ রাগ হচ্ছে তার উপর। কিন্তু কিছুই বললাম না। শুধু হালকা গলায় উত্তর দিলাম

“এখন খাওয়ার মুড নেই। আপনার মন চায়লে আপনি খেয়ে নিন। আমার আপাতত ইচ্ছা নেই কিছু খাওয়ার।”

মদিনা আমার কথা শুনে বিরক্তবোধ করল তার চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। তিনি খাবার নিয়ে চলে গেলেন।

এদিকে দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হওয়ার উপক্রম৷ পুরো বাড়ি শুনশান নীরব হয়ে আছে। এর মধ্যেই পুলিশ অফিসার আলবিদ সাহেব আবার আসলেন। আলবিদের উপস্থিতিতে আনহারি তার রুম থেকে বের হলো। লাবনী জোহা এখনও ঘুমুচ্ছে। আমি সোফায় বসে আছি। আনহারি আসতেই আলবিদ বলে উঠলেন

“একটা নিউজ আছে। এটা আপনাদের জন্য গুড নিউজও হতে পারে আবার বেড নিউজও।”

আনহারি রাগী কণ্ঠে বলল

“এত ভূমিকার কী দরকার। কী হয়েছে বলুন।”

“মালিহা রোড এক্সিডেন্টে আজকে মারা গেছে। গাড়িটা ব্রেক ফেল ছিল। আপনাদের গাড়িতেই সে মারা গেছে। গাড়িটা কী করে সেখানে গেল সেটাই এখন ভাববার বিষয়।”

অফিসার আলবিদ সাহেবের কথা শুনে আমি চমকে গেলাম। রাতে আমজাদ সাহেব নিজের হাতে সে গাড়ির ব্রেক নষ্ট করেছিল আনহারির মৃত্যুর জন্য। তাহলে সে গাড়ি কীভাবে মালিহার কাছে গেল?

কপি করা নিষেধ