#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_৪৩
#Esrat_Ety
কোনো রকমে বাইকটাকে সিটি হসপিটালের সামনে দাঁড় করিয়ে রুদ্ধশ্বাসে ভেতরে ছুটে যায় জামিল। তার শরীরের সমস্ত শক্তি ফুরিয়ে আসছে যেন। দোতলার থ্রি ব্লকের অ’পা’রেশন থিয়েটারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায় সে।
অপারেশন থিয়েটারের সামনে পায়চারি করছে সবাই। জামিলকে দেখে দাঁড়িয়ে পরে সামিন।
ধীর পায়ে জামিল এগিয়ে যায়। ইশিতা নরম গলায় বলে,”ওয়াটার ব্রে’ক হয়েছে হঠাৎ, সি-সেকশন ছাড়া পসিবল ছিলো না জামিল ভাই।”
জামিল ক্লান্ত ভঙ্গিতে একটা বেঞ্চিতে ধপ করে বসে পরে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,”একটু পানি খেতে চাই।”
আলো পানির বোতল এগিয়ে দিতেই পুরো বোতল খালি করে ফেলে। সামিন জামিলকে দেখছে। একটা সময় এসব সামিনের কাছে বাড়াবাড়ি মনে হতো। এখন বেশ মায়া হচ্ছে জামিলের প্রতি।
অ’পারেশন থিয়েটার থেকে একজন নার্স বের হয়ে আসে। তার হাতে কাপড়ে মোড়ানো ছোটো একটা প্রান। দোতলার ব্লক থ্রির পুরো এরিয়া কাঁপিয়ে গলা ছেড়ে চিৎকার দিয়ে জানান দিচ্ছে,”আমি এসে গিয়েছি।”
জামিল নার্সের দিকে তাকিয়ে আছে বোকার মতো। নার্স সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে,”বাচ্চার বাবা কে?”
সামিন নার্সকে ইশারা করে দেখিয়ে দেয় জামিলকে। নার্স এগিয়ে গিয়ে আনন্দিত গলায় বলে,”ধরুন। আপনার ছেলে। আপনার ওয়াইফ ঠিক আছে। একটু পরে কেবিনে শিফট করা হবে।”
জামিল উঠে দাঁড়ায়। কাঁপা কাঁপা হাতে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেয়। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বাচ্চাটার মুখের পানে তাকিয়ে থাকে। এ তার ছেলে! সে বাবা হয় এই ছেলেটার।
সামিন গলার স্বর উঁচু করে বলে,”হেনাকে স্বর্ণের চেইন দেওয়া হবে জামিল।”
জামিলের চোখে পানি ছলছল করছে। সে মুখ হাসি হাসি করে মজার ছলে বলে,”কিন্তু ছেলে হলে আমাকে নতুন বাইক দেওয়ার কথা ছিলো ভাই।”
_যে ওই প্রানটাকে দশমাস নিজের ভেতরে ধারণ করেছে,তাকে উপহার দিতে হয়। তুই কোথা থেকে উড়ে এসে এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলে বাইক হা’তিয়ে নিবি? উপহার হেনা পাবে, একজন মা পাবে।
আলো দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সামিনের দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটাকে সে জানতে চাইছে। ঠিক ঠিক ভাবে জানতে পারছে কি? সবকিছু কি এতটাই পরিষ্কার?
***
আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে আলো সামিনের দিকে এগিয়ে যায়। তার হাতে একটা গ্লাস। করিডোরে এখন কেউ নেই। ইশিতা এবং জামিল হেনার কেবিনে।
সামিন একটা চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে। আলো গিয়ে সামিনের পাশের চেয়ারটাতে বসে। সামিন মাথা তুলে আলোর দিকে তাকায়।
আলো জড়তা কাটিয়ে তার হাতের গ্লাসটা ধীরে ধীরে সামিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,”এটা খেয়ে নিন।”
সামিন অবাক হয়ে বলে,”কি এটা?”
_ডাবের পানি। হেনাকে র’ক্ত দিয়েছেন। তারপর কিছু মুখেও দেননি।
সামিন ম্লান হেসে বলে,”আমিও র’ক্ত সৈনিক। এসবে আমার অভ্যাস আছে। বাড়িতে গিয়ে এক প্লেট ভাত আর রিতুর হাতের শিং মাছের ঝোল খাবো, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
_আপনার দ’ম আছে।
_হ্যা, তা ঠিক বলেছো। নয়তো তোমার সাথে সংসার করার স্বপ্ন দেখি?
_কেনো আমার সাথে সংসার করা ভ’য়ংকর ব্যাপার নাকি? যে দ’ম থাকতে হয়?
_না, সাধনার ব্যাপার।
আলো নিশ্চুপ । মাথা নিচু করে গ্লাসটা ধরে রেখেছে। সামিন আড়চোখে একপলক আলোর দিকে তাকিয়ে আনমনে হেসে গ্লাসটা নেয়। ডাবের পানি টা খেয়ে নিচু স্বরে বলে,”এখন তো সব ঠিক আছে। বাড়িতে যেতে চাও? ক’ষ্ট হচ্ছে তোমার? তাহলে ইশিতা আর তোমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেই!”
“আর আপনি?”
“আমি পরে যাবো। সকালে।”
“আমরাও সকালে যাবো।”
আলো অস্ফুট স্বরে বলে।
সামিন আলোর দিকে তাকায়। আলো মাথা নিচু করে বলে,”হসপিটালে থাকতে কোনো অসুবিধা হয়না আমার। বেশিরভাগ সময়ই তো হসপিটালে থাকতে হয়েছে আমাকে।”
চুপচাপ বসে থাকে দুজন। কিছুক্ষণ পরে সামিন বলে,”বাড়িতে গিয়ে সকালে সবকিছু গুছিয়ে নেবে। সবকিছু বুক করে রেখেছি। পরশু সকালে ফ্লাইট।”
***
নিজের জিনিস পত্র গুছিয়ে নিতে গিয়ে আলো চিন্তায় পরে গিয়েছে। শাড়ি, প্রয়োজনীয় জিনিস সবকিছু নিয়েছে। আর কি নেবে? আলো কখনোই দেশের বাইরে যায়নি। তার কোনো ধারণাও নেই।
সামিন আড়চোখে একবার আলোকে দেখে বলে,”ওদেশে গিয়েও কি শাড়ি পরবে?”
আলো সামিনের দিকে তাকায়।
হঠাৎ সামিন বলে ওঠে,”রেডি হও।”
আলো অবাক হয়ে বলে,”কেনো?”
_বাইরে যাবো এখন আমরা।
_কিন্তু কোথায়?
_ভুলে গিয়েছিলাম। তোমাকে শুধু শাড়িই কিনে দেওয়া হয়েছে। তোমার জন্য কিছু ড্রেস কিনবো চলো।
আলো আমতা আমতা করে বলে,”ড্রেস মানে?”
_সালোয়ার কামিজ।
_দরকার নেই। শাড়ি পরতে পরতে আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।
আলো লাগেজ রেখে উঠে দাঁড়ায় । সামিন ওয়ালেট আর ফোনটা হাতে নিয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”রেডি হবার দরকার নেই , ঠিকই লাগছে তোমাকে, এখনই চলো।”
আলো বাধ সাধবার আগেই সামিন আলোর হাত ধরে । আলো চ’মকে ওঠে সামিনের এমন আচমকা স্পর্শে।
আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে সামিন বলে,”চলো।”
নিজে পছন্দ করে কিছু স্টিচড সালোয়ার কামিজ কিনে নেয়। আলো শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে সামিনের পাশে, সংকোচ নিয়ে।
শো-রুমের মালিক সামিনের সাথে হেসে হেসে কিছু পার্সোনাল কথাও বলছে। বিল মেটানোর আগে সামিন আলোকে বলে, ট্রা’য়া’ল রুমে গিয়ে দেখতে চাও?
আলো মাথা নাড়ায়। সামিন বলে,”দরকারও নেই। আমার পছন্দ বরাবর খুবই ভালো। সেটা পোশাক থেকে শুরু করে বৌ, যাই পছন্দ করি না কেনো, বেস্ট হয়ে থাকে।”
আলো দাঁড়িয়ে আছে। সামিন শপিং ব্যাগ গুলো হাতে নিয়ে আলোকে বলে,”চলো বাড়ি ফেরা যাক, তার আগে হেনাকে দেখে যাবো। ভালো কথা,ওর জন্য একটা স্বর্ণের চেইন কিনতে চাচ্ছি। এবার তুমি আমাকে হেল্প করো। এসো।”
একটা গয়নার শো রুমে ঢুকে হেনার জন্য চেইন পছন্দ করতে থাকে আলো। চেইন পছন্দ করার দায়িত্ব আলোকে দিয়ে সামিন চারপাশটা দেখতে থাকে। মাথা ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই হঠাৎ তার দৃষ্টি আটকে যায় একটা লকেটে। অনেক সিম্পল একটা লকেট। কিন্তু ভারি চমৎকার। ঐ জেদী মেয়েটার গলায় ভীষণ মানাবে। আড়চোখে আলোকে একবার দেখে সামিন বলে,”পছন্দ করা হয়ে গিয়েছে চেইন?”
_জ্বি। এটা।
_এবার তুমি ঐখানে গিয়ে বসো। আমি বিল মিটিয়ে আসছি।
***
গাড়ির হর্নের শব্দে কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম। এ শহরের লোকজনের ধৈর্য্য এতো কম কেনো? মাত্র দুমিনিট হয়েছে রাস্তাটায় জ্যাম লেগেছে, বিরক্ত হয়ে সবাই হর্ন বাজাতে শুরু করেছে। আলো ঘাড় ঘুরিয়ে সামিনের দিকে তাকায়। লোকটা সিটে হেলান দিয়ে আরাম করছে। যেনো জ্যামের মধ্যে পরে থাকতে তার বেশ ভালো লাগছে, এভাবে কয়েক বছর বসে থাকতে পারবে সে। ভাব দেখে মনে হচ্ছে কেউ যদি এখন বলে,আপনাকে আজ সারাদিন জ্যামে বসে থাকতে হতে পারে। এই লোকটা তখন ম্লান হেসে বলবে,জ্বি আচ্ছা, আমি বরং একটু ঘুমিয়ে নেই। জ্যাম কেটে গেলে ডেকে দেবেন।”
অবশ্য এই লোকটার প্রচুর ধৈর্য্য। তার প্রমাণ আলো পাচ্ছে। ২০২৩ সালের সেরা ধৈর্য্যশীল পুরুষের অ্যা’ওয়ার্ড টা একে দিয়ে দেওয়া উচিত। সামিনের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় আলো। একটা গাড়িও সামনে এগোচ্ছে না।
সামিন স্টিয়ারিং-য়ে হাত রেখে আড়চোখে আলোকে দেখছে। মেয়েটা এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখছে বাইরে? গাড়ির নাম্বার প্লেট?
এই মেয়েটার মধ্যে একটা গোয়েন্দা গোয়েন্দা ভাব আছে। অথচ এ একজন ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী। এর সাথে এর সাব’জেক্ট বড্ড বেমানান। এর উচিৎ ছিলো পু’লিশে জয়েন করা, যা গালাগালি জানে! এর একটা গালি শুনলেই আসামী লজ্জায় সব বলে দিতো, রি’ম্যা’ন্ডে নিতে হতো না।
হঠাৎ গাড়ির জানালায় টোকা পরে। সামিন জানালার কাঁচ নামিয়ে দেয়। একটা আট-দশ বছর বয়সী ময়লা ফ্রক পরা বালিকা সামিনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাতে কিছু বেলী ফুলের মালা। বালিকাটি নিস্তেজ কন্ঠে বলে ওঠে,”মালা নিবেন ভাইয়া? তাজা ফুল।”
সামিন একপলক মেয়েটির হাতের দিকে তাকিয়ে বলে,”স্কুলে যাওনা?”
_যাই, আজ তো বন্ধ।
ঘাড় ঘুরিয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে আবারও মেয়েটির দিকে তাকায়। তারপর বলে,”সবগুলো দাও।”
মেয়েটি খুশি হয়ে সবগুলো মালা সামিনকে দিয়ে দেয়। সামিন জিজ্ঞেস করে,”কত হয়েছে?”
_একশো বিশ টাকা ভাইয়া।
একটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে সামিন মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,”রেখে দাও।”
ফুলওয়ালি মেয়েটা বিস্ময় নিয়ে তার হাতের নোটটার দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন জানালার কাঁচ তুলে দেয়।
আলো সামিনের হাতের মালা গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন ঘুরে আলোর দিকে তাকাতেই ঘাবড়ে যায় কিছুটা। হঠাৎ করে তার মধ্যে অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছে। সে তার বত্রিশ বছরের জীবনে কাউকে ফুলের মালা দেওয়া তো দূরে থাক, একটা ফুলের পাপড়িও দেয়নি।
আলো একদৃষ্টে মালার দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন গাড়ির ড্যাশ’বোর্ডের ওপর মালা গুলো রেখে আমতা আমতা করে বলে,”গাড়িটা সাজাতে কিনেছি।”
আলো চুপ করে থাকে। সামিন মনে মনে বলে,”ওগুলো তোমার স্টুপিড মেয়ে।”
আলো আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি দেয়। বিরক্তিতে সামিনের কপাল কুঁ’চ’কে যায়। এদেশে একটা মেয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না যে বেলী ফুলের মালা পছন্দ করে না। অথচ এই মেয়ে ছুঁ’য়েও দেখছে না। এটা কি ধরনের নারী!
সামিনের ইচ্ছা করছে আলোর ঘাড় ধরে কাছে টেনে এনে মালা গুলো খোঁপায় লাগিয়ে দিতে। কিন্তু ধৈর্য্যশীল সামিন নিজেকে সংযত করে চুপ করে বসে থাকে।
***
“হ্যা আন্টি সব গুছিয়ে নিয়েছি। আপনি ওনাদের বলে রাখুন।”
এক হাত দিয়ে ফোনটা কানে ধরে রেখে অন্য হাতে কোলবালিশ এনে বিছানার মাঝে রাখে সে। প্রতিদিন রাতে এই জড়বস্তুটাকে আলমারি থেকে বের করে নিজের অধিকারের কিছুটা দিয়ে দেওয়া খুবই কষ্টের ব্যাপার সামিনের কাছে। কিন্তু নিজের বৌয়ের নারীবাদী অনূভুতির প্রতি সম্মান জানাতে সে এই কাজটা খুবই আনন্দের সাথে করে। মুখটা এমন করে রাখে যেন এই কাজটা করে তার একটুও বিরক্তি লাগছে না,সে খুবই আনন্দিত।
বুকের যন্ত্রনা বুকে চেপে রেখে মনে মনে কোলবালিশটার দিকে তাকিয়ে বলে,”একবার বৌয়ের মনে যায়গা করে নিতে দে। তারপর প্রথমেই তোকে কে’টে টু’করো টু’করো করবো আমি।”
ফোনের ওপাশে ডক্টর রুবি ছিলো। সিঙ্গাপুরে যাওয়ার ব্যাপারে কথা হচ্ছিলো দুজনের। ফোন কে’টে দিয়ে সামিন আলোর দিকে তাকায়। আলমারির মধ্যে কিছু একটা খুঁজছে।
“কিছু খুজছো?”
সামিনের প্রশ্নে আলো ঘুরে তাকায়। অস্ফুট স্বরে বলে,”আম্মু বলেছে স্বর্ণের গয়না গুলো সাথে করে না নিয়ে যেতে। সেগুলো রেখে দেবো।”
সামিন আলোর হাতের দিকে তাকায়। আলো নিজের হাতের বালা দুটো খুলতেই যাচ্ছিলো। সামিন নরম গলায় বলে,”ঐ দু’টো থাকুক প্লিজ!”
আলো থেমে যায়। কিছু মুহূর্ত সামিনের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে আলমারির দরজা বন্ধ করে বিছানার কাছে যায়। বেড সাইডের টেবিলের ওপর বেলী ফুলের মালা গুলোকে দেখতে পেয়ে সামিনের দিকে তাকায়।
সামিন বিছানায় চুপচাপ বসে আছে আলোর দিকে তাকিয়ে। আলো নিজের যায়গায় শুতেই যাচ্ছিলো তখনই সামিন বলে ওঠে,”আরেকটা আবদার রাখবে।”
আলো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। সামিন তার বালিশের নিচে থেকে একটা ক্ষুদ্রাকার বক্স বের করে তার মধ্যে থেকে সেই লকেট টা বের করে। আলো নিশ্চুপ হয়ে সামিনের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে।
একপলক আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে আলোর দিকে এগিয়ে যায়। আলো সামিনের পদক্ষেপ স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে, কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে নিজের যায়গায় নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে থাকে।
আলোর খুব কাছে গিয়েও দূরত্ব বজায় রেখে লকেট টা আলোকে পরিয়ে দিতে দিতে বলে,”এটাও থাকুক।”
লকেট টা পরিয়ে আলোকে মুগ্ধ চোখে দেখছে সামিন। আলো তার দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে বসে থাকে। পর পর সামিন বলে ওঠে,”একটা শেষ আবদার রাখবে?”
আলো জড়তা কাটিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”বলুন।”
সামিন ডান হাত বাড়িয়ে বেলী ফুলের মালা গুলো নিয়ে নেয়।সবগুলো একসাথে পেঁচিয়ে নিয়ে আলোর খোঁপায় বেঁধে দেয়। নির্দিষ্ট দূরত্বে বসে হাত বাড়িয়ে মালাটা খোঁপায় লাগাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। সামিন ভেবেছিলো আলো রিয়্যাক্ট করবে। আলোর নীরবতা সামিনকে স্বস্তি দিলেও আলোর চোখে মুখে ছেয়ে থাকা সংকোচ সামিনের মন খারাপ করে দেয় মুহুর্তেই।
খোঁপা থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে মৃদু স্বরে বলে,”এগুলোও থাকুক। আজ রাতের জন্য। গাড়ির ড্যাশ’বোর্ডের উপর পরে থাকলে এতো সুন্দর ফুলগুলোর অপমান হতো, তাদের সঠিক এবং উপযুক্ত যায়গায় রেখে দেওয়াটা আমার দায়িত্ব। মেয়র তার দায়িত্ব পালনে অলসতা করে না আছিয়া।”
আলো চেহারায় সংকোচ নিয়ে এদিক ওদিক তাকায়। সামিন নরম গলায় বলে ওঠে,”একটা সর্বশেষ আবদার রাখবে?”
আলো এইবার সামিনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন আলোর গালে একটা হাত রেখে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,” তুমিও প্লিজ থেকো। তবে এক রাত্রি কিংবা দু রাত্রির জন্য না, আরব্য রজনীর মতো হাজার রাত্রি থেকো, আমি তোমার উপযুক্ত স্থান হবার চেষ্টা করবো। যে স্থানে থাকলে তুমি কখনও অসম্মানিত কিংবা অপমানিত হবে না আছিয়া।”
কথাটা শেষ করেই সামিন আলোর গাল থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরে টানটান হয়ে। তার চোখে মুখে ছেয়ে থাকা তার কাঙ্ক্ষিত নারীটাকে একান্তে পাওয়ার জন্য তার পুরুষ মনের ব্যাকুলতা, চাদরে মুখ না ঢেকে নিলে ঐ নারীটা বুঝে নেবে, সামিন তাকে অস্বস্তিতে ফেলতে চায় না।
আলো অদ্ভুত চোখে সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কাঁপা কাঁপা হাতে নিজের গলায় সামিনের পরিয়ে দেওয়া লকেট টা ছোঁয়। দীর্ঘসময় বসে থেকে ধীরে ধীরে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পরে সে, তার হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছে লকেট টা।
***
ফ্লাইট সকাল সাড়ে সাতটায়। তারা ভোর সাড়ে চারটার সময় এয়ারপোর্টে পৌঁছে যায়। ইলহাম সামিন আর আলোকে নামিয়ে দিয়ে আসে এয়ারপোর্টে।
সিকিউরিটি চেকিং হয়ে গেলে সামিন আলোকে নিয়ে একটা ফুডশপের দিকে যায়। সেখান থেকে হালকা কিছু স্ন্যাকস কিনে নিয়ে আলোকে একটা বেঞ্চিতে বসতে বলে নিজেও পাশে বসে। হাতের প্যাকেট টা আলোর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,”হালকা কিছু খেয়ে নাও।”
আলো রোবটের মতো হাত বাড়িয়ে প্যাকেট টা নিয়ে নেয়। সামিন নিজের প্যাকেট খুলে স্যান্ডউইচ খেতে থাকে।
পাশে, কিছুটা দূরেই এক বৃদ্ধ দম্পতি তাদের দেখছিলো। মহিলা কৌতুহলী হয়ে সামিনকে বলে,”তুমি সামিন ইয়াসার মির্জা না?”
সামিন তার দিকে তাকিয়ে বিনয়ের সাথে উত্তর দেয়,”জ্বি। ”
_আমাকে চিনতে পেরেছো? আমি কলাম রাইটার নাফিসা কালাম, তোমার দিগন্ত ফা’উন্ডেশনের একটা প্রতিবেদন লিখেছিলাম আমি।
সামিন কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে,”জি।”
_সাথে কে? তোমার ওয়াইফ?
_জি।
_সিঙ্গাপুর কেনো যাচ্ছো? হানিমুনে?
সামিন থতমত খেয়ে আলোর দিকে তাকায়। আলো খাওয়া রেখে বসে আছে চুপচাপ। মুহুর্তেই অস্বস্তি কাটিয়ে সামিন বলে ওঠে,”চিকিৎসার জন্য।”
বৃদ্ধ লোকটা বলে ওঠে,”তোমরা ই’য়াং কাপল যাচ্ছো চিকিৎসার জন্য আর আমরা বুড়ো বুড়ি যাচ্ছি হানিমুনে। হা হা হা।”
“হ্যা, র’স উপচে পরছে তো আপনাদের।”
আলো বিড়বিড় করে বলে ওঠে।
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বলে,”মুরব্বি মানুষ, বেয়াদবি করবে না আলো।”
_উনারা এতো পার্সোনাল কথা জানতে চাচ্ছে কেনো? মুরব্বিদের মতো থাকতে পারে না?
ফিসফিসিয়ে বলে আলো।
সামিন কোনো কথা বলে না। বৃদ্ধ মহিলা বলে ওঠে,”চিকিৎসার জন্য যাও বা বিজনেস ট্রিপ, বৌ নিয়ে যখন যাচ্ছো সেটাকে হানিমুনই বলতে হবে।”
সামিন বিরস মুখে স্যান্ডউইচে একটা কা’মড় বসিয়ে মনে মনে বলে,”হানিমুন ? মধুচন্দ্রিমা? সে আর এ জীবনে হচ্ছে আমার!”
***
“সিটবেল্ট বেঁ’ধে নাও।”
আলো চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবকিছু দেখছিলো। সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”কখনো প্লেনে ওঠোনি?”
আলো মাথা নাড়ায় ।
_পাস*পোর্ট করেছিলে কেনো তবে?
_আব্বু আমাদের সবার পাস*পোর্ট করিয়ে রেখেছিলো। আব্বুর খুব শখ ছিলো মোটামুটি একটা এমা*উন্টের টাকা জমে গেলেই কাছের কোনো দেশে ট্যুর দেবে। কিন্তু সেই মোটামুটি এমা*উন্টের টাকা কখনোই জমতো না।
সামিন ম্লান হাসে। তারপর বলে,”সৎ মানুষদের সাথে এমনটা হয়।”
আলো বলে,”আপনি কোন কোন দেশে গিয়েছেন?”
_আমি? মোট তিনটা দেশে, ইন্ডিয়া, ইউএসএ,সিঙ্গাপুর।
_সিঙ্গাপুর কেনো গিয়েছিলেন?
_দুইহাজার চৌদ্দ সালে গিয়েছিলাম,তখন আমার তেইশ বছর বয়স। আমি,সাগর আর আমার কিছু বন্ধু। তখন বাবা এমপি ছিলো, আমি পলি*টিক্স করতাম না।
_সাগর মানে,সাগর ভুঁইয়া?
_হু।
_ও আপনার বন্ধু ছিলো? শ*ত্রু কিভাবে হলো? বিরোধী দল করে?
_না অন্য কারনে। সেসব তোমার না জানলেও চলবে। দেখি সিট বেল্ট বাধো।
সামিন নিজেই আলোর সিটবেল্ট বেঁধে দেয়। আলো সামিনের দিকে তাকায়। দু’জনের চোখাচোখি হতেই আলো চোখ সরিয়ে নেয়।
“এক্সকিউজ মি স্যার।”
অতি সুমিষ্ট নারীকন্ঠটি। সামিন আর আলো তাকায়। তাদের সামনে অতিমাত্রায় সুন্দরী একজন বিমানবালা দাঁড়িয়ে আছে।
সামিন বলে,”ইয়েস?”
_স্যার আপনাদের মিল।
তাদের সামনে খাবার সাজিয়ে রেখে বিমানবালা চলে যায়। আলো মেয়েটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। বয়স সাতাশ-আঠাশ হবে। শারীরিক গঠন খুবই চমৎকার। অত্যন্ত সুশ্রী চেহারা এবং অতিরিক্ত ফরসা। ঠোঁটে কড়া করে লিপস্টিক দিয়েছে,দেখে মনে হচ্ছে একটা গোটা লিপস্টিক ঘষে ঘষে লাগিয়েছে। গাঁয়ের শাড়িটা পরেছে আঁট*সাঁট ভাবে। যেখানেই যাচ্ছে পুরুষ লোক গুলো হা করে গিলে খেতে চাইছে তাকে। আলো বিরক্তিতে কপাল কুঁ*চকে ফেলে, তারপর সামিনের দিকে তাকায়! লোকটা একমনে তার হাতের একটা ম্যা’গা’জিনের দিকে তাকিয়ে আছে। চারদিকে কি হচ্ছে সেদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
সামিনের থেকে চোখ সরিয়ে আলো ম’নি’টরে চোখ রাখে। সামিন ম্যা’গা’জিন রেখে তার দিকে তাকিয়ে বলে,”কোনো অসুবিধা? ব’মি পাচ্ছে?”
আলো মাথা নাড়ায়। সামিন আলোর দৃষ্টি অনুসরণ করে মনিটরের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমরা এখন মিয়ানমার হয়ে যাচ্ছি।”
আলো কোনো কথা বলে না, আবারো আশেপাশে দেখতে থাকে। সামিন আলোর বাচ্চামো আড়চোখে দেখে মনে মনে হাসছে। মেয়েটার চোখে মুখে কৌতুহল।
একটা পঞ্চাশোর্ধ পেটমোটা লোক এক বিমানবালার বু’কের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আলোর পুরো শরীর জ্বলে ওঠে, বিড়বিড় করে বলে ওঠে “আরে লু’চু আংকেল মুখটা বন্ধ করুন, মাছি ঢুকে যাবে তো।”
সামিন তৎক্ষণাৎ আলোর মুখ চেপে ধরে এদিক ওদিক তাকায়।
সামনের সিটের একজন মহিলা ঘাড় ঘুরিয়ে অবাক হয়ে আলোকে একবার দেখে আবারও সামনে তাকায়।
আলো ছ’ট’ফ’ট করছে। সামিন আলোর মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিতেই আলো একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলে,”মে’রে ফেলবেন নাকি! অদ্ভুত।”
_সব যায়গায় মুখ চালাতে হবে তোমার? খোদা আমি এই মেয়েটাকে নিয়ে কোথায় যাবো!
চাঁপা স্বরে চেঁ’চি’য়ে বলে সামিন।
_ঐ লোকটা কিভাবে দেখছিলো ঐ বিমানবালাকে, পুরো গা ঘিনঘিনে ব্যাপার। এসব দেখলে আমার মুখ নিশপিশ করে।
_তুমি একটা সা*ইকো আলো। এটা ক্লি’য়ার হয়ে গিয়েছে আজ।
আলো মুখ ভার করে ফেলে। কিছুক্ষণ পরে সামিন হঠাৎ হাসতে থাকে। আলো অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে,”হাসছেন কেনো?”
_একটা কথা মনে পরে গিয়েছে। সেদিন একটা নি*উজে দেখলাম বাংলাদেশী একটা লোক বিমানে উঠে বিমান বালাকে জোরপূর্বক চু*মু দেওয়ার অপরাধে জে’ল জরি’মানা হয়েছে। আমি ভাবছি কতটা অসহায়, তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধার্ত হলে একটা অ*ধম শেষমেশ এতো সিকি*উরিটির মধ্যেও একজন বিমানবালার সাথে এসব করে। লোকটার জন্য করুণা হচ্ছে।
_এসব বাংলাদেশেই হয়, স্বভাবে খুব ভালো জাতি কি না।
_এভাবে বলো কেনো? আমি গর্বিত আমি বাঙালী।
আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”দেখলাম এখানের সবগুলো পুরুষ মানুষ একবার না একবার ঐ সুন্দরী বিমানবালার দিকে তাকিয়ে তার সৌন্দর্য উপভোগ করেছে। তা আপনি কেনো তাকাচ্ছেন না? নিজেকে কেনো ব*ঞ্চিত করছেন? এখানে কেউ তো আপনাকে নিষেধ করার মতো নেই।”
সামিনের মাথায় হুট করে রা*গ উঠে যায়। আলোর দিকে রা*গান্বিত দৃষ্টি দিতেই আলো মিইয়ে যায়। সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে,”সব পুরুষ এক?”
_আমার তো মনে হয়, সবাই সৌন্দর্যের পাগল।
আমতা আমতা করে বলে আলো।
সামিন একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে, মেয়েটা যদি বুঝতো সামিনকে সে তার ঐ সীমিত সৌন্দর্য দিয়ে কতটা মুগ্ধ করে রেখেছে!
বুঝবে না! এই মাথা মোটা মেয়ে কখনোই বুঝবে না!
দ্বিতীয় বারের মতো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামিন বলে,”চুপচাপ বসে থাকো,আর মাত্র ঘন্টা দুয়েকের ব্যাপার। কোন লোক কোন বিমানবালাকে চোখ দিয়ে খে*য়ে নিলো সেটা তোমার দেখতে হবে না। বেশি দেখাদেখি করতে ইচ্ছে হলে আমাকে দেখো বসে বসে, মোটামুটি হ্যান্ডসামই আছে তোমার স্বামী।”
চলমান……