বসন্ত বিকেল পর্ব-০৭

0
21

#বসন্ত_বিকেল
#পর্ব_৭
#নবনী_নীলা

মাহাদের বাড়ির সামনে শুদ্ধ গাড়ি থামালো তারপর তারা দুজনেই গাড়ি থেকে নামলো। মাহা বাড়ির দিকে রওনা হবে এ সময় শুদ্ধ পিছন থেকে তার নাম ধরে ডাকলো। মাহা থমকে গিয়ে পিছনে ফিরতেই শুদ্ধ মাহার দিকে এগিয়ে এসে বললো,

” আমি জানি বিয়েটা তুমি নিজের ইচ্ছায় করো নি। হয়তো এর জন্য কিছুটা দায়ী আমি নিজেও। আমি আমার মাকে কষ্ট দিতে চাই নি বলেই স্বার্থপরের মতন কাজটা করলাম। প্রথম দিনেও আমি অযথা রিয়েক্ট করেছি। আমি সে সব অস্বিকার করবো না। তবে এইটুকু তোমাকে এসিউর করতে পারি যে ইউ উইল বি সেইফ এরাউন্ড মী। তাই আজকের মতন এইসব আজে বাজে আইডিয়া নিজের মাথা থেকে ফেলে দেও।ওকে?”

মাহা শুদ্ধর কথা শুনে চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেছে। এত মিষ্টি কথা লোকটার মুখে? মাহা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। শুধু মাহা নয় শুদ্ধ নিজেও কিছুটা অবাক। তবে সে জানে সে কি করছে। শুদ্ধ মাহাকে গুড নাইট বলে নিজের গাড়িতে উঠে বসলো।

শুদ্ধ কাল রাত থেকেই নানা কিছু চিন্তা করছিলো। আজ মাহা যদি সত্যি সত্যি কিছু করে ফেলতো তাহলে হয় সে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারতো না। মাহার ভিতরে যে ভয় জন্মেছে সেটার জন্য শুদ্ধ নিজেই দায়ী। সত্যিকার অর্থে মানুষের জীবন কখনো কারোর জন্যে থেমে থাকে না। জীবন চলে আপন গতিতে তাই অতীতকে কেন্দ্র করে বর্তমানকে অবহেলা করা বোকামি ছাড়া কিছুই না।
নওশীন তার জীবন থেকে চলে গেছে প্রায় এক বছর কিন্তু শুদ্ধর জীবন থেমে নেই। শুদ্ধর নিজের জীবনে কোনো শূন্যতা তৈরি হয় নি কারণ তাদের ভালোবাসায় কোনো গভীরতা ছিলো না। হয়তো তারা যার যার স্বার্থেই ভালবেসেছিল। শুদ্ধ নিজের মায়ের জন্য একজন বন্ধু আনতে চেয়েছিল। চেয়েছিল নিজের মায়ের একাকিত্ব দূর করতে,আর নওশীন নিজের শখ পূরুণের তাগিদে ছিলো।

ভালোবাসার ডেফিনেশন কি শুদ্ধ নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করেছে কিন্তু কোনো উত্তর পায় নি।

তবে মাহাকে দেখে বুঝতে পেরেছে জীবনে সব কিছু ভেবে চিন্তে যুক্তি দিয়ে করতে হবে এমনটা নয়। মাঝে মাঝে ভুল করেও জীবন উপভোগ করা যায়। যেমন আজকের দিনটা। অবিশ্বাস্য একটা দিন ছিল তার জন্যে। তবু কোথাও একটু ক্লান্ত অনুভব করেনি শুদ্ধ। বরং যত চিন্তা করছে বিস্ময়ে অবাক হচ্ছে। মাহা তার কাছে সত্যি এক বিস্ময়ের নাম। যেই নাম তাকে প্রতিনিয়ত অবাক করছে। একটা মেয়ে কনে সেজে হাসপাতালে পৌঁছে গেলো। তারপর যখন সে ধরা পড়লো তার চোখে মুখে কত বিনয় আর মায়া! সে মায়া কাটিয়ে উঠার ক্ষমতা হয়তো কারোর নেই। অবিশ্বাস্য হলেও হাসপাতালেই তাদের বিয়ে হলো। বিয়ের পর মেয়েটি গাল ফুলিয়ে সারা রাস্তা গাড়ি করে এলো। তারপর যখন নিজের পছন্দের ফুলগুলো পেলো তার চোখে মুখে কি আনন্দ! মাহা নামটা আজকের দিনে তার জীবনে এক রাশ মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়েছে।

__________________

নিজ বাড়িতে মাহার এমন আপ্যায়নে মাহার দম আটকে আসছে। একি শুরু করেছে এরা! ঘণ্টায় ঘণ্টায় তার ঘরে খাবার নিয়ে আসছে। এ বিপদ যেহেতু সে নিজেই ডেকে এনেছে তাই সহ্য করা ছাড়া তার কাছে আর কোনো পথ খোলা নেই।

অন্য কোনো কথা বলা যেতো না? যে মেয়েটা দুশ্চিন্তায় অজ্ঞান হয়েছে তা না, সে চেঙ্গিস খান কি বলল? দুর্বলতার কারণে নাকি আমি অজ্ঞান হয়েছি। এখন আমার পুরো খানদান আমাকে জলহস্তীর মতন খাবার খাইয়ে যাচ্ছে।

মাহার সামনে এক প্লেট ফলমূল তার মা তাকে এইসব শেষ করতে দিয়ে গেছে। আবার কিছুক্ষণ পর পর এসে তদারকি করে যাচ্ছে। ফল শেষ না করতেই এদিকে তার বাবা মগ ভর্তি ডাবের পানি এনে তার সামনে ধরে বলল,” দেখি মা। এক টানে খেয়ে শেষ কর।”

” বাবা আমার পেট ভর্তি পড়ে খাবো।”

” আরেহ এতো শুধু পানি। এটা খেতে কিসের কষ্ট? খাও, জলদি শেষ করো। আমি আবার বাজারে যাবো।”

এদিকে মাহার মা এসে আরেক হইচই এখনো প্লেটে খালি হয়ে নি কেনো? আমার কথা এ মেয়ে কোনোদিন শুনেছে! খাবার দেখলেই তার নাক ছিটকানি। এখন দেখেছো?বিয়ের দিন কিভাবে অজ্ঞান হয়ে গেলো? ছেলের বাড়ির লোকজন কি বলবে যে মেয়েকে আমার খাওয়াই না? যতদিন এ বাড়িতে আছো আমি যখন যা দিবো তাই খেয়ে শেষ করতে হবে।

মাহার নিজের বাড়ি এখন তার কাছে অসহ্য লাগছে। এ বাড়িতে এক মুহূর্ত শান্তি নেই তার।বিকেলে অহনা ভয়ে ভয়ে মাহাকে দেখতে এলো। মাহার অবস্থা দেখে অহনার মায়া হলো। বড্ড বাজে ফেঁসে গেছে মেয়েটা।

” আমি তোকে আগেই বলেছিলাম তোর প্ল্যান মানেই ফেইল হবেই। এখন দেখছিস কি কি সহ্য করতে হচ্ছে।”

” তোর জন্যেই হয়েছে। ভাগ্যিস ওই চেঙ্গিস খান সামলে নিয়েছিলো নয়তো আজকে তোর আমার চল্লিশা খাওয়া দিন গুনতে হতো।”

” যাই বল শুদ্ধ কিন্ত অনেক সেন্সিবেল। কিভাবে সামলে নিলো পুরো সিচুয়েশন!”

” হ্যাঁ লোকটাকে যত খারাপ ভেবেছিলাম ওতো খারাপ না। কালকে আমাকে কি বলেছে জানিস?”

অহনা একটু দুষ্ট হাসি দিয়ে বলল,” কি বলেছে?”

মাহা ভ্রু কুঁচকে তাকালো।” এভাবে হাসবি না।”

” আচ্ছা বল কি বলেছে?”

” বলেছে ইউ উইল বি সেইফ এরাউন্ড মি।”

অহনা অবাক হয়ে বলল,” হঠাৎ এতো মিষ্টি কথা!”

” হঠাৎ না। লোকটা কখনো আমার সাথে খারাপ কিছু করে নি। আমি যদিও তেলে ঘি ঢালতাম তবুও…..” বলার আগেই মাহার মা রুমে এলো।
তার হাতে নাস্তা আর মাহার জন্যে এক গ্লাস দুধ। দুধের গ্লাসটা দেখে মাহার চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে গেলো।

অহনাকে দেখে তিনি বললেন,” ভালো করছো এসেছো। কালকে মাহার নাক ফোড়াতে নিয়ে যাবো। তুমি সকাল সকাল চলে এসো।”

নাক ফোড়ানোর কথা শুনে মাহার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। সে চট করে বললো,” আমি নাক ফোড়াবো না।”

মাহার মা তার দিকে চোখ রাঙিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।

” আমার এইসব একদম ভালো লাগে না। মুখ আমার, নাক আমার। অথচ আমার ইচ্ছে অনিচ্ছের কোনো দাম নেই। এইসব কু সংস্কার আমার একদম পছন্দ না। কিন্ত আমার মা! সে তো আমার কথা জীবনেও শুনবে না। আমি কি করবো?” বলেই মাহা হা হুতাশ করতে লাগলো।

অহনা কিছুক্ষণ ভেবে বললো,” আচ্ছা শুদ্ধকে বলে দেখ।”

” ওই লোককে আমি কি বলবো? মেয়েদের ব্যাপারে উনি কি বুঝবে?”

” আরেহ ঠিকই বুঝবে। এ সুযোগে চেক করে নিতে পারবি শুদ্ধ আসলে বর হিসাবে কেমন?”

মাহা ভ্রু কুচকে বললো,” মানে?”

______________________

শুদ্ধ নিজের ল্যাপটপ নিয়ে করিডোরে বসে কাজ করছিল। সামনের টি টেবিলের তার কফি রাখা। সে বেশ মনোযোগ দিয়ে নিজের কাজ করছে। একপাশে পড়ে থাকা তার ফোন বেজে উঠল। শুদ্ধ ল্যাপটপ পাশে রাখে ফোনটা হাতে নিলো। মাহার নাম্বার দেখে বেশ অবাক হলো। নিজে থেকে যেহেতু ফোন করেছে তাহলে নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে।

শুদ্ধ ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মাহা বললো,” আমি একটা জরুরী কারণে কল করেছি।”

” হুম, বলে ফেলো।”

” আপনি কালকে আমাকে একটা কথা বলেছিলেন মনে আছে?”

শুদ্ধ কফির মগ হাতে নিতে নিতে বলল,” কোন কথা?”

মাহা কি বলবে বুঝতে না পেরে অহনার দিকে তাকালো। অহনা ইশারায় কালকের কথা বলতে বললো। মাহা গলা ঠিক করে বললো,” আপনি না বললেন মনে নেই?”

“হ্যাঁ মনে আছে। কিন্তু কি হয়েছে সেটা বলো।”

” আমি একটা বিপদে পড়েছি। আপনি যদি আমাকে বাঁচাতে পারেন তাহলে বুঝবো আপনি যা বলেছেন সত্যি বলেছেন।”

” কি বিপদ !”, শুদ্ধ কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল।

” আমার মায়ের হাত থেকে আপনার আমাকে বাঁচাতে হবে।”

শুদ্ধ একটা ভ্রু তুলে বললো,” তোমার মা?”

” হ্যাঁ, আমার মা। কালকে সে আমাকে জোড় করে নিয়ে যাচ্ছে আমি একদমই যেতে চাই না। আপনি যে করেই হোক আমার যাওয়া আটকাবেন।”

মাহার কথাগুলো শুদ্ধ ঠিক বুঝে উঠতে না পেরে বললো,” কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?”

” কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেটা তো কথা না। কথা হচ্ছে আমি যেতে চাই না। আপনি আমাকে সাহায্য করবেন কিনা বলুন। নয়তো আমি নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে করে নিবো।”

” না! না। তোমাকে কোনো কিছু করতে হবে। তুমি কি করবে সে আমার জানা আছে। এক কাজ করো তুমি তোমার মাকে বুঝিয়ে বলো।”

” আমার মা কি জিনিস আপনি জানেন না। আর সাহায্য করবেন না সেটা বললেই হয়।”

” আমাকে কি করতে হবে?” শুদ্ধর কথা শুনে মাহা অহনার দিকে তাকালো। শুদ্ধকে এবার কি বলবে সে? অহনা মাহার কানে কানে সবটা বললো।

” আপনি কালকে সকাল সকাল আমাদের বাসায় চলে আসবেন।” মাহা অহনার কথা মতন বললো।

” আমি গিয়ে কি করবো?”

” আগে আসুন তারপর বলবো।”,বলেই মাহা কল কেটে দিলো। মাহার কেনো জানি মনে হচ্ছে এইসবে কোনো লাভ হবে না।

মাহা বিরক্তি নিয়ে বললো,” উনি এসে কি করবে সেটা আমি জানি না।তবে পরিস্থিতি বুঝে আমি তো কালকে পালাবো।”

(চলবে)