বিধুর রজনী পর্ব-২২+২৩

0
227

#বিধুর_রজনী
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ২২]
________________
৪৮.
শাহাবা এবং ইদ্রীস রাশীদ আলাপ আলোচনা করছিলেন।পালঙ্কের এক কোণে মুখ ভার করে বসে আছেন ফুফুমা আসমা।এক নাগড়ে বন্দিদশায় তিনি ত্যক্ত বিরক্ত।আরওয়ার প্রতি তার জেদ স্তরে স্তরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।সেদিন কেন বাঁচাতে গেল ছেলেটাকে?প্রহরীদের হাতে ম/রলে ম”রতো আরওয়া অতি দরদে আজ সেই ছেলে বাঘের ন্যায় থাবা বসিয়ে দিলো সাজানো গোছানো সাম্রাজ্যে।এই মেয়ে ম;রঃলে ম!রে যাক দরকার নেই আর ফিরে আসার।জন্মের পর থেকে যখন যে কাজে হস্তক্ষেপ করেছে তাতে কুফা লেগেগেছে।
বিনিতা তখন শেহজাদীকে নিয়ে পিতলের দ্বার খুলে শাহাবার কক্ষের নিকট প্রবেশ করলেন।সুস্থ সবল জ্যান্ত ভ্রাতা এবং মাতাকে দেখে দু’চোখ ছলছলিয়ে উঠলো।সম্রাজ্ঞী বিনিতার হাত ছেড়ে ছুটে গিয়ে ঝাপটে ধরলো ইদ্রীসকে।অকস্মাৎ ধাক্কা সামলাতে না পেরে দু’চরণ পিছিয়ে গেল ইদ্রীস রাশীদ।

” বোন, আমার বোন।”

ইদ্রীস রাশীদ যেন হারানো প্রাপ্তি ফিরে পেয়েছে।আদুরে হাতে ঝটপট জড়িয়ে ধরলেন আরওয়াকে।কপালে গালে চুমু খেয়ে কেঁদে উঠলেন চোখের পলকে।আরওয়ার তাকে কাছে এখনো ছোট্ট বাচ্চা বোন।এতদিন পর সুস্থ সবলে বোনকে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা ইদ্রীস।শাহাবা তখন কাতর চোখে চেয়েছিলেন মেয়ের দিকে।তিনি কাঁদছেন।হারানো বুকের ধন ফিরে পেয়ে কৃতজ্ঞতার চোখে চাইলেন বিনিতার নিকট।আরওয়ার দিকে তাকিয়ে বিনিতা আদেশ সুরে বলেন,

” খবরদার মেয়ে এত কাঁদবে না।আবার অসুস্থ হয়ে আমার ছেলেকে চিন্তায় মা/র|তে চাও?আরওয়া দ্রুত নিজের কক্ষে ফিরে যাও তাসবীর যদি জানে তোমায় এখানে এনেছি আমার সাথে খুব রাগারাগি করবে।”

” আমি আসছি একটু থাকি এখানে।”

কান্নার পর্ব শেষ হতে ফুফুমা আসমার নিকট আরওয়া যখন এগিয়ে গেল তখনি বাজখাঁই গলায় তিনি বলেন,

” খবরদার সামনে আসবে না।তোমার জন্য আমাদের এই হাল।আমার ভাইয়ের এই হাল।কে বলেছিল সেদিন এত দরদ দেখিয়ে ছেলেটাকে বাঁচাতে?প্রহরীকে হ/-ত্যা করে তাসবীরকে বাঁচালে আর মাঝ থেকে ফেঁসে গেলাম আমরা।আমার ভাইটা কোথায় আছে কি করছে কে জানে নাকি মে/রেই ফেলেছে।”

” ফুফুমা তোমার ভালো না লাগলে তোমার কক্ষে ফিরে যাও আমার বোনের সঙ্গে এভাবে কথা বলবে না।পিতা যা করেছেন তার শা/স্তি তাকে পেতেই হতো।”

আরওয়া স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে আছে ফুফুমা আসমার পানে।এতটা অবহেলা লাঞ্ছনা।এই মুহূর্তে আরওয়ার মনে হচ্ছে তার জীবনে ভালোবাসার বড্ড অভাব।তার কারনেই সব ভুল হয় আর সেই ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে পরিবারের সকলের।

” কি করেছে আমার ভাই?তোরা সব একদল আমার ইবনুল আর আমার ভাইটা সারাজীবন রাজ্যের চিন্তায় খেটে গেছে আর তোরা তো সব মহলে পা দুলিয়ে অন্ন গিলছিস।”

এতক্ষণের হা হতোস্মিতে আরওয়া ভুলেই গেছেন তার পিতার কথা ভাইয়ের কথা।ফুফুমার কথা মাথা থেকে সরিয়ে এগিয়ে যায় ভাই ইদ্রীসের নিকট।

” বড় ভাইজান কোথায়?পিতা কোথায়?

শাহাবা তখন আগুন চোখে তাকায় আরওয়ার পানে।ভেতরে ভেতরে ধরে রাখা রাগ এক নিমিষেই উগরে ফেলতে ইচ্ছে তার।

” এদিকে আসো আরওয়া।”

মায়ের আদেশ পেয়ে এগিয়ে যায় আরওয়া।শাহাবা সূক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে আছে আরওয়ার পানে।

” সম্রাট সাঈদের সঙ্গে তোমার বিয়ে নিয়ে তোমার বাবা চুক্তি করেছিলেন?”

থমথমে চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো আরওয়া।এ কথাতো তো শাহাবা জানার কথা নয়।কি করে জানলেন?

” আজ্ঞে হ্যাঁ।”

” লজ্জা নেই তোমার?বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্কে তুমি চুক্তিতে আবব্ধ হয়েছো।আর তুমি নাকি সবটা জানতে।”

” এসব কথা এখন বলে লাভ নেই।পরিস্থিতি আগের পর্যায়ে নেই।বাবা ভাইজান কোথায় তা বলুন দয়া করে।”

” আমার কোন ছেলে নেই যদি থাকে সে ম-রে গেছে।”

আরওয়া চমকে গেল।তবে মায়ের অভিমানী সুরের কথার তালে নিজেকে গুলিয়ে ফেলা সবচেয়ে বোকামির কাজ ভেবে ইদ্রীসের কাছে জানতে চাইলো ইবনুল রাশীদের সংবাদ।ইদ্রীস শুরু থেকে আলোর নির্মম হ/ত্যার কথা তুলে ধরে একে একে সবটা শুনে স্তম্ভিত আরওয়া।তাসবীরের উপর জমে থাকা পাহাড় সমান রাগ জেদ এক নিমিষে জমানো মেঘ ছেড়ে বৃষ্টিতে পতিত হয়েছে।

” কিন্তু বাবা তো দোষ করেনি ভাইজান, তাহলে বাবাকে কেন বন্দিশালায় রেখে কষ্ট দিচ্ছে?”

” বড় ভাইজান যত দুঃসাহসিক কাজ করেছে তার ইন্ধন আমাদের পিতা।পিতার আশকারায় ইবনুল এত দূর গড়িয়েছে।তাসবীর আমার বন্ধু আমি তাকে বিশ্বাস করে ভুল করিনি আমাদের পরিণাম আরো জঘন্য হওয়ার কথা ছিল আফসোস দয়ায় বেঁচে আছি।”

” আমিও ভালোবেসে ভুল করিনি।”

শেহজাদীর উচ্চস্বরের কান্নায় মিলিয়ে গেল শেষোক্ত বাক্যটুকু।তবে সেদিন জোছনার রজনীতে দু’জন দুদিক থেকে যন্ত্রণায় কাতারেছে কেউ আপনজন হারানোর কেউ বা অপেক্ষার আক্ষেপে।
৪৯.
নিজেকে এখন আর দয়াবান ভাবতে ভালোলাগে না সম্রাট তাসবীরের।শত্রু’র চারা পানি ঢেলে জীবন্ত রাখার কোন মানে নেই।এর থেকে ভালো একবারে শেকড় সহ উপরে ফেলা।বাহ্যিক কাজ সেরে সম্রাট তাসবীর বন্দিশালায় ফিরেছে সম্রাট সাঈদ তখন কাতর অবস্থায় মেঝেতে পড়ে ছিলেন।দিনে স্বল্প পরিমাণে পানি তাকে দেওয়া হয়।এই স্বল্প পানিতে পরিপূর্ণ ভাবে তৃষ্ণা নিবারণ হয় না তার।এটাও এক প্রকার শাস্তি যার আদেশ দিয়েছেন সম্রাট তাসবীর।বন্দিশালায় ডানে বামে না তাকিয়ে পরাজিত সম্রাট সাঈদের নিকট উপস্থিত হন সম্রাট তাসবীর।

” কেমন আছেন সাঈদ?”

” যেমন রেখেছেন তেমন আছি।”

” আমি মনে করি আপনাকে বেশ ভালো অবস্থায় রেখেছি।তবে আর রাখতে চাইছি না।ইবনুল রাশীদের খোঁজ যেহেতু আপনি জানেন না তাহলে আপনাকে বাঁচিয়ে রেখে আমার কি হবে?”

” এক কথা বলে আমায় বিরক্ত করবেন না সম্রাট তাসবীর।ইবনুল রাশীদ দু’দিন আমার কাছে এসেছিল সাহায্যের আশায় আমি কথা দিয়েছিলাম তাকে সাহায্য করবো।এরপর তার খোঁজ আমি পাইনি সে আর আসেনি।”

” ভালো বেশ ভালো।আপনি কি জানেন আগামীকাল সকালে আপনাকে শূলে চড়ানো হবে?”

চমকে গেলেন সম্রাট সাঈদ।শুষ্ক গলদেশ আরো যেন শুষ্ক হয়ে গেছে।ভয়ে সিঁটিয়ে গেলেন তিনি।তা দেখে আনন্দে হাসলেন তাসবীর।

” রাজ্যের সকলের সম্মুখে আপনাকে শূলে চড়ানো হবে।সবার দেখা উচিত বেইমানির শাস্তি।এরপর কেউ যেন আহমেদাবাদ রাজ্যের সম্রাট তাসবীর কিংবা সিদ্দিকের সঙ্গে বেইমানি করার কথা দুই বার না ভাবে।”

তাসবীর বেরিয়ে গেলেন পাতাল থেকে।আজকের সর্বশেষ কাজ তার আস্তাবলে যাওয়া।একটা সময় ছিল যখন তিনি তার প্রিয় ঘোড়া নিয়ে পথের পর পথ অতিক্রম করে ছুটতেন।বেশ কয়েকদিন হলো প্রিয় ঘোড়াটির সঙ্গে দেখা হয় না।এই ব্যস্ত জীবনে তার স্বাদ আহ্লাদ গুলো যেন চাপা পড়ে যাচ্ছে। যে কবিতার প্রেমে মূর্ছা গিয়ে শেহজাদীকে বশে এনেছিলেন সেই কবিতাও এখন আর সম্রাটের মুখে শোনা যায় না।মানব এমন কেন?রাজ্য দখলে তাদের এত স্পৃহা কেন?রাজ্য দখলে তারা কি পায়,ধন,দৌলত,ঐশ্বর্য এরপর সেই আবার আরেক সম্রাটের আগমন রাজ্য দখল পরাজিত জীবন এভাবেই চলতে থাকে।জীবনের রেষারেষির এক পর্যায়ে হারিয়ে যায় ইচ্ছে,আনন্দ,স্বপ্ন,শখ,আহ্লাদ।
আস্তাবলে সারি সারি নানান জাতের নানান রঙের ঘোড়া।এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা ঘোরাটির দিকে চোখ আটকে যায় তাসবীরের।এগিয়ে এসে ঘোড়াটির গলায় আদুরে হাত বুলিয়ে দেয়।তার দু’চোখে আনন্দেরা উপরে পড়ছে।ঘোড়াটি তাসবীরের ছোঁয়া পেয়ে শব্দ করে উঠে এর অর্থ সে তার মনিবকে চিনতে পেরেছে।

” কিরে তারিম আমার আদরের বাচ্চা ভালো আছিস?কি ভাবছিস তোকে ভুলে গেছি?ভুলিনিরে অপেক্ষা কর আমরা আবার লাগামহীন ছুটবো শুধু অসময় কাটিয়ে উঠতে পারলেই হয়।”

সম্রাট তাসবীর নিজের কক্ষে ফেরার আগে নিজের পিতাকে একবার দেখে আসেন।এটা অবশ্য তার প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য নিয়ম।বর্তমানে আবু সিদ্দীক বেশ সুস্থ হয়েছেন।এখন তিনি উঠে বসতে পারেন।মুখ ফুটে কথা বলতে পারেন যদিও মাঝে মাঝে কথা মিলিয়ে আসে তবুও আগের পরিস্থিতি থেকে তিনি বেশ ভালো হয়ে উঠেছেন।পুত্র তাসবীরকে আসতে দেখে এক গাল হাসলেন আবু সিদ্দীক।

” না চাইতেও রাজ্যের দায়িত্ব নিয়েছো তোমার উপর চাপ পড়ছে নিশ্চয়ই।”

” যা করছি ভালোবেসে করছি পিতা চাপ পড়বে কেন।”

” আমরা একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে আশা রাখছি শুনলে তুমি খুশি হবে।”

” আপনাদের সিদ্ধান্তের কথা যানতে চাই।”

” দুইদিন বাদে তোমার আর আরওয়ার বিয়ের দিন ধার্য করেছি।আরওয়াকে তুমি বিয়ে করতে চেয়েছো আগে কিন্তু….. যাই হোক এখন তো সময় এসেছে।”

” মাফ করবেন পিতা আপনাদের মতামতে আমি সম্মতি দিতে পারছি না।”

” কিন্তু কেন?”

” আগে ইবনুল রাশীদের ব্যবস্থা করি তারপর।”

ছেলের মুখের কথায় সুপ্ত মেজাজ চড়া দিয়ে উঠলো সম্রাজ্ঞী বিনিতার।

” এসব এখন রাখো তাসবীর।আরওয়া তোমার প্রতি ত্যক্ত বিরক্ত।যতটা ভালোবেসেছিল ততটা ঘৃণা করবে তোমায়।”

” আমিও দেখতে চাই ঘৃণার জোর বেশি নাকি ভালোবাসার। ”

” চুপ করো।আলোর কথা তুমি তাকে জানাওনি তার পরিবার বেঁচে আছে এ কথাও জানাও নি কিন্তু কেন?”

” ভেবে রেখেছি সুযোগ সময়ে জানাবো।কিন্তু আপনি তার আগেই…”

কথা শেষ করার আগে কুটিল হাসলো তাসবীর।মায়ের চতুরতা সে ধরে ফেলেছে, আরওয়ার সঙ্গে তার মায়ের সাক্ষাৎ করিয়েছে বিষয়টা অজানা নয় তাসবীরের।

” মেয়েটাকে কি অসুস্থ করে দিতে চাও?বড্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল তাই সবটা জানিয়েছি। ”

” আমার সিদ্ধান্ত আমিও জানিয়েছি।”

” তোমার সিদ্ধান্ত আমরা গ্রহণ করলাম না।আগামী শুক্রবার বিয়ে হচ্ছে প্রস্তুতি নাও।”

৫০.
গুনগুনে কান্নার শব্দ অলিন্দ থেকেই আসছে।এ কক্ষে একমাত্র শেহজাদী আছে সুতরাং কাঁদলে শেহজাদী কাঁদবেন।বাবা মা জীবিত আছে জেনেও এত কান্নার কি হলো?এখন তো অন্তত হাসতে পারে এই মেয়ে।ভাবনার অতলে নিজেকে না হারিয়ে অলিন্দে প্রবেশ করেন তাসবীর।রজনীর শীতল বাতাসে তার শরীরে হিম ধরে গেছে আর আরওয়া কি না এখানে বসে কাঁদছে।বেশ রাগ লাগলো তাসবীরের।নিজের রাগটাকে প্রাধান্য দিয়ে হুংকার ছাড়লো মুহূর্তে

” এত সাহস কোথায় পেলেন শেহজাদী?আপনাকে ঘুমাতে বলা হয়েছিল আপনি আমার আদেশ অমান্য করে অলিন্দে বসে আছেন!”

ভেজা চোখ তুলে তাকালো আরওয়া।তাসবীরের প্রতি বর্তমানে তার দুরকমের অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে।এক মায়া অপরটি বিতৃষ্ণা।

” চোখ মুছে কক্ষে আসুন আরওয়া।”

” আমার একটা প্রশ্ন ছিল।”

” বলুন।”

” সম্রাট সাঈদকে শূলে চড়ানোর সিদ্ধান্ত বাতিল করলে হয় না?”

” কেন মায়া লাগছে?”

” অবশ্যই লাগছে।”

” এ শেহজাদীকে আমি চিনি না আর চিনতেও চাই না।আমি যাকে চিনি সে বর্ব/র, হিংস্র,অহংকারী,রক্তপিপাসু।”

” ভুলে যাবেন না সম্রাট তাসবীর ভালোবাসা,মায়া,দরদ এসব অনুভূতির সন্ধান আপনি আমায় দিয়েছিলেন।”

” হ্যাঁ দিয়েছিলাম।তবে কোন বেইমান বি-শ্বাসঘা-তকের জন্য নয় এসব দেখাতে নয়।”

” সম্রাট সাঈদকে বাঁচিয়ে রাখুন অন্তত আমার অনুরোধে।”

তাচ্ছিল্যে হেসে উঠলেন সম্রাট তাসবীর।ডান হাত এগিয়ে শক্ত হাতে বাহু টেনে উঠে দাড় করালেন শেহজাদীকে।তাসবীরের হাসি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।এ হাসি রেখাতে নেই কোমলতা।

” আমি সেই পুরুষকে কখনোই বাঁচিয়ে রাখবো না যে পুরুষের প্রতি আমার প্রাণ প্রিয় বেগমের দরদ উতলে উঠে।”
#চলবে____

#বিধুর_রজনী
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ২৩]
__________________
৫১.
ঘোর অন্ধকার মিশ্রিত রজনী কাটিয়ে প্রত্যুষের সূর্যের আলোর দেখা মিলেছে।নতুন প্রভাতের সূর্যকে নিয়ে শুরু হয়েছে প্রত্যহ কার্য দিবস।তবে আজকের দিনটি একটু ভিন্ন ঠেকেছে সম্রাট তাসবীরের নিকট।সম্রাট পদ লাভ করার পর এই প্রথম তিনি একজন অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন এবং তা পূর্ণ করার কার্যক্রম চলছে।
শূল হচ্ছে কোন সূচালো দণ্ড বা বর্শা।কোন অপরাধী মানুষকে শূলে চড়াতে প্রথমে তাকে দণ্ডটির উপর বসিয়ে দেয়া হয়।অপরাধী মানুষটা নিজের ওজনের কারণে ধীরে ধীরে দণ্ডটি তার পায়ুপথ দিয়ে ঢুকে মুখ পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যেতো।অনেক যন্ত্রণা ভোগ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো মানুষটি।
শাস্তির যত মাধ্যম আছে তার মধ্যে শূল দণ্ড মাধ্যমটি তীব্র যন্ত্রণাদায়ক।কথিত আছে শূলের মাধ্যমে মৃত্যু হতে কখনো কখনো ২-৩ দিন সময় লাগতো।সবচেয়ে আলোচিত এই মাধ্যমটি যুদ্ধের সময় বিদ্রোহ দমন, বিশ্বাসঘাতক বা তার সহযোগীদের শাস্তি এবং সামরিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করার শাস্তি হিসাবে এটি ব্যবহৃত হতো। নিঃসন্দেহে এটি ছিল ভয়াবহ ও বর্বরোচিত শাস্তি।বিশ্বাসঘাতকতার হেতু নিয়ে শূলে দণ্ডিত হলো প্রাক্তন সম্রাট সাঈদ।
খোলা বিস্তার মাঠে সারি সারি প্রজারা জড়ো হয়েছে।বহুদিন পর তারা আজ একজন বিশ্বাসঘাতকের মৃত্যুদণ্ড দেখবে।সম্রাট সাঈদকে উপস্থিত করা হয়েছে তার থেকে অদূরে দাঁড়িয়ে আছেন সম্রাট তাসবীর।তিনি বাইরে থেকে অতি সাধারণ মুখ ভাব ধারণ করলেও ভেতরটা তার নিংড়ে যাচ্ছে।মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন সম্রাট সাঈদকে শেষ বারের মতো তার ইচ্ছা প্রকাশের সুযোগ দেওয়া হবে।তিনি যদি সিদ্ধান্ত নেন তিনি শুধরে যাবেন তবে তাকে মুক্তি দেওয়া হবে।
সময় গড়াতে লাগলো জ/ল্লা/দ এসে ইতোমধ্যে হাজির হয়েছে।সবাই অপেক্ষায় আছেন সম্রাট তাসবীরের হুকুমের কখন তিনি শূলে চড়ানোর ঘোষণা দেবেন।সম্রাট তাসবীর এগিয়ে গেলেন সম্রাট সাঈদের নিকট।রুষ্ট পুষ্ট পুরুষটা বন্দিশালায় অনাহারে শুকিয়ে গেছে।বড্ড মায়া লাগলো তাসবীরের।তবে বাইরে থেকে তিনি তা প্রকাশ করলেন না।

” কেমন লাগছে সম্রাট সাঈদ?আপনার অনুভূতি কি?”

“অনুভূতি শূন্য অবস্থায় পড়ে আছি।”

” আপনার সর্বশেষ একটি ইচ্ছে আমার কাছে প্রকাশ করুন আমি তা পূরণের ব্যবস্থা করবো।”

” সত্যি করবেন?আমার জানা মতে সম্রাট তাসবীর কথার খেলাপ করেন না।”

” সময় অপচয় আমি পছন্দ করি না।যা জানতে চাইছি উত্তরদিন।”

” আমি শেহজাদী আরওয়া নূরের গোলাপির পাপড়ির ন্যায় কোমল ওষ্ঠে দীর্ঘক্ষণ চুম্বন করতে চাই সম্রাট।যার জন্য জীবননাশ হলো তার সান্নিধ্যে না পেয়ে মৃত্যু গ্রহণ করার স্বাদ পাব না।”

আশ্চর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে হতবাক তাসবীর।তার বুকের বা পাশটায় কেউ যেন ছু;রির সাহায্যে ফালা ফালা করে দিয়েছে।চামড়ায় জ্বালিয়ে দিয়েছে আগুন।মায়া দয়াকে কবরে রেখে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তাসবীরের।আরক্ত নয়নে তাকিয়ে রইলো সম্রাট সাঈদের নিকট।তাতে সম্রাট সাঈদের কোন হেলদোল নেই তিনি গা দুলিয়ে হাসছেন।

“জল্লাদ।”

” আদেশ করুন সম্রাট।”

” আপনি আপনার কাজ শুরু করুন।আমি চাই আজকের রজনীতে তার দেহ থেকে প্রাণ বেরিয়ে যাক।এই আহমেদাবাদের প্রতিটি মানব মানবী দেখেনিক বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি।আমি আমার পিতার মতো শত্রুকে বেঁচে থাকার সুযোগ দেব না যার পরিণতি পরবর্তীতে ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।এমন পরিস্থিতি আমি ভবিষ্যতে চাই না।”

চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে সম্রাট সাঈদের শা/স্তির কথা।অনন্য রাজ্যের সম্রাটগন সম্রাট তাসবীরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।দেখতে শুনতে যেমন আকৃষ্ট তেমনি তার রাজ্য নিয়ে তার বিচক্ষণতা প্রশংসনীয়।সম্রাট সিদ্দীকের পুত্র সম্পর্কে এর আগে কেউ খুব বেশি অবগত না থাকলেও বর্তমানে ক্রমশ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে অল্প বয়সী এই পুত্রের সুনাম।এই পুত্র রাজ্য দখলে রেখে পিতার সম্মান ধরে রাখবে এবং মুখ উজ্জ্বল করবে।কিন্তু এসবে কোন আগ্রহ নেই তাসবীরের।তার কাছে তার যাযাবর জীবন শ্রেয়।তার ঘোড়া তারিমকে সাথে নিয়ে ছুটে চলা,কবিতার সাথে নিজের আলাপন ছবি আঁকা সব মিলিয়ে তিনি বড্ড অনুভব করেন আগের লাগামহীন জীবনটা। এই সম্রাট নামক জীবন থেকে তিনি পালিয়ে গেলে বাঁচেন।

সম্রাট সাঈদ সন্ধ্যা নামতে মৃত্যু বরণ করেন।যেহেতু আগে থেকেই তার শরীরটা দুর্বল ছিল তাই শূলে চড়ানো হলে কম সময়ে মৃত্যুর মুখে পতিত হন।শেহজাদী আরওয়া নূরের চোখের পানি আজ বাধ মানছে না।তিনি ক্রমশ কেঁদেই চলেছেন।দুর্বল শরীরটা এতটা ধকল সইতে না পেরে মূর্ছা গেছেন।লতা এবং সম্রাজ্ঞী বিনিতা নিজেদের চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি।শেহজাদীর চেতনা ফিরলেও তার কান্না কিছুতেই থামছে না।অপরদিকে এই বিষয়ে কিছুই জানেন না সম্রাজ্ঞী শাহাবা এবং ভাই ইদ্রীস।তারা সাঈদের মৃত্যুর খবর পেলেও শেহজাদীর কোন খবরাখবর পাননি।এ বিষয়ে সম্পূর্ণ আড়াল করেছেন বিনিতা।

৫২.
সারাদিনের ঝড় ঝামেলা শেষে তাসবীর নিজের কক্ষে ফিরেছে।আজ মন মেজাজ এতটাই রুক্ষ নিজের কক্ষে ফেরার আগে একটি বারের জন্যেও পিতার কক্ষে যায়নি।কানের কাছে যেন বারবার প্রতিধ্বনি হচ্ছে সম্রাট সাঈদের কথাগুলো।প্রিয়তমার নিকট অন্য পুরুষের লালসা ভেতরটা নাড়িয়ে তুলছে তাসবীরের।অবশ্য সম্রাট সাঈদের সাথে বিবাহের কথাবার্তা পাকাপোক্ত হয়েছিল অনেক আগে।সেই হিসেবে শেহজাদীর জন্য সম্রাট সাঈদের ব্যাকুলতা থাকতেই পারে।কিন্তু এসব ভাবনা ভেবেও নারাজ তাসবীর।লতার নিকট হতে শেহজাদীর মূর্ছা যাওয়ার বিষয়টা অবগত হয়ে আরো রেগে গেলেন তাসবীর।অন্য পুরুষের জন্য এত মায়া!এত ভালোবাসা!এসব আর সহ্য হচ্ছে না তাসবীরের।ভালোবাসা নামক ইন্দ্রজালের কথা শেহজাদীর মনে প্রাণে অনুভব করা শিখিয়েছিল তাসবীর।বর্ব/র শেহজাদীর মনে এক দানা শস্যের ন্যায় ভালোবাসার বৃক্ষ রোপণ করেছিল তাসবীর।আর সেই শেহজাদী এখন অন্যর জন্য ভালোবাসার শেকড় বাড়িয়েছেন!তাসবীর কখনো হিংসে,লোভ,অহংকার করেননি।কিন্তু জীবনের এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে তিনি হিংসে করছেন।আরওয়ার জন্য তার বড্ড হিংসে হয়।তিনি কখনোই সহ্য করতে পারবেন না আরওয়া তাকে ব্যতীত অন্যর জন্য ব্যকুল হয়।এছাড়াও তাসবীর অনুভব করেছেন তিনি লোভে পড়েছেন।নারী লোভ যা বড্ড ভয়াবহ লোভ।আরওয়াকে পাওয়ার তীব্র লোভ তার মন মস্তিষ্ক অচল করে তুলছে।এই রমণী তাকে হয়তো উন্মাদ করা ব্যতীত স্থির হবেন না।অবশ্য ইতোমধ্যে তাসবীর উন্মাদ।হয়ে উঠেছেন যদিও তার উন্মাদনা প্রকাশ হয় না। রইলো বাকি অহংকার, তিনি সেদিনই অহংকার করবেন,বড়াই করবেন যেদিন আরওয়া তার জীবনের সমস্ত ভালোলাগা,ভালোবাসা উজাড় করে দিবেন তার নিকট।

” তাসবীর।”

মায়ের কন্ঠে নিজের ধ্যান ভাঙ্গিয়ে গম্ভীর মুখে পেছনে ঘুরে তাকালেন তাসবীর।

” কিছু বলবে মা?”

” আরওয়াকে দেখে আসতে পারো।মেয়েটার বেহাল দশা।আমি কবিরাজ মশাইকে খবর দিয়েছি তিনি এসে পড়বেন।”

” কেন কি হয়েছে?”

” লতা তোমায় কিছু বলেনি?”

” হুম বলেছিল।এখন কি হয়েছে?”

” মাথা যন্ত্রণায় ছটফট করছে।”

” তাকে বলে দিও এত কম কাঁদলে চলবে না সারা রাত যেন কাঁদে।”

ছেলের তেজি কথার প্যাঁচ ধরে ফেললেন বিনিতা।ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে এলেন তাসবীরের সম্মুখে।

” আরওয়াকে দেখতে যাওয়া তোমার উচিত ছিল।”

” উচিত অনুচিত আমাকে শেখাতে আসবে না।”

” দিন দিন তুমি এমন হয়ে যাচ্ছো কেন?পাষাণের ন্যায় আচরণ বন্ধ করো তাসবীর।”

” আমি পাষাণ?যদি সত্যি কারের পাষাণ হতাম এতক্ষণে আরওয়ার দু’চোখ উপরে ফেলতাম।আমার ভাবী স্ত্রী অন্য পুরুষের জন্য অশ্রু ঝরাচ্ছেন তাও কি না…”

থেমে গেল তাসবীর।অতিরিক্ত রাগ দমনে ব্যর্থ হয়ে লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে তার মুখশ্রীতে।বুকটায় কেমন হাহাকার করছে এমন যন্ত্রণা তার আগে কখনোই হয়নি।এই যন্ত্রণা এমন অদ্ভুত কেন?

” মা আমার এসব সহ্য হচ্ছে না।আমার গভীর নিদ্রার প্রয়োজন।নিজের জন্য ইদানীং সময় দেওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে।”

” আর কিছুটা সময় অপেক্ষা করো তাসবীর আগে যেমন শেহজাদীকে নিজের মায়ার ডোরে বেঁধে নিয়েছো।আশা করি বিবাহের পর তুমি তোমার রাগ,জেদ লুকিয়ে মায়া, মহাব্বাত,বিশ্বস্ততা দিয়ে শেহজাদীকে আগের ন্যায় ফিরিয়ে আনবে।তবে তার আগে শেহজাদীকে দেখে এসো এটা আমার অনুরোধ নয় তাসবীর এ আমার আদেশ।”

কবিরাজ মশাইয়ের পথ্য গিলে নিজেকে স্থির রেখেছে শেহজাদী।তার এখন ঘুমের প্রয়োজন।মাথাটা যন্ত্রণায় ছিড়ে যাচ্ছে।লতা পাশে বসেই মাথা টিপে দিচ্ছিলো।লতা সম্রাট তাসবীরকে কক্ষে প্রবেশ করতে দেখে নত মস্তকে কুর্নিশ জানিয়ে বেরিয়ে গেল অতিদ্রুত।শেহজাদী চোখ মেলে তাসবীরকে দেখে উঠে বসলেন।
” কেমন আছেন আরওয়া?”

” ভালো থাকতে দিয়েছেন?”

এক সমুদ্র আক্ষেপ নিয়ে কথাটি বললো শেহজাদী।তাতে অবশ্য অবজ্ঞায় হাসলেন তাসবীর।

“আপনার ঠোঁটে হাসি লেগে আছে অদ্ভুত তাসবীর।সম্রাট সাঈদকে আরেকবার সুযোগ দিলে কি ক্ষতি হতো আপনার?আমার ভাই ইবনুল রাশীদ যে কাজ করেছেন তার শাস্তি আপনি দেবেন।তাকে কে/টে টুকরো টুকরো করে বনের শেয়ালকে খাওয়ালেও আমার আফসোস হবে না।অথচ সম্রাট সাঈদ যা করলেন তাতে আমার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।তিনি আমাকে পাওয়ার উছিলায় এই নোংরা খেলায় যোগ দিয়েছিলেন।তার মৃত্যুতে আমার নিজের কাছে নিজে কতটা ছোট হচ্ছি আপনি ভাবতেও পারছেন না তাসবীর।মানুষ মাত্র ভুল আর তাকে সে ভুল শুধরে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব।আপনি আমার ভুল শুধরে সঠিক পথে এনেছেন অথচ।”

থেমে গেলেন শেহজাদী।পাঙ্কের পাল্লায় গা এলিয়ে বসলেন হতাশার শ্বাস ছেড়ে তার পাশে বসলেন তাসবীর।

” আমায় আপনি বিশ্বাস করেন শেহজাদী?”

” করি।”

” তাহলে তো সত্যটা আপনাকে জানাতে হয়।”

” কি সত্য?”

” আজ সকালে আমি ভেবে রেখেছিলাম সম্রাট সাঈদকে আরেকটা সুযোগ দেব।তিনি যদি তার ভুল শুধরে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন তবে আমি তাকে মুক্তি দিব এবং তেলিকোনা রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়ার মন স্থির করি।শূলে চড়ানোর আগ মুহূর্তে তার কাছে যানতে চেয়েছিলাম তার শেষ ইচ্ছের কথা। আমি ভেবেছিলাম তিনি অন্তত বলবেন নিজেকে শুধরানোর কথা কিন্তু তিনি যা বলেছেন তা মুখ আনতেও আমার শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যায়।”

সম্রাট তাসবীর দুই চোখের পাতা এক করলেন।শেহজাদী কৌতূহল চোখে তাকালেন তার দিকে।

” কি হলো বলছেন না যে আমি শুনতে চাই।”

” তিনি বলেছেন, আমি শেহজাদী আরওয়া নূরের গোলাপির পাপড়ির ন্যায় কোমল ওষ্ঠে দীর্ঘক্ষণ চুম্বন করতে চাই সম্রাট তাসবীর।যার জন্য জীবননাশ হলো তার সান্নিধ্যে না পেয়ে মৃত্যু গ্রহণ করার স্বাদ পাব না।”

শেহজাদী হতবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন তাসবীরের নিকট।গলাটা কেমন শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে।

” এমন ইচ্ছে যে তার হবে আমি তা কস্মিনকালেও ভাবিনি।তার বুকে দম আছে বলতে হয়।আচ্ছা বিষয়টা যদি উলটে যায় কোন রাজ্যের শেহজাদী যদি আপনার নিকট এসে প্রকাশ করেন তিনি আমাকে চায় এবং আপনি যেন আমাকে মুক্তি প্রদান করেন।তাহলে আপনি কি করবেন।”

তাসবীরের কথা শেষ হতে শেহজাদী দাঁতে দাঁত খিচালেন।তার শরীরের শিরায় উপশিরায় কেউ যেন রক্তের সহিত বিষ মিশ্রিত করেছে।তীব্র জ্বালায় ছটফটিয়ে উঠলেন তিনি।দ্বিতীয় বারের ন্যায় করে বসলেন দুঃসাহসিক কাজ, খুবলে ধরলেন তাসবীরের পাঞ্জাবির গলার অংশ।

” আপনার ভাগ আমি কাউকে দিতে পারবো না তাসবীর।সে যে রাজ্যের যত শক্তিশালী সম্রাটের কন্যা হোক তাকে হ-ত্যা করতে কখনো পিছপা হবো না।আমি তরবারি ছেড়েছি মানে এই নয় যে তরবারি চালনা ভুলে গেছি।আপনাকে পাওয়ার দাবি নিয়ে যে আসবে তাকে তিরোহিত করতে দু’বার ভাববো না।প্রয়োজনে আপনার মৃত্যু কামনা করবো তবুও আপনাকে ছাড়তে আমি অপারগ।আপনার মৃত্যুর পর আপনার কবরের পাশে আমার সমাধি হবে তবুও আপনার পিছু ছাড়ছি না আবু তাসবীর।”

দেদারসে তেজীয়ান কথার ঘোরে হারিয়ে গেলেন তাসবীর।বিস্ময়ে হতবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন তিনি।বুকটা কেমন ধড়ফড় করছে।শিরদাঁড়া বেয়ে কেমন শীতল বাতাসের স্রোত বইছে।এ অনুভূতি কেমন ভাষায় প্রকাশ করতে পারবেন না তাসবীর।এমন জেদ,তেজ মিশিয়ে কেউ কখনো তাকে চাইনি।অজান্তে হেঁসে উঠলেন তাসবীর।শেহজাদীর রাগ কমলো না।তিনি তাসবীরকে ছেড়ে গা এলিয়ে শুয়ে পড়লেন পালঙ্কে।

” এখন কক্ষ ছেড়ে বের হন তাসবীর। আর একদিন বাদে শুভ বিবাহ আমি চাই না আমাদের বিয়েতে কোন ক্রুটি থাকুক।আমার ঘুমাতে হবে।শুভ রাত্রি”

একজন সম্রাটকে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে বলছে এই সামান্য কন্যা কত বড় সাহস!এটা তো সম্রাট তাসবীরের মহল তার যখন ইচ্ছে সে সেখানে থাকতেই পারেন অথচ এই মেয়ে বলে কি।অনমনে হাসলেন তাসবীর।শেহজাদীর নিকট ঝুঁকে নির্দ্বিধায় কপালে শব্দ করে চুমু খেলেন।

” এটা কেন দিলেন?”

” আদর করতে কারণ লাগে?”

” এখন এত দরদ দেখাতে হবে না।যত দরদ বিয়ের পর দেখাবেন,এখন এসব হজম করার শক্তি আমার নেই।যান নিজের কক্ষে যান তাসবীর।”
৫৩.
অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত শুভক্ষণ এসে পড়েছে।সম্রাট তাসবীর এবং শেহজাদী আরওয়া নূরের বিবাহ কিছুক্ষণ বাদে শুরু হবে।ঘোমটার আড়ালে চুপচাপ আসনে বসে আছেন আরওয়া।তার শরীর প্রচন্ড কাপছে দাঁতে দাঁত লেগে কেমন ঠকঠক শব্দ হচ্ছে শেহজাদীর অস্থির অবস্থা বুঝতে পারেন লতা।ঘোমটার আড়ালে ঢেকে রাখা শেহজাদীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেন,

” বলেছিলাম না শেহজাদী আপনার জন্য উত্তম কাউকে পাঠাবেন আল্লাহ।দেখলেন তো মিলে গেছে।”

শেহজাদী নিশ্চুপ জিভের সাহায্যে ঠোঁট ভিজিয়ে নেন।সামনে উপস্থিত তার পিতা সম্রাট আব্বাস।আব্বাসকে আজ সকালে বন্দিশালা থেকে মুক্ত করা হয়েছে। আপনজনদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হলেও তার সাথে সাক্ষাৎ করেননি আরওয়া।এমনকি পিতার দিকে চোখ তুলে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করেননি।তার কান্ডে আব্বাস রাশীদ ভালোভাবেই বুঝেছেন মেয়ের অভিমানের পাল্লা বেশ ভারী হয়েছে।ফুফুমা আসমা আরওয়ার বিয়েতে উপস্থিত হলেন না।তিনি কক্ষে বসে একের পর এক লানত দিয়ে যাচ্ছেন আরওয়াকে।ইদ্রীসের চোখে মুখে খুশির জোয়ার এতদিনে আরওয়া তার উত্তম জীবন সঙ্গী পেতে চলেছে।
সবার সম্মতিতে ঘরোয়া আয়োজনে সুষ্ঠভাবে বিয়ে সম্পূর্ণ হয় আরওয়ার।কবুল বলার এক পর্যায়ে সবাই যখন মোনাজাত শেষ করে মিষ্টি মুখে ব্যস্ত তখন তাসবীর উঠে এসে আরওয়ার পাশে বসেন।সবার অগোচরে তার বেগমের হাত শক্ত করে ধরে বলেন,

” এখন আপনি আমার,সম্পূর্ণ আমার,আমার প্রাণপ্রিয় বেগম।”

আহমেদাবাদ রাজ্যের মহলে আসার পর থেকে কোনদিন তাসবীরের কক্ষে প্রবেশ করেননি আরওয়া।সাদামাটা ঘর‍টা বেশ সাবলীল সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।পালঙ্কের আশেপাশে চারদিকে সাদা আর লাল গোলাপে ভরতি।ফুলদানিতে সাজানো হয়েছে বাগানের অনন্য সতেজ ফুল।এত এত ফুলের সুমিষ্ট ঘ্রাণে মাথা ধরে এলো আরওয়ার।টিমটিমে প্রদীপের আলোয় বুকটা ধুকধুক শব্দ যেন নিজেও শুনতে পারছেন।তাসবীর পিতলের দ্বার ঠেলে প্রবেশ করেন কক্ষে।ঠোঁটে লেগে আছে তার রাজ্যের হাসি।শেহজাদী সাদা ভারী পোশাকটা ঠেলেঠুলে কসরত করে পালঙ্ক ছেড়ে নামলেন।তাসবীর দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে তার নিকট।

” ওত পায়ে টায়ে ছুঁবে না খবরদার।”

তারপরেও আরওয়া বাঁধা মানলেন না।ছুঁয়ে দিলেন তাসবীরের পা।সময় পেরিয়ে গেল কিছুক্ষণ দুজনে নামায শেষ করে শেহজাদী পুণরায় পালঙ্কে বসলেন।মেয়েটা আজ টু শব্দ করছে না।ভয়ে তার শরীরের কাঁপন অনুভব করছিলেন তাসবীর।বিস্তৃত ঘোমটা সরিয়ে আরওয়ার মুখ টেনে কপালে গাঢ় চুম্বন করলেন।আরওয়া তখন অনুভব করছিলেন তাসবীরের ছোঁয়া।

” এতদিন কিছু বলিনি তবে এখন আর চুপ রইবো না এর জবাব আমি চাই আরওয়া।কোন সাহসে আপনি আপনার দিঘল কেশ কাঁটলেন?”

তাসবীদের হুংকারে কেঁপে উঠলেন আরওয়া।ভয়ে তটস্থ হয়ে চোখ তুলে তাকালেন তাসবীদের নিকট।

” কি হলো জবাব দিচ্ছেন না কেন?”

” র রাগে অন্ধ হয়ে কেটেছি।সেদিন আপনি আসেননি আমি কতটা কষ্ট পেয়েছি জানেন।”

” আমি সবটা শুনেছি লতার কাছ থেকে।তাই বলে আপনি কত সাধনার কেশ কাটবেন!আমি পছন্দ করেছি আপনার এই কেশ তাই তার জেদ মেটালেন।”

” বলছি তো ভ..ভুল হয়েছে আমায় ক্ষমা করুন।”

” অন্যর উপর জেদ মেটাতে কখনো নিজের পছন্দের কিছুতে আঘাত করবেন না আরওয়া।মাফ আমি একবার করি দ্বিতীয় বার না।”

মাথা দুলালেন আরওয়া।পরিস্থিতি কঠোর হতে দেখে কথা ঘুরিয়ে বলেন,

” এসব কথা ছাড়ুন একটা কবিতা বলুন তাসবীর।সেই রজনীর কথা মনে পড়ে আমাদের প্রথম দেখা।”

” হুম সেই রজনীতে আপনার বিধুর মুখখানি দেখে বিবস হয়েছিলাম।আর নিজেকে ফেরাতে পারিনি।যাদুমন্ত্রে আমাকে অসাড় করেছিলেন বলেই আজ এখানে আপনি।এতকিছুর পরেও আপনাকে ছাড়তাম না পরিস্থিতি যেমনি হতো আপনি আমার চোখের সীমানায় থাকতেন আরওয়া।”

লজ্জায় মাথা নত করলেন আরওয়া।হাতের সাহায্যে জামা খুটে খুটে তিনি যেন লজ্জা নিবারণ করছেন।তবে মুহুর্তে পালটে গেল তাসবীসের মুখশ্রী।কেমন মলিন হয়ে উঠলো ছেলেটার চেহারা।হঠাৎ আলোর কথা ভাবতে সবটা ধোঁয়ায় মিলিয়ে গেল।বোনটা আজ বেঁচে থাকলে কত আনন্দ করতো।

” আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন আরওয়া।সম্পূর্ণ সুস্থ আপনি নন।কাল সকালে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।”

” আপনার কি হয়েছে গলাটা এমন ঠেকছে কেন?”

” ক কিছু হইনি আমার বিশ্রামের প্রয়োজন দীর্ঘ বিশ্রাম।আমার কোথাও যেন শান্তি নেই,ইদানীং নিজের শান্তি খুঁজতে খুঁজতে আমি কাতর।আপনি আমার ঠাঁই হয়ে যান আরওয়া বাইরের বিনাশকারী জগৎ থেকে আপনি আমার শখের আদরের আরেকটা জগৎ যেখানে আমি আমার ভরসা,বিশ্বাস,আস্থা খুঁজে পাবো।”

” আপনি অস্থির হচ্ছেন কেন তাসবীর?ঘুমিয়ে পড়ুন আপনি পরিশ্রান্ত।”

“হাবভাব এমন আপনি যেন মহা সুস্থ।

হঠাৎ তাসবীরের ধমকের কথায় চমকে গেলেন আরওয়া।তিনি অবাক চোখে তাকাতে তাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে তাসবীর।ভারী জামাটা নিয়ে তাকে বুকে আগলে শুয়ে পড়েন মুহুর্তে ।

” ভয় পাবেন না আরওয়া কিছু হবে না।”

তাসবীর বালিশে মাথা ফেলে আরো শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে কুন্ডলী পাকানো নরম দেহখানির মেয়েটাকে।ততক্ষণে আরওয়ার শ্বাস নিতে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে কিন্তু সেই কথা তাসবীরকে মুখ ফুটিয়ে বলার সাহস পাচ্ছেনা।মানুষটা তাকে এতটাই জোরে ধরেছে মনে হচ্ছে আরওয়া কোথাও যেন পালিয়ে যাবে তাই সাবধানী হাতে তাকে বন্দি করেছে।আরওয়ার ছটফটানো ভাব বুঝতে পেরে তাসবীর চোখ বন্ধ অবস্থায় বলে,

” অভ্যস করেনিন।এভাবেই ঘুমাতে হবে প্রতিদিন।শুভরাত্রি ননি।”

” ন ননি মানে?”

” ছুঁতেই কেমন গলে যাচ্ছ।তাইতো ডাকলাম ননি।”

তাসবীর হাসে আরওয়া তখন চুপচাপ তাকিয়ে থাকে তার পানে।ধীরে ধীরে তাসবীরের শ্বাস কেমন ঘন হয়ে আসছে আরওয়া বুঝতে পারলো তাসবীর ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে।
#চলবে___