#বিকেলের_যতো_রঙ
পর্ব সংখ্যা-০২
#রুবাইদা_হৃদি
আব্বার বিয়ের খবর টা যেমন হুট করে এসেছিলো তেমনি আব্বাকে কে বা কারা যেন মে’রে ফেলে রেখে গিয়েছে সেই খবর টাও আচমকা এলো৷ রফিক চাচার বলা কথা শুনে উঠানো গড়াগড়ি করে কান্না করতে লাগলেন আব্বার সদ্য বিয়ে করা বউ৷ আমি তখনো রোয়াকে বসে অনবরত কাঁপছি৷ ভাইয়া ইতিমধ্যে রফিক চাচা সহ বেরিয়ে গেছে৷ যাবার আগে আমাকে শুধু বলেছে,
‘মিথি আমরা এমন একটা খোলা ময়দানে দাঁড়িয়ে আছি যেখানে শুধু তপ্ত রোদ৷ আমাদের ছায়া দেওয়ার মতো কোনো বটবৃক্ষ নেই৷’
ভাইয়ার কথা শুনে আমি কাঁদতে ভুলে গেলাম৷ আমাদের ছোট একটা পরিবার নিমিষে কেমন কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেলো৷ ওইদিকে মিনু খালার কান্নার আওয়াজে আমার বিরক্ত লাগছে৷ দাদি ঘরে বসে বিলাপ জুড়ছেন৷ ঝুমা আপা আমার কাছ ঘেঁষে বসে বললেন,
‘আশরাফ ভাই কে একটা কল দে৷’
আমি ঝুমা আপার মুখপানে তাকালাম৷ আপার হাতজোড়া ধরে বললাম,
‘এতিম হয়ে গেলাম আপা?’
আমার কথা শুনে আপা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন৷ পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন,
‘কিছু হবে না৷ কিছু হবে না৷’
এতোকিছুর মধ্যেও আমার কান্না গুলো কেমন যেন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে৷ মিনু খালাকে পাশের বাড়ির চাচিরা ধরে উঠালেন৷ খালা আমার দিকে তাকিয়ে কান্নার সুরে বললেন,
‘মাগো আমার স্বামীর জন্য কু দোয়া কইরো না৷ দোয়া করো৷ সন্তানের দোয়া নাকি কাজে লাগে৷
খালার কথাস শুনে আমার কান ঝাঁঝিয়ে উঠলো৷ শত হোক উনি আমার আব্বা৷ আমি ঝুমা আপাকে ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে কুলসুম কে ডাকলাম৷ আপা আমাকে টেনে বসাতে চাইলে আমি রুক্ষ কন্ঠে বললাম,
‘তোমার মা’কে সামলাও আপা৷ মহিলার মাথা ঠিক নাই৷’
আমার কথায় ঝুমা আপা কিছুটা মন খারাপ করলো৷ আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে কুলসুমকে হাঁক ছেড়ে ডাকছি৷ কুলসুম আসতেই আমি বললাম,
‘আমার সাথে সদর হাসপাতালে যেতে পারবি?’
‘এতো রাইতে মাইয়া মানুষ বাড়ি থাইকা বাইর হইবা কেন৷’
পাশের বাড়ির একটা কাকি কথাটা বলতেই আমি কুলসুম কে ধমকিয়ে বললাম,
‘যাবি?’
‘চলেন আফা৷ আমি টর্চ লাইট নিয়া আসি খাড়ান৷’
.
আঁধার চারদিক ছেয়ে আছে৷ আকাশে থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে৷ এ যেন আলো আঁধারের খেলা৷ আমি টর্চ নিয়ে এগিয়ে চলেছি৷ কুলসুম আমার এক হাত ধরে ভয়ে কাঁপছে৷ মেয়েটা বড্ড ভীতু৷ আম্মা থাকাকালীন মেয়েটাকে আমার মতো আদর যত্ন করছেন৷ কুলসুম কাঁপতে কাঁপতে বললো,
‘বাড়ি ফেরত যাই চলেন আফা৷’
‘গিয়ে কি করবো!আমার যে ওইখানে কেউ নেই৷’
আমার কথা শুনে কুলসুম হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো৷ হেঁচকি তুলে বললো,
‘খালাম্মার এমন অকাল মৃত্যু হইবো কে জানতো৷ ভালো মানুষ কেমন কইরা দাপাইয়া মরলো৷’
কুলসুমের কথা শুনে আমার মনেও কেমন করে উঠলো৷ সত্যিই তো! আমার ভালো আম্মা সকালের নাস্তা বানিয়ে আমাদের ডেকে তুলে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন৷ হুট করে আমার ঘরে এসে বললেন ভাইয়াকে খবর পাঠাতে৷ ব্যতিব্যস্ত হতেই আম্মা মাথা ঘুরে পরে গেলেন৷ এরপর আর কোনো কথা আমার মা আর বলতে পারেন নাই৷
আমার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে৷ আমরা খেয়া ঘাটে পোঁছাতেই দেখলাম ভাইয়া নৌকা থেকে নামছে৷ আমাকে দেখেই দ্রুত পাঁ চালিয়ে এসে বললো,
‘রাতের আঁধারে বাড়ি থেকে বের হয়েছিস কেন?’
‘আব্বা কোথায় ভাইয়া!আব্বা কি আর নাই?’ আমি শেষের কথাটুকু অনেক কষ্টে উচ্চারণ করতেই ভাইয়া লাইট টা হাতে নিয়ে বললো,
‘বেঁচে আছেন৷ তবে অবস্থা বেশি ভালো না৷’
‘তুমি চলে আসলা কেন৷ চলো আমিও যাবো৷ আব্বা একা হসপিটালে থাকতে পারবেন না৷’
‘আব্বার সাথে রফিক চাচা আর মামা আছে৷ চিন্তা করিস না৷ উনারা আব্বাকে নিয়ে ঢাকার পথে রওনা দিয়েছেন৷ আমি টাকা পয়সা নিতে আসছি৷ টাকাও তো লাগবে৷’
শেষের কথাটুকু ভাইয়া কেমন উদাস ভাবে বললো৷ তার চোখেমুখে রাজ্যের চিন্তা এসে ভর করেছে৷ বাড়ির পথে যেতে যেতে ভাইয়া উদাস ভাবে আবারো বললো,
‘মিথি আব্বাকে কারা যেন ছু’ড়ি মেরেছে৷ নদীর পাড়ে না’কি দুই তিন জন লোক মিলে আব্বাকে মারছিলো৷ তখুনি আমজাদ চাচা দেখে চিৎকার করতে ওরা নদীতে ঝাঁপিয়ে সাঁতার কেটে চলে যায়৷’
‘আব্বাকে কি অনেক মে’রে’ছে ভাইয়া?’
আমি কান্না গিলে প্রাশ্নটা করলাম৷ ভাইয়া উত্তর দিলো না৷ বিদ্যুৎ -এর আলোতে দেখলাম আমার ভাইয়ের বেদনা৷ ভালোবাসা না’কি আব্বাকে হারানোর বেদনা সেটা উপলব্ধি করতে পারলাম না৷
.
আমাদের গ্রামের নাম কাঞ্চনপুর৷ মানিকগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত একটা গ্রাম৷ তবে আমার আব্বার এই দুর্ঘটনার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো৷ দল বেঁধে মানুষ আসতে লাগলো৷ একে একে সবার উদ্ভট প্রশ্নের উত্তরে আমরক সবাই কোণঠাসা হয়ে উঠলাম৷ বেশিরভাগ সবাই আমার ভাইকে আব্বার খু’নি বলছে৷ ওইদিকে মিনু খালা আজকেও সুতির একটা শাড়ি পরে রোয়াকে চেয়ার নিয়ে বসে মহিলাদের সাথে দুঃখ বিনিময় করছে ৷ এরমধ্যেই ভাইয়ার ফোন আসতেই একটা খারাপ খবর এলো৷ আব্বার অবস্থা নাকি বেগতিক ৷ দাদি আমার পাশেই ছিলেন কথাটা শুনেই তিনি আবারো ম’রা কান্না জুড়লেন৷
অবস্থা এমন হয়েছে আমি কোনো শোক পালনের সুযোগ পাচ্ছি না৷ দাদি আমাকে ধরে কাঁদতে কাঁদতেই মূর্ছা গেলেন৷ ওইদিকে মিনু খালা এসেই আমাকে শাসিয়ে বললেন,
‘তোমরা ভাই বোন মিলে আমার জামাইরে মারছো৷ আল্লাহ গো কেউ পুলিশরে খবর দাও৷’
‘আপনি বুঝে শুনে কথা বলুন৷ উনি আমাদের জন্মদাতা পিতা৷’
উনি আমার কথা শুনে আরো তেঁতে উঠলেন যেন৷ কান্না করতে করতেই অভিশাপ দিলেন৷ আমি তাজ্জব হয়ে বসে আছি৷ মিনু খালার বলার অবসান ঘটলো ঝুমা আপা আসাতে৷ আপা এসে মিনু খালাকে ধমকে বললেন,
‘মা বেশি বাড়াবাড়ি করো না ৷ চুপ করো৷ তুমি নিজেও জানো আশরাফ ভাই আর মিথি নির্দোষ৷’
ঝুমা আপার কথাতে মিনু খালা থামলেন৷ ঝুমা আপা কোথায় যেন গিয়েছিলো৷ তার পরনে বোরকা৷ বোরকা কাঁদায় মাখামাখি৷ আমি ঝুমা আপাকে প্রশ্ন করলাম,
‘কোথায় থেকে আসলে?’
‘বাড়িতে গিয়েছিলাম৷ কাপড় আনতে৷’
ঝুমা আপার কথা শুনে আমি তার হাতের দিকে তাকালাম৷ দেখলাম একটা বড় কাপড়ের ব্যাগ৷ আমি ঝুমা আপাকে না ঘেটে কুলসুম কে বললাম দাদিকে পানি খাওয়াতে৷ আর বাতাস করতে৷
ঝুমা আপা ঘরে যেয়েই মিনু খালাও তার পিছুপিছু ঘরে গেলো৷ বাড়ির পরিবেশ ঠান্ডা হতেই মানুষের সমাগম কমতে শুরু করলো৷
গত দুইদিনে বাড়ির পরিবেশ বেশ হালকা হয়ে উঠেছে৷ আব্বার অবস্থা উন্নতি না হলেও অবণতি নেই৷ তবে মিনু খালার চেহারাটা মলিন হয়ে উঠেছে বেশ খানিকটা৷ কারণ আজকে বাড়িতে পুলিশ এসেছিলো৷ পুলিশের সন্দেহের তীর মিনু খালার দিকেই যাচ্ছে৷ মিনু খালাকে পুলিশ একা ঘরে নিয়ে জবানবন্দি নিয়েছে৷ সেই থেকে উনি চুপ করে আছেন৷
ঝুমা আপা আরো নিশ্চুপ হয়ে আছে৷ গত দুইদিনে তার রুপ লাবণ্য অনেক খানি কমে গেছে যেনো৷
তবে মিনু খালা চুপ থাকলেও সংসারের দায়িত্ব দাদির থেকে নিজের কাছে নিয়ে নিয়েছেন৷ দাদি ছেলের শোকে বিছানায় পরে গেছেন৷ তার এইদিকে কোনো মন নেই৷ আমি উঠান থেকে এসে আমার ঘরে জানালার পাশের টেবিলে বসতেই মিনু খালা আমার ঘরে এলেন৷
আমি উনাকে দেখে নড়েচড়ে বসলেও ঘুরে তাকালাম না৷ উনি আমার পাশে বিছানার কোণায় বসে বললেন,
‘আশরাফ কোনো খবর বার্তা দিছে?’
‘না৷ তবে ভাই আজকে টাকা নেওয়ার জন্য আসবে৷’
‘ওহ৷’
ঘরমত পিনপতন নীরবতা বিরাজ করলো কিছুক্ষণ৷ এরপর উনি উঠে এসে আমার কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালেন৷ আমি কিছুটা ভড়কে যেতেই উনি আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন,
‘আমাক্ব ভুল বুঝিস না মিথি৷ আমি যে বাধ্য হয়েছি বিয়েটা করতে৷’
‘মানে!’ আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করতেই মিনু খালা তড়িঘড়ি করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন৷ আমি পিছু যেতেই উনি দাদির ঘরে ঢুকে যেতেই আমি ঘরে ফিরে এলাম৷ উনি এমন টা কেন বললেন!
প্রশ্ন টা মাথায় ঘুরতেই ভাইয়ার একটা টেক্সট আসতে আমি সেদিকে মনোযোগ দিলাম৷
সন্ধ্যার পর ভাইয়া বাড়ি আসতেই আমি পানি দেওয়ার জন্য যাবার আগেই ঝুমা আপা এগিয়ে গেলো৷ ঝুমা আপাকে দেখে ভাইয়া এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘মিথি পানি নিয়ে আয়৷’
‘আপার হাতে তো পানি আছেই৷’
আমি বলতে বলতে ভাইয়া নিজেই কলপাড়ে এগিয়ে গেলো৷ ঝুমা আপা মন খারাপ করে আমাকে বললো,
‘তোর ভাই আমাকে অগ্রাহ্য কেন করছে মিথি৷’
‘মন খারাপ করো না আপা৷ বুঝোই তো আমাদের উপর দিয়ে কি যাচ্ছে৷’
ঝুমা আপা আর কথা বাড়ালো না৷ পানি টা রেখে ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো৷ আমি ভাইয়ার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে যাওয়ার পথে দেখলাম দাদি আর মিনু খালা বসে আছেন আব্বার রুমে৷ সাথে আমার আব্বার ছোট ভাই হোসেন কাকাও আছেন৷ কাকা কখন এসেছে আমি খেয়াল করি নাই৷ তবে উনাদের আলোচনার বিষয় আমার কানে আসতেই আমার শরীর ঝনঝন করে উঠলো৷ মিনু খালা চাপাস্বরে বলছেন,
‘আশরাফের মা যে এমনি এমনি মারা যায় নাই এই কথা পাঁচ কান হলে কি হবে আম্মা? আমাদের তো হাজত বাস করা লাগবো৷’
হোসেন চাচাও মিনু খালার সাথে তাল মিলিয়ে বললেন,
‘হ্যাঁ এখন এইসব ঝামেলায় পরা যাবে না৷’
দাদি এরপর কিছু একটা বললো বোধহয় তবে সেসব শোনার পূর্বেই ভাইয়া আমাকে ডাকলো৷ আমি ছিঁটকে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালাম৷ ভাইয়ার কাছে ছুটে গিয়ে বললাম,
‘ভাইয়া উনারা আম্মার মৃ’ত্যুর ব্যাপারে আলোচনা করছে৷ আম্মা নাকি স্বাভাবিক ভাবে মা’রা যায় নি৷’
ভাইয়া আমার কথা শুনে অত্যন্ত শান্ত কন্ঠে বললো,
‘হ্যাঁ আম্মাকে মে’রে ফেলেছে৷ আমি জানি৷’
চলবে….