#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_৪২
#Esrat_Ety
আলো একবারের জন্যও সামিনের চোখের দিকে তাকালো না। যদি তাকাতো তাহলে দেখতে পেতো কতটা মুগ্ধতা সামিনের চোখে তার জন্য। মাথায় গোবর ঠাসা আলো থ’মকে গেলেও যেতে পারতো।
নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বিছানায় চুপচাপ শুয়ে পরে সে।
সামিন আনমনে হাসে। এভাবে হুট করে গুটিয়ে নিলো কেনো মেয়েটা? কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সামিন বুঝবে কিভাবে রাগ করেছে নাকি লজ্জা পেয়েছে নাকি ভ’য় পেয়েছে!
সম্ভবত ভ’য় পেয়েছে। সামিন মনে মনে ভাবে আর ভয় দেখিয়ে কাজ নেই। কোনো বাক্য ব্যয় না করে সুইচ টিপে বাতি নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পরে।
কিছুক্ষণ যেতেই দরজায় ধা’ক্কা পরে। ইহান বাইরে থেকে তার বড় বাবাকে ডাকছে। সামিন উঠে বসে আবারও বাতি জ্বেলে দেয়। আলোও উঠে বসে।
দরজা খুলে দেখে ইহান দাঁড়িয়ে চোখ মুছছে। সামিন অবাক হয়ে ইহানকে কোলে তুলে নেয়। রিতু আর ইলহাম দাঁড়িয়ে আছে। সামিন রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”হয়েছে কি? কাঁ’দছে কেনো? হাত তুলেছো গায়ে?”
রিতু মাথা না’ড়ি’য়ে বলে,”বকেছি।”
_কেন?
_হোমওয়ার্ক করেনি।
_রাত এগারোটা প্রায়। এখন হোমওয়ার্ক করার সময়?
_সন্ধ্যা থেকে ওর বাবার ফোনে কার্টুন দেখেছে। বলেছে ঘুমানোর আগে করে দেবে। এখন ত্যা’ড়া’মি কেন করছে?
_ত্যা’ড়া’মি তো তুমি করছো রিতু।
ধ*মকের সুরে বলে সামিন। ইলহাম ইহানের দিকে তাকিয়ে বলে,”ঠিকাছে বাবা,তুমি পাপার কাছে এসো। হোমওয়ার্ক করতে হবে না আর।”
_না ,আমি যাবো না। মাম্মার মতো তুমিও ব*কেছো।
কাঁদতে কাঁদতে বলে ইহান।
_তুই যাবি না? চল বলছি!
ইহানকে টানতে থাকে রিতু। সামিন ধ*মকে ওঠে,”কি হচ্ছে কি এসব। আমি বাচ্চাদের সাথে তুই তোকারি পছন্দ করি না রিতু। যাও এখান থেকে। যাও বলছি। ও আজ আমার কাছে থাকবে।”
রিতু আমতা আমতা করে বলে,”আপনাদের বড্ড বিরক্ত করবে ভাইয়া। ভাবীকে ঘুমাতে দেবে না।”
“অসুবিধা নেই রিতু। তুমি যাও।”
আলো রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে। রিতু আর ইলহাম দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। সামিন একপলক আলোর দিকে তাকিয়ে কোনো বাক্য ব্যয় না করে ইহানকে নিয়ে ঘরে ঢুকে রিতু আর ইলহামের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয়।
ইহান মাথা ঘুরিয়ে আলোর দিকে তাকায়। আলো ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে তাকে স্বাগত জানায়। একপলক আলোর দিকে তাকিয়ে মাথা ঘুরিয়ে সামিন ইহানের দিকে তাকিয়ে আলোকে শুনিয়ে বলে,”বাবা,আজ রাতে তুই আমাদের কোলবালিশ ওরফে ব্যারিকেড।”
ইহান বড় বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কিছু বুঝতে পারছে না তার বড় বাবার কথা। আলো চুপচাপ বিছানায় বসে থাকে।
বিছানা থেকে কোলবালিশ সরিয়ে ইহানকে শুইয়ে দেয় সামিন। তারপর আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”ও খুব লক্ষি বাচ্চা। একটুও হাত পা ছো*ড়ে না। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও। ”
আলো গিয়ে একপাশে চুপচাপ গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে। সামিন বাতি নিভিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পরে ইহান উঠে বসে। সামিন উঠে বসে আবারও বাতি জ্বেলে দেয়।
আলো ওপাশ ফিরে দু’জনের কান্ডকারখানা পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। মনে হচ্ছে আজ রাতে আর ঘুমোতে দেবে না এই দুজন।
“বড় বাবা গল্প বলো।”
সামিন অবাক হয়ে ইহানের দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর বলে,”এতো রাতে? মানুষকে বসতে দিলে শুতে চায় আর তোমাকে শুতে দিয়েছি,তুমি গল্প শুনতে চাচ্ছো বাবা!”
ইহান জোর করতে থাকে। সামিন বলে,”গল্প আসছে না বাবা।”
“না তুমি বলবে।”
সামিন কোনো গল্প খুজে পাচ্ছে না বলার মতো। মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলবে? নাকি শেখ মুজিবুরের জীবনী বলবে? নাকি নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর গল্প?
এসব ছাড়া তো সে গল্প জানে না।
ইহান আগ্রহী হয়ে তার বড় বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন বলে,”মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনবে?”
_না রাজা রানীর গল্প।
_বাবা এমন করলে কিন্তু তোমাকে তোমার পাপা মাম্মার কাছে দিয়ে আসবো।
_তুমি বলবে বলবে বলবে।
সামিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ছেলেটা একেবারে তাদের স্বভাব পেয়েছে, একরোখা।
ইহানের দিকে তাকিয়ে সামিন বলে,
“এক ছিলো রাজা, আরেক ছিলো রানী, তারা দুজন ম*রে গিয়েছে, খতম কাহিনী। এখন ঘুমাও বাবা।”
আলো শাড়ির আঁচল মুখে চেপে নিশ্চুপ হয়ে হাসছে সামিনের এমন অদ্ভুত গল্প শুনে।
ইহান জেদ দেখিয়ে বলে,”পঁ*চা গল্প, এখন মিমিক্রি করো।”
_এখন?
_হ্যা মিমিক্রি করো।
_ইহান বাড়াবাড়ি হচ্ছে বাবা।
_মিমিক্রি করো করো করো।
সামিন দ্বিতীয় বারের মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,”একটু আস্তে কথা বলো বাবা, বড় মা ঘুমাচ্ছে। আচ্ছা বলো। কার মিমিক্রি করবো?”
_ফুপ্পির।
_ইশিতার?
_হু।
মাথা নেড়ে ইহান বলে।
সামিন গলা খাঁকারি দিয়ে গলার স্বর মেয়েদের মতো করার চেষ্টা করে বলে,”ভাইয়া! এতো দেরি কেন করলে! ভাইয়া এটা খাচ্ছো না কেন! ভাইয়া ভিজেছো কেনো, ভাইয়া এই শার্ট টা পরেছো কেনো!”
ইহান কুটি কুটি হয়ে যায় হেসে। বড় বাবা অবিকল ফুপির মতো বলছে।
আলো অবাক হয়ে সামিনের কথাবার্তা শুনতে থাকে। এই লোক নাকি একজন নামী প*লিটিশিয়ান! এ তো আস্ত একটা জোকার! বাচ্চাদের থেকেও বাচ্চা!
সামিন ইহানকে বলে,”হয়েছে? খুশি? এখন আমি ঘুমাই?”
_না। এখন বড় মার মিমিক্রি করে দেখাও।
_ইহান..
_মিমিক্রি করো বড় বাবা।
সামিন তৃতীয় বারের মতো দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আলো ওপাশে ফিরে ঘুমানোর ভান ধরে আছে। সে ভীষণ কৌতুহলী। ইয়াসার মির্জা তাকে নকল করবে!
সামিন আলোর দিকে এক পলক তাকিয়ে ইহানকে বলে তোমার বড় মাকে নকল করা একটু কঠিন বাবা, আমি চেষ্টা করছি।
একটু থেমে কন্ঠস্বরে আবারও মেয়েলী সুর এনে সামিন বলতে থাকে,”ঘৃণা করি ইয়াসার মির্জা, আপনি খারাপ ইয়াসার মির্জা, ঘৃণা করি, ঘৃণা করি, ঘৃণা করি….”
আলো ধরফরিয়ে উঠে বসে। সামিন চ’ম’কে ওঠে। দুজন দুজনের দিকে হত*ভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ যেতে আলো ক*ঠিন গলায় বলে,”আপনি একটা বাচ্চার সাথে এসব কি বলছেন!”
_মিমিক্রি করছি তোমার।
আমতা আমতা করে বলে সামিন।
_এসব কেনো বলছেন? ও এসবের কি বোঝে?
_কমন ডায়লোগ বলছি তোমার। আপাতত এটা মাথায় এসেছে।
আলো সামিনের দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে । সামিন নরম গলায় বলে,”কি জালা! আচ্ছা সরি।”
আলো বিড়বিড় করে বলে,”নিজের কোনো ভালো স্বভাব তো নেই। আর বাচ্চাটাকেও ভুলভাল কথা বলছেন।”
সামিন লজ্জিত ভঙ্গিতে বসে আছে। ইহান আলোকে বলে,”ব*কছো কেনো বড় বাবাকে তুমি? জানো বড় মা, বড় বাবা খুব ভালো মিমিক্রি করতে পারে।”
_আমিও খুব ভালো মিমিক্রি করতে পারি। দেখবে তুমি?
ইহান উৎসাহী। আনন্দের সাথে মাথা নাড়ায়। আলো বলে,”তোমার বড় বাবার মিমিক্রি করে দেখাই?”
ইহান মাথা নাড়াতে থাকে। তার চোখ দেখে মনে হচ্ছে সে খুবই উত্তেজিত। সামিন একদৃষ্টে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আলো গলা খাঁকারি দিয়ে একটু নড়েচড়ে বসে, তারপর ইহানের দিকে তাকিয়ে কন্ঠে গম্ভীর পুরুষালি ভাব এনে বলতে থাকে,”আমি সামিন ইয়াসার মির্জা, যেটা নিষেধ করছি সেটা করবে না, তাহলে আমি একদম বরদাস্ত করবো না আলো। ওটা করবে না,তাহলে আমি একদম বরদাস্ত করবো না আলো। বাড়াবাড়ি করবে না তাহলে আমি একদম বরদাস্ত করবো না আলো!”
অবিকল সামিনকে নকল করে কথা গুলো বলে চুপ হয়ে যায়। ইহান চোখ বড় বড় করে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে।
সামিন বলে ওঠে,”কিন্তু আমি সব কিছুই বরদাস্ত করে গিয়েছি বরাবর। তোমার সব জে*দ, ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, তোমার গালা*গাল, তোমার বাড়াবাড়ি। এতো হম্বতম্বি করেও তোমাকে দেখলেই কেমন মিইয়ে যেতাম, ইচ্ছে করতো না কঠোর হতে। একেবারেই না।”
আলো চুপ করে থাকে। সামিন বলতে থাকে,”একটা সামিন ইয়াসারের জন্য একটা অদ্রিতা আলোর দরকার ছিলো সম্ভবত। থ্যাংকস এ্যালো, আমার জীবনে লাইট ফিরিয়ে আনার জন্য।”
শেষের বাক্যটা বলে সামিন মৃদু হাসে। আলো কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে ইহানকে বলে,”চলো শুয়ে পরো। কাল সকালে আমি তোমাকে একটা রাজার গল্প বলবো। একটা দু*ষ্টু রাজার।”
ইহানকে আগলে নিয়ে আলো শুয়ে পরে। সামিন বলে ওঠে,”সেই রাজার নাম কি সামিন ইয়াসার মির্জা?”
আলো কোনো কথা বলে না। ইহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। সামিন বলতে থাকে,”তাহলে প্লিজ ছয়টা রানী রেখো গল্পে। ছোটো রানীর নাম থাকবে আলো।”
_বাকি রানীদের নামও বলে দিন।
ঠান্ডা গলায় বলে আলো।
_বড় রানীর নাম আলো, মেজো রানীর নাম আলো, সেজো রানীর নাম আলো, চতুর্থ রানীর নাম আলো, পঞ্চম রানীর নামও আলো।
আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”ইহান ঘুমিয়েছে। বাতিটা প্লিজ নিভিয়ে দিন।”
সামিন বাতি নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পরে। আলো বলতে থাকে,”সামান্য একটা গল্প জানেন না? কখনো কোনো গল্প শোনেননি?”
_শুনেছি, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর গল্প, বঙ্গবন্ধুর গল্প, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের গল্প। আমি এনাদের গল্পই শুনেছি।
আলো নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,”তাই? তাহলে নিশ্চয়ই রাজনৈতিক জীবনে এদের আদর্শ মেনে চলেন।”
সামিন একটু ভাব নেওয়ার চেষ্টা করলো, খুশি খুশি গলায় বলতে থাকে,”অবশ্যই অবশ্যই।”
_তা এদের মধ্যে কোন নেতা মেয়ে তুলে এনে বিয়ে করেছে? বঙ্গবন্ধু? সুভাষ চন্দ্র বসু? নাকি ফজলুল হক?
ভাগ্যিস অন্ধকার ছিলো। নয়তো আলো সামিনের বেলুনের মত চুপসে যাওয়া মুখটা দেখতে পেয়ে খুব হেসে নিতো।
সামিন কোনো কথা বাড়ায় না, মনে মনে বলে,”হ্যা। ঘাট হয়েছে আমার। তোমাকে জব্দ করতে গিয়ে এখন নিজে ফেঁ*সে বসে আছি। এই একটা অপবাদ আমাকে তুমি মৃ*ত্যুর আগেরদিন পর্যন্ত দিয়ে যাবে সম্ভবত। মৃ*ত্যু শয্যায় যখন আমাদের নাতি নাতনি আমার মুখে পানি দিতে আসবে তখনও তুমি এই কথা গুলো জপ করতে থাকবে। যদি আগে জানতাম তুমি কি চি*জ তাহলে সেদিন তুলে আনা তো দূরে থাক একশো হাত দূরে থাকতাম তোমার থেকে। এখন কিছুই করার নেই, ভালোবেসে ফেঁ*সে গিয়েছি আছিয়া।”
***
রাত দেড়টার কাছাকাছি। হঠাৎ গায়ে কারো হাত পরতেই আলো ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠে। অন্ধকারে টের পেলো ইহান তাকে আকরে ধরে রেখেছে। সামিনেরও হুট করে ঘুম ভেঙে যায়। সুইচ টিপে বাতি জ্বেলে আলোর দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অস্ফুট স্বরে বলে,”মা ভেবে তোমাকে জড়িয়ে ধরেছে হয়তো। দাও আমার কাছে।”
_থাকুক।
ইহানের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আলো বলে। সামিন বলে,”তুমি শিওর? অসুবিধা নেই তো?”
_না,আপনি ঘুমান।
কথাটা বলে ইহানকে জরিয়ে ধরে আলো দু’চোখ বন্ধ করে ফেলে। সামিন বাতি নিভিয়ে আবারও শুয়ে পরে। দিন দিন এ বাড়ির সবার প্রতি এই ক*ঠিন মানবীর দরদ দেখতে পাচ্ছে সে। ইশিতার বিড়াল টাও এর কাছে খুব আদর পায়। শুধু তাকেই দরদ দিয়ে দেখে না। তার হাতের ক্ষতটার দিকে দূর থেকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,”ব্যাথা সেরেছে?”
কেন? একটু কাছে এসে হাতটা ছুঁয়ে দেখলে কি হয়? মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়?
বিরক্তিকর একটা নারী। উপন্যাসের সবথেকে বিরক্তিকর নায়িকা।মনে দয়া মায়া দেয়ইনি সৃষ্টিকর্তা।
ভোর রাতের দিকে ইহানের ঘুম ভেঙ্গে যেতেই উঠে বসে। চোখ ডলে একবার আলোকে আরেকবার সামিনকে দেখে সামিন কে ডাকতে থাকে। দু’জনেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সামিন কোনো সাড়া দেয়না। ইহান বিছানা থেকে নেমে পরে। গুটি গুটি পায়ে দরজার কাছে গিয়ে দেখে দরজার সিটকিনি তোলা। একটা চেয়ার টেনে সেটার উপর উঠে দরজাটা খুলে ফেলে ইহান। তারপর মাম্মা পাপার ঘরে চলে যায়।
ঘুমের মধ্যে আলো টেরও পেলো না সে সামিনের একেবারে কাছে চলে এসেছে। ইহান ভেবে সামিনকে আকরে ধরেছে এক হাত দিয়ে। হুট করে সামিনের ঘুম ভেঙে যায় গায়ের ওপর নরম স্পর্শ পেয়ে। চোখ মেলে তাকাতেই চোখ দুটো ছানা*বড়া হয়ে যায় তার। একবার তার গায়ের উপর আলোর হাত টার দিকে, আরেকবার আলোর মুখের দিকে তাকায়। মেয়েটার কপালের কাছের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। সামিন সংকোচের সাথে চুল গুলো সরিয়ে দেয়। এখন কি করবে সে? এই ভদ্রমহিলাকে ঘুম থেকে তুলে দেখিয়ে দেবে তার কীর্তি? খুব তো সারাদিন সামিনকে দোষা*রোপ করে। এখন সামিনের এই মহিলাকে লজ্জা দিয়ে শো*ধ তোলা উচিত।
সামিন ডাকতে গিয়েও ডাকে না। মনে মনে বলে,”না সামিন ইয়াসার। এই ভুল করিস না। এই মহিলা দেখলে উল্টো তোকেই বলবে যে তুই ওর হাত এনে নিজের গায়ে রেখেছিস। ওর কোনো দোষ নেই।”
কিছুক্ষণ চুপ চাপ থেকে সামিন আলোকে না ডেকে ধীরে ধীরে হাতটা সরিয়ে দেয়।
****
কলিং বেলের আওয়াজে আলো এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে নিজেই এগিয়ে যায়। দরজা খুলে দেখতে পায় সামিন ইয়াসারের দলের ছেলেরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আলোকে দেখতে পেয়ে সবাই আহ্লাদে আটখানা হয়ে একে একে বলতে থাকে,”আসসালামুয়ালাইকুম ভাবী।”
সাতজন পর পর সালাম দেয়। আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সালামের উত্তর দেয়। রাহাত মুখ হাসি হাসি করে বলে,”বাড়িতে ঢুকতে দেবেন না ভাবী?”
আলো দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। ভদ্রতার সাথে বলে,”আপনারা বসুন।”
_ভাই কি ঘুমাচ্ছে ভাবী?
আরাফ জানতে চায়। আলো কিছু বলার আগেই আরাফ বলে,”প্লিজ একটু ডেকে দিন।”
আলো মাথা নাড়িয়ে দোতলায় চলে যায়। ঘরের মধ্যে কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। বারান্দা থেকে সামিন ঘরে ঢুকতেই আলো বলে ওঠে, “নিচে আপনার ‘পাশে আছি ভাইরা’ এসেছে।”
সামিন অবাক হয়ে বলে,”পাশে আছি ভাই মানে?”
_আপনার দলের ছেলেরা। সারাক্ষণ আপনার পেছনে পেছনে পাশে আছি ভাই, সহমত ভাই, রাজপথ ছাড়ি নাই ভাই এসব বলে ঘুরে বেড়ায় যারা।
সামিন শীতল চোখে আলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,”সবসময় খোঁ*চা মেরে কথা বলো কেন বলোতো? এই যে শহরে কোনো প্রসূতি মায়ের র*ক্তের প্রয়োজন পরলে কারা ছুটে যায়? আমার ছেলেরা। দিন নেই রাত নেই সবার বিপদে আপদে পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত। আর আমার প্রতিনিধিরা সবথেকে বিবেচক এবং যোগ্য।”
আলো কিছু না বলে আলমারি থেকে সামিনের একটা পাঞ্জাবি বের করে বিছানার উপর রেখে বলে,”এটা পরুন।”
সামিন পাঞ্জাবি টা তুলে নিয়ে আলোর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলে,”ব্যপার কি বলো তো। হঠাৎ এতো কর্তব্য পরায়ণ হয়ে গেলে যে?”
আলো বলে,”এসব আপনার বোন গুছিয়ে রেখে গিয়েছে। আপনাকে এটা পরিয়ে নতুন জামাই সাজিয়ে ও বাড়িতে নিতে বলেছে। তার কড়া আদেশ। এতো বিরক্তিকর আপনার এই বোনটা!
ভাইয়ের প্রতি কি আহ্লাদ! সারাক্ষণ ভাইয়ের এটা কেন গুছিয়ে রাখোনি, এটা কেন ধুয়ে রাখোনি,
কোনদিন না জানি বলে বসে,” আমার বুড়ো ধা*মরা ভাইয়ের সর্দি কেনো মুছিয়ে দাও নি!”
সামিন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে আলোর দিকে। আলো সামিনের দৃষ্টি উপেক্ষা করে চলে যেতে যেতে বলে,”তাড়াতাড়ি নিচে যান, আপনার র*ক্ত সৈনিকেরা বসে আছে তাদের প্রানপ্রিয় অভিভাবকের জন্য!”
***
রাশিয়া আর ইউ*ক্রেন কবে চূড়ান্ত শান্তি চুক্তি সই করবে? তাদের শান্তিচুক্তির কথা জানা নেই। কিন্তু আলোর সামনে সে এক রাশিয়া আর ইউ*ক্রেনকে বসে খাবার খেতে দেখছে। তাও আবার রাজ*নৈতিক আলোচনা করতে করতে। আলো নিজের প্লেটের ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে একবার আতাউর আলম, একবার সামিন ইয়াসার মির্জার দিকে তাকাচ্ছে ।
খাবার টেবিলে তারা পাঁচ জন খেতে বসেছে। আজান,আয়াত, আতাউর আলম এবং আলো। রেহেনা সবার প্লেটে খাবার পরিবেশন করে দিচ্ছে।
রাজ*নৈতিক আলোচনা বেশ রসালো মনে হচ্ছে। সামনে এতো ভালো ভালো খাবার রেখে এরা বর্তমান সরকারের পক্ষে বিপক্ষে বিতর্ক করছে। আরে এটা খাবার টেবিল নাকি ট*কশো?
আতাউর আলম খুব সুন্দর ভাবে সামিন ইয়াসার মির্জাকে বর্তমান সরকারের খারাপ দিকগুলো বলছে। জবাবে সামিন ইয়াসার তার দলীয় সরকারের ভালো ভালো দিক গুলো তুলে ধরছে।
আলোর রীতিমতো মাথা ধরে গিয়েছে। হুট করে গলায় মাছের কাঁ*টা বিঁধতেই সে বি*ষম খেয়ে কাশতে শুরু করে। আতাউর আলম এবং সামিন উভয়েই আলোচনা থামিয়ে,একই সাথে,একই মুহূর্তে দুটো পানির গ্লাস আলোর দিকে এগিয়ে দেয়।
আলো কাশি থামিয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সবাই অবাক হয়ে আতাউর আলম এবং সামিন ইয়াসার মির্জাকে দেখছে। তারা নিজেরাও একে অপরের হাতের পানির গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আছে।
আলো তাদের কারো গ্লাসই নেয়না। নিজে একটা গ্লাসে পানি ঢেলে খেয়ে নেয়।
দুজনে গ্লাস নামিয়ে রেখে আবারও বিতর্কে মেতে ওঠে। রেহেনা সামিনের প্লেটে মাংস তুলে দিতে যায়। সামিন বাধা দিতে গেলে আ*চমকা সামিনের গায়ে পরে যায়। তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে সামিন। সাদা রঙের পাঞ্জাবিটা মাংসের ঝোল লেগে একেবারে শেষ।
আতাউর আলম বিরক্ত হয়ে রেহেনাকে বলে,”তুমি জামাইয়ের প্লেটে মাংস না দিয়ে গায়ে দিচ্ছো যে?”
রেহেনা কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। কি একটা লজ্জার ব্যাপার। আলো ফিক করে হেসে ফেলে। রেহেনা দূর থেকে চোখ রাঙানি দেয় আলোকে। আতাউর আলম আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”ওকে ঘরে নিয়ে যাও আম্মু। আমার একটা নতুন পাঞ্জাবি বের করে দাও।”
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। কতটা ছেলে মানুষ হলে অন্যের বিপদে এভাবে হাসতে পারে! এই মেয়েটা সত্যিই দুর্বোধ্য!
আলো হাসি থামিয়ে সামিনের রাগান্বিত দৃষ্টি দেখে কিছুটা ঘা*বড়ে যায়। তারপর হাত ধুয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বলে,”আসুন।”
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে সামিন। শশুরের পাঞ্জাবি গায়ে তাকে খুব একটা খারাপ লাগছে না। আলো তার পেছনে দাঁড়িয়ে তার কর্মকান্ড দেখছে। সামিন একপলক আলোকে দেখে নিয়ে পাঞ্জাবির বোতাম লাগাতে লাগাতে বলে, ” একেবারে শশুরের জামাই লাগছে না বলো?”
আলো ঠান্ডা গলায় বলে,”আমার আব্বুকে বেশি সুন্দর লাগে এই পাঞ্জাবি টাতে।”
সামিন ম্লান হেসে বলে,”জানি, প্রত্যেকটা মেয়ের কাছে নিজের বাবাই সবথেকে হ্যান্ডসাম পুরুষ, তুমি আর তোমার আব্বু একে অপরের জন্য জান বের করে দাও।”
_এই অনুভূতির আপনি কি বুঝবেন এখন? নিজে যখন মেয়ের বাবা হবেন তখন বুঝবেন।
সামিন আলোর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে,”আমি মেয়ের বাবা হবো? তাহলে তো তুমিও মেয়ের মা হবে।”
আলো থতমত খেয়ে যায়। তার মুখ দেখে কিছুক্ষণ তাকে বুঝতে চেষ্টা করলো সামিন। লজ্জা নাকি জড়তা? কোনটা ছেয়ে আছে তার সামনের নারীটির মুখমণ্ডলে?
কিছু সময় তাকিয়ে থেকে আলোকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে মৃদু স্বরে বলে,”তোমার মুখে ফুলচন্দন পরুক আছিয়া।”
***
তলপেটের নিচটা কেমন অবশ হয়ে যাচ্ছে বারবার। আবার হঠাৎ করে অসহ্য যন্ত্রণায় বি*ষিয়ে উঠছে কখনো কখনো। পেটে হাত দিয়ে বসে আছে হেনা। জামিল ফিরছে, নিজে বাইক চালিয়ে এতো দূরের রাস্তা পাড়ি দিচ্ছে। যাত্রাপথে চিন্তায় ফেলতে চাচ্ছে না লোকটাকে হেনা,তাই তাকে কিছু বলেনি।
ইশিতা ফোন থেকে চোখ সরিয়ে হেনার দিকে তাকিয়ে বলে,”কোনো সমস্যা ভাবি? কেমন অস্বাভাবিক লাগছে তোমাকে।”
হেনা মাথা নাড়িয়ে বলে,”কিছুনা ইশিতা, ফলস পে*ইন সম্ভবত।”
ইশিতা আবারও নিজের কাজে মন দেয়। তার তো এসব ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই। মেজো ভাবীর আছে। কিন্তু মেজো ভাবী বাড়িতে নেই। ভাইয়াকে নিয়ে তার অসুস্থ মাকে দেখতে গিয়েছে।
ব্যাথাটা বারছে হেনার, মুখমণ্ডল নীল হয়ে আছে। ইশিতা ফোন নিয়ে উঠে দাঁড়ায়,শান্ত ফোন দিচ্ছে। গেস্ট রুমের বেলকোনিতে গিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে নিয়ে ফিরে এসে হেনাকে দেখে । তার ভালো ঠেকছে না হেনার এই অবস্থা। কন্ঠে উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”এক গ্লাস দুধ এনে দেই?”
হেনা হাঁপাতে থাকে। ইশিতা রান্নাঘরের দিকে যায়। গ্লাসে দুধ ঢেলে নিয়ে এসে ঘরের দরজায় দাঁড়ায়। তারপর গ্লাস টা রেখে সিঁড়ির দিকে দৌড়ে যায়।
সামিন ঘরের বাতি নেভাতেই যাচ্ছিলো এমন সময় দরজায় ইশিতা ধা*ক্কা দিতে থাকে। দরজা খুলে বোনের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় সামিন। ইশিতা হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,”হেনা ভাবীর পেইন হচ্ছে!”
আলো কথাটা শুনে দৌড়ে নিচে চলে যায়। ইশিতা তার পিছু পিছু যায়। সামিন সাথে সাথে সিটি হসপিটালে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে নিয়ে নিচে যায়।
ব্যা*থায় কা*তরাতে থাকে হেনা। হাঁটু গেড়ে বসে হেনার হাত ধরে রাখে আলো। খুব মায়া লাগছে মেয়েটির জন্য। একটা আপন মানুষও কাছে নেই। তাই সম্ভবত ভরসা করতে পারছে না কাউকে। হেনার ফোনে বারবার জামিল ফোন দিয়ে যাচ্ছে। ইশিতা ফোনটা ধরে জামিলকে হেনার সুস্থতার কথা জানায় হেনার অনুরোধে। আসলে তো নিজেই দেখবে, এখন টেনশন দেবার প্রয়োজন কি!
আলো কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে দাঁড়ায়, দ্রুতপায়ে লিভিং রুমে গিয়ে সামিনকে বলে,”কি করবেন?”
“অ্যাম্বুলেন্স ডেকেছি। আসছে, পথে।”
আলো অবাক হয়ে বলে,”গাড়ি আছে তো আপনার। গাড়ি টা কোন কাজে ব্যাবহার করবেন শুনি? শুধু মেয়ে তুলে আনার জন্য? চলুন বের হই। অ্যাম্বুলেন্স আসতে আসতে অনেক সময় লেগে যাবে। আপনার শহরে ফুট*পান্ডার ডেলিভারি ম্যান আপনার ঐ সিটি হসপিটালের অ্যা*ম্বুলেন্স সা*র্ভিসের থেকে ফাস্ট।”
সামিন শীতল চোখে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে, এই পরিস্থিতিতেও মেয়েটা তাকে খোঁ*চা মেরে কথা বলতে ছারছে না!
ঠান্ডা গলায় বলে,”গাড়িটা গ্যারেজে আছে। বাইক নিয়ে বের হবো? বলো? ”
আলো কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে যায়। কিন্তু সে নিজের ভুল স্বীকার করবে না,তাকে তো জিততেই হবে,তাই বলে ওঠে,”আরেকটা গাড়ি কিনতে পারেন না? এতো টাকা দিয়ে কি করবেন?”
সামিন বোকার মত তাকিয়ে আছে আলোর দিকে। তারপর আলোকে জব্দ করার জন্য বলে ওঠে,”তোমার ডেলিভারির আগে কিনে ফেলবো। যাতে একটা গাড়ি গ্যারেজে থাকলে অন্যটাতে করে তোমাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে পারি। এখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে অ্যা*ম্বুলেন্সের অপেক্ষা করো, বেশি ঠোঁট না*ড়ালে চুপ করিয়ে দেওয়ার অনেক উপায় আমার কাছে আছে।”
চলমান……