বসন্ত কন্যা পর্ব-২৭+২৮

0
424

#বসন্ত_কন্যা
#পর্ব_২৭
#লেখিকা : সাদিয়া

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

দেখতে দেখতে কেটে গেল কয়েকটি দিন। আজ নিশা, আবসার, আয়না, ইয়াসিন, কাজল , শাহরিয়ার গায়ে হলুদ। এই কয়দিন বিয়ের কাজে কর্মের ধকলে দেখা মেলেনি নিশা আর আবসারের, যখনই দেখা হয়েছে তখনই ব্যস্ত তারা। একে অপরের সাথে সময় কাটানোর মতো ফুসরত মিলেনি। তবে রোজ সকালে আবসারের রুমে কফি নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পড়েছিল নিশার। সে নিয়ম করে রোজই আবসারের রুমে কফি নিয়ে যেত আর আবসার রোজই এই ফাঁকে নিশার সাথে দুষ্টুমি শুরু করে দিতো।

এক সাথেই স্টেজ সাজানো হয়েছে। নিশা সেজেগুজে বসে আছে, আর পাশেই বিরস মুখে বসে আছি আবসার । হলুদে যেন তার এলার্জি আছে। একটু পরপর একেকজন এসে হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছে আবার মিষ্টি খাইয়ে যাচ্ছে , কি বিরক্তিকর পরিস্থিতি। নিজেকে যেন এখন একটা হলুদের কারখানা মনে হচ্ছে আবসারের। নিশাও বেশ ক্লান্ত কিন্তু মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখেছে। করার কিছু নেই, আবসার একটু পর পর নিশার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। মেয়েটার মুখটা ভীষণ শুকনো লাগছে। আয়না উঠে চলে গেছে, সে এবাড়ির মেয়ে মুখের উপর একটা কথা বলতে পারে কিন্তু নিশা , সে তো এ বাড়ির বউ, নতুন বউ , ওর যে ভীষণ অসস্থি হচ্ছে ক্লান্ত লাগছে সেটাও বলতে পারছে না লজ্জায়। কে আবার কি মনে করেন? পরে বদনাম রটে যাবে বউ বাড়িতে আসার আগেই অধিক চালাকি শুরু করে দিয়েছে। কাজলও বাসায় চলে গেছে। কাজল আবার একটু উড়নচন্ডী টাইপের মুখে কোনো কথায় আটকায় না, ক্লান্ত লেগেছে উঠে হাঁটা শুরু করে দিয়েছে। আর নিশা এখনও ভ্যাবলার মতো বসে আছে। আর ও বসে আছে বলে আবসারও বসে আছে না হয় এই অনুষ্ঠানে আবসারকে কেউ মেরেও বসিয়ে রাখতে পারতো না। মনে মনে খুব বিরক্ত আবসার। নাহ এভাবে আর বসে থাকা যায় না। এই মেয়ে তো উঠার নাম গন্ধই নিচ্ছে না। আবসার উঠে দাঁড়ালো। নিশাকে মৃদু স্বরে ধমকে বলল – ওঠো

নিশা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে আবসারের দিকে তাকালো। আবসার আবার ধমক দিয়ে বলল – কি বলছি শোনোনি? ওঠো তাড়াতাড়ি আর আমার সাথে এসো বলে গটগট করে হাঁটা ধরলো।

নিশাও উঠে দাঁড়ালো, মুখ ভর্তি হলুদ। আবসারের পিছু পিছু পা চালালো। আবসারের আদেশ অমান্য করার মতো বুকের পাটা ওর এখনও হয়নি। যাওয়ার পথে দুই একজন মহিলা জিজ্ঞেস করেছে অবশ্য যে কোথায় যাচ্ছো, নিশা উত্তর দিয়েছে ওয়াশ রুমে যাচ্ছি।

আবসারের রুমের কাছে যেতেই নিশার হাত ধরে রুমের ভিতরে নিয়ে গেল আবসার। দরজাটা লক করে দিয়ে পকেট থেকে একটা রুমাল বের করলো। পানি দিয়ে হালকা ভিজিয়ে নিল রুমালটা। নিশার কাছে এসে নিশার গাল থেকে হলুদগুলো মুছে দিতে শুরু করলো।

অস্থির কন্ঠে নিশাকে শুধালো – অসহ্য লাগছে তোমার? ইসসসস গালে কত হলুদ দিয়েছে, যেন গালের উপর হলুদের আর একটা আবরন বানিয়ে দিয়েছে।

নিশা এক দৃষ্টিতে আবসারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মুহূর্তে ওর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ইসসসস ওর ভাগ্যটা বুঝি সত্যিই এত ভালো যে আবসারের মতো এমন একজন কেয়ারিং হাজবেন্ড পেয়েছে, যে ওকে এতটা ভালোবাসে।

আবসার আবার অস্থির কন্ঠে বলল – তোমার কি ক্ষুধা পেয়েছে? তোমার মুখটা এমন শুকনো লাগছে কেন?

নিশার ভ্রু কুঁচকে এলো। ক্ষুধা পেয়েছে মানে কি? উনার সামনেই যে এতক্ষন এত এত মিষ্টি গিললাম এর মধ্যে আবার ক্ষুধা পাবে কিভাবে? ও কি রাক্ষস নাকি?

আবসার নিশার গালে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করল – কি হলো কথা বলছো না কেন? এমন শুকনো লাগছে কেন তোমার মুখটা? শরীর খারাপ লাগছে?

নিশা একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল – এত উতলা হবেন না ক্যাপ্টেন সাহেব আমি একদম ঠিক আছি, আমার একটু ক্লান্ত লাগছে।

আবসার নিশাকে আদেশের সুরে বলল – এতক্ষন ওখানে এভাবে তোমাকে বসে থাকতে বলেছে কে? যাও এখনই ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।

– কিন্তু……

আবসার বুঝতে পারলো নিশার মনের কথা। নিশাকে ভরসা দিয়ে বলল –
– কোনো কিন্তু না। এদিকটা আমি সামলে নেব তুমি এখন গিয়ে বিশ্রাম করো।

__________________________

তিন বান্ধবীর বিয়ে আজ এক সাথে। তিনজনই হুবহু একই রকমভাবে সেজেছে। কাউকে কারো থেকে কম লাগছে না। কত স্বপ্ন ছিল তিন বান্ধবীর যে এক সাথে, একই রকম সেজে বিয়ে করবে। সেই স্বপ্ন যে এভাবে সত্যি হয়ে যাবে ভাবতে পারেনি কেউই। তিনজনই পাশাপাশি বসে আছে। ক্যামেরা ম্যানকে দিয়ে বিভিন্ন পোজে ছবি তুলছে। এদের তিনজনের জন্য স্টেজে যেন আর কেউ জায়গাই পাচ্ছে না। আবসার, ইয়াসিন আর শাহরিয়ার স্টেজের এক কোনে এতিমের মতো পড়ে আছে। এই তিন বান্ধবীকে দেখে মনে হচ্ছে এখানে বর ছাড়া বিয়ে হচ্ছে। বিয়ের দিনও যদি বউয়ের পাত্তা না পেয়ে ঘুরতে হয় এর চেয়ে নির্মম আর কি হতে পারে। আবসার তাও গম্ভীর মুখভঙ্গি নিয়ে বসে আছে, তাকে দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে সে বিয়ে করতে এসেছে নাকি যুদ্ধ, ইয়াসিন অসহায়ের মতো মুখ করে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে, আর শাহরিয়ার মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এখনই কেঁদে দিবে, এমনি সে যে পরিমাণ ছিঁচকাদুনে তার ভিতরে আবার বিয়ের দিনও বউয়ের পাত্তা পাচ্ছে না। প্রায় হাজারখানেক ছবি তুলল তিন বান্ধবী কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এই ছবিগুলর কোথাও তাদের বরের কোনো অস্তিত্ব নেই।

_________________________

বিয়ে শেষে এখন বিদায়ের পালা। তিন বান্ধবী গলাগলি বেঁধে কান্না করতে করতে প্রায় বেহুঁশ। অন্য কেউ সুযোগই পাচ্ছে না। আবিদা বেগম, নদী বেগম হতবম্ব হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছে, এরা যে হারে গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদছে মনে হচ্ছে কেউ মরে টরে গিয়েছে। তাদের মেয়ের বিদায়ে তারা একটু মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবে কিন্তু এখানে তাদের কান্নার কোনো সুযোগই নেই এরা তিন বান্ধবীকে শান্তনা দিতে ব্যস্ত।কান্নাকাটি করতে করতে তিনজনই নাকের জলে , চোখের জলে একসাথ করে সাজ নষ্ট করে ফেলেছে। এত কান্নাকাটির পরও এদের কান্না শেষ হয়নি, টানা টানি করেও এদের গাড়িতে ওঠানো সম্ভব হচ্ছে না। টেনে গাড়িতে উঠালে আবার নেমে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কান্না শুরু করে দেয়। আত্মীয় স্বজন যারা এসেছিল তারাও সবাই হতবম্ব। বোনের বিদায়ে কোথায় একটু মন খারাপ হবে আবসারের সেখানে সে এখন প্রচন্ড বিরক্ত হচ্ছে। আর উপায় না পেয়ে কোলে তুলে নিল নিশাকে, আর ইয়াসিন আর শাহরিয়ারকেও আদেশ দিল আয়না আর কাজলকে কোলে নিয়ে গাড়িতে বসতে। এ ছাড়া আর এদের কান্না থামানোর কোনো উপায় নেই।

আকর্ষিক ঘটনায় হকচকিয়ে গেল তিনজনই। তিনজনের কান্নাই থেমে গেছে। হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে যে যার বরের দিকে। এই সুযোগে তিনটাকেই গাড়িতে বসিয়ে গাড়ির দরজা লক করে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। নিশার যেন এখনো চমকানোর ঘোর কাটেনি, গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে আবসারের দিকে। আবসার একটু ঝুঁকে নিশার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল – এভাবে তাকিয়ে আছো কেন সবাই দেখছে।

সত্যিই তো, এতক্ষন খেয়ালই ছিল না। নিশা লজ্জা পেয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরালো। এতগুলো মানুষের মধ্যে এতক্ষন কিনা ও ভ্যাবলার মতো আবসার দিকে তাকিয়ে ছিল। গাড়িতে বসা আয়ান, মিষ্টি আর আবসারের দুজন কাজিন মিটিমিটি হাসছে। এদের হাসি যেন নিশার লজ্জা আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

_________________________

আবসারের বাসর ঘরের সামনে আয়ান আর ওর কাজিনরা দাঁড়িয়ে আছে , উদ্দেশ্য টাকা না দিলে আবসারকে বাসর ঘরে ঢুকতে দিবে না। ওদের সাথে রাকিব আর নিলয়ও আছে। যদিও এই সাহসটা করে উঠতে ওদের অনেকটা সময় লেগেছে, আবসার নামক এক ভয়ংকর প্রানীর বাসর ধরবে বলে কথা। তবুও অনেক সাহস সঞ্চয় করে আজ ওরা এখানে এসেছে , আবসার যদি ধমক দেয় দুটো ধমক খাবে তবুও এখান থেকে নড়চড় নেই। রাকিব তো মনস্থির করেই এসেছে আজ আবসারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ছাড়বে ,এই লোকটার জন্য ওরা আয়ানের বাসরের টাকা পায়নি ওরা। তাতে যদি আজ যুদ্ধ করতে হয় করবে তবুও টাকা নিয়েই ছাড়বে।
রাকিব সবাইকে উস্কে দিতে বলল –

” এবারের সংগ্রাম বাসরের টাকা আদায়ের সংগ্রাম।
এবারের সংগ্রাম আমাদের অধিকারের সংগ্রাম।
সাহস যখন করেছি সাহস আরও করবো,
তবুও বাসরের টাকা আদায় করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। ”

রাকিবের সাথে সবগুলো যেন আজ কোমড় বেঁধে নেমেছে। বাসরের টাকা হাতিয়ে ছাড়বেই ছাড়বে। কিন্তু আবসার সামনে আসতেই যেন সবগুলো চুপসে গেল, এখন আর কেউ কথা বলছে না। এমনকি রাকিবের মুখ থেকেও কথা বের হচ্ছে না। এই মানুষটা সামনে আসলেই ওর বুক ধরফর করা শুরু করে। রাকিব শুধু ভয়ে এলোমেলো দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।

আবসার ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল – কি হয়েছে?

আয়ান আমতা আমতা করে উত্তর দিল – ওরা আসলে…..

আবসার আয়ানকে মাঝ পথেই থামিয়ে দিয়ে বলল – টাকা চাই , না হলে আমাকে বাসর ঘরে ঢুকতে দিবে না? কত টাকা চাই?

এবার যেন রাকিব একটু সাহস পেল। মিনমিনিয়ে বলল- বিশ হাজার।

আবসার এক ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল – আয়ানের কাছে পঞ্চাশ হাজার চেয়েছিলে আমার কাছে এত কম কেন?

রাকিব আমতা আমতা করছে কিছু বলছে না। আবসার সবাইকে অবাক করে পুরো পঞ্চাশ হাজারই দিয়ে দিল, তাও ক্যাশ। সবাই হতবাক, নড়তে চড়তে যেন ভুলে গেছে‌। অতিরিক্ত শকডে যা হয় আর কি। ওরা তো আয়ানের বাসরে এত টাকা চেয়েছিল মজার ছলে, সবাই জানতো এত টাকা কোনোদিনই দিবে না। চাওয়ার সময় সবাই একটু বেশি চায় তারপর দর দাম করতে করতে কম দেয়। কিন্তু আবসারের কাছে কম চাইতেও আবসার এতগুলো টাকা দিয়ে দিলো সবার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। সবাইকে এভাবে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবসার বিরস কন্ঠে বলল – টাকা দেওয়ার পরও কি তোমরা আমাকে এখানে আটকে রাখার প্ল্যান করেছো? আরও চাই টাকা?

আয়ান একটা মেকি হাসি দিয়ে বলল – না না ভাই তুমি রুমে যাও। এই তোরা এখান থেকে ফোট এখন সব। আয়ানের কথা শেষ হতেই সবগুলো দ্রুত ওখান থেকে কেটে পড়লো।

_______________________

বাসরঘরে বসে আছে নিশা, মাথায় এক হাত ঘোমটা। রেবেকা বানু দিয়ে গেছে এই ঘোমটা আর বলে গিয়েছে আবসার এসে এই ঘোমটা উঠাবে তার আগে যেন এই ঘোমটা না উঠায়। সেই থেকে একইভাবে ঘোমটা দিয়ে বসে আছে নিশা। এখন রীতিমতো মাজা কোমড় ধরে গেছে তাও আবসারের আসার কোনো নাম গন্ধ নেই। নিশার হাজার বিরক্তির মধ্যে খট করে দরজা খুলে রুমে ঢুকলো কেউ। নিশার বুঝতে বাকি নেই লোকটা কে? বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে। অদ্ভূত একটা অনুভুতি হচ্ছে , কেমন লজ্জা, ভয়, ভালোলাগা, খারাপ লাগা, অস্থিরতার সংমিশ্রনে এই অনুভুতিটা। বিবাহিত বান্ধবীদের মুখে আগে শুনেছিল এই রাতে নাকি এমন অনুভূতি হয়। তারই সাক্ষী আজ ও নিজেই।

আবসার দরজাটা আটকে দিয়ে ধীর পায়ে নিশার পাশে এসে বসলো। আলতো হাতে নিশার ঘোমাটাটা তুলে বলল – ফ্রেশ হওনি এখনও? সারাদিন এই পোশাক পড়ে থেকেছো এখনও এটা পড়েই আছো, নিশ্চই এই ভারী পোশাকে তোমার অসস্তি লাগছে।

এই মানুষটা এত বোঝে কেন? সবসময় নিশার এত খেয়াল রাখে, বলার আগেই সব বুঝে যায় লোকটা। নিশা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আবসারের দিকে।আবসার শান্ত কন্ঠে বলল – যাও ফ্রেশ হয়ে এসো।

নিশা একটু অভিমানী কন্ঠে বলে উঠলো – আজ আমাকে কেমন লাগছে আপনি কিন্তু একবারও বললেন না।

চলবে….

#বসন্ত_কন্যা
#পর্ব_২৮
#লেখিকা : সাদিয়া

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

নিশা একটু অভিমানী কন্ঠে বলে উঠলো – আজ আমাকে কেমন লাগছে আপনি কিন্তু একবারও বললেন না।

আবসার হাসলো, নিশার মাথা থেকে আলাদা ওরনাটা খুলতে খুলতে বলল- আমার চোখে তুমি সর্বদাই সুন্দর নতুন করে আর বলার কিছু নেই। তবে এই ভারী মেকআপ আর সাজের নিচে যে তোমার নিজের সৌন্দর্যটা ঢাকা পড়ে গেছে তাই আমি তোমার সৌন্দর্যটা আজ খুঁজে পাইনি। আমার চোখে তোমার ঐ মেকাআপহীন ত্বকটাই যে বড্ড সুন্দর লাগে বউ।

অবাক হয়ে আবসারের কথা শুনছে নিশা। লোকটা কি সুন্দর করে কথা বলে। আচ্ছা লোকটা আর্মির ক্যাপ্টেন না হয়ে কবি হলে কেমন হতো? হয়তো ভালো হতো, তবে শুধু কবি না এই লোকটার মাঝে যেন সব গুন আছে তবে ঐ মাঝে মাঝে একটু ক্ষেপে যায় , নাকের ডগায় রাগ আর কি।

আবসার নিশার দিকে একটা টি – শার্ট, একটা প্লাজো আর একটা ওরনা এগিয়ে দিয়ে বলল – যাও ফ্রেশ হয়ে এসো।

নিশা অবাক চোখে আবসারের দিকে তাকালো। আবসার বুঝলো নিশার দৃষ্টির মানে। সে উত্তর দিল – আমি জানি তোমার এগুলো পড়েই ঘুমানোর অভ্যাস। শুধু শুধু আমাকে দেখাতে শাড়ি বা থ্রি পিস পড়তে হবে না। তুমি ঠিক যেগুলো পড়তে কমফোর্টেবল সেগুলোই পড়বে।

নিশা এখনও আবসারের দিকে তাকিয়ে আছে। এই লোকটাকে ও যতটা দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে। একটা মানুষ এত কেয়ারিং কিভাবে হয়। এত ভালোবাসা, সুখও ওর কপালে ছিল? না ও কোনো ভুল মানুষকে বিয়ে করেনি। এমন একটা মানুষের সাথে নির্দিধায় সারাটা জীবন কাটানো যাবে। নিশার চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে। এটা দুঃখের কান্না নয় এটা সুখের কান্না। এমন একটা মানুষকে নিজের করে পাওয়ার খুশির কান্না এটা। আবসারের সামনে আর দাঁড়ালো না নিশা। হাতের জামা কাপড়গুলো নিয়েই দ্রুত ওয়াশ রুমে চলে গেল। এখন ওর চোখে পানি দেখলে আবার আবসার হাজারটা প্রশ্ন করবে, দিশেহারা হয়ে পড়বে , এটা যে ওর আনন্দের কান্না সেটা তাকে বোঝাতে আবার কয়েকযুগ সময় খরচ করতে হবে।

ওয়াশ রুম থেকে বের হতেই দেখলো আবসার একটা প্লেটে ভাত আর মাংস নিয়ে বসে আছে। নিশাকে দেখেই আবসার ইশারায় ওকে বসতে বলল। নিজ হাতে ভাত মাখাতে মাখাতে বলল – আমি দেখেছি সারাদিন তোমার তেমন কিছুই খাওয়া হয়নি। তখন খেতে বসেও অসস্তিতে কিছুই মুখে দেওনি। নিশ্চই খুব ক্ষুধার্ত তুমি। এত রাতে বাসায় শুধু এইগুলোই পেয়েছি। কষ্ট করে একটু খেয়ে নেও প্লিজ। তুমি হা করো আমি খাইয়ে দিচ্ছি।

লোকটা এত দৌড় ঝাপের মধ্যে এটাও খেয়াল করেছে? নিশা আবসারের দিকে দৃষ্টি রেখেই হা করলো। আবসার নিজ হাতে নিশার মুখে ভাত পুরে দিল। এবার আর নিশা নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না । গাল চুইয়ে টপটপ পানি পড়ছে নিশার। নিশার চোখে পানি দেখেই আবসার অস্থির হয়ে উঠলো। ভাতের প্লেটটা পাশে রেখে বাঁহাত দিয়ে নিশার চোখের পানি মুছে দিয়ে অস্থির কন্ঠে শুধালো – কি হয়েছে তোমার ? কাঁদছো কেন? ঝাল লেগেছে? পানি খাবে?

নিশা আর নিজেকে সংযত করতে পারলো না। ঝাপিয়ে পড়ল আবসারের বুকে। নাক টেনে টেনে বলল – আপনি এত ভালো কেন? আমাকে এত ভালোবাসেন কেন?

আবসার হতবাক, এর জন্য কাঁদছিল মেয়েটা? আবসার আলতোভাবে নিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল – ভালোবাসা বুঝি অপরাধ?

– মোটেই না।

– তবে তুমি কাঁদছো কেন?

– এ যে আমার আনন্দের কান্না।

– পাগলী মেয়ে,ওঠো ভাতগুলো শেষ করো। পেটে তো মনে হয় অনেক ক্ষুধা পুষে রেখেছো।

– আপনি খেয়েছেন?

– আমাকে কি তোমার মতো মনে হয় যে পেটে ক্ষুধা পুষে রেখে দেব। আমি আগে ভাগেই খেয়ে দেয়ে রেডি হয়ে আছি বউকে আদর করতে হবে না।

লজ্জায় যেন মিইয়ে গেল নিশা। এভাবে বলে কেউ, অসভ্য লোক।

খাওয়া শেষে ওযু করে দুজনেই দু রাকাত নফল নামাজ আদায় করে নিল। নিশাকে বিছানায় বসিয়ে আলমারির কাছে গেল আবসার। হাতে একটা ছোট্ট বক্স নিয়ে নিশার পাশে বসলো। আলতো হাতে এ বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য দেওয়া বড় নাকফুলটা খুলে ছোট্ট একটা স্বর্নের নাকফুল পড়িয়ে দিল, দু হাতে সরু দুটো স্বর্নের চুড়ি, আর কানে দুটো ছোট ছোট স্বর্নের কানের দুল পড়িয়ে দিল। আবসারের প্রতিটি স্পর্শে নিশা যেন কেঁপে উঠছে। শ্যামবর্না শরীরে সোনালী রঙের ছোট ছোট গহনাগুলো যেন ফুটে উঠেছে। আবসার এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিশার দিকে। নিশার দুই গাল নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল – খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে। কখনও খুলবে না এগুলো, সব সময় পড়ে থাকবে।

নিশা মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিল। হঠাৎ চোখে পড়লো বিছানার উপরে গিফট পেপারে মোড়া একটা বক্সের উপর। ভ্রু উঁচিয়ে নিশাকে জিজ্ঞেস করলো – কি এটা?

– জানি না আমি, দাদি দিয়ে গেল আর বলে গেছে এটা নাকি তার তরফ থেকে আমাদের দুজনের জন্য উপহার। একমাত্র আপনার সামনেই যেন খুলি।

– তাহলে খুলে ফেল।

নিশা খুশি মনে গিফটটা হাতে নিল। এতক্ষন এই গিফটটা খোলার জন্য হাতটা বড্ড নিসপিস করছিল। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে রেখেছিল। গিফট বক্সটা খুলেই হতবম্ব আবসার নিশা দুজনেই। কেউ কারো দিকে তাকাতে পারছে না। বুড়ির বয়স কি দিন দিন বাড়ছে না কমছে। এসব কি ছিঃ ছিঃ। রেবেকা বানু এমন কিছু করবে কল্পনাতেও আসেনি নিশার। শেষ পর্যন্ত এই গুলো। রেবেকা বানুর গিফট বক্সটা খুলেই বক্স থেকে বেড়িয়ে এলো জন্ম*নিরো*ধক পি*ল, আর একটা লাল টুকটুকে পাতলা একটা নাইটি। ওটা পড়া আর কিছু না পড়া সমান মনে হয় নিশার কাছে।

নিশার এখন ইচ্ছে করছে লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে। আবসারও কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। আর রেবেকা বানু আজ ওর হাতে হাড়ি ভেঙ্গে দিল। ঐ বুড়িটার পেটে পেটে কিনা শেষ পর্ষন্ত এই ছিল। লজ্জায় আবসারের সামনে আর বসে থাকা যাচ্ছে না। উঠে দৌড়ে চলে গেল বারান্দায়। একটু পরই ঘাড়ে কারো উত্তপ্ত নিঃশ্বাস পড়তেই জমে গেল নিশা। শরীরের লোমকূপগুলো সব সজাগ হয়ে গিয়েছে। আলতো হাতে পিঠের উপরে ছড়ানো চুলগুলো সরিয়ে দিল আবসার। ঘোর লাগা কন্ঠে বলে উঠলো –

– দাদীও আমার মনের কথাগুলো বুঝে গেছে, তুমিই শুধু বুঝলে না।

নিশা কেঁপে উঠলো, বুকের মধ্যে দ্রিম দ্রিম আওয়াজ হচ্ছে। লজ্জায় গাল দুটো রক্তিম বর্ন ধারন করেছে। আবসার আবার মাতাল করা কন্ঠে বলে উঠলো – আজ যদি তোমাকে খুব গভীরভাবে ছুঁয়ে দেই তবে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে বসন্ত কন্যা? আমি যে আর পারছি না, অনেক তো অপেক্ষা হলো। আর কত অপেক্ষা করাবে আমাকে?

নিশা পিছন ঘুরেই আবসারের বুকে মুখ লুকালো। পা দুটো অবশ হয়ে আসছে, দাঁড়িয়ে থাকা দায় হয়ে পড়েছে। লজ্জায় মুখ তুলে তাকাতে পারছে না আবসারের দিকে। ও কি মেয়ে হয়ে এখন লজ্জা শরম ভুলে বলবে ” আমিও আর পারছি না, আপনাকে আমার নিজের করে চাই, ছুঁয়ে দিন আমাকে।” লোকটা এতকিছু বোঝে আর এইটুকু বোঝে না। আবসার তার উত্তর পেয়ে গেছে। কোলে তুলে নিল নিশাকে। বিছানায় শুইয়ে নিজেও নিশার উপর ভর করে শুয়ে পড়লো। নিশার ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে, ঘোর লেগে যাচ্ছে আবসারের। নিজের বৃদ্ধা আঙ্গুলি দিয়ে নিশার ঠোঁট দুটো আলতো করে ছুঁইয়ে দিল, কেঁপে উঠলো নিশা, পরম আবেশে চোখ দুটো বন্ধ করে নিল। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এসেছে দুজনেরই , দুজনের নিঃশ্বাসই আঁচড়ে পড়ছে একে অপরের মুখে। নিজেকে আর সংযত করতে পারছে না আবসার। ঠোঁট ছোয়ালো নিশার ঠোঁটে। নিশা দুহাতে খামচে ধরলো বিছানার চাদর। আবসার আবার ঠোঁট ছোয়ালো নিশার ঠোঁটে তবে এবার বেশ গভীরভাবে। নিশার ঠোঁট দুটো থেকে যেন মধু শুষে নিচ্ছে আবসার। নিশা পরম আবেশে আবসারের পিঠ খামচে ধরলো। নিজেও সাড়া দিতে শুরু করলো নিশা। ধীরে ধীরে আবসারের ছোঁয়াগুলো আরও বেশামাল হতে শুরু করেছে, গভীর থেকে গভীরে ছুঁয়ে দিচ্ছে, উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে নিশা। দুজনের ভারী নিঃশ্বাসের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দেয়ালে। একে অপরের মধ্যে স্বর্গ সুখ খুঁজে চলেছে দুজনেই। পূর্নতা দিয়েছে নিজেদের ভালোবাসার।

___________________________

কলেজের প্রথম দিনই কলেজে পৌঁছাতে দেরি হয়ে গিয়েছিল আয়নার। সেদিন প্রথম ক্লাসটাই ছিল ইয়াসিনের। আয়না তড়িঘরি করে ক্লাসে ঢুকতে গেলে তাকে থামিয়ে দেয় গম্ভীর, কর্কশ এক পুরুষালী এক কন্ঠস্বর, বলেছিল –

– ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবেন। প্রথম দিন ক্লাসেই দেরী বেশ ভালো ছাত্রী তো আপনি। আপনার আর আজ ক্লাস করতে হবে না ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকুন।

আয়না হতবম্ব হয়ে ক্লাসের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম দিন ক্লাসেই এসেই কিনা এভাবে অপমানিত হতে হলো। প্রথম দিন ক্লাসে তো স্যাররা দয়া করেও মাফ করে আর ইনি কিনা এই প্রথম দিনও ছাড় দিলেন না। ক্লাসের সবাই কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ভীষণ অসস্থি হচ্ছিল ওর।

এরপর বেশ কিছুদিন ভালোভাবেই কেটেছিল কিন্তু একটু অল্প কারনেই প্রায়ই ইয়াসিনের ধমকের মুখোমুখি হতে হতো আয়নাকে যেটা অন্যকারো বেলায় খুঁজে পায়নি ও। সে কারনেই আয়না সব সময়ই চেষ্টা করতো ইয়াসিনকে এড়িয়ে চলার কিন্তু যতই ইয়াসিনকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতো ততই ইয়াসিনের কাছাকাছি চলে আসতো। আর ওর আর ইয়াসিনের দেখা হলেই একটা না একটা অঘটন ঘটতোই। আর ফলস্বরূপ ইয়াসিনের দেওয়া শাস্তির মুখোমুখি হতে হতো। ঘন্টার পর ঘণ্টা ইয়াসিনের কেবিনে কান ধরেও দাঁড়িয়ে থাকতে হতো, অনার্সে পড়ুয়া একটা মেয়েকে কিনা কান ধরে স্যারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো, ভাবতেই কেমন লজ্জা লাগে। লজ্জায় কারো কাছে বলতেও পারতো না আয়না। ধীরে ধীরে ইয়াসিনের প্রতি একটা ভয়, রাগ, বিরক্তি জমে গিয়েছিল আয়নার। তবে এই ভয়, রাগ , বিরক্তির পাশাপাশি কোথাও ইয়াসিনের প্রতি একটা টানও অনুভব করতো আয়না, তবে সেই টানকে সব সময়ই উপেক্ষা করে চলার চেষ্টা করতো আয়না। আর আজ সেই ইয়াসিন কিনা ওরই স্বামী। হঠাৎ খট করে দরজা খোলার শব্দে অতীত থেকে বেড়িয়ে এলো আয়না।

চলবে….