বিধুর রজনী পর্ব-২৬

0
211

#বিধুর_রজনী
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ২৬]
___________________
যেখানে আপন মানুষের কাছে প্রতারিত হতে হয় সেখানে পর মানুষকে বিশ্বাস করা যেন বিলাসিতা আরওয়ার কাছে।তবুও চোখের পর্দা ফেলে কাউকে যদি বিশ্বাস করতে হয় আরওয়া তাসবীরকে করবে।এই মানুষটাকে অবিশ্বাস করা মানে তার কাছে নিজের বিবেকের সাথে প্রতারণা করা।পালঙ্ক ছেড়ে অলিন্দে উপস্থিত হন সম্রাজী আরওয়া।মনের অস্থিরতা ক্রমশ বেড়ে চলেছে তাসবীর কখনো তার সাথে ছলনা করবেন না এ বিশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্থির রাখলেন।লতা তখন তার সম্রাজীকে খুঁজতে খুঁজতে অলিন্দে উপস্থিত হয়।

” হিম বাতাসে অলিন্দে কি করছেন আপা।”

পেছনে চমকে তাকালেন সম্রাজী গলা খেঁকিয়ে বসে পড়েন পাশে থাকা আসনে।

” আপনাকে এমন অস্থির লাগছে কেন আপা?”

” পিতার মৃত্যুর রহস্য যে আমায় ভাবিয়ে তুলছে লতা।”

” ভাববেন না আপা সময় হলে ঠিকি জানবেন সবটা উপর ওয়ালার হুকুম।”

” একটা প্রশ্ন করি কাউকে বলবে না তো?”

” আজ্ঞে না।”

” সম্রাট তাসবীর কে তোমার সন্দেহ হয়?আমার পিতার মৃত্যুর পেছনে কি তার হাত থাকতে পারে?”

লতা আশ্বর্যান্বিত হলেন।পিলে চমকে তাকালেন আরওয়ার পানে।

” ছিহ ছিহ ছিহ এমন ভাবনা আসার আগে আমার মৃত্যু হোক।”

” এ কথা বলছো কেন লতা?”

” আপনি কী সম্রাটকে অবিশ্বাস করতে চাইছেন?”

” মোটেও না।কিন্তু…. ”

” বিশ্বাসের মাঝে অবিশ্বাসের ফাটল তৈরি করবেন না আপা।না হয় যে আপনার সুখে ভাটা পড়বে।”

৬২.
জীবনের চলমান গতির যে তাল সবটাই বর্তমানে বেতালে পরিণত হয়েছে সম্রাট তাসবীরের।জীবনে পরিপূর্ণতার ছোঁয়া পেতে গিয়ে বারংবার অপরিপূর্ণ ঘোলাটে হয়ে উঠছে।এই তো কিছুক্ষণ আগের কথা ভাবতেই গা শিউরে উঠে তার।পাশে বসে হাউমাউ শব্দে কাঁদছে ইদ্রীস রাশীদ।ছেলেটাকে আজ বড্ড বাচ্চা মনে হচ্ছে তার।ততক্ষণে তাসবীর উঠে দাঁড়ালেন একজন সম্রাটের এভাবে ভেঙ্গে পড়লে চলে না তাকে থাকতে হবে পাথরের ন্যায় কঠিন।কিন্তু কঠিন থাকবেন কি করে?যাকে মায়ের স্থানে বসিয়েছে সম্মান দিয়েছে আম্মীজান বলে মায়ার সুরে ডেকেছেন সেই আম্মীজান কিয়ৎক্ষণ আগে এই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছেন।কি সহজ সারমর্ম কয়েক ঘণ্টা আগে বাইরে থেকে তরতাজা মানুষটা চোখের পলকে দেহ থেকে তার রুহ বিদায় নিয়েছে।
সময়টা তখন দ্বিপ্রহর প্রজাদের ভোজন শেষে কক্ষে ফিরে আসেন শাহাবা।শরীরটা খারাপ লাগায় দাসীদের পানি দিতে বলেন।পানি পান করতে শরীরে ভালো লাগার পরিবর্তে হাঁসফাঁস দ্বিগুণ বেড়ে যায়।দাসীরা দিশাহীন হয়ে ডেকে পাঠান তাসবীরকে।তাসবীরকে উচাটন হতে দেখে হাত ইশারায় থামিয়ে দেন শাহাবা।

” আমি ঠিক আছি।তাসবীর কোথায় তাসবীর বাবা শুনো।”

” আম্মীজান আমি কবিরাজ ডাকছি আপনি অপেক্ষা করুন।”

” পরে ডেকো আমার কথা শুনো,হায়াত মওত সবটা আল্লাহর হাতে আমার মৃত্যুর পর আমার জীবিত দুই সন্তানেত দায়িত্ব তোমার বাবা”

” এসব কথা এখন উঠছে কেন আম্মীজান।দাসী দ্রুত গিয়ে কবিরাজ মশাইকে ডেকে আনুন।”

একজন দাসী সম্রাটের আদেশ পেয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল।শাহাবা তখন জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে আঁকড়ে ধরলেন তাসবীরের হাত।

” আমার ছেলে মেয়েকে কখনো একা করে দিও না বাবা।আরওয়া তোমায় ভালোবাসে বিশ্বাস করে তাকে কখনো অমর্যাদা করো না।আমার ছোট ছেলে ইদ্রীসকে নিজের ছোট ভাইয়ের চোখে দেখো কখনো সে কোন ভুল করলে তাকে শুধরে দিও।ইদ্রীস তোমাকেও বলছি এটা তোমার মায়ের আদেশ তাসবীরকে কখনো আসম্মান করবে না সর্বদা বড় ভাইয়ের চোখে দেখবে।নিজের বোনের খেয়াল রাখবে আমার আরওয়া অনেক কষ্ট পেয়েছে সে মানসিক যন্ত্রণায় বড় হয়েছে তবুও আমি তাকে আগলে রেখেছি বাকি দায়িত্ব তোমাদের।আর আমার বড় ছেলে ইবনুলের বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই তার বিষয়ে সব সিদ্ধান্ত তাসবীর নেবে জা/নোয়ারের শাস্তি একদিন হবেই।”

রুদ্ধশ্বাস স্বরে কথা শেষ করে স্থির হলেন শাহাবা।ততক্ষণে অবশ্য কবিরাজ মশাই উপস্থিত হয়েছেন, কবিরাজ আকরাম তার বুদ্ধি বিচক্ষণতা অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে উপযুক্ত পথ্য খাওয়ান শাহাবাকে।কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন শাহাবা।তীব্র বুকের ব্যথা এবং শ্বাস প্রশ্বাসের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে একটা পর্যায়ে ইহকাল ত্যাগ করেন তিনি।

তারপরের সময়টা ঘোলাটে ধোঁয়ার মতো মনে হলো তাসবীরের কাছে।আরওয়ার মায়াবী মুখখানী ভাবতে কলিজা ছি/ড়ে আসছে তার।দূতকে দিয়ে খবর পাঠালেন তাসবীর, আরওয়া এবং ফুফু আসমাকে কড়া নিরাপত্তায় যেন আহমেদাবাদ থেকে অলকপুরী রাজ্যে আনা হয়।সময়ের সাথে সাথে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন ইদ্রীস।কয়েকদিন আগে বাবাকে হারানোর রেষ না যেতে মাকে হারিয়ে ধৈর্য্যর সীমানা তার যে বাঁধ ভেঙ্গে গেছে।
আরওয়া এবং আসমা অলকপুরীতে উপস্থিত হয় মধ্য রাতে এর আগে অবশ্য শাহাবার মৃত্যুর বিষয়টি তাদের জানানো হয়নি।মহলে প্রবেশ করতে তাদের সম্মুখে তাসবীরকে দেখে স্বস্তি শ্বাস ছাড়ে আরওয়া।

” কি হয়েছে সম্রাট?কোন সমস্যা?হঠাৎ জরুরি তলবে হাজির করলেন যে।”

” আপনাকে সবটা বলবো তার আগে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নিন।ফুফু মাকে নিয়ে কক্ষে যান।”

“আমার মা ভাই কোথায়?”

থমকে গেলেন তাসবীর।আরওয়ার নিকট চাইলেন চোরা চোখে।

” তারা আছে আপনি….”

” আমি আগে তাদের সঙ্গে দেখা করতে চাই।”

“তারা ঘুমিয়ে আছেন এখন তাদের বিরক্ত করার কি দরকার।”

” বিরক্ত করবো না তাদের দেখে আমি চলে আসবো।”

আরওয়ার সন্দিহান গলা তাসবীর খুব সহজে ধরে ফেললো তবে এই মুহুর্তে আরওয়াকে জানানো যাবে না তা ভেবে মেয়েটাকে থামিয়ে দিল সে।

” একজন সম্রাটের কথা অমান্য করছেন?একবার বলেছি দুবার বলতে পারবো না নিজের কক্ষে যান।”

আরওয়া চমকে যান।চোখ তুলে তাকান তাসবীরের পানে।

” আপনার আমার সম্পর্ক বাকি সব সম্রাটের মতো নয় তা কি আপনি ভুলে গেছেন?”

” ঠিক আছে মানলাম সম্রাটের আদেশ নয় একজন স্বামী হিসেবে বলছি আমার আদেশ মানতে আপনি বাধ্য।”

” তর্ক করছেন কেন সম্রাট মশাই।আমার মন কু-ডাকছে নিজের চোখে তাদের না দেখতে পেলে স্বস্তি পাব না যে।”

দুজনের কথার মাঝে উপস্থিত হন ইদ্রীস রাশীদ।আরওয়ার গলা শুনে কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন তিনি।বোনকে দেখে নিজেকে এক মুহুর্তের জন্যেও দমিয়ে রাখতে পারলেন না বরং হু হু শব্দে কেঁদে উঠলেন মুহুর্তে।ভাইয়ের বাঁধনে পড়ে আরওয়া স্তম্ভিত সে।ভাইয়ের কান্নার মাঝে যেন ঘোর অশনি দেখা মিলছে তার।

” কি হয়েছে ভাইজান?কাঁদছেন কেন?”

” আমাদের আর কেউ নেই কেউ নেই।”

” কেউ নেই মানে?”

” মা…”

তাসবীর দ্রুত সরিয়ে আনলেন ইদ্রীসকে ফলে আরওয়ার সন্দেহ বহুগুনে বেড়ে গেছে।পেছন থেকে আসমা এবং লতা দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে ব্যস্ত।

” আপনি ভাইকে সরিয়ে আনছেন কেন?সত্যিটা প্রকাশ করুন আমার মা কোথায়?”

” আরওয়া আপনি স্থির হন আমি বলছি সবটা।”

ধীরে ধীরে সত্যটা প্রকাশ হয় আরওয়ার শাহাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে নিজের মস্তিষ্ক স্থির রাখতে পারেননি মেয়েটার একের পর এক আপনজন হারানোর বেদনা তাকে যেন অচল করে তুলছে ঝাপসা চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে লহমায় চেতনা হারালেন সম্রাজী আরওয়া।

৬৩.
ভোরের আলো ফুটেছে পাখিরা তাদের কলকাকলিতে ব্যস্ত প্রাসাদের ব্যস্ততা প্রতিদিনের ন্যায় চলমান।সম্রাজী উঠে বসে তাকালেন লতার পানে মেয়েটার ভেজা চোখ তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে মা হারানোর যন্ত্রণা।আরওয়াকে উঠে বসতে দেখে হেচকা টেনে ধরেন আসমা।

” বলেছিলাম আমি বিশ্বাস করোনি আমার কথা এখন দেখলে তো তোমার সুস্থ স্বাভাবিক মায়ের আচমকা মৃত্যু।তাসবীর ছেলেটাকে বিশ্বাস করে ঠকে গেছো তুমি তোমার পিতা মাতার খুনি সে।”

লতা চমকে তাকান, সম্রাট তাসবীরের নামে এসব অপবাদ সে কিছুতেই মানতে পারবে না।কিন্তু মুখ খুললেই বিপদ হিতাহিত এখন বিপরীত করে বসবেন আসমা।

” আরওয়া শুনতে পাচ্ছ আমার কথা?তোমার মা নেই আর তোমার মায়ের খু/নি তাসবীর এই কথা মেনে যাও।কাল ভাইয়ের বউ মরেছে আজ যে ভাইয়ের ছেলে ম/র/বে না তার নিশ্চয়তা নেই।যত দ্রুত সম্ভব তুমি পালিয়ে যাও আমাদের পালাতে হবে,পালাতে হবে আমাদের।”

আরওয়া ফুঁপিয়ে উঠে এখন তো ফুফুমার কথাই সত্যি মনে হচ্ছে। তাসবীর কেন তাকে ঠকালো ভালোবাসার মিথ্যা জাল বুনলো তবে কী সে নীরব ঘাতক হয়ে তার মাঝে বিচরণ করছে?তাসবীর অতিত ভুলেনি সেকি তবে তার বোনের হ/ত্যার প্রতিশোধে উত্তাল হয়েছে।

সময় কেটে গেলো শাহবার দাফন কার্য খুব দ্রুত সম্পূর্ণ হলো আরওয়া বাদ বাকি সময়টা ছিল নিশ্চুপ।মহলের আনাচে-কানাচে সে ঘুরেফিরে দেখছিলেন, শাহাবার কক্ষে পৌঁছে বেশ অবাক চোখে তাকালেন কক্ষের প্রত্যেকটা জিনিসপত্র আগের মতো সাজানো।একে একে স্মৃতি বিচরণ করতে করতে মহলের চারিদিকে পর্যবেক্ষণ করেন।কিছুটা সময় পর একজন দাসী হাজির হন সম্রাজীর সম্মুখে।নত মস্তকে আরওয়াকে কুর্নিশ জানিয়ে বলেন,

” সম্রাজী সম্রাট আপনাকে স্মরণ করেছেন।”

” ইচ্ছে করছে না তার কাছে যেতে গিয়ে বলো।”

দাসী ফিরে গেলেন এবং সম্রাটকে সম্রাজীর কথা বললেন।সম্রাট তাসবীর দাসিকে পাঠিয়ে এগিয়ে গেলেন আরওয়ার কাছে।

” আপনাকে আমি ডেকেছিলাম।”

” তো?”

” জরুরি কাজে এক্ষুনি আহমেদাবাদে ফিরতে হবে আপনি তৈরি হয়ে নিন।”

“আপনার রাজ্যে আপনি যান আমি আর যাব না।সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি এখানেই থাকবো।”

“আমরা আবার আসবো এখন আপাতত সব কাজ শেষ এখন যাওয়া যায়।”

” কোন কাজ শেষ?আমার পরিবার ধ্বং//স করা।এখনো আমার ভাই, ফুফু আমি বেঁচে আছি আমাদের মা^\রবেন না সম্রাট মশাই?”

” এসব কি বলছো?”

” ঠিক বলেছি আমার পিতামাতার হ/ত্যাকারী আপনি আমাকে কেন ঠকালেন সম্রাট মশাই?”

তাসবীর অবাক চোখে তাকিয়ে আছে! আরওয়ার মুখের একেকটা বাক্য তার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকছে।

” এসব মিথ্যা আপবাদ আমায় দিও না, সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই।”

“অপবাদ নয় সবটা সত্যি।”

” বুঝেছি এখন তোমার মন মেজাজ ঠিক নেই সময় দিলাম ধীরে ধীরে সবটা বুঝবে। নিশ্চই এখন কেউ কু-মন্ত্র ডুকিয়েছে কানে।”

” কে কু-মন্ত্র দিবে?আমার কি জ্ঞান বুঝ কম?আমার পিতার হ/ত্যাকারীকে এতদিনেও খুঁজে পাননি কেন?পাবেন কি করে যে খু/ন করে সে আর কাকে খু/নী বানাবে।”

” সময় অসময় বলে ছেড়ে দিলাম তোমায় না হলে এতক্ষণে…”

” এতক্ষণে কী?আমার পিতামাতা হiত্যার প্রতিশোধ আমি নিয়েই ছাড়বো।আমি থাকবো না আপনার সাথে আমি ভুলে যাব আমার স্বামীর কথা।সম্রাট তাসবীর যাকে আমি চিনি একজন খু/নি হিসেবে সে আমার কেউ নয়।”

” আরওয়া চুপ করো আমার ধৈর্য্য আর কুলাবে না।এখন আমার সাথে চলো যা কথা হবার আহমেদাবাদে গিয়ে হবে।”

” যাব না আমি আপনার সাথে বলেছিনা আপনি আমার কেউ না।”

” চলো বলছি।”

” আমি যাব না”

” চলো।”

” না।”

#চলবে___

#বিধুর_রজনী
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ২৬ বর্ধিত অংশ]
________________
৬৪.
” জীবনের তাগিদে ধৈর্য্য ধারণের মতো মহাগুন আমার আছে।
দ্বিতীয় বারের মতো অবিশ্বাস করলেন আমায়।এবারো হয়তো আমি সয়ে যাবো তবে তৃতীয় বার, তৃতীয় বার হয়তো আপনি ক্ষমার অযোগ্য হয়ে পড়বেন সম্রাজী।তখন আমার ধৈর্য্যে আর কুলাবে না।”

” আপনার আমার মাঝে তৃতীয় বারের সময়টা আসবে না সম্রাট তাসবীর।সত্য চাপা থাকে না আপনি আমাকে বিভোর করে আমার পিতামাতাকে হ/ত্যা করেছেন।কিন্তু কেন? এত নাটকীয় আচরণের কোন প্রয়োজনী ছিল না আপনি বরং নিজের প্রতিশোধ নিতে আমাদের এক সারিতে একই ভাবে মা/রতেন।”

তাসবীর রাগান্বিত হলেন তবে তিনি রাগকে প্রাধান্য না দিয়ে এগিয়ে এলেন আরওয়ার কাছে ততক্ষণাৎ দু’কদম পিছিয়ে গেলেন আরওয়া তবুও তাসবীর তার বেগমের নরম গাল ছুঁয়ে দিলেন কাঁপা হস্তে।

” কি হয়েছে আপনার?সত্যটা কেন মানতে চাইছেন না?আমি সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি একমাত্র ইবনুল রাশীদের শাস্তি আমি নিজের হাতে দেব।আপনার মাকে আমি আম্মীজান বলে ডেকেছি আমি আমার আম্মীজানকে কেন হত্যা করবো?আপনার পিতাকে হ/ত্যা করার ইচ্ছে থাকলে জনসম্মুখে হ/ত্যার আদেশ দিতাম কিন্তু এভাবে নয়।”

” জনসম্মুখে হ/ত্যার আদেশ দিলে যে আমার নজরে শত্রু রূপে পরিণত হতেন তাই তো আড়ালে কার্য হাসিল করেছেন।”

” যে বুঝবে তাকে একবারি বোঝানো যায়।আর যে বুঝেও বোঝেনা তাকে কখনোই বোঝানো যায় না।”

“ছাড়ুন আমায়।”

তাসবীরের হাত ছাড়িয়ে দিলেন আরওয়া।রাগান্বিত হয়ে কুটিল হাসলেন তাসবীর।চোখের পলকে আরওয়ার ওষ্ঠে নিজের রুক্ষ ওষ্ঠ মিলিয়ে দিলেন তিনি।আরওয়া নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা চালালেও তাসবীর ছাড়লো না।যতক্ষণ না আরওয়া স্থির হচ্ছে ততক্ষণ তাসবীর নিজের কার্য হাসিল করে যায়।

” আপনার এসব ভুল ধারণা যেন আমার পিতামাতার কানে না যায় আরওয়া।খবরদার আমার উপরে থাকা জেদ যেন আমার মায়ের উপর প্রয়োগ না করা হয়।তাতে কিন্তু ফলাফল খুব ভালো হবে না।”

” আপনার সাথে আমি থাকবো না।”

তাসবীর আরওয়ার কথা কানে নিলেন না।কক্ষের বাইরে গিয়ে বাইরে থেকে দ্বার বন্ধ করে চললেন পিতার কক্ষের উদ্দেশ্যে।অলকপুরী ছেড়ে আরওয়া যখন আহমেদাবাদে ফিরতে চাইলো না তখন একপ্রকার জোরজবরদস্তি করে তাকে নিয়ে আসে তাসবীর।সর্বশেষ ইদ্রীসের কথা রাখতে আহমেদাবাদে পুণরায় ফিরে আসে আরওয়া নূর।

৬৫.
আবু সিদ্দীক বর্তমানে সুস্থ।তিনি এখন হাটতে পারেন চলাচলে কোন সাহায্যের প্রয়োজন হচ্ছে না।তাসবীর ক্লান্ত শরীর টেনে নিয়ে বসে পড়লেন সিদ্দীকের পাশে।

” কেমন আছেন পিতা?”

” বেশ ভালো।”

” এবার সময় এসেছে আপনি আপনার সিংহাসন দখল করুন পিতা।”

” তুমি কী বলতে চাইছো বাপ বেটার মাঝে রাজ্য দখল নিয়ে দ্বন্দ্ব চলুক।আমি কি যুদ্ধ ঘোষণা করবো? হা হা হা।”

” যুদ্ধ ঘোষণার প্রয়োজন নেই মহামান্য সম্রাট আপনার নিকট আত্মসমর্পণ করতে আমি বাধ্য।”

আবু সিদ্দীক হা হা শব্দে হেসে উঠলেন।

” এখন নয়, উপযুক্ত সময়ে আমি তোমায় ছাড়বো তবে তার আগে উপযুক্ত ভাবে রাজ্য পরিচালনায় দক্ষ হয়ে উঠো এই কামনা করি।”

” আব্বাস রাশীদের মৃত্যু রহস্য উদঘাটন আমার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।কোন কিছুই করতে পারছি না আমি।”

” ধৈর্য্য ধরো নিশ্চই আল্লাহ তায়ালা রাস্তা দেখাবেন।”

” আরওয়া আর আমার সম্পর্কের অবনতি হয়েছে পিতা।আরওয়া আমাকে অবিশ্বাস করছেন তিনি ভেবেই নিয়েছেন তার পিতামাতার হ/ত্যাকারী আমি।”

” যে সম্পর্কে বিশ্বাস নেই সেই সম্পর্কে ভালোবাসার মর্যাদা কোথায়?”

সম্রাট তাসবীর মাথা নত করলেন।বুক ছিড়ে তার বেরিয়ে আসলো দীর্ঘ নিশ্বাস।একটা সময় আরওয়ার ভালোবাসার মর্যাদা রক্ষণে পিতার নিকট এ সম্পর্কের নাম চেয়েছিল।আরওয়াকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে এই প্রাসাদে তোলার আজ্ঞা চেয়েছিল অথচ আজ পিতার নিকট সেই সম্পর্কের রঙ বদলের গল্প শুনালো হায় ভালোবাসা!

” চিন্তা করো না বাবা নিশ্চয়ই আরওয়ার সুবুদ্ধি হবে।”

” আপনার নিকট আমার একটি অনুরোধ রইলো,এসব যেন মা জানতে না পারে।তিনি জানলে বড্ড কষ্ট পাবেন।”

” বেশ আমি কিছুই জানাবো না বিনিতাকে।

ঘুটঘুটে অন্ধকার অলিন্দে বসে মুক্ত অন্তরিক্ষে তাকিয়ে এক ফোঁটা চোখের জল বিসর্জন দিলেন ইদ্রীস রাশীদ।এইতো কিছুদিন আগেও মায়ের সঙ্গে খোশ গল্পে মেতে ছিলেন অথচ আজ মা নেই।মা হারানোর শোক পৃথিবীর কোন আনন্দোচ্ছ্বাসে ভুলিয়ে দিতে সক্ষম নয়।শত শত মানুষের ভীড়েও ইদ্রীস এখন খুঁজে বেড়ায় চিরসাথী তার মাকে।

” ইদ্রীস ঘুমাও নি যে?”

তাসবীরের কণ্ঠে বসা থেকে উঠে দাঁড়ান তিনি।

” ঘুম আসছে না।তুমি এখানে?আরওয়া কি করছে?”

” আমি কক্ষে যাইনি এখনো।লতা বলেছেন তিনি ঘুমিয়েছেন।”

” ওহ আরওয়ার কথায় মনে কষ্ট নিও না।আমার বোন ফুফুমার প্ররোচনায় এমনটা বলছে।নিঃসন্দেহে একদিন তার ভুল ভাঙবে।”

” তা আমি জানি।সময় অসময় সবার জীবনেই আসে।অনুকূল প্রতিকূল কাটিয়ে স্থির আমাদের থাকতে হবে।আরওয়াকে আমি মন থেকে ভালোবাসি আর ভালোবাসি বলেই তার এসব কথা কানে তুলে তার প্রতি বিতৃষ্ণা জাগাতে চাই না কিংবা তাকে ঘৃণার পাত্রী করতে চাই না।”

” আমার বোনকে কখনো আঘাত দিও না তাসবীর সে আমার আদরের। ভুল হলে শাসন করবে তবে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর কিছু নির্মম যন্ত্রণা তাকে কখনো অনুভব করতে দিও না।”

” তুমি ঘুমিয়ে পড়ো এভাবে থাকলে শরীর খারাপ হবে।শুভ রাত্রি।”

” শুভ রাত্রি।”

তাসবীর নির্জন মহলে বেশ কিছুক্ষণ পাইচারি করেন সবাই ঘুমিয়ে আছে অথচ তার চোখে ঘুম নেই।প্রিয়তমার চোখে নিজের জন্য ঘৃণা দেখে মনে হচ্ছে শানিত তরবারির সাহায্যে কেউ যেন তার প্রেমজ হৃদয়খানি ফালা ফালা করছে অথচ বাইরে থেকে তাসবীর নীরব যেন কিছুই হয়নি তার।আজকের আকাশে চাঁদ নেই,আলোকিত তারাদের দেখা নেই।বেশ কিছুক্ষণ পাইচারি শেষে নিজের কক্ষে ফিরলেন তাসবীর।তাহাজ্জুদের নামাযের সময় হয়েছে নিজেকে পাক পবিত্র করে নামাযের জন্য প্রস্তুত করেছেন।নামায শেষে ক্লান্ত শরীর টেনে তিনি দাঁড়ালেন আরশির সম্মুখে।
পাশে পালঙ্কে শায়িত প্রিয়তম স্ত্রী আরওয়া নূর।স্ত্রীর পাণে তাকিয়ে বড্ড কাছে টানলো তাসবীরকে। অবাধ্য মনটা সকল জড়তা ভুলে এগিয়ে গেলো আরওয়ার সম্মুখে।আরওয়ার মাথা এলিয়ে রেখেছিলেন এক পাশে অনাবৃত গলাটায় কাতর চোখে তাকিয়ে ছিলেন তাসবীর।পালঙ্কে শরীর এলিয়ে আরওয়ার কণ্ঠদেশে ডুবিয়ে দিলেন তার মুখ আকস্মিক ছোঁয়ায় কেঁপে উঠলেন আরওয়া এতে যেন সর্তক হলেন তাসবীর তবুও একটুও সরলেন না।প্রিয়তমার উষ্ণ শরীরে নিজের শীতল শরীরটা ধীর ধীরে আবেশে আচ্ছন্ন হচ্ছে।সারাটা দিনের ক্লান্তি,অভিযোগ, অনুযোগ মিলিয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালেন তাসবীর।একটা সময় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন তিনি সুযোগ বুঝে চোখের পর্দা খুললেন সম্রাজী আরওয়া কুটিল হেসে নিজেকে মনে আওড়ালেন,

” আমি তো ঘুমাইনি সম্রাটমশাই।আপনার অপেক্ষায় ছিলাম যে।আমি জানি আমার সম্মোহনী ভাব আপনাকে বার বার কাতর করে কাতরে কতল হতে বাধ্য আপনি।”

সম্রাজী নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে বসেন।গলার বাম দিকটা হাত রেখে বার বার ঘষতে থাকেন।কিছুক্ষণ আগে তাসবীরের উষ্ণ ঠোঁটের গভীর ছোঁয়ায় কেমন যেন স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে।পালঙ্ক ছেড়ে নেমে আরওয়া বিশাল তাকের কাছে পৌঁছায়
তার পেছনেই রাখা আছে শানিত তরবারি।এই তরবারির সাহায্যে আজ মৃত্যু হবে তাসবীরের।পিতামাতার হ/ত্যার প্রতিশোধ তবে আজকেই পূর্ণ হবে!ভাবতেই আনন্দের শ্বাস ছাড়লেন সম্রাজী।ধীরে ধীরে তাকের আড়াল থেকে তরবারি হাতে তুলে নেন আরওয়া।নিঃশব্দে এগিয়ে যান তাসবীরের অভিমুখে।কাঁপাকাঁপা হাতে তরবারি তুলে প্রথম বারের ন্যায় আঘাত করে বসলেন তাসবীরের বুকে।

কপালজোরে পরিস্থিতি অন্য স্রোতে ঘুরে গেল তাসবীর সহসা নিজের জান বাঁচাতে ডান হাতের সাহায্যে ধরে নিলেন শানিত তরবারি।চামড়া ছিলে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল তার বুকে।আরওয়া অবাক হলেন, তাসবীরের কঠোর চোখের দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠলো তার দু’পা।কাঁপা কাঁপা হাতে তরবারি নিজের হাতের কবজায় আনার আগেই সেই তরবারি ছিনিয়ে নিলেন তাসবীর।আরওয়ার হাত টেনে সহসা ফেলে দিলেন পালঙ্কে। তখন তাসবীর আরওয়ার উপর শুয়ে রক্তাক্ত হাতে ছুঁয়ে দিলেন আরওয়ার গাল থেকে ধীরে ধীরে গলায়।তাসবীরের রক্তাক্ত হাত যখন তার সারা মুখে বিচরণ করছিল তখন নিঃস্পৃহে মুখ সরাতে চাইলেন আরওয়া।

” যে বুকে মাথা রেখে আপনার শান্তি মেলে সেই বুকে আঘাত করতে চাইলেন বেগম!”

আরওয়া নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা চালায় তবে তাসবীরের তেজের কাছে সে বার বার হেরে যায়।

” ম/রে গেলে একে বারে খুশি হতাম।”

” মৃত্যু সহজ আবার সহজ নয়।যে আমাকে ভালোবেসেছে তার হাতে আমি হাসতে হাসতে মরতে পারি কিন্তু যে আমার সাথে ভালোবাসার নামে ছলনা করেছে তার হাতে যে আমি মরতে চাই না বেগম।”

আরওয়া চমকে তাকান তাসবীরের সূক্ষ্ম খোঁচা সে খুব সহজে ধরে ফেলেন।

” আপনি আমায় কখনো ভালোবাসেননি আরওয়া।ভালোবাসলে বিশ্বাস করতেন মায়া করতেন।এই যে আমার রক্ত ঝরছে আপনার চোখে মুখে নেই উচাটন ভাব,নেই নিঃশব্দে আহাজারির ছাপ।”

অসহ্য ব্যথায় তাসবীর দাঁতে দাঁত চেপে থেমে গেলেন।হাতের ফিনফিনে ব্যথায় চোখ বুঝে হতাশার শ্বাস ছাড়লেন।

” মানলাম ভুলবশত আঘাত করেছেন,বর্তমানে আপনি আপনার মাঝে নেই কিন্তু আমার কষ্টে আপনার একটুও টনক নড়লো না।আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে।আমি তবে ভুল মানুষকে হৃদজমিনে জায়গা দিয়েছি বসত করার সুযোগ দিয়েছি অথচ সে সেটার যোগ্যই নয়।”

তীব্র ঘৃণা নিয়ে আরওয়ার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেন তাসবীর।হাতের রক্ত গড়িয়ে সাদা পাঞ্জাবি রঞ্জিত।আরওয়া স্থির শুয়ে আছেন পালঙ্কে।বাম হাতটা চোখের সামনে নিয়ে দেখতে পান রক্তের দাগ ভয়ে ঢোক গিললেন আরওয়া।চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়ে নোনা জল।পালঙ্ক থেকে উঠতে তাসবীরকে সম্মুখে দেখতে পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন সহসা।কিন্তু তাকে অবাক করে তাসবীর কেমন বাঁকা হাসছেন।শানিত তরবারি তখন তাসবীরের হাতে ছিল বিষয়টা গায়ে লাগালেন না সম্রাজী।হঠাৎ তীব্র ব্যথায় ছটফটিয়ে উঠেন তিনি বাহু চেপে বসে পড়েন মেঝেতে।চামড়া কেটে গলগলিয়ে রক্ত ঝরছে আর তাকে আঘাত করেছেন স্বয়ং তাসবীর একি ভাবা যায়!তাসবীর হাটু মুড়ে বসেন আরওয়ার অভিমুখে,

” কষ্ট লাগছে বেগম?আগেই বলেছিলাম আপনি আমি এক সত্তা।আমার আঘাত আপনার আঘাত। কিন্তু আজ যেটা করলেন দুঃসাহসিক কাজ।আজকের এই আঘাতে বুঝিয়ে দিলাম আপনি আমাকে আঘাত করার যেমন দুঃসাহস করেছেন তেমন আপনাকে আঘাত করার সাহস আমার আছে।সাবধান সম্রাজী সম্রাট তাসবীরের স্ত্রী আপনি কিন্তু এখনো বুঝতে পারেননি সম্রাট তাসবীর কোন স্তরের মানব!

তাসবীর দ্রুত পায়ে উঠে গেলেন এই মুহুর্তে আরওয়ার রক্ত রোধের প্রয়োজন।বেশ কিছুটা সময় নিয়ে নিজের হাতে যত্ন নিয়ে আরওয়ার বাহু পরিষ্কার করে বেঁধে দিলেন তাসবীর।নিজের হাত বেঁধে সহসা পাঁজা কোলে তুলে নিলেন তার বেগমকে।

” সারাদিন তর্কাতর্কি করেছেন।আমাকে দেখলেই রাগারাগি করেছেন,একটু আগে মারামারি করেছেন আসুন এখন শেষ রাতে ভালোবাসাবাসি করবো।কথায় আছে শেষ ভালো যার, সব ভালো তার।”
#চলবে___