বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে পর্ব-৪৬

0
1038

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_৪৬
#Esrat_Ety

সামিনের পেটের কাছের শার্ট খামচে ধরে রেখেছে আলো। হৃদস্পন্দন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সামিনের। সামিনের চোখ বড়বড় হয়ে আছে। সে কি স্বপ্ন দেখছে! স্বপ্ন এতোটা স্পষ্ট হয়? এতোটা রঙিন?
মাথা ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকায় সামিন। সবাই তাদের দেখছে। রিসিপশনে লোক জড়ো হয়ে গিয়েছে। আলো তখনও সামিনের বুকের সাথে নিজের মাথাটা ঠেকিয়ে রেখেছে। কোনো নড়াচড়া করছে না, সামিনের মনে হচ্ছে আলো নিঃশ্বাস পর্যন্ত নিচ্ছে না। চঞ্চল, উড়ন*চন্ডী মেয়েটাকে কেমন অদ্ভুত শান্ত, নমনীয় লাগছে।

অনাকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তের তীব্র অনূভুতির ঘোর কাটে না। সামিন যথাসম্ভব চেষ্টা করে নিজেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে। না এটা কোনো স্বপ্ন নয়। সে চোখ নামিয়ে আলোর মাথার দিকে তাকায়। দৃষ্টি আলোর সিঁথিতে নিবদ্ধ রেখে নরম গলায় বলে,”কি হয়েছে আলো?”

আলো কোনো কথা বলে না। একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, নিশ্চুপ হয়ে,সামিনের বুকে মাথা ঠেকিয়ে।

পাশ থেকে নাফিসা কালাম বলে ওঠে,”তুমি এলে শেষমেশ সামিন! কোথায় গিয়েছিলে এতো রাতে? এদিকে তোমার স্ত্রী কেঁ*দে কে’টে একাকার হয়ে গিয়েছে, ভেবেছে তার পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চির, সু-স্বাস্থ্যবান স্বামীকে কেউ তুলে নিয়ে গিয়েছে, অথবা হারিয়ে গিয়েছে তার স্বামী। এক্ষুনি পুলিশ নিয়ে তোমাকে খুঁজতে যাচ্ছিলো তোমার বৌ।”

সামিন অবাক হয়ে নাফিসার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আশেপাশের লোকজন নিজেরা নিজেদের কাজে মন দেয়। স্বামী স্ত্রীর ব্যক্তিগত মুহূর্তে তারা নাক গলাতে ইচ্ছুক নয়।

আলো সেই যে মুখ লুকিয়েছে সামিনের বুকে এখনো সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। সামিন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আলোর বাহু ধরে ধীরে ধীরে আলোকে নিজের থেকে আলগা করে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে আলোর মুখের দিকে তাকায়। আলো চোখ নামিয়ে রেখেছে। সামিন একহাত দিয়ে আলোর থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে আলোর চোখে চোখ রাখে। চোখের কার্নিশ এখনো ভেজা মেয়েটার।
সামিন নরম গলায় জানতে চায়,”কি হচ্ছিলো এসব?”

সামিনের প্রশ্নের জবাব আলো দেয়না। আত*ঙ্কিত, ভী*ত, কান্নাভেজা মুখটা ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে এক ঝটকায় সামিনের হাত সরিয়ে দেয় নিজের থুতনি থেকে, তারপর ছুটে যায় লিফটের কাছে।

সামিন বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে। নাফিসা বলে,”দেখছো কি দাঁড়িয়ে, যাও!”

সামিন নাফিসার দিকে তাকিয়ে বলে,”আন্টি আপনারা!”

_আমাদের রুম নাম্বার আর থার্টি সেভেন। কাল দেখা হবে! এখন যাও ছেলে, তোমার বৌয়ের মান ভাঙাও। যাও। দেখে মনে হচ্ছে প্রচুর ক্ষে*পেছে তোমার বৌ।

***
“আলো, দাঁড়াও বলছি। আলো ! কথা শোনো।”

আলো দাঁড়ায় না। পিছু ফিরে তাকায় না। লিফটে উঠে পরে।

যে লিফট টাতে আলো উঠেছে, সেটাতে ঢোকার চান্স পেলো না সামিন। জলদি জলদি পাশের লিফটে উঠে পরে সে। ছয়তলায় উঠে আলোর পিছু নেয়। পেছন থেকে ডেকেই যাচ্ছে আলোর নাম ধরে। আলো রাগান্বিত চেহারা নিয়ে ছুটতে থাকে এল টুয়েন্টি ফোরের দিকে‌। এ যেনো দৌড় প্রতিযোগিতা চলছে!

সামিন চেঁচিয়ে বলতে থাকে,”আলো স্টপ! মানুষ আমাকে স্ট*কার ভেবে গন*পিটুনি দেবে। দেশের সূর্য সন্তান বিদেশের মাটিতে গন*পিটুনি খাবে,এটা চাও তুমি?”

দৌড় প্রতিযোগিতায় সামিন ইয়াসার মির্জা তার সহধর্মিণীর কাছে হেরে যায়‌।

নিজেদের রুমে ঢুকে আলো দরজা লক করে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে সে।

সামিন এসে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পরে। হাঁপাতে থাকে সেও। কিছু সময় পরে নরম গলায় বলে,”দরজা খোলো আলো!”

আলো চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। সে খুলবে না দরজা। খুলবেই না। এটাই ঐ দায়িত্ব জ্ঞানহীন পুরুষটার উপযুক্ত শা*স্তি।

সামিন দরজায় আলতো করে চাপড় মে*রে বলে,”প্লিজ আলো, দরজা খোলো। দেখো সবাই আমাকে দেখে হাসছে! খুলে দাও দরজাটা।”

আলো নিশ্চুপ। সামিন বলতে থাকে,”বড্ড অবিচার করো তুমি আমার সাথে। দোষ কি করেছি সেটা না জানিয়েই শাস্তি দিচ্ছো।”

_গত ছয়ঘন্টায় আপনি লকেট উদ্ধারের পাশাপাশি আর কোন কোন রাষ্ট্র উদ্ধার করে এসেছেন সেটার বিবরণ দিন ইয়াসার মির্জা, আপনার হাতে সময় পাঁচ মিনিট। এই পাঁচ মিনিটে গত ছয় ঘন্টার প্রত্যেকটা মিনিটের হিসেব আপনাকে দিতে হবে।
চেঁ*চিয়ে বলে ওঠে আলো।

সামিনের শার্টের বুক পকেটে একটা ক্ষুদ্রাকার সাদা রঙের ফুল ছিলো, সেটায় হাত বুলিয়ে সামিন হেসে ফেলে। পরক্ষনেই বলতে থাকে,”এখান থেকে ভিভোসিটি মলে যেতে চল্লিশ মিনিট লেগেছে আলো, ক্যাব পাচ্ছিলাম না। তারপর ওখান থেকে বিশ মিনিটে ঐ মোটেলে পৌঁছালাম। এই গেলো এক ঘন্টার হিসেব। পেয়েছো?”

_পেয়েছি।
ঠান্ডা গলায় বলে আলো।

_তারপর মোটেলের রিসিপশনিস্টের সাথে কথা বলে,ম্যানেজারকে মানিয়ে তন্নতন্ন করে খুজেছি তোমার লকেট টা সেই ওয়াশ রুমে। এতে চলে গিয়েছে প্রায় দুঘন্টা। তিন ঘণ্টার হিসেব পেয়েছো?

_পেয়েছি।

_তারপর যখন লকেট টা খুঁজেই পাইনি, তখন ঐ রুমের রুম বয়কে ডেকে আনিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে লকেট টা উদ্ধার করতে করতে আরো এক ঘন্টা চলে যায়। চার ঘন্টার হিসেব পেয়েছো?

_পেয়েছি।

_মোটেল থেকে লকেট টা নিয়ে বের হওয়ার পরে একটু হালকা হতে একটা পাবলিক টয়*লেটে ঢুকেছিলাম। বেরিয়ে দেখি সেন্তোসা টু ভিভোসিটি মলের রাতের শেষ বাসটা তিন মিনিট আগে চলে গিয়েছে। কপাল আমার! ওখানে দাঁড়িয়ে থাকি আধাঘণ্টার মতো। একটাও ক্যাব পাচ্ছিলাম না। ফোনটা ডে*ড হয়ে পরে ছিলো। তারপর বাধ্য হয়ে হাঁটতে শুরু করি, শর্ট*কাট রাস্তা ধরে। আরো বিশ মিনিট চলে যায়। চার ঘন্টা পঞ্চাশ মিনিটের হিসেব পেয়েছো?

_পেয়েছি।

_তারপর ভিভোসিটি মল থেকে বেরিয়ে সৌভাগ্য ক্রমে একটা ক্যাব পেয়ে যাই। এখানে এখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আরো চল্লিশ মিনিট লেগে যায়। পাঁচ ঘন্টা ত্রিশ মিনিটের হিসেব। পেয়েছো?

_পেয়েছি।

_বাকি আধাঘণ্টার শেষের পনের মিনিট তো তুমি আমাকে জরিয়ে ধরেই ছিলে আলো।
নরম গলায় বলে সামিন‌ ।

_ঐ আধা ঘন্টার প্রথম পনেরো মিনিটের হিসেব দিন।
তে*জী কন্ঠে আলো বলে।

সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ঠান্ডা গলায় বলে,”সেন্তোসা টু ভিভোসিটি মলের রাতের শেষ বাসটা, যেটা আমি মিস করেছিলাম, সেটা এক্সি*ডেন্ট করেছে আলো। হোটেলের সামনে এসে খবরটা শুনতে পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে ছিলাম পনেরো মিনিট।

আলো কেঁ*পে ওঠে। সামিন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।

ধীরে ধীরে দরজার নব ঘোরার শব্দ হয়। দরজা খুলে আলো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন কয়েক মুহূর্ত আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে রুমে ঢুকে দরজা লক করে ঘুরে আলোর দিকে তাকায়। চোখের কার্নিশ এখনো ভেজা আলোরানীর। সামিনের চোখের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে,”আমি এখানে আমার সা*র্জারির জন্য এসেছি, আপনার জন্য দুশ্চিন্তা করে রাত পার করে দিতে নয় ইয়াসার মির্জা।”

সামিন কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে আলোর দিকে। তারপর হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলে,”রাত পার করলে কই ? সকাল হতে এখনো দুঘন্টা দেরী।”

কথাটা বলে শেষ করতে পারে না সামিন, আলো এলোপাথাড়ি সামিনের বুকে কি*ল ঘু*ষি মারতে থাকে, দাঁতে দাঁত চেপে। সামিন উচ্চশব্দে হেসে ফেলে, হাসতে হাসতে আলোর দুহাত শক্ত করে ধরে ফেলে। ধীরে ধীরে আলো শান্ত হয়। তার দৃষ্টি সামিনের চোখের দিকে। সামিনও তার স্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে, ঐ চোখে আজ কোনো ঘৃ*ণা নয়, বরং তার জন্য অনূভুতি দেখতে পাচ্ছে সে। তবে কি সামিন ইয়াসার নির্বাচনে জয়ী হয়েছে?
অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে সামিন,”স্বামীর গায়ে হাত তুলতে নেই মূর্খ মেয়ে, তোমার মা তোমাকে সহবত শেখায়নি?”

আলো চুপ করে থাকে‌।

আলোকে টেনে নিজের অনেকটা কাছে নিয়ে গিয়ে সামিন ধ’ম’কে’র সুরে বলে,”ইররেস্পনসিবল লেডি। তোমার জন্য আজ আমি মা*রা পরতে যাচ্ছিলাম। ঢং করে লকেট টা খুলে কেনো রেখেছিলে? বেশ হতো, ঐ বাসে যদি আমি থাকতাম……”

কথাটা বলে সামিন শেষ করতে পারে না,আলো তার মুখ চেপে ধরে ডান হাত দিয়ে। সামিন চোখ বড়বড় করে রেখেছে। আলো ধরা গলায় বলে,”বলবেন না, বলবেন না এমন কথা।”

ঠোঁট কাঁপছে আলোর। সামিন বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের মুখের ওপর থেকে আলোর হাতটা ধীরে ধীরে সরিয়ে দেয়। আলো তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাতটা মুঠি করে শক্ত করে ধরে সামিন বলতে থাকে,”ফে*রাউন ম*রে গেলে তোমার কি আছিয়া।”

_ছিঃ এসব আর কখনো যেনো না শুনি। ফে*রাউনের সাথে নিজের তুলনা দেবেন না, মজা করেও না, জা*লিমের সাথে নিজের তুলনা দিতে নেই।
চাপা স্বরে চেঁচিয়ে বলে আলো।

সামিন ম্লান হাসে, নরম গলায় বলে,”তুমিই তো বলতে আমাকে এটা।”

_রাগ ছিলো, ঘৃ*ণা ছিলো….

_ছিলো?
শব্দটা উচ্চারণ করে আলোর চোখে চোখ রাখে সামিন। আলো চোখ নামিয়ে নেয়।

সামিন বলতে থাকে,”ছিলো? রাগ ছিলো, ঘৃ*ণা ছিলো? অতীতকাল। তার মানে এখন নেই? রাগ নেই ঘৃ*ণাও নেই?”

আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”নাহ।”

_কোথায় গিয়েছে সেসব?

_জানিনাহ।

_আচ্ছা ঠিকাছে, রাগ নেই, ঘৃ*ণাও নেই। তাহলে তো এখন অন্যকিছু একটা আছে। সেটা কি?

_জানিনাহ।

সামিন মুখে চ কারন্ত শব্দ করে বলে,”জানো কি তুমি?”

_আমি কিচ্ছু জানিনা।
আলো কাঁপা কাঁপা গলায় বলে।

সামিন আলোর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলে,”এই যে মাথামোটা মেয়ে, আমার ভুল হয়ে গিয়েছে তোমাকে ভালোবাসা, অনেক বড় ভুল হয়েছে আমার। তোমাকে কিচ্ছু জানতে হবে না। তুমি এখানে জানিনাহ জানিনাহ জপ করতে থাকো, আমি বাইরে গেলাম। দরজা লক করে দাও। ”

দরজা খুলে সামিন বেড়িয়ে যেতে নেয়, পেছন থেকে আলো সামিনের হাত ধরে ফেলে, সামিন আলোর দিকে তাকায়, বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”কি? কি সমস্যা? কি চাও?”

আলো অপলক সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন ধ’ম’কে’র সুরে বলে,”কি? বলবে না কি চাও? নাকি কি চাও সেটাও জানোনা?”

_জানি!
অস্ফুট স্বরে বলে আলো।

_কি? কি চাও?

_সংসার করতে। আপনার সাথে সংসার করতে চাই ইয়াসার মির্জা!
একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে আলো ধরা গলায় বলে।

সামিন একদৃষ্টে তার বৌয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আলো বলতে থাকে,”আমি, আমি আপনাকে স্বামী হিসেবে স্বীকার করতে চাই!”

কথাটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে বললেও আলোর দু’চোখ বেয়ে নিশ্চুপে তরল গড়িয়ে পরে। দীর্ঘক্ষণ সামিন সেই গড়িয়ে পরা তরলের দিকে তাকিয়ে থেকে,চোখ সরিয়ে নিয়ে এদিক ওদিক তাকায়। তার ইচ্ছে করছে এক্ষুনি, এই মুহূর্তে তার বৌকে কোলে তুলে নিয়ে পুরো সিঙ্গাপুর সিটিতে আনন্দ মিছিল করতে। আজ সে জিতেছে, জিতেছে সে। ঐ পাথর কন্যা অমানবিক নয়, তাকে জিতিয়ে দিয়েছে।

নিজের ভেতরটা উত্তেজনায় তোলপাড় করে দেওয়া অনূভুতিকে দমিয়ে রেখে সে আলোর কাছে এগিয়ে যায়। দুহাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে আলোর চোখের কার্নিশ মুছিয়ে দেয়। আলো নিস্তেজ কন্ঠে বলতে থাকে,”যু*দ্ধ চলছিলো। ভীষণ ভয়া*বহ যু*দ্ধ। কেউ কারো কাছে হার স্বীকার করতে রাজি নয়। কিন্তু শেষমেশ একটা তু*খোড় আত্মগড়িমায় ভরপুর নারী সত্তা দুর্বল প্রমানিত হয়েছে, সে হার স্বীকার করে নিয়েছে অদম্য শক্তিশালী একজন স্ত্রী সত্তার কাছে, যে স্ত্রী সত্তার কাছে একটা কাগজ অনেক বড় গুরুত্ব বহন করে।”

গলা থেকে আর কোনো কথা বেরোতে চাইছে না, তবুও একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে সামিনের চোখের দিকে তাকিয়ে কোনোমতে আলো বলে ওঠে,”এখন আমি কি করবো মেয়র সাহেব?”

একটু থামে আলো, তারপর আবার বলতে থাকে,”একজন কঠিন নারীসত্তার পরাজয়ের আনন্দ করবো, নাকি একজন স্ত্রী সত্তার জয়ের আনন্দ করবো? কি করবো মেয়র সাহেব?”

তাকিয়ে আছে আলো তার স্বামীর দিকে। সামিন চুপ করে দেখছে আলোকে। আলো বলতে থাকে,”আমি জানিনা। আপনি বলে দিন। তার আগে প্লিজ আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিন। গত ছয়ঘন্টায় অনেক বড় একটা যু*দ্ধ শেষ হয়েছে আমার ভেতরে। আমি একটু প্রশান্তি চাচ্ছি মেয়র সাহেব। যু*দ্ধ বিধ্বস্ত শরীরটা একটু স্বস্তি চাচ্ছে।”

সামিন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে আলোকে বুকে টেনে নেয়। আলোর মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।

দীর্ঘসময় দু’জনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ আলো অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”কেনো বলুন তো! অনুভূতিরা এতো অবুঝ কেনো? এরা কেনো একজন অপ*রাধীর জন্য জড়ো হয়েছে? বলুন না!”

আলোকে নিজের থেকে আলগা করে সামনে দাঁড় করিয়ে তার মুখটা উঁচু করে ধরে, চোখে চোখ রেখে সামিন বলে,”আমিও জানিনাহ।”

আলো কিছু সময় সামিনের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন ওয়ালেট থেকে লকেট টা বের করে আলোর গলায় পরিয়ে দিতে দিতে বলে,”তৃতীয় এবং শেষ বারের মতো পরিয়ে দিচ্ছি এটা তোমায়, যদি আর কখনো কেয়ার*লেসের মতো এটা হারিয়ে ফেলো তাহলে শা*স্তি দেবো তোমাকে।”

লকেট টা ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে আলো। সামিন অনেকটা কাছে চলে যায় তার,একহাতে আগলে ধরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে,”তুমি আমাকে জিতিয়ে দিলে আছিয়া। ধন্যবাদ স্বরূপ আমি কি আমার বৌকে একটা চু*মু দিতে পারি?”

আলো চোখ নামিয়ে নেয়। কিছুটা সময় নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”এর আগেও তো দিয়েছেন। কখনো তো অনুমতি নেন নি।”

সামিন ম্লান হেসে ঠান্ডা গলায় বলে,”কারন আমি চু*মুটা কাঁদতে কাঁদতে লাল হয়ে যাওয়া তোমার ঐ নাকের ডগায় দিতে চাচ্ছি ।”

আলো নিচু মাথাটা আরো নিচু করে ফেলে। ধীরপায়ে খানিকটা পিছিয়ে যায় সংকোচে, লজ্জায়। সামিন ম্লান হেসে এগিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আলোকে পাঁজা*কোলা করে তুলে নেয়। আলো চ’ম’কে ওঠে। লজ্জার আতিশয্যে সামিনের বুকের কাছের শার্ট খামচে ধরে। তখনি দেখতে পায় তার বুক পকেটে একটা ক্ষুদ্র সাদা রঙের অচেনা ফুল। এটা এতক্ষণ সে খেয়াল করেনি। আলো ফুলটার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। যেন জানতে চাইছে,”তুমি আমার স্বামীর বুকে কি করছো!”

সামিন আলোকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে নিজেও পাশে বসে। দৃষ্টি আলোর দিকে রেখে বুক পকেট থেকে ফুলটা বের করে আলোর খোঁপায় গুঁজে দিতে দিতে আলোর কানের কাছে মুখ নিয়ে ঘোর লাগা কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
“সাদা ফুলের ভাগ্য ভালো,
আমার আছিয়ার খোঁপা পেলো।”

আলো চুপচাপ বসে থাকে। দীর্ঘসময় মুগ্ধতা নিয়ে সামিন তার স্ত্রীকে দেখতে থাকে। তারপর উঠে দাঁড়ায়, নিচু স্বরে বলে,”ধন্যবাদ স্বরূপ চু*মু টা দিতে দিলে না, ধন্যবাদ স্বরূপ এক কাপ কফি বানিয়ে খাওয়াতে চাই, খাবে?”

আলো নিশ্চুপ, সামিন বলে,”একটা গোটা রাত নির্ঘুম, বেশ মাথা ধরেছে আমার। সাথে আমিও খাবো।”

আলো উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে,”আমি বানিয়ে দিচ্ছি….!”

_চুপচাপ বসে থাকো!
আলোকে থামিয়ে দেয় সামিন। আলো বসে পরে। ইলেকট্রিক কেটলিতে পানি গরম করতে দিয়ে সামিন ফোনটাকে চার্জে বসিয়ে দেয়।

কফি বানাতে বানাতে আলোকে বলে,”কয় চামচ চিনি?”

_এক চামচ।
অস্ফুট স্বরে বলে আলো।

কফির মগটা আলোর সামনে ধরে। আলো মগটা নিয়ে নেয়। সামিন আলোর পাশে বসে পরে।

দু’জনের মধ্যে দীর্ঘসময় পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে। হঠাৎ সামিন নিজের হাতের মগটার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”সামিন ইয়াসার মির্জা তার বৌয়ের জন্য কফি বানিয়েছে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার!”

আলো মুচকি হাসে। তারপর অস্ফুট স্বরে বলে,”এই একমগ কফির জন্য আজকে আমাকে ছয় ঘণ্টা টেনশনে রাখার অপরাধ ক্ষ*মা করা হলো।”

সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে চুমুক দেয় কফির মগে। তারপর বলে,”ঐ হাসিটার জন্য তোমার আজকের লকেট হারানোর অপরাধ ক্ষ*মা করা হলো।”

আলো কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে কফির মগে চুমুক দিয়ে বলে,”মনে করে ফোনে চার্জ না দেওয়ার অপরাধও ক্ষমা করা হলো।”

সামিনও কফিতে চুমুক দিয়ে বলে,”ঠিকাছে, তবে শুরু থেকেই শুরু হোক…….আমাকে ভুল বুঝে জনসভায় চ’ড় মারার অপরাধ ক্ষ*মা করা হলো।”

আলো হেসে ফেলে, তারপর মগে চুমুক দিয়ে বলে,”আমার ভোলা ভালা ভাই দুটোকে ফাঁ*সিয়ে আমাকে দিয়ে পা ধরানোর অ’প’রা’ধ ক্ষ*মা করা হলো।”

সামিন ম্লান হাসে,কফিতে চুমুক দিয়ে বলে,”সবখানে, সবার সামনে আমাকে উল্টো পাল্টা কথা শোনানোর অ’প’রা’ধ ক্ষ*মা করা হলো।”

আলো মগে চুমুক দেয়, কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”ভয় দেখিয়ে আমাকে জোরপূর্বক বিয়ে……..”

থেমে যায় আলো। সামিন আলোর দিকে তাকায়। হাতের কফির মগটা পাশে রেখে আলোর হাত থেকেও কফির মগটা সরিয়ে রাখে। তারপর আলোর হাত দুটো মুঠি করে ধরে নিজের হাতে, চোখ রাখে আলোর চোখে, নরম গলায় বলে,”করতে হবে না ক্ষমা, তুমি বরং….”

_করা হলো, ক্ষ*মা করা হলো!
মৃদু স্বরে বলে ওঠে আলো ।

সামিন তাকিয়ে থাকে তার স্ত্রীর দিকে,আলো বলতে থাকে,” যথেষ্ট শা*স্তি আপনাকে দিয়েছি। ঐ অপরাধটাও ক্ষ*মা করা হলো।”

সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আলোর হাতে চু*মু খায়। আলো নরম গলায় বলে,”সম্ভবত আমার জন্যই আপনার বাবার মৃ*ত্যু হয়েছে। আমিই পরোক্ষভাবে দায়ী। আপনি আমাকে ক্ষ*মা করতে পেরেছেন কি?”

কথাটা বলে আলো শেষ করতে পারে না, সামিন আলোকে টেনে নিজের বুকে নেয়। আলো চুপটি করে থাকে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সামিন বলে,”সব খারাপ স্মৃতি আমি এই কফির সাথে গিলে নিয়েছি। আর কিছু বাকি নেই, কিছুই নেই।”

_আমিও গিলে নিয়েছি।
ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে আলো।

কথাটি বলে ধীরে ধীরে মাথা তুলে আলো সামিনের চোখে চোখ রাখে। সামিন আলোর গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,”ভালোবাসি, আমি আমার স্ত্রীকে ভালোবাসি। আমার কাছে স্ত্রী কেবল বিছানার সৌন্দর্য নয় আলো, তুমি আমার জীবনের সৌন্দর্য। তোমার অনুপস্থিতিতে আমি কুৎসিত। তুমি আমার আলো।”

অনূভুতিকে দমিয়ে রাখতে না পেরে অবশেষে সামিন ইয়াসার অনুমতির অপেক্ষা না করেই তার স্ত্রীর নাকের ডগায় চু*মু খেয়ে বসে। আচমকা পরম স্পর্শ‌ পেয়ে আলো লাজুক মুখটা নামিয়ে রেখে বসে থাকে চুপচাপ।

অন্ধকার কে*টে যেতে শুরু করেছে। আলো কিছু সময় পরে সামিনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আশেপাশে তাকায়। তারপর উঠে গিয়ে ওযু করে, ফজরের নামাজ আদায় করে নেয়। সামিন বসে বসে আলোকে দেখতে থাকে। তারপর উঠে গিয়ে বিছানায় বালিশ টা ঠিক করে রাখে।

মোনাজাত শেষ করে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে সামিনকে দেখে আলো। ওয়াশ রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হয়েছে, তার গায়ে একটা কালো রঙের পাঞ্জাবি। লোকটাকে পাঞ্জাবিতেই বেশ মানায়। তোয়ালে খুঁজে না পেয়ে সামিন আলোর মাথা থেকে ঘোমটা নামিয়ে আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে শুরু করে। আলো লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে। সামিন বলে ওঠে,”তুমি কি জানো, লজ্জা পেলে তোমাকে তিনগুণ বেশি সুন্দর লাগে।”

_না, জানিনা।
নিচু স্বরে বলে আলো।

সামিন আলোর আঁচল তার ডান কাঁধে টেনে দিয়ে তার হাত ধরে টেনে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়, গায়ে চাদর টেনে দিয়ে নিচু স্বরে বলে,”এখানে,এই সিঙ্গাপুরে যতখুশি আমাকে দিয়ে নিজের সেবা করিয়ে রাখো, বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে একেবারে স্বামীর বাধ্য বৌ হয়ে যেতে হবে। একচুলও ছাড় পাবে না তুমি আছিয়া।”

আলো তাকিয়ে থাকে সামিনের দিকে। সামিন নিজের বিছানায় শুয়ে গায়ে চাদর টেনে আলোর দিকে ফিরে শোয়। দু’জনে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। দু’টো আলাদা বিছানায় শুয়ে আছে, দু’টো বিছানার দূরত্ব এক কি দুইগজ, দুটো শরীরেরও দূরত্বও তেমন। কিন্তু দু’টো মনের? সেখানে যে আর কোনো দূরত্ব নেই। সামিন ইয়াসার মির্জা এক সমুদ্র ধৈর্য্য ব্যায় করে সেই দূরত্ব কা*টিয়ে উঠেছে অবশেষে! দুটি মন একে অপরকে আলিঙ্গন করে রেখেছে।

“কি দেখছো না ঘুমিয়ে?”
আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে সামিন প্রশ্ন করে। আলো মৃদু স্বরে বলে,”আপনাকে।”

_ঘুমিয়ে পরো। দু রাত ঠিকভাবে ঘুমোতে পারোনি। এখন পুরো সিঙ্গাপুর সিটি জেগে উঠবে। আর আমরা ঘুমাবো।

কথাটা বলেই সামিন হাই তোলার ভান করে। আলো আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দু’চোখ বন্ধ করে ফেলে। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তলিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে। সামিন দেখতে থাকে আলোকে, অপলক দৃষ্টিতে।

চলমান…….