#বসন্ত_এসেছে
#মাহিমা_রেহমান
#পর্ব_১০
প্রণয়ের অতল গহীনে ডুবে যেতে যেতে নিজের সংযত টেনে নিল রায়ায। ঘনঘন নিঃশ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করল। বেলার বয়স এখন অনেক অল্প তা ভুললে চলবে না। প্রিয়সীর বুঝে থাকা আঁখি দুটোর মাঝে নিজের ওষ্ঠের সিক্ত স্পর্শ দিয়ে নিজের বক্ষ পাঁজরে চেপে ধরে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল।
.
.
সকালে নাস্তা টেবিলের সকলে একত্রে নাস্তা করতে বসলো। হঠাৎ করে জহির রওশন রায়াযের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
-“কাল রাতে রুহানি ফোন করেছিল। টিয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে। দেখতে এসে হুট করে নাকি হয়ে গেছে সব।
ছেলে অস্ট্রেলিয়া থাকে। দেশে এসেছে,,আবার কিছুদিন পরই চলে যাবে। তাই দ্রুত বিয়েটা সেরে নিতে চায় তারা। তাই ছোটখাটো করে ঘরোয়া ভাবে আকদের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাড়ির সকলকে সেখানে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। সকলে আজকে রওনা হচ্ছি।
আশা করছি তুমিও সেখানে উপস্থিত থাকবে।”
খাবার খেতে খেতে রায়াযের উত্তর,
-“অফিসে অনেক কাজের প্রেসার। তাছাড়া সেখানে থেকে আমার কোন কাজ নেই। তার চেয়ে বরং তোমরাই যাও।”
ছেলের মুখের দিকে কয়েক পল তাকিয়ে থেকে জহির রওশন বললেন,
-“ঠিক আছে তোমার কাজ নিয়ে তাহলে তুমি থাকো। কিন্তু বেলা আমাদের সাথে যাবে।”
ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে রায়ায উত্তর করল,
-“বেলার সেখানে গিয়ে কি কাজ বলতো? তাছাড়া যেখানে আমি যাচ্ছি না, সেখানে ওর উপস্থিতি অনাকাঙ্ক্ষিত।”
জহির রওশন আর কিছু বলল না । ছেলে তার বড় হয়েছে। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে। তাই আর কথা বাড়ালেন না তিনি। তবে রায়াযের এমন প্রত্যুত্তর শুনে ঘনঘাটা মেঘেরা এসে হানা দিল বেলার চিত্তপটে। প্রায় যেন কেঁদেই দিবে সে। রাগ হয় তার ভীষণ। কান্না পায়। তবে মুখ ফেটে রায়াযের কথার প্রেক্ষিতে কিছু বলতে পারে না সে। তাই মুখে কুলুপ এঁটে বসে রয়। খাওয়া শেষে রায়ায বেলার উদ্দেশ্যে বলে,
-“যা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আয়। আমি গাড়িতে তোর জন্য অপেক্ষা করছি।”
গোমরা মুখ করে বেলা উত্তর দেয়,
-“আজকে যাব না।”
ভ্রু কুঁচকে সে জিজ্ঞেস করে,
-“সমস্যা কি? যাবি*না কেন?
মৃদু কন্ঠে বেলা প্রত্যুর করে
-“ইচ্ছা করছে না।”
খানিক বেলার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে রায়ায। মাথা নেড়ে বলে,
-“ঠিক আছে যাস না। কিন্তু কাল থেকে কোন প্রকার মিস করা যাবে না”
বেলা কিছু বলে না। বেলাকে নিজের কাছে টেনে নেয় রায়ায। আলতো করে কপালে চুম্বন এঁকে দিয়ে নিজের গন্তব্যে বেরিয়ে পড়ে সে।
একছুটে নিজের রুমে চলে যায় বেলা। কেঁদে কেটে একবারে অবস্থা খারাপ করে ফেলে নিজের। তার কিয়ারা আপুর বিয়েতে যাওয়ার খুব ইচ্ছে। কিন্তু রায়ায তাকে যেতে দিচ্ছে না কেন? তা ভেবে পায় না সে।
ব্যাকপ্যাক নিয়ে দুপুরের দিকে হাজির হয় অর্পিতা। বেলা কে খুঁজতে খুঁজতে তার রুমে গিয়ে স্থগিত হয় সে। দুহাতে বেলার মুখখানা আগলে ধরে বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
-“কীরে বেলা তোর চোখ মুখের এই অবস্থা কেন?
আর কেঁদেছিস কেন এভাবে? ভাই কিছু বলছে ?”
দুদিকে মাথা নাড়ে বেলা। যার অর্থ না। পরমুহূর্তের নিজ থেকেই সকালের সকল ঘটনা খুলে বলে অর্পিতাকে। রায়াযের উপর এবার চরম রাগ হয় অর্পিতার। ফোন লাগায় ভাইয়ের উদ্দেশ্যে। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হতেই ঝাঁঝালো কন্ঠে সে বলতে লাগে,
-“সমস্যা কী তোর ভাই ? তুই না গেলে না যাবি। তাই বলে তুই বেলাকে কেন আটকাবি?”
বরফের ন্যায় শীতল কন্ঠে রায়ায উত্তর করে,
-“কারণ সে আমার স্ত্রী। আর আমার স্ত্রীর সাথে আমি কী করবো না করবো,, তার কৈফিয়ত আমি কাউকে দিবোনা।”
এবার যেন আরো বেশি রেগে যায় অর্পিতা। রাগান্বিত কণ্ঠে রায়াযের উদ্দেশ্যে বলে,
-“ফালতু কথা বন্ধ কর ভাই। ও একটা বাচ্চা মেয়ে। তুই কি করে ওর সাথে এমন করতে পারিস? ভুলে যাস না তোর আর ওর বয়সের মধ্যে অনেক তফাৎ। তুই এখন যা বুঝিস,, ও তা ও তা বুঝে না। তোর আর ওর মন মানসিকতা এক নয়। কেঁদে কেটে মেয়েটা একেবারে অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে। চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। এতই যখন ভালবাসিস নিজের জেদকে প্রাধান্য না দিয়ে নিজের ভালোবাসাকে প্রাধান্য দে।”
ওপাশ থেকে রায়াযের গম্ভীর কণ্ঠ কর্নপাত হয়,
-“বাড়িতে এসে কথা বলছি।”
কথাটা শেষ করেই ফট করে ফোন কেটে দেয়। পুনরায় ফোন করে না অর্পিতা। ভাইয়ের উদ্দেশ্যে ছোট্ট একটা টেক্সট করে দেয়
.
.
বিরক্তিতে হাসফা*স অবস্থা রায়াযের। এত মানুষের ভিড় তার মোটেও সহ্য হচ্ছে না। তার উপর চৈত্রের ভ্যাপসা গরম। আশেপাশের চোখ বুলিয়ে সে বেলা কে খুঁজতে ব্যস্ত। কিয়ারাদের বাড়িতে আসার পর থেকে একবারও চোখে পরেনি মেয়েটিকে। এখানে এসে কেমন তার কথা বেমালুম ভুলেই গেছে সে! অর্পিতার টেক্সট পাওয়ার খানিক বাদ বাড়িতে ফিরে এসে যখন বেলার বিধ্বস্ত অবস্থা দেখেছিল রায়ায,, তখন আর নিজের জেদে অটল থাকতে পারেনি সে। বাধ্য হয়েই আসতে হয়েছে এখানে তাকে। লম্বা করে শ্বাস ত্যাগ করে সে। হাঁটতে হাঁটতে ছাদের দিকে চলে যায়। গিয়েই তার চোখ পড়ে কয়েক দল মেয়ের মাঝে বসে আছে বেলা। সকলে হাসি ঠাট্টায় মেতে। কিছুক্ষণ বাদেই কিয়ারার গায়ে হলুদ। ঘরোয়াভাবেই সবকিছু করা হয়েছে। বেলার দিকে এগিয়ে যাবে সে,,তার পূর্বেই মেয়েগুলো বেলাকে টেনে কোথাও একটা নিয়ে যায়। এবার বেশ রাগ হয় রায়াযের। অপেক্ষার প্রহর শেষই হচ্ছে না যেন তার। অবশেষে ঠিক সন্ধ্যার দিকে নিজের প্রিয়তাকে দেখে নিজের তৃষ্ণার্ত আখির তৃষ্ণা মেটাই সে। লাল টুকটুকে একটা জামদানি পড়ে আছে বেলা। সাজ বলতে কেবল কানে এক জোড়ার দুল। তারই পাশে খিল খিল করে হেসে চলছে কয়েকদল মেয়ে। শুরু হয় হলুদ দেওয়ার পালা। এক এক করে সকলে হলুদ লাগায় কিয়ারাকে। মেয়েগুলো তখন বেলা কে ছেড়ে কিছু দূর এগোতেই, সুযোগ বুঝে ফট করে বেলাকে হিরহির টানতে টানতে রুমের ভিতর নিয়ে আসে রায়ায। চেপে ধরে তাকে দেয়ালের সহিত। চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগে,
-“সারাদিন কোথায় ছিলি হ্যাঁ? এখানে এসে বেশ ডানা গজিয়েছে তোর তাই না? আমার কথা তো বেমালুম ভুলেই গেছিস !”
কম্পনরত ওষ্ঠ নেড়ে বেলা জবাব দেয়,
-“আসলে তেমন কিছুই না। ওই আপু গুলোই আমাকে আসতে দিচ্ছো না, সত্যি বলছি।”
কিছুটা রাগ দমে এলো বুঝি এবার রায়াযের। আলতো করে নিজের বুকের মাঝে চেপে ধরে বেলাকে। ভালোবাসার আবেশে মুড়িয়ে নেয় দুজন দুজনকে। আকস্মাৎ দরজায় করাঘাত পড়তেই রায়াযকে ছেড়ে বেশ খানিক দূরে দাঁড়ায় বেলা। বিরক্তিকর মুখ নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায় রায়ায। দরজা খুলতেই হুরহুর করে ভিতরে প্রবেশ করে সেই মেয়েগুলো। খিলখিল হাসতে হাসতে রায়াযের উদ্দেশ্যে বলে,
-“কি রায়ায ভাই? এতটুকুতেই তড় সইল না? যেই সুযোগ পেলে অমনি বউকে নিয়ে চলে এলে ঘরের ভেতর! তবে তোমার মনস্কামনাকে এক বালতি পানি ঢেলে এখন আমরা বেলাকে নিয়ে যাচ্ছি। যা করার পরে করো।”
আবারো পরলো হাসির রোল। অস্বস্থিতে পরে গেল বেলা। মেয়েগুলোর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে ধমকে উঠল রায়ায,
-” চুপচাপ এখান থেকে বের হ এখন।”
ভেংচি কেটে একটি মেয়ে বলে উঠলো,
-“বের তো হবো,,কিন্তু তোমার বউকে নিয়ে।”
বলেই বেলাকে টানতে টানতে নিজেদের সাথে নিয়ে গেল
মেয়েগুলো।”সেদিকে তাকিয়ে কপালে ভাঁজ ফেলল রায়ায। আজকে তার বউ আর তার নেই,,,তা বেশ টের পাচ্ছে সে।
ছাদের একপাশে চলছে হলুদের অনুষ্ঠান। তারই অপর পাশে চিলেকোঠার ঘরটিতে বেলাকে নিয়ে এলো মেয়েগুলো।একপ্রকার চেপে ধরলো তাকে।একটা মেয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“কীরে বেলা! সত্যি সত্যি তোর রায়ায ভাইয়ার সাথে বিয়ে হয়েছে?”
অবাক চোখে তাকিয়ে বেলা মৃদু মাথা নাড়ল।আরেকজন বলল,
-” কিন্তু এটা কী করে সম্ভব? তোর আর রায়ায ভাইয়ার মধ্যে তো বয়সের অনেক তফাৎ! তাহলে কী করে কী?”
চুপ করে রইল বেলা।কিছু বলল না।আগের মেয়েটি এবার গোমড়া মুখ করে বলল,
-“কত স্বপ্ন ছিল আমার জানিস,,আমি রায়ায ভাইয়ার বউ হব। তার সাথে সুখের সংসার করব।কত পছন্দ করতাম তাকে আমি,,মাঝখান দিয়ে তুই এসে ট্রফিটা মেরে দিলি।”
অসস্তিতে পড়ে গেল বেলা।কী বলবে এখন সে।পাশের মেয়েটি ওপর মেয়েটিকে খোঁচা মেরে বলল,
-“চুপ কর তো তুই। তোর এই ছ্যাকার গল্প আর শুনতে ইচ্ছা করে না।আচ্ছা বেলা তোদের মধ্যে সব ঠিকঠাক তো? আই মিন হয়েছে তো?”
বলেই বেলাকে কনুই দিয়ে গুতো মারল।ভ্রু কুঁচকে নিল বেলা।জিজ্ঞেস করল,
-“কী হবে? কিসের কথা বলছো?”
বিরক্তকর মুখভঙ্গি বানিয়ে মেয়েটি বলল,
-“কিসের কথা বলছি জানিস না বুঝি?”
বেলা দুদিকে মাথা নাড়ালো।মেয়েটি কপাল চাপড়ে বলল,
-“বাসর হয়নি তোদের ?”
.
.
.
চলবে কী…?