#বাসন্তীগন্ধা
|২৪|
লাবিবা ওয়াহিদ
“কবুল” শব্দটি কোনোরকম আওড়ে মূর্তির মতো বসে রইলো মেহের। মাথায় রোকসানার বিয়ের সেই পুরানো দোপাট্টা। এখন ঘড়ির কাটা সকাল সাতটার ঘরে। বাড়ির বেশিরভাগ মানুষ ঘুমে বিভোর। এমতাবস্থায় মেহের এবং সারিমের বিয়ে হলো। ইতিহাসে এই বিয়ের কাহিনী থাকা উচিত। কেউ বিয়ে করে মাঝরাতে আবার কেউ বিয়ে করে ভোর সাতটায়। অদ্ভুত হলেও সত্য, মেহের এখন সারিমের বিবাহিতা স্ত্রী। এই ভোরেই তাদের বিয়ে হয়েছে। জোরপূর্বক। জোর করেছে স্বয়ং আইঁয়ুব সাহেব। যা এতদিন রোকসানা নিজে চেয়েছিলেন। মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে তার। এজন্যই বলে গুরুজনকে মান্য করতে হয়। কেন যে এতদিন নাটক করলো কে জানে? ভাগ্যের লিখন কী কেউ বদলাতে পারে?
সারিম হতভম্ভ হয়ে বসে আছে। নেশা ভাব তখনই কেটে গেছে যখন বাবার মুখে শুনেছিলো
“এখন এই মুহূর্তে-ই সারিম এবং মেহেরের বিয়ে হবে।”
সারিম বুঝলো না, ব্যাপারটা আসলে কী? হুট করে তার বাবা এরকম একটা সিদ্ধান্ত কেন নিলো? নেশার ঘোরে কী এখনোও আছে? না থাকলে এই বিষয়গুলো মাথায় নাড়া দিচ্ছে না কেন? অদ্ভুত তো!
মেহের এবং সারিমকে একই ঘরে দেখার পরপর আইঁয়ুব সাহেব একপ্রকার ধরে-বেঁধে মেহেরের বাবাকে বললো কাজি ডাকতে। এখন মানে এখনই। মেহেরের বাবা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলো কিন্তু সেরকম কোনো কাজ হয়নি। উলটো ধমক খেতে হয়েছে। পরে আর কী, গেলো কাজিকে ডাকতে। ছেলে-মেয়ের সিদ্ধান্ত জানারও চেষ্টা করেনি। জানতে চাইবে কেন? যা চোখে দেখেছে তাই-ই তো যথেষ্ট। এখন সম্মান বাঁচাতে এই পথ-ই অবলম্বন করতে হবে। ছোটো ছেলে তো আর মুখ-ই রাখলো না।
মেহের অসহায় নজরে তার মায়ের দিকে তাকালো। জ্যুতি ফোলা চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেহেরের বাবা একপ্রকার জোর করে তাকে ঘুম থেকে তুলেছে। মেয়ের বিয়ে শুনে জ্যুতিও কিছুটা অপ্রস্তুত।
রোকসানা বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে মেহেরের পাশে গিয়ে বসলো। খুব সুন্দর কারুকাজ করা এক জোড়া বালা মেহেরের হাতে পরিয়ে দিয়ে বললো,
–“এগুলো সারিমের মায়ের। আজ তোর হাতে পরিয়ে দিয়ে সারিমের মায়ের দায়িত্ব পালন করলাম পাখি। সদা ভালো থাক, এই দোয়াই করছি!”
মেহের ছলছল নয়নে রোকসানার দিকে তাকালো। কম্পিত গলায় বললো,
–“এসব কেন হলো দাদী?”
রোকসানা হেসে বললো,
–“সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকাতে হয় রে বোকা। এখন একটু হাস তো দেখি। আজ মোটেও কাঁদবি না।”
বিয়ে হতেই সকল ছেলেরা হনহনিয়ে বেরিয়ে যায়। সারিম কিছুক্ষণ বসে থেকে সেও বেরিয়ে যায়। অদ্ভুত লাগছে সব। বড়োই অদ্ভুত। সারিম চলে যাওয়ার পরপরই মেহেরের পাশে এসে বসেছে রোকসানা। মেহের বললো,
–“তাও দাদী, এভাবে…”
–“চুপ কর। সবটা আমি বুঝে নিবো। তুই শুধু আমার নাতীকে আগলে রাখিস। যদিও পুচকে হয়ে বুড়োটাকে সামলাতে একটু কষ্ট হবে। তবে দেখবি, ভালোবাসা থাকলে হঠাৎ-ই কেমন বড়ো হয়ে যাবি। সব দায়িত্ব নিজে বুঝে ফেলবি। বিয়ের পবিত্র বন্ধন তো এরকমই। অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলে।”
–“সারিম ভাইয়া যদি আমাকে খারাপ ভাবে?”
–“দিবো এক চড়! ভাই কিসের? থাপড়ে গাল লাল করে দিবো। এখন সারিম তোর বর। শরীয়ত মোতাবেক স্বামীকে “ভাইয়া” বলা কী-রকম গুনাহের কাজ জানিস?”
রোকসানার কথা শুনে মেহের নিজেকে সামলে নিলো। অতঃপর শুকনো ঢোঁক গিলে বললো,
–“ঠিকাছে বলবো না।”
–“লক্ষী মেয়ে। এখন যা দেখি, হাত-মুখ ধুঁয়ে নে। আমি বেদ্দপ গুলাকে উঠাই। বাড়ীতে কত বড়ো ঝড় গেলো অথচ এগুলার একটারও কোনো খবর নাই!”
মেহেরের হাসি পেলেও হাসলো না। এখনো গভীর শকে আছে কী না। সে আলতো করে হাতের বালা গুলো খুলে রোকসানার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
–“এগুলা বড়ো মার হয়ে থাকুক দাদী। নিজের কাছে রাখতে চাই না। যদি হারিয়ে যায়?”
রোকসানা বুঝলো মেহেরের অবস্থা। তাই হাতে নিয়ে বললো,
–“আচ্ছা, ঠিকাছে। যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন আমার কাছেই আমানত হিসেবে থাকুক। বড়ো বউয়ের টা বড়ো বউকে বুঝিয়ে দিয়েছি।”
মেহের হঠাৎ রোকসানাকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী স্বরে বললো,
–“খুব ভালোবাসি তোমাকে দাদী। তুমি ছাড়া আমায় কেউ বুঝে না। তুমি আমার সাহস জুগাও এবং ভীতি দূর করে দাও। তুমি আমার খুব খুব প্রিয়।”
রোকসানা হাসলো। মেহেরের মাথায় সুন্দর করে হাত বুলিয়ে বললো,
–“আমার এই বিয়ের দোপাট্টা দ্বিতীয়বার স্বার্থক হলো রে মেরু।”
—————–
রোকসানা আড়ালে ডাকলো সেই তিন আত্নীয়কে। যারা বিয়ের সাক্ষী হিসেবে ছিলো এবং সারিম মেহেরকে যারা একসাথে একরুমে দেখেছে। রোকসানা ছেলে সম আত্নীয়দের দিকে কোণা চোখে তাকিয়ে এক গাল হাসলো। সেই চাচা তিনজনও হাসলো। হেসে একজন বললো,
–“অবশেষে আপনার মনের আশা পূরণ হলো জেঠী।”
–“সে আর বলতে? ভাগ্যিস ফজরের পরপর তসবিহ পাঠ করতে করতে ওদের ঘরের সামনে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি সারিম বিছানায় ঘুমোচ্ছে আর মেহের চেয়ারে বসে ঘুমোচ্ছে। তখনই বুদ্ধি আঁটলো মাথায়। তারপর তোমাদের তিন জনকে নিয়ে এসে দেখালাম। নয়তো তোমরা আমার নাতী-নাতনিকে বাজে ভাবতে পারো!”
দ্বিতীয় জন হেসে বললো,
–“আরে নাহ জেঠী। বাজে কেন ভাবতে যাবো? তবে আপনার বুদ্ধি চমৎকার ছিলো। কিন্তু কথা হচ্ছে আপনি ওদের দরজা লক কী করে করলেন?”
রোকসানা আড়াল থেকে একটা চাবি বের করলো। এই চাবিটা ডুপ্লিকেট। প্রায় সব ঘরের চাবি-ই রোকসানার কাছে ডুপ্লিকেট আছে। সেটা দেখে তিন ভাই-ই হেসে দিলো।
বাড়িতে পীনপতন নীরবতা পালন হচ্ছে। প্রগাঢ় নীরবতা। সবাই নীরবে নাস্তা করতে ব্যস্ত। বাড়িতে এতগুলা মানুষ। সবাই হঠাৎ বিয়ের কারণে স্তব্ধ, বিমূঢ়। কেউ যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। তার চেয়েও বড়ো সমস্যা হলো, একটা বিয়ে হলো, আর সবাই কী না ঘুমিয়ে ছিলো? কেউ টেরও পেলো না? এই ব্যাপারটা কারোই হজম হচ্ছে না।
বড়োরা খেয়ে উঠেছে আগেই। সকলেই জিজ্ঞেস করলো কী এমন জরুরি পরলো যে হুট করে বিয়েটা দিয়ে দিলো? বাড়িতে এতগুলা মানুষ থাকা সত্ত্বেও কেউ কেন খবর পেলো না? এত তাড়াহুড়োর কী ছিলো? রোকসানা তখন সবার উদ্দেশ্যে বলেছিলো,
–“আমার জেদে বিয়ে হয়েছে। তোমরা ঘুমে কাতর ছিলে। তোমরা ওঠোনি তাই তোমরা ব্যর্থ। বিয়ে দেখতে পারোনি!”
মাহিম বেচারার মুখটা দেখার মতো। সে অসহায় ভান ধরে বললো,
–“আমার থেকে দেড় মিনিটের ছোটো মেয়েটাও আমার আগে বিয়ে করে ফেললো। এখন আমার এই মুখ লুকাবো কই? মানুষ আমাকে বিয়ের দিক দিয়ে আর বড়োই ভাববে না!”
মাহিমের এরূপ কথায় সকলে হেসে দিলো। শুধু হাসি নেই সারিম এবং মেহেরের মুখে। দুর্ভাগ্যবশত মেহের মাহিমের মুখোমুখি বসেছে। মাহিম এ-কথা বলতেই সজোরে পায়ে লাথ খেলো। যার ফলে মাহিম চাপা আর্তনাদ করে উঠলো। “উ” করে উঠে সারিমের উদ্দেশ্যে বললো,
–“তোমার এই নয়া বউটারে সামলাও সারিম ভাইয়া। মেয়েটা এখনো শোধরায়নি, কত বড়ো বেয়াদব দেড় মিনিটের বড়ো ভাইকে লাথ দেয়। বিচার চাই সারিম ভাই!”
সারিম কড়া নজরে চাইলো মাহিমের দিকে। এই সময়ে এই ধরণের কথা-বার্তা কানে বিষের মতো লাগছে যেন। মেহেরেরও তাই অবস্থা। মাহিমের দিকে গরম চোখে চেয়ে মিনমিন করে বকতে লাগলো। আশিফের সাথের জন টিপ্পনী কেটে বললো,
–“মাহিম। বরের কাছে বিচার দিয়ে লাভ নেই। নিজের বিচার নিজে কর। নয়তো সবাই বলবে তোর মধ্যে সৎ সাহস নেই। এজন্য বিলাইয়ের মতো আরেকজনের কাছে গিয়ে মিউমিউ করছিস!”
এ-কথা শুনে মাহিমের নিজেকে বড্ড অসহায় অনুভব হলো। এটা কী ঠিক হলো?
মেহের করিডোর দিয়ে নিজের রুমে যাচ্ছিলো ওমনি পেছন থেকে সারিমের গলা শুনতে পেলো। সারিম মেহেরকে ডাকছে।
–“মেরু!”
পুরুষালি শীতল কন্ঠস্বর শুনে মেহেরের সর্বাঙ্গ শিথিল হয়ে গেলো। পা জোড়া না চাইতেও থেমে গেলো। মেহের পিছে ফেরারও সাহস পেলো না। সব কেমন যেন লাগছে। মিশ্র অনুভূতি। ভালো লাগা, লজ্জায় নিমজ্জিত হওয়া, কিছুটা জড়তা ইত্যাদি। ভয়টা তো আছেই। এখনো স্বপ্ন লাগছে যে সারিম মেহেরের বর!
সারিম এগিয়ে আসলো মেহেরের দিকে। সারিমের পায়ের শব্দ যত নিকটে পাচ্ছে তত মেহেরের বুকের ধুকপুকানি ক্রমশ বাড়ছে। মেহের হাত দুটো মুঠিবদ্ধ করে নিজেকে ধাতস্থ করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালালো।
সারিম মেহেরের সামনে দাঁড়িয়ে মেহেরের মুখশ্রীতে চোখ বুলালো। অতঃপর কপালে কয়েক ভাঁজ ফেলে খুবই নরম গলায় বললো,
–“গতকাল রাতে কী আমার দ্বারা কোনো ভুল হয়েছে মেরু?”
মেহের হতভম্ভ, বিমূঢ় সারিমের এরূপ কথা শুনে। কী বলছে সারিম? মেহের আমতা আমতা করে বললো,
–“মা..মানে?”
সারিম আগের মতোই অনুশোচনা নিয়ে কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
–“তোর রুমে এসে শুয়েছি। এরপর আর সেন্স ছিলো না। কী হয়েছে তাও মনে করতে পারছি না। এজন্য জিজ্ঞেস করছি, আমায় দ্বারা কোনো ভুল হয়েছিলো? না মানে, সকাল সকাল বিয়ে..!”
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
#বাসন্তীগন্ধা
|২৫|
লাবিবা ওয়াহিদ
মেহের হতভম্ভ সারিমের এই ধরণের কথা শুনে। উত্তরে সারিমকে কী বলবে তাও বোধগম্য হলো না। পিটপিট করে চেয়ে রইলো সারিমের দিকে। সারিমের কপালে তখনো চিন্তার ভাঁজ। মেহের আমতা আমতা করে বললো,
–“সেরকম কিছু না ভা..”
বলতে গিয়ে মেহের দমে গেলো। আবারও ভুল করতে বসেছিলো সে। নিজেকে একবার বকে আবারও বললো,
–“দাদী পরিকল্পনা করে বিয়ে দিয়েছে। আপনি তো বিছানাতে এমনিতেই ঘুমিয়ে ছিলেন। আর আমি.. চেয়ারে বসে!”
মেহেরের গলা নেমে এলো। সারিম অবাক হলো মেহেরের কথা শুনে। এর মানে সবকিছুর পেছনের রোকসানার হাত? কিন্তু কেন? রোকসানার এরকম পরিকল্পনা করার কারণ কী? মেহের সারিমকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিতেই সারিম মেহেরের হাত ধরে থামালো। এতে মেহেরের সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। হৃদপিন্ডের ধুকপুকানির শব্দ ক্রমশ বাড়ছে। সারিম খুব শীতল গলায় বললো,
–“এই বিয়েতে তুমি খুশি তো মেরু?”
“তুমি” সম্বোধন! এক জাদুর সম্বোধন লাগলো মেহেরের নিকট। ভেতরে মিশ্র অনুভূতির ভয়ংকর ঝড় চলতে লাগলো। সারিম যেখানে ছুঁয়েছে এই সেই হাতটুকু যেন ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।
–“মেরু? কিছু বলো?”
মেহের চারপাশে এলোমেলো নজর ফেলে কম্পনরত কন্ঠে বললো,
–“খুশি না হওয়ার কী আছে?”
–“এর মানে আমাকে নিয়ে অভিযোগ নেই?”,
মেহের ডানে-বামে মাথা নাড়ায়। সারিম সঙ্গে সঙ্গে মেহেরের হাত ছেড়ে দিলো। সুযোগ পেতেই মেহের ছুটে চলে গেলো রুমের দিকে। সারিম মেহেরের যাওয়ার পানে চেয়ে চাপা হাসি দিলো। মন বড্ড ফুরফুরে লাগছে তার।
মেহের রুমে এসে অসম্ভব কাঁপছে। বিছানার চাদর মুঠ করে চুপচাপ বসে আছে। মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে কিছুক্ষণ আগের ঘটনা। ভালো লাগাময় মুহূর্ত। কিন্তু এত লজ্জা কেন লাগছে? কেন মাটির সাথে মিশে যাওয়ার অনুভূতি হচ্ছে? আশ্চর্য!
মেহের ধপ করে বিছানায় শুয়ে পরলো। বালিশে মুখ গুঁজতেই চেনা এক ঘ্রাণ পেলো। এটা সারিমের পারফিউমের ঘ্রাণ। গা শিউরে ওঠে মেহেরের। এপাশেই তো গতকাল সারিম শুয়েছিলো। মেহের সারিমকে নিয়ে চিন্তায় বিভোর হয়ে ঘুমিয়ে গেলো। রাতে সেরকম ঘুমোতে পারেনি বোধহয়।
রোজা শুনে হতবাক সারিম এবং মেহেরের বিয়ের কথা শুনে। ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরী হয়েছিলো অবশ্য। তবে নিচে এসে যা শুনলো, অবাক হবারই কথা। রোজা সাইয়ানের পাশে বসলো। সাইয়ান নাস্তা করতে করতে খুবই নরম গলায় বললো,
–“কিছু বলবে?”
–“আপনার ভাইয়ের বিয়ে মেহেরের সাথে..?”
সাইয়ান হেসে বলে,
–“হওয়ারই ছিলো। মন বলতো একদিন এই দুটো এক হবে। দেখো, মন মিথ্যে বলেনি। মন বলেছিলো তোমাকে একদিন ভালোবেসে ফেলবো। সেটাও মন মিথ্যে বলেনি!”
বলেই অন্যরকম চাহনিতে রোজার দিকে চাইলো। সাইয়ানের ওই নজরে খু’n হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা রোজার। লজ্জায় সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে ফেললো। এতে সাইয়ান স্মিত হাসলো।
সকলে হৈ-হুল্লোড় করছে সারিম এবং মেহেরকে নিয়ে। বিয়ে যেহেতু হয়ে গিয়েছে সেহেতু লাঞ্চে স্পেশাল ডিশ খাবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো। আইঁয়ুব সাহেব মেহের এবং সারিমের জন্য বিয়ের লেহেঙ্গা এবং সেরওয়ানির অর্ডার করলো। মেহেরের বাবা ছুটেছে সেগুলো আনতে। যেহেতু সময় হাতে কম এজন্য প্রি-অর্ডার করে আরও ভালো কিছু কিনতে পারেনি। আইঁয়ুব সাহেব রোজা এবং জ্যুতিকে পাঠালো জুয়েলারি এবং মেহেরের জন্যে আরও কিছু কেনাকাটা করতে৷ সকলে মিলেমিশে কাজ করছে। যেহেতু বিয়ে হয়ে গিয়েছে সেহেতু আজ হলুদ এবং আগামীকাল রিসিপশন হবে। সকলকে জানালো হবে হয়তো আজ বিকালের মধ্যেই। বাবুর্চি বাগানে রান্না করছে। সেগুলোর তত্ত্বাবধানে আছে সেই তিন চাচা। বাড়ীর মধ্যে এলাহি আয়োজন হচ্ছে তা মেহের জানেই না। সে তো বেহুঁশ হয়ে ঘুমোচ্ছে।
দুপুরে সকলে খাওয়া-দাওয়া করে যে যার কাজ শুরু করে দিলো। হলুদের জন্যে সকাল থেকেই বাগানে ডেকোরেশন হচ্ছে। বিকালের দিকে মেহেরকে হলুদ সবুজে তৈরি করতে শুরু করলো সামিরা সহ আরও দুজন। মেহেরের সব কেমন স্বপ্নের মতো লাগছে। আচ্ছা, সারিমও কী মেহেরের মতো অনুভব করছে? নাকি বিয়েটা সারিমের ইচ্ছের বিরুদ্ধে। তবে মেহেরের মনে হয় না এই বিয়ে সারিমের ইচ্ছের বিরুদ্ধে হয়েছে। সারিম যথেষ্ট ম্যাচিওর৷ দামড়া ছেলেকে ধরে বেঁধে বিয়ে দাওয়া সম্ভব নাকি? এছাড়া সারিম সকালে যেভাবে মেহেরকে খুশি হওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলো সেখানে বোঝা যায় সারিম বিয়ে নিয়ে খুশি। তবে.. সারিম কী সেরকম অনুভব করে যেরকমটা মেহের করে? এই একুটা জায়গাতেই মেহের সব গুলিয়ে ফেলছে।
সাজানোর পর্ব শেষ হতেই হন্তদন্ত হয়ে মেহেরের রুমে প্রবেশ করলো সোহা। মেহের চমকালো সোহাকে দেখে। সোহা সাপের ন্যায় হিসহিসিয়ে বললো,
–“লানদ তোদের মতো স্বার্থপর বান্ধুবীর উপর, যারা বিয়ের মতো সেরা মুহূর্তেও বান্ধুবীকে ভুলে যায়। মাহিম না জানালে তো জানতেই পারতাম না তোর বিয়ে হয়ে আবার গায়ে হলুদও হচ্ছে।”
মেহের সত্যি-ই ভুলে গেছিলো সোহার কথা। সকাল থেকে এত চাপে খেয়ালে আসেনি। এজন্য কিছুটা অনুশোচনা বোধ অনুভব করলো। মুখ ভার করে বললো,
–“আমি সত্যি স্যরি সোহা। সবকিছু এত তাড়াতাড়ি হলো যে আমি নিজেই ঘোরের মধ্যে আছি। মাহিম এই প্রথম ভালো কিছু করলো তোকে জানিয়ে!”
সোহা মুখ বাঁকিয়ে বললো,
–“তা তো ভুলবাই। আমি তোমার কে? যাইহোক, এবারের মতো মাফ করে দিলাম। সামনে থেকে যেকোনো ফাংশন হলে আমাকে প্রথমে জানাবি। এখন আমার আম্মু-আব্বুকে রাজি করা তোর বাড়ি থাকতে। আমি সব অনুষ্ঠানে থাকতে চাই!”
মেহের হাসলো। হেসে বললো,
–“আমি এখনই মাকে বলছি তোর আম্মুকে কল দিতে!”
মেহেরের কথা শুনে সোহার মুখ চিকচিক করে উঠলো। খুব খুশি হলো সে।
নির্ধারিত সময়ের থেকে অল্প কিছুটা দেরীতে অনুষ্ঠান শুরু হলো। উচ্চশব্দে গান-বাজনা চলছে। সারিম এবং মেহের পাশাপাশি স্টেজে বসেছে। গুরুজন’রা একে একে এসে দুজনের গালে, হাতে হলুদ ছুঁয়ে দিচ্ছে। এসব কিছু মেহের মন-প্রাণ দিয়ে উপভোগ করছে। সবকিছু কল্পনা লাগছে তার। সবকিছু সুন্দর লাগছে। আরাম লাগছে। এত কান্না-কাটির ফলস্বরূপ বুঝি এত সুখ পাওয়ার কথা ছিলো তার? অবিশ্বাস্য লাগছে।
মেহেরের ভাবনার মাঝে হঠাৎ সকলের সামনেই সারিম এক অবিশ্বাস্য কাজ করে বসলো। তার গাল থেকে কিছুটা হলুদ নিয়ে মেহেরের গালে লাগালো। যার ফলে সকলে চিৎকার করে উঠলো। মেহের অসম্ভব চমকালো সারিমের এ-কাজে৷ বয়াল বাহুল্য অবাকের চরম পর্যায়ে। শিরশির করে উঠলো সর্বাঙ্গ। আশিফ দূর থেকে চেঁচিয়ে বললো,
–“জোস বন্ধু জোস। এই নাহলে আমাদের নিরামিষ সারিম! নিরামিষ যে আমিষ হয়ে গেলো। দেখেছো নি সবাই?”
বাচ্চদের হৈ-হুল্লোড় দেখে বড়ো’রা সরে গেলো। আর মেহের লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নিচু করে ফেললো।
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।