বহুব্রীহি পর্ব-৩+৪

0
6

🔴বহুব্রীহি (পর্ব :৩, ৪)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ

আনিস অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছে ভয়ঙ্কর একটা রাগের ভঙ্গি করতে। যা দেখে তার আট বছরের ছেলে টগর আঁৎকে উঠবে এবং মুখ কাচুমাচু করে বলবে, আর করব না বাবা। টগর যা করেছে তাকে ক্ষমা করার কোন প্রশ্নই উঠে না। সে ফায়ার ব্রিগেড খেলা খেলছিল। আগুন ছাড়া একরম খেলা হয় না, কাজেই অনেক কষ্টে সে বিছানার চাদরে আগুন ধরাল। তাকে সাহায্য করছিল তার ছোট বোন নিশা যার বয়স পাঁচ হলেও এই জাতীয় কাজ খুব ভাল পারে। খেলার দুটি অংশ, প্রথম অংশে বিছানার চাদর এবং জানালার পর্দায় আগুন লেগে যাবে, নিশা তার খেলনা টেলিফোন কানে নিয়ে বলবে, হ্যালো, আমাদের বাসায় আগুন লেগে গেছে। তখন শুরু হবে খেলার দ্বিতীয় অংশ–টগর সাজবে ফায়ার ম্যান। বাথরুম থেকে নল দিয়ে সে পানি এনে চারদিকে ছিটিয়ে আগুন নেভাবে। বেশ মজার খেলা।

খেলার প্রথম অংশ ভালমত শুরু হবার আগেই ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেল। তিন তলার ভাড়াটে ছুটে এলেন। একতলা থেকে বাড়িওয়ালা এলেন এবং ঘন ঘন বলতে লাগলেন, কি সর্বনাশ! কি সর্বনাশ।

আনিস গিয়েছিল বাড়ির খোজে। বাড়িওয়ালা নোটিশ দিয়েছে। গত মাসেই বাড়ি ছাড়ার কথা। এখনো কিছু পাওয়া যায়নি বলে বাড়ি ছাড়া যাচ্ছে না। বাড়িওয়ালার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এবার তিনি আর মুখের কথা বলে সময় নষ্ট করবেন না। পাড়ার ছেলেপুলে দিয়ে তুলে দেবেন। গত সপ্তাহে খুব ভদ্র ভাষায় এ জাতীয় সংগীত দেয়াও হয়েছে।

সারাদিন বাড়ি খুঁজে ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে বাসায় ফিরে টগর এবং নিশার নতুন কীর্তি শোনার পরে মেজাজ ঠিক থাকার কথা নয়। আনিসের মেজাজ যথেষ্টই খারাপ, কিন্তু তা সে ঠিক প্রকাশ করতে পারছে না। টগরের গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়া খুবই প্রয়োজন, হাত উঠছে না। বাচ্চা দুটির মা এক বছর আগে মারা গেছে। মা নেই দুটি শিশুর উপর রাগ করার কিংবা তাদের শাসন করা বেশ কঠিন ব্যাপার। আনিসের বেলায় তা আরো কঠিন কারণ রাগ তার স্বভাবে নেই। সে এক দৃষ্টিতে টগরের দিকে তাকিয়ে আছে। টগর খানিকটা অস্বস্তি বোধ করছে। তবে খুব ঘাবড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে না।

টগর!

জি বাবা!

টগর যা করে নিশার ঠিক সেই জিনিসটিই করা চাই, কাজেই সেও বলল, জ্বি বাবা।

আনিস বলল, নিশা মা, তুমি এখন কোন কথা বলবে না। টগরের সঙ্গে আমার খুব জরুরি কথা আছে। ওকে আমি যা বলব তা খুব মন দিয়ে শুনবে।

টগর!

ঘরে আগুন লাগিয়েছিলে?

নাতো–বিছানার চাদরে লাগিয়েছিলাম। আর নিশাকে বলেছিলাম জানালার পর্দায় লাগাতে।

কি জন্যে?

আমরা ফায়ার সার্ভিস ফায়ার সার্ভিস খেলছিলাম।

খেলতে আগুন লাগে?

অন্য খেলায় লাগে না। ফায়ার সার্ভিস খেলায় লাগে। আগুন না লাগলে নেভাব কি করে?

আমি খুব রাগ করেছি। টগর। এত রাগ করেছি যে আমার গা কাঁপছে রাগে।

কই বাবা, গা তো কাঁপছে না।

তোমরা দুজন খুবই অবাধ্য হয়েছে। আমার কোন কথা তোমরা শোন না। রোজ অদ্ভুত অদ্ভুত সব খেলা খেল। দুদিন আগে দোতলার ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়লে।

দোতলার ছাদ থেকে তো লাফ দেই নি। গ্যারাজের উপর থেকে লাফ দিয়েছি। নিচে বালি ছিল। একটুও ব্যথা পাইনি। বালি না থাকলে লাফ দিতাম না।

তোমাদের কখনো আমি কোন শাস্তি দেই না বলে এই অবস্থা হয়েছে। আজ তোমাদের শাস্তি দেব।

কি শাস্তি?

তুমি নিজেই ঠিক কর কি শাস্তি। আমি কিছু বলব না।

এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকব বাবা?

বেশ দাড়াও।

টগর এবং নিশা দুজনই উঠে এক পায়ে দাঁড়িয়ে গেল। দেখা গেল শাস্তি গ্রহণে দুজনেরই সমান আগ্রহ। এই শাস্তিতে তারা বেশ মজা পাচ্ছে বলেও মনে श्ल। মিটিমিটি হাসছে–

টগর!

জ্বি বাবা!

একটা কথা তোমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে কথাটা হচ্ছে–

আনিস তার দীর্ঘ বাক্য শেষ করতে পারল না, বাড়িওয়ালার ভাগ্নে এসে বলল, আপনাকে মামা ডাকে। আনিস দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ওঠে দাঁড়াল। বাড়িওয়ালার সঙ্গে বকবক করতে তার মোটেই ইচ্ছা করছে না। উপায় নেই, ইচ্ছা না করলেও বকবক করতে হবে।

আনিসের বাড়িওয়ালার নাম মির্জা সুলায়মান। ভাড়াটেদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভাল। শুধু ভাল না, বেশ ভাল। সুলায়মান সাহেবের ব্যবহার অতি মধুর। হাসি হাসি মুখ না করে তিনি কোন কথা বলেন না। ভাড়াটেদের যখন ডেকে পাঠান। তখন বসার ঘরের টেবিলে নানান ধরনের খাবার দাবার তৈরি থাকে।

আনিস বাড়িওয়ালার বসার ঘরে ঢুকে দেখল টেবিলে ঠাণ্ড পেপসির গ্লাস, প্লেটে ফ্ৰট কেক। সুলায়মান সাহেবের বয়স ষাটের কাছাকাছি হলেও তিনি তার সব ভাড়াটেদের ডাকেন— বড় ভাই। কেউ এই নিয়ে কিছু বললে তিনি বলেন, এটা হচ্ছে আমার দস্তুর। আমার পিতাজীর কাছ থেকে শিখেছি। পিতাজী সবাইকেই বড় ভাই ডাকতেন।

সুলায়মান সাহেব তার দস্তুর মত আনিসকে দেখে হাসি হাসি মুখ করে বললেন, বড় ভাই সাহেব আছেন কেমন?

জি ভাল।

আপনার পুত্ৰতো সর্বনাশ করে দিয়েছিল। দোতলায় উঠে দেখি বুন্দা বুন্দা ধোয়া। কোথায় আমাকে দেখে ভয় পাবে তা না উল্টা ছেলে আমাকে বলেআপনি এখন যান, আমরা খেলছি। আপনাকে দেখে মনেই হয় না যে আপনার এমন বিছু ছেলেমেয়ে আছে।

আনিস। গম্ভীর গলায় বলল, আপনি আপনার বাবার মত হয়েছেন, সবাই সে রকম হয় না।

খুবই খাটি কথা। তাছাড়া বড় ভাই সাহেব একটা ব্যাপার কি জানেন? অল্প বয়সে মা মারা গেলে ঘাড়ের একটা রাগ তেড়া হয়ে যায়। ওদের তাই হয়েছে। রাগ হয়ে গেছে তেড়া।

হতে পারে।

এদের সামলাবার জন্যে আপনার একটা বিবাহ করা দরকার। ঘরের শাসন হচ্ছে আসল শাসন। নেন কেক মুখে দেন। ফ্রেঞ্চ বেকারীর কেক। একশ টাকা পাউন্ড।

আনিস কেক মুখে দিল। সুলায়মান সাহেব মধুর গলায় বললেন, অনেক পুরুষ আছে যারা মনে করে সংসারে সৎ মা এলে ছেলেপুলেদের উপর অত্যাচার হবে। কথা ঠিক। অত্যাচার হয়। তবে বুঝে সুঝে বউ আনলে হয় না।

আমি বুঝে সুঝেই আনব।

বুদ্ধি কম এমন মেয়ে বিবাহ করতে হবে। বুদ্ধি কম মেয়ে মুখের একটা মিষ্টি কথাতেই খুশি হয়। এদের খুশি করা খুব সোজা। নিউমার্কেট থেকে আসার পথে এক টাকা দিয়ে একটা ফুলের মালা কিনে নিয়ে গেলেন— এতেই খুশি আর বৌ যদি বুদ্ধিমতী হয় তাহলে কিছুতেই খুশি হবে না। জ্বলিয়ে মারবে। বোকা স্ত্রী সংসার হচ্ছে সুখের সংসার।

আনিস বলল, বোকা মেয়ে পাওয়াইতো মুশকিল। সব মেয়েরই বুদ্ধি বেশি।

বড় ভাই সাহেব, ভুল কথা বললেন, পুরুষের চেয়ে মেয়েদের বুদ্ধি অনেক কম।

তাই-না-কি?

হ্যাঁ। আমার মুখের কথা না, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। একজন পুরুষ মানুষের ব্ৰেইনের ওজন হচ্ছে ১,৩৭৫ গ্রাম। আর একজন মেয়ে মানুষের ১,২২৫ গ্রাম। একশ পঞ্চাশ গ্ৰাম।

এই তথ্য পেয়েছেন কোথায়?

খোঁজ-খবর রাখি বড় ভাই। একেবারে মুখতো না। কই, এখানে চা দিল না।

পেপসি খেলামতো আবার চা কেন?

পেপসি খেলেন পানির বদলে। চা ছাড়া নাস্তা শেষ হয় না-কি? হয় না।

আনিস নাস্তার শেষে চা-এর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। সুলায়মান সাহেব বললেন, বড় ভাই সাহেব, এবার একটু কাজের কথা বলি।

বলুন।

ফ্ল্যাটটা যে বড়ভাই ছেড়ে দিতে হয়।

ছেড়ে দেব। বাড়ি খুঁজছি। বিশ্বাস করুন খুঁজছি। পাওয়া মাত্র ছেড়ে দেব।

বুধবারের মধ্যেই যে ছেড়ে দিতে হয় ভাই সাহেব। আমি একজনকে জবান দিয়ে ফেলেছি, সে বুধবারে বাড়িতে উঠবে। জবান তো বড় ভাই সাহেব রক্ষা করতে হয়।

আমি যদি এর মধ্যে কিছু খুঁজে না পাই— আমি যাব কোথায়?

আমি আমার একটা ঘর ছেড়ে দিব। মেহমান হিসেবে কয়েকদিন থাকবেন।

চা এসে গিয়েছে। আনিস চা-য়ে চুমুক দিল। কি বলবে ভেবে পেল না।

বড় ভাই সাহেব।

জি বলুন।

বলতে শরম লাগছে–না বলেও পারছি না। আপনার কাছে তিন মাসের ভাড়া পাওনা আছে। বলেছিলেন একটা ব্যবস্থা করবেন।

অবশ্যই করব।

তা করবেন জানি। কিন্তু ভাইসাহেব যাওয়ার আগে পরিশোধ করে যাওয়াটা কি ভাল না। একবার চলে গেলে আপনার হয়ত মনে থাকবে না।

আনিস তিক্ত গলায় বলল, এই মুহূর্তে আমার হাত একেবারে খালি তবে স্ত্রীর কিছু গয়না আছে। ঐগুলো বিক্রি করে হলেও আপনার পাওনা মিটিয়ে দেব।

এইটা খুব ভাল কথা বলেছেন। যে পুরুষ ঋণ রেখে এক কদম পা ফেলে না, সে হচ্ছে সাচ্চা পুরুষ। বড় ভাই সাহেব, আমার একটা পরিচিত গয়নার দোকান আছে। আপনি যদি চান আপনাকে নিয়ে যাব।

ঠিক আছে যাব আপনার সঙ্গে।

কাল বিকালে কি আপনার সময় হবে?

হবে। এখন তাহলে উঠি? না-কি আরো কিছু খাওয়াবেন?

সুলায়মান সাহেব হো হো করে অনেকক্ষণ হাসলেন। যেন এরকম মজাদার কথা অনেকদিন শোনেননি। আনিস শীতল গলায় বলল, এরকম শব্দ করে হাসবেন না। সুলায়মান সাহেব। শব্দ করে হাসলে হার্টে প্রেসার পড়ে। আপনার যা বয়স তাতে হার্টে বাড়তি প্রেসার দেয়াটা ঠিক হবে না।

সত্যি বলছেন?

হ্যাঁ সত্যি। হাসাহাসি একেবারেই করবেন না। সব সময় মন খারাপ করে বসে থাকবেন তাহলেই দেখবেন হার্ট ভাল থাকবে, অনেক দিন বাঁচতে পারবেন।

অনেক দিন বাঁচতে ইচ্ছা করে না। যত তাড়াতাড়ি কবরে যেতে পারব ততাই ভাল।

তোড়াতাড়ি কবরে চলে গেলে এই যে টাকা পয়সা রোজগার করছেন সেগুলো ভোগ করবে। কে? ভোগ করবার জন্যেই তো আপনার দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা দরকার।

আপনি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন।

হ্যাঁ করছি।

হাসলে হার্টের উপর চাপ পড়ে ঐটাও তাহলে ঠাট্টা?

না। ঐটা ঠাট্টা না। ঐটা সত্যি। যে কারণে হাসি খুশী মানুষদের বেশি দিন বাঁচতে দেখা যায় না। বেঁচে থাকে খিটখিটে গম্ভীর মানুষজন। দেখেন না পৃথিবী ভর্তি বদমেজাজী বুড়ো-বুড়ি।

কথাটাতো ভাইসাহেব খুব ভুল বলেন নাই।

কথা আমি সচরাচর ভুল বলি না। আচ্ছা আজ তাহলে যাই। কাল সন্ধ্যায় দেখা হবে। এক সঙ্গে গয়নার দোকানে যাব।

ইনসাআল্লাহ।

হাসির ব্যাপারটা মনে রাখবেন। হাসি সম্পূর্ণ বন্ধ। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে হলে রাম গরুর ছানা হতে হবে।

নিজের ঘরে ঢুকে আনিসের মন খারাপ হয়ে গেল। টগর এখনো একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিশা রণে ভঙ্গ দিয়ে ছবি আঁকছে। বাবাকে দেখে নিশা বলল, টগর ভাইয়ার শাস্তি আর কতক্ষণ হবে বাবা?

আনিস বলল, শাস্তি শেষ।

টগর বাবার দিকে তাকিয়ে হাসল। আনিস বলল, পা ব্যথা করছে?

হুঁ করছে।

আর কোনদিন ফায়ার ব্রিগেড খেলা খেলবে না তো?

টগর না সূচক মাথা নাড়ল। আনিস বলর, মাথা নাড়লে হবে না। বল, আর কোনদিন খেলিব না।

আর কোনদিন খেলিব না। ভেরি গুড। তোমরা এখন হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বস। আমি রান্না শেষ করি।

নিশা বলল, আমি কি তোমাকে সাহায্য করব বাবা?

না। সাহায্য লাগবে না। আজ তোমাদের কি খেতে ইচ্ছা করছে বল? ডিমের ভাজি না তরকারী?

টগর বলল, আমরা রোজ ডিম খাচ্ছি কেন বাবা?

ডিম রান্না সবচে সহজ এই জন্যে রোজ ডিম খাচ্ছি।

নিশা গম্ভীর গলায় বলল, আমরা পৃথিবীর সব ডিম খেয়ে শেষ করে ফেলছি তাই না বাবা?

হ্যাঁ তাই। এখন বই নিয়ে বস।অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন

বই নিয়ে বসতে ইচ্ছা করছে না।

কি ইচ্ছা করছে?

নিশা অবিকল বড়দের মত গলায় বলল, কি যে ইচ্ছা করছে তাও তো জানি না।

আনিস হেসে ফেলল। তার ছোট মেয়েটি বড় মায়াবতী হয়েছে। কথা বলার কি অদ্ভুত ধরন। কোথেকে পেয়েছে এসব?

টগর বলল, আজ রাতে কি গল্প বলার আসর বসবে বাবা?

এখনো বুঝতে পারছি না। সম্ভাবনা আছে।

গল্প বলার আসর শেষ পর্যন্ত বসল না। নিশা ঘুমিয়ে পড়েছে। একা একা গল্প শুনতে টগরের ভালো লাগে না। অথচ তার ঘুমও আসছে না। আনিস তার পিঠে চুলকে দিল, মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, তাতেও কিছু হলো না। টগর চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। একটু পর পর বলছে— ঘুম আসছে না বাবা।অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন

একেবারেই আসছে না?

না।

তাহলে আস নতুন ধরনের একটা খেলা দুজনে মিলে খেলি।

কি খেলা?

এই খেলাটার নাম হচ্ছে সত্যি-মিথ্যা খেলা। আমি তোমাকে প্রশ্ন করব তুমি মিথ্যা জবাব দেবে। দশটা প্রশ্ন করব। প্রতি বারই যদি মিথ্যা জবাব দিতে পার তাহলে তুমি জিতে যাবে। যেমন ধর আমি যদি জিজ্ঞেস করি, তোমার নাম কি? তুমি যদি বল টগর তাহলে তুমি হেরে যাবে। সব জবাব হতে হবে মিথ্যা।

এটাতো খুব সহজ খেলা বাবা।

মোটেই সহজ না। খুব কঠিন খেলা। কারণ মানুষ বেশিক্ষণ মিথ্যা কথা বলতে পারে না। পর পর দশটা মিথ্যা বলা মানুষের জন্যে খুব কঠিন। বেশির ভাগ মানুষই পারে না।

আমি পারব?

না তুমিও পারবে না। এসো শুরু করা যাক। রেডি-ওয়ান টু খ্ৰী— খোকা তোমার নাম কি— টগর?

জ্বি না। আমার নাম টগর না।

তোমার ছোট একটা বোন আছে না?

জ্বি না। আমার একটা ভাই আছে।

তুমি কি ক্লাস থ্রিতে পড়?

জ্বি না। আমি ক্লাস টেনে পড়ি।

তোমার কি তিনটা হাত আছে?

হ্যাঁ আমার তিনটা হাত আছে?

তুমি কি তোমার মা-কে খুব ভালবাস?

হ্যাঁ বাসি।

আনিস হেসে ফেলল। টগর মাথা নিচু করে ফেলেছে। আনিস বলল, দেখলে তো টগর, মাত্র পাঁচটা প্রশ্নেই তুমি সত্যি কথা বলে ফেললে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিথ্যা কথা বলা খুবই কঠিন।

টগর চাপা গলায় বলল, মিথ্যা কথা বলা কঠিন কেন বাবা?

কঠিন, কারণ মানুষকে মিথ্যা কথা বলার জন্য তৈরি করা হয়নি। তবু আমরা মিথ্যা কথা বলি। যখন বলি তখন আমাদের খুব কষ্ট হয়।

আমার তো কষ্ট হয় না। বাবা।

তুমি কি মিথ্যা কথা বল?

হ্যাঁ বলি। স্কুলে বলি।

আনিস উপদেশমূলক কিছু বলবে কি বলবে না। এই নিয়ে খানিকক্ষণ ভাবলা। শৈশবে নীতিকথার আসলে কি কোন গুরুত্ব আছে? একই পরিবারের চারটি ছেলেমেয়ে শৈশবে একই ধরনের নীতিকথা এবং উপদেশ শোনে কিন্তু বড় হয়ে চারজন চার রকমের হয়। আনিসের ধারণা শিশুরা বইয়ের উপদেশ গ্ৰহণ করে না। একটি শিশু অন্য একটি শিশুর কথা শুনে কিন্তু একজন বয়স্ক মানুষের কথা শুনে না। তাদের জগৎ ভিন্ন, তারা নিজেদের জগৎ থেকে শিক্ষা গ্ৰহণ করে।

টগর।

টগর জবাব দিল না। আনিস দেখল, টগর ঘুমিয়ে পড়েছে। তার নিজের চোেখও ঘুমে জড়িয়ে আসছে কিন্তু সে জানে বিছানায় শোয়া মাত্র ঘুম চলে যাবে। নানান উদ্ভট চিন্তা মাথায় ভর করবে। তারপর আসবে সুখময় কিছু কল্পনা। সেই কল্পনায় চব্বিশ বছর বয়েসী একজন তরুণী এসে ঘরে ঢুকবে। পান খাওয়ায় সেই তরুণীর ঠোঁট লাল হয়ে আছে। তরুণীটির নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম। টলমলে চোখে স্নিগ্ধ ছায়া।

আনিস বিরক্ত হবার মত ভঙ্গি করে বলবে, আবার পান খেয়েছ?

তরুণীটি বলবে, হ্যাঁ খেয়েছি।

দাঁতগুলি নষ্ট করবে।

করলে করব। সারা দিনে একবার পান খাই তাতেই–

আচ্ছা যাও আর কিছু বলব না।

তোমার কি চা লাগবে?

হ্যাঁ।

ঘুমুতে যাবার আগে কেউ চা খায় এই প্রথম দেখলাম।

ঘুমুতে যাব তোমাকে কে বলল?

ঘুমুবে না?

নো ম্যাডাম। সারা রাত জাগব।

লেখালেখি? হ্যাঁ লেখালেখি। নতুন উপন্যাস শুরু করছি।

তুমি না বললে সোমবার থেকে শুরু করবে।

দুদিন আগেই শুরু করছি।

উপন্যাসের নাম কি?

ময়ূরাক্ষী। নামটা কেমন?

সত্যি জানতে চাও।

হ্যাঁ।

বললে রাগ করবে নাতো?

না–এর মধ্যে রাগ করার কি আছে?

নিউ এলিফেন্ট রোডের একটা জুতার দোকানের নাম ময়ূরাক্ষী।

আনিস তাকিয়ে আছে। তরুণী খিলখিল করে হাসছে। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে গেল। তবু সে হাসছে। কি অসাধারণ একটি দৃশ্য চমৎকার দৃশ্য তার জীবনে অভিনীত হয়েছে এই কথাটা আজ আর কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না। আজ মনে হয় রাত্ৰি নামে কোন তরুণীর সঙ্গে তার কোনদিন পরিচয় ছিল না। সবই কল্পনা সবই মায়া।

পর্ব ৩ শেষ 📌

🔴পর্ব :৪🔴

সোবাহান সাহেবের সামনে যে যুবকটি দাঁড়িয়ে আছে সোবাহান সাহেব তাকে চিনতে পারলেন না। মাঝারি গড়নের একজন যুবক। গায়ে খন্দরের পাঞ্জাবী, চোখে মোটা কাচের চশমা। মুখ হাসি হাসি। গেট খুলে তরতর করে এগিয়ে

এসেছে। যেন বাড়ি ঘর খুব পরিচিত। অনেকবার এসেছে।

স্লামালিকুম। ওয়ালাইকুম সালাম।

আমার নাম আনিস। আমি কি আপনার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলতে পারি?

আমি কি আপনাকে চিনি?

জ্বি না। অচেনা লোকের সঙ্গে কি আপনি কথা বলেন না?

সোবাহান সাহেবের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। এই যুবকের মতলব ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। দেশ ভর্তি হয়ে গেছে। মতলববাজ যুবক। এদের কোন রকম প্রশ্ৰয় দেয়া উচিত না।

স্যার, আমি কি বসব?

দীর্ঘ আলাপ থাকলে বসুন। আর সংক্ষিপ্ত কোন কিছু বলার থাকলে বলে চলে যান।

আনিস বসল। তার কাঁধে একটা ভারী হ্যান্ডব্যাগ ঝুলছিল, সেই হ্যান্ডব্যাগ খুলে কোলের উপর রাখল। সোবাহান সাহেব অত্যন্ত সন্দেহজনক দৃষ্টিতে হ্যান্ডব্যাগের দিকে তাকাতে লাগলেন। তার মন বলছে ছোকরার আসার উদ্দেশ্য এই হ্যান্ডব্যাগেই আছে। কিছু একটা গছাতে এসেছে। সম্ভবত ইনসু্যারেন্স কোম্পানির লোক। পটিয়ে পটিয়ে ইনসু্যারেন্স করিয়ে ফেলবে।

সোবাহান সাহেব কঠিন স্বরে বললেন, বলুন কি ব্যাপার। সংক্ষেপে বলবেন। লম্বা কথা শোনার সময় বা ধৈৰ্য কোনটাই আমার নেই।

আপনার বাড়ির দোতালার ছাদে দুটা ঘর আছে। ঐ ঘর দুটা কি আপনি ভাড়া দেবেন?

ছাদের ঘর ভাড়া দেয়া হবে এই রকম কোন বিজ্ঞাপন কি আপনার চোখে পড়েছে?

জ্বি না।

তাহলে?

আমি এই এলাকায় বাড়ি খুঁজছিলাম। তখন একজন বলল, এক সময় তেতলার দুটি ঘর আপনি ভাড়া দিতেন।

এক সময় দিতাম বলে সারা জীবন দিতে হবে?

তা-না। আপনি রাগছেন কেন? জোর করে নিশ্চয়ই আমি আপনার বাড়িতে উঠিব না!

আপনি কি করেন?

কিছু করি না।

কিছু করি না মানে? কিছু না করলে সংসার চলে কি ভাবে?

আমি একজন লেখক। লেখালেখি করি।

কি নাম?

আগে একবার বলেছিলাম।

দ্বিতীয়বার বলতে অসুবিধা আছে?

না নেই–আমার নাম আনিস।

এই নামে কোন লেখক আছে বলে তো জানি না।

আমি ছদ্মনামে লিখি।

ছদ্মনামটা কি?

আপনাকে বলতে চাচ্ছি না। ছদ্মনাম গ্রহণের উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজেকে আড়াল করা। যদি বলেই ফেলি। তাহলে শুধু শুধু আর ছদ্মনাম নিলাম কেন?

তুমি কি লেখা?

আনিস লক্ষ্য করল এই ভদ্রলোক হঠাৎ আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছেন এবং নিজে তা বুঝতে পারছেন না।

এইটি ভাল লক্ষণ। আনিস বলল, গল্প, উপন্যাস। এসব লিখি। একটি প্ৰবন্ধের বই আছে। কেউ সেই বই পড়ে না।

আমার বাড়ি ভাড়া নেওয়ার ইচ্ছা তোমার কেন হল?

শুনেছি আপনি ভাড়া খুব কম নিতেন। এ্যাডভান্সের ঝামেলা ছিল না। তাছাড়া বাড়িটাও আমার পছন্দ হয়েছে।

তুমি কি ব্যাচেলার?

জ্বি না। আমার দুটি বাচ্চা আছে।

দেশের সমস্যা নিয়ে কি তুমি ভাব?

আপনার কথা বুঝতে পারলাম না।

এই যে দেশে অসংখ্য সমস্যা এসব নিয়ে কখনো ভাব?

কোন সমস্যার কথা বলছেন?

সব রকম সমস্যা।

জ্বি-না, ভাবি না।

তুমি একজন লেখক মানুষ, তুমি এসব নিয়ে ভাব না? তুমি কি রকম লেখক?

খুবই বাজে ধরনের লেখক।

তুমি এখন যেতে পার। তোমাকে বাড়ি ভাড়া দেব না।

দেবেন না?

না। তোমাকে আমার পছন্দ হয় নি।

আপনাকেও আমার পছন্দ হয় নি। তবে আপনার বাড়ি পছন্দ হয়েছিল।

আমাকে পছন্দ না হবার কারণ?

আপনি হচ্ছেন এক শ্রেণীর পয়সাওয়ালা অকৰ্মণ্য বৃদ্ধ। যারা দেশের সমস্যা নিয়ে ভাবে এবং মনে করে এই ভাবনার কারণে সে অনেক বড় কাজ করে ফেলছে। এক ধরনের আত্মতৃপ্তি পায়। আসলে আপনার এসব চিন্তা ভাবনা অর্থহীন এবং মূল্যহীন। আপনার যা করা উচিত তা হচ্ছে— রগরগে থ্রীলার পড়া। মাঝে মাঝে দান দক্ষিণ করা যাতে পরকালে সুখে থাকতে পারেন। ইহকাল এবং পরকাল দুটিই ম্যানেজ করা থাকে বলে।

অভদ্র ছোকরা। স্টপ। স্টপ।

আপনি খুব বেশি রেগে যাচ্ছেন। আপনার প্রেসার ট্রেসার নেইতো? প্রেসার থাকলে সমস্যা হয়ে যেতে পারে।

বহিস্কার। বহিস্কার। এই মুহুর্তে বহিস্কার।

সোবাহান সাহেব প্ৰচণ্ড চিৎকার করতে লাগলেন। মিলি বারান্দায় ছুটে এল। চোখ বড় বড় করে বলল, কি হয়েছে?

এই ছোকরাকে ঘাড় ধরে বের করে দে। ফাজিলের ফাজিল, বিদের বদ।

মিলি কড়া গলায় বলল, আপনি বাবাকে কি বলেছেন?

আনিস অবস্থা দেখে পুরোপুরি হকচকিয়ে গেছে। কিছু একটা বলতে গিয়েও সে বলতে পারল না। মিলি বলল, প্লীজ আপনি এখন কথা বলে আর ঝামেলা বাড়াবেন না। চলে যান। আনিস গেট পার হয়ে চলে যাবার পর সোবাহান সাহেব বললেন, কাদের বাসায় আছে?

মিলি বলল, আছে।

কাদেরকে বল ঐ ছোকরাকে ধরে আনতে।

বাদ দাও না বাবা। আর কেন?

যা করতে বলছি কর।

ভদ্রলোক কে?

আমাদের নতুন ভাড়াটে।

তোমার কথা বুঝলাম না বাবা।

তিনতলার ঘর দুটা তার কাছে ভাড়া দিয়েছি। ছোকরাকে আমার পছন্দ হয়েছে। ছোকরার মাথা পরিষ্কার।

কাদের আনিসকে আনতে গেল। সোৱাহান সাহেব নিজেই দোতলার ছাদে উঠলেন ঘর দুটির অবস্থা দেখার জন্যে। অনেক দিন তালাবন্ধ হয়ে আছে।

দুটি ঘর। একটা বাথরুম, রান্নাঘর। ছোট পরিবারের জন্যে খুব ভালই বলতে হবে। ঘর দুটির সামনে বিশাল ছাদ। ছাদে অসংখ্যা টব, টবে ফুলের চাষ হচ্ছে। মিলির শখ।

মিনু ছাদে উঠে এলেন। তার মুখ থমথমে। কিছুক্ষণ আগে মিলির কাছে তিনি বাড়ি ভাড়া দেবার খবর শুনেছেন। রাগে তার গা জুলে যাচ্ছে।

তুমি নাকি ছাদের ঘর দুটি ভাড়া দিচ্ছ?

হ্যাঁ।

কাকে দিলে?

নামটা মনে আসছে না। ফাজিল ধরনের এক ছোকরা।

বাড়ি ভাড়া দেয়া কি খুব দরকার ছিল?

না।

তাহলে, বাড়ি ভাড়া দিলে কেন?

আমার দরকার ছিল না, কিন্তু ঐ ফাজিলের দরকার ছিল।

তুমি হুট করে একেকটা কাজ কর আর সমস্যা হয়।

সোবাহান সাহেবের মেজাজ। চট করে খারাপ হয়ে গেল। তিনি থমথমে গলায় বললেন, আমি সমস্যার সৃষ্টি করি?

মিনু চুপ করে গেলেন। সোবাহান সাহেব চাপা গলায় বললেন, আমার জন্য কারোর কোন সমস্যা হোক তা আমি চাই না।

এই বলেই তিনি নিচে নেমে গেলেন। মিনু গেলেন পেছনে পেছনে।

একতলার বারান্দায় আনিস দাঁড়িয়ে আছে। কাদের তাকে নিয়ে এসেছে। আনিস খানিকটা শংকিত বোধ করছে। বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে আবার ডেকে আনার অর্থ সে ঠিক ধরতে পারছে না। সোবাহান সাহেব তার কাছে এসে দাঁড়ালেন এবং শুকনো গলায় বললেন, এসেছ?

আনিস বলল, জ্বি। আপনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

সোবাহান সাহেব বললেন, তোমাকে বাড়ি ভাড়া দেয়া হবে না। এটা বলার জন্যে ডেকে পাঠিয়েছি।

সেতো একবার বলেছেন।

আবার বললাম, আবার বলায় তো দোষের কিছু নেই।

জ্বি না নেই। দ্বিতীয়বার বলাটা ভাল হয়েছে। এখন কি আমি যেতে পারি?

হ্যাঁ যাও।

স্লামালিকুম।

আনিস গেটের বাইরে বেরুতেই মিনু বললেন, কাদের যা ভদ্রলোককে ডেকে নিয়ে আয়।

কাদের সোবাহান সাহেবের দিকে তাকাল। তিনি কিছু বললেন না। মিনু বলল, দাঁড়িয়ে আছিস কেন যা। কাদের বিমর্ষ মুখে বের হল। বড় যন্ত্রণায় পড়া গেল।

আনিস বড় রাস্তা পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। কাদের সেখানেই তাকে ধরল, নিষ্প্রাণ গলায় বলল, আপনেরে বুলায়।

আনিস বলল, ঠাট্টা করছি?

জ্বি না। আবার যাইতে বলছে।

আবার যাব?

যাইতে ইচ্ছা না হইলে যাইয়েন না। আমারে খবর দিতে কইছে। খবর দিলাম। যাওন না যাওন আফনের ইচ্ছা।

নাম কি তোমার?

আমার নাম মোহাম্মদ আব্দুল কাদের। সৈয়দ মোহাম্মদ আব্দুল কাদের।

সৈয়দ নাকি।

জ্বি। বোগদাদী সৈয়দ।

বল কি? বোগদাদী সৈয়দ যখন খবর নিয়ে এসেছে তখন তো যেতেই হয়।

আনিস তৃতীয়বারের মত নিরিবিলি বাড়ির বারান্দায় এসে উঠল। সোবাহান সাহেব তার দিকে না তাকিয়েই বললেন, কাদের ভদ্রলোককে তিনতলার ঘর দুটার চাবি এনে দে।

আনিস বলল, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ স্যার। অনেক ধন্যবাদ।

রাত আটটার মত বাজে।

মিলি বিরক্ত মুখে খাতা কলম নিয়ে বসে আছে। তার সামনে চার পাঁচটা বই। আগামীকাল সকাল নটায় তার টিউটোরিয়েল ক্লাস। এ্যাসাইনমেন্টের কিছুই এখনো করা হয়নি। বিষয়টাই মাথায় ঢুকছে না। এর আগের টিউটোরিয়েলে বি মাইনাস পেয়েছে। এবার মনে হচ্ছে সি মাইনাস হবে। খাতায় প্রথম বাক্যটা লিখে শেষ করবার আগেই কাদের ঘরে ঢুকে বলল, আফা আফনেরে ডাকে।

মিলি রাগি গলায় বলল, কে ডাকে?

ডাক্তার সাব। গ্ৰীন ফার্মেসীর চেংড়া ডাক্তার।

আমাকে ডাকছে কি জন্যে? আমার কাছে কি?

আমি ক্যামনে কই আফা? আমি হইলাম গিয়া চাকর মানুষ। আমার সাথে কি আর খাতিরের আলাপ করব?

মিলি কঠিন গলায় বলল, তুই কথা বেশি বলিস, কথা কম বলবি।

অর্ডার দিলে কথাই কমু না। অসুবিধা কি? কথা কওনের মইধ্যেতো আফা আরাম কিছু নাই।

যা আমার সামনে থেকে।

কাদের গম্ভীর মুখে বের হয়ে গেল। পেছনে পেছনে আসছে মিলি, বেআক্কেল ডাক্তারের জন্যে তার মেজাজ খুবই খারাপ হয়েছে, যদিও তাকে দেখে তা বোঝা যাচ্ছে না।

মনসুরের পোশাক-আষাক আজ খুবই পরিপাটি। সার্ট প্যান্ট সবই নতুন কেনা হয়েছে। জুতা জোড়াও নতুন। জুতা জোড়া সাইজে খানিকটা ছোট হয়েছে। কেনার সময় তা ঠিক বোঝা যায়নি। এখন জানান দিচ্ছে। পাটন টন করছে। পায়ের আঙুলে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে কি-না কে জানে। মিলিকে দেখে সে উঠে দাঁড়াল। মিলি বলল, কি ব্যাপার ডাক্তার সাহেব?

না মানে আপনার বাবার প্রেসারটা চেক করতে এসেছিলাম।

আপনাকে কি আসতে বলেছিল কেউ?

জ্বি না। তবে উনার যেহেতু হাই প্রেসারের টেনডেন্সি কাজেই প্রায়ই চেক করা দরকার।

ও আচ্ছা।

আমি আপনাদের বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম দেখেই যাই।

ভাল করেছেন। বাবা দোতলায় তার ঘরে। আসুন বাবার কাছে আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।

চলুন।

মিলি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলল, আপনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন কেন?

মনসুর লজ্জিত গলায় বলল, নতুন জুতা। সাইজে হয়েছে ছোট। কেনার সময় বুঝতে পারি নি। মনসুর সিড়ির শেষ মাথা পর্যন্ত উঠল না। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। দিশাহারা গলায় বলল, একটা ভুল করে ফেলেছি।

মিলি বলল, প্রেসার মাপার যন্ত্র ফেলে এসেছেন। তাই না?

জ্বি। তাহলে আজ বরংচ চলে যান। বাবার শরীর যদি খারাপ হয় আপনাকে খবর দেব।

আমি বরং এক দৌড়ে নিয়ে আসি। যাব আর আসব।

তেমন ইমার্জেন্সিতো না। ব্যস্ত হবার কিছুই নেই। আপনি সিঁড়ি ধরে ধরে নামুন। ঐ দিনের মত হওয়াটা ভাল হবে না।

মনসুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটা ঐ দিনকার ঘটনাটা ভুলতেই পারছে না। সামান্য দুর্ঘটনার বেশিতো কিছু না। দুর্ঘটনা মানুষের জীবনে ঘটে। না? সব সময়ই তো ঘটছে।

অতিরিক্ত সাবধানতার জন্যেই কি না কে জানে সিঁড়ির মাঝামাঝি এসে মনসুরের নতুন জুতা ক্লিপ কাটল। অতি সহজেই মনসুর নিজেকে সামলাতে পারত। কিন্তু সে কেন জানি মিলির মুখের দিকে তাকাতে গেল আর তখনি রেলিং-এ ধরে রাখা হাত ফসকে গেল। সে গড়িয়ে পড়ে গেল নিচে। আজ ঐ দিনের চেয়েও ভয়াবহ শব্দ হল।

সোবাহান সাহেব, ফরিদ, কাদের এবং রহিমার মা ছুটে এল। সোবাহান সাহেব বললেন, কি ব্যাপার? মিলি বলল, ডাক্তার সাহেব পড়ে গেছেন।

ফরিদ বিস্মিত গলায় বলল, কোন ডাক্তার ঐ দিনকার পাগলা ডাক্তার?

মিলিকে ঐ প্রশ্নের জবাব দিতে হল না। মনসুর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, একেবারেই ব্যথা পাইনি।

ফরিদ বলল, আপনি ব্যথা পেয়েছেন কি পাননি এটা আমার জিজ্ঞাসা নয়। আমি জানতে চাচ্ছি। আপনাদের ডাক্তারী শাস্ত্রে আছাড়া, খাওয়া রোগ নামে কোন রোগ আছে কি না? যদি থেকে থাকে তাহলে সেই রোগের চিকিৎসা আছে, না সেটা দুরারোগ্য ব্যধি?

মনসুরের মনে হল ইনি রসিকতা করছেন। অপমানজনক পরিস্থিতিতে রসিকতা খুবই ভাল জিনিস। সবাই মিলে এক সঙ্গে হেসে উঠলে ব্যাপারটা হালকা হয়ে যায়। সবাই হেসে উঠবে এই ভেবে মনসুর উচ্চস্বরে হাসল। আশ্চর্য অন্য কেউ তার সঙ্গে হাসছে না। বরংচ কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। নির্যাৎ তাকে পাগল ভাবছে।

ধারণা ভদ্রলোকের ব্রেইন ফাংশান করছে না। এই যে ভাই ডাক্তার সাহেব, আপনি কাদেরের সঙ্গে যান। সপ্তাহখানেক বেড রেস্টে থাকবেন। বিশ্রামের মত ভাল জিনিস আর কিছু নেই। সব চিকিৎসার সেরা চিকিৎসা হচ্ছে বিশ্রাম।

নিরিবিলি বাড়ির দুজন সদস্য রাতের খাবার খেতে বসেছে। ফরিদ এবং মিলি। মিনু বেশির ভাগ সময় রাতে খান না। আজও খাবেন না। বাকি শুধু সোবাহান সাহেব। ফরিদ এবং মিলি প্লেটে ভাত নিতে নিতে সোবাহান সাহেব এসে পড়লেন। ফরিদ হাসি মুখে বলল, কেমন আছেন দুলাভাই?

সোবাহান সাহেব অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেন।

কথা বলছেন না কেন দুলাভাই? রাগ করলেন না কি?

চুপচাপ খাওয়া দাওয়া কর। আমাকে বিরক্ত করবে না।

খাওয়ার টেবিল হচ্ছে সামাজিকভাবে মেলামেশার একটা স্থান। নিঃশব্দে খাওয়া দাওয়া করে উঠে যাওয়া খাবার টেবিলের উদ্দেশ্য নয়।

চুপ কর।

এত ভাল যন্ত্রণা হল দেখি–কিছু বললেই চুপ কর। আপনার সমস্যাটা কি?

মিনু লেবু দিতে এসে বললেন, চুপচাপ খেয়ে বিদেয় হ ফরিদ। ভ্যাজর ভ্যাজর করিস না। ফরিদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। গল্প গুজব করে খাওয়া দাওয়া করতে তার ভাল লাগে। দুলাভাই টেবিলে থাকলে তা সম্ভব হয় না। সোবাহান সাহেব মিনুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আজও ইলিশ? পর পর তিন দিন ইলিশ হয়ে গেল না?

কি করব, বাজারে মাছ নেই। কাদেরকে পাঠালে ইলিশ নিয়ে চলে আসে। মাছের খুব আকাল।

সোবাহান সাহেব মিলির দিকে তাকিয়ে আফসোসের স্বরে বললেন, এই দেশ মাছে এক সময় ভর্তি ছিল। মেঘের ডাক শুনে ঝাঁক বেঁধে কৈ মাছ পানি ছেড়ে শুকনায় উঠে পড়ত। মাছের জন্যে আমরা কি করতাম জানিস? নৌকা ড়ুবিয়ে রাখতাম। কয়েকদিন পর পর সেই নৌকা তুলে পানি সেছা হত। আর তখন–

দুলাভাই, কিছু মনে করবেন না। আপনাকে ইন্টারাপ্ট করি। না করে পারছি না। আমাকে চুপ করে থাকতে বলে নিজে সমানে কথা বলে যাচ্ছেন এটা কেমন হল? প্রাচীন একটা আপ্ত বাক্য হচ্ছে–আপনি আচারি ধর্ম পড়কে শেখাও। আপনি তা করছেন না।

সোবাহান সাহেব সরু চোখে ফরিদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ফরিদ সেই দৃষ্টি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করল। মিলি মিনতি মাখা চোখে মামার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ বলছে–মামা, তোমার পায়ে পড়ছি বাবার সঙ্গে ঝগড়া বঁধিও না। মিলি চোখের ভাষা ফরিদকে কাবু করতে পারল না। সে উৎসাহের সঙ্গে বলে চলল,

আমাদের প্রফেটের সেই বিখ্যাত গল্পটা কি আপনার মনে আছে দুলাভাই? এক লোক তাঁর কাছে গিয়ে কাতর গলায় বলল, হুজুর বড় সমস্যায় পড়েছি, আমার মধ্যম পুত্ৰ শুধু মিষ্টি খেতে চায়—

এই গল্পটি আমার জানা আছে ফরিদ।

আমারও ধারণা আপনার জানা আছে কিন্তু গল্পের মোরাল আপনি হয় ধরতে পারেননি কিংবা নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে চাননি।

মিলি বলল, এই প্রসঙ্গটা থাক মামা। তোমার যদি এতাই কথা বলতে ইচ্ছা! করে তাহলে অন্য কিছু নিয়ে কথা বল।

অন্য কি নিয়ে কথা বলব?

ছবি নিয়ে কথা বল। বাবা জান! মামা ছবি বানাবে, শর্ট ফ্রিম। ছবিটা দারুণ একটা কিছু হবে।

সোবাহান সাহেব বললেন, ভাল। বলেই প্লেট সরিয়ে উঠে পড়লেন। মিলি বলল, বাবার খাওয়াটা তুমি নষ্ট করলে মামা।

আমি কারো খাওয়া নষ্ট করিনি। পরিষ্কার যুক্তি দিয়ে দুলাভাইকে পরাস্ত করেছি। অবশ্যি তাঁকে পরাস্ত করা সহজ। তাঁর আই কিউ খুবই নিচের দিকে। আমার মনে হয়। গাছপালার আই কিউ-এর কাছাকাছি।

তোমার আই কিউ বুঝি আইনস্টাইনের মত?

আমি কারো সঙ্গে তুলনায় যেতে চাচ্ছি না। তবে বুদ্ধি বৃত্তির ক্ষেত্রে ১০০র ভেতর আমাকে ৯৩ থেকে ৯৫ দিতে পারিস।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। আর তোর বুদ্ধি হচ্ছে ৫৬ থেকে ৬২-র মধ্যে। আর একই স্কেলে দুলাভাইয়ের বুদ্ধি ১৮ থেকে ২২র মধ্যে উঠানামা করে।

তোমার তাই ধারণা?

হ্যাঁ এবং আমি আমার ধারণার কথা বলতে কোন রকম দ্বিধাবোধ করি না। কারণ সত্য হচ্ছে আগুনের মত। আগুন চাপা দেবার কোন উপায় নেই। আমি বুঝতে পারছি দুলাভাইয়ের বুদ্ধি কম বলায় তুই আহত হয়েছিস, কিন্তু উপায় কি যা সত্যি তা বলতেই হবে। আমার মুখ হয়তবা তুই বন্ধ করতে পারবি, কিন্তু পাবলিকের মুখ তুই কি করে বন্ধ করবি? পাবলিক এক সময় সত্যি কথা বলবেই।

বিকবকানি থামাও তো মামা।

থামাচ্ছি। কিন্তু প্ৰসঙ্গটা যখন উঠলই তখন এই বাড়িতে আমার পরই কার আই কিউ বেশি সেটা জানা থাকা বল। আমার পরই কাছে কাদের। অসাধারণ ব্রেইন।

চুপ করতো মামা। অসাধারণ ব্ৰেইন হল কাদেরের!

প্ৰপার এড়ুকেশন পেলে এই ছেলে ফাটাফাটি করে ফেলত।

তুমিতো প্রপার এড়ুকেশন পেয়েছ। তুমি কি করেছ?

করব। সময়তো পার হয়ে যায় নি। দেখবি দেশ জুড়ে একটা হুলুস্থুল পড়ে যাবে। তোদের এই বাড়ি বিখ্যাত হয়ে যাবে। লোকজন এসে বলবে—এটা একটা বিখ্যাত বাড়ি। তোদের বই লিখতে হবে— মামাকে যেমন দেখেছি কিংবা কাছের মানুষ ফরিদ মামা—।

কিছু মনে করো না, আমার ধারণা তোমার আই কিউ খুবই কম।

ফরিদ উচ্চাঙ্গের হাসি হাসল। তার সম্পর্কে অন্যদের ধারণা তাকে খুব মজা দেয়। এটা হচ্ছে পৃথিবীর যাবতীয় প্রতিভাবান ব্যক্তিদের সাধারণ ট্র্যাজেডি। প্রিয়জনরা তাদের বুঝতে পারে না। আড়ালে হয়তবা হাসাহাসিও করে। করুক। তাদের হাসাহাসিতে কিছু যায় আসে না।

কাদের এসে ঢুকল। গম্ভীর মুখে ঘোষণা করল, নতুন ভাড়াটে চলে এসেছে। সে মুখ কুঁচকে বলল, এক মালগাড়িতে বেবাক জিনিস উপস্থিত। ফকির্যা পার্টি।

বলেই সে আবার বারান্দায় চলে গেল। নতুন ভাড়াটের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা দরকার। ফুলের গাছ টাছ না ভেঙে ফেলে। এই বাড়িতে তার অবস্থান সম্পর্কেও জানিয়ে দেয়া দরকার। ভাড়াটে যদি তাকে সামান্য একজন কাজের মানুষ মনে করে তাহলে মুশকিল। প্রথম দর্শনে মনে করে ফেললে সারাজীবনই মনে রাখবে। যখন তখন ডেকে বলবে, এক প্যাকেট সিগারেট এনে দাওতো, চিঠিটা পোস্ট করে দাওতো, এক দৌড়ে খবরের কাগজটা এনে দাও।

আনিস রিক্সা করে এসেছে। টগর এবং নিশা দুজনেই গভীর ঘুমে। মিলিদের বসার ঘরের দরজা খোলা। আনিস বাচ্চা দুটিকে বসার ঘরের সোফায় শুইয়ে আবার বাইরে এসে দাঁড়াল। কাদেরের দিকে তাকিয়ে বলল, কাদের তুমি সুটকেস দুটা উপরে দিয়ে আসতো।

কাদের তৎক্ষণাৎ বলল, কুলীর কাম আমি করি না ভাইজান। সৈয়দ বংশ।

বখশীস পাবে।

এই বংশের লোক বখশীসের লোভে কিছু করে না ভাইজান। আমরা হইলাম আসল। সৈয়দ। বোগদাদী সৈয়দ।

আনিস নিজেই জিনিসপত্র টানাটানি করে তুলতে লাগল। ঠেলাগাড়ির লোক দুটি উপরে কিছু তুলবে না। দোতলার ছাদে তোলা হবে এই কথা তাদের বলা হয়নি। এখন যদি তুলতে হয় পঞ্চাশ টাকা বাড়তি দিতে হবে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে আনিসের হাতে এই মুহুর্তে পঞ্চাশটা টাকাও নেই। এ বাড়িতে সে কপর্দক শূন্য অবস্থাতেই এসে উঠেছে।

মিলি কি করতে জানি বসার ঘরে ঢুকেছিল। সোফাতে দুটি শিশুকে শুয়ে থাকতে দেখে সে এগিয়ে এল। আহ কি মায়া কাড়া চেহারা। দুটি দেবশিশু যেন জড়ােজড়ি করে শুয়ে আছে। মেয়েটির মাথাভর্তি রেশমি চুল। চোখের ভুরুগুলো যেন কোন চৈনিক শিল্পী সুক্ষ তুলি দিয়ে এঁকেছে। কমলার কোয়ার মত পাতলা ঠোট বার বার কেঁপে উঠছে। বাচ্চাটিকে কোলে নেবার এমন ইচ্ছা হচ্ছে যে মিলি রীতিমত লজ্জা লাগছে। মিলি দোতলার ছাদে উঠে গেল। আনিস খাটের ভারী একটা অংশ টেনে টেনে তুলছে।

মিলি বলল, আপনি এত কষ্ট করছেন কেন? আপনার ঠেলাগাড়ির লোকজন কোথায়?

ওরা চলে গেছে।

দাঁড়ান আমি কাদেরকে পাঠাচ্ছি।

না থাক। বেচারা সৈয়দ বংশের মানুষ কুলীর কাজ করবে না। আমার অসুবিধা হচ্ছে না। তুলে ফেলেছি।

তইতো দেখছি। আপনার স্ত্রী কোথায়?

ও আসে নি।

আসে নি মানে? মাকে ছাড়াই বাচ্চা দুটি চলে এসেছে?

হুঁ।

উনাকে কবে আনবেন?

তাকে আনা সম্ভব হবে না। সে আসবে না।

আপনার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।

ও মারা গেছে।

বেশ কিছুক্ষণ সময় মিলি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। এত বড় একটা খবর তার হজম করতে সময় লাগল। মিলি বলল, বাচ্চা দুটির মা নেই শুনে আমার খুব খারাপ লাগছে। এটা নিয়ে আপনি রহস্য করবেন তা ভাবিনি। আপনি হয়ত খুব রসিক মানুষ, সব কিছু নিয়ে রসিকতা করা হয়ত আপনার অভ্যাস কিন্তু এটা অন্যায়।

আনিস বলল, ঠিক এই ভাবে কিছু বলিনি। ওর মৃত্যুর কথা সরাসরি বলতে খারাপ লাগে বলেই অন্য পথে বলতে চেষ্টা করি।

আর করবেন না।

আচ্ছা আর করব না।

আনিস মুগ্ধ হয়ে লক্ষ্য করল মিলি নামের এই মেয়েটি তার ঘর গুছিয়ে দিল। মশারি খাটিয়ে দিল, টগর এবং নিশাকে কোলে করে এনে বিছানায় শুইয়ে দিল। মেয়েরা প্রাকৃতিক নিয়মেই মমতাময়ী, কিন্তু এই মেয়েটির মধ্যে মমতার পরিমাণ অনেক অনেক বেশি।

আনিস বলল, আপনাকে অনেক যন্ত্রণার মধ্যে ফেললাম।

তা ঠিক। কাল সকালেই আমার টিউটোরিয়াল। কিছুই করা হয় নি।

আপনি আমার জন্যে অনেক কষ্ট করেছেন কাজেই আমি আপনার ক্ষুদ্র একটা উপকার করতে চাই। এ গুড টার্ন ফর এ গুড টার্ন।

মিলি বিস্মিত হয়ে বলল, কি উপকার করতে চান?

একটা উপদেশ দিতে চাই যা আপনার খুব কাজে আসবে। উপদেশটা হচ্ছে আমার বাচ্চা দুটিকে একেবারেই পাত্তা দেবেন না।

সে কি!

ওদের একজনই আপনাকে পাগল করে দেবার জন্যে যথেষ্ট। দুজন মিলে কি করবে। তার বিন্দু মাত্র ধারণাও আপনার নেই। কাজেই সাবধান।

মিলি হাসল। আনিস বলল, আপনার হাসি দেখেই বুঝতে পারছি আমার কথা আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না। সাবধান করে দেবার দরকার ছিল করে দিয়েছি।

যেতে। রাত জাগা পুরোপুরি বারণ। ডাক্তারের উপদেশ মত কিছুদিন তাই করলেন। দেখা গেল রাত দশটার দিকে ঘুমুতে গেলে ঘুম আসে। দেড়টা দুটায় দিকে অথচ বারটার দিকে ঘুমুতে গেলে দশ পনেরো মিনিটের মধ্যে ঘুম চলে আসে। কিছুদিন হল তিনি তার নিজস্ব নিয়ম চালু করেছেন— রাত বারোটায় ঘুমুতে যান। তবে তিনি জানেন না যে শোবার ঘরের ঘড়ি এক ফাঁকে মিলি একে এক ঘন্টা আগিয়ে রাখে।

শোবার ঘরের ঘড়িতে এখন বারোটা বাজছে। যদিও আসল সময় রাত এগারেটা। মিনু ঘরে ঢুকলেন। হাতে বরফ শীতল এক গ্রাস পানি। বিছানায় যাবার আগে সোবাহান সাহেব ঠান্ডা এক গ্লাস পানি খান। মিনু পানির গ্রাস টেবিলের পাশে রাখতে রাখতে বললেন, ঘুমুবে না?

সোবাহান সাহেব বললেন, একটু দেরী হবে মিনু। তুমি শুয়ে পড়।

দেরী হবে কেন?

একটা বিষয় নিয়ে ভাবছি।

কি নিয়ে ভাবছ?

দেশে মাছের যে ভয়াবহ সমস্যা। ঐটা নিয়ে ভাবছি। কি করা যায়। তাই—

ঐ সব ভাববার লোক আছে। তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না।

এই তো একটা ভুল কথা বললে মিনু। দেশের সমস্যা নিয়ে সবাইকে ভাবতে হবে। সবাই যদি ভাবে তাহলেই সমস্যার কোন একটা সমাধান বের করা যাবে।

বেশতো সকাল বেলা সমাধান বের করবে। বারটা বাজে, এখন শুয়ে পড়। নাও পানিটা খাও।

সোবাহান সাহেব চোখ থেকে চশমা খুলে রেখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন। হাসতে হাসতেই বললেন, ঘড়িতে বারটা বাজে না, বাজে এগারোটা। তোমরা এই ঘরের ঘড়ি এক ঘণ্টা আগিয়ে দাও। যেদিন প্রথম করলে সেদিনই টের পেয়েছি। তোমাদের বুঝতে দেই নি। তোমরা যা করছ, আমার প্রতি মমতাবশতাই করছ, তবু কাজটা ঠিক না। তোমরা ধোঁকা দেবার চেষ্টা করছি। ধোকা দেয়া অন্যায়। যাও শুয়ে পড়।

মিনু কথা বাড়ালেন না, শুয়ে পড়লেন। স্বামীকে তিনি খুব ভাল করে চেনেন। এই মুহুর্তে তাকে ঘাটানো ঠিক হবে না।

মিনু।

বল।

আচ্ছা বলতো তোমরা কি আমাকে খুব অল্প বুদ্ধির মানুষ বলে মনে করা?

তা মনে করব কেন?

এই যে ঘড়ির কাটা এক ঘণ্টা আগিয়ে দিলে, মনটাই একটু খারাপ হল। তোমরা আমাকে নিয়ে এমন একটা ছেলেমানুষী ব্যাপার করছ।

মিলি করেছে। এই সব মিলির বুদ্ধি। দাও এক্ষুণি ঠিক করে দিচ্ছি।

দরকার নেই। আমার ঘরের ঘড়ি এক ঘণ্টা এগিয়েই থাকুক। আমি মানুষটা অবশ্যি অনেকখানি পিছিয়ে আছি। এই দিক দিয়ে ঠিকই আছে। তুমি ঘুমাও মিনু। বয়সতো শুধু আমার একার বাড়ছে না, তোমারও বাড়ছে। আমার যেমন বিশ্রাম দরকার, তোমারও দরকার। সমাজটাই এমন যে পুরুষের প্রয়োজনটাই বড় করে দেখা হয়। মেয়েদেরটা দেখা হয় না। এই সমস্যা নিয়েও ভাবতে হবে।

সোবাহান সাহেব নিজেই উঠে ঘরের বাতি নিভিয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে দিয়ে চেয়ারে বসলেন। তার সামনে একটা বিশাল খাতা। খাতায় লেখা–মৎস্য সমস্যা। খাতার প্রথম পাতায় এদেশের সব রকম মাছের নাম লেখা আছে। দেশে কত ধরনের মাছ পাওয়া যায়, কোন অঞ্চলে কোন মাছের কি নাম সব আগে লেখা দরকার। সব জাতের মাছের ব্রিডিং টাইম কি এক–না একেক মাছের একেক সময় তাও জানা দরকার। মাছের খাবার কি?

সোবাহান সাহেবের মন খারাপ লাগছে, তিনি মাছের দেশের মানুষ অথচ মাছের ব্যাপারে প্রায় কিছুই জানেন না। শুধু জানেন বৈশাখ জৈষ্ঠ্য মাসে যখন আকাশ গুড় গুড় করে উঠে তখন কৈ মাছের ঝাক পানি ছেড়ে শুকনোয় উঠে আসে। রহস্যময় ব্যাপার। এই পৃথিবী যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি কত অদ্ভুত রহস্য চারদিকে দিয়েছেন। তাকে চিনতে হবে। এইসব রহস্যের মাঝে।

বারান্দায় মিলি হাঁটছে।

হাঁটতে হাঁটতে গুনগুন করে গাইছে। মেয়েটার গানের গলা চমৎকার অথচ ভাল করে গান শিখল না। তার ইচ্ছা করল মেয়েকে ডেকে পাশে বসিয়ে গান শুনেন। তা সম্ভব হবে না। গাইতে বললে মিলি গাইতে পারে না। সে না-কি গান করে নিজের জন্যে, অন্য কারো জন্যে না।

মিলি গাইছে—

বলি গো সজনী যেয়ো না, যেয়ো না
তার কাছে আর যেয়ো না।
সুখের সে রয়েছে, সুখে সে থাকুক,
মোর কথা তারে বোলো না বোলো না।

সুন্দর গানতো। সোবাহান সাহেবের মন আনন্দে পূর্ণ হল। তিনি খাতা বন্ধ করে বারান্দায় এসে দাড়ালেন। মিলি রেলিং-এ হেলান দিয়ে আছে। আকাশ ভরা জোছনা। কি অপরূপ ছবি। এমন সুন্দর পৃথিবী ফেলে রেখে তাঁকে চলে যেতে হবে ভাবতেই কষ্ট হয়। স্বৰ্গ কি এই পৃথিবীর চেয়েও সুন্দর হবে? তাও কি সম্ভব?

মিলি গান বন্ধ করে বাবার দিকে তাকিয়ে করুণ গলায় বলল, আমার মন অসম্ভব খারাপ হয়ে আছে। বাবা।

কেন?

কাল আমার টিউটোরিয়েল, কিছু পড়া হয়নি। পড়তে ভাল লাগে না, কিযে করি!

সোবাহান সাহেব সিস্নেহে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। মিলি বলল, জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা আমরা পড়ালেখা করে নষ্ট করি। কোন মানে হয় না।

চলবে📌