বাবুইপাখির অনুভূতি পর্ব-৪৬+৪৭+৪৮

0
275

#বাবুইপাখির অনুভূতি
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🕊️
— পর্বঃ৪৬+৪৭+৪৮
_________________

অতঃপর হসপিটালের মায়া ত্যাগ করে গাড়ি নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাচ্ছে আহি, নিলয় আর আদ্রিয়ান। আর ওদের হাত নাড়িয়ে বাই জানাচ্ছে রিনি আর শুভ। প্রথমে আহি অথৈদের বাড়ি যাবে কথাটা একটু অদ্ভুত লাগলেও পরক্ষণেই হাসি মনে মেনে নিয়েছে রিনি। রিনি সেদিন শুভর কথা শোনার পর ফোন করতে চাইছিল অথৈকে ফোন করেও ছিল কিন্তু আবার কেটে দেয় চটজলদি। ভিতরে ভিতরে আনিজি ফিল হওয়ার কারনে আর কথা বলা হয় নি তার অথৈর সাথে। কিন্তু এখন যখন আহি যেতে চাইছে অথৈদের বাড়ি তাহলে সেও সেখানে গিয়েই ক্ষমা চাইবে অথৈর কাছে। রিনি মুচকি হেঁসে তাকিয়ে রইলো আহির যাওয়ার পানে। আর আহিও বেশি না ভেবে কিছুক্ষন রিনি ওদের দিকে তাকিয়ে থেকে চুপচাপ বসে রইলো গাড়িতে। আর তার পাশেই চুপচাপ বসে আছে আদ্রিয়ান। আর সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে আছে নিলয়। কারো মুখেই কোনো কথা নেই। হয়তো পুরো রাস্তা নীরবতাতেই কাটবে তাদের।’

আর এদিকে নিলয় ওঁরা যেতেই রিনি বলে উঠল শুভকে,

‘ আমিও তবে যাই এখন?’

রিনির কথা শুনে শুভও বলে উঠল,

‘ এখনই চলে যাবে?’

‘ হুম।’

‘ ঠিক আছে সাবধানে যেও।’

‘ আচ্ছা বাই।’

বলে রিনিও বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলো। আর শুভ সেও কিছুক্ষন রিনির যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে চললো হসপিটালের ভিতরে। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে হবে যে তাঁকে। এখন থেকে আদ্রিয়ানের সাথে থাকবে সে,কথাটা ভাবতেই যেন শুভর চোখে মুখে খুশির ছাপ ফুটে উঠছে বারবার।’

____

অবশেষে সেই নীরবতার মধ্যে দিয়েই আদ্রিয়ানদের গাড়ি এসে থামলো আদ্রিয়ানের বাড়ির সামনে। তারপর আস্তে আস্তে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো আহি আর আদ্রিয়ান। শুধু নামলো না নিলয় কারন তাঁকে এখনই অফিসে যেতে হবে। আদ্রিয়ান বলে দিয়েছে সেও কাল থেকে অফিসে যাওয়া শুরু করবে। নিলয়ও মেনে নিয়েছে কারন এই মুহূর্তে সত্যি আদ্রিয়ানের প্রয়োজন আছে অফিসে।’

আদ্রিয়ান আহি নামতেই নিলয় ওদেরকে বাই জানিয়ে চলে গেল নিজের গন্তব্যের দিকে। আর আহি আদ্রিয়ান চললো বাড়ির ভিতরে। শুরুতেই আদ্রিয়ান বাড়ির দরজা খুলে আস্তে আস্তে গিয়ে বসলো সোফায়। আর আহি আশেপাশে চোখ বুলায় চারদিকে, চারপাশে পর্দা থাকায় পুরো বাড়িটায় যেন অন্ধকারে টুইটুম্বর হয়ে আছে আহি শুরুতেই তাঁর হাতের ব্যাগটাগুলো নিচে রেখে এগিয়ে যায় সামনে তারপর আস্তে আস্তে সরিয়ে দেয় থাইগ্রাস জড়িয়ে থাকা সাদা পর্দাগুলো। পর্দা সরাতেই পুরো রুম যেন আলোতে আলোকিত হয়ে গেছে। পর্দা সরাতেই সর্বপ্রথম আহির যেদিকে চোখ যায় সেটা হলো সুইমিংপুল। এই সুইমিংপুলটাকে আগে দেখে নি আহি এর আগের বার যখন প্রথম আদ্রিয়ানের বাড়ি দেখছিল তখন এদিকটা খেয়াল করে নি সে। এক ধমকা হাওয়া বয়ে আসলো রুম জুড়ে। আহি রুমের পর্দা সরিয়ে দিয়ে বললো আদ্রিয়ানকে,

‘ এখন বলুন আপনি কি খাবেন?’

‘ আমি কি খাবো তাঁর চেয়ে তুমি বলো তুমি কি খাবে আমি অর্ডার করে দিচ্ছি।’

‘ কি সারাদিন শুধু বাহিরের খাবার খান, কোনো কিছু অর্ডার করতে হবে না আজ বাড়িতে রান্না হবে।’

আহির কথা শুনে বেশ অবাক হয়েই বললো আদ্রিয়ান,

‘ কিন্তু তা কি করে সম্ভব, এখানে রান্না করার মতো কেউ নেই আহি।’

‘ কে বলেছে কেউ নেই আমি আছি না।’

আহির কথা শুনে কিছুটা বিস্মিত হয়ে বললো আদ্রিয়ান,

‘ মানে?’

‘ মানে আজ আমি আপনাকে রান্না করে খাওয়াবো।’

‘ কিন্তু আহি?’

‘ কোনো কিন্তু নয়। আচ্ছা আপনার বাড়ির রান্না ঘরটা কোনদিকে বলুন তো, এর আগে যখন এসেছিলাম তখন রান্নাঘরটা দেখা হয় নি?’

আদ্রিয়ান কিছু বলবে তাঁর আগেই আহি বলে উঠল,

‘ যাগ গে আপনি বাদ দিন আমি নিজেই খুঁজে নিচ্ছি।’

বলেই এগিয়ে যায় আহি সামনের দিকে। আর আদ্রিয়ান জাস্ট হা হয়ে তাকিয়ে থাকে আহির যাওয়ার পানে সে ভাবে নি এমন কিছু হবে।’

রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আহি কিন্তু রান্নাঘরের অবস্থা দেখে নিরাশ সে। কারন সে বুঝতে পেরেছে এই জায়গাটার ব্যবহার তেমন কেউ করে নি। আহি এগিয়ে যায় ফ্রিজের দিকে কিন্তু ফ্রিজ খুলে আরো নিরাশ যেন সে। কারন ফ্রিজ পুরো ফাঁকা, আশেপাশের সবকিছুর দিকেই চোখ বুলিয়ে দেখলো আহি কিন্তু রান্না করার মতো তেমন কিছুই মিললো না। অবশেষে আহি বুঝতে পারলো এখন কিছু রান্না করতে হলে সর্বপ্রথম তাকে বাজার করতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ আহি কিছুটা নিরাশ হয়ে চলে যায় আদ্রিয়ানের কাছে। আদ্রিয়ান জানতো আহি নিরাশ হয়েই বেরিয়ে আসবে রান্নাঘর থেকে কারন লাস্ট কবে আদ্রিয়ান বাজার করেছিল তাঁর মনে নেই। বাহিরের খাবার খাওয়াতেই অভ্যস্ত আদ্রিয়ান তাই সেইভাবে কখনোই বাজার করা হয় নি তাঁর, কারন নিজ হাতে রান্না করে খাওয়ার প্রয়োজন কখনোই পড়ে নি তাঁর। আহিকে দেখেই বলে উঠল আদ্রিয়ান,

‘ কি হলো রান্না করবে না?’

‘ কি রান্না করবো আমি রান্নাঘর তো পুরোই ফাঁকা।’

‘ সেটা আমিও জানি লাস্ট কবে রান্না করার জন্য কিছু কিনেছিলাম মনে নেই। যাগ গে এখন বলো কি খাবে আমি অর্ডার করে দেই।’

আদ্রিয়ানের কথার তেমন উওর না দিয়ে বলে উঠল আহি,

‘ চলুন আমার সাথে?’

আহির কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে বললো আদ্রিয়ান,

‘ কোথায় যাবো?’

‘ বাজার করতে।’

আহির এবারের কথা শুনে আদ্রিয়ান চোখ বড় বড় করে বললো,

‘ হোয়াট?’

____

শহরের অলিগলি পথ পেরিয়ে অবশেষে আদ্রিয়ান আর আহি এসে দাঁড়ালো একটা বড়সড় বাজারের ভিতর। অনেক লোকের আগমন সেখানে, এত মানুষের ভিড় দেখে কেমন যেন লাগছে আদ্রিয়ানের। এইসব জায়গায় ভুল করেও কখনো আসা হয় নি আদ্রিয়ানের। আদ্রিয়ান আশেপাশের পরিবেশ দেখে বলে উঠল আহিকে,

‘ আর ইউ শিওর আহি আমরা এটার ভিতরে ঢুকবো?’

‘ হুম আপনি জানেন না এখানে কম মূল্যে ভালো পন্য পাওয়া যায়।’

‘ এর চেয়ে আমরা কোনো সুপারশপে গেলে ভালো হতো না আহি?’

‘ কি যে বলেন ওখানে সবকিছু একদরে বিক্রি করে আর এখানের চেয়ে ডাবলদামে।’

‘ তাতে কি হইছে?’

‘ কি হইছে মানে শুধু শুধু বেশি টাকা খরচ করবো কেন চলুন তো আমার সাথে,

বলেই আদ্রিয়ানের হাত ধরে চললো আহি বাজারের ভিতরে। আর আদ্রিয়ানও কোনো উপায় না পেয়ে মুখে মাস্ক পড়ে চললো আহির সাথে।’

শুধুতেই সবজির দোকানের সামনে গেল আদ্রিয়ান আর আহি। আহি আশেপাশের সবকিছু দেখে চোখ গেল করলার দিকে, তাজা তাজা করলা দেখে বললো সে,

‘ করলার কত করে?’

‘ জ্বী ৭০ টাকা।’

লোকটার কথা শুনে আদ্রিয়ান বলে উঠল,

‘ তাহলে আমাদের ২ কিলো দিয়ে দিন।’

আদ্রিয়ানের কথা শুনে দোকানদারও মাপতে শুরু করলো করলা আর আহি একবার আদ্রিয়ানের দিকে বললো,

‘ আপনার কি মাথা ঠিক আছে সত্তর টাকা দিয়ে করলা কিনবো ৪০ টাকার উপরে একটাকাও দিবো না।’

আহির কথা শুনে দোকানদার হতাশ হয়ে বললো,

‘ এডা কি কইলেন আফা?’

‘ যা বলেছি তাই দিলে দিন না দিলে অন্যদোকান থেকে কিনবো।’

বলেই আদ্রিয়ানের হাত ধরে অন্যদিকে যেতে নিলো আহি। আহিকে যেতে দেখে দোকানদারও বলে উঠল,

‘ দাঁড়ান দিতাছি।’

দোকানদারের কথা শুনে আহিও খুশি হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সেখানে আর আদ্রিয়ান তো চরম প্রকার অবাক। দোকানদারের করলা মাপা দেখতে দেখতে আবারো বলে উঠল আহি,

‘ এই শাক কত করে?’

‘ ৪০ টাকা।’

‘ হুম ২৫ টাকার নিচে একটুও হবে না।’

এমনই করতে করতে বিভিন্ন পদের জিনিসপত্র কিনলো আহি আর আদ্রিয়ান শুধু হা হয়ে তাকিয়ে রইলো আহির কাজের দিকে কারন দোকানদার যেটারই দাম বলছে আহি সবকিছুই অর্ধেক অর্ধেক দাম বলছে? এভাবে পুরো বাজার ঘুরে এটা ওটা কিনে চললো আহি আর আদ্রিয়ান বাড়ির উদ্দেশ্যে। আজ প্রথমই আদ্রিয়ান এমনভাবে বাজার করার দৃশ্য দেখলো।’
____

রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের কাজ করছে আহি আর ওর পাশেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিয়ান। এমনটা নয় আহি রান্নাবান্না জানে না,টুকিটাকি যা জানে তাই সেভাবেই কাজ করছে সে। মাছ,ভাত, করলা ভাজি, আর ডাল এগুলোই রান্না করবে আহি। ভাত আর ডাল রান্না করা শেষ এখন শুধু মাছ আর করলা ভাজি বাকি। ঘেমে পুরো একাকার হয়ে গেছে সে তারওপর চুলগুলো খোলা। এই মুহূর্তে আহির বিরক্ত লাগছে নিজের ওপর, কেন সে কাজ শুরু করার আগে তাঁর চুল বেঁধে নেয় নি,সামনের চুলগুলোও তাকে বার বার বিরক্ত করছে আর বার বার হাত দিয়ে সেগুলোকে সরাতে সরাতে অতিষ্ঠ আহি।’

অন্যদিকে আহির এমন কাজ দেখে আদ্রিয়ান কিছু একটা ভেবে বেরিয়ে যায় রান্না ঘর থেকে। তারপর সোফার উপর আহির ব্যাগ থেকে একটা রাবার ব্যান্ট বের আবার চলে যায় আহির কাছে। তারপর আহির পিছনে দাঁড়িয়ে ওর সামনের চুলগুলোও পিছনে নিয়ে এসে সুন্দর করে সব চুলগুলো বেঁধে দিতে লাগলো আদ্রিয়ান।’

হুট করেই কিছুর স্পর্শ পেতেই চমকে উঠলো আহি পরক্ষণেই পিছনে আদ্রিয়ানকে দেখে তেমন কিছু ভাবলো না আহি। অন্যদিকে আদ্রিয়ান নিজের কাজ শেষ করে এসে দাঁড়ালো আবার কিছুটা দুরত্ব নিয়ে আর আহি আদ্রিয়ানের কাজে মুগ্ধ হয়ে আনমনেই মুচকি হেঁসে নিজের কাজে মন দিলো। আদ্রিয়ান শুধু তাকিয়ে রইলো আহির কাজের দিকে আজ প্রথম বোধহয় ঘরের রান্না খাবে আদ্রিয়ান তাও আবার আহির হাতের।’

অনেকক্ষন পর,

আহি তাঁর কাজ শেষ করে পুরো জায়গাটা পরিষ্কার করে জোরে এক নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো সে,

‘ এখন তবে আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন তারপর আপনাকে খেতে দিচ্ছি আমি।’

উওরে আদ্রিয়ানও খুশি মনে বললো,

‘ ঠিক আছে তুমিও যাও?’

‘ হুম, আপনি যান এই খাবারগুলো টেবিলে রেখে আমিও যাচ্ছি।’

উওরে আদ্রিয়ান আর কিছু না বলে চলে গেল নিজের রুমের দিকে।’

____

উপরের রুম থেকে সিঁড়ি বেয়ে ব্লাক ট্রাউজার সাথে এস কালার ফুল হাতার টিশার্ট পড়ে নিচে নেমে আসতে লাগলো আদ্রিয়ান, চুলগুলো এলেমেলো তাঁর। আর এদিকের নিচের সোজাসুজি রুম থেকে কিছুটা দ্রুত গতিতে, ভেজালো চুল, সাথে ওয়াইট থ্রি-পিচ পড়ে এগিয়ে আসছিল আহি কারন সে ভেবেছে তাঁর আগেই হয়তো আদ্রিয়ান ডাইনিং টেবিলে পৌঁছে গেছে। আর এই দ্রুত গতিতে আসাটাই তাঁর ভুল ছিল কারন হঠাৎই পা পিছলে পড়ে যেতে নিলো আহি।’

অন্যদিকে তাঁর থেকে অল্প কিছুটা দুরত্ব নিয়েই এগিয়ে আসছিল আদ্রিয়ান হঠাৎই আহিকে পড়ে যেতে দেখে চটজলদি ধরলো সে আহিকে। আর সেই মুহূর্তেই বাড়ির ভিতর ঢুকলো শুভ আর রিনি। বাড়ির ভিতর ঢুকতে না ঢুকতেই এমন এক রোমান্টিক সিন দেখবে না তাঁরা ভাবতেই পারে নি। আর আদ্রিয়ান আহি তারাও ভাবেনি এইসময়ই শুভ আর রিনি এসে পড়বে এখানে, চারজনই প্রায় অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়ে রইলো এঁকে অপরের দিকে….
!
!
!
!
!
#চলবে…..

#বাবুইপাখির_অনুভূতি🕊️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🕊️
— পর্বঃ৪৭
_________________

চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে আহি, আদ্রিয়ান শুভ আর রিনির মুখের দিকে। হঠাৎই তাদের হুস আসতেই এঁকে অপরকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো দুজন। তারপর কিছুটা অপ্রস্তুত কন্ঠ নিয়ে বললো আদ্রিয়ান,

‘ তোরা চলে এসেছিস?’

‘ হুম ভাইয়া কিন্তু ভিতরে ঢুকতে না ঢুকতেই যে এমন সিনেমাটিক ঘটনা দেখবো এটা তো ভাবি নি আমরা।’

শুভর কথা শুনে আদ্রিয়ান ওদের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,

‘ আরে তোরা যা ভাবছিস তেমন কিছুই নয় ও পড়ে যেতে নিয়েছিল আমি জাস্ট হেল্প করেছি এই আর কি?’

‘ হুম বুঝতে পারছি ভাইয়া (রিনি)

‘ আরে সত্যি বলছি।’

‘ তা আমি কখন বললাম আপনি মিথ্যে বলছেন ভাইয়া।’

বলেই হাসতে হাসতে এগিয়ে গেল রিনি আহির কাছে। আর আদ্রিয়ান কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো শুভকে,

‘ তোরা বিশ্বাস করছিস না কেন?’

আদ্রিয়ানের অবস্থা বুঝতে পেরে শুভ আদ্রিয়ানের কাঁধে হাত দিয়ে বললো,

‘ আমরা বিশ্বাস করেছি ভাইয়া এখন তুমি বলো আমার জিনিসপত্রগুলো গাড়িতে আছে কোথায় এনে রাখবো?’

‘ উপরে রাখ আমার রুমে পাশেই আর একটা রুম আছে তুই ওখানেই থাকবি।’

‘ ঠিক আছে ভাইয়া।’

বলেই উপরে যেতে নেয় শুভ। শুভকে যেতে দেখে বলে উঠল আহি,

‘ এখন ওসব রাখো আগে খাবে এসো,আমি নিজ হাতে রান্না করেছি।’

আহির কথা শুনে রিনি অবাক হয়ে বললো,

‘ তুই নিজ হাতে রান্না করেছিস?’

‘ হুম। খাবি চল?’

বলেই রিনিকে নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো আহি ডাইনিং টেবিলের কাছে কিছুদূর এগিয়েই বলে উঠল সে আদ্রিয়ানকে,

‘ আপনিও আসুন আপনার জন্যই তো রান্না করা আর শুভ ভাইয়া তুমিও আসো সবাই মিলে একসাথে লাঞ্চ করবো।’

আহির কথা শুনে শুভ প্রচন্ড খুশি হয়ে বললো,

‘ আমায় পাঁচ মিনিট সময় দেও আমি এক্ষুনি হাত মুখ ধুয়ে আসছি?’

‘ ঠিক আছে ভাইয়া তাড়াতাড়ি এসো।'(আহি)

উওরে শুভও বেশি দেরি না করে চটজলদি চলে যায় সে উপরে।’

___

ডাইনিং টেবিলের সামনে বসে আছে আদ্রিয়ান আর রিনি। আর ওদের খাবার সার্ভ করে দিচ্ছে আহি। এরই মধ্যে সেখানে উপস্থিত হলো শুভ, গিয়ে বসলো সে আদ্রিয়ানের পাশ দিয়ে। শুভ বসতেই আহি চলে যায় শুভর কাছে তাঁকে খাবার বেড়ে দিতে লাগলো সে। অন্যদিকে রিনি শুধু তাকিয়ে আছে আহির মুখের দিকে, তাঁর যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না আহি এত কিছু রান্না করেছে আদ্রিয়ানের জন্য। মনে মনে ভীষণ খুশিও হয়েছে রিনি যেন নতুন ভালো কিছু হওয়ার আভাস পেয়েছে সে। হঠাৎই রিনির মাথায় একটা চাটি মেরে বললো আহি,

‘ তোর আবার কি হলো মিটমিটিয়ে হাসছিস কেন?’

‘ না তেমন কিছু নয়।’

‘ হুম বুঝতে পারছি সদ্য সদ্য প্রেমে পড়লে যা হয় আর কি।’

‘ মোটেও তেমন কিছু নয়।’

‘ হুম বুঝি বুঝি এহন কি আর খাই সুজি, তাই একটু হলেও আমরাও বুঝি।’

‘ কচু বুঝোস তুই।’

আহি আর রিনি কান্ড দেখে হেঁসে ফেললো আদ্রিয়ান আর শুভ। হঠাৎ আদ্রিয়ানও বলে উঠল আহিকে,

‘ তুমিও খেতে বসো আহি?’

‘ হুম বসছি, আগে বলুন খাবার কেমন হয়েছে?’

আহির কথা শুনে শুভ বলে উঠল,

‘ খুব সুন্দর।’

সাথে সাথে খুশি হয়ে গেল আহি। তারপর সেও খুশি মনে বসে পড়লো চেয়ারে। যাক এতক্ষণ কষ্ট করাটা বৃথা যায় নি তাঁর। তারপর চারজনই হাসি ঠাট্টার মধ্যে দিয়ে কাটিয়ে দিলো দুপুরটা। আজকের দুপুরটা সত্যি খুব স্পেশাল আদ্রিয়ান আর শুভর কাছে। কারন বহুবছর পরই তাঁরা এইভাবে একসাথে ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছে। সত্যি আজকের সময়টা যেন খুবই সুন্দর।’

অবশেষে দুপুর পেরিয়ে কখন যে বিকেল হয়ে গেল বুঝতেই পারে নি কেউ।’ বিকেলের কার্নিশ বেয়ে মৃদু বাতাস বইছে চারপাশে, সোনালি রোদ্দুরেরাও পাড়ি জমিয়েছে দূরে। এসবের মাঝেই নিচের রুমে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে আহি আর রিনি। কারন এখন তাঁরা দুজনই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। সোফায় চুপচাপ বসে আছে আদ্রিয়ান, আহি চলে যাবে বিষয়টাতে তার ভিষনই খারাপ লাগছে সে চাই না আহি এক্ষুনি চলে যাক। কিন্তু কি করার ছোট্ট দীর্ঘ শ্বাস ফেললো সে। আহি শুভর সাথে কিছুক্ষন কথা বলে এগিয়ে আসলো আদ্রিয়ানের কাছে। তারপর বললো,

‘ আমি চলে যাচ্ছি ভালো থাকবেন, শুনুন বাহিরের খাবার খুব বেশি খাবেন না। আর হ্যাঁ আমি মাঝে মধ্যে ফোন করবো নিশ্চয়ই৷ এছাড়া কোনো অসুবিধা হলে নিশ্চয়ই বলবেন আমায়।’

উওরে আদ্রিয়ানও মুচকি হেঁসে বললো,

‘ হুম আর থ্যাংক ইউ আহি।’

‘ থ্যাংক ইউর কোনো প্রয়োজন নেই যা হয়েছে তাঁর জন্য আমি দায়ী ছিলাম এর জন্য আই এক্সট্রিমলি সরি।’

‘ সরির কোনো প্রয়োজন নেই আহি, ভালো থেকো।’

‘ আপনিও ভালো থাকবেন। আর আপনার যদি সময় হয় বলবেন আমায় মা বলেছিল আপনায় বাড়ি নিয়ে যেতে।’

‘ আমার হয়তো সময় হবে না বলো তোমার মাকে।’

‘ ঠিক আছে।’

এরই মধ্যে রিনি এসে বললো আহিকে,

‘ এখন তাহলে যাওয়া যাক আহি?’

‘ হুম চল,

বলেই আর একবার আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো সে,

‘ চলে যাচ্ছি আবারো বলছি ভালো থাকবেন, আর সময় হলে বলবেন প্লিজ।’

‘ ঠিক আছে আহি।’

উওরে আহি আর কিছু বলে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। ওদের পিছন পিছন শুভও গিয়েছিল যাই নি শুধু আদ্রিয়ান।’

_____

রাত_১০টা,

নিজের রুমে বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে আহি। কারন সে ঘুমাতে পারছে না,চোখ বন্ধ করলেই শুধু আদ্রিয়ানের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোর কথা বার বার চোখের সামনে ভেসে আসছে তাঁর। চরম প্রকার বিরক্ত নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো আহি। সে উড়ে বসতেই নিচে থাকা তাঁর খরগোশ ছানাটাও লাফ মেরে উঠলো খাটে। আহি খরগোশ ছানাকে কোলে নিয়ে বলতে শুধু করলো,

‘ তুই ও ঘুমাস নি আমার মতো, আজ ঘুম কিছুতেই আসছে না বুঝলি বার বার আদ্রিয়ানের কথা মনে পড়ছে, জানিস উনি না রাতে আমায় জড়িয়ে না ধরে ঘুমালে ঘুমাতেই পারতো না। কি জানি আজ রাতে আমায় ছাড়া ঘুমাতে পারবে কিনা।’

বলেই বিছানা ছেড়ে নেমে খরগোশ ছানাকে বিছানা উপর রেখেই এগিয়ে গেল সে বেলকনির দিকে। আকাশের দিকে তাকাতেই সূর্যের আলোতে উজ্জ্বল হওয়া চাঁদ মামার ফেসটা দেখলো আহি। ছোট দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো সে,

‘ আই মিস ইউ আদ্রিয়ান, আচ্ছা আপনি কি আমায় মিস করছেন না?’ আপনি তো আমায় ভালোবাসেন নাকি তাহলে মিস তো করা উচিত তাই না। আচ্ছা আমি আপনায় নিয়ে ভাবছি কেন বলুন তো?’

বলেই বেলকনির দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে রইলো আহি। ভালো লাগে না তাঁর কিন্তু আহি বুঝতে পারছে না তাঁর ভালো কেন লাগছে না। ছোট্ট দীর্ঘ শ্বাস ফেললো সে, হয়তো কিছুদিনের একসাথে থাকায় মায়া পড়ে গেছে তাঁর আদ্রিয়ানের ওপর। কিছুদিন পর হয়তো এমনি এমনি ঠিক হয়ে যাবে সব।’

অন্যদিকে,

নিজের রুমের থাইগ্রাসের পাশ দিয়ে চুপচাপ চেয়ারে বসে আছে আদ্রিয়ান। আর তাঁর বিছানার একপাশ দিয়ে বেঘোরে ঘুমিয়ে আছে শুভ। অনেকক্ষণ আগেই সে এসেছে আদ্রিয়ানের রুমে ঘুমাতে। আদ্রিয়ানও বারন করে নি। মনটা ভালো নেই আদ্রিয়ানের, সাথে চোখে ঘুমও নেই তার আদ্রিয়ান এটাও জানে না আধও আজ রাতে ঘুম আসবে কি না তাঁর?’ এই একসপ্তাহ যেন আদ্রিয়ানের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর রাত ছিল কারন এই এক সপ্তাহ সে নিশ্চিতে ঘুমাতে পেরেছিল। আদ্রিয়ান জানে না তাঁর আর আহির ভবিষ্যত কেমন হবে যেখানে আহি তাকে রিজেক্ট করে দিয়েছে। আচ্ছা তাঁর কি উচিত আর একবার আহির কাছে তার ভালোবাসার দাবি নিয়ে যাওয়া। এমনও তো হতে পারে এবার আর আহি তাঁকে রিজেক্ট করবে না। এই রকম নানা কিছু ভাবতে লাগলো আদ্রিয়ান। রাতের জোৎসা ভরা আলোতে শীতল মেশানো বাতাস বইছে বাহিরে, বাতাসে আদ্রিয়ানের সামনে থাকা সাদা পর্দাটাও দুলছে খুব। চাঁদ মামাটাও জ্বল জ্বল করছে বাহিরে। আকাশে তেমন তাঁরা নেই আজ হাতে গুনে চার পাঁচ হবে হয়তো। চারপাশ পুরোই নিঝুম।’

আর প্রকৃতির এই নির্জন মায়ার ভিড়েই দুটি মানুষ আজ নির্ঘুম কাটাবে হয়তো সারারাত। কারন দুজনই যে তাদের নিজেদের স্মৃতি স্মরণ করতে ব্যস্ত।’

____

পরেরদিন খুব সকালে কথা মতো ট্রেনে করে বেরিয়ে পড়লো আহি আর রিনি অথৈদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।’

আর বলতে না বলতে কয়েক ঘন্টা পরই তাঁরা পৌঁছে গেল অথৈদের বাড়ির সামনে।’

বাড়ির কলিং বেল বাজতেই অথৈ এসে দরজা খুলে দিলো সামনেই রিনি আর আহিকে দেখে চরম প্রকার অবাক হয়ে বললো সে,

‘ তোরা?’
!
!
!
!
!
#চলবে…..

#বাবুইপাখির_অনুভূতি🕊️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🕊️
— পর্বঃ৪৮
_________________

কিছুটা বিষন্নমাখা মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে অথৈ, রিনি আর আহির মুখের দিকে। সে কল্পনাও করতে পারে নি এই মুহূর্তে রিনি আর আহিকে দেখবে। অথৈ এতটাই বিষন্ন যে, সে যে আহিদের বাড়ির ভিতরে ঢুকতে বলবে সেটাই যেন মাথা দিয়ে বেরিয়ে গেছে তাঁর। অথৈকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে উঠল আহি,

‘ এভাবে তাকিয়ে থাকবি নাকি আমাদের ভিতরেও যেতে বলবি?’

আহির কথা শুনতেই হুস আসলো অথৈর কিছুটা হতভম্ব হয়ে বললো সে,

‘ দেখছো আমি ভুলেই গেছিলাম তাড়াতাড়ি আয় ভিতরে আসলে তোদের যে আমি এই মুহূর্তে দেখবো এটাই ভাবি নি তাই একটু শকটে আছি।’

এমন সময় অথৈর পিছনে দাঁড়িয়ে থেকে বলে উঠল ওর মা,

‘ কি হলো অথৈ তুই এখনো ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন কে এসেছে বাহিরে?’

অথৈ তাঁর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ আমার ভার্সিটির এক বন্ধু আর রিনি এসেছে মা।’

সাথে সাথে অথৈর মা এগিয়ে গেল সামনে। রিনি আর আহি অথৈর মাকে দেখে খুশি মনে বলে উঠল,

‘ আসসালামু আলাইকুম আন্টি, কেমন আছেন?’

‘ ওলাইকুম আসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো তোমরা?’

‘ জ্বী ভালো।’

‘ তোমরা বাহিরে দাঁড়িয়ে আছো কেন ভিতরে আসো?’

‘ দেখো না আন্টি অথৈ আমাদের দেখে এতটাই চমকে গেছে যে আমাদের ভিতরে নিয়ে যাবে এটাই বলতে ভুলে গেছে।’ (রিনি)

রিনির কথা শুনে রিনির মা বলে উঠল,

‘ ও তো ওমনই তোমরা আসো?’

বলেই রিনি আর আহিকে ভিতরে নিয়ে গেল অথৈর মা। আর অথৈ সেও আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ওদের পিছুপিছু।’

_____

দোতলার রুমে জানালার পাশ দিয়ে খাটের ওপর বসে আছে আহি আর রিনি। আর ওদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে অথৈ। কিছুক্ষন আগেই অথৈর মায়ের দেওয়া হাল্কা পাতলা নাস্তা সেরে অথৈর রুমে এসে বসলো তাঁরা। অথৈ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে উঠল,

‘ তারপর বল,তোরা এখানে কেন এসেছিস?’

অথৈর কথা শুনে আহি সোজাসাপ্টা বলে উঠল,

‘ তোকে নিতে এসেছি।’

‘তোকে নিতে এসেছি’ কথাটা শুনতেই যেন নীরবের ফেসটা ভেসে আসলো অথৈর সামনে। চিনচিনে ব্যাথা শুরু হয়ে গেল বুকে। যেটা রোজই হয় তাঁর। অথৈ মুখটা ঘুরিয়ে বলে উঠল,

‘ কিন্তু আমি তো যাবো না আহি।’

অথৈর কথা শুনে আহি বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো তারপর অথৈর দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর কাঁধে হাত দিয়ে বললো,

‘ কেন যাবি না তুই? আমার হয়তো আরো আগেই আসা উচিত ছিল কিন্তু সময় করে উঠতে পারি নি।
দেখ যা হয়েছিল সেদিন তাতে তোর কোনো দোষ ছিল না। তাহলে শুধু শুধু আমার জন্য নিজের ক্যারিয়ার কেন নষ্ট করবি তুই? আর তাঁর থেকেও বড় কথা তুই চলে আসলেই কি নীরব ভাইয়া আমায় ভালোবাসতে শুরু করবে নাকি?’

আহির কথার উওরে কি বলবে অথৈ জানে না। অথৈকে চুপ থাকতে দেখে আবারো বললো আহি,

‘ প্লিজ চল আমাদের সাথে।’

আহি কথা শুনে আহির দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো অথৈ,

‘ বিষয়টা তেমন নয় আহি?’

‘ ওতোশতো জানি না আমি সামনে এক্সাম তোকে আমার খুব প্রয়োজন। কিছু পারি না তুই না গেলে আমায় পড়াবে কে? তোকে ছাড়া ভালো লাগে না চল না ফিরে।’

‘ কিন্তু আহি?’

এবার রিনিও এগিয়ে গেল অথৈর দিকে তারপর বললো,

‘ কোনো কিন্তু নেই অথৈ, আমরা যখন এসেছি তখন তোকে নিয়েই যাবো বুঝতে পেরেছিস।’

‘ তোরা বুঝতে পারছিস না।’

‘ কি বুঝতে পারছি না আমরা?’ (আহি)

এখন অথৈই কি বলবে বুঝতে পারছে না। এমন সময় অথৈর ডাক পড়লো নিচে, অথৈ ‘আমি একটু আসছি’ বলে চলে যায় নিচে। আর আহি রিনি দুজনেই কিছুটা হতাশ হয়ে তাকিয়ে রয় অথৈর যাওয়ার পানে।’

রিনি নিশ্চুপেই গিয়ে বসে বিছানায়, আর আহি হতাশ হয়ে বসে সামনে থাকা টেবিলের পাশের চেয়ারটায়। হঠাৎই অথৈর ফোনটা বেজে উঠল উপরে শুভর নাম দেখে মুচকি হেঁসে বললো সে,

‘ তুই দু’মিনিট বস আমি এক্ষুনি আসছি।’

‘ কি শুভ ফোন করেছে বুঝি?’

উওরে মুচকি হাসলো রিনি। আর রিনির হাসি দেখেই আহি তাঁর প্রশ্নের উওর পেয়ে গেছে। আহি নিজেও হেঁসে বললো,

‘ যা তাড়াতাড়ি আসিস।’

‘ হুম।’

বলেই ফোনটা তুলে ‘হ্যালো’ বলে বেরিয়ে যায় রিনি রুমে থেকে। আর আহি নিশ্চুপে বসে রয় চেয়ারে। সময়টা তখন প্রায় দুপুর বারোটার কাছাকাছি বেজে গেছে। দুপুরের কড়া রোদ্দুর এসে পড়ছে অথৈর রুমে যেটা সরাসরি আহির দিকে বিদ্যমান বর্তমানে। রুমে রোদ আসায় আহি হাত দিয়ে জানালার পাশে থাকা একদিকের জানালাটা একটু ঠেলে দিলো। এরই মধ্যে হঠাৎই এক ধমকা হাওয়া এসে অথৈর টেবিলে থাকা সেই লাল ডাইরিটার কিছু পৃষ্ঠা উল্টে দিতে লাগলো। আহির চোখটা যায় সেদিকেই আহি আনমনেই ডাইরিটা হাতে নিলো কারন কিছু পেইন্টিং জাতীয় জিনিসের দিকে চোখ আঁটকে যায় তাঁর।’

শুরুতেই আহির যে ছবিটার দিকে চোখ যায় সেটা হলো একটা চশমা পড়া ছেলে সাইকেল চড়ে এদিকেই আসছে। এঁকে এঁকে ডাইরির প্রতিটা পৃষ্ঠা উল্টে দেখতে লাগলো আহি। ডাইরির প্রতিটা ভাঁজে ভাঁজে লেখা ছিল অথৈর ছোট বেলার ভালোবাসার মানুষের অনুভূতির কথা। কি করে একটা মেয়ে একটা মানুষকে না দেখেই এতটা ভালোবাসতে পারে সেটা হয়তো এই ডাইরিটা না পেলে জানতেই পারতো না আহি। অবশেষে আহির চোখ গেল এই ডাইরির লেখা শেষ পৃষ্ঠার কাছে, শেষের দু’পৃষ্ঠা পড়ে আহির চোখ যেন ভেসে আসছিল। কারন সেখানে লেখা ছিল,

জীবনটা যেন আজ দোটানার মুখে পড়ে গেছে। একদিকে প্রান প্রিয় বন্ধু আর আরেকদিকে ছোট বেলার ভালোবাসা। আমি কখনো কল্পনাও করিনি যাকে আমি না দেখেই সেই ছোট বেলা থেকে ভালোবাসতাম সেই মানুষটাই নীরব হবে। আমার ভালোবাসাগুলো হয়তো ভালোবাসা হয়েই থেকে যাবে। কারন আমি কখনোই আমার ভালোবাসা প্রকাশ করে আমার প্রান প্রিয় বন্ধুকে ঠকাতে পারবো না। এই রকম হাজারো বাক্য লেখাছিল সেই ডাইরিতে, শেষে অথৈর চোখের পানির ছাপটাও দেখতে পেলো আহি। আহি বুঝতে পেরেছে অথৈ লেখাগুলো যখন লিখেছিল তখন কাঁদছিল। আহি পুরো লেখাটা পড়ে ডাইরিটা বন্ধ করে রেখে দেয় টেবিলের এক কোনে। সে ভাবতেই পারে নি তাঁর জন্য দুজন ভালোবাসার মানুষ শুধু শুধু কষ্ট পেল। সবার ভালোবাসাই যে সবসময় অসম্পূর্ণ থাকবে এমনটা তো নয়। যেখানে অথৈ নীরব এঁকে অপরকে খুব ভালোবাসে। আহি তাঁর চোখ মুছে ফেললো চটজলদি। আর ভাবলো তাঁর এখন অনেক কাজ যেগুলো খুব দ্রুত সম্ভব শেষ করতে হবে।’

_____

অফিসের চার দেয়ালের মাঝে বসে আছে আদ্রিয়ান। দৃষ্টি তাঁর সামনে থাকা ল্যাপটপের দিকে। আদ্রিয়ান আজ থেকে আবারো ব্যস্ত হয়ে পড়বে তাঁর নিজের জীবনের অতীতে চলাকালীন সময়ের দিকে। যেটা কিছুদিনের জন্য স্থগিত ছিল। আজ আদ্রিয়ানের মনটা খুবই খারাপ, আদ্রিয়ান বুঝতে পেরেছে ভালোবাসা জিনিসটা মানুষের জন্য সত্যি খুব বাজে একটা জিনিস। ভালোবাসা জিনিসটা তখনই খুব খারাপ যখন ভালোবাসার মানুষটা আপনাকে রিজেক্ট করে দিবে বা আপনি কাউকে ভালোবাসবেন কিন্তু অপর প্রান্তের মানুষটি আপনায় মেনে নিবে না।’

আদ্রিয়ান যখন কাউকে ভালোবাসতো না তখনই ভালো ছিল। এক অন্যরকম এটিটিউড ছিল, অন্যরকম চিন্তা ধারা ছিল। কিন্তু এখন আহিকে নিয়ে ভাবা ছাড়া আর কোনো কিছুই ভালো লাগে না আদ্রিয়ানের। কিন্তু সে তো আর আহিকে নিজ ইচ্ছে ভালোবাসতে চায় নি। পরিস্থিতি তাঁকে আহিকে ভালোবাসতে বাধ্য করেছে। হুট করে কাছে আসা, হুট করে অনুভূতিতে জড়ানো, হুট করে জড়িয়ে ধরা, ছোট বেলার স্মৃতি জাগ্রত হওয়া, না চাইতেও একসাথে সময় কাটানো, হুটহাট মুখোমুখি হওয়া এগুলোর একটাও কি আদ্রিয়ান নিজ ইচ্ছে করেছে নাকি। তাহলে, যদি ভালোবাসার পূর্ণতা নাই হওয়ার ছিল তাহলে এগুলো কেন হলো না হলেই তো হতো। ভালোবাসার ওপর বড্ড অভিমান হচ্ছে আদ্রিয়ানের। যে অভিমান তাঁকে ভিতর থেকে ধীরে ধীরে ভেঙে দিচ্ছে।’

এমন সময় ওর রুমে ঢুকলো নিলয়। আদ্রিয়ানের দিকে এগিয়ে এসে বললো সে,

‘ আদ্রিয়ান আমাদের বিদেশি ক্লাইন্ট ভিডিও কনফারেন্স মিটিং এর জন্য অপেক্ষা করছে সব তৈরি এখন শুধু তুই গেলেই হয়।’

নিলয়ের কথা শুনে আদ্রিয়ানও বেশি না ভেবে বলে উঠল,

‘ ঠিক আছে তুই যা আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।’

‘ ওঁকে তাড়াতাড়ি আসিস।’

‘ হুম।’

উওরে নিলয় আর কিছু না বলে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। নিলয় যেতেই নিজের মাথা থেকে কিছুক্ষনের জন্য আহিকে দূরে রেখে সামনের ল্যাপটপটা বন্ধ করে বেরিয়ে যায় আদ্রিয়ান মিটিং রুমের উদ্দেশ্যে।’

____

‘দুপুর ৩ঃ৩০টা’

অথৈদের বাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে রিনি আর আহি। অপেক্ষা করছে তাঁরা অথৈর জন্য। অবশেষে অনেক জোরাজোরি করে অথৈকে ঢাকা বেক করাসে সক্ষম হয়েছে আহি আর রিনি। অথৈ শুরুতে রাজি না হলেও শেষে দুই বান্ধবীর জোরাজোরিতে তাঁকে হার মানতেই হলো। অথৈ জানে না সামনে তাঁর জন্য কি অপেক্ষা করছে তবে অথৈ এতটুকু ভেবে নিয়েছে নীরবের থেকে দুরত্ব বজায় রাখতে হবে। যতই নীরব আহিকে ভালোবাসুক বা না বাসুক। কারন একটাই আহিকে সে কিছুতেই ঠকাতে পারবে না। অন্যদিকে রিনি অথৈর কাছে অনেক আগেই সরি বলেছে। অথৈও তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে অনেক আগেই। কারন রিনি জায়গায় যদি অথৈ থাকতো তাহলে সেইম রিয়েকশন সেও করতো। আর সবশেষে আহি, আহির মাথায় এই মুহূর্তে কি চলছে সেটা একমাত্র সেই জানে। এঁকেক ভাবনায় মগ্ন এঁকেকজন।’

অতঃপর অথৈদের বাড়িকে গুড বাই টাটা জানিয়ে তিন বান্ধবী গাড়ি করে চললো একসাথে ঢাকার উদ্দেশ্যে। যেখানে কিছু পূর্ণতা আর অপূর্ণতার গল্প লুকিয়ে আছে।’

.
.

রাত তখন আটটা বেজে বারো মিনিট। নীরব চুপচাপ তাঁর পড়ার টেবিলে মুখ মাঝে মুখ লুকিয়ে বসে ছিল। যদিও বইটা জাস্ট সো অফ, সে তো বর্তমানল অথৈর চিন্তায় মগ্ন। এই যুগে নীরব অথৈকে ভুলতে পারবে কি না এটা সন্দেহ আছে নীরবের। এমন সময় নীরবের ভাবনার মাঝে তাঁর দরজায় নক করলো আহি বললো সে,

‘ আসবো ভাইয়া?’

হুট করেই আহির কন্ঠ কানে আসতেই কিছুটা চমকে উঠলো নীরব। আজ অনেকদিন পর যেন নীরব আহির ভয়েস শুনতে পেল। কিছুটা অবাক হয়েই তাকালো সে সামনে সত্যি সত্যি আহিকে এমন সময় নিজের রুমের দরজার সামনে দেখে বেশ খানিকটা বিস্ময় নিয়েই বললো নীরব,

‘ হুম আয় কিন্তু এই সময় তুই আমার রুমে?’

নীরবের কথা শুনে আহি বেশি কিছু না ভেবেই গিয়ে বসলো নীরবের সোজাসুজি থাকা চেয়ারে তারপর বললো,

‘ তোমার সাথে কিছু কথা ছিল ভাইয়া?’

আহির কথা শুনে বিষন্নমাখা মুখ নিয়েই বললো নীরব,

‘ এখন।’
!
!
!
!
!
#চলবে…..