বাঁধনহীন সেই বাঁধন অকারণ পর্ব-১৩+১৪

0
568

#বাঁধনহীন_সেই_বাঁধন_অকারণ|১৩|
#শার্লিন_হাসান

-কী হলো এখনো দাঁড়িয়ে থাকবি এখানে? যা তোর ছেলেকে নিয়ে বেড়িয়ে যা আমার বাড়ী থেকে।

-রাইহান তুমি বুঝার চেষ্টা করো।

-চুপ একদম চুপ। জিয়াউলকে কী বলবি? আমি তার সাথে বেঈমানী করেছিলাম বিজন্যাসে? যা বল গিয়ে আমার কিছু যায় আসে না। আর কী থ্রেট দেওয়া বাকী আছে? আমার সন্তানদের মেরে ফেলবি? আয় মারতি আয়! তেকে আমি জেলের ভাত না খাইয়েছি। আমার জাফিয়াকে তুই মেরেছিস।

-আমি মারিনি ও হার্ট অ্যাটাক করেছে এটার জন্য তুমি দায়ী রায়হান।

ঠাস করে চড় বসে যায় সাদিয়ার গালে। রক্তচক্ষু করে রাইহান চৌধুরী বলে,

-চুপ একদম চুপ। আমার দোষ দেওয়ার আগে নিজের দিকে তাকা। তুই তো আমায় ফাঁসিয়ে বিয়ে করেছিস। আমি তো বললাম আমি তোকে ডিভোর্স দেব। তারপর তো গেলি আরেক লোকের কাছে। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক করে আমায় ফাঁসালি।

-ওইসব তো!!

-আর একটা কথা বললে তোর লা’শ যাবে। যা বের হ আমার বাড়ী থেকে।

কথাটা বলে সাদিয়াকে ধাক্কা দেয় রাইহান চৌধুরী যার ফলস্বরূপ দরজার বাইরে চলে যায় সাদিয়া।

-যা বের হয়ে যা তোর ছেলেকে নিয়ে।

সাদিয়া আসে আয়মানের রুমে। সে রুমের লাইট অফ করে মুভি দেখছিলো। হঠাত লাইট জ্বলে উঠাতে বিরক্ত হয়। সাদিয়াকে দেখে বলে,

-কী হয়েছে? ডিস্টার্ব করেছো কেন?

-চলে আসো। তোমার বাবা আমাদের বাড়ী থেকে বের করে দিয়েছে।

-কিন্তু কেন?

-কারণ তুমি তার আসল সন্তান না। আর অতীতের কিছু ঘটনা সামনে এসেছে। চলে আসো এই বাড়ী এই প্রোপার্টির কোন অংশ তুমি পাবে না। তেমার অধিকার ও নেই।

-বললেই হয়ে গেলো। ওই রুদ্র? রুদ্রই তো? সবকিছুর মূল এই রুদ্র তাই না?

ছেলের আশকারা পেয়ে সাদিয়া এবার কেঁদেই দেয়। আয়মান রক্তচক্ষু করে তাকিয়ে আছে।

-এই রুদ্র। জাফিয়া মরেছে তো রুদ্রকে আর রাখিকে রেখে গেছে আমার সুন্দর সংসারটায় আগুন জ্বালানোর জন্য।

-তুমি চিন্তা করো না মা। রাখির সংসার আর রুদ্রর জীবন হেল করে দিতে আমার কয়েক ঘন্টার ব্যপার। এখন যাও রিলেক্স করো।

-তোমার বাবা তাড়িয়ে দিয়েছে আমায়। তিনমাস পর ডিভোর্স লেটার দিবে। তুমি তার সন্তান নও। এখন তোমার ও অধিকার নেই এই বাড়ীতে থাকার।

-কোথায় যাবো আমরা?

-আমার বান্ধুবার বাসায়। সেখানে বসে নতুন কিছু পরিকল্পনা করা যাবে। শুনেছি চৌধুরী বাড়ীতে নাকী খুশির আমেজ লেগেছে। এই খুশিকে দুঃখে পরিনত করে দিবো।

হাসে আয়মান। ফোন হাতে বেলকনিতে যায়। তার দলের কয়েকজনকে বলে দেয় রুদ্রকে কিডন্যাপ করে মে’রে শহর থেকে দূরে সরিয়ে দিতে।

নিজেও রেডি হয়ে নেয়। সাদিয়াকে নিয়ে লিভিং রুমে আসতে সাদবি আসে। তার মা ভাইকে চলে যেতে দেখে সাদবি বলে,

-কোথায় যাচ্ছো তোমরা?

-চলে যাচ্ছি। তুমি থাকো তোমার বাবার সাথে। আর কখনো আমার মুখ দেখবে না তুমি।

সাদিয়া বলে। সাদবি কোন রিয়েক্ট করে না। তার কাছে এই অন্দরমহল ভালো লাগে না। আর না এই পরিবার তার ইচ্ছে রুদ্র,রাখি,আরিশ,অর্ণব আরোহীর কাছে যেতে। সেই পরিবারের সাথে সময় কাটাতে থাকতে। দাদীর সাথে গল্প করতে। যৌথ পরিবার তার ভীষণ পছন্দের। অথচ নামগুলোই শুনে এসেছে এখন অব্দি কারোর মুখই দেখলো না সাদবি। মেয়েকে চুপ থাকতে দেখে সাদিয়া আবারো বলে,

-কিছু বলবে না সাদবি?

-কী বলবো? যাও না যাও। আমার ভালো লাগে না তোমাদেরকে। এই আয়মান ভাইয়াই তো রুদ্র ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড কী জেনো নাম হ্যাঁ আলিশা। আলিশা আপুকে রুদ্র ভাইয়ার থেকে সরিয়ে এনেছে। নিজে সম্পর্কে গেছে। রুদ্র ভাইয়াকে আপু ঠকিয়েছে শুধু মাত্র আয়মান ভাইয়ার জন্য।

-মুখ সামলে রাখো সাদবি।

আয়মান বলে। সাদবি পুনরায় বলে,

-কী সামলাবো? আমি সবই শুনেছি তুমি আমার বাবার সন্তান নও। যাও নিজের পরিবারের কাছে। আমার পরিবারের কারোর দিকে চোখ তুলে তাকাবে না তুমি।

-মা দেখো তোমার মেয়ে কেমন।

-পাপা!

ডাক দেয় সাদবি। রাইহান চৌধুরী আসেন। তখন সাদবি বলে,

– এই ছেলেটা আমায় থ্রেট দিচ্ছে। একে বলো চলে যেতে।

সাদবির কথায় রাইহান চৌধুরী গলে যান। তার মেয়েটা চঞ্চল বৈকি তবে আয়মানকে পছন্দ করে না। মূলত তার চলাফেরা কথাবার্তার জন্য। আর না তাদের ভাই বোন হিসাবে কোন ভালো সম্পর্ক ছিলো তেমন। তখন রাইহান চৌধুরী বলেন,

-বেড়িয়ে যা আমার বাড়ী থেকে।

চলে আসে আয়মান এবং সাদিয়া। সাদবি তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে। মেয়েটা ওতোটাও অবুঝ না। এবার ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে। মা ভাইয়ের কীর্তি এতোদিন দেখেছে। সেই সাথে আলিশাকে নিয়ে করা নাটক সবই সাদবির জানা।

-আমি দাদীনের কাছে যাবো। তাঁদের সাথে পরিচিত হবো। প্লিজ আমায় নিয়ে চলো বাবা।

-এখন না মা। আমরা আগামী কালকে যাবো।

-আচ্ছা। প্রমিস করো আগামী কালকে নিয়ে যাইবা?

-প্রমিস করলাম।

*****

পরের দিন সকাল থেকে তোরজোর চলছে খান বাড়ীতে। কিছুক্ষণ পর বরযাত্রী আসবে আর বিয়ে হবে। আলিশাকে রেডি করাচ্ছে পার্লারের মেয়েরা৷

এরই মাঝে খবর আসে বর এসেছে। সবাই বর দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তবে প্রিতী,সুমাইয়া আলিশার কাছেই বসে থাকে। তারা রুদ্রর কথা ভাবছে। আহারে! কিছুই তো জানে না রুদ্র।

বিয়ে পড়ানোর কাজ শুরু করবে এমন সময় কোথা থেকে আয়মান আসে সাথে আসে তার দলবল। বাক্যব্যায় না করে হবু বর এবং বাকীদের মাথায় রিলভার ঠেকায় তার লোকেরা। আশরাফ খান তাঁদেরকে বাঁধা দিতে যায় তখন আয়মান বলে,

-শ্বশুর মশাই আমি আমার বউকে নিতে এসেছি। বিয়েটা আগেই হয়ে গেছে আমাদের। আমার বউকে অন্য কারোর হাতে তুলে দিবেন আমি চেয়ে, চেয়ে দেখবো নাকী?

বাক্যহারা হয় আশরাফ খান। ইতোমধ্যে শোরগোল, কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে। আয়মান সেসব উপেক্ষা করে আলিশার রুমের দিকে অগ্রসর হয়। আলিশাকে বউ সেজে বসে থাকতে দেখে মেজাজ বিগড়ে যায়। আয়মানকে দেখে উঠে দাঁড়ায় আলিশা। এরই মধ্যে আয়মান স্ব জোরে চড় বসিয়ে দেয় আলিশার গালে। গাল চেপে ধরে বলে,

-এতো বাড় বেড়েছিস তুই? আমাকে ধোঁকা দিবি? কী মনে করেছিস আয়মান আরহাম চৌধুরীর কানে কোন খবর যায় না? আমি রুদ্র না যে অন্ধের মতো পড়ে থাকবো। আয় এক্ষুনি তোর বাবা মায়ের সামনে তোকে বিয়ে করবো আর প্রোপার্টি তোর নামে লেখাবো।

আলিশার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। কান্না থামছে না। প্রিতী সুমাইয়া এগিয়ে আসতে যাবে আয়মান হাতের ইশারায় থামিয়ে দেয়। আলিশাকে টেনে নিচে আনে। বাকীরা চুপচাপ কারণ তাদের অনেকের মাথায় রিলভার ঠেকানো। তখন আলিশা আয়মানের হাত ঝাড়ি মেরে সরিয়ে দেয়।

-ডোন্ট টাচ্ মি! গেট লস্ট।

পুনরায় আয়মান আলিশার হাত ধরে শক্ত করে। বাক্যব্যায় না করে নিচে আসে। আলিশাকে সোফায় বসিয়ে নিজেও তার পাশে বসে, কাজীকে বলে,

-বিয়ে পড়ানো শুরু করুন।

কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করে। আয়মান তিনবার কবুল বলে ফেলে আলিশাকে কবুল বলতে বললে আলিশা চুপসে যায়। সে কবুল বলবে না। আয়মান বিশ্রী কয়টা গালি দেয় আলিশাকে। ধমকের স্বরে বলে,

-প্রেম করার সময় মনে ছিলো না জান? এখন বিয়ে করতে কেনো এতো কষ্ট?

-আমি বিয়ে করবো না। রুদ্র কোথায়?

আবারে চড় বসে যায় আলিশার গালে। ধমক দেয় আয়মান।

-কবুল বলবি?

-না।

-তাহলে তোর বাবাকে তোর সামনে গত করে দেই?

-না,না। কবুল বলবো।

-বল তাহলে?

-কবুল,কবুল,কবুল।

আলিশা বলে আয়মান উঠে দাঁড়ায়। আশরাফ খানের সামনে এসে বলে,

-বিয়েটা তো হয়ে গেলে শ্বশুর মশাই এবার থাকার ব্যবস্থা করুন আপনার একমাত্র মেয়ের এবং মেয়ের জামাইয়ের।

উত্তর দেয় না আশরাফ খান। আয়মান অনুমতি দিতে রিলভার নামায় তার লোকেরা। তখন শাহরিয়ার সায়ন্তিক শিকদার উঠে দাঁড়ায়। আশরাফ খানকে বলে,

-ছিঃ আংকেল ছিঃ। মেয়েকে তো শিক্ষা দিতে পারেননি শুধু,শুধু আমাদের সময় আর টাকা নষ্ট করালেন। এর ক্ষতি পূরণ না দিলে আপনার নামে কেস করবো।

সায়ন্তিকের কথায় অনেকে অবাক হয়। এই জেনো নিয়ম উল্টে নিলো। বিয়ে করতে এসে বিয়ে করতে পারেনি বলে সময় আর টাকার ক্ষতিপূরণ চায় হবু বর। আশরাফ খান বললেন,

-আগে মেয়েটাকে শিক্ষা দেই তারপর ক্ষতিপূরণ দিচ্ছি তোমার। এখন আসতে পারো।

আশরাফ খানের কথায় শিকদার পরিবার চলে যায়। আলিশা দাঁড়িয়ে, দাঁড়িয়ে কাদছে। আশরাফ খান পুনরায় চড় মারে আলিশাকে। চড়টা একটু বেশী জোরে পরেছে যার দরুন আলিশা নিচে পড়ে যায়। চিৎকার করে উঠে আশরাফ খান।

-এক মাত্র মেয়ে আদরে যত্নে বড় করেছি এতো সুন্দর দিন,সময়,সন্মান উপহার পেতে। ছিঃ!

-প্রোপার্টিটা মেয়ের নামে লিখে দিন শ্বশুর মশাই।

আয়মানের কথায় আশরাফ খান তার গালেও চড় বসিয়ে দেয়। তবে একটা না দুই দু’টো চড়।

-প্রোপার্টির জন্য আমার মেয়েকে ফাসিয়েছো? গুন্ডা কোথাকার। যাও বেড়িয়ে যাও তোমার বউকে নিয়ে খান মহল থেকে। আমার মেয়ে নেই আজকে থেকে আর মেয়ের জামাই তো দূরে থাক।

-আলিশা তোর বাবাকে বল প্রোপার্টি তোর নামে লিখে দিতে।

উঠে দাঁড়ায় আলিশা। নিজেও স্ব জোরে চড় বসিয়ে দেয় আয়মানের গালে। রেগে যায় আয়মান। এরা বাপ মেয়ে দু’জন তার গাল দুটোকে সরকারি পেয়েছে। একটু পর পর শুধু চড় দিচ্ছে।

-জানো’য়া র কোথাকার। এই ছিলো তোর আসল উদ্দেশ্য? আমায় ঠকালি তুই। আমাকে আমার রুদ্রর থেকে কেড়ে নিলি? আসলে ঠিকই বলেছিস রুদ্র একপিস। রুদ্র, রুদ্রই রুদ্রর মতো কেউ হয়না। এমন রুদ্র হতে হলে তোকে হাজার বার জন্মগ্রহণ করতে হবে। দুইদিন না যেতে নিজের আসল রুপটা দেখিয়ে দিলি। আর রুদ্রর সাথে আমার সাড়ে তিনবছর সম্পর্ক ছিলো কোনদিন তুমি থেকে তুই শব্দটা মুখে আনেনি। তোর পারিবারিক শিক্ষার অভাব আছে বুঝলি?

-এই জানো য়া রে র সাথে তোকে বাকীটা জীবন কাটাতে হবে আলিশা।

কথাটা বলে আলিশার হাত টেনে হিচড়ে বাইরে নিয়ে আসে আয়মান। আলিশার কান্না পাচ্ছে। ভীষণ রকমের কান্না পাচ্ছে। রুদ্রকে ঠকালো সে আর আজকে সে বাজে ভাবে ঠকে গেলো। নিজের ভুলের জন্য আফসোস হচ্ছে বড্ড বেশী আফসোস হচ্ছে তার। আয়মান! তাকে কতোই না ভালো ভেবেছে আলিশা। অথচ মানুষ রুপী জানো য়া র একটা। এই জন্য বলে কারোর মিষ্টি কথায় না ভোলা আর কারোর চোহারা দেখে মিষ্টি কথা দেখে বিচার করা ঠিক না। সময় মতো আসল রুপ বেড়িয়ে আসে। এই রুদ্র যাকে আলিশা নব্বই দশকের প্রেম কাহিনী নিয়ে পড়ে থাকে। নব্বই দশকের প্রেমকাহিনী তুলে ধরতে চেয়েছেন আজকে আলিশার সেই নব্বই দশকের প্রেমকাহিনী তুলে ধরতে চাওয়া প্রেমিককে মনে পড়ছে। খুব করে চাইছে তাকে।
তার সাথে কাটানো মূহুর্ত গুলো চোখের সামনে ভাসছে।

#চলবে

#বাঁধনহীন_সেই_বাঁধন_অকারণ|১৪|
#শার্লিন_হাসান

সোফায় বসে আছেন আশরাফ খান। তার থেকে কিছু দূরে বসে আছে আফিয়া ইসলাম। কেউ কোন কথা বলছে না। সময় সন্ধ্যা গড়িয়ে। পূর্ণনিরবতা বিরাজমান খান বাড়ীতে। একমাত্র মেয়ে! সব শেষ আশরাফ খানের। আফিয়া ইসলাম ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছেন। এরই মাঝে কর্কশ ফোনটা বেজে উঠলো। তিক্ততা নিয়ে তাকায় ফোনের দিকে আফিয়া ইসলাম। তার বোন আরিয়া কল দিয়েছে। তড়িঘড়ি রিসিভ করে কানে দেয় আফিয়া ইসলাম। অপরপাশ থেকে আরিয়া ইসলাম বললেন,

-হ্যাঁ রে আফিয়া রোশানের তো বিয়ে ঠিক হয়েছে। আগামী কালকে তোরা সবাই চলে আয়। কালকের দিন পেড়িয়ে আর একটা দিন তারপর হলুদ সন্ধ্যা রোশানের। দেরী করবি না একদম।

-হ্যাঁ যাবো আগামী কালকেই যাবো।

-আচ্ছা আসিস। আলিশা কেমন আছেরে আফিয়া?

চুপসে যায় আফিয়া ইসলাম। কী বলবে? বোনকে তো বলাই হয়নি আলিশার বিয়ে ঠিক করেছিলো আর আজকে! ভেবে বুকটা ছ্যাৎ করে উঠে।

-আলিশা আছে ভালোই আছে হয়ত বা। আগামী কালকে বলবো সব।

-কী আগামী কালকে? এই আলিশার কী হয়েছে আফিয়া?

-ওকে জোর করে বিয়ে করে নিয়েছে আয়মান। ওর বয়ফ্রেন্ড ছিলো। জানো না আপু এখানে পরিস্থিতি বা’জে। আলিশার বাবাকে কী বলবো ভেবে পাচ্ছি না।

-আগামী কালকে চলে আয় আশরাফ কে নিয়ে।

-আসবো।

******

সোফায় বসে আছে আলিশা। তার সামনে আয়মান আর সাদিয়া বসে আছে। তাঁরা মা ছেলে দু’জন বেজায় খুশি। আলিশার ঘৃণা হয়। এই সাদিয়াকে সে কতই না ভালো ভেবেছে। এখন মনে হচ্ছে কুৎসিত একজন মানুষ। যার ভেতরটা কুৎসিত উপরটা চকচকা আয়না। মৌনতা বজায় রেখে সাদিয়া বলে,

-জানো আলিশা এই বাড়ীটা আমার বাবার বাড়ী। যদিও তারা কেউই বেঁচে নেই। এখন আপাতত এই বাড়ীতে আমরা থাকবো। কয়েকদিন যাক তোমার বাবাকে বলে তোমার নামে প্রোপার্টি টা নিয়ে নিও। এই পুরোন বাড়ীতে কয়দিনই বা থাকবো?

সাদিয়ার কথায় আলিশা মনে,মনে হয় কয়েকটা গালি দেয় সাদিয়াকে। এই ছিলো তাঁদের উদ্দেশ্য। ভাবতে রাগে গা জ্বলে। আলিশা পারছে না মা ছেলে দুটোকে চেয়ারে বেঁধে কিছুক্ষণ কারেন্টের থেরাপী,গরম খুন্তির থেরাপী দিতে।

-জান বিশ্বাস করো আমি কখনোই তোমার বাবার প্রোপার্টির দিকে নজর দিতাম না। বাট একটাই প্রব্লেম হয়ে সেটা হলো তোমার প্রাক্তন রুদ্র। রুদ্র এখন সব প্রোপার্টি পাবে আমি কিছুই পাবো না।

আলিশা কিছুই বুঝতে পারছে না। রুদ্রর সাথে আয়মানের কী সম্পর্ক আর কিসের প্রোপার্টির কথা বলছে আয়মান? আর সাদিয়া? সব তালগোল পাকিয়ে ফেলছে আলিশা। তখন আয়মান চটজলদি বলে উঠে,

-সিম্পল রুদ্র আমার সৎ ভাই। আমার সৎ ভাই বললে ভুল হবে আমার বোন সাদবির সৎ ভাই আর রুদ্র আমার কেউ না। তবে রুদ্রর বাবা আমায় প্রোপার্টি দিবে বলে বেঈমানী করেছে। সমস্যা নেই রুদ্রকে পথ থেকে সরিয়ে আমি প্রোপার্টি নিয়ে নেবো। আর শোনো আমি জানতাম রুদ্রর গার্লফ্রেন্ড তুমি সেজন্য রুদ্রর থেকে বাজ পাখির মতো ছোবল মেরে তোমায় নিয়ে নিলাম এবং ঠিক একই ভাবে প্রোপার্টিও আমার করে নেবো।

উঠে দাঁড়ায় আলিশা। নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে স্ব জোরে চড় বসিয়ে দেয় আয়মানের গালে। শার্টের কলার চেপে ধরে বলে,

-রুদ্রর গায়ে টাচ ও করবি না তুই। আর প্রোপার্টির চিন্তা মা ছেলে দুজনেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দে।

আলিশার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় আয়মান। রেগে বলে,

-তোরা বাপ মেয়ে দুজন আমার গাল দুটোকে কী পেয়েছিস? সরকারি সম্পত্তি? যে যখন খুশি তখন চড় বসিয়ে দিবি।

-আয়মান এই মেয়ে কী বললো শুনেছো? প্রোপার্টি নাকী নিবে না আর রুদ্রর গায়েও নাকী আঁচড় লাগতে দিবে না।

-ওর বলা কওয়াতে কিছু যায় আসে না। রুদ্রর খেলা শেষ করে দিবো তো আমি। এই আগামী কালকের মধ্যেই।

-আমাকে ভুলে গেলি আয়মান? রুদ্রর গায়ে একটা আঁচড় ও লাগতে দেবো না আমি।

-স্বামীর থেকে ভাসুরের প্রতি দরদ বেশী দেখছি তোর। চুপ কর একদম চুপ আর একটা কথা বললে খবর আছে তোর।

-আলিশা কারোর ধমকের নিচে থাকে না। তুই চুপ কর। রুদ্রকে নিয়ে আর একটা কথা মুখ দিয়ে বের করলে তোর মুখটাই আমি ভেঙে দেবো।

-আয়,আয় আমার মুখ ভাঙবি? পারলে ভেঙে দেখা?

দু’জনের মাঝে কথা কাটাকাটি শুরু হতে সাদিয়া থামায়।

-আর একটাও কথা না। এখন ডিনারের ব্যবস্থা করতে হবে। পুত্রবধু চলে আসো রান্না বসাতে হবে।

-এতো পারবো না। আপনাদের খাওয়ার প্রয়েজন হলে নিজে রান্না করে খান। আর আমায় পুত্রবধূ বলবেন না আমার নাম আছে পারলে নাম ধরে ডাকবেন।

সাদিয়া চলে যায় কিচেনে রান্নার জন্য। আলিশা সোফায় ধপ করে বসে পড়ে। এই মূহুর্তে তার এই বাড়ী থেকে চলে যেতে মন চাইছে। রুদ্র! রুদ্রর কিছু হবে না তো? এই আয়মানের ভাবভঙ্গি ভালো ঠেকছে না। কিন্তু সেই বা কী করবে? ডিভোর্স দিবে? হ্যাঁ কিন্তু তিনমাস তো অপেক্ষা করতে হবে। এই আয়মান এতো সহজে তাকে ছেড়ে দিবে?

-জান আজকে আমাদের ফুলসজ্জার রাত মনে আছে?

-ফুলসজ্জা মাই ফুট। আর একটা কথা বলবি না তুই। আগামী কালকেই আমি চলে যাবো আর ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেবো।

-ডিভোর্সের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো জান। তুমি তো চাইতে আমি তোমার হই, তুমি আমার হও?

উত্তর দেয় না আলিশা। বাড়ীটা খুঁটিয়ে, খুঁটিয়ে দেখছে। পুরোনো বাড়ী তবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা। হয়ত বা এটা কেউ দেখাশোনা করে রাখা হয়। নিজের দিকে একবার চোখ ভোলায় আলিশা। বিয়ের শাড়ীটা এখনো চেন্জ করেনি সে। করবে কীভাবে? আর জামাকাপড় ই তো সাথে নেই।

****

আড্ডা দিচ্ছে রাখি,রুদ্র,আরিশ,অর্ণব, আরেহী। আলিশাকে নিয়ে কথা বলছে। বাকীরা রুদ্রর বিয়ের প্লানিং করছে। রুদ্র শুধু শুনেই যাচ্ছে সবার প্লানিং। তখন রাখি বলে,

-আলিশার সাথে বিয়েটা হবে আর এই বাড়ী চলে আসবে ভাই। ওই বাড়ীতে যাওয়ার দরকার নেই। যৌথ পরিবার কত সুন্দর দেখো? দোখো?

রাখির কথায় আরিশ বলে,

-রুদ্র ভাই তাড়াতাড়ি বিয়েটা করে নেও। সিরিয়ালে অর্ণব তারপর আমি আছি ভাই।

-তুই তো মেঘকে বিয়ে করবি তাহলে এতো তাড়া কিসের? ওয়েট কর? ওর বড় হোক তারপর।

-এহহ বললেই হলো মেঘকে বিয়ে করবে। মেঘের জন্য অন্য কেউ আছে। আরিশ তুই নতুন কাউকে জুটিয়ে নে। আর মেঘ তোকে পাত্তা দিবে না।

রাখির কথায় আরিশ বলে,

-কেনো মেঘ পাত্তা দিবে না? আরিশ চৌধুরীর মতো কয়জন আছে? মেঘের সাত কপালের ভাগ্য আমায় পাবে।

তখন অর্ণব আরিশের মাথায় গাট্টি মেরে বলে,

-বড় ভাই দু’জন বাকী আছে। তাঁদের দিকে তাকাও বাবু! তারা এখনো বিয়ে করলো না আর তুমি মেঘকে বিয়ে সাদী করে একবারে দুনিয়া উল্টে ফেললে?

-মেঘ,মেঘ আর মেঘ ভালো লাগে না। ও এখানে আছে ভাই? ওকে নিয়ে এতো টানাটানি কেন? এই টপিক বাদ সবাই ডিনার করতে আসো।

কথাটা বলে রুদ্র উঠে চলে আসে। বাকীরা তাকিয়ে আছে। আসলেই মেঘকে নিয়ে বেশী বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে তাদের মাঝে।

*****

বাইরে থেকে এসেছে,মেঘ,মায়া,মোহনা। ঘুরতে বের হয়েছিলো তারা। মায়া,মোহনা চটজলদি ফ্লাটে যাচ্ছে। আজকে লেট হয়ে গেছে। মেঘ আস্তে,আস্তে আসছে। তিনতালায় আসতে কারোর সাথে ধাক্কা লাগে। সামনের দিকে পরে যেতে নিবে ধাক্কা দেওয়া ব্যক্তি মেঘের হাত ধরে নেয়।
চোখমুখ বন্ধ করেই মেঘ বলে ফেলে,

-আজকে আবার কোন শা’লাকে কুকুরে দৌড়ানি দিলো? যে এতো তাড়াহুড়োয় নামছে। ভালো চোখের ডাক্তার দেখানো উচিত।

মেঘের কথায় রাগ হয় নিবরাসের। হাত ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড় করায় মেঘকে।
মেঘ থমকে দাঁড়ায় সামনের ব্যক্তিকে দেখে। মেঘকে দেখে নিবরাস বলে,

-আপনি সেই কোমড় ভাঙা, লাউডস্পিকার মেয়েটা না? আবার এখানে কী করছেন?

রাগ হয় মেঘের। সে নিজেই তো ধাক্কা দিয়ে ফেলেছিলো তাকে।আ বার বলে আপনি সেই কোমড় ভাঙা মেয়েটা না? মেঘকে চুপ থাকতে দেখে নিবরাস বলে,

-আপনি এখানে? এই বাড়ীতে ভাড়াটিয়া নাকী?

-বাড়ীটা কী আপনার?

মেঘের এমন কথায় ভড়কে যায় নিবরাস। সে কী বললো আর মেয়েটা তাকে কী বললো। মুখটাকে ছোট করে নিবরাস উত্তর দেয়,

-হ্যাঁ বাড়ীটা আমাদেরই।

-ওহ্! আপনি চোখের ডাক্তার দেখাননি? আজব মেয়ে দেখলে ধাক্কাধাক্কি করতে মন চায়?

-চোখ আমার ঠিকই ছিলো। সমস্যা হলো আপনার সাথে কেনো ধাক্কা লাগতে যায়? আমার আশে-পাশে এতো নার্স ঘুরাঘুরি করে কই কোনদিন তো তাঁদের সাথে ভুল করে ধাক্কা লাগলো না।

-আমি কী করে জানবো কেন তাঁদের সাথে ধাক্কা লাগে না আমার সাথেই লাগতে আসে। অসভ্য লোক নিজের মন মানসিকতা বদলান।

কথাটা বলে মেঘ উপরের দিকে অগ্রসর হয়। নিবরাস মুচকি হাসে। কোমড় ভাঙা লাউডস্পিকার মেয়েটা এখানে আবারো? তড়িঘড়ি হসপিটালে যাচ্ছিলো নিবরাস। মেঘের সাথে ধাক্কা লাগবে বুঝতে পারেনি। ভেবে, পরক্ষণে ঘড়ির দিকে নজর দেয় নিবরাস। অলরেডি দশমিনিট ওভার। তার তাড়াতাড়ি যেতে হবে হসপিটালে।

ফ্রেশ হয়ে সোফায় বসে টিভিতে ধ্যান দে য় মেঘ।

– অন্ধ লোকটাকে এখানে কী করছে? ওহ্ ওনারই তো বাড়ী এটা। ধুর জাহান্নামে যাক অন্ধ লোক আমার কী? শালা হারামি মেয়ে দেখলে ধাক্কা খেতে মন চায়। আবার কীভাবে বলে নার্সদের সাথে ধাক্কা লাগে না কেন? এমন বজ্জাত দু’একটা সোজা না করতে পারলে নারী তুমি ব্যর্থ।

হসপিটালে এসে নিজের ডেস্কে যায় নিবরাস। আর বিশমিনিট পর একটা অপারেশন আছে সেই সাথে তিনটা ওটি আছে। তখন তার এসিস্ট্যান্ট একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট আসে। নিবরাসকে দেখে শাম্মি বলে,

-হ্যালো স্যার! কেমন আছেন?

নিবরাস মুচকি হেসে বলে,

-আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?

-আলহামদুলিল্লাহ।

এরই মাঝে নিবরাসের ফোন বেজে উঠে। শাম্মি প্রস্থান করে। নিবরাস ফোন হাতে নিতে দেখলো তার বোন কল দিয়েছে। রিসিভ করতে অপর পাশে মিসবাহর গলা শোনা গেলো।

-মামা বউমনিকে দেখেছি।

-বউমনি কে নিবরাস?

-ওই যে ধাক্কা দিলা ।

-তুমি কীভাবে দেখলা মিসবাহ?

-তোমার রুমের বেলকনি দিয়ে। পাশের বেলকনিতে দেখলাম ওই বউমনি দাঁড়িয়ে আছে। আমি হ্যালো বলেছি।

-তো মামু এটা বলার জন্যই কী কল দিলা?

-হ্যাঁ মামা। কিন্তু মামা বউমনি আমায় মিসবাহ সোনা বললো না। তোমার মতো করে।

-ও তোমায় চেনে নাকী মামু? আর অপরিচিত কেউ তোমায় এই নামে ডাকবে ও না। রাখো তো! ওই লাউডস্পিকারের কথা না বললেই নয়কী?

কথাটা বলে কল কেটে দেয় নিবরাস।

মিসবাহ পুনরায় বেলকনিতে আসে। মেঘ এখনো বেলকনিতে আছে। তখন মিসবাহ চিল্লিয়ে বলে,

-ও বউমনি আমায় মিসবাহ সোনা বলো না? আমার মামু আমায় এটা বলে। কী সুন্দর নাম।

মেঘ তাকিয়ে রয়। ছেলেটা বেশী পাকনামি করছে। কিসের বউমনি? হ্যাঁ? মেঘ বিরক্তি নিয়ে বলে,

-তোমার মামুকে বলো বউ করে নিতে তারপর তোমায় এই নামে ডাকবো।

কথাটা বলে বিরক্তি নিয়ে চলে আসে মেঘ। এখানে এসেও সে এক দন্ড শান্তি পাচ্ছে না। রুদ্রকে দেখার তৃষ্ণায় কাতর। কীভাবে সে দেখা পাবে রুদ্রর? দুই দিন হলো মুখটা দেখে না সে। তারউপর এমন উদ্ভট জনগনের সাথে দেখা।

#চলবে