বিনিদ্র রজনী পর্ব-০২

0
377

#বিনিদ্র_রজনী
#পর্ব_২
#মুমতাহিনা_তারিন

তুলির চোখের জল শুকিয়ে যাচ্ছে বার বার ।রাহেলা খালা পাশে বসে দম নিয়ে বিলাপ করে কান্না করে যাচ্ছে। আদনানকে একবার ওর দিকে তাকাইনি! একবারও কি মনে হয়নি আজকে এমন সেজেগুজে ছিল কেনো ও!নিজের কাছে প্রশ্ন করে কিন্তু উত্তরের খাতা শূন্য। চোখের উপর ভেসে উঠলো প্রথম ভালোবাসার অনুভূতি সৃষ্টি করা আদনানের প্রতিচ্ছবি।

তুলির বয়স কেবল সতেরো । গ্রামের কাচা রাস্তা দিয়ে ছাগল নিয়ে বাড়ি ফিরছে সাথে আছে টুম্পা ভাবির আট বছরের ছেলে ইশরাক । বর্ষার মওসুমে বিলে অনেক ঘাস হয় শুধু সকালে ছাগল বেধে রেখে আসবে আর বিকেলে গিয়ে নিয়ে চলে আসলেই হলো । তবে মাঝে একবার পানি খাওয়াতে আসতে হয় । বিকেলে এই রাস্তা দিয়ে যেতে যে কি আরাম ঠান্ডা বাতাস বয়ে যায় । একেবারে মন ছুঁয়ে যায় যেনো । ছাগল গুলো দৌঁড়ে সামনে চলে গেছে নিশ্চিত বাড়ি পৌঁছে যাবে । ইশরাক আর তুলি পরিবেশ উপভোগ করতে করতে বাড়ি যাচ্ছে । হঠাৎ পা থেমে গেলো তুলির ,,,তুলিকে দাড়াতে দেখে ইশরাক ও থেমে গেলো।

সামনে রাস্তার পাশে বসে আছে আদনান । বাতাসে চুলগুলো উড়ে যাচ্ছে বাম হাত দিয়ে সেগুলো ঠিক করছে বার বার । দেখেই বোঝা যাচ্ছে স্বাস্থ্য সম্পর্ককে অনেক সচেতন । জোড়া ব্রু খুব বেশি ফর্সা না আবার শ্যাম রঙের ও না । তবে তুলির থেকে উজ্জ্বল রঙ।নিয়মিত শরীর চর্চা করায় একেবারে ফিট আদনান।

” হা রে ওই ছেলেটা কে? আগে তো গ্রামে দেখিনি শহরের ছেলে মনে হচ্ছে”

তুলির কথা শুনে মুখে টিপে লজ্জা লজ্জা ভাব এনে ইশরাক বললো –

” তোর বর ,,,,নিজের বর রে চিনতে পারছিস না ছি ছি মানুষ শুনলে কি বলবে ”

“অনেক পেকে গেছিস না । ওই ব্যাটা আমার বর কিভাবে হবে!!চিনি না জানি না তোরে ধরে উল্টো করে পেটাতে হবে ”
” আরে উনি রুকু দাদীর সেই সোনার টুকরো পুতা যার সাথে দাদি দিনে তিন চারবার তোর সাথে বিয়ে দেয়,,,নাম ডা মনে নেই”

“এইতি সেইতি!!!!!”

” এক্কেবারে শাকিব খানের মত না?”

” শাকিব খানের থেকে ও সুন্দর”

রুকু দাদি তো মজা করে বিয়ের কথা বলে । তুলির মনটা খারাপ হয়ে গেলো নিমিষেই । নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো । সে তো শ্যাম বর্ণের তার উপর মুখে ব্রণ। ওর থেকে কত সুন্দর সুন্দর মেয়েরা আছে গ্রামে । পুরো গ্রাম ঘুরে দেখার ও দরকার নেই । তাদের দুই বাড়ি পরেই বৃষ্টিদের বাড়ি কি সুন্দর চেহারা ! লাল টুকটুকে শরীর চোঁখে ঘন পাপড়ি। তুলির তো কিছুই নেই ওমন যে রুকু দাদি উনার সাথে বিয়ে দেবে । মনে মনে নিজেকে হাজার বোঝালো তুলি । সে না হোক তার মতো অন্য কি হলেও চলবে । যেতে যেতে আল্লাহর কাছে খুব চাইলো আদনানের মতোই যেনো আল্লাহ তাকে একটা বর দেয় । তুলি অনেক ভালোবাসবে তাকে অনেক খেয়াল রাখবে ।

বাড়ি এসে ছাগল গুলোকে খুঁটির সাথে বেধে রাখলো । ছাগল বাড়ি এসেই তুলির লাগানো ফুল গাছে হামলে পড়েছিল । আদনানের ভাবনায় ফুল গাছ গুলোর কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল তুলি । রাগে মুখটা লাল হয়ে গেছে তুলির কিন্তু ছাগল গুলোর কি দোষ নিজের রাগ টা নিজের মধ্যে পুষে রাখলো।

” এ তুলি টুল টুল টুলি”

মেম্বারের ছেলে রাফিদ,,,দুনিয়ার বদ দুইবার মেট্রিক ফেল করে এখন তুলির পিছনে লেগেছে । মেজাজ এমনি বিগড়ে ছিল । রাফিদের আগমন যেনো আগুনে ঘি ঢালার কাজটা করে দিলো ।

” রাফিদের বাচ্চা তোর কল্লা কেটে দেবো বেয়াদপ। তোর ভবিষৎ অন্ধকার করে দিতে আমার দুই মিনিট লাগবে না । এমন জাগায় দেবো না আমার নাম মনে পড়লেই তোর কাপাকাপি লেগে যাবে”

” তুলি ”

” আবার কিডা রে”

রুকু দাদি হো হো করে হেঁসে দিলো । চোখ গুলো বড় করে পিছনে ফিরতেই তুলির রাগে লাল হয়ে থাকা মুখে ভিড় করলো লজ্জা । দাদীর পিছনে চোঁখ মুখ কুচকে আদনান দাড়িয়ে আছে । তুলি কোথায় যে পালাবে ,,,,লজ্জায় মুখ লুকানোর ব্যার্থ চেষ্টা করলো । ততক্ষনে রাফিদ পগারপার।

” একেবারে ঠিক মত দিয়েছিস ওই ব্যাটারে। এইযে আমার আদরের পুতা আদনান তোরে এর কথা বলতাম মনে আছে ”

” হ্যাঁ দাদি মনে আছে ”

মিষ্টি করে হাসার চেষ্টা করে বললো তুলি । সুন্দর ভাবে আদনানকে সালাম দিল আদনান খুব ভদ্র ভাবেই উত্তর দিয়ে চলে গেলো । কোনো দ্বিতীয় কথা বললো না । তুলি আদনানের চলে যাওয়াই খুব একটা খারাপ লাগল না তুলি যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো । লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল তার।

তারপর!! তারপরে স্বপ্নের মত করেই আদনান আর তুলির বিয়ে হল।বাবা মারা যাওয়ার পর আম্মা যখন দিশেহারা তখন রুকু দাদি আদনানের সাথে তুলির বিয়ের কথা তোলেন । মেয়ের ভালো একটা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই বিয়ে দিতে রাজি হয় শাপলা বেগম । এতো দুঃখের মাঝেও তুলির মনে দোলা দিয়ে যাচ্ছিল । হাতছানি দিয়ে নতুন জীবন তাকে ডাকছিল । আদনানের হাসি খুশি মুখটা দেখে সেদিন নিজের মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল যতটা সম্ভব সে আদনানকে ভালোবাসবে । নিজের ভালোবাসা দিয়ে আদনানকে রাঙিয়ে দেবে নতুন রঙে।কিন্তু কে জানত অন্য কাউকে রাঙানোর প্রতিজ্ঞা নেওয়া তুলির জীবনটাই নিকষ অন্ধকার হারিয়ে যাবে!!!!

অতীত থেকে বর্তমানে ফিরলো তুলি । ফজরের আজান দিচ্ছে। স্টোর রুমে জায়গা হয়েছিল তুলির একটা ছোটো খাট আর বাতিল আসবাবপত্র গুলোর সাথেই দিন কাটিয়ে দিত সে। গল্পঃ করার জন্য তো রাহেলা খালা ছিলোই। ময়লা পরিষ্কার করে সব আসবাবপত্র গুছিয়ে নিজের ছোট্ট জগৎ বানিয়ে নিয়েছিল এই ঘরটাকে । জানালার কাছে দুটো টবে বেলী আর গন্ধরাজ ফুল গাছ আছে । সেগুলোকে হাত দিয়ে একটু ছুঁয়ে দিলো । জামা কাপড় রাখা কোনো জায়গা ছিল না তুলির তাই বিয়ের সময় আনা ট্রলিতে সব গুছানো আছেই ।কাবিনের টাকা গুলো এক পাশে রেখে যেমন ছিল তেমন ভাবেই বেরিয়ে গেলো । রাহেলা খালাকে শেষ বিদায় টা দিলো না । বিদায় নিতে খুব কষ্ট হবে তার ,,,,, বুক জ্বলে যাচ্ছে তুলির রাতে চুরি চুরি করে আর আদনানকে দেখা হবে না । কলিং বেলের শব্দ শুনেই দৌঁড়ে যাবে না ও আর । আদনান আজকে তুলি নামক আপদ থেকে বেঁচে যাবে ।

আজকে আর আদনানের ঘরে কফি আসেনি । এতক্ষন পরিস্থিতি ভালো থাকলে মুখে হাসি নিয়ে তুলি ঘরে ঢুকত। কফি টা আদনানের হাতে দিয়েই জানালার পর্দা গুলো সরিয়ে দিত তারপর ব্যালকনি তে রাখা গাছগুলোতে পানি দিয়ে, বিছানা গুছিয়ে আদনানের শার্ট ,টাই,জুতো ঘড়ি সব কিছু গুছিয়ে ঘর থেকে বের হতো । এতদিন এভাবেই চলেছে আজকে ঘুম থেকে উঠে আদনান আর ধোঁয়া উঠা কফি পায়নি । আস্তে হেঁটে হেটে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো । নিচে দিকে তাকিয়ে সেই সদ্য আঠারো বছরে পা রাখা মেয়েটার দুই বছরের সংসারে রেখে যাওয়া স্মৃতি ফেলে চলে যাওয়ার সাক্ষী হল সে। অগোছালো চুলের মোটা বিনুনী হাঁটার তালে তালে দুইদিকে দুলছে । হাতে ছোট ট্রলি ব্যাগ। আদনানের কানে একটা কথা শুধু বাজছে….

” আর কিছু লাগবে?”

চলবে,,,,