#বসন্ত_কন্যা
#পর্ব_১১
#লেখিকা : সাদিয়া
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
পিছন ফিরতেই আঁতকে উঠলো দুজনেই। এই লোক ওদের পিছনে এসে কখন দাঁড়ালো? ওর সব কথা কি শুনে নিয়েছে? আব তেরা কেয়া হোগ নিশা, তু তো গায়া? সব সময় কেন আমার সাথেই এমন হয় ভাবতে ভাবতে নিশা পা বাড়ালো এখান থেকে কেটে পড়ার উদ্দেশ্যে এখানে থেকে ও কিছুতেই ঐ আবসার নামক প্রানীর রোশানে পড়তে রাজি নয়। কিন্তু কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কি, দুই পা বাড়াতেই শাড়ির কুচির সাথে পা জড়িয়ে ধপাস করে মুখ থুবরে নিচে পড়ে গেল নিশা। লজ্জার উপরে লজ্জা, এই লোকের সামনেই কি ওকে সব সময় আছাড় খেতে হয়। নিশার বুক ফেটে এখন কান্না আসছে, কিন্তু কান্না করাও যাবে না। আবসার এগিয়ে গিয়ে নিশার হাত ধরে তুলে দাঁড়া করিয়ে একটু ফিসফিস করে বলল –
– তুমি যদি রাজি থাকো তাহলে বাসরটা এখনই করে ফেলতে পারি।
একটু সময়ের জন্য নিশার মাথাটা হ্যাং হয়ে গেল। কি বলল আবসার, ও কি ভুল শুনেছে? এত লাগাম ছাড়া কথা, তাও ওকে আবসার বলেছে না না ও নির্ঘাত ভুলই শুনেছে। আর আবসার বড্ড রসকষহীন মানুষ। তার পক্ষে এমন কথা বলা তো অসম্ভব। একটু পর আবসারের গম্ভীর কন্ঠে নিশার ধ্যান ভাঙলো। আবসার সকলকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর কন্ঠে বলল –
– রাত অনেক হয়েছে সকলে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আমি যেন এখানে আর একজনকেও না দেখি।
আবসারের কথামতো মুহুর্তেই সবাই হাওয়া। শুধু দাঁড়িয়ে আছে নিশা একা। নিশাকে যেতে না দেখে আবসার ভ্রু কুঁচকে বলল –
– এখন তোমাকে কি আমার কোলে করে দিয়ে আসতে হবে?
নিশা আশে পাশে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই সবাই চলে গেছে। মুখ ঘুরিয়ে একবার আবসারের দিকে তাকিয়ে একটা শুকনো ঢোক গিলে নিজেও দিল দৌড়। কাজল, রাকিব আর নিলয় আজ এখানেই থাকবে। রাত বেশি হয়ে যাওয়ায় ওরা আজ আর বাড়িতে যায়নি।
_____________________
দেখতে দেখতে কেটে গেল ১ টা সপ্তাহ। আয়ানের বউভাত শেষেই নিশা নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছে। রেবেকা বানু তো কিছুতেই নিশাকে আসতে দিবে না কিন্তু কোন অধিকারে তিনি নিশাকে আটকে রাখবে? হয়তো অধিকারের অভাবেই তিনি নিশাকে আটকে রাখতে পারেনি। আবসার সেও ছুটি শেষে চট্টগ্রামে ফিরে গেছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো যে আবসারের ভয়ে নিশা ওই বাড়ি থেকে বারবার চলে আসতে চেয়েছিল সেই আবসারের ধমকগুলোই খুব মিস করছে। এই কয়দিনে মানুষটার থেকে প্রতি ক্ষনে ক্ষনে ধমক শোনা যেন নিশার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। ফয়সালকে এখন আর নিশার মনে তেমন মনে পড়ে না। এত সহজে তো তাকে ভুলে যাওয়ার কথা ছিল না নিশার তবে কি সে শুধুই নিশার ভালোলাগা ছিল ভালোবাসা নয়, যেটা নিশা ভালোবাসা ভেবে ভুল করেছিল। নাকি ফয়সালের থেকে পাওয়া অপমানগুলো ফয়সালের প্রতি নিশার ভালোবাসার মধ্যে দেয়াল তৈরি করেছে।
( রাত ১ টা )
নিশা আনমনেই আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। আকাশটা আজ বেশ অন্ধকার কোথাও একটা তারা নেই। হয়তো আকাশের বুকে আমবস্যা চলছে। নাকি আকাশটাও মন খারাপ আজকে? হঠাৎ নিশার মোবাইলটা প্রবল ঝংকারের সাথে বেজে উঠলো। নিশা ভ্রু কুঁচকে মোবাইলটা হাতে নিল, অপরিচিত নাম্বার, এত রাতে আবার কে কল দিল? এসব ভাবতে ভাবতেই রিসিভ বাটনে ক্লিক করে কানের কাছে নিয়ে গেল মোবাইলটা।
– ঘুমাওনি বসন্ত কন্যা?
ওপাশ থেকে শান্ত অথচ গম্ভীর কন্ঠে যেন থমকে গেল নিশা। হ্যা আবসারের কন্ঠস্বর। কন্ঠস্বরটা চিনতে একটুও বেগ পেতে হলো না নিশার। কানের কাছ থেকে মোবাইলটা মুখের কাছে ধরে নাম্বারটা আবার একবার চেক করলো, লাস্টে ২৮, হরতাল এই নাম্বার থেকেই তো আবসার একদিন কল করেছিল নিশাকে। নাম্বারটা সেইভ করা হয়নি বলে প্রথমে চিনতে পারেনি। নিশা কাঁপা কাঁপা হাতে মোবাইলটা আবার নিজের কানের কাছে ধরলো। ওপাশ থেকে আবার ধ্বনিত হলো –
– কেমন আছো?
– জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপনি? ( কাঁপা কাঁপা কন্ঠে )
– এই দুই দিন ভালো ছিলাম না, এখন বেশ ভালো আছি। বুকের বাঁ পাশের যন্ত্রনাটা কিছুটা লাঘব হয়েছে।
নিশা অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল – আপনার বুকে যন্ত্রনা করে বুঝি? কিসের যন্ত্রনা ? ডাক্তার দেখিয়েছেন?
আবসারের ঠোঁটের কোনে সুক্ষ্ম এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল – আমার যন্ত্রনায় বুঝি তোমার ভিতরে অস্থিরতার সৃষ্টি করেছে বসন্ত কন্যা?
থতমত খেয়ে গেল নিশা? অস্থিরতা, হ্যা আবসারের জন্য ওর ভিতরে অস্থিরতা কাজ করছে। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? উত্তর নেই নিশার কাছে। আর আবসারই বা কি নামে ডাকলো ওকে, বসন্ত কন্যা? এই নামে ওকে কেন ডাকলো। আনমনেই নিশা আওরাতে লাগলো –
– বসন্ত কন্যা?
– তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছিল কোনো এক বসন্তে। হলদে শাড়িতে আবৃত করেছিলে নিজেকে, হাঁটু পর্যন্ত ঢেউ খেলানো চুল আমার বুকে ঝড় তুলেছিল । তাই তোমার জন্য বসন্ত কন্যা নামের থেকে আর উত্তম নাম খুঁজে পেলাম না।
হঠাৎই কেটে গেল কলটা। চট্টগ্রামে পাহাড়ে নেটওয়ার্ক শুন্যতায় আবসারের বুকেও যেন শুন্যতা সৃষ্টি করেছে। এতক্ষন অনেক কষ্টে এখানে ওখানে হেঁটে হেঁটে একটু নেটওয়ার্ক পেয়ে কল করেছিল নিশাকে। হতভম্ব হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে নিশা। কি বলল আবসার? সব যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আবসারের আজকের কন্ঠ, ভাষা সবকিছুই যেন নিশার বুকে ঝড় তুলেছে। ভিতরে ভিতরে অস্থির লাগছে খুব। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে, ঘুম আসছে না। আজ বুঝি আর ঘুম হবে না।
সারারাত না ঘুমিয়ে ভোরের দিকেই একটু ঘুমিয়েছিল নিশা। তাও বুঝি কারো সহ্য হলো না। নদী বেগম ( নিশার মা ) হাতে বেলন নিয়ে নিশাকে ঘুম থেকে তুলতে লাগলেন।
– মা আর একটু ঘুমাই না, কাল সারারাতে ঘুমাইনি একটুও।
– তা ঘুমাবি কেন? সারারাত ঐ শয়তানের বাক্সে ( মোবাইল ) মুখ গুজে থাকলে ঘুমাবি কেন? সকাল ৮ টা বেজে গেছে ওঠ।
-মা আর একটু। ( ঘুম জড়ানো কন্ঠে )
– উঠবি নাকি এই বেলনের বাড়ি তোর পিঠে মারবো?
– উঠছি বাবা, এই বাড়িতে একটু শান্তিতে ঘুমাতেও পারবো না বলে উঠে ওয়াশ রুমে ঢুকলো।
বোনের অসস্থা দেখে ঠোঁট টিপে হাসছে রিশা ( নিশার ছোট বোন ) অবশ্য এটা এ বাড়ির রোজগার রুটিন। রিশাকে হাসতে দেখেই তেতে উঠল নদী বেগম-
– কি হলো ওখানে বসে ভ্যাটকাচ্ছিস কেন? তোর না ৯ টায় কোচিং আছে যা রেডি হ।
মায়ের ঝাড়ি খেয়ে রিশাও দৌড় লাগালো।
________________________
নিশা কলেজে এসেছে। কলেজে আসতেই দেখা ওর বন্ধু মহলের সাথে। অবশ্য কলেজে এরা সব সময় এক সাথেই বসে, এক সাথেই থাকে।
– কি রে তোর হিটলার ভাই গেছে?
আয়নাকে উদ্দেশ্য করে রাকিব বললো কথাটা। আয়না বলল – একদম আমার ভাইকে হিটলার বলবি না। আর ভাইয়া বউ ভাতের পরের দিনই চলে গেছে।
– ইসসসস এই বার ভেবেছিলাম তোর ভাইকে কলিকাতা হারবালের ঔষধটা দিয়ে দেব তা আর হলো না, আফসোস।
তেতে উঠল আয়না। বলল – ঐটা তোর বেশি প্রয়োজন তুই খা।
নিশা বিরক্তি নিয়ে বলল – থামবি তোরা? সামনে পরীক্ষা সেই খেয়াল আছে?
নিজের তর্জনী আঙ্গুল নাকের ছিদ্রের মধ্যে চালাতে চালাতে – সেই খেয়াল রেখে কি করব, এমনিও ফেল মা ওমনিও ফেল মারবো এটা তো আগে থেকেই জানা।
কাজল নাক ছিটকে বলল – ইয়াক নিলয় তুই আঙ্গুল দিয়ে নাক পরিষ্কার করছিস ছিঃ
নিলয় ভাবলেশহীন ভাবে বলল – আমার আঙ্গুল দিয়ে আমি আমার নাক না যা খুশি পরিষ্কার করি তোর কি? তুই নাক ছিটকাচ্ছিস কেন? কিন্তু তোর আঙ্গুল গুলো সুন্দর অনায়াসেই আমার নাক পরিষ্কার করা যাবে আমার আঙ্গুল গুলো একটু মোটা মোটা কিনা, ধার দিবি একটু প্রমিস নাকটা পরিষ্কার করেই দিয়ে দেব।
কাজল আগের তুলনায় দ্বিগুণ নাক ছিটকে বলল : ইয়াক, তুই আমার থেকে দূরে যা। আমার ধারে কাছে আসবি না।
চলবে….
#বসন্ত_কন্যা
#পর্ব_১২
#লেখিকা : সাদিয়া
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
দেখতে দেখতে কেটে গেল বেশ কিছু দিন। আবারও বসন্ত এসে গেছে। এর মধ্যে মাঝে মাঝে আবসারের সাথে কথা হয়েছে নিশার। আবসারের শান্ত ব্যবহারে আবসারের প্রতি নিশার ভয়টা আগের থেকে একটু একটু করে ভাঙতে শুরু করেছে। সেদিন শপিং মলের পর ফয়সালের সাথে আর দেখা হয়নি। রোজ কলেজ, টিউশনি মিলিয়ে ভালোই যাচ্ছে দিনগুলো।
রুমের ভিতরে বসে শপিং ব্যাগ কেটে ফুল বানাচ্ছিল নিশা হঠাৎই কলিং বেল বেজে ওঠায় বেজায় বিরক্ত সে। তবুও বিরক্ত নিয়ে দরজা খুলেই দেখে একজন ডেলিভেরি ম্যান।
– নিশা বলে কেউ আছে?
– জ্বি আমিই নিশা।
– ম্যাম আপনার নামে একটা পার্সেল আছে।
– কিন্তু আমি তো কোনো অর্ডার করিনি। তাহলে আমার নামে কে অর্ডার করলো?
– তা তো জানি না ম্যাম তবে পার্সেলটা আপনার নামেই এসেছে।
নিশা মনের মধ্যে হাজার প্রশ্ন নিয়ে সব ফর্মালিটিজ পূরন করে পার্সেলটা নিয়ে ভিতরে চলে গেল। পার্সেলটা খুলতেই একটা হলদে শাড়ি বেড়িয়ে এলো। কলাপাতা রঙের পাড়ের হলদে শাড়ি। কাল পহেলা ফাল্গুন, দেখেই। বোঝা যাচ্ছে বসন্তের জন্যই কেউ শাড়িটা পাঠিয়েছে। শাড়ির সাথে একটা চিরকুটও রয়েছে। নিশা চিরকুটটা খুলেই অবাক।
বসন্ত কন্যা ,
তোমাকে দেখেছিলাম কোনো এক বসন্তে হলদে শাড়িতে। কালও আবার বসন্ত। আমি চাই তুমি আবার হলদে রঙে নিজেকে সাজিয়ে আমার সামনে আসো। এটাই আমার তরফ থেকে তোমাকে দেওয়া প্রথম উপহার, হলদে শাড়ি। শাড়ির সাথে আর কি কি লাগে সে সম্পর্কে ততটা জ্ঞান নেই আমার। সেলস গার্লটাকে বলেছিলাম ” আপনি তো মেয়ে , শাড়ির সাথে আর যা যা লাগে সেটাই আমার বসন্ত কন্যার জন্য প্যাক করে দিন। তারপরই শুরু হয়ে গেল মেয়েটার উদ্ভট যত কথা। মেয়েটা আমার কাছে কি সব মাপ টাপ জানতে চাইছিলো , আমি বেশ লজ্জা আর অসস্থিতে পড়ে গিয়েছিলাম তাই আর সেগুলো কিনতে পারিনি। তুমি একটু কষ্ট করে ওগুলো ম্যানেজ করে নিও। আর কাল প্লিজ এই শাড়িটা পড়ে এসো। আমি অপেক্ষা করবো, আর অবশ্যই তোমার হাঁটু পর্যন্ত ঢেউ খেলানো চুলগুলো খোলা রাখবে। আমি জীবনে কখনও কাউকে অনুরোধ করিনি এই প্রথম তোমাকে করলাম, প্লিজ কাল তুমি আমার দেওয়া শাড়িটাই পড়ে এসো।
চিরকুটটা পড়ে হতবম্ব হয়ে বসে আছে নিশা। বসন্ত কন্যা নামটা দেখে আর কোনো সন্দেহ নেই যে এই পার্সেলটা আবসার পাঠিয়েছে। কিন্তু সে কেন নিশার জন্য উপহার পাঠাবে তাও হলদে শাড়ি, ভেবে পাচ্ছে না নিশা। লজ্জাও লাগছে খুব, কিন্তু লজ্জার থেকে অবাক বেশি। আর কি বলল কাল অপেক্ষা করবে? তবে কি সে বাড়িতে এসেছে? সেদিন আর কল করলো না আবসার। অনেক রাত পর্যন্ত বসে ছিল নিশা , আবসারের কলের অপেক্ষায়। নিজেও ভয়ে আবসারকে কল করতে পারেনি। কল দিলে যদি আবার রেগে যায়, ধমক দেয়।
_______________________
পরেরদিন সকাল সকাল উঠে রেডি হয়ে বাইরে বের হলো নিশা। উত্তেজনায় তার সারা শরীর কাঁপছে। মনের মধ্যে কেমন একটা বিশ্বাস জন্মেছে আজ আবসার আসবে। ইস কতদিন পর মানুষটাকে একটু দেখতে পাবে ভাবতেই হৃদয় প্রফুল্ল হয়ে উঠছে। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? আবসার কি নিশার জীবনে বিশেষ কেউ? কিন্তু আবসারকে তো নিশা ভয় পায়, ভীষণ ভয় পায়। নিজের কাছে করা প্রশ্নের কোনো উত্তরই খুঁজে পায় না নিশা। অতঃপর একটা জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করে গাড়ি নিল নিশা। আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বরে দেখা করবে নিশা আর ওর বন্ধুমহল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে পৌঁছাতে দূর থেকে দেখেই নিশার কাছে দৌড়ে এলো নিশার বন্ধু মহল।
– কি রে হলদে শাড়িতে আজ তো তোকে পুরাই হলদে পরী লাগে রে।
কাজলের কথা শেষেই আয়না বলল – ওকে একটা কালা টিকা লাগিয়ে দেওয়া দরকার যাতে কারো নজর না লাগে।
নিলয় বলল – চিন্তা নেই তোদের মতো পেত্মীনের উপর কারো নজর লাগবে না।
কাজল রেগে বলল – কি বললি তুই? আমরা পেত্মী?
রাকিব বলল – ও তো ভালো বলেছে পেত্মী , আমার কাছে তো মনে হয় ঠাকুমার ঝুলির সেই শেওড়া গাছের পেত্মীটার মতো।
ওরা যে যাই বলুক নিশার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। তার চোখ দুটো খুঁজছে আবসারকে। তবে সে কি আজ আসেনি? কিন্তু সে তো বলল অপেক্ষা করবে। চারদিকে চোখ বুলাতে বুলাতে চোখ পড়লো একটু দূরেই একটা গাছের নিচে আবসার দাঁড়িয়ে আছে, ওর দিকেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আবসারকে দেখে নিশার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠেল এক চিলতে তৃপ্তির হাসি। এদিকে নিশা যখন প্রথম এসেই রিকশা থেকে নেমেছিল তখনই নিশার ওপর চোখ আটকে গিয়েছিল আবসারের। কতদিন পর তার বসন্ত কন্যাকে দেখেছে , তাও সেই প্রথমদিনের মতোই হলদে শাড়ি আর খোলা চুলে। মুহুর্তেই যেন আবসার থমকে গিয়েছিল, ভেসে গিয়েছিল মুগ্ধতার সাগরে। পা দুটো ওখানেই আটকে গিয়েছিল। তাই আয়নাদের সাথে নিশার সামনে আসেনি। আবসার আজ আয়নার সাথেই এসেছে। আয়নার মোটেই ইচ্ছা ছিল না আবসারকে নিয়ে আসার, সে আসলে একটুও মজা করতে পারবে না বন্ধুদের সাথে। কিন্তু আবসারের সেই গগন কাঁপানো ধমকের ভয়েও কিছু বলতে পারেনি। অগত্যা আবসারকে নিয়ে আসতে হয়েছে।
এবার অবশ্য আবসার একা আসেনি , সাথে আবসারের এক বন্ধু কেও নিয়ে এসেছে। তার নাম শাহরিয়ার মাহমুদ। আবসারের সাথেই নাকি আর্মিতে আছে তবে আবসারের চেয়ে একটু নিচু পোস্টে। ছেলেটা ভদ্র , সুশীল , মার্জিত। এক দেখাতেই কাজল আবার এই ছেলের উপরও ক্রাশ খেয়ে বসেছে।
নিশা আর ওর বন্ধুরা এখানে সেখানে ঘুরছে। আজ পুরো ঢাকা মেতে উঠেছে বসন্ত উৎসবে। আবসারও ওদের সাথে সাথেই ঘুরছে তবে তার চোখ শুধু একজনের উপরই। নিশার কম যায় না, সেও আড় চোখে আবসারকে দেখে চলেছে। আবসার আজ গায়ে একটা কলাপাতা রঙের পাঞ্জাবি জড়িয়েছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে নিশার সাথে মিলিয়ে পাঞ্জাবিটা পড়েছে। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় আজ আবসার কাউকে ধমক দিচ্ছে না, একদম শান্ত হয়ে ওদের সাথে ঘুরছে। আবসারকে দেখে আজ এটাও মনে হচ্ছে না সে ওদের থেকে বেশ বড়। ওদের মতো অতিরিক্ত কথা ,ঝগড়া না বললেও ওদের কথায় কথায় হু হা করছে। আয়নার তো মাঝে মাঝে সন্দেহ হচ্ছে ” ওর ভাইকে ভুত প্রেতে ধরেছে নাকি? ” বারবার নিশার দিকে তাকিয়ে দেখছে সে ওর ভাইয়ের দিকেই আড় চোখে দেখছে। তবে কি তাদের প্রেম হয়েছে বা হবে? আয়নার ঠোঁট প্রসস্ত করে হাসি ফুটে উঠল।
একটা ফুলের দোকানে ফুল আর মাথার ক্রাউন কিনছিল নিশা আর তার বন্ধু মহল, পাশেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল আবসার আর শাহরিয়ার। দোকানটির পাশ থেকেই বন্ধুদের সাথে হেঁটে যাচ্ছিল ফয়সাল। হঠাৎ তার চোখ দুটো আটকে গেল কোনো এক হলদে শাড়ি পরিহিত রমনীর দিকে। সে মাথায় একটা ফুলের ক্রাউন দিয়ে খিলখিল করে হাসছিল। এক ফালি রোদের আলো এসে তার শ্যামলা মুখখানায় যেন সৌন্দর্যের অন্য মাত্রা যোগ করেছে। ফয়সাল এক দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। হ্যা ফয়সাল নিশার দিকেই তাকিয়ে আছে। এভাবে নিশাকে আগে কখনও দেখা হয়নি তার, এই প্রথম ওকে শাড়ি পরিহিত অবস্থায় দেখছে ফয়সাল। শাড়ি পড়লে নিশাকে যে এতটা অপূর্ব লাগে জানা ছিল না তার। লাফিয়ে লাফিয়ে যেন ফয়সালের হার্টবিট বেড়ে চলেছে। সে এগিয়ে গেল নিশার দিকে।
– নিশা…..
চেনা পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে পাশ ফিরে তাকালো নিশা। ফয়সালকে দেখেই মুখের হাসি উবে গিয়ে সেখানে জায়গা করে নিল মলিনতা, দৃষ্টি এড়ায়নি আবসারের। ফয়সালকে দেখলেই যে নিশার সব অপমানের কথাগুলো মনে পড়ে যায়, বিশেষ করে ওর মাকে নিয়ে বলা কটু কথাগুলো। পৃথিবীর কোনো সন্তানই তার মায়ের অপমান সহ্য করতে পারে না। নিশা ছোট করে জবাব দিলো –
– হুম, কেমন আছেন?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো, তুই কেমন আছিস? অনেক দিন পর দেখা।
– জ্বি, বাড়ির সবাই কেমন আছে?
– আছে ভালোই।
– হলদে শাড়িতে তো তোকে চমৎকার লাগছে।
– ধন্যবাদ।
তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে নিশা আর ফয়সালের দিকে তাকিয়ে আছে দুই ভাই বোন আয়না আর আবসার। আয়না সে যেন আবসারের থেকেও বেশি জেলাস। মনের মধ্যে তার যেন ক্রোধের অগ্নিশীখা জ্বলছে। তার ভাইয়ের প্রেম হলো না তার আগেই শত্রুরা হানা দিচ্ছে। নিশাকে চমৎকার লাগছে কিনা তা এই উগান্ডার প্রানীর কাছে কে জানতে চেয়েছে , আউগারি পটকামি।
( অতিরিক্ত চালাকিকে বরিশালের ভাষায় বলা আউগারি পটকামি )
মনের মধ্যে ক্রোধের দাবানল নিয়েই নিশাকে জিজ্ঞাসা করল – কে রে ছেলেটা?
নিশা স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিল : ভাই।
ভাই পরিচয়টা যেন পছন্দ হলো না ফয়সালের, সোজা গিয়ে ওর বুকে বিধলো। ও তো আর নিশার মায়ের পেটের ভাই না। ফয়সাল ফট করে উত্তর দিল : আপন ভাই না, মামাতো ভাই।
চলবে….