#বাতাসে_তার_সৌরভ–১৭
” শোন নদু,আমার যদি ছেলে হয় নাম হবে এপোলো ,আর যদি মেয়ে হয় নাম হবে ভেনাস! কেমনরে?
” খ্রিস্টান খ্রিস্টান! ”
-ফোট মূর্খ, এটা গ্রীক মিথলজির দেবদেবীর নাম। আমার বাচ্চারা মুক্ত মনের মানুষ হবে, কোন সামাজিক বিধিনিষেধ ধর্মীয় অনুশাসন তাদের উপর খাটবে না। ”
নিশি কত বলিষ্ঠ গলায় কথাগুলো বলত। নদীর অবাক লাগত শুনতে। নিশি পূর্ণ বিশ্বাসে বললেও হয়তোবা তা যন্ত্রনাই ছিল যার জন্য এত বড় প্রলয়ের বিরুদ্ধে সে একা দাঁড়িয়েছিল। যা কিছু তারজন্য ভালো ছিল, সে বিষয়গুলো কেউ তাকে ভালোবাসতে না শেখালে তাকে কি সত্যি দোষ দেওয়া যায়? তখন হয়তো ভালোটাকেই মন্দ মনে হয়। স্বপ্নালু চোখ নিজের মতো পৃথিবী রচতে চায় অথচ বাস্তব পৃথিবীর জটিল অংকের হিসেবগুলোর সাথে লড়তে পারে না।
সারাদিনের ছোটাছুটি আর তীব্র চিন্তার ভারে নদীর গোটা শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে। ভয়াবহ সত্যি কিছু পরিস্থিতি আসলে বিচিত্র ঘোর পেয়ে যায় কখনো। ভয় আতঙ্কের উর্ধ্বে উঠে যায় অনুভূতিগুলো। নয়তো নিশিকে রম্য যখন পাজাকোলা করে গাড়িতে তুলছিলো তার ব্যাখ্যা তাকে কী দিয়েছিল মনে পড়ে না। নিশি নিজেও ভয় পেয়েছিল প্রচন্ড। অবচেতনের মধ্যেও শক্ত করে ধরেছিলো নদীকে।
” নদু নদু… আমার কিছু হলে মাকে বলিস আই এম সরি ফর বিং এ ব্যাট গার্ল।”
” নিশি একটু শান্ত হ’
“অনেক ব্যথা নদু অনেক ব্যথা”
“কমে যাবে ব্যথা ডাক্তার ওষুধ দেবে।”
” এত রক্ত কেন গেল রে? আমার বেবিটা কি ঠিক আছে?”
” ডাক্তার দেখুক, একটু চুপ কর” নদী নিজের কান্না চেপে বলছে।
নিশির তখন ড্রাইভিং সিটে জিএসের দিকেই নজর গেল “ওটা কে রে? তোর বাবুর্চি?সেই রকম হট তো ”
ভয়ংকর অবস্থাতেও এমন ফাজলামো শুধু নিশির পক্ষেই সম্ভব। কিন্তু পরিস্থিতি হাল্কা অনুভবে এড়ানো সম্ভব ছিলো না। নিশিকে নিয়ে ঘর থেকে বের হওয়া,
ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালিয়ে যাওয়া, পপুলারের ইমার্জেন্সিতে আসা..এতসব নদীর একার পক্ষে হতো কিনা জানা নেই। গ্যাব্রিয়েলের ছোটাছুটি দেখেই হাসপাতালের অনেকে এগিয়ে এলো। একের পর এক ঘটনার পসরায় নিয়তি তার সিদ্ধান্ত জানালো।
“আল্ট্রাসাউন্ড হয়ে গেছে এটা আর ভালো নাই, অনেক আগেই যা হবার হয়ে গেছে ,ব্লিডিং হয়েছে অনেক, ব্লাড ব্যাংকেও যেতে হবে। এখন ওয়াশ করতে ওটিতে নেওয়া হচ্ছে, এই জায়গায় একটা সিগনেচার করে দিতে হবে কে করবে? ”
নদীর কিংকর্তব্যবিমুঢ় অবস্থায় জি এস নো অবজেকশন পেপারে সিগনেচার করে দিলো। ডিউটিরত নার্স আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে ছিলো গ্যাব্রিয়েলের দিকে।
” আপনার ওয়াইফ?”
” সিস্টার” নদী উত্তর দিলো।
জি এস কি বুঝলো কে জানে, মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো ” শি ইজ মাই সিস্টার”
” হাজবেন্ডকে জানানো দরকার ছিলো ওয়াশ হবার পর কিন্তু… ”
” উনি দেশে নাই ” নদী এমনভাবে স্পষ্ট উত্তর দিলো যে নার্স মেয়েটা একটু থেমে গেলো।আসলে সত্যির থেকে মিথ্যাটা জোরেই বলতে হয়।
” ম্যাম তুমি রোগীর কন্ডিশন খুব স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছ। এখন তোমরা আগাতে পার। নিশ্চয়ই যেটা ঠিক সেটাই তোমরা করবে, আমরা অপেক্ষা করছি”
গ্যাব্রিয়েল শান্তকন্ঠে ইংরেজি সংলাপে কাজ হলো। মেয়েটি আর ঘাটালো না তাদের।
এরপরে যেন অনন্তকালের অপেক্ষা।জিএসকে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে ব্যাখ্যা অথবা কোন আত্মসমীক্ষা শোনানোর মতো অবস্থা নদীর ছিল না। গ্যাব্রিয়েলও বিনা বাক্যব্যায়ে তার পাশে থাকলো।সেই মুহূর্তে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে সাথের মানুষটা পশ্চিমাকেতায় বড় হওয়া।এমন অদ্ভুত পরিস্থিতিতেও অযাচিত কোন প্রশ্নের ধার দিয়ে গেলো না।
” টেক দিস “একসময় এটেন্ডেন্স চেয়ারে অপেক্ষা রত নদীকে জি এস একটা কোকের ক্যান এগিয়ে দিলেন।
” না স্যার ভালো লাগছে না”
” ভালো লাগার জন্য না, এনার্জির জন্য। অনেক স্ট্রেচ গেছে।”
” আমি ঠিক আছি,”
জি এস পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বলল ” আমি জানি তুমি স্ট্রং। তবে স্ট্রংদেরও এনার্জি লাগে। তুমি নিজের খেয়াল না রাখলে বোনকে দেখবে কী করে?এটা হাই ক্যাল, খেলে ভালো বোধ করবে, কাম অন ”
নদী ক্যান নিলো। রম্যও ছেড়ে গেলো না তাকে। সঙ্গ দেবার দায় কেউ না দিলেও তা একাই অর্পিত হয়ে যায় কখনো।
ওটি থেকে বের করে নিশিকে পোস্ট অপারেটিভে দিয়ে দেয়া হয়েছে। সারারাত স্যালাইন চলবে। ডাক্তারের মতে নদীরা চাইলে বাসায় চলে যেতে পারে।নদী ঘোষণা দিলো সে হাসপাতালেই থাকবে।
” এখানে থেকে কী করবে? তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছেন। ও ভালো আছে এখন। তোমাকে বাসায় নামিয়ে দেই চল, টেক এ লিটল ন্যাপ ”
রম্যের কথা মানতে নারাজ নদী,
“আমি কথা দিয়েছি ওর সাথে থাকবো, এই মুহূর্তে আমি ছাড়া ওর কেউ নাই ”
রম্য বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো। নদী মাথা তুলে বলল
” আপনি যান স্যার, আমি ম্যানেজ করতে পারব ”
নদীর শেষ কথাটা চ্যালেঞ্জ করতেই বোধহয় মোবাইল সশব্দে বেজে উঠলো, ” শানুখালা ” নদী চমকে উঠে দাঁড়ালো। হঠাৎ মনে হলো গলা শুকিয়ে কাঠহয়ে যাচ্ছে৷ গ্যাব্রিয়েল খেয়াল করলো
“ফোন পিক করো”
” সাহস নেই স্যার, ওপাশে নিশির মা। আমার আন্টি, সম্ভবত নিশির ফোনে না পেয়েই আমায় ফোন দিয়েছেন আমি কথা বলতে পারব না, সাহস নেই ”
জিএস মোবাইলটা তুলে নদীর হাতে দিলো, ” ওনার সাথে কথা বলো মেহরোজ, পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে যাওয়া কোন সমাধান নয়।তার জানা দরকার এখানে কী হচ্ছে”
গ্যাব্রিয়েলের কন্ঠে কিছু ছিলো নদী কাঁপা হাতে ফোন হাতে নিলো।
*******
সোহরাব সাহেবের হাতে গুরুত্বপূর্ণ একটা ফাইল। কাগজ গুলোয় যা তথ্য তা খুবই প্রাইভেট এবং কনফিডেনশিয়াল। এবং সাধারণ নাগরিকের পক্ষে এমন ব্যক্তিগত তথ্য হাতে নেওয়াও একটা ক্রাইমের সামিল। কিন্তু এই দেশ বলেই হয়তো এই কাগজ বের করা সম্ভব হয়েছে। কাগজগুলো গতকালই এসিল্যান্ড অফিস থেকে ফটোকপি করে আনা হয়েছে। সোহরাব সাহেব মনোযোগ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করছেন কিন্তু মনোযোগ দিতে পারছেন না। কাচাপাকা চুলের গোড়ায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে যাচ্ছে। যুদ্ধের সমস্ত প্রস্তুতি মিথ্যা হয়ে যায় একটা চিন্তায় সেটা হলো প্রতিপক্ষকে দুর্বল ভাবা৷ এই কাগজ যে ধাক্কা তাকে দিয়েছে তাতে চোখে অন্ধকার দেখা ছাড়া আর উপায় নেই। যেকোনো মুহূর্তে তাকে নি:স্ব করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে এই কাগজ।
” স্যার, শরীর কি খারাপ ? ” হাইকোর্টের সিনিয়র এডভোকেট ফিরোজ আলম চৌধুরীকে যেন মাত্রই খেয়াল করলেন সোহরাব
” অবস্থা তো বেশ গুরুতর ফিরোজ সাহেব’
” জি তারা আমাদের থেকেও স্মার্ট ”
” আমার প্রশ্ন কাগজে কলমে তারা এত শক্ত হলে প্রসিড করছে না কেন? এতদূর এগিয়ে গেলে তো জানার কথা আমরা কী করছি”
” হয়তো, সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছে তবে আপনি চাইলে আমি একটা কাজ করতে পারি স্যার। বিষয়টায় খরচ হবে অনেক তবে হয়তো কাজ হয়ে যাবে ”
সোহরাব সামদানী তাকিয়ে আছেন, ফিরোজ আলম বললেন, পুরো ডক্যুমেন্টস মেনুপুলেট করা ফেলা যায়। সবই হবে ল ফুলি ”
” এটাও সম্ভব! আর ইউ ইনসেইন ”
” এই দেশে সবই সম্ভব স্যার। শুধু সঠিক নেটওয়ার্ক লাগে। একটা পার্টিকুলার টিমই আছে যারা এসব করে। খরচ একটু বেশি।আপনি যাবেদ সাহেবের ভড়ং ব্র্যান্ডের নাম তো শুনেছেন। ওনার বনানী আউটলেটটার ব্যাপারটা তারাই হ্যান্ডেল করেছে…’
” আমি যাবেদ নই ফিরোজ সাহেব। আমি জীবনে তার থেকে কম অর্থ উপার্জন করিনি,সংসার ভেঙে এই দেশে ফিরেছিলাম একঅর্থে সন্ন্যাস নিয়ে। ভড়ংয়ের মতো কোন ব্র্যান্ড তৈরির আগ্রহ আমার নেই। প্রায় পঁচিশবছর আমেরিকান সিভিল কোর্টের আন্ডারে কাজ করেছি কোন ধরনের একনিষ্ঠতার কোন অভাব হয়নি। নিজের দেশে এসে সেই নিয়মের ব্যত্যয় করার প্রশ্নই আসেনা। ”
” কিন্তু বুঝুন এভাবে কিছু উদ্ধারও হবে না স্যার”
” একটা ওয়ে বের করতে হবে… যাহোক আরেকটা কেসের ব্যাপারে বলুন শুনি”
” ফৌজদারি কোর্টে মামলা নিয়ে নিয়েছে। অদ্ভুত ব্যাপার ওই ছেলের একদিন পরই জামিন হয়ে যেত৷ আর কপালটাও ভালো
এইবছরই এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটা প্রণয়ন হয়েছে (২০১৮ ধারা ২৯) সোশ্যাল মিডিয়ায় গোপন তথ্য ফাসের জন্য তিন বছর থেকে পাঁচ বছর এবং পাঁচ লক্ষ টাকা জরিমানা। ”
” যাক আপনি মেয়েদের হয়ে মামলা দর্জ করেছেন এই যথেষ্ট । আমি ফাকেই থাকতে চাই। কারণ একসময় না একসময় তাদের ফ্যামিলি তো জানবেই আমার মেয়েদের মামার সাথে এমনিতে একটু বাকবিতন্ডা হয়েছিলো তাই সামনে যেতে চাচ্ছি না”
” আপনার নাম আসবে না স্যার আমি জানাবো নদী মেয়েটাই এসেছে আমার কাছে ”
সোহরাব সাহেব একটা দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেললেন, ধর্ম আইন সব কিছুর উর্ধ্বে হলো সমাজের মহান বিচারকদের নিজেদের নিয়ম।।
আঠেরো উনিশ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ের ভুলকে পাপ আখ্যা দিয়ে দিয়ে বাস্তবিক ভাবে পাপী বানাতে ছাড়ে না এই সমাজ।গোটা পরিস্থিতি ভাবলে মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়।
সেদিন গভীর রাত গড়ালেও রম্যের দেরি দেখে ফোন দিয়েছিলেন ছেলেকে। বিষয়টি আংশিক জেনে বিভ্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক ছিলো, পুরো ঘটনা জানা গেলো আরও দুদিন পর।হাসপাতাল থেকে ফিরে কী একটা দরকারে নদী বাড়ি ঢুকতে পারছিল না।রম্য আর সোহরাব সাহেব সাথেই ছিলেন। সাবলেটের বাড়িওয়ালা চিৎকার জুড়ে দিয়েছেন কী যেন ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। নদী পুরো ঘটনায় লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছিল।সাইবার ক্রাইম ডিপার্টমেন্টকে রিপোর্ট করে যাবতীয় ফুটেজ সরানোর কাজ চলছে তবে বড় লস যা হবার ছিলো, তা হতে কেউ ঠ্যাকাতে পারেনি।
এই সমাজে মেয়েগুলোর অপরাধবোধ তাদের আরও বড় ভুল করিয়ে দেয়। যে মুহূর্তে পরিবারের দরকার হয়, তখন তাদের থেকে আরও দূরে সরে যায়। যদিও এই বাচ্চাদের পরিবারের কেউ কাছে নেই এটাও তাদের বড় দোষ হয়ে যায় ।
” স্যার কি আজ বের হবেন নাকি গাড়ি গ্যারেজ করে ফেলতে বলব ” তুষার কখন এসেছে খেয়াল করেননি সোহরাব সাহেব।
” আজ বের হতে ইচ্ছে হচ্ছে না, সোহরাব সাহেব তার হাতের ফাইল দেখিয়ে বললেন, ” তুমি এই কপির একটা রম্যকে পাঠিয়ে দাও ”
” অনেক আগেই পাঠিয়েছি,জি এস বিজি ছিলেন বলেছেন পরে দেখবেন ”
সোহরাব সাহেব বুঝলেন ছেলে এখনো বিষয়টি বুঝতে পারেনি। রম্য বিষয়টা বুঝলে রি-এক্ট অবশ্যই করবে।
তবে তারজন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা লাগলো না, ফিরোজ আলম চলে যাবার পর পরই রম্যের ফোন এলো
” আমি বুঝতে পারছি না তুমি এতগুলো বাংলায় লেখা নথিপত্র আমায় পাঠিয়েছ কেন?
” এটা এখানকার ভূমি অফিসের ডক্যুমেন্টস। যেটা তোমার জানা প্রয়োজন আমি এর ইংরেজি তর্জমাও মেইল করেছি ”
রম্য ফোন কেটে দিলো। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন কন্ঠ উত্তেজিত,
” এটা কীভাবে সম্ভব? ”
” যেভাবে আমি আশঙ্কা করেছিলাম, তোমাকে আগেই বোঝানোর চেষ্টা করেছি তুমি বোঝনি। ”
ওপাশে প্রতুত্তর নেই। সোহরাব সাহেব কোমল কন্ঠে বললেন, ” রম্য শোন জোর-জবরদস্তিতে কিছু হয় না।এই দেশে নিয়ম কানুন সবই কাগজে আটকে থাকে, আমাদের লড়াইটার কৌশল বদলাতে হবে। তারা প্রচন্ড ধূর্ত ৷ আমি আমার মতো সামলে নিতাম ”
” তুমি যেভাবে সামলাচ্ছিলে তার ফলই এই কাগজ ড্যাড। এখন যেকোনো সময় কোর্টের সমন জারী হয়ে যাবে আমাদের…”
” কিছুই হবে না যদি একটু বুদ্ধি নিয়ে চলো, এই দেশের মারপ্যাঁচ তুমি বুঝবে না বেটার লেট মি হ্যান্ডেল দিস”
রম্য ফোন রেখে দিলো। বিরক্তিতে মাথা ধরছে,কোনদিক থেকে গুছিয়ে এগোনোই যাচ্ছে না। একটা মিটিং সেরে ধানমন্ডির ক্লিনিকের দিকে গাড়ি ঘোরাতে গিয়ে জামে পড়ে ছিলো বাবার ফোনে মেজাজের সপ্তম হলো।
” অসহ্য একটা জায়গা! মাঝেমধ্যে মনে হয়,কুইট করে ফিরে যাই ”
“এত তোড়জোড় করে এসে এখন ফিরে যাওয়াটা কাওয়ার্ডের মতো লাগবে না? ”
ব্লুটুথে অর্ণব অন্যপাশের লাইনেই ছিলো হাল্কা গলায় বলল” ইজি রমি, এইখানে এক্সাইটমেন্ট একেবারে কাজে আসবে না। উল্টো আমার মতে ড্যাডের পলিসি অনেক লজিক্যাল। যদি আমি থাকতাম তাহলে তাকে এফোর্ট দেওয়াই লাগতো না। ”
” তুই থাকলে কী করতি? ” রম্য ক্লিনিকে গাড়ি পার্ক করতে করতে বলল।
” যেটা তোর পক্ষে সম্ভব না কারণ তুই একটা গাধা।আজীবন মিশেলের বিরহে ফোসফাস করতে থাকবি টেকনিক্যাল কাজ তোকে দিয়ে হবে না।বাই দ্যা ওয়ে তোর ওই ওয়েট্রেসের খবর কী?তার উন্ডেড সিস্টারকে নিয়ে ঝামেলা মিটেছে? ”
” তার বোন এখনো এডমিটেড। মেহরোজ তিনদিন ধরে ছুটিতে, রেস্টুরেন্টে চাপ পড়ে যাচ্ছে রাজিয়া আর লিজা আজও কমপ্লেইন করছিলো।আগামীকাল একটা পার্টি কয়েকজন এটেনডেন্স লাগবে, সে এই কাজে ভালো ছিলো, কিন্তু এই জাতি একেবারে প্রফেশনাল না … ”
” রমি শোন,আমি বলি কি কুইট করে ফিরে আয়! তোর দ্বারা হবে না তুই আসলেই একটা এসোল, ইডিয়ট, মোরন”
” মানে কী? ”
” তুই শুধু এই সিচুয়েশনে আমাকে ইমাজিন কর, ভেবে দেখ আমি কীভাবে কাজ উদ্ধার করতাম তাহলেই বুঝবি মানে কী; গাধা! ”
রম্য বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে নিশির ক্যাবিনের দিকে এগোলো।ডিউটি ডাক্তার তার ক্যাবিন রাউন্ডেই ছিলেন। রম্য গিয়ে কথা বলল ওটির পর মেয়েটাকে একব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছিল সাথে বেশ জ্বর যেটা কোন অভ্যন্তরীণ ইনফেকশনের কারণে হয়েছিল । পুরো দুর্বলতা কাটাতে হাসপাতালে এডমিট করারই সিদ্ধান্ত নিতে হলো। মেহরোজও বোনের সাথে ছিলো ছায়ার মতো। রম্য আর সোহরাব সাহেব নিয়ম করে দেখে গেছেন ।
আজ ডিউটি ডাক্তার আশার কথা বললেন যে মেয়েটা রিকভার করছে হয়তো আগামীকাল রিলিজ করে দেবে ।
রুমে ঢুকে দেখা গেলো নিশি ঘুমানোর জন্য পাশ ফিরছে। রম্যকে দেখে চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তি। এই মেয়েটার আচরণ আমেরিকান টিনএজ গ্রাঞ্জ গার্লদের মতো।শুধু কালো লিপস্টিকটার অভাব। রম্যের বেশ মজাই লাগে, এর সাথে কষ্ট করে বাংলা বলা লাগে না।
-হেই নিশি কী অবস্থা তোমার?
– হেই বাবুর্চি, এখন কেন?
-তোমাকে দেখতে ওভিয়াসলি..
– নদু বারান্দায়,আমি ঘুমাবো বলে প্রস্তুতি নিলাম ডাক্তার হাজির ডাক্তার গেল এখন তুমি হাজির।
রম্য কিছু বিব্রত হলো ” তোমায় বিরক্ত করায় খুব দু:খিত…
নিশি বালিশ টেনে নিলো, “গুডবাই বাবুর্চি
– বাবুর্চি মানে কী?
-নদুকে জিজ্ঞেস কর,
-নদু?
– তুমি ডেকো না এই নামে, জীবনে পটবে না।
নিশি কম্বল টেনে নিজের মতো গুটিয়ে গেলো।রম্য আর ঘাটালো না, গ্রাঞ্জ গার্লদের কথাবার্তা ঠিক ঠিকানা খোঁজ করা অবান্তর। নদী ক্যাবিন সংলগ্ন ঝুল বারান্দার চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে আছে। রম্যের একটু অবাক লাগলো এই কয়দিনের এত ছোটাছুটির মাঝেও মেয়েটাকে ক্লান্ত দেখেনিবোনের ছায়ার মতো সাথে ছিল। আজ হঠাৎ কী হলো?
তবে নদী সে মুহূর্তে কোন প্রশ্নের জবাব দেবার অবস্থায় ছিল না। মনের মাঝে একরাশ হরেক রঙের অদ্ভুত অনুভূতি ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে। ঝড়ের মতো পার হওয়া দুটা দিনের হিসাব-কিতাবের কথা যখন ভাবছে তখন নিজের কাছেই বিশ্বাস হচ্ছে না। নিশিকে যখন রক্তাক্ত উদ্ধার করলো হঠাৎই সব হারানোর ভয় নতুন করে জাকিয়ে ধরলো তাকে।এক অর্থে মরিয়া হয়ে যাচ্ছিল নিশিকে আটকে রাখতে।নিশি ফিরলো কিন্তু তার ক্ষতগুলোর সাথে লড়াই থামেনি।ডিউটি নার্সের নিজের মাঝের কথোপকথনগুলো না চাইতেও কানে ছুরির ধার হয়ে ভেতরে আঘাত করছিলো।
“আমার বেবিটাকে তুই দেখেছিলি রে ছেলে ছিলো না মেয়ে ছিল৷ ডাক্তার কিছু বলেছিল? “নিশির কন্ঠ খুব স্বাভাবিক ছিলো।
” নিশি এইসব চিন্তা বাদ দে প্লিজ, যা হয়ে গেছে ভালো হয়েছে। ”
” তুই আমার পেইনটা ফিল করতে পারতেসিস না নদু। তাহলে বুঝতি যা হয়েছে তা ভালো হয় নাই আমার বুকটা কেমন যেন খালি খালি লাগছে।মনে হচ্ছে একটা বডিপার্ট মিসিং আমি আল্লাহকে গালি দিয়েছিলাম বলেই কি শাস্তি দিলো?
“আপু এগুলো ভুলে যা সব দু:স্বপ্ন ..”
” ওই শয়তানটা আমাকে এক্সপোজ করসে আমি কেয়ার করি না,কিন্তু এই ভিডিও সে আম্মুকেও মেইল করে পাঠিয়েছে । আই ইউজড টু লাভ দ্যাট সান ওফ এ বি*চ… নদু। ”
নিশির অঝোর ধারার কান্না দেখে নদীর কিছু বলার ছিলো না।শত আঘাতেও ভেঙে না পড়া কারো আশ্রয় হবার অলিখিত শর্ত। নদী তার শর্ত পূরণ ঠিকই করেছে।কিন্তু এখন বুকের মাঝে কেমন বিচিত্র পাথরের চাপ অনুভূত হচ্ছে।
” মেহরোজ” নদী চমকে তাকালো গ্যাব্রিয়েল শান্তচোখে তাকিয়ে নদী চমকিত চাহনিতে বিস্মিত হলো,
‘ এত আপসেট কেন, কোন সমস্যা ”
” কিছু মানুষের কখনো সমস্যা হয় না স্যার,সমস্যা থাকলে তার সমাধান হয়। আশ্রয়হীন মানুষ নিজেরাই তো পৃথিবীর বড় সমস্যা”
নদীর কন্ঠ বাষ্পরূদ্ধ হতে হতে কখন সংযমের বাধ ভাঙলো বুঝতে পারেনি।গত কয়েকদিন ধরে শক্ত পাথর বনে থাকার ক্লান্তিতে ভেঙে বেশ কিছুক্ষণ ঝরেছে। প্রলয়ঝড় কমে আসল একসময়, নাকের কাছে দামী পারফিউমের সৌরভ অন্য একটা কেমন সুক্ষ্ম অনুভবে নাড়া দিল,হুট করেই হুশ ফিরালো তার। মাথা তুলে দ্রুত ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে রম্যের থেকে। আসলে কিছু চোখের অশ্রু যখন গোপন থাকে না তাকে গোপন করতে কাউকে এগিয়ে আসতে হয়। রম্য সেই উদ্দেশ্যেই এগিয়ে এসেছিল।
নদীর নিজের ওপর রাগ লাগছে। এই লোকের সামনে ভ্যা করে কান্নার কতটা খ্যাতের মতো আচরণ। ভাবছে হয়তো সমবেদনা চাইছে। যদিও গত টানা তিন-চারদিন যতটা দায়িত্ব আর আন্তরিকতার সাথে সোহরাব সাহেব আর জি এস তাদের পাশে ছিল তার জন্য নি:সন্দেহে নদী কৃতজ্ঞ। তবে এখন মনে হয় একটু বাড়াবাড়ি হলো। জি এসের কালচারে হয়তো তেমন কিছু না, নদীর সংস্কৃতির জন্য অনেক কিছু। তবে পরিস্থিতি ব্যাখ্যার অবকাশের আগেই মোড় ঘুরে গেল
” বড়ো মামা”
নদী বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে, মোজাফফর হোসেন সাহেব ক্লিনিকের বারান্দার দরজার কাছে মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন ।
-বড়ো মামা কখন এসেছেন?
– নিশির মায়ের রাতে ফিলাইট ছেলো, তারি নিয়ে সোজা এলাম ক্যাবিন খুঁজতিসি তোমারে ফোন দিয়ে যাচ্ছি বেশটুক সময় হয়েছে, তোমরা টের পাওনি! ”
তার মানে শানুখালাও এসেছেন।গত কয়েকদিনে নিউজার্সি থেকে ফোনে অনেককথা হয়েছে, সবই প্রচন্ড রাগ আর ক্ষোভের। তবে তিনি যে আসবেন একবারও বলেননি। এখন ঘরে নিশির ওপর কী যাচ্ছে জানে না। নদীর ভয়ে দুই পা জমে যাচ্ছে। গ্যাব্রিয়েল বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে।
বড়মামার মুখের অভিব্যক্তির সাথে কিসের তুলনা করা যায়? সম্ভবত ফাসির জল্লাদের দৃষ্টি এমন শীতল থাকে।
**********
চারদিন পরের দৃশ্যপট
মোজাফফর হোসেন সাহেবের মিরপুরের এক মামার বাড়ির ছাদে সভা বসেছে৷ অতিথি হয়ে বেড়াতে এসেও, বলা চলে রুদ্ধদ্বার বৈঠক। জরুরি অবস্থায় ঢাকায় আসতে হয়েছে এক হতে হয়েছে পরিবারের সবাইকে। সবারই মুখ অন্ধকার নি:শ্বাসের মাঝে ফোঁসফোঁস করছে তীব্র ক্ষোভ। সাতক্ষীরার সম্ভ্রান্ত ধর্মভীরু পরিবারের কারো উত্তরসূরীকে নিয়ে এমন কোন বৈঠক হতে পারে তা কল্পনার অতীত। কিন্তু সময়ও মাঝেমধ্যে পরিস্থিতির উল্টো ঘন্টা বাজিয়ে নিজের মতো মজা নেয়। অপ্রাসঙ্গিক টুকটাক কথার জালে একঅর্থে মুখে কুলুপ তুলেছিল সবাই,শানু নিজেই এক সময় নীরবতা ভাঙলেন,
” যা আমি বলতে চাই আশা করি সবাই বুঝতে পারতেসেন আমার মেয়েটার ওপর একটা ট্রমা গেছে আমাএ অনুরোধ যে আপনারা সবাই ওর সামনে একটু সেনসিবল বিহেইভ করবেন ”
রানু ফোঁস করে উঠলো বোনের কথায় ” তা আর বলতি, মেইয়ে তোমার একুশি পদক জিতিসে, তারে নিয়ে কোলে কইরে বসায় রাখবো নানে ”
শানু উত্তর দিলেন না, ছোট নি:শ্বাস ফেললেন।
” স্বপ্নে ভাবিনি এইদিনও যে দেকতি হবে” মোজাফফর সাহেবের ছোট ভাই মঞ্জুর হোসন গজগজ করে বলে ফেললেন।
” তোমাগের নিজির নিজির দায়িত্ব ঠিক থাকলে এই দিন দেখতি হতো না।তোমাগের ভরসাতেই মেইয়ে রেখে গিয়েছিলাম “শানুর কন্ঠ উত্তেজিত।
রানু ফুসে উঠলো ” আমাগের ভরসায় রাখতি তোমারি বইলেছিলো কিডা? নিজের মেইয়ে সামলাতি পারোনি আমাগের ভরসা ছেইড়ে পয়সার পেছনে ছুটেছাও এখন এইসেছ আমাগের বেলেম (ব্লেইম) কত্তি! ”
” এই চ্যাটাংচ্যাটাং কথা বলার আগে ভাবতি পয়সাগুলোন খেইয়েসে কে? হাত পাতার সময় দরদের বোন আর বোনের মেয়ে দেখতি গেলে কোন দায়িত্ব তোমাগের না” শানু নিজের ক্রোধ সামলাতে পারছেন না
রানু মাথা নেড়ে বললেন, ” ও তো তুমি পয়সা দে আরেকখান মা কিনে আনতে। মেইয়েরে সাইজ কইরে রাখতি পারবা না, নিজের মতো চলতিও চাবা, আবার মেইয়েও মানুষ হয়ে যাবে এ ভাবলে কী করে?”
মঞ্জুর সামর্থন করলেন ” তাই তো তোর মেইয়ে কি আমরা পেটে ধইরেসিলাম? এখন এত গলা মোটা করতিসিস। স্বামী সামলাতি পারিসনে মেইয়ে সামলাতি পারিসনে,মনে কইরেসো পয়সা দিলি সব হয়ে গেলো, পয়সার নেশায় তুমি ধরারি সরা জ্ঞান করতিসো ”
ভাইবোনদের তর্কাতর্কিতে আরও হুলুস্থুল বেধে যাচ্ছিল, অবশেষে মোজাফফর হোসেন সাহেবের কড়া ধমকে শান্ত হলো সবাই।
” যা হবার তা হইয়েসে সে গোবর ঘেইটে হাত গন্ধ করার দরকার নেই,শানু যখন মেইয়ে নিয়ে এইসেছিল আমি শুরু থেকেই এর খেলাফ ছিলাম। তার কথা হচ্ছে মেইয়ে নাকি ওখানে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে…।
” ওহরে এইখানে এক্কেবারে হাজী হয়ে গিয়েছে” রানুর এর মাঝে ফোড়ন না কাটলে চলছিলো না,” যত ঘষো মাজো ও মেইয়ে জীবনে আর কিছু ঠিক হবি নানে ”
” রানু, নাইনে থাকতি তুই ওই পুবপাড়ার জোলার ছেইলে ইলিয়াসের সাথে ভাগতি গিয়েসিলি। লঞ্চে উঠতি সেজচাচা ধইরে নে এইসলো, বাড়ি এইনে আব্বা বেল্ট খুইলে উদোম মার , তিনদিন জ্বরে পইড়ে থাকলি সেইসব ইতিহাস কিছু মনে পড়ে? সেই সময় আমরাও তোর সব শেষ ভেইবে ছেড়ে দিলি তুই এখন গলাবাজী করতি পারতিনে। পাঁচ ছটা গ্যান্ডাপ্যান্ডা পয়দা কইরে ওই জোলার বাড়ির আস্তকুড়ের মধ্যি পইড়ে থাকতি ”
মোজাফফর সাহেবের কথা শানুর মুখে প্রশান্তি এলেও রানুর মুখ শুকিয়ে গেলো৷ মোজাফফর সাহেব আবার শুরু করলেন,
” মানুষের নিজের ইতিহাস কখনো ভোলা উচিত না এইটাই বুঝাতে এসব বলছিলাম, এখন বিষয় হইলো গিয়ে শানু মেইয়েরে আম্রিকা নি যাতি চাচ্ছে, খুব ভালো কতা। কিন্তু আমার মতে জোর-জবরদস্তি না করে শান্তি মতো বুঝাও। বাছুরের মতোন গলায় দড়ি পরালি আরও উল্টোপাল্টা কইরে বসপে।এরপর সামাল দেবার কিছু পাবিনে। মেইয়ে তোর একটাই। তারি সময় দে একটু বুঝা যেন স্বাভাবিক জীবনে ফেরে। সে যদি ভাবে যে ভুল কইরেসে তাহলি পরে অর্ধেক কাজ হয়ে গেছে তবে এখন অন্তত টাকার মায়াটা ছাড়”
শানু মাথা নাড়লেন “সে ছেড়েই এলাম,লম্বা ছুটি নিয়েই এসেছি। ওর পাসপোর্ট প্রসেসিংয়ের জন্য জমা দিয়েছি আরও দু-সপ্তাহ লাগবে৷ তার সাথে কি কি সব ভেরিফিকেশন আছে। এতদিন আমি সাথেই থাকবো ।
রানু গজগজ করতে করতে এখন কতা হইল নদীরে নিয়ে।বাপরে বাপ যে ঢাকায় এইসে ভোল পাল্টে গেছে।এতদিন আমার হেফাজতে ছিল যেমন রেইখেসি ফুলের টোকা লাগেনি মেইয়ের। এই কয় দিনি সঙ্গদোষে কত উন্নতি হয়েছে আল্লা মালুম।”
” ঢাকায় থাকার রিস্ক থেকেও বড় রিস্ক ধানমন্ডির ভ্যাজালের মধ্যি পড়ে গেলে, ওর বাপের কারণে মেইয়ের ঝামেলা না বাড়ে ” মঞ্জুর বলে উঠলেন।
রানু বলছেন ” আমি এখন নদীর অঘটনের অপেক্ষায় আছি একজন চুনকালি মাখায়েসে আরেকজন কেমন আলকাতরা মাখায় তার জন্যি তৈরি থাকা ভালো ”
”
“পাড়ার মানুষের মতো কথা বলবিনে রানু, তুই তার খালা প্রতিবেশী না।”
মোজাফফর সাহেব ধমকে উঠলেন তবে মনের মাঝে দ্বন্দ্ব থামলো না সেদিন ক্লিনিকে সাহেব মতো তরুণের সাথে নদীর একঝলক যে দৃশ্য দেখেছেন তাতে দুশ্চিন্তা অনেকখানি বেড়ে গেছে। বসন্ত বাতাসে কোকিলও ভোল পাল্টে ফেলে,নরকের বাতাসে নারী। নদীর মধ্যে পরিবর্তন আসেনি কেউ বলতে পারে না।
নিশির ভাষ্যমতে ছেলেটা গ্যাব্রিয়েল তার আমেরিকার বন্ধু। যদিও শানু তাকে চিনতে পারেনি৷ তবে মেয়ের সব বন্ধুদের চিনে রাখলে সে নিশ্চয়ই এমন উড়নচণ্ডী হতো না। নিশি নদীদের থেকে ছেলেটা বেশ বড়ই হবে, এইদেশে কোন বিদেশি একটা ফার্মের বড় দায়িত্বে আছে। এই ছেলেই নাকি নিশিকে এডমিট করেছে যাবতীয় দায়িত্ব নিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো তার নদীর সাথে এত ঢলাঢলির কারণটা কী? তা ভালো বংশের শিক্ষিত ছেলে পাওয়া গেল নদীর একটা হিল্লে করা সমস্যা ছিল না।এইদিকে একেবারে ভাবাই সম্ভব নয়, একে আমেরিকান তার ওপর গ্যাব্রিয়েল নামটা !
পরিচয় পর্বে এই ছোড়া সহজ স্বাভাবিক থাকলেও ইংরেজি ভালো মতো না জানায় মোজাফফর তাকে বেশি একটা ঘাটতেও পারেননি।আর শানু তো নিজের মেয়ের চিন্তাতেই গদগদ।
এই নিয়ে নদীকে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছেন না। আধুনিকতার হাওয়া গায়ে লাগানো প্রজন্মকে প্রশ্ন করার মাঝেই সম্মান যাবার ঝুঁকি থাকে৷নদীকে ঢাকায় পড়নোর সিদ্ধান্তে মাথা কুটতে মন চাইছে ভাইবোনদের কাছেও কম কথা শোনেননি।রানু ইনিয়েবিনিয়ে আবারও নিজের প্রস্তাব রাখতে চাইছেন। অনেক দিন পর ঝামেলা সামলে তার ছেলে শাহিন ফিরেছে বাড়ি। সামনের মাসেই ছেলের বিয়ে, ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে নাহয় নদীকে সাথে করে নেওয়া যায়,তার বড়োমামাকে যেহেতু খুব মানে…
” আজকালকার ছেলে পেলেদের জোর করে মানানো যায় না রানু, কাজ উদ্ধার করতি হলে ঠান্ডা মাথায় কায়দা করতি হয়। সেই কায়দা ভেবে বের করতে হবে”
মোজাফফর সাহেব ভাইবোনের সভার ইতি টানলেন মাথায় অন্য চিন্তা।নদীকে সাতক্ষীরা ডেকে নিয়ে একটা ব্যবস্থা করা যেতে পারে।মরা বোনের মেয়ের দায়িত্ব যখন নিয়েছেন চেষ্টাও পুরোদমে করতে হবে যেন এই মেয়েটা ভুলপথে না যায়৷
******
হাসপাতাল থেকে রিলিজের পর শানুখালা নিশিকে নিয়ে সোজা একটা ফোরস্টার হোটেলে উঠে গেছেন। সেখানেই মেয়ের দেখাশোনা করেছেন সময় দিয়েছেন। শানুখালার সাহায্যে নদীকেও থাকতে হয়েছে সাথে। তাছাড়া সাবলেটের মহিলার যা ব্যবহার তাতে সহসা ফিরতে ইচ্ছে করেনি। শানুখালা আর নিশির সাথে এই কয়দিন চাকরি বা ক্লাস ঠিকমতো না হলেও কিছু বিরল অভিজ্ঞতা হয়েছে।
” নিশু বল, ড্রাগন ফ্রুটটা সাদা না লাল বেট লাগা টেন ডলার ”
“উহ হান্ড্রেড ডলার দিলে বেট লাগাবো ”
” ডান আমি জিতলে তোর মাথায় তেল দিয়ে চাম্পি করবো এরপর হেয়ার ওয়াশ, তুই জিতলে হান্ড্রেড বাক্স টেল মি রেড ওর ওয়াইট ”
” হোয়াইট ”
” ওকে নদী তুই সাক্ষী, রেট হলেই চাম্পি,থ্রি টু ওয়ান…”
ড্রাগন ফ্রুট ছুরি দিয়ে কাটতেই বেরিয়ে এলো ভেতরের লাল শাস। নিশি ততক্ষণে ছুটে বাথরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। শানুখালা সেখান থেকে বের করে তার মাথায় চাম্পি করেছেন। নিশি জেদ করেছে হাত-পা ছুড়েছে তবে নদীর মনে হলো এর থেকে খুশি নিশিকে কখনো দেখা যায়নি। শানুখালা পরম মমতা নিয়ে কন্যার চুল আচরে দেন,গল্প করেন নদী মুগ্ধ বুভুক্ষুর মতো অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে। দেখতে বড় ভালো লাগে।সত্যিই কারো মনে বিশেষ স্থান রাখার কী দারুণ অহংবোধ থাকে। এইকথাটা ভাবতেই বিচিত্র ভাবে নদীর আরেকটা কথা মনে পড়ে
ক্লিনিকে এডমিট থাকতেও যা গ্যাব্রিয়েল কিচেন থেকে রোজ খাবার পার্সেল আসতো তার জন্য। সোহরাব না গ্যাব্রিয়েল, এই কাজটা কার নির্দেশে হতো নদী জানে না। তবে শেষের পার্সেলে স্বর্গীয় স্বাদের চিজকেকটার অন্যরকম অনুভব দিয়ে যায়।
তবে ভালোলাগাতেও বাধ আসেনি তা নয়। মাঝখানে চলে এসেছেন রানুখালা। অসুস্থ বোনঝিকে দেখতে আসতে তার কত ঝামেলা পোহাতে হয়েছে, মাত্র ছেলেটা ফিরেছে তাকেও সময় দেওয়া হয়নি এইসব ফিরিস্তি শোনা লাগছিলো মুহুর্মুহু। তার সাথে রানুখালার আরেকটা বাতিক,
” এই ব্যাগটা তো সেই রে শানু, আমাগের জন্যি এমন আনতে মনে থাকে না? যাবার বেলা দিয়ে যাস৷ আর এই পারফিউমটা কি ভালো রে?আমার জন্যি আনতে বইলেসিলাম এই বার তো কিছুই আনলি নে?”
নদী নিশি রানুখালাকে দেখে নীরবে বিনোদন নিতো। শানুখালার বিদেশি লাগেজের প্রায় অর্ধেকটা জিনিস নিজের লাগেজে স্থানান্তর করেই ফেলেছিলেন কিন্তু বাদ সাধলো রানুর মুখের জবান।
” এত আছাড় খাবার পরে একটু রাস্তায় এসো বুঝলে নিশি কম ঘাটের পানি তো খাওনি ”
এই কথাতেই শানুখালার ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেল,”রানু আমি আমার মতো মেয়েকে রাস্তায় ফেরানোর চেষ্টা করছি, তোর কষ্ট করে আর এখানে থাকতে হবে না, তুই শাহিনের কাছে যা। তোর ছেলে একটা ঘাটের পানি খেয়েই খুনের কেসে ফেসেছিলো। অনেক কষ্টে ছাড়িয়েছিস তার বিয়ের প্রস্তুতি নে গিয়ে যা ”
সেইদিন বিকেলের গাড়িতেই রানুখালা সাতক্ষীরা রওনা হলো৷ তাও সাধারণ বাসে কষ্ট হবে বলে শানুখালার কাছে ঘ্যানঘ্যান করে স্কেনিয়ার টিকিট কাটাতে ভুললেন না ।
কিছু খরচান্ত হলেও এই বিদায় উদযাপন করতে শানুখালা কক্সবাজার ভেকেশন ঘোষণা করলেন।
” লেটস গো গালস অল থ্রি অফ আস উইল রক দি বিচ”
নিশি আনন্দে ছোট বাচ্চাদের মতো জড়িয়ে ধরলো মাকে তবে একটা দু:সংবাদও ছিলো। সুবর্ণা নদীর ফোনে জানালো দুইদিনের মাঝেই ধারাবাহিকভাবে কলেজে আইটেম শুরু। বিশ পার্সেন্ট মার্কস সেমিস্টারের সাথে যোগ হবে। নদীকে ছোট নি:শ্বাস ফেলে হলেও যাবার চিন্তা বাদ দিতে হলো।পড়াশোনায় অনেকটা বিচ্যুতি এসেছে আর সুযোগ নেই। নিশি জেদ করলেও তাকে শানুখালা বোঝালেন। এরমাঝে একবার নদীর ক্যাম্পাসেও সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে এলেন।কোথায় ক্লাস হয়, করে কোন ডিপার্টমেন্ট গত আইটেমের স্কোর নোটিশ বোর্ডে ছিলো, সেটাও দেখে নিলেন মনোযোগ দিয়ে। নদী বুঝলো এটা বাকি মামা-খালাদের পক্ষ থেকে জরিপ কার্যের অংশ বিশেষ । তবে তৃষা সুবর্ণাকে ইশারায় বুঝিয়ে দিয়েছিল যে৷ চাকরির প্রসংগ না তোলে। সব দেখে শুনে শানু সন্তুষ্ট হলেন।
ঠিক হলো শানু আর নিশিই যাবে। মা মেয়ের একান্ত সময় কাটানোর সুযোগ হয়তো নদী সাথে থাকলে হতোও না। আপন হলেও সব সম্পর্কের সীমার সুতো থাকে। ভালোই হবে নদী এর মাঝে গ্যাব্রিয়েলস কিচেনের ডিউটিটাও স্বাভাবিক করতে পারবে৷ শানুখালা যে কয়দিন থাকবেন সেটা হোটেলেই থাকবেন, সাবলেটের বাসায় নদীর নিজের মতো কাজ চালিয়ে যেতেই পারে। সোহরাব স্যার আর গ্যাব্রিয়েল কম করেনি৷ কৃতজ্ঞতার বোঝা বাড়ানোর আগে নিজের দায়িত্ব বুঝে নেওয়া শ্রেয়। ভালো খবর হলো এখনো গ্যাব্রিয়েল বিষয়ক কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়নি। নিশি খুব দ্রুত সামলে নিয়েছে। তবে সকালে কক্সবাজার ফ্লাইটের উদ্দেশ্য যাবার আগে শানু খোঁজ করলেন ,
“এই কয়দিনে ওই ছেলেটা তো এলো না, দ্যাট কিউট চ্যাপ, গ্যাব্রিয়েল ”
নদীর চোখাচোখি হলো নিশির সাথে নিশি দ্রুত বলল
” ফ্যামিলি টাইমস এর মধ্যে খালি এন্টারফেয়ার করতে চায়নি, কালই তো কল দিলো আমাকে”
” যাক ভালো, অনেক কষ্ট করেছে৷ এই দেশে এ বেচারারা এসে এমনি ঝামেলার মধ্যে পড়ে যায়, আর তারপরে তোর ঝামেলা… ওর অফিস বা বাসা চিনিস তো,যাবার আগে দেখা করতে হবে ”
নদী মুখ আমসি হয়ে গেলো।
” রিল্যাক্স আমরা আসতে আসতে বাবুর্চিকে নাহয় আমেরিকা পাঠিয়ে দেব আবার। নো টেনশন ” নিশির একটা চোখ মেরে নিচু গলায় সান্ত্বনা দিলো।
” খালাকে কি চাকরির ব্যাপারে বলে দেব রে। শানুখালা মনে হয় কিছু বলবে না বিষয়টা বুঝবে”
“আপাতত কোন দরকার নাই, শুধু শুধু ডিস্ট্রেকশন আসবে, তোর বিষয়টা একটু জমুক ”
” মানে? ”
“মানে তুই একটা গাধী! ওয়েট্রেস হয়ে আর কত দিন, ডু সামথিং গার্ল। কিছু তো কর যেন আগুন ধরে যায় ”
“আমার কি ইচ্ছা করে নাকি বাসী প্লেট বাসন ওঠাতে, কিন্তু কিচেনে সবার এন্ট্রি নাই, ওই লোক ঢুকতেই দেয় না”
” তাহলে এন্ট্রি তৈরি কর। কিচেনের কাউকে এক্সিটের পথ দেখা বেইব। ব্ল্যাংক স্পেস তৈরি হবে তবেই তোর এন্ট্রি হবে,নয়তো বাবুর্চিকে ইম্প্রেস্ট করবি কী করে, ইউ সিলি সিলি গার্ল”
নিশির কথা যদিও মাথার উপর দিয়ে গেল। কিন্তু আজ ক্লাসসেরে যখন নদী গ্যাব্রিয়েলস কিচেনে পা রাখলো, তখন হঠাৎই মনে হলো জায়গাটা তাকে কতটা আচ্ছন্ন করেছে। এই কয়দিনের স্নিগ্ধ সময়েও থেকে থেকে মনে পড়েছে নদীর কর্মক্ষেত্রের কথা।
ভালোলাগার ঘোর না কাটতেই এসে পড়েছে কর্মঘূর্ণী। সাতদিন পর জয়েনিংয়ের দিনেই কোন বড় পার্টির আয়োজন। হাই প্রোফাইল ক্লায়েন্ট গোটা রেস্টুরেন্ট বুকড। স্টাফ এবং কিচেন শেফ সবাই সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে। নদীও সারিতে দাঁড়ালো জেরিন ম্যাম দেখে হাসলেন, তুষারের চোখাচোখি হলেও দৃষ্টি সরিয়ে নিলো দ্রুত। নাফিজের দৃষ্টি সারিবদ্ধতার মধ্যেও নদীর পেছনটা দেখে ঘুরিয়ে নিলো; বরাবরের মতো শরীর জ্বলে গেল নদীর। এদিকে রাজিয়ার যেন চোখই সরছে না তার দিক থেকে। তার চাপা ক্ষোভ মুখ থেকে নিসৃত হলো সুক্ষ লাভার ধারার মতো-
” সাতদিন ছুটি কাটিয়ে এলেন মহারানী, এখন তিনি কোন দেশের মহারানী এইটা খুঁজে বের করতে হবে”
নিচু গলার গজগজানি শুনে লিজা কিছু বলতে গিয়েও বলল না। জিএস এলেন একসময়। তিনি কিচেনের চিফ শেফের দায়িত্বে থাকবেন আজ। সবার সাথে নদীর প্রতিও একটা ক্ষরদৃষ্টি। দুজন মানুষ ঘটনাক্রমে একান্ত কিছু সময়ের অংশিদার হলে অধিকারবোধও জন্ম নেয় স্বাভাবিকভাবেই। তবে গ্যাব্রিয়েল
নিজের পেশাদারিত্বকে গুরুত্ব দেওয়া মানুষ ।
প্রত্যেককে তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলো। প্রথম এত বড় পরিসরে গ্যাব্রিয়েলস কিচেন কিছু আয়োজন করতে যাচ্ছে কোথায় কার ডিউটি, আউট ডোরে কে, ইনডোরে কে ডিউটি করবে ভাগ করে দিলেন। কিচেন স্টাফদের মেইনকোর্স মেনু সবই দ্রুততার সাথে বোঝালেন৷
“মেহরোজকে দায়িত্ব দেয়া হলো রিসিপশনে এরপর নিচের বুফেট পয়েন্টে। ”
” রাইট স্যার ”
” ওয়েলকাম ব্যাক মেহরোজ ” গ্যাব্রিয়েল পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, ” এন্ড আই ওয়ান্ট ইউ টু ব্যাক উইথ দ্যা ব্যাং ”
গ্যাব্রিয়েল হ্যান্ডশেকের ভঙ্গিতে হাতে যেন আলগা চাপ দিলো। ঠোঁটে খুব সুক্ষ হাসি অথবা নেই তবে নদীর মনে হলো; যেন রেস্তোরাঁর বাইরের কোমল হৃদয়ের ছেলেটা উঁকি দিলো।
ডিউটি যেতে যেতে নদীর মাথার মধ্যে নিশির কথাগুলো খেলছে
” ব্ল্যাংক স্পেস তৈরি হবে তবেই কিচেনে তোর এন্ট্রি হবে,নয়তো বাবুর্চিকে ইম্প্রেস্ট করবি কী করে? ”
নদীর চোখ চকচক করছে। ব্ল্যাংক স্পেস তৈরির একটা পন্থা তার চোখে হঠাৎ স্পষ্ট ধরা দিচ্ছে।এটা কি সম্ভব? ঠিকঠাক ভাবে গুছিয়ে করলে নিশ্চয়ই সম্ভব।ঝুঁকি নিতেই হবে। নিয়তি বিনাকারণে তাকে চন্দ্রমল্লিকায় আনেনি সেটা পর্যন্ত যেতে তাকে কিছু ক্রুর হতে হবে হয়তো ।
(চলবে)
ডিসক্লেইমার