বাসন্তীগন্ধা পর্ব-২৬+২৭

0
390

#বাসন্তীগন্ধা
|২৬|
লাবিবা ওয়াহিদ

মেহের কাঁচুমাচু হয়ে সারিমের রুমে বসে আছে। বঁধু সাজে। ভাবতেই অদ্ভুত লাগছে গত পরশু সাইয়ানের রিসিপশন হলো আর আজ সারিমের রিসিপশন। সারিম মেহেরের বর। মানুষের জীবনের মোড় কখন কোন দিক ঘুরে যায় সেটা কেউ-ই কল্পনা করতে পারে না। অতি রঞ্জিত কিছু ঘটলে তো সেই ঘোর কাটানোই যায় না।

ফুলের ঘ্রাণ মেহেরের নাকে এসে বিঁধছে। মেহেরের কেন যেন ভয় করছে। ভয়ের কারণ হয়তো নিজের চোখে দেখেছে তাই? মেহের দেখেছে আমিন স্টেজের পেছনে ওই ছাঁইপাশ গুলো এনে রেখেছে। মেহেরের অপছন্দের শীর্ষে আছে এই জিনিসটা। তাও কী করে তারই বিয়ের রিসিপশনে এগুলো আনে? যদি সারিম খায়? মেহেরের কেমন গলা শুকিয়ে আসছে। ছাঁইপাশের গন্ধে মেহের বমি করে দিবে। সাথে তার এত সুন্দর বাসরঘরের পরিবেশ দূষণ হবে। ফুলগুলো সুরভী অনুভব করা যাবে না। এখন কী হবে? সারিমও তো দেরী করছে।

মেহের দুশ্চিন্তায় খেয়াল করলো না তার হাত-পা, গলা ভীষণ চুলকাচ্ছে। হঠাৎ হাতের দিকে তাকাতেই চমকে গেলো। লালচে দাগ ফুটে উঠেছে। মেহের কিছু একটা আঁচ করতে পারলে দ্রুত বিছানা থেকে নেমে চুড়িসহ গায়ের সব গয়না খুলতে লাগলো। খুব তড়িঘড়িতে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বেশ কয়েক অংশে ছিলে গেলো। কোনো রকমে সব খুলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে গলা, ঘাড়, হাত-পা চুলকালো। সারা শরীরে কেমন লাল লাল এলার্জির মতো হয়েছে। বিদঘুটে লাগছে দেখতে। মেহেরের মনে পরেছে চিংড়ি মাছে তার ভীষণ রকম এলার্জি। তাও মেহের সবার থেকে লুকিয়ে এক টুকরো নয় বরং দুই টুকরো মাছ খেয়েছে। যার ফলাফল স্বরূপ এই ভয়াবহ এলার্জি। মেহের শাড়ির কুঁচি ধরে তাড়াতাড়ি সারিমের রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রু ঝড়ছে। বেরিয়ে এসে দেখলো মেহেরের রুম লক করা। মেহের উপায়ন্তর না পেয়ে জোরে জোরে কড়াঘাত করলো। সর্বাঙ্গ কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। মাথা ধরে আছে। ভয়ানক অবস্থা তার। এলার্জির ওষুধ না খেলে কিছু না কিছু হবেই। মেহের তার রুম থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে আবারও সারিমের রুমে চলে গেলো। রুমের এক কোণে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। পাগলের মতো ঘাড়, গলা, হাত চুলকাচ্ছে। এবার নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়ে যাচ্ছে তার।

–“মেরু!”
মেহের পিছে ফিরে তাকালেই দেখলো সারিম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। চোখে তার বিস্ময়। মেহের কিছু বলার আগেই হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে পরে গেলো। সারিম এত জোরে চিৎকার দিলো সে পাশের ঘরের কয়েকজন ছুটে এলো। আর সারিম ছুটেছে মেহেরের কাছে।

মেহের যখন চোখ খুললো তখন নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করলো। আশেপাশে তাকাতেই দেখলো পশ্চিম দিকে মুখ করে সারিম নামাজ পড়ছে। মেহের অবাক চোখে চেয়ে রইলো সারিমের দিকে। সারিমের অল্প অল্প অধর নাড়ানো। এক মনে জায়নামাজে চেয়ে থাকা, মাথার টুপি সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সে। এখন সময় কত সেটা মেহের বুঝতে পারছে না। সারিম সেজদাহ শেষ করে সালামে ফিরলো। তখনো সারিমের চোখ বন্ধ ছিলো। মেহের পিটপিট করে দেখলো শুধু। মুগ্ধ চোখে। সারিমকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। এর কারণ কী নামাজে দাঁড়িয়েছে বলে? হয়তো তাই। ওযুর পরপর সবাইকেই অদ্ভুত সুন্দর লাগে। চেহারায় যেন স্বচ্ছ নূর ভাসা ভাসা থাকে।

মোনাজাত শেষ করে মেহেরের দিকে তাকালেই দেখে মেহেরের জ্ঞান ফিরেছে। সারিম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আবার সিজদাহ্ দিলো। মেহের চেয়েই রইলো। নামাজ শেষ করে সারিম মেহেরের কাছে চলে আসলো। সারিমকে কাছে পেয়ে মেহেরের হৃদপিন্ডের ওঠা-নামা বেড়ে যায়। মেহের চোখ নামিয়ে নিচু স্বরে বলে,
–“আমি হসপিটালে কেন?”

সারিম হঠাৎ মেহেরের কপালে অধর ছোঁয়ালো। মেহেরের পা জোড়া সাপের মতো মুঁচড়ে উঠলো। দম বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা মেহেরের। সারিম সেভাবেই মিনিটখানেক রইলো। মেহেরের নিঃশ্বাস বেড়ে গেলো। গলা শুকিয়ে কাঠকাঠ। অদ্ভুত অনুভূতি। সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপছে কেমন। বহু কষ্টে সারিমের গলায় হাত রাখলো না। শক্ত করে চোখ বুজে সারিমকে সরানোর চেষ্টা করলো। পারলো না। পরমুহূর্তেই সারিম মেহেরের কপালে কপাল ছোঁয়ালো। মেহেরের কপাল যে বরফের মতো জমে গেছে। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সে। সারিম চোখ বুজে খুব কাতর গলায় বললো,
–“ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে মেরু। খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে!”

মেহের নির্জীব হয়ে বিছানায় পরে রইলো। সারিমের কথা মন-প্রাণ দিয়ে অনুভব করলো। মেহের কম্পিত কন্ঠে বললো,
–“এলার্জির ওষুধটা রুমে ছিলো। আমার রুমে যারা ছিলো কেউই দরজা খুলেনি। আমিও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো সুখ ছোঁয়ার আগেই হারিয়ে যাচ্ছি!”

সারিম কিছুই বললো না। বকলোও না মেহেরকে। মেহের ভেবেছিলো খুব বকবে। কিন্তু সারিমের নিত্যদিনকার বকাবকির স্বভাবটা আজ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে৷ সারিম এবার মেহেরের গালে অধর ছুঁয়ে বললো,
–“কিছু হয়নি। সব ঠিকাছে৷ এখন কেমন লাগছে?”
মেহের কথা বলতে পারলো না কিছুক্ষণ। সারিমের ছোঁয়ায় নেতিয়ে গেছে। সারিম মেহের চোখের দিকে চেয়ে বললো,
–“কিছু বলবে না? খারাপ লাগছে?”

মেহের চট করে চোখ মেলে নেতিবাচক মাথা নাড়ায়। আবদার করে বললো,
–“বাড়ি যাবো আমি!”

সারিম মাথা নাড়িয়ে বললো,
–“আচ্ছা। ডাক্তারকে ডেকে আনছি।”

বলেই সারিম বেরিয়ে গেলো। সারিম বের হওয়ার পরপর জ্যুতি, মেহেরের বাবা, রোজা তিনজন ছুটে এলো ভেতরে। জ্যুতি তো মেয়েকে আলতো জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে মেয়েকে খুব বকলো। কেন যে চিংড়ি খেয়েছিলো? জ্যুতি কে মেহেরের বাবা থামিয়ে দিয়ে মেয়ের উদ্দেশ্যে নরম গলায় বললো,
–“সকলে খুব ভয় পেয়েছিলাম মা। তুমি সুস্থ আছো, এতেই আল্লাহ্’র দরবারে শুকুরিয়া। আর এভাবে চিন্তায় ফেলবে না ঠিকাছে?”

মেহের ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। যার অর্থ বাবার কথা সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। নিজে নিজে কখনোই পাকামো করবে না।

মেহের একদিন পর বাড়ি ফিরলো। লাল মেহেদীতে রাঙানো বাম হাতের উলটোপিঠে স্যালাইনের ক্যানেল। অদ্ভুত লাগছে দেখতে। নতুন বউ বিয়ের প্রথম রাতেই হাসপাতালে চলে গেছে। বিষয়টা আরও বেশি অদ্ভুত। মেহের রেস্টে থাকলেও সকলে তার রুমে গিজগিজ করছিলো। পুরোদিন সবাই এক ঘরে ছিলো। বিছানা, চেয়ার, সোফা কোথাও জায়গা না পেলেও কার্পেট বিছিয়ে সকলে আড্ডা দিয়েছে। মেহেরের কাছে খুব রঙিন লাগছে সবকিছু। এত আপন কেন সবাই? রোকসানাও মেহেরের পাশ থেকে সরছে না। কিছুক্ষণ পরপর দোয়া-দরুদ পড়ে মেহেরের মাথায় ফুঁ দিচ্ছে। মেহেরের গায়ের লাল লাল ফোলা অংশগুলো স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে।

সারিম মেহেরের থেকে দূরে থাকলেও মেহের ঠিকই খেয়াল করেছে সারিম মেহেরের দিকে তাকিয়ে থাকতো। অপলক নয়নে। যখন সকলে খেতে চলে যেত তখন সারিম এক প্লেটে খাবার এনে নিজে খেত আর মেহেরকেও খাইয়ে দিতো। খাওয়া শেষ হলে নিজেই মেহেরের মুখে ওষুধ পুরে দিতো। একদিনেই সারিমের এত যত্ন দেখে মেহের সিক্ত। সন্ধ্যার পরপর কাজিন’রা সবাই চলে গেলো। আশিফও চলে যায়। বাড়িটা পুরোপুরি মেহমান বিহীন হয়ে যায়। রোজা এবং সাইয়ানের রোজার মায়ের বাড়ি যাওয়ার কথা থাকলেও মেহেরের অসুস্থতার জন্যে ওরা যায়নি। তবে যাওয়াও উচিত। বিয়ের পরপর সাইয়ানের রোজার বাড়ি গিয়ে থাকা হয়নি। এ নিয়ে রোজার মায়েরও তাও মন খারাপ হয়। এজন্য আইঁয়ুব সাহেব বেশ জোর দিয়েই বললো যেন ওরা আগামীকালের মধ্যেই চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

রাতে মেহের চোখ বুজে শুয়ে ছিলো তখনই অনুভব করে কেউ তার পাশে শুয়েছে। মেহের চট করে চোখ মেলে তাকালো। তাকাতেই দেখলো সারিম এক হাতে ভর দিয়ে কাত হয়ে মেহেরের দিকে ঝুঁকে আছে। মেহের তাকাতেই লহু কন্ঠে বললো,
–“ঘুমাওনি?”

মেহের চোখ নামিয়ে বললো,
–“ঘুম আসছিলো না!”
থেমে গিয়ে গলার স্বর আরও নামিয়ে মৃদু স্বরে বললো,
–“আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম!”

সারিম হাসলো। সৌভাগ্যক্রমে তখনই মেহের সারিমের মুখের দিকে চেয়েছিলো। সারিম হঠাৎ মেহেরকে বুকে টেনে নিলো। মুহূর্তে-ই সর্বাঙ্গ জুড়ে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। বরফের মতো জমে গেলো মেহের। সারিম খুব ভালোবাসায় মেহেরকে আগলে নিয়ে নিলো,
–“এবার চোখ বন্ধ করো। ঘুম আসবে!”

বলেই অন্য হাত দিয়ে খুব আলতো করে মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। এতে মেহেরের আবেশে চোখ বুজে এলো। মিশ্র অনুভূতিতে ভাসছে সে। নিজের অজান্তেই অধর প্রসারিত হয়ে রইলো। আহ্! একেই বুঝি বলে পবিত্র ভালোবাসার সুখ! এই ভালোবাসা পাওয়ার জন্যেই বুঝি মেহের এতদিন ব্যাকুল ছিলো?

~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।

#বাসন্তীগন্ধা
|২৭|
লাবিবা ওয়াহিদ

এখন মেহের পুরোপুরি সুস্থ। দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সকলে নিজেদের ব্যস্ত জীবনে ফিরে গেলো। শুধু মেহের ব্যতীত। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ। এডমিশনের জন্যে টুকটাক পড়াশোনা ছাড়া আর সারাদিন শুয়ে বসে কাটায়৷ মাহিম থাকে কলেজে। সারিম, সাইয়ান থাকে অফিসে। রোজাও ঘরে বসে অফিসের কাজ করে। সামিরা গেছে ফুফুর বাসায়৷ মেহের যেতে চেয়েছিলো কিন্তু সারিমের নিষেধাজ্ঞা। এডমিশনের পুরো প্রস্তুতি থাকতে হবে। এমনিতেই অনেকগুলা দিন নষ্ট হয়ে গেছে। আর নষ্ট করা যাবে না।

এদিকে মেহের যখন পারে তখনই মাহিমকে খোঁচা দেয়। খোঁচা এরকম,
–“আহারে। আমি এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে দিলাম আর আমার দেড় মিনিটের বড়ো ভাইটা সবে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে উত্তীর্ণ হলো। খুব কষ্ট লাগে বুঝি বড়ো ভাই?”

মাহিম তখন না পারে সইতে আর না পারে কিছু বলতে। শুধু তেলে-বেগুনে জ্বলতে জ্বলতে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“সময় আমারও আসবে!”
মেহের তখন ফিক করে হেসে দিয়ে বলে,
–“যতই সময় আসুক না কেন, আমার উপরের ক্লাসে উঠতে পারবে না বৎস।”
মাহিম এবার মেহেরের মাথায় গাট্টা মেরে বললো,
–“এই বিবাহিতা মহিলা, প্যানপ্যান না করে স্বামীর সেবা কর গিয়া। এইটুকুনি বয়সে বিবাহিত হয়ে গেছোস। বুড়ি!”

মেহের মাহিমের চুল টেনে দিয়ে কর্কশ কন্ঠে আওড়ায়,
–“বুড়ো!”

মেহেরের মন-খানা আজকাল খুব আঁকুপাঁকু করছে বাইরে ঘোরার জন্যে। মাহিমের সঙ্গে নয়, সারিমের সঙ্গে। এই ফুল সদ্য বিবাহিতা নারীর জন্যে স্বাভাবিক। তাদের এক চাপা আকাঙ্খা থাকে, তাদের একমাত্র সঙ্গী তাদের সময় দিবে, তাদের আবদার শুনবে, মন ভরে তাদের হাসবেন্ডের সেবা করবে, সময় কাটাবে, ঘুরবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের সখ এবং আবদার শত ছুঁয়ে যাবে যেন। মেহের তাদের থেকে ব্যতিক্রমধর্মী নয়। কিন্তু সারিম সারাদিন অফিসে পরে আসে। বাড়ী ফিরে রাত ন’টার পর। মেহেরের মন বিষণ্ণ থাকলেও রাত বাড়লে ঘুমানোর সময় সারিম তাকে আগলে নেয়। সেই মুহূর্ত খুব সুন্দর, সুখের। তাও সারাদিনের আকাঙ্খা তো থেকেই যায়। আবদার গুলো পূরণ না হোক, অন্তত প্রাণভরে কথাও তো বলতে পারে। তা-ই বা হয় কোথায়?

শুধু তিন বেলা কল করে সারিম মেহেরের খবর নেয়। এখন আপাতত মেহেরের একমাত্র সঙ্গী মেহেরের দাদী রোকসানা। মেহের রোজ দাদীর কোলে মাথা রেখে সারিমের নামে কত কত অভিযোগ করে। মেহেরের এই ধরণের অভিযোগ শুনলে রোকসানা শুধু হাসে। হাসতে হাসতে বলে,
–“বিয়ের এক মাসও পেরুলো না, এতেই এত অভিযোগ? তুই কী বাচ্চা নাকি মেরু?”

মেহের তখন চোখে-মুখে অভিমান ফুটিয়ে বলে,
–“তোমার নাতীটাই এমন। না চাওয়া সত্ত্বেও এক ঝুঁড়ি অভিমান মন আকাশে ভীড় করে। তাও দেখো কী অবস্থা? অভিমান, অভিযোগ করার আগেই তোমার সারিমের ক্লান্তিমাখা মুখখানা দেখে সব উধাও হয়ে যায়। একা থাকলেই আবার ঝেকে বসে!”

রোকসানা আবার হাসলো। হাসি বজায় রেখে বললো,
–“আচ্ছা। তাহলে আজ ঘুরে আয় কোথাও। সারিমকে কল করে জানিয়ে দে।”

মেহের ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে ভাবলো। অতঃপর কিছুটা নড়েচড়ে চোখ বুজে বললো,
–“রাখো এসব কথা দাদী। ঘুম পাচ্ছে।”

—————–
মেহের দাদীর বলা কথামতো বিকালেই রেডি হয়ে তাদের বাড়ির বাইরের বড়ো গেটে গিয়ে দাঁড়ালো। বোরকা, হিজাব পরে একদম ফিটফাট। দারোয়ান তার ম্যাছ সামলাতে ব্যস্ত। সেদিন মেহের তার ম্যাছ নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। সেই ম্যাছটা ছিলো দারোয়ান চাচার শেষ ভরসা। এমনিতেই রাত-দিন এক করে ডিউটি করতে গিয়ে ম্যাছ কেনার সময় পায় না। কিনলেও একসাথে কয়েকটা করে কিনে। সে আবার ধূমপানে আসক্ত। ধূমপান ছাড়া চলাটা তার নিঃশ্বাস আটকে যাবার মতোই লাগে। তার ওপর সব ম্যাছ শেষ করে একটাই অবশিষ্ট আছে তার। এজন্যে যে করেই হোক তাকে সেটা সুরক্ষিত করতেই হবে।

মেহের যদি চায় তাহলে সোজাসুজি বলে দেবে তার ম্যাছ শেষ, কিনতে যাবে যাবে বলেও যাওয়া হচ্ছে না। আবাসিক এলাকা হওয়ায় আশেপাশে টঙের হুঁদিশও নেই।

মেহের লোহার গেটে পিঠ এলিয়ে সারিমকে কল করলো। দু’বার রিং হওয়ার পর রিসিভ করলো। মেহের তখন খুব আবদারের সাথে বললো,
–“আমি ঘুরতে যেতে চাই!”

ওপাশ থেকে সারিমের শীতল গলা শোনালো। বললো,
–“মাহিম কোথায়?”
–“আমি তো আপনার সাথে যেতে চাইছি।”
সারিম বললো,
–“মিটিং আছে।”

মেহের অত্যন্ত অভিমান করে বসলো সারিমের এই কথায়। জেদটাও মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। নাক কুচকে দৃঢ় গলায় আওড়ায়,
–“সেটা আমার জেনে কাজ নেই। আমি গেটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। এক পাও নড়ার ইচ্ছে নেই।”
–“মেরু। জেদ কেন করছো?”

মেহের কোনো কথা না শুনে কল কেটে দিলো। কতক্ষণ একভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পায়চারী করলো। এরকম করতে করতে সন্ধ্যা নেমে এলো। পাখিরা তখন নিজ নীড়ে ব্যস্ত হয়ে ফিরছে। দারোয়ান হঠাৎ কানে ফোন নিয়ে মেহেরের কাছে ছুটে এলো। তার সাধারণ বাটন ফোনটা মেহেরের দিকে দিয়ে বললো,
–“সারিম বাবা কল করছে!”

মেহের দারোয়ানের থেকে মোবাইলটা নিয়ে কানে দিলো। হ্যালো বলতেই ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো,
–“এত অবাধ্য কেন? কল দিচ্ছি দেখছো না?”

মেহের সহজ হয়েই বললো,
–“ফোন সাইলেন্ট। ব্যাগে। দেখিনি!”
সারিম চোখ বুজে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বললো,
–“আমি আসছি। আর হাঁটাহাঁটি করার দরকার নেই। আপাতত ভেতরে যাও নয়তো দারোয়ান চাচার রুম থেকে একটা চেয়ার এনে বসো।”

মেহের সঙ্গে সঙ্গে বললো, “আচ্ছা।”

সারিম কল রেখে দিলো। আর মেহেরের হাসি যেন ঝুলে পরছে। অবশেষে সারিম তার মিটিং ফেলে আসছে। মেহের অত্যন্ত খুশি। এর সাথে আফসোসও করলো এই ভেবে, সারিমকে মেহের শুধু শুধু ভয় পেত!!

মেহের চেয়ার এনে বসলো না। আগের মতোই হাঁটা-চলা করলো। মিনিট দশেকের মধ্যেই সারিমের গাড়ি গেটের বাইরে এসে থামলো। সারিম গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। মেহের সারিমকে লক্ষ্য করতেই হাঁটা থামিয়ে দিলো। মেহেরকে বসতে না দেখে সারিম চোখ রাঙালো। মেহের বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে নিজেই গেট খুলে বেরিয়ে আসলো। যেন অপেক্ষা করতে করতে সে ক্লান্ত।

মেহের হাসতে হাসতে সারিমের পাশ কেটে গাড়িতে উঠতে যেতে যেতে বললো,
–“চলুন।”

সারিম মেহেরকে পিছু ডেকে থামালো। এরপর সারিম এগিয়ে এসে মেহেরের কালো বোরকার পিঠে থাকা সাদা ময়লার দাগ ঝেড়ে দিতে দিতে বললো,
–“গেটে কতদিনের ময়লা জমে আছে। সেটায় হেলান দিয়েছো কেন? জানো না কালো জিনিস কতো সেন্সিটিভ? সামনে থেকে খেয়াল রাখবে।”

মেহের আসলেই খেয়াল করেনি। তবে সারিমের সূক্ষ্ম দৃষ্টির প্রসংশা মনে মনে ঠিকই করলো। কত খেয়াল রাখে সারিম৷ মেহের আপনমনে আওড়ালো,
–“আপনার স্পর্শ পাওয়ারর জন্যে এক ভুল বারবার করতে রাজি!”

ওরা ঘুরতে বেশি দূর গেলো না। ধানমন্ডি লেকেই গেলো। আশেপাশে অসংখ্য কপোত-কপোতীর ছড়াছড়ি। সারিম মেহেরের আঙুলের ফাঁকে নিজের আঙুল গুলো গুজে হাঁটছে। আর মেহেরকে অনুভূতিরা সুঁড়সুঁড়ি দিচ্ছে। কত কল্পনা করতো এই দিন গুলির। কল্পনার চাইতেও সুন্দর প্রতিটা মুহূর্ত। মেহেরের ভাবনার মাঝে হঠাৎ-ই সারিম বলে ওঠে,
–“খুব জেদী হয়ে গেছিস মেরু। শেষমেষ বাধ্য হয়ে মিটিং ফেলে তোর কাছে ছুটে আস্পতে হয়েছে!”

মেহেরের মন ভার হয়ে গেলো। সারিম আবারও তাকে তুই সম্বোধন করেছে। মেহের হাত ছাড়াতে চাইলো। কিন্তু সারিম আরও শক্ত করে ধরলো। থেমে গিয়ে বললো,
–“কী হলো?”

মেহের হাত মোঁচড়াতে মোঁচড়াতে বললো,
–“আপনি এমন বিশেষ কেউ নন যে আপনি ছাড়া আপনার অফিস অচল, আপনার ব্যবসা অচল। আপনি ছাড়াও সাইয়ান ভাই, বাবা সব দেখছে। তাই মিটিং-এ আপনি না থাকলেও তা দেখার জন্যে আরও দুজন আছে!”

সারিম শুধু অবাক হয়ে দেখলো মেহেরকে। মেহেরের থুঁতনি ধরে মেহেরের নত মুখখানা তুলে চোখে চোখ রেখে বললো,
–“এত বড়ো কবে হলি? আজকাল কথাও গুছিয়ে বলতে পারিস!”
–“আগে থেকেই বড়ো ছিলাম। শুধু আপনার নজর ছোটো দেখে ছোটো-ই দেখে গেছেন!”

সারিম চাপা হাসলো। আবার হাঁটতে শুরু করলো। এর মাঝে হঠাৎ বললো,
–“অভিমান করাও শিখে গেছো। ভালো তো।”

~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।