#বিনিদ্র_রজনী
#পর্ব_৩
#মুমতাহিনা_তারিন
তুলি দাড়িয়ে আছে তার আম্মুর সামনে । মুখে পাঁচটা আঙ্গুলের দাগ স্পষ্ট ভাবে বোঝা যাচ্ছে। হাউমাউ করে কান্না করছে শাপলা বেগম মেয়েটা যাতে সুখে থাকে ভালো থাকে এজন্যই তো বিয়ে দিয়েছিল কিন্তু তার মেয়ের গায় কলঙ্কের দাগ লাগিয়ে তারা তাড়িয়ে দিলো তাও গর্ভবতী অবস্থায়।
” মা রে তোকে আমি বিশ্বাস করি । তুই ওদের উপর রাগ রাখিস না মাফ করা মহৎ গুন । আল্লাহ যখন এই পরিস্থিতি দিয়েছে নিশ্চয় ভালোর জন্যই দিয়েছে। ”
” কিন্তু ভাইয়া ভাবি জানলে কি হবে আম্মু! ওরা তো আমাকে বিশ্বাস করবে না । ভাইয়ার চোখের বালি হয়ে গেছি আমি ”
” কেউ জানবে না তুই আর আমি দূরে চলে যাবো । আমি আমার মেয়ের গায় কোনো আঁচ লাগতে দেবো না”
______________________
তুলি লাল টকটকে একটা শাড়ি পরে বসে আছে আদনানের ঘরে । বাড়িতে আসার পরেই এই ঘরে বসিয়ে রেখে যে জার মত চলে গেছে । তুলি কত শুনেছে এই দিন ননদ ভাবীরা কত লজ্জা দেয় ,গল্পঃ করে নতুন বউদের সাথে কিন্তু ওর বেলায় কিছুই হলো না। তাতে অবশ্য ওর মন খারাপ লাগছে না এমনি ও অতটা রাস্তা গাড়ি করে এসে শরীরটা কেমন করছে । ঘরটা ছিমছাম বাসর ঘর যেমন পুষ্পে পুষ্পে ভরা থাকে তেমন না । শুধু বিছানার পর কয়টা গোলাপের পাপড়ি আর বিছানার পাশে থাকা ছোটো টেবিলের উপর এক গুচ্ছ লাল গোলাপ ।
এইসব কিছু দেখার মধ্যেই ঘরে ঢুকলো আদনান । শরীরে জড়ানো সাদা পাঞ্জাবি । ওদের বিয়েটা খুব সাধারণ ভাবেই হয়েছে তাই চোঁখ ঝলসে যাওয়া কোনো অনুষ্ঠান অথবা পোশাক কারোর শরীরেই নেই । আদনান একবার তুলির দিকে তাকালো তুলি উঠে এসে সালাম করলে শুধু উত্তর দিয়েই বারান্দায় চলে গেলো ।
রাস্তা দিয়ে বসানো সারি সারি ল্যাম্প পোস্টের আলোয় আলোকিত শহর । বারান্দায় দাড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালো আদনান । তুলিকে কেনো যেনো ওর সহ্য হচ্ছে না । নিজে এর কারণ খুঁজেও পায় নি । তুলি গ্রামের মেয়ে সহজ সরল ধরন তার উপর গায়ের রঙ চাপা প্লাস ইন্টার পরীক্ষা এখনও দেই নি । বয়সের দিক দিয়ে বিস্তর তফাৎ। তুলির বয়স সতেরো কিছুদিন পর আঠারো হবে আর ওর ছাব্বিশ বছর বয়স। অর্থনৈতিক কিংবা সামাজিক অবস্থানের কোনো দিক দিয়েই তুলির সাথে ওর মেলে না ।
এইসকল বিষয় ভাবতে ভাবতেই একটা সিগারেট শেষ । শরীর ম্যাজ ম্যাজ করছে আদনানের একটু গোসল করতে হবে । বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকে একটা টি শার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুম চলে গেলো আদনান।
তুলি বিছানা থেকে উঠে ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। ইংরেজি সাহিত্যের বই দিয়ে ভরা বুকশেলফ। ওদের কলেজের লাইব্রেরিতে এমন বুকশেলফ দেখেছিল তুলি । কি সুন্দর ভাবে সাজানো হরেক রকম বই মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো তবে গাছ লাগানো । এই গাছ গুলোর নাম জানা নেই ওর।
” শাড়ি চেঞ্জ করে নেন”
গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠের উক্ত কথা শুনে থমকে গেলো তুলি । সারা শরীর কেঁপে উঠলো ওর ।পিছে ফিরে আবারও মুগ্ধ হলো তুলি । চুল বেয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে,কাধের এক পাশে টাওয়াল। তুলি আদনানের পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোঁখ বুলিয়ে হো হো করে হেসে উঠলো ।
” এই হাসছো কেন?”
আদনানের চোঁখে মুখে বিরক্ত ভাব জোড়া ব্রু দুটো কুচকে চোখ বড় বড় করে তুলির দিকে তাকালো । তুলি কোনো কথা না বলেই আবারও হেসে দিল ।
” কথা বল না কেন ?”
” আপনাকে আমাদের গ্রামের সাত্তার মিয়ার মত লাগছে । সাত্তার মিয়া আপনার মতোই এক কাধে গামছা নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়াতো।আমরা তাকে বলতাম সাত্তারের বউ বুড়ি সাত্তার মিয়ার অনেক সুড়সুড়ি । আপনি আয়নায় গিয়ে দেখেন আপনাকে খুব ভালো লাগছে”
তুলি একটা শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো । ভারী শাড়িটা খুলতে অনেক অসুবিধা হয়েছে । প্রায় আধঘন্টা লেগে গেলো শাড়িটা খুলতেই সেফটিপিন গুলো শাড়ির সাথে পেঁচিয়ে গিয়েছিল। শাড়ি পরার অভ্যাস নেই তুলির তাই কোনোমতে যেমন তেমন ভাবে পরেছে শাড়িটা । শাড়ি পরতে পরতে নানান জল্পনা কল্পনা সাজিয়েছে তুলি।
বিছানায় আদনান এক পাশে চোঁখ বুঁজে শুয়ে আছে । তুলি গুটি গুটি পায়ে বিছানায় বসলো । তুলি ভেবেছিল আদনান ওর সাথে কথা বলবে। নিজের সম্পর্কে জানবে তুলির কাছে ওর পছন্দ অপছন্দ জিজ্ঞেস করবে কিন্তু অনেক্ষণ বসে থাকার পরও কিছু জিজ্ঞাসা করলো না।
” আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?”
আদনান কোনো প্রতিউত্তর করলো না । তুলি আবারো জিজ্ঞেস করলো –
” আপনি কি ঘুমিয়ে গেছেন?”
আদনান জেগে আছে তবু ও কোনো উত্তর দিলনা । তুলিকে তার বিরক্ত লাগছে । এমন বেয়াদপ কেন মেয়েটা!t
কোনো কথা যখন বলছে না তখন তো বোঝা উচিত ও কথা বলতে ইচ্ছুক না । তুলি আলতো হাতে আদনানের কপালে রাখলো নাহ জ্বর তো নেই । তবে চুল গুলো একেবারেই ভিজে এমন ভিজে থাকলে কালকে নিশ্চিত ঠান্ডা লাগে যাবে । তাই বারান্দায় গিয়ে টাওয়াল এনে চুলগুলো ধীরে ধীরে যত টুকু পারলো মুছে দিলো । আদনান দাতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে । কেউ ওর চুলে হাত দিক সেটা ওর কোনোকালেই পছন্দ না । কিন্তু কথা বললে কথা বাড়বে সেজন্য চুপ থাকলো ।
তুলি আদনানের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে শুয়ে পড়লো ।
রাত তিনটে কি চারটে বাজে আদনানের নাকে ফিমেল শাম্পুর গন্ধ হানা দিচ্ছে বারবার । চোখ খুলে তুলিকে তার বাহু আকড়ে ধরে থাকতে দেখলো । বিছানা জুড়ে ছড়িয়ে আছে ঘন কালো চুল। আদনান চেয়েও রাগ করতে পারলো না । এলেমেলো হয়ে থাকা শাড়ির জন্য শরীরের বিভিন্ন অংশ দেখা যাচ্ছে । খুব সাবধানে পাতলা চাদরটা দিয়ে গলা পর্যন্ত ঢেকে দিলো আদনান। বাইরে বৃষ্টির শব্দ শুনে জানালার দিকে তাকিয়ে রইল । ওই অবস্থায় কখন যে ঘুমিয়েছে জানা নেই ।
দরজায় কেউ জোরে জোরে থাবা দিচ্ছে । কার এত তাড়া! আদনানের ঘুমের বারোটা বেজে গেছে ।আর তুলি,,,,সে আরামসে ঘুমাচ্ছে । আদনান অবাক হয়ে তুলির দিকে তাকালো নিজের মনে মনেই বলে উঠলো কুম্ভকর্ণের মামাতো বোন!!!
” কি হয়েছে আম্মু সকাল সকাল এমন ভাবে অমর ঘরের দরজার পিছনে লাগছো কেনো?”
” তুলি না ফুলি ঘুম থেকে উঠেননি!”
” না ”
” ডেকে দে বিয়ে করে এসেছে ঘুমানোর জন্য নাকি…”
” আমি পারবো না ”
” সর তুই আমি ডাকতেছি”
লিতুন বেগম অত্যন্ত ফর্সা রাগ করলে দুই গাল লালচে হয়ে যায় । তখন অনেক ভয়ংকর লাগে দেখতে এখন তাকে খুব বেশি রেগে আছে বলেই মনে হলো আদনানের ।নিজের মনে এর কারণ খোঁজার চেষ্টা করলো ,,,তুলি তো কালকে এসেছে বাসায় তাহলে তুলির উপর রেগে আছে কেনো?! কোথাও যায়নি তো রুম থেকে তাহলে!অনেক খুঁজেও কারণ পেলো না আদনান । তুলির দিকে তাকিয়ে দাত কটমট করে চেঁচিয়ে উঠলো –
” এই মেয়ে ঘুম থেকে উঠো!! আশ্চর্য এই বেলা পর্যন্ত ঘুমানোর অভ্যাস নিয়ে সংসার করতে এসেছো!? গোসল করে নিচে আসবে পনেরো মিনিটের মধ্যে । অবশ্যই শাড়ী পরে ”
লিতুন বেগমের এহেন আচরণে খুব অবাক তুলি । নিজের বিস্ময় কাটিয়ে উঠে পড়লো পনেরো মিনিটের মধ্যে যদি নিচে না যেতে পারে তাহলে হয়তো আবার বকবে। আদনানকে দরজার কাছে দাঁড়ানো দেখেছিল কিন্তু পরে আবার কই গেলো কে যাবে । জলদি জলদি গোসল করে শাড়ীটা পরেছে । এতো কিছুর মধ্যে খুদা না লাগলেও এখন বেশ ক্ষিদে পেয়েছে তুলির । কেউ ওকে রাতে খেতে ডাকেনি । নিচে যেতে না যেতেই আদরির সাথে দেখা খুব সুন্দর ভাবে সালাম দিলো তুলি । আদরি একবার আর চোঁখে ওর দিকে তাকিয়ে রান্নাঘরে নিয়ে গেল ।
” আজকে থেকে তুমি রান্না করবে । আমাদের এইখানে বিয়ের পরেরদিন থেকেই রান্নার কাজ বউরা করে । আর আর হচ্ছে রাহেলা খালা আমাদের বাড়ি অনেক বছর থেকেই কাজ করে । তোমাকে কাজে সাহায্য করবে ”
তুলি অবাকের উপর অবাক ওদের গ্রামে কারোর বিয়ে হলে তিন থেকে চার মাস কোনো কাজ করতেই দেয় না । পরিবেশের সাথে মানিয়ে গেলে তারপর থেকে কাজ করে । তাও শহর এটা গ্রাম তো না । নিজের মনকে বুঝিয়ে রাহেলা খালার সাথে ভাব করে নিয়েছিল। যা যা রাধতে হবে সব রান্না দুইজন শেষ করেছে । তুলি গ্রামে থাকতে বিকেলের রান্নাটা করতো তাই রান্না করতে কোনো সমস্যা হয়নি । এরপর থেকে রান্নার কাজের পাশাপাশি যোগ হলো বাড়ির অন্য সব কাজ । যে দুইজন কাজ করতো তাদেরকে ছাঁটাই করে দিলো লিতুন। তার এক কথা এখন তো বউ আছে কাজের লোক দিয়ে কি হবে । রাহেলা লিতুন এই বাড়ীতে বউ হয়ে আসার আগে থেকে কাজ করতো তাই আর তাকে বের করা হয়নি । আদরি কিছুদিন পর নিজের সংসারে ফিরে গেলো । পড়ে রইলো তুলি যাকে দিয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করায় লীতুন । আর আদনান! তার সকল কাজও তুলি করে । তার শ্বশুর বেশিরভাগ সময় বাইরে কাটায় নিজের ব্যাবসার কাজে ব্যস্ত থাকে।
নিজের অতীত নিয়ে ভাবছিল তুলি । আদনানের পরিবারকে কত ভালবাসা দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা করেছিল কিন্তু তারাই কি সুন্দর ওকে তাড়িয়ে দিল । নিজের জন্য কষ্ট নেই নিজের বাচ্চা সে ত বাবা ছাড়া বড় হবে । যখন জানতে চাইবে তার বাবা কই তখন কি বলবে তুলি!
তুলি চলে গেছে । তবুও রাস্তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আদনান । নিজের মধ্যে কেমন আলাদা শূন্যতা অনুভব করলো । এই মেয়েটা কতভাবে ওর মনে জায়গা করার চেষ্টা করেছে । আর কেউ রাত বেরাত খেয়াল রাখতে ছুটে আসবে না । রাতে গোসল করে ঘুমালে চুড়ি চড়ি এসে ওর চুলগুলো মুছে দেবে না । চোখ দিয়ে এক ফোঁটা উষ্ণ জল গড়িয়ে হাতে পড়লো। হাতের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো ও কি তুলির জন্য কাঁদছে!!
আজকে ডাল রান্না করেছে রাহেলা। ডাল ছোটো থেকেই আদনানের খুব পছন্দের যখন তুলি শুনেছিল ডাল আদনান পছন্দ করে ,,ডাল রান্না করার সময় মন দিয়ে ভালোবাসা ঢেলে দিয়ে রান্না করতো । ডাইনিং টেবিলে বসে ডাল খেতে গিয়ে একেবারে পানসে লাগলো আদনানের । আদনানের চাচী সুরেলা নাম সুরেলা হলেও কখনো তার মুখে মিষ্টি কথা শোনা যায় না ।
” দেখলেন ভাবি কেমন মেয়ে গছিয়ে দিয়েছিল আম্মু! যার চরিত্রের ঠিক নেই । এমন ভাবে থাকতো দেখে মনে হতো ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না কিন্তু পরে কি শোনা গেলো!! পর পুরুষের সাথে ছি ছি ছি”
কথাটা শুনেই ধক করে উঠল আদনানের বুকটা । সবাই কি তুলিকে দুশ্চরিত্রা ভাবছে যেমনটা চাচী ভাবছে! অরোরার সাথে কথা বলতে হবে আদনানের খুব শীঘ্রই……
চলবে,,