#বাবুইপাখির অনুভূতি
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🕊️
— পর্বঃ৩১+৩২+৩৩
_________________
ঘাবড়ানো মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে শুভ রিনির মুখের দিকে। বুকের ভিতর এক অজানা ভয় কাজ করছে তার ভিতর, না জানি সত্যি রিনি তাঁর কথা শুনে ফেললো নাকি। শুভকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবারো বলে উঠল রিনি,
‘ আপনি কি এইমাত্র আমার নাম নিয়ে কিছু বলেছেন?’
রিনির কথা শুনে হাল্কা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল শুভ,
‘ না হ্যাঁ না আসলে, না কিছু বলি নি শুধু বলেছি আকাশটা খুব সুন্দর আজকের তাই না রিনি।’
‘ ওহ, না আমি জানো অন্যকিছু শুনলাম এনিভে এখন আমায় যেতে হবে।’
‘ ওহ ওকে।’
‘ আপনি যাবেন না?’
‘ হুম যাবো আপনি যান?’
‘ ওকে বাই এন্ড থ্যাংক ইউ ফর ইয়োর এডভাইস।’
‘ ইট’স ওঁকে।’
উওরে রিনি আর কিছু না বলে চলে যায় তাঁর গাড়ির কাছে। তারপর গাড়ির ভিতর ঢুকে সিটব্লেট লাগিয়ে হাত নাড়িয়ে আর একবার শুভকে বাই জানিয়ে চলে যায় সে।’
শুভ কিছুক্ষন রিনির যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে আবার দৃষ্টি রাখে আকাশ পথে। তারপর জোরে এক নিশ্বাস ফেলে প্রচন্ড ভয় পেয়েছিল সে। না জানি তাঁর কথাটা শুনলে রিনি কি করতো?’
____
পরেরদিন সকালে মাকে বিদায় জানিয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বের হয় আহি। যাওয়ার আগে একবার সে তাকিয়ে ছিল তিন’তলায় ওঠা সিঁড়ির দিকে। আজ প্রায় চারদিন হয়ে গেল আহি একবারও দেখতে পায় নি নীরবকে। সেই ছাঁদে বসে যে নীরবের সাথে কথা হয়েছিল তাঁর সাথে তারপর আর দেখা হয়নি। তবে আহি বেশ বুঝতে পেরেছে অথৈ চলে যাওয়ার জন্যই নীরব ভাইয়া আপসেট। কারন সেদিন আন্টি বলে ছিল নীরব ভাইয়া নাকি দু’দিন যাবৎ রুম থেকেই বের হয় না। এই মুহূর্তে আহি আর নীরবের মনের অবস্থাটা হয়তো সেইম। আর বেশি ভাবলো না আহি নীরবের কথা ভাবলেই একটা অস্থিরতা আর খারাপ লাগা কাজ করে তার ভিতর। আহি জোরে শ্বাস ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলো এমন সময় হুট করে তাঁর সামনে চলে আসলো নীরব। ধাপ করে আচমকা নীরবকে দেখে চমকে উঠলো আহি সাথে বুকের ভিতর ধুকপুকানি বেড়ে গেল তার। আহি তাকালো নীরবের মুখের দিকে। একদমই অন্যমনস্ক আর অগোছালো লাগছে নীরবকে আহি বেশ বুঝতে পেরেছে নীরবের এমন অবস্থা কেন। আহি হাল্কা হেঁসে বললো নীরবকে,
‘ কেমন আছো ভাইয়া?’
‘ হুম ভালো তুই?’
‘ হুম ভালো তোমায় তো দেখাই যায় না সারাদিন থাকো কোথায়?’
আহির কথা শুনে হাল্কা হেঁসে বললো নীরব,
‘ আর বলিস না পড়াশোনার জন্য রুম থেকে বের হওয়াই হয় না।’
আহি নীরবের কথার ধরন দেখে বেশ বুঝতে পেরেছে নীরব মিথ্যে কথা বলছে। আহি হাল্কা হেঁসে বললো নীরবকে,
‘ ওহ তা এখন যাচ্ছো কোথাও নাকি ফিরছো?’
‘ দুটোই, আমার বহুবছর পুরনো এক বন্ধুর কাজিনের বিয়ে সেখানে যাবো আর কি?’
‘ ওহ?’
‘ হুম তবে যেতে চাই নি বুঝলি কিন্তু বন্ধুর জোরাজোরিতে যাওয়া লাগছে।’
‘ যাও কিছুদিন অন্য জায়গা থেকে ঘুরে আসলে তোমার মনটা ভালো থাকবে?’
আহির কথা শুনে নীরব বুঝতে পেরেছে আহি কিসের ইংগিত দিচ্ছে তাকে। নীরব ছলছল চোখে তাকালো আহির চোখের দিকে। আহি তক্ষৎনাত তাঁর দৃষ্টি সরিয়ে ফেললো নীরবের ওপর থেকে। তারপর নীরবের দিকে আর না তাকিয়েই চটজলদি বলে উঠল আহি,
‘ আমায় যেতে হবে ভাইয়া আর তুমিও যাও বাই?’
বলেই একপ্রকার দৌড়ে চলে আসলো আহি। হয়তো আর বেশিক্ষণ নীরবের সামনে থাকলেই তাঁর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়াটা নীরব দেখে ফেলতো।’
অন্যদিকে নীরব ঠিকই বুঝতে পেরেছে আহি কেন এইভাবে চলে গেল। আহির জন্য প্রচন্ড খারাপ লাগছে নীরবের। সাথে নিজের জন্যও দু’দিন আগেই অথৈর এক ক্লাসমেটের কাছ থেকে নীরব জানতে পেরেছে অথৈ ভার্সিটি ছেড়ে চলে গেছে। অথৈ চলে গেছে এটা জানার পর থেকেই খুব বাজে সময় যাচ্ছে তাঁর, সাথে আহির জন্য খারাপ লাগছে। হয়তো আহিকে কষ্ট দেওয়ার জন্যই তাঁকেও কষ্ট পেতে হচ্ছে। কিন্তু সেই বা কি করতো সে তো আহিকে ভালোবাসে না। কখনো সেই নজরে ভাবেও নি আহিকে নিয়ে। ছোট্ট দীর্ঘ শ্বাস ফেললো নীরব তাঁরপর চটজলদি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো সে।’
____
মনখারাপ নিয়েই আস্তে আস্তে হাঁটছে আহি। চোখের কোনে পানি ভড় করেছে তাঁর। ভীষণ জোরে কান্না পাচ্ছে আহির। কিন্তু এই মুহূর্তে রাস্তার মাঝখানে বসে কান্না করাটা মোটেও পসিবল নয়। এই মুহূর্তে আহির মাথায় একটা কথাই আসছে,
ভালোবাসা মানুষকে যতটা না আনন্দ দেয় তাঁর থেকেও বেশি কষ্ট দেয়। এতদিন নীরবকে দেখলেই এক অদ্ভুত অনুভূতি হতো আহির সাথে অসম্ভব ভালো লাগা। কিন্তু আজ এই নীরবকে দেখলে যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছুই হয় না আহির। চোখের কোনে পানিটা মুছে যেতে নিলো আহি। এমন সময় হুট করেই তাঁর সামনে এসে থামলো একটা গাড়ি। হুট করে এমনটা হওয়াতে প্রচন্ড ঘাবড়ে যায় আহি। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে আস্তে আস্তে তাকায় সে গাড়ির দিকে।
আহিকে গাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে আদ্রিয়ানও তাঁর গাড়ির জানালাটা খুলে ফেললো। গাড়ির কালো জানালাটা যেতেই ভিতরে আদ্রিয়ানকে দেখে অবাক হয়ে বললো আহি,
‘ আপনি?’
‘ হুম আমি। গাড়িতে বসো আমি তোমায় পৌঁছে দেই ভার্সিটি যাবে তো?’
‘ হুম ভার্সিটিই যাবো কিন্তু, আপনার গাড়ি লাগবে না আমি একাই যেতে পারবো।’
‘ তুমি এত কথা বলো কেন, বলো তো গাড়িতে বসতে বলেছি সো গাড়িতে বসো।’
‘ কিন্তু?’
‘ কোনো কিন্তু নেই কুইকলি আসো?’
আদ্রিয়ানের কথা শুনে কিছুটা বাধ্য হয়েই আহি বসলো আদ্রিয়ানের গাড়িতে। আহি বসতেই আদ্রিয়ান বলে উঠল,
‘ সিটবেল্ট লাগিয়ে নেও?’
আদ্রিয়ানের কথা শুনে আহিও হাল্কা চমকে উঠে বললো,
‘ হুম।’
তারপর তাড়াতাড়ি সিটবেল্ট লাগিয়ে নিলো সে। আহি সিটবেল্ট লাগানো শেষ হতেই আদ্রিয়ান তাঁর গাড়ি স্টার্ট দিলো। কিছুদূর এগোতেই আদ্রিয়ান বলে উঠল,
‘ এবার বলো কাঁদছিলে কেন?’
আদ্রিয়ানের কথা শুনে আহি অবাক হয়ে পাল্টা কিছু বলতে যাবে তাঁর আগেই আদ্রিয়ান বলে উঠল,
‘ আমি দেখেছি তাই নো এক্সকিউজ, কাঁদছিলে কেন শুধু সেটা বলো?’
‘ আসলে?’
‘ নীরবের সাথে দেখা হয়েছিল নাকি?’
এবার যেন আদ্রিয়ানের কথা শুনে অবাকের চরম সীমানায় পৌঁছে যায় আহি। আহি অবাক হয়েই বলে উঠল,
‘ আপনি কি করে বুঝলেন?’
‘ জাস্ট গেস করেছি, দেখা হয়েছিল নীরবের সাথে?’
উওরে উপর নীচ করে মাথা নাড়ায় আহি। আহির মাথা নাড়ানো দেখে আদ্রিয়ান এক নিশ্বাস ফেলে বললো,
‘ সত্যি বলতে কি এইসব ভালোবাসা টালোবাসার উপর বিন্দুমাত্র ধারনা নেই আমার। কিন্তু তারপরও কিছু কথা বলতে চাই তোমায়। দেখো সবার জন্য সবাই জন্মায় নায়। সবার প্রতি সবার ফিলিংসও হয় না। আমি যদি এই মুহূর্তে নীরবকে দোষ দেই তাহলে সেটা সম্পূর্ণই ভুল হবে। কারন ওর কোনো দোষ নেই তুমি ছোট বেলা থেকে নীরবকে যে নজরে দেখেছো ও তোমাকে সেই নজরে কখনোই দেখে নি। আগেই তো বলেছি সবার জন্য সবার ফিলিংস হয় না। নীরব ভালোবাসে অন্য আরেকজনকে, তাই অকারণে এইসব ভালোবাসা নিয়ে সময় নষ্ট করো না সাথে মনখারাপও কর না। তোমার জন্য কেউ না কেউ আছে যে তোমায় সত্যিকারের ভালোবাসবে। হতে পারে তুমি এখন নীরবকে যতটা ভালোবাসো তাঁর থেকেও অন্যকেউ তোমায় বেশি ভালোবাসবে। তাই মন খারাপ করো না দেখবে ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। ভুলে যাও নীরবকে, চেষ্টা করো ভুলে যাওয়ার দেখবে সব ঠিক গেছে।’
আদ্রিয়ানে কথাগুলো সব ভালো মতো শুনলেও শেষের লাইনটা শুনে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আহির। কি করে সে ভুলে যাবে নীরবকে। তার একটু একটু করে গড়ে ওঠা অনুভূতিগুলো কি এইভাবে ভুলে যাওয়া যাবে। আহি না চাইতেও তাঁর চোখ দিয়ে আপনাআপনি পানি গড়িয়ে পড়লো। আহিকে কাঁদতে দেখে আদ্রিয়ান আহির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আরে আরে কাঁদছো কেন?’
উওরে কিছু বললো না আহি। আহিকে চুপ থাকতে দেখে আদ্রিয়ান তাঁর গাড়ি থামালো তারপর আহির দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো,
‘ তুমি কাঁদছো কেন? আমি কাঁদার মতো কিছু বলেছি তোমায় আমি জানি তুমি নীরবকে অনেক ভালোবাসো কিন্তু ও তো তোমায় ভালোবাসে না। তাই এক্ষেত্রে ভুলে যাওয়াই ঠিক হবে তাই না।’
‘ আপনি এভাবে বলবেন না প্লিজ আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’
বলতে বলতে হেঁচকি উঠে যায় আহির। আহির কাজে আদ্রিয়ান আহির দু’গাল চেপে ধরে বললো,
‘ ঠিক আছে আমি আর কিছু বলবো না তুমি প্লিজ কেঁদো না। তোমায় বলেছিলাম না তুমি কাঁদলে তোমায় ভালো লাগে না।’
বলেই আহির চোখের পানি মুছে দিলো আদ্রিয়ান। আদ্রিয়ানের কাজে আহি শুধু কান্নাভেঁজা চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইলো আদ্রিয়ানের মুখের দিকে।’
আদ্রিয়ান আহির চোখের পানি মুছে দিয়ে চটজলদি আবারো গাড়ি স্টার্ট দিলো।’
__
আহিদের ভার্সিটির সামনে এসে গাড়ি থামালো আদ্রিয়ান। ভার্সিটি চলে আসাতে আহিও নামতে নিলো গাড়ি থেকে। হঠাৎই আদ্রিয়ান বলে উঠল,
‘ তুমি হসপিটাল থেকে কয়টায় বের হও?’
হুট করেই আদ্রিয়ানের মুখে এমন কথা শুনে গাড়ির দরজা খুলতে নিয়েও থেমে যায় আহি। আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলে সে,
‘ মানে?’
‘ এখানে আবার মানে কিসের বলেছি হসপিটাল থেকে কয়টায় বের হও তুমি?’
‘ এই সাড়ে সাতটা থেকে আটটার ভিতর কেন বলুন তো?’
‘ ওঁকে সাড়ে সাতটার সময় আমি তোমার জন্য হসপিটালের বাহিরে অপেক্ষা করবো?’
‘ কেন বলুন তো?’
‘ সেটা না হয় তখন বলবো এখন যাও না হলে তোমার লেট হয়ে যাবে।’
উওরে আহি আর কিছু বলতে পারলো না গাড়ি থেকে নেমে যায় সে। আহি নামতেই আদ্রিয়ানও আর বেশিক্ষণ না দাঁড়িয়ে চলে যায়।’
কিছু কাজের জন্য এদিকটায় এসেছিল আদ্রিয়ান। কিন্তু হঠাৎই আহিকে এদিকে আসতে দেখে সাথে ওর চোখে দেখে বেশ বুঝতে পেরেছে আদ্রিয়ান আহি কোনো কারনে আপসেট। তাই তো গাড়ি থামিয়ে আহিকে গাড়িতে উঠানো। নীরবের বিষয়টা জাস্ট গেস করেই বলেছিল আদ্রিয়ান। তবে নীরব কানেক্টেট কোনো বিষয় নিয়েই কাঁদছিল আহি। এটা বেশ বুঝতে পেরেছিল আদ্রিয়ান। আর বেশি কিছু ভাবলো না আদ্রিয়ান চটজলদি গাড়ি নিয়ে এগোতে লাগলো সে।’
_____
দুপুরের কড়া রোদ্দুরে পেরিয়ে ছাউনি ভরা গাছেদের ভিঁড়ের ভিতর দিয়ে হাঁটছে অথৈ। কাল সন্ধ্যা রাতের দিক দিয়ে তাঁর কাকিমার বাড়ি এসে পৌঁছেছে তাঁরা। পুরো সকালটা ঘুমিয়েই কাটিয়েছে অথৈ।’
আর বর্তমানে অথৈ সেই রাস্তাটা দিয়েই যাচ্ছে যেখান থেকে প্রথম তাঁর অনুভূতি ঘেরা চশমা পড়া ছেলেটিকে দেখেছিল সে। গ্রীন কালার জর্জেট থ্রি-পিচ, খোলা চুল, হাতে হাল্কা পাতলা কিছু চুড়ি সাথে চোখে চশমা পড়ে এগোচ্ছে অথৈ। আজও সে সেই টংয়ের দোকানের উদ্দেশ্যে হাঁটছে কিছু লজেন্স কেনার জন্য। আশেপাশের পরিবেশ তাঁকে বার বার সেই ছেলেটাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। যদিও এগুলো এগুলো নতুন কিছু নয় অথৈ যতবারই এখানে আসে ততবারই সেই ছেলেটাকে মনে পড়ে তাঁর। সেই রাস্তা, সেই ফুলগাছ, সেই বাতাস, সেই নদীর তীর। সবকিছুই প্রায় একিরকমই আছে। অথৈ ছোট্ট শ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল দোকানটার দিকে। কিন্তু আজও তাঁর ভাগ্য খারাপ কারন দোকানটা বন্ধ। অথৈ বেশ হতাশ হয়ে বললো,
‘ আজকেও বন্ধ। ধুর এই দোকানটা অলওয়েজ বন্ধই থাকে নাকি যখনই একা আসি তখনই বন্ধ ধুর ফালতু।’
বলেই বিরক্ত মাখা মুখ নিয়ে উল্টোদিক ঘুরে আবারও হাঁটা দিলো অথৈ। এমন সময় আচমকা একটা জোরে বাতাস আসলো। বাতাসটা এতটাই তীব্র ছিল যে অথৈর চোখে কিছু ধুলো ঢুকে যায়। চোখে কিছু যেতেই অথৈ তাঁর চোখের চশমাটা খুলে চোখ ডলতে লাগলো। এরই মাঝে তাঁর উল্টোদিক দিয়ে সাইকেলের বেল বাজার শব্দ আসলো। অথৈ বেশ হতাশ হয়ে আস্তে আস্তে চোখ খুলে সামনে তাকালো। কেউ একজন সাইকেল চালিয়ে তাঁর দিকেই আসছে। চোখে ধুলো পড়ায় ঠিকভাবে ছেলেটির চেহারারা দেখতে পারছে না অথৈ। পর পর কয়েকবার পলক ফেলে চোখের চশমাটা পড়ে আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকাতে লাগলো অথৈ। এবার সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। অথৈ ধীরে ধীরে তাকাতে লাগলো সামনের ছেলেটির মুখের দিকে। ছেলেটির ফেস দেখেই থমকে গেল অথৈ।’
!
!
!
!
!
#চলবে…..
#বাবুইপাখির_অনুভূতি🕊️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🕊️
— পর্বঃ৩২
_________________
হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে অথৈ নীরবের দিকে, কারন সাইকেলে করে আসা ছেলেটা আর কেউ নয় আমাদের নীরব। অথৈ কল্পনাও করতে পারে নি এই মুহূর্তে এইখানে নীরব থাকবে। জাস্ট হা দাঁড়িয়ে আছে অথৈ। তাঁর বিশ্বাসই হচ্ছে না এখানে সত্যি সত্যি নীরব এসেছে।’
এদিকে,
অথৈর মতো নীরবও বেশ অবাক হয়েছে অথৈকে দেখে। সে ভাবতেও পারে নি এখানে অথৈ থাকতে পারে। নীরবও অবাক হয়ে শুধু তাকিয়ে রইলো অথৈর দিকে। আর এই তাকিয়ে থাকাটাই তাঁর জন্য একটা বাজে ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো কারন নীরব অথৈকে দেখতে এতটাই মগ্ন ছিল যে, সে যে সাইকেল চালাচ্ছে এটাই ভুলে গেছে। আর এই ভুলে যাওয়ার কারনে ধারাম করে সাইকেল নিয়ে নিচে পড়ে গেল নীরব।’
নীরবকে পড়ে যেতে দেখে অথৈ হাসবে না কাঁদবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। সে জাস্ট অবিশ্বাস্য চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে নীরবের দিকে। যেন রিপিট টেলিক্যাস্ট হচ্ছে এমন কিছু। হঠাৎই অথৈর হুস আসতেই আস্তে আস্তে চলে যেতে লাগলো সে।’
অন্যদিকে অথৈ চলে যাচ্ছে বিষয়টা দেখতেই নীরবও চটজলদি উঠে যেতে চাইলো কিন্তু পড়ে গিয়ে তাঁর পা টা খুব বাজে ভাবে আঁটকে পড়েছে সাইকেলের সাথে। এই মুহূর্তে এই রাস্তাটাকে গালি ছাড়া আর কিছুই দিতে ইচ্ছে করছে না নীরবের। এই রাস্তাটা তাঁর জন্য খুব বাজে নীরবের মনে আছে এর আগেও বহুবছর অাগে একবার এই রাস্তাটায় সাইকেল নিয়ে পড়েছিল সে। আর তখনও অথৈর মতো একটা মেয়ে দেখেছিল তাঁকে। শুধু অথৈ তো তাকে দেখে নিরালায় হেঁটে গেল। কিন্তু সেই মেয়েটা হাসতে হাসতে হেঁটে গিয়েছিল। সেদিন ভীষণই রাগ হয়েছিল নীরবের। এমন সময় নীরবের দিকে দৌড়ে আসলো তাঁর ছোট বেলার পুরনো বন্ধু রবিন। নীরবের অবস্থা দেখে বললো সে,
‘ আরে পড়ে গেলি কি করে?’
‘ চোখে ধুলো ঢুকে গিয়েছিল তাই ব্যালেন্স সামলাতে না পেরে পড়ে গেছি এখন আমায় উঠা তাড়াতাড়ি।’
‘ হুম,
বলেই চটজলদি রবিন সাইকেলটাকে উঠালো নীরবের উপর থেকে। পায়ে কিছুটা ব্যাথা পেয়েছে নীরব। রবিন নীরবকে ধরে নিয়ে বসালো সামনে থাকা একটা বেঞ্চে তারপর বললো,
‘ ভাগ্যিস অথৈ বলেছিল আমায় তাই তো দৌড়ে আসলাম এখানে?’
‘ তুই চিনিস ওই মেয়েটাকে?’
‘ হুম চিনবো না কেন ও তো লিলির চাচাতো বোন। আরে তোর মনে নেই ও আর তুই তো ছোট বেলায় একসাথে মাছ ধরতি তারপর ওই যে মনে আছে আমের ঘটনাটা মালিক চলে আসায় তুই ওর হাত ধরে দৌড়ে ছিলি।’
এবার যেন নীরব চরম বেগে অবাক তার মানে সেদিনের সেই তাঁকে দেখে হাসা মেয়েটা অথৈ ছিল। নীরব অবাক হয়ে বললো রবিনকে,
‘ ওহ!’ আমি তো ওর কথা একদমই ভুলে গিয়েছিলাম জাস্ট মনে পড়েছিল।’
‘ ভুলে যাওয়ারই কথা কত বছর আগের কথা বলতো।’
‘ হুম তা অবশ্য ঠিক আমার যতদূর মনে পড়ে ছোট বেলায় ও চশমা পড়তো না।’
‘ হুম আগে পড়তো না এই কয়েক বছর আগে থেকেই পড়া শুরু করেছে এখন চল বাড়ি যাই কাল আবার লিলির গায়ে হলুদের অনেক কাজ আছে,৷ আর তখনই না হয় তোর সাথে অথৈর পরিচয় করিয়ে দিবো।’
নীরবের কথা শুনে মনে মনে খুব খুশি হলো নীরব আস্তে আস্তে বসা থেকে উঠে হাঁটতে হাঁটতে বললো সে,
‘ তুই বললি ও নাকি আমার কথা তোকে বলেছে কিন্তু ও বুঝলো কিভাবে আমি তোর ফ্রেন্ড?’
‘ আরে ওই তোকে খুঁজতে খুঁজতে এদিকে আসছিলাম তখন আমি ওঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কোনো চশমা পড়া ছেলেকে দেখেছে কি না আর তখনই ও বললো তুই নাকি ঠ্যাং উল্টে সাইকেল নিয়ে পড়ে গেছিস।’
‘ কি ঠ্যাং উল্টে কোথায় পড়লাম পরলাম তো..
বলতে গিয়েও থেমে গেল নীরব। নীরবকে চুপ হতে দেখে বললো রবিন,
‘ কি হলো থেমে গেলি যে?’
‘ না কিছু না।’
উওরে হাল্কা হাসলো রবিন। রবিনকে হাসতে দেখে বললো নীরব,
‘ তুই হাসছিস কেন?’
‘ না কিছু না।’
‘ 😒😒😒
নীরবের চাহনী দেখে রবিন কিছু না বলে হাসতে হাসতে চলে গেল। আর নীরব শুধু রাগী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো রবিনের মুখের দিকে।’
____
রাত_৮ঃ০০টা…
হসপিটালের কাজ সেরে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে আস্তে আস্তে হসপিটাল থেকে বের হলো আহি। এরই মধ্যে তাঁর চোখ যায় আদ্রিয়ানের গাড়ির দিকে। আহি বেশ খানিকটা অবাক হয়েই এগিয়ে গেল আদ্রিয়ানের গাড়ির দিকে সে ভাবে নি আদ্রিয়ান সত্যি সত্যি এখানে আসবে।’
গাড়ির সিটে বুকে দু’হাত বেঁধে ঘুমিয়ে আছে আদ্রিয়ান। বেশ অনেকক্ষন আগেই এখানে এসেছে সে। শরীরটা হাল্কা ক্লান্ত থাকায় সাথে আহির জন্য অপেক্ষা করতে করতে গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়ে আদ্রিয়ান।’
গাড়ি জানালা থেকে উঁকি মারতেই আদ্রিয়ানকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে এখন ঠিক কি করবে আহি বুঝতে পারছে না ডাকবে নাকি না ডেকেই চলে যাবে। কি করবে না করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না আহি। একবার কি ডাকা উচিত তাঁর চরম বিরক্ত লাগছে আহির। আনমনেই আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো সে,
‘ আচ্ছা আমি যদি না ডেকেই চলে যাই তাহলে কি উনি রাগ করবে, কিন্তু ডেকেই বা কি বলবো
উফ্ মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আমার।’
বলেই মাথা ঝাঁকানি দিল আহি। এরই মধ্যে হাল্কা নড়ে চড়ে উঠলো আদ্রিয়ান। পরক্ষণেই আস্তে আস্তে চোখ খুললো সে। চোখ খুলেই গাড়ির বাহিরে আহিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো সে,
‘ তুমি এসেছো?’
হুট করেই আদ্রিয়ানের কন্ঠ কানে আসতেই হাল্কা চমকে উঠলো আহি তক্ষৎনাত আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো সে,
‘ হুম হ্যাঁ।’
‘ ভালো করেছো সেই কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি, গাড়ির ভিতর আসো?’
উওরে আহিও আর বেশি কিছু না ভেবে চলে যায় গাড়ির অন্যদিকে। তারপর গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে বসে সিটব্লেট লাগিয়ে বললো সে,
‘ আমার জন্য অপেক্ষা কেন করছিলেন?’
উওরে আদ্রিয়ান কিছুক্ষন চুুপ থেকে বললো,
‘ লং ড্রাইভে যাবে?’
আদ্রিয়ানের কথা শুনে আহি বেশ অবাক হয়ে বললো,
‘ মানে?’
_____
রাতের জোৎসা ভরা আলোতে নিজের রুমে বসে আছে শুভ। সামনেই টিভিতে একটা মুভি চলছে কিন্তু আপাতত শুভর সেই মুভির দিকে কোনো নজর নেই সে মগ্ন তাঁর রিনিকে নিয়ে, সাথে তাঁর অনুভূতিগুলো নিয়ে। শুভ বুঝতে পারছে না রিনির মাঝে এমন কি দেখলো সে যার জন্য রিনির কথা ভাবা ছাড়া আর কিছুই ভালো লাগছে না তাঁর। শুভর এখনো মনে আছে প্রথম যখন তাঁর সাথে রিনির দেখা হয়েছিল তাও ঝগড়ার মাধ্যমে ভার্সিটি বসে। সামান্য ‘আপু’ ডাকায় কিভাবে রেগে গিয়েছিল সে। সেদিন সত্যি রিনিকে দেখে ভিষণ ভয় পেয়েছিল শুভ। আনমনেই আসলো শুভ। এমন সময় হসপিটাল থেকে ফোন আসলো শুভর। ফোনের শব্দেই ধ্যান ভাঙলো তাঁর। শুভ চটজলদি ফোনটা তুলে অপর পাশে কিছু শুনতেই বলে উঠল,
‘ আমি এক্ষুনি আসছি?’
বলেই চটজলদি টিভি অফ করে টিশার্টের ওপর একটা শার্ট পড়ে গাড়ি করে বেরিয়ে গেল সে বাড়ি থেকে।’
____
খোলা আকাশের নিচে শহর থেকে কিছুটা দূরে একটা উঁচু রাস্তার পুলের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে আহি। আর তাঁর পাশেই গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিয়ান। কিছুক্ষন আগেই এখানে এসেছে তাঁরা। সাধারণত এখানে আসার মূল কারণ হলো সকালে আহির মন খারাপের জন্য। মুক্ত বাতাস বইছে চারপাশে, এখান থেকে পুরো শহরটাকে খুবই ছোট আর সুন্দর দেখাচ্ছে। পুরো শহরটাই যেন আলোকিত দেখাচ্ছে এখান থেকে। যেন খোলা আকাশের মাঝে তাঁরারা চিক চিক করছে নিচে, উপরে সত্যি কারে আকাশে তাঁরারা জ্বল জ্বল করছে আর নিচে শহরটা বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক আলোতে আলোকিত হওয়া বাতিতে চক চক করছে।’
আহি চোখ বন্ধ করে জোরে এক নিশ্বাস ফেললো। এরই মাঝে তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালো আদ্রিয়ান আনমনেই বলে উঠল সে,
‘ জায়গাটা সুন্দর না?’
আদ্রিয়ানের কথা শুনে আহি চোখ বন্ধ করেই বললো,
‘ হুম খুব।’
‘ আমার যখন খুব মন খারাপ হয় তখন আমি এখানে এসে দাঁড়াই, এখানে আসলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। সকালে তোমার মন খারাপ ছিল তাই ভাবলাম তোমাকেও এখানে একবার নিয়ে আসি হয়তো তোমারও মন খারাপ চলে যাবে।’
আদ্রিয়ানের কথা শুনে হাল্কা হেঁসে বললো আহি,
‘ থ্যাংক ইউ সো মাচ সত্যি জায়গাটা খুব সুন্দর। আমার খুব পছন্দ হয়েছে।’
উওরে মুচকি হাসলো আদ্রিয়ান। তারপর বললো সে,
‘ একটা জিনিস ট্রাই করবে দেখবে তোমার ভালো লাগবে?’
আদ্রিয়ানের কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে ভ্রূ কুঁচকে বললো আহি,
‘ সেটা কি?’
আহির কথা শুনে আহির কিছুটা কাছে এগিয়ে কিছু বললো আদ্রিয়ান। আদ্রিয়ানের কথা শুনে চোখ বড় বড় করে বললো আহি,
‘ না না এটা সম্ভব নয়।’
‘ আরে ট্রাস্ট মি, এখানে তুমি আমি ছাড়া আর কেউ নেই ট্রাই তো করে দেখো।’
‘ কিন্তু?’
‘ কোনো কিন্তু নয় একবার চেষ্টা তো করো, দেখবে মনটা হাল্কা লাগবে?’
আদ্রিয়ানের কথা শুনে আহিও আস্তে আস্তে রেলিংয়ের দিকে ঘুরে আকাশের দিকে তাকিয়ে জোরে এক চিৎকার দিয়ে বললো,
‘ নীরব ভাইয়া আমি তোমায় ভুলে যাবো দেখে নিও, তোমার প্রতি আমার থাকা যত অনুভূতি ছিল সবকিছুকে ভুলে গিয়ে আবারো নতুন করে সবকিছু শুরু করবো। তোমায় নিয়ে ঘেরা আমার সেই ‘বাবুইপাখির অনুভূতি’ গুলোকে ভুলে নতুন করে জীবনটাকে সাজাবো আমি। আর তুমিও ভালো থেকো।’
এইরকম নীরব কানেক্টেড আরো অনেককিছু চেঁচিয়ে বললো আহি। আর আদ্রিয়ান শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো আহির দিকে। এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে তার ভিতর। আদ্রিয়ান নীরবেই রেলিংয়ের দিকে ঘুরে তাকালো আকাশ পথে। আকাশের তাঁরারা জ্বল জ্বল করছে তাদের দিকে কিছু ভাবলো আদ্রিয়ান।’
‘ মন খারাপ, ভালো লাগা, আনন্দে থাকা, দুঃখ কষ্ট সবকিছু নিয়েই তো জীবন। আর এই জিনিসগুলোকে সময়ের সাথে সাথে উপভোগ করতে পারলেই জীবনকে খুব সুন্দর মনে হবে।’
ছোট্ট দীর্ঘ শ্বাস ফেললো আদ্রিয়ান।’
বেশ কিছুক্ষন পর,
আদ্রিয়ান আহির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ এবার তবে যাওয়া যাক?’
উওরে আহিও উৎসাহের সাথে হাসিমাখা মুখ নিয়ে বললো,
‘ হুম।’
!
!
!
!
!
#চলবে…..
#বাবুইপাখির_অনুভূতি🕊️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🕊️
— পর্বঃ৩৩
_________________
একটা বড় রেস্টুরেন্টের জানালার পাশ দিয়ে পাশাপাশি চেয়ারে বসে আছে আহি আর আদ্রিয়ান। কিছুক্ষন আগেই আদ্রিয়ান গাড়ি করে এখানে নিয়ে আসে আহিকে। আহি প্রথমে ভাবে নি আদ্রিয়ান তাঁকে এখানে নিয়ে আসবে। শুরুতে সে যেতে চায় নি কিন্তু পড়ে আদ্রিয়ানের জোরাজোরিতে আসতে হয় তাঁকে। আহির বাহিরের খাবার খুব একটা পছন্দ নয় এমনটা নয় সে একেবারেই পছন্দ করে না। করে অল্প স্বল্প। আদ্রিয়ান আহির দিকে মেনুকাটটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
‘ কি খাবে বলো?’
আহি মেনুকাটের সব খাবারগুলো দেখলো সাথে খাবারের দামও দেখলো। খাবারের দাম দেখে তাঁর চোখ চড়ুইগাছ কারন এক একটা খাবারের দাম প্রায় ২ থেকে ৪ হাজারের উপরে। আহি দাম দেখেই বললো,
‘ এগুলোর তো অনেক দাম আমি এগুলো খাবো না।’
‘ আরে তুমি দাম দেখছো কেন খাবার কোনগুলো খাবে সেটা বলো?’
আহি মেনুকাটে আর একবার চোখ বুলিয়ে মেনুকাটটা আদ্রিয়ানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠল,
‘ না না আমি এসব খাবো না।’
আহির কাজে আদ্রিয়ান কিছুটা হতাশ হয়ে বললো,
‘ আরে তুমি এমন করছো কেন আচ্ছা তোমায় অর্ডার করতে হবে না আমি অর্ডার করে দিচ্ছি?’
বলেই কিছু ভালো ভালো খাবার অর্ডার করলো আদ্রিয়ান। ওয়েটারও আদ্রিয়ানের কথা মতো চলে যায় খাবার আনতে। কিছুক্ষনের মধ্যেই ওয়েটার সব খাবারগুলো এনে টেবিলে সাজিয়ে রাখে।’
আহি এওতো এওতো খাবার দেখে চোখ বড় বড় করে বলে উঠল,
‘ এত খাবার কে খাবে?’
‘ কেন তুমি?’
‘ আপনার কি আমাকে রাক্ষস মনে হয় যে এতোগুলা খাবার আমি খাবো।’
‘ আগে শুরু তো করো।’
এতটুকু বলে আদ্রিয়ান নিজের খাবার দেখে নিলো। শুরুতে সফট ড্রিংকস দিয়ে শুরু করলো দুজন। তারপর এঁকে এঁকে সব খাবারগুলো খেতে লাগলো আহি আর আদ্রিয়ান। আহি দুই তিনপদ খেয়েই আর পারছে না কারন খাবারগুলো খুব একটা পছন্দ হয় নি তাঁর। যেহেতু আদ্রিয়ান এসব খেতে অভ্যস্ত তাই খুব একটা সমস্যা হয় নি তাঁর।’
অতঃপর খাবার খেয়ে রেস্টুরেন্টের বিল মিটিয়ে দুজনেই বেরিয়ে পড়লো। রেস্টুরেন্টের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিয়ান আর আহি। আহির মুখে তেমন কোনো কথা নেই। আদ্রিয়ান আহির মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ কি হলো মুড অফ হয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন খাবার পছন্দ হয় নি?’
‘ না বিষয়টা তেমন নয় এতগুলো টাকা খরচ করার কি ছিল তাঁর চেয়ে আমাদের ওখানে শাফিন চাচার হাজী বিরিয়ানি খেলেও ভালো হতো অল্প দামে অনেক পাওয়া যেত।’
‘ তোমার এত বড় দামি রেস্টুরেন্টের এতো এতো খাবার রেখে বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছে করলো এটা আগে বলবে তো এখানেও বিরিয়ানি পাওয়া যায় খাবে?’
‘ না এখানের খাবার ভালো লাগে নি, অন্য এক সময় আপনাকে আমাদের ওখানের শাফিন চাচার হাতে রান্না করা বিরিয়ানি খাওয়াবো। দেখবেন কি মজা?’
‘ ঠিক আছে কোনো এক সময় যাবো এখন বাড়ি যাবে তো রাত কিন্তু প্রায় এগারোটার কাছাকাছি বেজে গেছে।’ (হাতের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে)
ঘড়ির টাইমের কথা শুনতেই আহি চোখ বড় বড় করে বললো,
‘ কি এগারোটা বেজে গেছে তাড়াতাড়ি চলুন আজ মা গায়ে ঝাড়ু ভাংবে আমার।’
আহির কথা শুনে আদ্রিয়ান হাসতে হাসতে বললো,
‘ তাই?’
‘ তাই নয়তো কি আপনি জানেন না আমার মা কতটা ডেঞ্জারাস এমনিতেও রাত করে হসপিটাল থাকি বলেও তাঁর হাজার সমস্যা চলুন চলুন তাড়াতাড়ি যাওয়া যাক।’
বলেই এই প্রকার দৌড়ে গাড়িতে বসলো আহি। আহির কাজে আদ্রিয়ানও আর বেশি কিছু না ভেবে হাসতে হাসতে চলে যায় গাড়ির কাছে তারপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চললো তাঁরা নিজেদের গন্তব্যের দিকে।’
_____
হসপিটালের ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে রিনি আর রিনির মা বাবা সাথে সোহানের কিছু ফ্রেন্ড। সবার চোখে মুখেই দুশ্চিন্তার ছাপ,সোহানের মা তো অলরেডি কান্না কাটি শুরু করে দিয়েছে।’
কারন কিছুক্ষন আগেই বাসায় আসতে গিয়ে বাইক এক্সিডেন্ট করেছে সোহান। খুব গুরুতরভাবে মাথায় আর হাতে পায়ে ব্যাথা পেয়েছে সে। খুব শীঘ্রই অপারেশন করতে না পারলে সোহানকে বাঁচানো যাবে না।’
এরই মধ্যে গায়ে কমলা রঙের টিশার্ট সাথে সাদা শার্ট পড়ে হতভম্ব হয়ে দ্রুত ভিতরে ঢুকলো শুভ। কারন কিছুক্ষন আগেই সে জেনেছে কেউ একজন বাইক এক্সিডেন্ট করে হসপিটালে ভর্তি হয়েছে আর এক ঘন্টার মধ্যেই তাঁকে অপারেশন করাতে হবে। শুভ হলো একজন ডাক্তার। ৬ মাসই হয়েছে সে এখানে জয়েন্ট হয়েছে।’
এদিকে এরই মধ্যে রিনি ওদের সামনে আসলো আর একজন সাদা এপ্রোন পরিধিত ডাক্তার। যিনি বর্তমানে সোহানকে দেখছেন। ওনাকে দেখেই রিনিসহ রিনির বাবা মা এগিয়ে গিয়ে বললো,
‘ কেমন আছে আমার ছেলে ডক্টর?’
‘ দেখুন ওনার সিচুয়েশন খুবই কিটিকাল, এই মুহূর্তে শুধু এতটুকুই বলতে পারি টেনশন নিবেন না আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন। আর কিছুক্ষনের মধ্যেই ওনাকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হবে।’
ডাক্তারের কথা শুনে রিনির বাবা বলে উঠল,
‘ যত টাকার লাগবে নিন ডক্টর কিন্তু আমার ছেলেকে শুধু বাঁচিয়ে দিন?’
‘ দেখুন বাঁচা মরা সবই আল্লাহর হাতে আর ওনার যে অবস্থা তাতে বাঁচার চান্স খুবই কম, তবে টেনশন নিবেন না আমাদের এখানে সুযোগ্য একজন ডাক্তার আছে যিনি এইসব বিষয়ে খুবই ভালোভাবে হ্যান্ডেল করতে পারে। আমরা ফোন করেছি ওনাকে কিছুক্ষনের মধ্যেই হয়তো চলে আসবে..
বলতেই বলতেই সামনে দিক দিয়ে শুভকে নিজের দিকে আসতে দেখে বলে উঠলেন সেই ডাক্তার,
‘ ওই তো শুভ চলে এসেছে।’
‘শুভ’ নামটা কানে আসতেই কিছুটা অবাক হয়ে তাকালো রিনি সামনের ছেলেটির দিকে এই ডাক্তার শুভই ওই শুভ দেখেই চোখ ছানাবরা রিনির। ওই ভীতু মার্কা সহজ-সরল ছেলেটা একজন ডাক্তার। ভাবতেই কেমন লাগলো রিনির। আর সে কিনা সেদিন ভার্সিটি বসে এই ছেলেটার রাগের চোটে কলার চেপে ধরেছিল।’
রিনির ভাবনার মাঝেই শুভর সাথে কথা হয় রিনির বাবা মায়ের। শুভও বলে ফেলে,
‘ টেনশন নিবেন না আল্লাহ উপর ভরসা রাখুন সব ঠিক হয়ে যাবে।’
হঠাৎই শুভর চোখ যায় রিনির দিকে। এতক্ষণ সে খেয়াল করেনি রিনিকে। শুভ রিনিকে দেখে বলে উঠল,
‘ উনি,
শুভর কথা শুনে রিনির বাবা বলে উঠল,
‘ ও আমার ছোট মেয়ে মানে পেসেন্টের ছোট বোন।’
‘ ওহ।’
এতটুকু বলে শুভ চলে যায় ভিতরে তাঁকে তৈরি হতে হবে।’
অতঃপর কিছুক্ষনের মধ্যেই গায়ের পোশাক চেঞ্জ করে গায়ে ডাক্তারি পোশাক পড়ে হাতে মাস্ক নিয়ে বেরিয়ে আসলো শুভ। শুভকে দেখে জাস্ট হা হয়ে তাকিয়ে রইলো রিনি তাঁর এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না শুভ একজন ডাক্তার। তারপর কিছুক্ষনের মধ্যেই সোহানকে নিয়ে ঢোকা হলো অপারেশন থিয়েটারে। শুভ ভিতরে ঢোকার আগে একপলক রিনির দিকে তাকিয়ে চটজলদি মুখে মাস্ক পড়ে ঢুকে পড়লো ভিতরে। সবাই ঢুকতেই থিয়েটারের দরজা বন্ধ করে বাহিরের দেয়ালের উপরে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো লাল বাতি।’
খুব টেনশন মাখা মুখ আর অস্থিরতা নিয়েই বসে আছে সবাই। রিনিরও কান্না পাচ্ছে ভিষন, ভাইটার হুট করে এমন কিছু হবে ভাবতে পারে নি রিনি। ভাইয়ের সাথে কাটানো ছোটবেলার মুহূর্তগুলোর কথা বার বার মনে পড়ছে তাঁর। রিনি বসে থাকতে না পেরে উঠে চলে যায় অন্যদিকে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তাঁর।’
___
আহিদের বাড়ি সামনে এসে গাড়ি থামালো আদ্রিয়ান। আহিও হাসিমুখে আদ্রিয়ানকে বিদায় সাথে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যায় ভিতরে। আর আদ্রিয়ানও বেশিক্ষণ না দাঁড়িয়ে চলে যায় তাঁর নিজের বাড়ির দিকে। আজ তাঁর ভীষণ ভালো লাগছে। ইদানীং আহির সাথে সময় কাটাতে ভীষণ ভালো লাগে আদ্রিয়ানের। আনমনেই মুচকি হেঁসে বললো আদ্রিয়ান,
‘ আমি কি তবে আহিকে পছন্দ করতে শুরু করেছি?’
কথাটা মাথায় আসতেই কেমন একটু লাগলো আদ্রিয়ানের। নিজের কথা শুনে নিজেই যেন অবাক আদ্রিয়ান। পরক্ষণেই নিজের মাথাটা ঝাঁকিয়ে বললো আদ্রিয়ান,
‘ ধুর! কিসব উল্টো পাল্টা জিনিস ভাবছি আমি?’
বলেই আহিকে নিয়ে আর কিছু না ভেবে চললো আদ্রিয়ান গাড়ি নিয়ে।’
অন্যদিকে,
বাড়ির কলিং বাজাতেই আহির ফোনটা বেজে উঠল উপরে রিনির নাম্বার দেখে ফোনটা তুলে বললো আহি,
‘ হুম বল?’
উওরে অপরপাশে রিনির কান্না ভেঁজা কন্ঠের কথা শুনে থমকে গেল আহি। আহি হতাশা ভরা কন্ঠ নিয়ে বললো,
‘ তুই টেনশন করিস না আমি এক্ষুনি আসছি?’
এরই মধ্যে আহির মা এসে দরজা খুলে দিল আহিকে কিছু বলবে তাঁর আগেই আহি বলে উঠল,
‘ তোমার কথা পড়ে শুনবো মা, সোহান ভাইয়ার এক্সিডেন্ট হয়েছে আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে।’
‘ কি করে হলো?
‘ তোমায় সব পড়ে বলবো মা।’
বলেই দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল আহি। আর আহির মা কিছু বলতে চেয়েও আর বলতে পারলো না।’
_____
ঘড়ির কাঁটায় প্রায় একটার কাঁটায় ছুঁই ছুঁই। এখনো অপারেশন চলছে ভিতরে। ভয়ে হাত পা কাঁপছে সবার। যদিও সেটা কেউ বাহিরে বের করছে না সবাই নিজেকে সামলে নিয়ে শক্ত হয়ে বসে আছে। আর রিনিও সবার থেকে কিছুটা দূরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।’
এরই মধ্যে অপারেশন থিয়েটারের লাইট অফ হয়ে গেল। লাইট অফ হতেই সবাই একপ্রকার দৌড়ে দাঁড়ালো থিয়েটারের সামনে। না জানি ডাক্তার বেরিয়ে এসে কি বলবে তাদের।’
বলতে না বলতেই ধীরে ধীরে বের হলো শুভসহ বাকি সবাই। খুব যত্নসহকারেই পুরো কাজটা করেছে তাঁরা। সবার মুখে সাকসেসফুল হওয়ার হাসি। রিনির মা শুভর সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
‘ কেমন আছে আমার ছেলেটা বাবা?’
শুভ মুচকি হেঁসে রিনির মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ সব ঠিক আছে পেসেন্ট এখন বিপদমুক্ত। কাল সকালেই আপনারা ওনার সাথে দেখা করতে পারবেন।’
‘ থ্যাংক ইউ ডাক্তার। (রিনির বাবা)
‘ ইট’স ওকে আঙ্কেল।’
বলেই চলে যায় শুভ। এবার আর রিনির দিকে তাকায় নি শুভ। শুভর কথা শুনে রিনির কান্না ভেঁজা মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলো আহি। রিনিসহ সবাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো সে,
‘ রিনি?’
আহির কন্ঠ কানে আসতেই রিনি তাকালো আহির দিকে তারপর ওর সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
‘ দোস্ত তুই এসেছিস?’
‘ হুম কেমন আছে সোহান ভাইয়া?’
‘ হুম ভালো। ডাক্তার বলেছে কাল সকালেই ভাইয়ার সাথে দেখা করা যাবে।’
এতক্ষণ পর যেন রিনির কথা শুনে সস্থির নিশ্বাস ফেললো আহি। রিনি আহির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ জানিস ভাইয়ার অপারেশন কে করেছে?’
‘ হুম শুনবো তাঁর আগে মাকে একটা ফোন করে নেই বুঝলি, টেনশন করছে হয়তো?’
বলেই মোবাইল হাতে অন্য সাইডে চলে যায় আহি। আর রিনিও পাল্টা কিছু না বলে চলে যায় তাঁর মায়ের কাছে।’
_____
সূর্যের কড়া রোদ্দুরের মাঝে জানালার পাশে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে অথৈ। হঠাৎই মনে পড়লো তাঁর কালকের দুপুরের কথা নীরবকে দেখেছে সে। চোখের সামনে ভেঁসে আসলো তাঁর সেই কালকের সাইকেল নিয়ে নীরবের পড়ে যাওয়ার দৃশ্য।সাথে ভার্সিটি বসে নীরব তাকে প্রপোজ করছে তাঁর দৃশ্য, আহির কান্না ভেঁজা চেহারার কথা ভাবতেই হকচকিয়ে উঠল অথৈ।’
!
!
!
!
!
#চলবে…..